তীক্ষন ফণীমনসা কাঁটা, বিছুটির দাহজ্বালা

একটি ডিমের ওপর তা দিচ্ছে সন্ত্রাস

অভ্যন্তরেও ডানার কম্পন

পৃথিবীর কাছে জীবনের কাছে

যেন পশুত্বের বিরামহীন অভিসম্পাত

– ত্রিদিব দস্তিদার, (সন্ত্রাস-১)

 

পৃ-থিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটছে মানুষ। এই ছুটে চলা, বেঁচে থাকার এই আর্তনাদ এক মুঠো অন্নের জন্যে, ভূমির জন্যে। অদৃশ্য হিংস্র থাবায় দেশে দেশে আক্রান্ত হলো ভূমিচ্যুত মানুষ, ক্ষুধার্ত মানুষ। সজীব সেন একেবারে তরুণ। তাঁর ভাবনায় প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খায় মানুষের দেশান্তরের ভাবনা, ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকারের কথা। প্রথাগত চিত্রকর্ম বা শিল্পকর্ম বলতে আমরা যেটা মানি, তার ধারেকাছেও সজীব সেন চিন্তা করেন না। তাতে আমরা কোনো শিল্পভাবনায় কমতি দেখতে পাই না।

সজীব সমাজবিরুদ্ধ অথবা সমাজকাঠামোর বিপরীতে ঘটে যাওয়া বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর কাজের মাঝে সুচালো কাঁটার বহির্মুখী দৌরাত্ম্য দেখা যায়। নির্দিষ্ট ফ্রেম বাদ দিয়ে কোনো ছবি শুধু দেয়ালে এঁটে দিয়ে দর্শকের কাছে ছবির বার্তা পৌঁছে দেন।

সজীব ছবির বিষয় হিসেবে প্রকাশ করেছেন এক দেশ থেকে অন্য দেশে আসা-যাওয়া অভিবাসী মানুষের অশুভ অধ্যায়কে। শুধু একটি বিষয় ছাড়াও চলতি সমাজে দুর্জনের দৌরাত্ম্য, হিংস্র থাবার নখর ছবিতে দেখা যায়। প্রতীকের আশ্রয় নিয়ে অভিব্যক্তিবাদী প্রকাশ-ভাবনা দর্শকদের মধ্যে এক ধরনের বিবেচনাবোধ তৈরি করে।

সজীবের প্রদর্শনীর শিরোনাম হলো ‘এক্সাইল স্টোরি’ বা ‘নির্বাসনের গল্প’। এক জনগোষ্ঠী দীর্ঘ সময় ধরে জন্মভূমিতে বাস করে জীবন অতিবাহিত করছে। এমন মুহূর্তে রাষ্ট্র শক্তি প্রয়োগ করে নানা পীড়নের মাধ্যমে সেসব জনগোষ্ঠীকে পার্শ্ববর্তী দেশ অথবা সীমান্তবর্তী কোনো দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে – প্রাচ্যে বা পাশ্চাত্যে, গোষ্ঠী-বর্ণ-ধর্মভেদে এ-আচরণ আমরা দেখে যাচ্ছি। এ-অবস্থাকে মূল বিষয় করে সজীব ক্যানভাস গড়েন। সজীবের ছবির মাধ্যমে রয়েছে কিছু বৈচিত্র্য, যেমন – ক্যানভাস কাপড়ে সুই-সুতার বুননে ক্যানভাসের ফিগারগুলো গড়ে উঠেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষের অবয়বে ভীতিকর অবস্থা বোঝাতে কালো রঙের সুতা বেশ জাঁকালোভাবে ব্যবহার করেছেন।

হাঁ-করা মানুষের মুখ, হাত-পা ছুড়তে থাকা মানুষ, কাঁটাযুক্ত মানুষের মুখ থেকে বেরিয়ে-পড়া মানুষের শরীরের অংশ ছবির নান্দনিকতাকে ব্যাহত করেনি। গ্যালারির সাদা দেয়ালে ফ্রেমহীন সাদা জমিনের ছবির মধ্যে সাদৃশ্য দেখা গেলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব ছবিকে গুরুত্বহীনতার অভিযোগ দেওয়া যায়।

প্রশ্ন আসতে পারে, সব ছবিতেই কি ফ্রেম আবশ্যক অথবা ফ্রেমযুক্ত ঝাঁ-চকচকে ছবিই কি ছবি? এ-আলাপে আমরা হয়তো বেশ এগোতে পারব এবং সেটি দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বলা যায়, সজীব সেন শিল্পী হিসেবে তাঁর ভাবনার জায়গা স্পষ্ট করেছেন। ‘এক্সাইল স্টোরি-৪’ ছবিতে দেখা যায়, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যাওয়া মানুষের মধ্যে হাজির হয়েছে কাঁটাযুক্ত দাঁতাল একদল মানুষ। এ-মানুষগুলোই বিশ্বসভ্যতায় আগ্রাসনবাদিতার প্রতীক। সজীবের কাজে রঙের দ্রুতি নেই, উজ্জ্বল রঙের বাড়াবাড়ি দেখা যায় না; নির্বাচিত কিছু রঙের মধ্যে রয়েছে ধূসর, বাদামি, লাল, কালো – অপেক্ষাকৃত মস্নান রঙের প্রয়োগ। প্রধান রং হিসেবে লাল- কালো রংকে ধরে নেওয়া যায়। মানুষই সজীবের ছবির মূলকেন্দ্রে অবস্থান করছে। মানুষের অবস্থার সঙ্গে যুক্ত করা জ্যামিতি ও ত্রিমাত্রিক অবজেক্ট ছবির ভারসাম্যে স্থিরতা দিয়েছে। একজন শিল্পীর ছবির কাঠামোয় বাস্তবতা করণকৌশলে ব্যতিক্রমী অনুষঙ্গ যুক্ত করা সজীবের বৈশিষ্ট্য।

গ্যালারির প্রথম দেয়ালে রাখা বিশাল আকৃতির মানচিত্রের গায়ে একদল মানুষের টুকরো টুকরো অবস্থান পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে অবস্থান নেওয়া ক্ষমতাধর মানুষের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।

সমস্ত কাজে একধরনের ঐক্যের সূত্র দেখা যায়। ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজবৈশিষ্ট্যের জাঁতাকলে চ্যাপ্টা হওয়া মানুষগুলোই সজীবের ক্যানভাস। পুঁজিবাদী বিশ্বে পুঁজির মালিকদের শোষণ আমাদের সমাজকাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে। সংঘাত, অস্ত্র, বুলেট, ড্রোন, যুদ্ধবিমান, প্রতিনিয়ত খেলা করছে অসহায় মানুষের সঙ্গে। সজীব সেনের তরুণ হাত যখন ক্যানভাস ছোঁয়, তখন এসব মানুষের বেদনার কথা বলে, হাহাকারের শব্দ উপস্থাপিত হয়।

রাজধানীর কলাকেন্দ্রে গত ১৭ নভেম্বর শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনী শেষ হয়েছে ১৫ ডিসেম্বর।