ডন : তাকে ভালো লাগে হাওয়া কল আর অলীক ঘোড়সওয়ারের খোয়াবনামা

চেতনার নতুন নাটক ডন : তাকে ভালো লাগে। ঠিক টক অব দ্য টাউন না হলেও ২০১৮ সালে কলকাতার প্রসেনিয়াম থিয়েটার যে গুটিকয় নাটককে সামনে রেখে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারে, তাদের দলের সামনেই থাকবে এ-নাটক।

মাসছয়েক ধরে এই নাটক অভিনীত হচ্ছে। রেওয়াজমাফিক ঢক্কানিনাদ সহযোগে এবং হাউজফুল অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসসমেত ইতিউতি। বছর তিরিশ-চলিস্নশ আগে যখন অ্যাকাডেমিতে হপ্তায় একটি দিন চেতনার জন্য বাঁধা ছিল এবং মারীচ সংবাদ, জগন্নাথ এর টিকিটের জন্য আকুলিবিকুলি চলত, বছরবিশেক আগে যখন এই অ্যাকাডেমিতেই চেতনার তিস্তা পারের বৃত্তান্ত মঞ্চস্থ হতেই বামপন্থি রাজনৈতিক দলের তাঁবে থাকা পশ্চিমবঙ্গের
সংস্কৃতি-অঙ্গনে বেমক্কা ফাটল দেখা দিয়েছিল, সেই অ্যাকাডেমিতে পুরোদস্ত্তর ডানপন্থি রাজনৈতিক দলের নজরবন্দি থাকা ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে ডন : তাকে ভালো লাগে যে সাড়া ফেলছে এবং ক্ষমতাতন্ত্রের চোখে চোখ রেখে বুক ঠুকে প্রতিস্পর্ধী স্বরকে জাহির করতে পারছে সেটা অবশ্যই একটি ঘটনা। আরো তাজ্জব কি বাত হলো, আজ থেকে তেইশ-চবিবশ বছর আগে এই একই নাটক যখন দুখীমুখী যোদ্ধা নামে মঞ্চস্থ করেছে চেতনা, তখন একেবারেই লোক হয়নি। সেই শরম কি বাত আজকের পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহের মৌতাতে কিঞ্চিৎ লঘু হচ্ছে। এও এক ঘটনা বইকি।

বস্ত্তত ডন : তাকে ভালো লাগে একটি ঘটনাবহুল নাট্য প্রযোজনা। এ-নাটকের শুরুতেই যে-প্রেক্ষাপট রচনা করেন নির্দেশক সুজন মুখোপাধ্যায়, তা বর্তমান ভারতে রাষ্ট্রের সঙ্গে সিভিল সোসাইটির লড়াইয়ের ময়দান। ক্রমম্রিয়মাণ বঙ্গনাটমঞ্চ আজো এ-লড়াইয়ে আছে তাহলে!

একটু খোলসা করা যাক। কিঞ্চিৎ জগঝম্পসহযোগে প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে সার্চলাইটের দাপাদাপির পর পর্দা উঠতেই দেখা যাচ্ছে একটি কয়েদখানা। ওহ্! ওই সার্চলাইট তবে এই কয়েদখানার দোসর। আচ্ছা! আরো নড়েচড়ে বসতে হয় যখন আলো পড়ে গরাদের ওপর। গরাদের আড়ালে মানুষের মুখ নেই। সব মুখোশপরা জানোয়ার। মানে? এও কি এক পশুখামার? আবার গরাদের ওপর একেলে সব সাইনবোর্ড। কোনোটায় মিলিটারি এনকাউন্টারের ইশারা, তার ওপরে-নিচে লেখা ‘রেসট্রিকটেড এরিয়া, নো এন্ট্রি’। আরো খুঁটিয়ে অন্যান্য সাইনবোর্ড দেখলে বোঝা যাবে সার্ভেইল্যান্স সোসাইটির চাপা আন্দাজ। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার তলায় ‘ইউ আর আন্ডার সিসিটিভি সার্ভেইল্যান্স’ না লিখে খচিত হয়েছে ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ’। তা এই বিগ ব্রাদারটি কে? নরেন্দ্র মোদি? না ডোনাল্ড ট্রাম্প? এর দুপাশে আরো দুটি সাইনবোর্ড। একটিতে চলতে মানা, অন্যটিতে একটি মুখব্যাদানরত শ্বাপদের বুকের ওপর দিয়ে চলে গেছে লাল বারণরেখা। এই শ্বাপদ কি তবে মাইনে বাড়ানোর ন্যায্য দাবিতে সোচ্চার পশ্চিমবঙ্গীয় সরকারি কর্মীদের প্রতীক? ওই বারণরেখা কি তাদের ঘেউ ঘেউ করার প্রতিষেধক? এই তো সেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এরই জন্য তাদের দুষেছিলেন। আরে! ডন : তাকে ভালো লাগে দেখছি কাউকে ছেড়ে কথা বলার বান্দা নয়! আমাদের চাঞ্চল্য বাড়ে। সেই কবে ১৯৬০ সালে সলিল চৌধুরীর কথায় মার্চিং টিউনের সুরে মনে মনে গুনগুন করে ওঠেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য : ‘এইটুকু এই জীবনটাতে/ হাসতে মানা/ চলতে মানা/ কথাটিও কইতে মানা/ এই মানায় ভরা জীবনটা/ কেমন করে কাটাব/ তা নেই জানা।’

বলতে বলতে গরাদের ওপর ভাসমান এক অশোকস্তম্ভের ওপর আলো পড়ে। মানে পুরো অশোকস্তম্ভ নয়, সারনাথে মৌর্য সম্রাট অশোকের আমলের পাথরের থামের ওপর যে লায়ন ক্যাপিটাল স্বাধীন-সার্বভৌম ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতীক, সেই প্রতীকের ওপর আলো পড়ে। আলো যত প্রখর হয়, তত প্রবল হয় এর ব্যঞ্জনা। আরে! এখানে আবার কেশরফোলানো সিংহের বদলে শিংওয়ালা গরুর মুখ দেখা যাচ্ছে। তাতে আবার রক্তের ছোপ পড়েছে। আর কতক ক্রুশের মতো ঘাড়ে করে সেই ‘অশোকস্তম্ভ’ নিয়ে ডিপ সেন্টারস্টেজে যিনি দাঁড়াচ্ছেন তিনি শুভময় দত্ত (সুমন মুখোপাধ্যায়)। তিনি একা নন। একজন অনুচর তাঁরও আছে। সত্যজিৎ মিশ্র (সতীশ সাউ/ সুজন মুখোপাধ্যায়)। পাবলিক ট্রায়ালের তোড়জোড় শুরু হতেই জানা যাচ্ছে রাষ্ট্র ও ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্নাতীত আনুগত্য না দেখানোর দায়ে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বয়ে আনা ওই বস্ত্তটির পরিচয় জানতে চাওয়ায় তেজি জবানে তিনি জবাব দিচ্ছেন যে, সেটি ‘শোকস্তম্ভ’। একবার নয়, দুবার।

অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস হেসে কুটিপাটি হচ্ছে। যে-দেশে রাজধর্ম আর আগ্রাসী ‘হিন্দুত্ব’কে একাকার করে দেওয়ার উদ্যোগ চলেছে, যে-দেশে যে-কোনো ধরনের প্রতিবাদী কণ্ঠকে আলটপকা দেগে দিয়ে টুঁটি টিপে মারার আয়োজন চলেছে, তৎসত্ত্বেও যে-দেশের সংস্কৃতিচর্চায় বহুস্বরের ফিসফিসানি কান পাতলেই শোনা যায়, ডন : তাকে ভালো লাগে তেমন দেশের আয়নামহল হয়ে উঠছে। যখন জানা যাচ্ছে এই শুভময় দত্ত আদতে নাটক করেন ও তাঁর তোরঙে মোটের ওপর নাটকের সাজসরঞ্জাম বোঝাই করা আছে, যখন বোঝা যাচ্ছে টিনের তলোয়ারের প্রতি তাঁর বিশেষ আসক্তি আছে, যখন তাঁর মুখে শোনা যাচ্ছে ইদানীংকালে ভারত জুড়ে নৃশংসভাবে কতল হওয়া সিভিল সোসাইটি অ্যাকটিভিস্টদের নাম, তখন এ-নাটকের রাজনীতি নিয়ে আমাদের মনে আর কোনো সংশয় থাকছে না। যে-চেতনা ১৯৭২ সালে তার জন্মমুহূর্তে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের খবরদারিকে কচুকাটা করতে বসে তখন পর্যন্ত দেশের ওপর জাঁকিয়ে থাকা সামন্ততন্ত্র আর মৌলবাদকে ছেড়ে কথা বলেনি, সে-চেতনা যে মাঝবয়সে পৌঁছে চারদিকে ছক্কা-পাঞ্জার আবহাওয়ায়ও তার কবজির জোর ধরে রেখেছে, এ বড় আশ্বাসের কথা।

যে-সূচনাপর্ব তার জাত চেনাচ্ছে, সেটি ফুরোতেই মূল নাটকে ঢুকে পড়ছে ডন : তাকে ভালো লাগে। নাটকের মধ্যে নাটক। সেটি ম্যান অব লা মাঞ্চা। এই প্রযোজনার প্রবেশপত্র, পুসিত্মকা সব জায়গাতেই ডেল ওয়াসারম্যানের ম্যান অফ লা মাঞ্চার স্বীকৃতি আছে। ম্যান অব লা মাঞ্চা হলো মিগেল দে সেরভানতেসের আশ্চর্য আখ্যান দন কিহোতেকে আকর ধরে পুষ্পেপল্লবে সম্প্রসারিত  এক নাটক, পশ্চিমের থিয়েটারে যাকে মিউজিক্যাল বলে। ডন : তাকে ভালো লাগে তারই অনুসারী। সেরভানতেসের চারশো বছর আগেকার এই আখ্যান থেকে ডেল ওয়াসারম্যানের এই নাটক ১৯৬৫ সালে ব্রডওয়েতে হইচই ফেলেছিল বলে জানা যায়। তারপর থেকে নয় নয় করে চারবার ম্যান অব লা মাঞ্চার সগৌরব প্রত্যাবর্তন ঘটেছে ব্রডওয়েতে। ওয়েস্ট এন্ডে দাপিয়েছে। দেশ-বিদেশে সাড়া ফেলেছে। থিয়েটার থেকে সিনেমায় এসেছে পিটাল ও’টুল-সোফিয়া লরেনদের নিয়ে।

১৯৯৪ সালে এই নাটকেরই বাংলা তরজমা মঞ্চস্থ করেছিল চেতনা। দুখীমুখী যোদ্ধা নামে। অরুণ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদ ও প্রয়োগে সে-প্রযোজনা যতটা নাড়া দিয়েছিল বোদ্ধাকুলকে, তার ছিটেফোঁটা সাড়া ফেলেনি সাধারণ দর্শকদের মধ্যে। এমনিতেই হিস্পানিক সংস্কৃতির সঙ্গে অ্যাংলোফোন সংস্কৃতির অনেক তেলেজলে আছে। ইয়োরোপ-আমেরিকায় দন কিহোতে নিয়ে যে অপার মুগ্ধতা, যা বয়ান হয়েছে শোপেনহাওয়ার, কিয়ের্কেগার্দ থেকে পিকাসো, চে গোয়েভারার লেখালেখিতে, আমাদের মধ্যে তার লেশমাত্র নেই। তাছাড়া কর্তার ভূত আমাদের প্রসেনিয়াম থিয়েটারের ঘাড়ে এমনভাবে ভর করে থাকে যে, মামুলি ছকের বাইরে বেরোলেই ছাঁটাই হওয়ার আশঙ্কা থাকে, যার সবটুকু বুঝি না তাকে দুর্বোধ্য বলে দেগে দিতে আমাদের বাধে না। দুখীমুখী যোদ্ধার বেলায় এমনই কিছু হয়ে থাকবে। ওই ‘ব্যর্থতা’র বছরদশেক বাদে অরুণ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘যে কোনো শিল্পের রস গ্রহণের ক্ষেত্রে সবকিছু বুঝতে পারাটা যে কখনও কখনও প্রমাদ ঘটায় তার একটা দৃষ্টান্ত হিসাবে গণ্য হতে পারে এটা।’ তবু কেন লড়েছিলেন? অরুণের সাফাই ছিল, ‘ওই সময় দুখীমুখী যোদ্ধা নাটকটি নির্বাচন করার সব থেকে বড় কারণ ছিল সমাজতান্ত্রিক শিবিরে বিপর্যয় এবং ভাঙনের ফলে মানুষের মনে যে এক ধরনের বিভ্রান্তি এবং হতাশা দেখা দিচ্ছিল – দন কিহোতেকে সামনে এনে স্বপ্নটাকে জাগিয়ে রাখার বার্তা শোনাতে চেয়েছিলাম। কোনো পরিস্থিতিতেই যে মানুষটা হার মানতে চায় না – শেষ পর্যন্ত লড়াই জারি রাখাটাকেই যে বেঁচে থাকার শর্ত বলে মনে করে তাকেই তুলে ধরতে চেয়েছিলাম – ‘স্বপ্ন অসম্ভবকে স্বপ্নে ধরা’র সংকল্প যার মধ্যে চিরজাগরূক। ‘তারাকে ছোঁয়ার আশা’ তাকেই তো মানায়। মৃত্যুশয্যাতেও যে খাড়া হয়ে দাঁড়ায় লড়াইয়ের পতাকা অন্যদের হাতে তুলে দিতে।’

যে ‘তারাকে ছোঁয়ার আশা’র কথা তুলেছিলেন অরুণ, তা আসলে ছিল দুখীমুখী যোদ্ধার ধুয়ো। ওই নাটকে ‘দ্য ইমপসিবল ড্রিম’ নামে যে-গানটি ইতোমধ্যে কিংবদন্তিপ্রতিম তারই আক্ষরিক বাংলা তরজমা করেছিলেন সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটি ডন : তাকে ভালো লাগেরও ধ্রম্নবপদ। তুমুল নাটকীয়তায় গড়া, বাজনার হরেক কারিকুরিতে ঠাসা, গিটারের কর্ড প্রোগ্রেসনের গতে বাঁধা এই গানটির বারোআনাই অক্ষরে ধরা পড়ে না। অধরা থাকে তার জাদুকরী ঘোর। তবু সমালোচনার সূত্রে তা স্মরণ করা যেতে পারে :

স্বপ্ন অসম্ভবকে স্বপ্নে ধরা

অদম্য কোনও শত্রম্নর সাথে লড়া

অসহন যত দুঃখকে বুকে নিয়ে

যে অসম দেশে বীরেরাও যেতে ত্রস্ত

সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়া।

শোধরানো সব শোধন-অতীত ভ্রান্তি

দূর থেকে যেন পুজোর মতন তোমাকেই ভালোবাসা

ক্লান্তিতে ভারী দুই বাহু নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে তবু

সেই কতদূরে, নাগাল পেরিয়ে ফোটা

তারাকে ছোঁয়ার আশা

সেই তারাটিকে খুঁজে খুঁজে ফেরা সেই

তো আমার খোঁজা।

না থাকুক আশা হোক যত বেশিদূর

প্রশ্ন না করে বিরতিবিহীন, সঠিক কারণে বোঝা

নরকে পথে যাওয়া –

মাটিতে নামেতে স্বর্গের মায়াপুর।

পৃথিবীও হবে সুন্দরতর, একটি মানুষ শুধু একা

বিক্ষত হয়ে যদি লিখে যায়, রক্তরঙিন ভাষায়

শেষ যুদ্ধের ইতিহাস, নিয়ে শেষ সাহসের কণা

যদি রাখে তবু, নাগাল পেরিয়ে ফোটা

তারাকে ছোঁয়ার আশা।

যে-গান অনায়াসে কোনো লড়াকু মানুষের এফিটাফ হতে পারে, সে-গান যখন নাটকের শেষে সবার বুকে যখন বারুদের মতো উশখুশ করে, তখন তার জোর টের পাওয়া যায়। আড়াই ঘণ্টার ডন : তাকে ভালো লাগের পর এমনটিই হচ্ছে।

নবকলেবরে এ-নাটকের মঞ্চায়নের ঠিক আগে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে নির্দেশক সুজন মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘চারপাশের বন্দিদশা, ধর্মীয় উন্মাদনা, জাতের নামে বজ্জাতি, সেন্সরশিপ সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে তারাকে ছোঁয়ার আশা দেখানো ডনের পক্ষেই সম্ভব।’ চিমত্মাসূত্রে বাপবেটার যে-সামঞ্জস্য সেটি ডন : তাকে ভালো লাগের অন্ধিসন্ধিতে স্পষ্ট হয়েছে। ডন সম্পর্কে সুমন মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘চরিত্রটি লোভনীয়, রীতিমতো আইডেন্টিফিকেশন হয়, স্প্যানিশ ভাষায় তার নাম দন কিহোতে। ডনের অলীক সব ব্যাপারস্যাপার উসকে দিয়েছে লুকোনো অন্তর্ঘাতী চেতনা, খুঁড়ে বের করেছে চাপাপড়া পালটে দেওয়ার স্বপ্ন, ঠেলে দিয়েছে লড়াকু অভিযান, ভাবনায় ঘটিয়েছে বিপ্লবী বিস্ফোরণ। তবুও তাকে আটকে রাখা যায়নি মানুষের গড়ে তোলা সেইসব কারাগারে, যেখানে চিমত্মার শাসন হয়, বা মুক্ত ভাবনাকে একঘরে করা হয়।’

এমন নাটকের মধ্যে গোলগাল গপ্পো? সে গুড়ে বালি। কারণ দন কিহোতের মতো ডন : তাকে ভালো লাগেও এক অনেকান্ত আখ্যান। এক চোখ দিয়ে দেখলে এ-নাটক ওই কয়েদখানার একুশে আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহী শুভময় দত্তর বিচারসভা। গভর্নরের (অমিতাভ ঘোষ) এজলাসে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য একটি নাট্যাভিনয়ের বন্দোবস্ত করছেন শুভময়। সাঙাত সত্যজিৎ তাঁর স্টেজ ম্যানেজারের কাজ সারছেন। অভিনয় করছেন কারা? ওই কয়েদখানার হরেকরকম আসামি। কারো মাথায় হাত বুলিয়ে, কাউকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, কাউকে উসকে দিয়ে, কাউকে নিবিয়ে দিয়ে আলোনসো কিহানা ওরফে দন কিহোতের গপ্পো ফাঁদছেন শুভময়। কথা সরিৎসাগর বা ডেকামেরনের ধাঁচে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা এক আখ্যানবিশ্বে নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের। রয়েসয়ে। চেনাচ্ছেন মধ্যযুগীয় নাইটদের। তারপর মাথায় চড়াচ্ছেন শিরোস্ত্রাণ, গায়ে পরছেন বর্ম, হাতে তুলছেন বল্লম। স্যাঙাত সানচো পানসাকে জুটিয়ে এক কয়েদিকে ঘোড়া (বিউটি দাস), আরেক কয়েদিকে খচ্চর (অস্মিতা ঘোষ) সাজিয়ে ‘আমি যে আমিই দন কিহোতে’ গাইতে গাইতে নাচতে নাচতে ভোল বদলে দিচ্ছেন রঙ্গমঞ্চের।

এই ভোলবদলে তাঁদের সহায় হচ্ছে সুদর্শন চক্রবর্তীর ছকে দেওয়া নাচের বিভঙ্গ। সহায় হচ্ছেন একদল বাজনদার যারা প্রসেনিয়ামের উইংস বরাবর একটি হারমোনিয়াম, একটি দোতারা, দুটি গিটার, বেশকিছু ড্রাম বাজিয়ে এ-নাটককে সাজাচ্ছেন। তাদের জুটিয়ে সুরের দেশ-বিদেশের সাম্পান ভাসাচ্ছেন প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়। কখনো হিস্পানিক সভ্যতার রং লাগছে তাতে। গির্জার প্রার্থনাসংগীতের গেরামভারি চাল ফুটছে কখনো, তো কখনো মদালসা ছন্দে আরবি ধুন বাজছে। কাওয়ালি আর কীর্তন চলেছে হাত ধরাধরি করে। এসব গানের সুর সেই সেবারই করে রেখেছিলেন অরুণ আর সুমন। সেবার কিছু মৌলিক গান জুড়েছিলেন, এবারও জুড়েছেন। প্রতুল মুখোপাধ্যায়, কবীর সুমনের কাছে মাধুকরী নিয়েছেন। ব্রডওয়ে মিউজিক্যালের ছোঁয়াচ মেনেও ডন : তাকে ভালো লাগে হয়ে উঠেছে গান-বাজনায় আগাপাশতলা মোড়া একটি বাংলা নাটক। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মঞ্চের প্রেক্ষাপট পালটে ফেলছেন আলোকশিল্পী সৌমেন চক্রবর্তী।

এই নির্মাণ কতখানি মৌলিক, কতখানি অনুপ্রাণিত আর কতখানি নকলনবিশি এ-প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক নয়। নির্দেশক সুজন মুখোপাধ্যায়ের কাছে দেড় কুড়ি বছর আগেকার জাদুকাঠি ছিল। এই সমালোচনা লিখতে বসে ইউটিউব খুলে ম্যান অব লা মাঞ্চার নানাবিধ প্রযোজনার যেসব ভিডিও ক্লিপিং চোখে পড়ল, তাতে ডন : তাকে ভালো লাগের দৃশ্যগুণের বেশ খানিকটা অকপটে ধার করা মনে হলো। তবু পুরনো নাটক ঝেড়েপুঁছে কেটেছেঁটে, নতুন দলবল গুছিয়ে গয়নাগাটি পরিয়ে তাকে চোখজুড়োনো মনভোলানো করে তোলার পেছনে যে মেধা ও শ্রমের যুগলবন্দি চাই, তার জন্য সুজন বাহবা পাবেনই। আরো বড় বাহবা পাবেন এ-নাটক বাছার জন্য। কলকাতার প্রসেনিয়াম থিয়েটার আজকাল যে সরলরৈখিক কাঠামোর গর্তে পা হড়কে মুহ্যমান, ডন : তাকে ভালো লাগে সে সবথেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে। এর নামকরণে যে অদ্ভুত মাদকতা, এর বিন্যাসে যে অনিবার্য জটিলতা, এর বৈভবে যে অবশ্যম্ভাবী বিভ্রম আছে, তাও ওই থোড় বড়ি খাড়া নাট্যচর্চার সঙ্গে বেমানান।

যারা ডন : তাকে ভালো লাগের খেই ধরতে চান, তাদের জন্য এটুকু ধরতাই দেওয়া থাক যে-এ-নাটক স্রেফ দন কিহোতে আর সানচো পানসার আজব অভিযানের গজবকাহিনি নয়। এর অনেকখানি জুড়ে যে সরাইখানার কিসসা আছে, যে-সরাই চালাচ্ছেন তরুণ ভট্টাচার্য আর মোনালিসা দাস, যে-কিসসা জুড়ে আছেন গেঁয়ো বিদ্যেধরী আলদনসা (নিবেদিতা মুখোপাধ্যায়) আর তার কৃপাপ্রার্থীর দল, যাদের মধ্যস্থতায় কল্পবাস্তবের কুহক রচনা করছেন দন কিহোতে, যে কুহকজালে আটকা পড়ছে পেদ্রো (রাহুল সেন রায়), আমেত্মানিয়া (সৌরালি ঘোষ), মা (রুমা বাখুলি), ছেলে (পরীক্ষিত ঘোষ), পাদ্রি (সুশোভন গুহ), ডাক্তার কারাসকো (আসিফুদ্দিন শেখ), বাড়িওয়ালি (সোমরশ্মি ঘোষ), পুলিশ (রজতনারায়ণ ভট্টাচার্য), খচ্চর আরোহীর দল (পিনাকী চক্রবর্তী, দেবাশিস নস্কর, শুভজিৎ দত্ত, অভিষেক মুখোপাধ্যায়, কৃশানু দাস) এবং একমেবাদ্বিতীয়ম এক নাপিত (অরুণ মুখোপাধ্যায়), তাদের বিচিত্র কা-কারখানা পড়ার চাইতে দেখা শ্রেয়। তবে মন দিতে হবে দু-তিনটি আখ্যায়িকায়। প্রথমটি উইন্ড মিলের সঙ্গে দনের যুদ্ধবিষয়ক। অ্যাকাডেমির প্রসেনিয়ামের ধাঁচে উইন্ড মিলের দুরন্ত ঘূর্ণি কিছুতেই আঁটানো যায়নি বলে এই অলোকসামান্য যুদ্ধ মাঠে মারা গেছে। অন্যত্র খুলে যাবে আশা করি। দ্বিতীয়টি দনের কল্পলোকের মহীয়সী নারী দুলসনিয়ার সঙ্গে প্রণয়বিষয়ক। সুমন ও নিবেদিতার অভিনয় এই পর্বে পরতে পরতে খুলেছে বলে আমাদের অনুভবের স্তরবিন্যাসের সঙ্গে তা খাপসই হয়েছে। তৃতীয়টি নাটকের যবনিকাপাতের অনতিপূর্বে মুমূর্ষু নায়কের শয্যাপাশে। এটিকে কম কথায় বলা যাবে না। একবার দেখলে হৃদয়ঙ্গম হবে, এমন দুরাশা না করাই ভালো।

সত্যি বলতে চেতনার ডন : তাকে ভালো লাগে এমনই বহুস্তরী এক অভিজ্ঞতা যে, তাকে অক্ষরে আটকে রাখা যায় না। তবু প্রধান ভূমিকায় সুমন মুখোপাধ্যায়ের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। অনেকদিন বাদে তাঁকে মঞ্চের ওপর দেখা গেল। সম্ভবত গলা তুলতে বেগতিক বুঝে কলার মাইক নিয়ে অভিনয় করলেন। সাউন্ড ব্যালেন্সে মাঝেমধ্যেই তেলেজলে হলো। এটুকু উনিশ-বিশ বাদ দিলে এমন বহুমাত্রিক ভূমিকায় তাঁকে একাঙ্গী লেগেছে। শুভময়ের মধ্যে যে নাছোড়বান্দা মানবাধিকার কর্মীর আদল আছে তা ফুটিয়ে তোলা সুমনের কাছে জলভাত ছিল। আলোনসো কিহানাও তাই। দন কিহোতের সাজে নিজেকে যেই বদলে ফেললেন সুমন, কেবল আহার্যে নয় বাচিক-আঙ্গিকেও, সেই মুহূর্ত থেকে তাঁর ওস্তাদি মালুম হলো। চলনে-বলনে এক নড়বড়ে দোদুল্যমান দুনিয়ার ছাঁদ এনেছেন সুমন। সেটি দন কিহোতের খোয়াবনামার সঙ্গে খাপ খেয়ে গেল। গানে তাঁর ব্যুৎপত্তি আমাদের অজানা নয়। এ যাত্রায় আবারো টের পাওয়া গেল। সতীশ সাউ যে সানচো পানসা করতেন, সুজন মুখোপাধ্যায়ের সানচো পানসা তার চেয়ে আলাদা। প্রথমটি যেন মালিক-গোলামের সমীকরণ মাফিক, দ্বিতীয়টি দুই হুজুরের গপ্পোর ছাঁচে ঢালাই। দুটিই চলনসই। বাটি আর নরুন-হাতে নাপিত সেজে অশীতিপর অরুণ মুখোপাধ্যায় কয়েক মিনিটের জন্য মঞ্চে আসেন। বাঁদিক দিয়ে ঢুকে ডানদিক দিয়ে বেরিয়ে যান। প্রায় কিছুই বলেন না। আজো নমনীয় শরীরটিকে ভেঙেচুরে এমনসব বিস্ফোরণ ঘটান অরুণ যে, দর্শকদের উচ্ছ্বাস বাঁধ মানে না। আলদনসা-দুলসনিয়ার জোড়া ভূমিকায় অবাক করেছেন নিবেদিতা মুখোপাধ্যায়। চরিত্রের চাহিদামাফিক শস্নীল-অশস্নীলের চৌকাঠের এদিকে-ওদিকে আনাগোনা করতে হয়েছে তাঁকে। বদলাতে হয়েছে বারবার। আমাদের নাট্য সংস্কৃতিতে লাজে রাঙা কনে বউ সাজা যত সোজা, কুকথায় পঞ্চমুখ বারবধূ সাজা তত কঠিন। নিবেদিতা দিব্যি তরে গেছেন। ডন : তাকে ভালো লাগেতে বিপুল চরিত্রের সমাহার। তাই এ-নাটকের কুশীলবদের ক্রমাগত ভূমিকা পালটে পালটে এগোতে হয়েছে। সবাইকে বেশ উঁচুদরের পেশাদার মাপে পৌঁছে যেতে দেখে বড় আহ্লাদ হয়েছে। যেখানে ঝট করে এক দঙ্গল আধাপেশাদার নট জুটিয়ে পট করে নাটক করে দেওয়ার রমরমা বাজার, সেখানে এমন মেধাসন্দীপ্ত শ্রমসাধ্য অনুশীলনসাপেক্ষ প্রযোজনা হাটে আনার মধ্যে যে বাহাদুরি আছে, সেটি চেতনার প্রাপ্য। অধুনা প্রতিবাদ আর প্রতিস্পর্ধার এমন মণিকাঞ্চনযোগ যে অচল আধুলি নয়, বরং সচল মোহর, সেই সার কথাটি তারা প্রমাণ করলেন।

দুটি অন্যকথা। চেতনার ডন : তাকে ভালো লাগের প্রথম অভিনয় হয়েছে ২২ এপ্রিল ২০১৮। এই প্রযোজনা নিয়ে খবর বেরোতে শুরু করেছে তারও মাসখানেক আগে থেকে। গেল ছমাসে অনেক খবর বেরিয়েছে। প্রথম প্রথম যিনি সানচো পানসা সাজছিলেন, সেই সতীশ সাউয়ের কালান্তক ব্যাধি ধরা পড়ার খবর বাদ দিলে সর্বত্র মুখোপাধ্যায় পরিবার পুরোভাগে থেকেছে। যেখানে অনুবাদকের নাম অরুণ মুখোপাধ্যায়, নায়কের চরিত্রে সুমন মুখোপাধ্যায়, নির্দেশক সুজন মুখোপাধ্যায় এবং সংবাদমাধ্যম তারায় তারায় খচিত সুন্দর অঙ্গদের খোঁজ পেলেই দৌড়ে যান, সেখানে এমনটি হওয়া অনিবার্যতা। যে-চেতনা বরাবর নাটকের নামে, বড়জোর প্রয়োগপ্রধানের নামে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে অভ্যস্ত, সেই চেতনার বিজ্ঞাপনে বারবার মুখোপাধ্যায় পরিবারের প্রাধান্য চেতনার পুরনো অনুরাগীদের মনে লেগেছিল। কার্টেন কলের সময় দলের সবার সঙ্গে দর্শককুলের পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা যখন দস্ত্তর, তখনো বিশেষ কয়েকজনের পুরোভাগে থাকাটা চোখে পড়েছিল। ২২ মে সন্ধেবেলা আকাদেমির শো শেষ হতে হতে রাত ৯টা বেজে গেছিল। বিভিন্ন কলাকুশলীর সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করানোর চেয়ে অনুরোধের আসরের ঢঙে আরেকবার সবাই মিলে এ-নাটকের থিম সং গেয়ে ওঠাকেই শ্রেয় মনে করেছিলেন নির্দেশক। খারাপ লেগেছিল। ২৫ আগস্ট দুপুরের শোর পর দেখলাম ভুল শুধরে নিয়েছেন তিনি। সবাইকেই চেনা গেল। ভালো লাগল। যে-যূথবদ্ধতা চেতনার ছেচলিস্নশ বছরের নান্দনিক অভিযাত্রার অন্যতম বৈশিষ্ট্য, সেই দলে পদাতিক অশ্বারোহী গোলন্দাজদের মধ্যকার স্তরবিন্যাস সাদা চোখে ধরা না পড়াই কাম্য। যৌবনের যে-উদ্ভাস, যূথবদ্ধতার যে উচ্চারণ হাল আমলে গা-ঝাড়া দেওয়া ওঠা চেতনার সাম্প্রতিক দুটি প্রযোজনা ঘাসিরাম কোতোয়াল, ডন : তাকে ভালো লাগের অন্যতম চালিকাশক্তি তার এমন স্বীকৃতি আখেরে গ্রম্নপ থিয়েটারের মরা খাতে পরি নাচানোর শামিল।

তাই চেতনা। তাই তাকে ভালো লাগে।

 

তথ্যসূত্র

‘অভিনয়ে ফিরলেন সুমন’, আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৩ এপ্রিল-২০১৮