লম্বা চেহারায় ছাই রঙের জিন্সের ফুল প্যান্ট। পায়ে স্নিকার। পকেটওয়ালা নীল টি-শার্টের বোতাম এঁটেই ঘরের চৌকাঠ ডিঙোয় ষাট-বাষট্টির কলেস্নাল, ‘বিদিশা এবার দরজাটা বন্ধ করো।’
আবাসনের এদিকটায় পিচঢালাই পথের দুপ্রান্ত ধরে পরপর বকুলগাছ বেশ লম্বা হয়ে দোতলা ছুঁইছুঁই! ফলে রাস্তায় পোস্টের আলো ডালে-পাতায় আটকে ওপরে সিঁড়ি-বারান্দাটা ঝাপসা-আঁধার। সেই আঁধারে মাথাভর্তি কোঁকড়ানো সাদা চুলে নিজেও খানিক আলো ফুটিয়ে বাইরে আসে। বাহান্ন-তিপ্পান্নতে ঘাড়, গলা টানটান চামড়ায় ফর্সা চোখমুখ বিদিশা চৌধুরী ম-লের। চুড়িদার পাঞ্জাবিতে বেশ ঢিলেঢালা। বাড়ির চটিসুদ্ধ দু-এক পা এগিয়ে মৃদু গলায় বলে, ‘সে কী গো? খালি হাতে, লাঠি নিলে না …?’
লম্বা চেহারায় শিরদাঁড়া সোজা। কাঁচাপাকায় টেরিকাটা চুল। দীর্ঘ নাসিকায় বড় চোখ মানুষটার। একবার বাঁ-পকেটে রুমাল, ডান পকেটে মোবাইল ছুঁয়ে বলে, ‘এই রে সব নিলাম, শুধু ওটাই ভুলে গেলাম? আবার জুতো খুলবো …।’ দুই মানুষের সংসার। সিঁড়িবারান্দা বেয়ে আফসোস কানে আসতেই বিদিশা বলে, ‘থাক, আমি এনে দিচ্ছি।’
গাছগাছালিময় রাস্তার দুপাশে ম্যাচ বক্স ডিজাইনের চারতলা করে কমপেস্নক্স পরপর ডানে-বাঁয়ে গিয়ে বিশাল বৃত্তাকারে এই আবাসন। তারই একটা টু বি এইচ কে ফ্ল্যাটে পকেট ফাইভে কলেস্নালবাবু আর বিদিশা। লোহার ফ্রেমে সরু নেট-লাগানো দরজাটা খুলে রেখে বিদিশা ঢুকে যায় ভেতরে। শু-বক্সের পাশে রাখা দেড় ফুটের মসৃণ রুল-বাড়িটা বের করতেই বেশ ওজন মালুম হয়। সেটা নিয়ে এগিয়ে দেয় কলেস্নালের দিকে, ‘ধরো।’
কলেস্নালবাবু ডান হাতে পাঁচ আঙুলে আঁকড়ে বাঁ-হাতে লোহার ফ্রেমের দরজা ঠেলতে ঠেলতে বলে, ‘মশা ঢুকে গেল বোধহয়? যা গাছপালা …’
‘কোনো পুরুষ ঢুকে যায়নি তো? ছোকরা পুরুষ, তুমি কিন্তু নিজ চোখে দেখে গেলে?’
‘তা আমি চলে গেলে, কেউ ঢুকতে পারে। তুমি মর্নিং ওয়াকে যাও, মার্কেটে যাও, আমি কি তোমাকে ফলো করেছি একদিনও?’
‘করে দেখতে, কেউ বারণ করেছে?’
তখন উলটো-দিকের রুমে দরজা খোলার শব্দ। বছরে দেড়েকের বাচ্চাটাকে বুকের ওপর নিয়ে আটাশ-ঊনত্রিশের তরুণী মা। সাদা লেগিংস হলুদ কুর্তি। বাচ্চা মেয়েটার গায়ে সাদা ফ্রকে সেলাইয়ের কারুকার্যে যেন সাদা গোলাপের পাপড়ি পরপর গাঁথা। কথা একটু দমে যায়। বিদিশা শিশুর টানে এগিয়ে হাত বাড়ায়, ‘ও বাবা মম … আমাদের মম বেড়াতে বেউ বেউ করতে যাচ্ছে …’
বাচ্চাটা সঙ্গে সঙ্গে কোল ঝাঁপিয়ে বিদিশার আকর্ষণে। তরুণী মা বলে, ‘আন্টি, আমরা একটু মেডিসিন স্টোরে …’
‘মম এখন ঠিক আছে?’
সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ায় তরুণী মা। কলেস্নালবাবু বাচ্চাটাকে একটু আদর দেখিয়ে হাসিমুখে সিঁড়ি দিয়ে এক ধাপ-দুধাপ নামতে থাকে। রাবার সোলে পা ফেলার ধুপধাপ আওয়াজ ক্রমে ক্ষীণতর হয়। সে-শব্দ শুনতে শুনতে লোহার ফ্রেমে দরজা টেনে পরে, ভারী কাঠের এক পাল্লা দরজা লক করে দিতেই নিজের দমে যাওয়া কথাগুলো এলোমেলো ডানা ঝাপটায়। বাইরে কোনো আবাসিকের চলন্ত গাড়ির হর্নের শব্দ। হঠাৎ মনে পড়ে : … আবাসনের কমিটি পরিচালিত সবজি, মুদিখানা দোকান বাচ্চাদের ক্যারাটে প্র্যাকটিস মাঠের ওপাশে। ভোরের আলো ফুটলে কিছু কিছু মানুষ তো তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ে শরীরের কলকব্জা ঠিক রাখতে। অযথা মেদ-শর্করা, কমাতে। আবাসন চত্বরে বৃত্তাকারে পাকা পথটা এক পাক দিলে তো এক-দেড় মাইল রাস্তা হাঁটার শামিল। আগুপিছু পড়শী ফ্ল্যাটের বউরা, অল্প বয়েসে ভারী স্বাস্থ্যবতী মেয়েরাও লেগিংস কুর্তি শাড়ির সঙ্গে জিন্স বারমুডা, গেঞ্জি গায়ে কিশোরী তরুণ-তরুণীরা হাঁটছিল। রাস্তার প্রান্ত ধরে আকাশমণি অমলতাস গাছের শাখা-প্রশাখা মাথার ওপর মৃদু দুলছে। সকালে সবজির গাড়ি ঢোকে দোকানটায়। দু-পাক দিয়ে বিদিশা সবজি দোকানে দাঁড়ায়। এক বান্ডিল সবুজ পেঁয়াজকলি কেনে। টাটকা পেঁয়াজকলির ডগা ব্যাগ ছাপিয়ে মাথা উঁচু। রঙিন চুড়িদার হাফ পাঞ্জাবি আর পা-ঢাকা জুতোয় যতই জোরে হাঁটে, হাতের সঙ্গে ব্যাগ দোলে। দোলে তো পেঁয়াজকলির ডগায় সাদা ফুলের জটা। পিচ খোয়ায় মসৃণ রাস্তা রেখে টু হুইলারের আওয়াজ ক্রমশ কাছে আসে।
নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে ঘাড় কাত করে পাশে তাকায় বিদিশা। তখনই গায়ের কাছে ব্রেক কষার কেরামতি। বাইকের বাস্কেটে কিছু গাজর, পেঁয়াজ, মেথিশাক। শাকের ডগায় না-ফোটা ফুল। পরণে ট্র্যাকস্যুট আর গায়ে স্ট্রাইপড টি-শার্ট। পকেটে মোবাইলটার আভাস। মাথার চুল খানিক হালকা। চোখমুখের ফর্সা রঙে তো আটত্রিশ-চল্লিশ। কামানো গাল। যুবকটি বলে, ‘ম্যাডাম আপনি কি পুরুলিয়ায় গার্লস স্কুলের মিস্ট্রেস?’
‘কেন বলুন তো?’ ব্যাগ হাতে থমকে দাঁড়ায় বিদিশা চৌধুরী ম-ল। কাঁধে সরু ফিতের ঝোলানো চামড়ার ব্যাগটায় চাবি, পার্স, মোবাইল। যুবকটির চোখের সামনে ওড়নাহীন দু-বুক বেশ প্রকট। মাথাভর্তি ঘন কোঁকড়ানো সাদা চুলের কারুকার্য যে কত মনোরম ও সম্ভ্রমের …!
‘আপনি যখন পেঁয়াজকলির দাম দিচ্ছেন, মনে হচ্ছিল একবার জেনে দেখি …’
‘তাই …! হঠাৎ পুরুলিয়া? আপনার বাড়ি ওখানে?’
‘একদম না। কোম্পানির কাজে বড়াবাজার টাউনে দু-তিনদিন ছিলাম …’ খানিক গন্ধ পেয়ে সেটা আপাতত লুকিয়ে বিদিশা বলে, ‘আমাকে সেখানে দেখেছেন। কোথায়, স্কুলে?’
‘না। ওই টাউনে বড় স্টেশনারি দোকানে …’
‘দোকানে সেলস গার্ল, নাকি মালিক … মালকিন …?’
‘তাও না, আমি কিনলাম সাবান, দাড়ি শেভ করার জন্য কিট। দেখলাম এক মহিলা’, বলে চকিতে আর একবার বিদিশার দিকে চোখ বুলিয়ে খানিক জরিপ করে নেয়, ‘প্রায় আপনার মতোই এক ভদ্রমহিলা স্যাভলন, হরলিক্স কেনার পর এইরে ভুলে গেছিলাম এক বাক্স চক পেনসিল আর দুটো বোর্ড ডাস্টার দিন। আমার বাড়িতে পিয়ন আসবে কাল। নিয়ে যাবে, এই দুটো আইটেমের আলাদা বিল দেবেন, দোকানের সিল, আপনার সই থাকে যেন।’
প্রায় সমঝে নিয়ে বিদিশা ফিক করে হেসে বলে, ‘আর একবার দেখুন তো আমি সেই কি না?’ এমন অনুরুদ্ধ হয়ে চোখ-মুখ-গা-বুকে নজর বুলোতে গিয়ে সামান্য বাধে, ‘মনে হচ্ছে আপনি, আবার মনে হচ্ছে আপনি নন …’
‘আমার কিছু বছর ছাড়াছাড়িতে দুই মাসতুতো বোন। ওই বোনটা ওখানে ঝর্ণাকুচি স্কুলে পড়ায়। সাঁওতাল … আদিবাসী ছেলেমেয়েরা খুব ভালোবাসে -’
কথা রুখে দিয়ে নিজেই শুরু করে ছোকরাটি, ‘ঝর্ণাকুচি …? দারুণ সুন্দর জায়গা। ছোট পাহাড়-গোড়ায় নীল জলাশয় … গাছগাছালিময় পাহাড় গা-ধরে সরু ঝর্ণাধারা … কাছেই ছোট গ্রামটায় গায়ে গায়ে ঘর। লেপাপোছায় মেটে দেয়ালে দেয়ালে ছবি আঁকা। কারো কারো পাকা দেয়াল টিনের ছাউনি বাড়িয়ে ঘরের ধারিতে ছায়া। ছোকরা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মোড়ল-মুরুবিবদের আড্ডায় গালগল্পের জায়গা …’
বছর দেড়েক আগে বোনের ইশকুলের গাঁয়ে মেম্বারের বাড়ি কদিন কাটিয়ে এসেছে বিদিশিরা। তাই সেই রাস্তাঘাট লাল মাটির ফসলহীন উঁচু টাঁড় চোখে ভাসছে …! নিজেও যেন ভেসে গিয়ে ঝর্ণাকুচির টিউ কলতলার পাথরে দাঁড়িয়ে …
‘ঠিক বলেছেন, মস্ত মাঠ কখানা মহুয়া পলাশ গাছ পরপর দাঁড়িয়ে …’
‘সেই মাঠে তো পাকা দেয়াল ছাদে স্কুলবাড়ি, দেখেছি দেখেছি …’
‘আদিবাসী ছেলেমেয়েদের মা-বাবারা খুব ভালোবাসে … সম্মান করে বোনকে, ও ভালোবাসার কাঙাল তো …।’ হুট করে বলে লজ্জায় পড়ে বিদিশা। পরক্ষণে ভাবে, ‘একজন মেয়েকে ভালোবাসার কাঙাল বলা কি ঠিক হলো …!’
এই কথার পর বাইক থেকে যুবক, বিদিশার চোখের সামনে পুরুলিয়ায় বোনের কোঁকড়ানো সাদা চুলের পাটাসিতে ফর্সা উজ্জ্বল মুখটা দেখে। আবার সে-মুখ সরে গিয়ে বিদিশার মুখ, চোখের আওতায়। একদম সামনে মাথা বিছিয়ে ঘন কোঁকড়ানো চুলের ঢেউ। মুখের মধ্যে দিয়ে মানুষ, না মানুষের মধ্যে মুখ … কোনটা মেলাতে চায় মানুষ …।
বাইকে গুছিয়ে বসে যুবকটি, ‘আচ্ছা, এই কমপেস্নক্স যখন, দেখা হবে।’
‘তাই তো? কোন পকেট?’
‘সেভেন। বস্নক সি এইটটি এইট’, বলে বিদিশার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
বুকে মৃদু পাক মারলেও মুখে বাধে। ভাবে বিদিশা, … কলেস্নাল সঙ্গে নেই, সদ্য এমন আলাপে বাড়ির নম্বর ঠিকানা বলা ঠিক হবে?
দুধ দই ঘিয়ের বোতল ডেলিভারি দিয়ে, খালি ক্যান ট্রে নিয়ে পেছনে মাদার ডেয়ারির কনটেইনার গাড়িটা। ঝনঝন ধাতব শব্দ। একবার পেছনে তাকিয়ে বাইক নিয়ে ধারে সরে এসেই স্টার্ট দেয়। আওয়াজ করে বেরিয়ে যায়। বাতাস বেয়ে দুকানে সে-আওয়াজ অনেকক্ষণ বাজে …। গায়ের পাঞ্জাবি চুড়িদার কাঁপে। পা ফেলে এগোয় বিদিশা। হাতের ব্যাগ দোলে। পেঁয়াজকলির বান্ডিল দোল খেতেই বিদিশার বুকের মধ্যে নড়ে ওঠে, ‘ওই ছোকরা … যুবক … এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা বলল, আমার … না, বোনের সঙ্গে …।’
মনটা সেঁতিয়ে যেতেই সেদিন সকালে পায়ের গতি ধীর …! গাছের বাসি ফুল ঝরে রাস্তায় শুকনো জঞ্জাল। সেসব পাড়িয়ে তো এগিয়েছিল বিদিশা …।
… ভাবতে ভাবতে কখন যে দোতলায় জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে, খেয়াল করেনি। আবাসনে গ্রিলের গায়ে স্টিলের ফ্রেমে জানালা। কাচ বসিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা, রোদ জলো হাওয়া আটকায় সেই ধাতব পাল্লা। জানালার ওপারে ক্যাম্পাসের পার্ক, বাতিস্তম্ভের গায়ে আলো। হালকা হাওয়ায় বোতল ব্রাশ গাছের পাতা শিরশির করে কাঁপে। তখন মোবাইলে, কলিং টোন …। হাতে নিয়েই দেখে ভিডিও কল। তাড়াতাড়ি আঙুল টাচ করতেই ওপারে পুরুলিয়া থেকে মুখটা ভেসে ওঠে, ‘কী রে বিকিদি, কী করছিস?’ বলে কপালে কোঁকড়ানো চুলের ঝুরিটা সরায়।
‘উঁ? তেমন কিছু নয়রে আজ একটু -, তুই স্কুল থেকে বোধহয়?’
‘আজ তো রোববার রে দিদি?’
‘ইস …। সরি …’
‘কলেস্নালদা কোথায়?’
‘হাঁটতে গেছে। যেমন যায় …, এই কণিকা তোর মনে আছে, আমাদের কমপেস্নক্সে আমাকে দেখে এক আধবুড়ো ছোকরা তোর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিল …?’
‘হ্যাঁ … হ্যাঁ। আজ আবার তোকে ধরেছিল নাকি রে দিদি? আমার কথা জানতে চাইল?’
‘না, তা নয় তবে আমার …’
দিদিকে আটকে দিয়ে হুটপাট শোনায়, ‘আমি ডিভোর্সি, তুই বলেছিস নাকি?’
‘কেন বলতে যাব অযথা?’
‘দিদি, ওই আধবুড়ো ছোকরা কি ডিভোর্সড ক্যান্ডিডেট …?’ হঠাৎ নেট লিঙ্ক অফ হতেই স্ক্রিনে অন্ধকার …

দুই
বিল্ডিংগুলোকে আগলে মোটোরেবল কালো পিচ রাস্তাটা মস্ত আবাসন পরিসরকে বৃত্তাকারে ঘিরে আছে। ফাগুনের ফুরফুরে হাওয়া। আবাসন কমিটির গাছগাছালির শাখা-প্রশাখা মৃদু দোলে। দোলে তো শাখাপাতার ছায়া এ-রাস্তায়। ভারী সোলের স্নিকার পায়ে যত এগোয় কলেস্নাল ম-ল, হাতে দেড় ফুটি রুল-বাড়িটা পদক্ষেপের সীমায় সামনে-পেছনে রেখা কাটে অন্ধকারে। সে-রেখা তো মুছে মিলিয়ে রাতের আঁধার আগের মতো …। হাঁটতে হাঁটতে দু-নম্বর গেটের কাছে জুতোয় ঢাকা পা তুলতে ভারী বোধহয়। সেই ভারী মুখ সিসিটিভিতে গেঁথে যায়। দু-পাল্লা লোহার গেট পরিসর বেশ খানিক উঁচু হয়ে পাথুরে চড়াই, তখন একবার পিছনে তাকায়, ‘কই সঙ্গী … বন্ধুরা এলো কোথায় …।’
সাবধানে পা ফেলে। তারপর থেকে রাস্তা তো ক্রমে ঢালু হয়ে বাঁয়ে সমতলে মিশেছে। হাতের লাঠি দোল খেতেই গাড়িবারান্দা থেকে চার-পাঁচটা কালো লালচে তাগড়াই কুকুর ঘেউ ঘেউ চেঁচিয়ে কাছে আসতে চায়। কলেস্নালবাবু পাঁচ আঙুলে শক্ত করে আঁকড়ায় লাঠিটা …। এ-মুহূর্তে একবার পেছনে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে, হাঁটার সঙ্গীদের কেউ কি পেছনে আসছে …! সেটুকু উদ্যোগ নেওয়ার আগেই পাশের বিল্ডিং … ক্রমে তার পাশের বিল্ডিংয়ে গাড়িবারান্দায় বেওয়ারিশ কুকুরগুলো চিৎকারে যোগ দেয়। দেয়াল পিলারের কোণ থেকে একদঙ্গল কুকুর ছুটে এসে ঘিরে ধরে। কলেস্নালের
কপাল-গলায় বিন-বিন ঘাম। বুকের গেঞ্জি ভিজতে শুরু করে। দুটো কুকুর আরো গায়ের কাছে আসে। কলেস্নালবাবুর সারা শরীর কাঁপতে থাকে। মাথার মধ্যে চকিতে পাক খায়, … কমিউনিটি হল। ঢোকার মুখে হলুদ বোর্ডে লেখা, ‘ইউ আর আন্ডার সারভেইল্যান্স অব সিসি ক্যামেরা।’ জিন্সের ওপর সাদা গেঞ্জি গায়ে থলথলে চেহারায় ফর্সা। বব ছাঁটে সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ বছর বয়েসি মহিলা। ধোঁয়া-কষের দাগ সাদা দাঁতে। ঠোঁট চড়া লাল। গোলগাল মুখে বক্তৃতা, ‘অ্যানিম্যাল ক্রুয়েল্টি … আর এসপিসিএ … ওয়েলস … ইংল্যান্ড। … আওয়ার ভিশিওন ইজ টু লিভ ইন এ ওয়ার্ল্ড হয়ার অল অ্যানিম্যালস আর রেস্পেক্টেড অ্যান্ড ট্রিটেড উইথ কমপ্যাশন …।’ সঙ্গে সঙ্গে ভারী চেহারায় কালো লোম, লালচে চোখে লেজকাটা কুকুরটা মুখ তোলে। লাঠি তাক করে, জোরে ঘেউ ঘেউ ডাক ছাড়ে …
পাশাপাশি বিল্ডিংগুলোয় রাস্তামুখো ব্যালকনি ওপর-নিচে। মা মেয়ে বউ বাচ্চাদের মিলিত চিৎকার ‘ডগ … ডগি কাট দেগা … আরে সেভ হিম … সেভ হিম …’
বাড়িতে সিভিল সার্ভিস, আর্মি সিলেকশন পরীক্ষার চ্যাপ্টার নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল কজন তরুণ। সে-চিৎকার তাদের কানে যেতেই পড়ার টেবিল ছেড়ে ব্যালকনি থেকে মুখ বাড়ায়। বারমুডা আর এক্সারসাইজ গেঞ্জি গায়ে লাঠি উইকেট হাতড়ে লিফটের বোতাম টেপে। লাল আলো ঠিকরোতে বুকে দাঁত ফোটে, ‘এইরে আঙ্কেল কে বাইট করল নাকি বাই দিস টাইম …!’
মানুষটির এমন বনিদদশা দেখে দু-নম্বর গেট থেকে নীল শার্ট-প্যান্টে এক সিকিউরিটি হাতপাঁচেক লম্বা লাঠি নিয়ে ছুটে আসে …। কালো বুটজুতোর খটমট শব্দ খোয়া পিচঢালাই রাস্তার চামড়া ভেদ করে তলার মাটিতে। যে-মাটির নিচে শুয়ে আছে নাম … চেহারায় দাগ-খতিয়ানের শিরা-স্নায়ুর সীমারেখা হারিয়ে চার-পাঁচ থানা গ্রাম …। কত কবরস্থান, শুকনো পুকুর ঘাট, বেলতলায় শিবস্থান, গোয়াল … গরু-বাছুর বিড়াল-কুকুরের হাড়গোড় যে …।

তিন
পকেট ফাউভে বস্নক বি-র দোতলা। ফ্লেক্সিবল খাট, মোটা ফোমের আরামদায়ক বিছানা। পাথর-বসানো ডাইনিং টেবিল। ওয়াশিং মেশিন, দেয়াল টিভি, সেগুন কাঠের সোফাসেট। দামি শোপিস সাজানো, পাশে পারিবারিক ছবি বাঁধিয়ে বসানো কাঠের আলমারি। ড্রয়িংরুমের দেয়ালে সমুদ্র-বাঁধানো …। ঘড়িটায় গোলাকার ডায়ালে সেকেন্ডের কাঁটা টিকটিক শব্দে বাজে …! প্রতিটি মুহূর্তকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগোয় …। সাদা ধবধবে বিছানায় ফুলকাটা ওয়াড়ে ঢাকা বালিশ দুখানা। গায়ের কাছে মানুষটি পাশ ফিরতেই, আধোঘুমে বিদিশা উঠে বসে, ‘কী গো? এখন তো ভোর পাঁচটা হতে যায় … চা করব?’
‘উহ্? রাতে তোমার ঘুম হয়নি। আমাকে নিয়ে ঝামেলা গেল … থাক …।’ বিদিশার কোলের দিকে মুখটা কোমর, বুকের অনেকখানি নিয়ে আসে কলেস্নাল। রাতের নাইটি এলোমেলো হয়ে হাঁটু, পায়ের গোছে যেন এখন চল্লিশ-বিয়াল্লিশের আলগা ফর্সা ত্বকে বিদিশা। শক্ত চেহারায় বাষট্টির পুরুষ। তার মুখে গত রাতে ধস্ততার ক্ষীণ ছাপ।
মানুষটার মাথার চুলে আঙুল গলিয়ে বিলি কাটে, ‘কী আর …! ডাক্তার ত্যাগীকে ফোন করতেই বলল, সকালে যে-ট্যাবলেট খায়, সেটাই এখন খাইয়ে দিন, হাইপার টেনশন রোগী তো? প্রেসার ডাউন করবে -, যাক একটু চা করি?’
‘থাক, মৌসুমি এসে করবে’, বলেই বিদিশার কোলে মাথা সেঁধিয়ে দেয় বাষট্টির কলেস্নাল।
নিজেকে একটু ছড়িয়ে বসে বিদিশা, ‘মৌসুমির তো প্রথম বাড়িটা সেরে আসতে বেলা হবে।’
‘হোক…’, বলে মাথাটা ডানে-বাঁয়ে সরিয়ে জুত পায় না।
‘কাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যায় হসপিটালে ডক্টর ত্যাগীর চেম্বারে …’, বলেই কোন ভরসায় যে পকেট সেভেনের সি এইটটি এইট … বাইকে ছোকরামুখ ক্ষণিকে ভেসে উঠল নিজের পুরুষের পাশে নিঃশব্দে …!
কথাগুলো কানে আসতেই মুখটা সোজা করে বলে, ‘সেক্টর আঠারো … বাবলীকে ফোন করোনি?’
‘তোমার মেয়ের মেয়ের টেনথ ক্লাসে ফাইন্যাল ম্যাথ একজাম … হলে নিতে যাবে ওই সময়ে।’
‘রাতুল?’
‘জামাই মেশিন ইনস্টল করছে কেরলে …’
বিদিশার মুখের খাঁজে … রেখায় তো উত্তর ফুটে ওঠে …। কলেস্নাল এপাশ-ওপাশ গাল পেতেও ঠাঁই পায় না। বিদিশার নাইটি আবরণে ঊরু-জঙ্ঘা … যোনিভূমি …! বড্ড জোরে শ্বাস ফেলতেই বুক খালি।
শ্বাসাঘাতে ঝলসে যায় বিদিশার ঊরু, থাই। কলেস্নালের মুখ দু-হাতের আওতায় নিয়ে ঝাঁকুনি দেয়, ‘কী গো …?’ ছাদ মুছে ফাঁকা আকাশ কলেস্নালের চোখে। বিড়বিড় করে, ‘… আর একটা … আমরা যদি তখন আর একজন …’
‘ততো জোর করোনি তো …’
উঠে বসে কলেস্নাল, ‘বলেছিলে, থাক, বাবলীকে ভালোবাসায় টানাটানি পড়বে …’
উত্তর দিতে গিয়ে বিদিশার গলায় স্বর জড়িয়ে যায়। নত চোখ। বাবলীকে উপচে বরং বুক মুচড়ে ভারী চোখে বিদিশার সামনে ভাসে শিশুমুখে মম … আরো মম-মুখ …