তুমি যে গিয়াছ বকুল-বিছানো পথে

রাতুল দেব বর্মণ

ঢাকায় গেলে কাইয়ুমভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবেই। তাঁর সঙ্গে দেখা না হলে, কথা না হলে ঢাকা সফর বা বাংলাদেশ বেড়ানোর কোর্স পুরো হয়নি। দাওয়াত থাকত প্রতিবারেই। কখনো তাঁর বাড়িতে, কখনো ঢাকা ক্লাব কিংবা অন্য কোনো বন্ধু-গুণিজনের বৈঠকখানায়। দেখা-সাক্ষাৎ, আড্ডায় ডুবে যেতাম দীর্ঘসময়। এমন প্রাণোচ্ছল, প্রকৃতি ও মৃত্তিকালগ্ন মানুষ আমি কজন দেখেছি জানি না। অশীতিপর কাইয়ুমভাইয়ের সঙ্গে শেষ সংক্ষিপ্ত আড্ডা ছিল গত আগস্টে, কালি ও কলমের সম্পাদক আবুল হাসনাতের বৈঠকখানায়। কথা ছিল পরেরবার ঢাকায় এলে দীর্ঘ আড্ডা হবে কাইয়ুমভাইয়ের সঙ্গে, মানে যেমন প্রতিবারই বলে এসেছি তাঁকে। কথা ছিল সেপ্টেম্বরে আগরতলায় আসবেন, একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এলেন না শেষ অবধি। আর নভেম্বরের শেষ দিনে তাঁর হারিয়ে যাওয়ার খবর শোনালেন মফিদুল হকভাই, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। মফিদুলভাইয়েরা বললেন, তুমি আসতে চাইলে আসতে পারো। কিন্তু ততক্ষণে দাফন হয়ে যাবে। শেষ দেখা আর হলো না। সমস্ত ওড়ার অভ্যাস যেন ডানা ভেঙে মুচড়ে পড়ল।

কুলুঙ্গি থেকে তরতাজা স্মৃতিগুলি একে একে বেরিয়ে এসে আমার কণ্ঠরোধ করেছিল। এই মুহূর্তগুলি যে যত ভালোভাবে প্রকাশ করতে পেরেছে তারাই কিন্তু ভালো লেখক, কবি, চিত্রকর, অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি পান। কাইয়ুমভাইকে নিয়ে আমি সে-ধরনের কোনো শাব্দিক খেলা খেলতে চাই না। কারণ তিনি যে সবচেয়ে বড় খেলাটা খেলে গেলেন। কাইয়ুমভাইয়ের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন আমাকে নস্টালজিয়ার মুহূর্তে দারুণ সঙ্গ দিয়েছিল। কবিতার লাইনগুলি এরকম, ‘হৃদয়স্পন্দন তখন পর্বত শিখরে/ শ্রাবণধারায় ঝাপসা ইলিশের নৌকা/ চারদিকে নৃত্যরত বৃষ্টির চাদর/ মাতাল হাওয়ায়/ তবুও তোমাকে জানাতে পারিনি/ সঙ্গ সুখ কী গভীর অপেক্ষায়।’ কাইয়ুমভাইয়ের ওপর আমার অভিমান আছে। কাইয়ুমভাই কথা রাখতে পারেননি। বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, আমাকে পেইন্টিং দেবেন। দিয়ে যেতে পারেননি।

একদিন ঢাকা ক্লাবের আড্ডায় দুপুরে আমরা একসঙ্গে খাবার খেয়েছিলাম। রসনাতৃপ্ত খাবার, তাও কাইয়ুমভাইয়ের সঙ্গে। খাবার টেবিলে বসেই পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার মতো অভ্যাসবশে দু-লাইন গান বেরিয়ে এলো আমার গলা দিয়ে। লক্ষ করলাম, কাইয়ুমভাই বেশ তাড়িয়ে শুনলেন দুলাইন। পরেরটাও শুনতে চাইলেন। কিন্তু আমার তো আর আসে না, মানে লাইন মনে নেই। হারানো সেই লাইন গাইলেন কাইয়ুমভাই। একটি দুটি লাইন নয়, পুরো গানটাই গাইলেন। গান তো দুরকম। একটা গলা দিয়ে, মানে যারা গলার নিয়মিত ব্যায়াম করে গেয়ে থাকেন। আর আমার মতো যারা, আমাদের গলার বালাই নেই। আমরা গাই হৃদয় দিয়ে। কাইয়ুমভাইও সেরকমই গাইবেন ধারণা ছিল। কিন্তু অবাক হলাম আরো একবার। গানটা ছিল শচীনকর্তার। শচীনকর্তাকে যে তিনি ভেজে খেয়ে নিয়েছেন বুঝলাম সেদিন। একজন বৃদ্ধ (বাইরে থেকে দেখতে) মানুষ শচীনকর্তার ভাঙা-মদির কণ্ঠটা প্রায় অবিকল নকল করে পুরো গানটাই গেয়ে দিলেন। শচীন দেববর্মণের বংশলতার মানুষ আমি। বিষয়টি আমাকে সেদিন যেভাবে হকচকিত করেছিল, পরে বুঝেছিলাম কাইয়ুম চৌধুরী বলেই এটি সম্ভব হলো। কবিতা লিখি বলে সাহিত্যের নানান অঙ্গনে ঘোরাফেরার চেষ্টা করে বেড়াই। চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরী সারাজীবন আমাকে নানাভাবে শুধু বেপাটই বানিয়ে গেলেন। কবি কাইয়ুম চৌধুরীকে আমি ফলো করতাম। মানে কোন দিকে, কোনভাবে, কোন পথে হাঁটছেন ধরার চেষ্টা করতাম। মনে হতো এই পথটায় হেঁটে লোকটার নাগাল পাওয়া সহজ হবে। কিন্তু সেখানেও হাঁটতে গিয়ে ভুল ভুলাইয়ায় পড়েছি, অন্ধকারে হারিয়ে গেছি। তাঁর একটি কবিতার (প্রেমের কবিতার) লাইন – ‘বাইরে নিকষ কালো/ আষাঢ়ের ঘন অন্ধকার/ দাঁড়িয়ে তুমি তোরণপাশে/ বেরিয়ে এসেছ গানের শেষে।/ ঘননীল ছাড়া কামিনী গাছে/ আমার হৃদয় কেন বারবার – / নামে অন্ধকার।’

এই উপমহাদেশের প্রণম্য ও অনন্য চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর কাজ নিয়ে বহু কাটাছেঁড়া হবে। চিত্রশিল্পের বিদ্বজ্জনেরা তাঁর কাজকে উত্তর-আধুনিকোত্তর বলবেন। আমি বলব, কাইয়ুমভাইকে এসব কাল, কালের গন্ডিতে ধরা যায় না। তিনি বোধহয় অন্যমাত্রিক শিল্পী। বাংলার নদী, জল, মানুষের আনন্দ-বিষাদ, লড়াই-ভালোবাসাকে চিত্রিত করতে গিয়ে এক অনন্ত, অসীমের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে গিয়েছিল। এমন এক অনন্তসলিলা হৃদয়বত্তার মানুষকে মাপজোখে ফেলার আগে তাঁর ভাষাতেই বিধিসম্মত সতর্কীকরণ সঙ্গে রাখা যেতে পারে। ‘- তুমি তো জানো না তার পরিমাপ/ সবুজেই হারাবে তোমার সহস্র গোলাপ’

বাংলাদেশের জাতীয় দুর্যোগ-সংকট, দেশের মুক্তির লড়াইয়ে কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পীসত্তা বারবার অগ্নিশুদ্ধি লাভ করেছে। বাংলাদেশ এবং বাঙালির জীবনসংগ্রামকে নিয়ত ব্যঞ্জনাময় করেছেন প্রকৃতির অন্তর্নিহিত তেলরং, জলরং দিয়ে। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্র শিল্পকর্ম নিয়ে তাঁর জীবদ্দশায় বিশ্বময় বহু আলোচনা হয়েছে। সে-তুলনায় কবি কাইয়ুম চৌধুরীর কবিতা নিয়ে সেভাবে কোনো কাজ হয়নি বাংলাদেশে। আমি বিভিন্ন সময়ে কালি ও কলম সম্পাদককে কাইয়ুম চৌধুরীর কবিতা নিয়ে সংকলন করার জন্য বলেছি। কাইয়ুমভাইয়ের সামনেই বলেছি। ওই যা হয়। এখন নিশ্চয়ই হবে। তবে তাঁর জীবদ্দশায় হলেই তো ভালো ছিল। ঢাকায় যেদিন কাইয়ুমভাইয়ের কবিতার গ্রন্থ প্রকাশ হবে, খবর পেলে বিনা নিমন্ত্রণে হলেও ছুটে যাব। পরে যাব কাইয়ুমভাইয়ের ডিজাইন করা টি-শার্টটি। ৩০ নভেম্বরের পর তিনবার ওই শার্টখানা আলমারি থেকে বের করেছি আবার ভাঁজ করে রেখে দিয়েছি। কাইয়ুমভাইকে শ্রদ্ধা জানানোর মতো কোনো ভাষা কোনো শব্দ বা বর্ণ খুঁজে পাই না। আমার এই চরম দৈন্যই সমর্পণ করছি তাঁর স্মৃতিতে। এই দীনতা ক্ষমা করো – । ভাবিজান তাহেরা খানম কেমন আছেন। প্রণাম নেবেন। সবশেষে আড্ডায় গাওয়া শচীনকর্তার সেই গানটির লাইনই আমার খুব করে মনে পড়ছে – ‘তুমি যে গিয়াছ বকুল-বিছানো পথে’।