তবে ফিরে এসো . নেরুদার হারিয়ে যাওয়া একুশটি কবিতা

হাসান ফেরদৌস

একটি অপূর্ব বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। পাবলো নেরুদার অপ্রকাশিত একুশটি কবিতার সন্ধান মিলেছে, তাঁর ফেলে যাওয়া অগোছালো নানা কাগজপত্রের ভেতর। এর কোনো-কোনোটি পঞ্চাশ বা তার চেয়েও পুরনো। রুলটানা খাতায়, খাতা ছেঁড়া আলগা কাগজে,  বিদেশে থাকার সময় কেনা কোনো পুরনো নোটবুকে, এমনকি ন্যাপকিনে ও নাটকের অনুষ্ঠানসূচিতে কবিতাগুলো লেখা হয়েছিল। সম্পূর্ণ নতুন কবিতা, পুরনো কোনো কবিতার ভিন্ন সংস্করণ নয়। কেন তিনি এসব প্রকাশের প্রয়োজন দেখেননি বলা কঠিন। ১৯৮৬ সালে, কবির মৃত্যুর বছর-পনেরো পর, তাঁর স্ত্রী মাতিলদে উররুতিয়ার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় নেরুদা ফাউন্ডেশন, তারা কয়েক বছর ধরে নেরুদার সব প্রকাশিত-অপ্রকাশিত পা-ুলিপি, চিঠিপত্র ও অন্যান্য দলিলের একটি পূর্ণাঙ্গ ক্যাটালগ তৈরি শুরু করে। ২০১৪ সালে, নানা পুরনো কাগজপত্রের ভেতর মাতিলদেই কবিতাগুলো আবিষ্কার করেন।

স্প্যানিশ ভাষায় মূল কবিতাগুলো প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে, তার দুবছর পর, এ-বছরের গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের কপার ক্যানিয়ন প্রেস সে-বইয়ের এক অপূর্বসুন্দর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে। মূল স্প্যানিশ ও তার ইংরেজি অনুবাদ ছাড়াও এ-সংস্করণে রয়েছে নেরুদার হাতে লেখা সে-কবিতাগুলোর ফ্যাকসিমিলি, রয়েছে অনুবাদক ফরেস্ট গ্যান্ডারের একটি শ্রদ্ধামিশ্রিত ভূমিকা ও প্রতিটি কবিতার রচনাকাল নিয়ে তথ্যপূর্ণ নির্ঘণ্ট। সব মিলিয়ে এক কথায় অপূর্ব।

শুরুর কবিতাটির কথাই ধরা যাক। গ্রন্থভুক্ত সবচেয়ে পুরনো কবিতা নয় এটি, নেরুদা ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুসারে ১৯৫৯-৬০-এর কোনো এক সময়ে কবিতাটি লেখা। কোনো শিরোনাম নেই, তবে এখানে নেরুদা মাতিলদের নাম উলেস্নখ করেছেন। ফলে ধরে নেওয়া যায় এটি তাঁর সে-সময়ের গোপন এই প্রেমিকার উদ্দেশে নিবেদিত। ১৯৪৬ সালে তাঁদের দুজনের পরিচয় হয়েছিল। পরিচয় থেকে প্রণয়, যা শেষ পর্যন্ত বিয়েতে গড়ায় ১৯৬১ সালে।  নেরুদার দুটি বিখ্যাত বই,  Los Versos del Capitan (ক্যাপ্টেইন’স ভার্সেস) এবং  প্রেমের ১০০টি সনেট তাঁর প্রতি নিবেদিত।

 

Tus pies toco en la sombra,     tus manos en la luz,

Y en el vuelo me guían tus       ojos aguilares

Matilde, con los besos que       aprendí de tu boca

Aprendieron mis labios a          conocer el fuego.

Oh piernas heredadas de la      absoluta avena

Cereal, extendida la batalla

Corazón de pradera,

Cuando puse en tus senos mis                orejas,

Mi sangre propago tu silaba    araucana

 

আঁধারে তোমার পদযুগল আমি স্পর্শ

করি,

তোমার হাতদুটো ছুঁই আলোয়

মধ্য আকাশে তোমার ভিনদেশি চোখ আমাকে পথ দেখায়

মাতিলদে, তোমার চুম্বন থেকে আমার ঠোঁট

জেনে নেয় আগুনের পরিচয়।

ওহ, তোমার পা দুখানা নিখুঁত ওট দানার মতো সরযুক্ত, যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত

হৃদয় তৃণভূমি

আমার কর্ণ যখন তোমার স্তনে ঝুঁকে

আসে

আমার রক্ত চেঁচিয়ে বলতে চায় তোমার আরাউকান বর্ণমালা।

(আরাউকান ষোড়শ শতকের হিস্পানীয় কাব্য, এতে স্পেনের হাতে চিলি জয়ের কাহিনি বিবৃত হয়েছে।)

নেরুদা, যাঁকে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ বিশ শতকের সেরা কবি হিসেবে বর্ণনা করেছেন, তাঁর দুই ধরনের কবিতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় – চিত্তে ঢেউ জাগে, রক্তে আগুন ধরে এমন প্রেমের কবিতা এবং গভীর প্রতিবাদী ও রাজনৈতিক কবিতা। ১৯২৪ সালে, নেরুদার যখন মাত্র ২০ বছর বয়স, সে-সময়ে প্রকাশিত কুড়িটি প্রেমের কবিতা ও একটি হতাশার গানের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে, তাঁরা নিশ্চয় লক্ষ করবেন, মাতিলদের প্রতি নিবেদিত এ-কবিতায় সে-গ্রন্থের মন-মাতাল, তীব্র শরীরবাহী কামজ মদিরতার পুরোটাই অক্ষুণ্ণ। তুলনা হিসেবে কুড়িটি প্রেমের কবিতার বহু উদ্ধৃত ‘নারীর শরীর’ কবিতাটির উদ্বোধনী বাক্যচতুষ্টয় ধরা যাক :

নারীর শরীর, শুভ্র শৈলচূড়া, শুভ্র ঊরু

আত্মদানের মুদ্রায় তুমি উপমা ধরিত্রীর

বন্য কৃষাণের মতো আমি উপগত হই তোমার শরীরে,

পৃথিবীর গভীর থেকে উঠে আসে এক আশ্চর্য

শিশু।

(অনুবাদ : আলী আনোয়ার)

 

লাতিন কাব্যে – ফরাসি কাব্যধারার প্রভাবে – কামজ চেতনার উপস্থিতি বরাবরই ছিল, তবে দ্বিধাহীন ‘ইরোটিকা’র বদলে কিছুটা শৈল্পিক আড়ালে, কিছুটা ইঙ্গিতে সে-চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। নেরুদাই এই মহাদেশের প্রথম কবি, যিনি সব ওলটপালট করে দিলেন। নারীকে তিনি শর্তহীনভাবে আহবান করলেন কামজ উল্লাসে, নিঃশর্ত বশ্যতা ঘোষণা করলেন তার দেহের প্রতি। কবি, তা তিনি যে-দেশের বা যে-ভাষারই হোন না কেন, বরাবর নারীর প্রতি তাঁর অনুরাগ ও আনুগত্য প্রকাশে ইতস্তত করেননি, যদিও তা মুখ্যত এসেছে সৌন্দর্যের এক ‘আদর্শবাদী’ ঐতিহ্যিক চেতনা থেকে। নারীর চোখ, তার চুল, তার স্তন, এসবই এসেছে, কিন্তু পূর্ণ নারীদেহকে আদর্শ করে এমন সরল, এমন প্রখর ও নির্লজ্জ নির্মাণ লাতিন কবিতায় সেই প্রথম। এর ফলে ‘আদর্শবাদের পরিবর্তে কবিতায় এলো ইন্দ্রিয়বোধ, বিমূর্তের স্থান নিল সুনির্দিষ্টতা’ (রেনে দে কস্তা)।

তাঁর প্রেমের কবিতায় নেরুদা বরাবর নারীকে প্রকৃতির সঙ্গে তুলনা করেছেন, তাকে বর্ণনা করতে প্রকৃতির কাছে বারবার ফিরে গেছেন। এর ফলে তাঁর কবিতা, দেহজ চেতনার পাশাপাশি এক ধরনের ‘প্যাস্টোরাল’ চরিত্র অর্জন করে। সম্ভবত সে-কারণে যে, নারীকে তিনি পূজার ফুল তুলে দেন, কোনো বিশেষ এক দেশের নয়, বিশেষ এক বর্ণেরও নয়। কবিতায় যে-নারীর কথা তিনি বলেন, তাকে তিনি অধিকার করতে চান সম্পূর্ণ ও বিপুল, কিন্তু অধরা থেকে যায় যে-নারী, তার প্রতিই কবির আকাঙক্ষা ও আনুগত্য অধিক।  কুড়িটি প্রেমের কবিতার ছয় নং কবিতার কথা ধরা যাক।

মনে পড়ে তুমি যেমনটি ছিলে বিগত

হেমমেত্ম

মনে পড়ে ধূসর টুপিটি ও তোমার           হৃদয়ের প্রশামিত্ম

তোমার দৃষ্টিতে ছিল সূর্যাসেত্মর রঙের      দ্বৈরথ

হেমমেত্মর পাতারা পড়ছিল টুপটাপ

মনের চাতালে

(অনুবাদ : আলী আনোয়ার)

এখন তুলনা করুন তবে ফিরে এসো গ্রন্থের শিরোনামহীন দ্বিতীয় কবিতাটি :

পৃথিবীতে কখনো একা নই,

যখন আগুন পেরোই

কারণ তুমি যে-পাশে।

অরণ্যমাঝে তোমার সাথে

ফের খুঁজে পাই

ঊষার কঠিন শর,

বসমেত্মর নরম শ্যাওলা।

এই কবিতাটি ১৯৫৬ সালে লেখা, যখন মাতিলদের সঙ্গে জমে উঠেছে তাঁর গোপন ও উন্মাতাল প্রেম। বস্ত্তত, এই কবিতায় নেরুদা তাঁর অনতি তরুণ বয়সের কামজ আকুতি কাটিয়ে উঠেছেন, নারীর সাহচর্য কামনা করেছেন নিকট-বন্ধুর আন্তরিকতা ও আমন্ত্রণে।

তুমি সাথে রও ব্যস্ত সড়কে

বেলাভূমে,

তুমি আমার

রুটিখ- ও সুরা,

একই মুদ্রায় দারিদ্র্য ও দীপ্তি

জখম ও বেদনা

সুখ।

নেরুদার কবিতায় নারী ও প্রকৃতি এসেছে সমান্তরাল স্রোতে, একই রকম স্বাভাবিক ঝর্নাজলের স্ফুরণে। ‘আমি প্রতীকময়তায় বিশ্বাস করি না’, এ তো নেরুদার নিজের কথা। ‘সমুদ্র, মাছ, পাখি, এসবই বস্ত্ত ভিন্ন অন্য কিছু নয়, আমি তাদের ঠিক সেভাবে বিবেচনায় আনি যেভাবে বিবেচনায় আনি সকালের সূর্যালোক।’ এই গ্রন্থভুক্ত অধিকাংশ কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতির এই সহজ সহাবস্থান আমাদের বিস্মিত করে, অথচ নেরুদার জন্য তা ছিল দৈনন্দিন নিশ্বাসের মতো সহজ ও বাস্তব।

একই গ্রন্থের সাত নম্বর কবিতায় আমরা প্রথম পরিচিত হই, নেরুদার বিবেচনায়, কবি হওয়ার গোপন মন্ত্র। তরুণ কবিদের উদ্দেশে রচিত এ-কবিতায় ইতিমধ্যে পরিণত নেরুদা তাঁর নিজের কবি হয়ে-ওঠার কঠিন – অথচ আনন্দময় – অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে নবাগত কবিকে সাবধান করে দিয়েছেন সে যেন চটজলদি সাফল্য লাভের পথ অনুসরণ না করে। কবিতা এক কঠিন ও দুর্বোধ্য দেবীর নাম, শুধু সাধকের নিরন্তর অন্বেষণ দিয়ে যার দ্বারস্থ হওয়া সম্ভব।

নবযুবা, বলছি শোন,

লেগে থাক

শব্দ পরিপক্ব না হলে

নিঃশব্দ অনুসরণ কর

তোমার হাত চেনে

এমন বস্ত্তকে দেখে চেন, হাত বুলাও

হে যুবক, শোন

পুরনো প্রবাদ রয়েছে,

ধীরে জ্বাল দেওয়া শিখলে ফায়দা

আছে

ধরে নিও না

তুমি সেরা কলমবিদ

স্বর্ণশিকারি

রাজহংস

মহার্ঘ্য দুই বাক্যের মাঝে ও

পরিপার্শ্ব শূন্যতায়

তুমি ট্রাপিজ শিল্পী এক

(‘মনে রেখ’)

তোমার একমাত্র আনুগত্য

কয়লা ও আগুনের কাছে

দুহাত তোমার মলিন হবে

পোড়ানো তেলে ও জ্বলন্ত চুলিস্নতে

তারপর নিজেকে ধুয়ে-মুছে নাও

নতুন জামাখানা গায়ে চড়াও

এখন, স্বর্গ যখন তোমার হাতের

নাগালে,

তুমি শুভ্র নলিনীর কথা ভাবত পার।

নিজের কবিতা নিয়েও একটি স্বগত উচ্চারণ রয়েছে গ্রন্থভুক্ত নয় নং কবিতায়। নেরুদা নিজ কাব্যক্ষমতা বিষয়ে গভীর আস্থাবান ছিলেন ও নিজের সমালোচকদের প্রতি ছিলেন প্রবল তাচ্ছিল্যপূর্ণ। এ-কবিতায় নিজের আত্মগরিমা বিষয়ে সচেতন তিনি, কিন্তু নিরন্তর যে রক্তক্ষরণের ভেতর দিয়ে তাঁকে যেতে হয়, শুধু সে-কথা পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চান।

আমি দাম্ভিক,

ঠিক আছে আমি দাম্ভিক

কিন্তু আমার কবিতা বিষয়ে নয়।

কবি হিসেবে নিজের দেশ ও জনগণের প্রতি তাঁর দায়িত্ব আছে, এমন বোধ দ্বারা নেরুদা চালিত হয়েছেন, যার ফলে তাঁর কাছ থেকে আমরা পেয়েছি আশ্চর্য প্রভাময় রাজনৈতিক কবিতাসমূহ। যে-দেশ ও যে-মহাদেশের তিনি নাগরিক, তার বেদনা ও রক্তক্ষরণের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা ও স্মৃতিতে ধরে রাখার কঠিন দায়িত্ব তিনি নিজেই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। নয় নং কবিতায় সে-কথার একটি স্বগত উচ্চারণ প্রকাশিত হয় এইভাবে :

কখনো কখনো

আমার স্বদেশবাসী আক্রান্ত হলে

আমি দেখি দেশের পতাকা কেমন

উড্ডীন

ফেনিল স্রোতমালা ভুলে

সড়কের পাশের ফুলটির কথা ভুলে

আমি ছুটে যাই ঘণ্টাঘরে

না, অন্য সবার চেয়ে খুব বেশি কিছু

আমি করিনি

হয়তো কমই করেছি।

এই কবিতা অথবা নেরুদার অধিকাংশ কবিতা, কতটা রাজনৈতিক, কতটা ব্যক্তিগত, সে-বিতর্কে আমরা যাব না। তবে একথা উলেস্নখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, তিনি কখনো নিজেকে রাজনৈতিক কবি হিসেবে বিবেচনা করতেন না। যে-কোনো আদর্শগত তালিকাভুক্তির বিরোধিতা করেছেন তিনি, তাঁর একমাত্র লক্ষ্য, কবি নিজেই বলেছেন, সেইসব বিষয় অথবা বস্ত্ত নিয়ে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করা যা তাঁর কাছে দৃষ্টিমান ও স্পর্শযোগ্য।

আমি শ্রমিক শ্রেণির মুখপাত্র নই, আমাকে নিয়ে এই রকম কোনো লেবেল সাঁটানোর আমি বিরোধী।  আমার কবিতায় রয়েছে শুধুমাত্র সেইসব বিষয়, সমকালীন বিশ্বে যা মানুষকে উদ্বিগ্ন করে। আমি মনে করি, সেইসব কবি যারা কবিতায় সচেতনভাবে নিজ দেশের মানুষের ভাবানুভূতিও, তাদের উদ্বেগ সযত্নে এড়িয়ে চলেন, তারাই হলেন সবচেয়ে রাজনৈতিক কবি।

তাঁর এ-কথার অর্থ, আমার বিবেচনায়, কবি অথবা লেখকের কাছে রাজনৈতিক প্রসঙ্গসমূহ স্বাভাবিকভাবে প্রকাশিত হয়, যেভাবে প্রকাশিত হয় ঊষার আগমন অথবা গ্রীষ্মের খরা। যুদ্ধ, বিপ্লব, মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই, কবির ও প্রতিটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বহির্গত কোনো বিষয় নয়। ফলে কবিতায় – অথবা যে-কোনো ধরনের সাহিত্যে, এই জীবনাভিজ্ঞতার প্রকাশ থাকবে, তাতে বিস্ময়ের কী আছে! অন্যদিকে, যারা এইসব স্বাভাবিক ও দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাকে সচেতন নির্বাচনের মাধ্যমে এড়িয়ে চলেন, তারাই প্রকৃত রাজনৈতিক লেখক। নেরুদা এসব লেখককে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলতেও দ্বিধা করেননি।

বস্ত্তত, কবিতার মাধ্যমে নেরুদা চেয়েছিলেন তাঁর পাঠকদের মানুষ ও প্রকৃতির নিকটস্থ করতে, এই দুইয়ের মধ্যে কোনো ব্যবধান নেই, সেই সহজ সত্যটুকু অনুধাবন করাতে। বেরিয়ে এসো, দেখো কী অফুরন্ত ও ধনী সমুদ্র ও আকাশ, তাদের চিনলে তুমি নারীকেও চিনতে পারবে। এই গ্রন্থের ১৫ নং কবিতায়, যার শিরোনাম ‘আন্দিসের প্রতি’, সেখানে নেরুদা বলছেন :

তুষারশোভিত

পর্বতশৃঙ্গ

ধবল আন্দিজ

আমার স্বদেশের প্রাচীর

কী গভীর নৈঃশব্দ্যে

আগলে রাখে আমার মানুষের প্রতিজ্ঞামন্ত্র, তাদের লড়াই।

মাথার ওপর রুপোলি পাহাড়শৃঙ্গ

নিচে সমুদ্রের সবুজ হুঙ্কার।

তবু এই মানুষজন

নিজেদের একাকিত্বে

খামচি কেটে

ঢেউয়ের পর ঢেউ মাড়িয়ে যায়

আর অপরাহ্ণে খুঁজে নেয় একখানা

গিটার

তারপরে বেরোয় গান গাইতে।

আমার এইসব মানুষকে

ঠেকানো যাবে না।

আমি জানি তারা কোত্থেকে আসে

কোথায়ই বা তারা একদিন

গিটার হাতে চলে যায়।

নেরুদার এই কবিতা আমাদের স্মরণ করায় তাঁর এলিমেন্টারি ওডস কাব্যগ্রন্থ, যা প্রবলভাবে রাজনৈতিক, অথচ রাজনীতির কোনো ছায়াও সেখানে নেই। আপাতসরল অথবা সারল্যমিশ্রিত এ-কবিতাগুলোর লক্ষ্য কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী নয়, মানচিত্রের নির্ধারিত সীমানা চিহ্ন নয়। সে-কারণে যে-কোনো দেশের ও যে-কোনো সময়ের মানুষ, যে ভালোবাসে নারীকে, সন্ধ্যার নীরব আগমনকে ও সমুদ্রের গর্জনকে, এই কবিতায় স্বসিত্ম খুঁজে নিতে সমর্থ। মানুষের প্রতি এমন মমত্ব দেখাতে পারেন যে-কবি, তাঁকে যা খুশি নামে ডাকুন, ক্ষতি নেই।

দি লস্ট নেরুদা পোয়েমস কাব্যগ্রন্থের মোট ২১টি অপ্রকাশিত কবিতার ভেতর দিয়ে আমাদের চিরচেনা প্রিয় এ-কবিকে কেবল পুনরাবিষ্কার করি না, ‘শব্দকে আলোকোজ্জ্বল’ করার যে-মন্ত্রগুপ্তি তিনি নিয়েছিলেন, তাঁর অজ্ঞাত একগুচ্ছ কাব্য কর্মের মাধ্যমে নবরূপে পরিচিত হই তাঁর সঙ্গে। নেরুদাকে যাঁরা ভালোবাসেন, এই বই তাঁদের জন্য এক অমূল্য সংযোজন। যাঁরা নেরুদার কবিতার সঙ্গে ইতোমধ্যে সম্যক পরিচিত, তাঁরাও প্রেমের ও বিপ্লবের এই কবি-বিষয়ে নতুন খোরাক পেয়ে যাবেন এ-গ্রন্থে। r