তৃণভূমি ও সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

আশরাফ উদ্দীন আহ্মদ

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের (১৯৩০-২০১২) তৃণভূমি (১৩৭৫ বঙ্গাব্দ) বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী উপন্যাস, স্বীকার করতেই হয়। ভাব-ভাষা বা কাহিনি-অলংকরণ অথবা এর বিস্তৃত ব্যাখ্যা, কাহিনি-বুননের জাদুকরী ক্ষমতা, একই সঙ্গে মানুষের প্রতি লেখকের অন্তরঙ্গ যোগাযোগ, প্রকৃতির মাঝে নিজেকে অভিন্ন করে তোলা কাহিনিকে আরো সজীব এবং সাবলীল করেছে, করেছে মানুষ বা জীব এবং প্রকৃতিকে একাকার, কেউ কারো চেয়ে এতটুকু কম নয়, ভূপ্রকৃতি মানুষকে করেছে স্বজন, আবার জীবনকে দিয়েছে প্রাণ। সমস্ত সৌন্দর্যকে উপুড় করে ঢেলে সাজিয়ে তুলেছে যে-প্রকৃতি, তার পাদতলে মানুষ বারবার ছুটে গেছে নিজের প্রয়োজনে। এখানে কিছু খেটে-খাওয়া মানুষ এবং চরিত্রকে নির্ণয় করে কাহিনি তার গতি পেয়ে এগিয়েছে, পাঠক তন্ময় হয়ে তাকিয়ে দেখে, জীবন যেন তৃণভূমিতে আটকে আছে যুগ-যুগান্তর ধরে।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এমনই একজন কথাকার, যাঁর প্রতিটি লেখায় ব্যক্তি-সমাজের খুঁটিনাটি বিষয় এবং প্রকৃতির দ্বন্দ্ব সমন্বয়ের চিত্র ফুটে ওঠে, ব্যক্তির অভ্যন্তরের আদিসত্তায় নিহিত জৈবিকতা উত্তরণ ঘটায় মানবিকতায়। জীবনকে কখনো করে তোলে কঠিন বা মোক্ষম এবং কখনো-বা নদীর মতো সরল। এই জীবন চলছে নদীর মতো শত-সহস্র কাল ধরে, কোথায় চলেছে নদী, কেউ কি এমন প্রশ্ন করেছে কোনোদিন? কিন্তু তাতে কী নদীর, সে তো আপন বেগে পাগলপারা।

বাংলা সাহিত্যের দিকপাল বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথের পর তারাশঙ্কর-মানিক ও বিভূতিভূষণের মতো কথাসাহিত্যিকদের পথ ধরেই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের আবির্ভাব। নিজেকে তাঁদের সমগোত্রীয় করে তোলা, হয়তো সবটাই সঠিক নয়, কখনো নিজের মতো করেও চলতে চেয়েছেন; তারপরও বলতেই হয়, সেই মাটি-আবহাওয়া-মানচিত্রের ওপরেই তাঁর বসবাস। রাঢ়ের মানুষ-প্রকৃতি তাঁকে টেনেছে বারবার। শহুরেপনা অর্থাৎ মানুষের বানানো, মানুষের মতো করে বা কৃত্রিম কোনো কাঠামো নয় (যার ভেতর আছে শুধুই লোভ-সংঘাত আর মানুষের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস-দ্বন্দ্ব), নিপাট গ্রামবাংলার হতশ্রী মার্কা ওই সাধারণ মানুষই তাঁর লেখার বিষয় হয়ে গেছে। কারণ গ্রামবাংলার ওই সমস্ত জীবের মধ্যেই জীবনের প্রকৃত রূপ, যা জলছবির মতো মনে হলেও বাস্তব জীবন সেখানেই রোপিত। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের প্রকাশিত উপন্যাস-গল্প  সংকলন-প্রবন্ধগ্রন্থ দুই শতাধিক। ছোটদের জন্যও লিখেছেন। তাঁর রহস্যকাহিনির নায়ক প্রকৃতিবিজ্ঞানী কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ছোটদের জনপ্রিয় চরিত্র। উল্লেখযোগ্য রচনা – নীলঘরের নটী, স্বর্ণচাঁপার উপাখ্যান, দাবানল, বেদবতী, জনপদ জনপথ, রানীরঘাটের বৃত্তান্ত, নিশিলতা, অলীক মানুষ, জানমারি, মায়ামৃদঙ্গ, নাগমিথুন, তৃণভূমি, কিংবদন্তীর নায়ক, আনন্দমেলা, সোনার ঠাকুর, শ্রেষ্ঠ গল্প, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ৫০টি গল্প, আমার প্রিয় গল্প, সেরা বড় গল্প, রাজার ঘাটের উপাখ্যান প্রভৃতি। সিরাজের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যরত্নের মধ্যে তৃণভূমি অনন্য। উপন্যাসটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় অধুনালুপ্ত ধ্বনি নামক একটি ছোট কাগজে।

তৃণভূমিতে বাক্য ও অনুপ্রাস ব্যবহার, শব্দের সঙ্গে শব্দের যে মাধুর্যমন্ডিত সমন্বয় তার সবই সার্থকভাবে করছেন লেখক। মানুষের সঙ্গে মানুষের যে ভালোবাসা, মাটির সঙ্গে মানুষের আজন্ম প্রেম অথবা বিবাদ, তাও দেখতে পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বারবারই কাব্যিক ভাষার দ্বারস্থ হয়েছেন, প্রতি ছত্রে-ছত্রে কবিতা যেন হানা দিয়েছে। সিরাজ যে প্রথম যৌবনে কবিতার হাত ধরে সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশাধিকার পেয়েছেন তা স্পষ্ট ধরা দেয়, কাব্যগন্ধি বাক্য-প্রয়োগে তাঁর সাফল্য অবশ্যই অনবদ্য। তৃণভূমির আদ্যোপান্তে একজন মানুষই কাহিনির মধ্যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থেকেছে, সে হলো বড়বাড়ির স্নাতক পাশ করা নিশানাথ। পাঠক একজন শিক্ষিত ধনীপুত্রের মাটির সঙ্গে সম্পর্কের ছবি দেখতে পাবেন। মানুষ যে কতভাবে, কত রকমে মানুষের  ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঘোষণা করতে চায় – আমি স্বাধীন, আমি মুক্তির আনন্দে হারাতে চাই মানুষেরই মাঝে। পাখিডাকা-ছায়াঘেরা সেই শান্তসুনিবিড় একটা গ্রাম অথবা দূর কোনো প্রান্তর, যেখানে মাটি-মানুষ আর আকাশ মিশে থাকে নদীর মতো, নদী আপন বেগে বহমান, তাকে আর থামায় কে, সে তো নিরবধি, কারো সঙ্গে কারো কোনো বিভেদ নেই, রূপ-রং-রসের কোনো বৈষম্য নেই, একটাই শুধু পরিচয় – মানুষ। পাঠক সমাজতন্ত্রের যে একটা আবহ দেখতে পান তৃণভূমিতে তা কি সত্যিই, নাকি নগরবিলাসের বহিঃপ্রকাশ। নিশানাথের চরিত্রের মধ্য দিয়ে সিরাজ বোঝাতে চেয়েছেন, মানুষ আসলেই প্রকৃতির সৃষ্টির একটা খেলা, এখানে মানুষ যেন সত্যিই অসহায়, কেউ কারো জন্য নয়, আবার সবাই সবার জন্য, মার্কসীয় দর্শন স্পষ্ট ফুটে উঠেছে উপন্যাসের মধ্যে।

তৃণভূমি উপন্যাসে জীবনের প্রকৃত রূপকেই সিরাজ কলমের অাঁচড়ে টেনে এনেছেন, কোনো কৃত্রিমতায় তিনি জড়িয়ে যাননি। বিদগ্ধ পাঠক ও সমালোচকদের মতে অবশ্য, ছোটগল্পেই সিরাজ অধিকতর সিদ্ধ সাহিত্যিক। তারপরও তাঁর সমস্ত সাহিত্যকর্মেই পাঠক দেখতে পান সাফল্য, বিষয়বৈচিত্র্যময়তা এবং প্রায় অনিবার্য পটভূমি বাংলার নিম্নবর্গীয় গ্রাম্যজীবন, যাদের সিরাজ তুলে এনেছেন মমতা এবং ভালোবাসার অাঁচড়ে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর গূঢ় অন্বেষণ মানুষ ও প্রকৃতি। মানুষ আর প্রকৃতির মাঝেই জীবন-জগৎকে বিচার করেছেন। উপলব্ধি করেছেন মানুষ এবং প্রকৃতির চিরকালীন বন্ধুত্ব। তৃণভূমি উপন্যাসে কান্দী মহকুমার এক বৃহৎ প্রান্তর ধরা পড়েছে, যার ভেতর দিয়ে উপন্যাস এগিয়ে গেছে নদীর মতো তরতর করে। নদী শুধু নদী হয়েই থাকেনি, সে-নদী হয়ে গেছে জীবন ও জগতের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ, জীববৈচিত্র্যের নানান জটিল বিষয় সেলুলয়েডের মতো ভেসে আসে, আর তখনই মনে হয় জীবন বুঝি একটা সাধারণ কিছু, বেশি বা বড় করে দেখার মতো কিছুই নয়। সিরাজের তৃণভূমি উপন্যাসটি ঘিরে আছে মুর্শিদাবাদের দ্বারকা নদী। মূলত দ্বারকা নদীই তৃণভূমির প্রাণ। এর সবুজ প্রান্তের তৃণমূল মানুষের জীবন-জীবিকা। চাষিরা অবিরাম লড়াই করছে রাজনৈতিক অধিকারের জন্য, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না হলে যে একজন মানুষ প্রকৃত মানুষ হয় না, সে-অবস্থার উন্নতি করার প্রত্যয় নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন মানুষ লড়ে যাচ্ছে। জীবনভর শুধুই লড়ে যাচ্ছে মানুষ, কিন্তু তাতে কি এমন লাভ হচ্ছে? খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার মতো কিছু কি পাচ্ছে? নাকি শুধুই গঞ্জনা আর লাঞ্ছনা প্রাপ্য?

উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নিশানাথ, যে কিনা প্রকৃতির মতো সহজ-সরল, কিছুটা রহস্যময়। তার রহস্যময়তা তৃণভূমির ভূপ্রকৃতির সঙ্গে অনেকটা খাপ খাইয়ে গেলেও কখনো মনে হয়েছে বেপরোয়া তার গতি। মানবজীবনের হাসিকান্না, সমাজের ভাঙাগড়া তৃণভূমি ও নদীপ্রবাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তৃণভূমির (১৯৬৭) পটভূমি রাঢ়ের অপর অঞ্চল মুর্শিদাবাদের দ্বারকা নদীতীরবর্তী তৃণাঙ্গন সোনাটিকুরি পেরিয়ে ঢালু আবাদি মাঠের পর কূলহীন ধূসর সমুদ্রের মতো তৃণভূমি। হিজরোল গ্রাম পেরিয়ে সোনাটিকুরির মাঠ, এই মাঠে ভিজে মাটির বুকভরা মিয়ানো ঘাসের ওপর ঠান্ডা নীল শরীরে সারাটি দিনের রোদ্দুর আর শেষচৈত্রের রাত্রিবেলার অবশিষ্ট শিশির জমে। বিলবাঁওড় থেকে হিজরোল গ্রামে যাওয়ার পথে মরাডুঙরির বটতলায় দাঁড়িয়ে দেখা যায় চৈত্রদিনের নিসর্গদৃশ্য। জমিদারবাড়ির বড় তরফের কর্তা আদিনাথ, তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী অর্থাৎ নিশানাথের মা অগ্নিদগ্ধ হলে সরযূকে বিয়ে করে, সে যদিও বরাবরই বিষয়ী, কামুক প্রকৃতির, পরস্ত্রী-আসক্ত। রাখাল কবিরাজের অপঘাতে মৃত্যু হলে তার বিধবা অল্পবয়সী স্ত্রী চন্দনাকে বারবার কুপ্রস্তাব দেয় জমিদার। এমনও কথা ওঠে, জমিদারই রাখাল কবিরাজকে লোক দিয়ে মেরে ফেলেছে। সাত গাঁয়ের লোকের মতো নিশানাথও তা বিশ্বাস করত। জীবন এখানে সত্যিই রহস্যময়, তল পাওয়া যায় না, শুধুই হাতড়ে বেড়ানো। আমরা দেখি আদিনাথ এমন চরিত্রের মানুষ ছিল, যে শুধু চন্দনা নয়, এমনকি চন্দনার বান্ধবী ঝুমরিকেও কুকথা বলে; কিন্তু চন্দনাকে নিজের করে পেতে আদিনাথ কান্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে, নিজের মান-সম্মান বিসর্জন দিয়ে রাতের অন্ধকারে ছুটে যায় চন্দনার ঘরে। একদিন পুত্র নিশানাথের সঙ্গে তার সংঘাত বাধে, লজ্জায়-অপমানে আদিনাথ আত্মহত্যা করে। পিতাকে হত্যা করতে যাওয়ার অপরাধে সরযূ সৎপুত্র নিশানাথকে চাবুক মারে, তারপরই নিশানাথ গৃহত্যাগী। পাঠক দেখেন মূল কাহিনি তাকে ঘিরেই। তৃণভূমি উপন্যাসের নিশানাথ জমিদারবাড়ির ছেলে হলেও সে প্রকৃতিচর মানুষ। সে খুঁজে দেখে দিগন্তে-দিগন্তে ঘন নীল কুয়াশায় জমে আছে পৃথিবীর অশেষ রহস্য। সৎমা সরযূকে সে শ্রদ্ধা করে কিন্তু ভালোবাসতে পারে না। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা নেই, বাবার লাম্পট্য তাকে বরাবরই ক্ষুব্ধ করে, নিজের প্রতি ঘৃণা হয়। গোপন অভিসারী বাবাকে হত্যা করতে গিয়ে সৎমায়ের হাতে চাবুক খেয়ে ঘর ছাড়ে, আশ্রয় নেয় চাষাভুসোদের খামারে। প্রকৃতিকে

নিবিড়ভাবে অনুভব করে এবং নিজেকে প্রকৃতির অংশ জ্ঞান করে, এভাবেই নিশানাথ মাটির মানুষে রূপান্তর হয়। নিশানাথ কিন্তু বরাবরই প্রকৃতির প্রতিনিধি, তার রাগ-কাম-প্রেম প্রকৃতির মতো অনাবৃত-উদ্দাম, তাই চন্দনার ঘরে মাঝরাতে সে যেতে পারে,  চিঁড়ে-ফলার খায়, আবার তাকে আদিম কামনায় গাঢ় আলিঙ্গন করে। ভালোবাসার অনেক রূপ যেমন আছে, দেহ ছাড়া তো ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই, শরীর দিয়েই তো ভালোবাসাকে জয় করতে হয়, এখানে তারই চিত্র দেখা যায়। ভালোবাসার সঠিক রূপ এবং রসের যে-গন্ধ পাওয়া যায়, তা সত্যিই পাঠককে অভিভূত করবে, মানুষ কি শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার কাছে পরাজিত, ভালোবাসাই পারে মানুষকে সুন্দর পথের সন্ধান দিতে। তৃণভূমি প্রকৃত অর্থে সাহিত্যজীবনের স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা সিরাজের জীবনে। তৃণভূমি তাঁকে এনে দিয়েছে মানসিক তৃপ্তি, যদিও সাহিত্যিকের কোনো তৃপ্তি নেই, তারপরও সিরাজ মানুষের হৃদয়ে একটা বড় রকমের আসন গেড়ে নিতে পেরেছেন। তারাশঙ্করের সমগোত্রীয় রূপকার হিসেবে নিজেকে উন্মোচিত করলেও তারপরও কোথায় একটা স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়; কিন্তু তা সত্ত্বেও দুজনই তো রাঢ়বঙ্গের জীবনাচরণ, মানুষ ও প্রকৃতি এবং সেই সমস্ত খেটে খাওয়া নিরন্ন মানুষকেই তুলে এনেছেন তুলির অাঁচড়ে, যারা দিনমান কঠোর কাজ শেষে মনের সুখে গান গায়, ভালোবাসার গল্প বলে, কেউ হয়তো সামনের স্বপ্ন দেখে, আগামী তাদের কাছে শুধুই কি স্বপ্ন, কখনো হয়তো জীবনটাই একটা ভেলকিবাজি তাদের কাছে, তারপরও তারা বেঁচে থাকে, এই বাঁচার জন্যই যেন জীবন। সিরাজ তুলে এনেছেন তাদের আদিমতা-বন্যতা এবং বন্য প্রকৃতি, তৃণভূমির মধ্যে জীবন ও জগতের যে-সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছেন, তা সার্থকভাবেই পেরেছেন। দ্বারকা নদীর বিস্তীর্ণ তৃণাঞ্চল বা জমি (খাড়ি জমি) জঙ্গল, মানুষের আবেগ-ক্রোধ-হিংসা-প্রেম-সহজ-সরল জীবনাচরণ, যৌনতা-দ্বেষ সর্বোপরি পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা নিয়েই তৃণভূমি গড়ে উঠেছে। তারপরও শুধু যে গ্রাম্য জীবনাচরণই ফুটে উঠেছে  তা-ই নয়, রাজনৈতিক আবহাওয়াও সত্য হয়ে এসেছে। আরো আছে বৈপ্লবিক ভাঙাগড়া। অবশেষে চন্দনা কমরেড হয়ে যায়, জীবন থেমে থাকেনি, দ্বারকা নদীর মতো প্রতিনিয়ত অতিবাহিত হতে থাকে। উপন্যাসে চরিত্রের শেষ নেই, কত মানুষ যে এসেছে, কেউ ভালো, কেউ মন্দই নয় পিশাচ, তারপরও জীবন যেখানে থেমে থাকেনি, সেখানে তো জীবনের ঘনঘটা চলতেই থাকবে। রাখাল কবিরাজ-আদিনাথ-নিশানাথ-সরযূ-চন্দনা-শুভেন্দু-সীতা-ঘুমরি যেমন এসেছে, অন্যদিকে সুখময় বসু-সৌমেন চ্যাটার্জি-মাধবী-ফিলিপ ডাক্তার-অরুন্ধতী-মানিক-তোরাপ-হামিদ-গণেশ বাউড়ি-সোহাগী প্রভৃতি। আবার পাখিধরা সুধন্য সামান্য একটা মানুষ হলেও তার মধ্যে মানবিকতার কমতি নেই। পেটের দায়ে পাখি ধরে বিক্রি করে, বনে-জঙ্গলে ঘুরতে-ঘুরতে সে নানান দৃশ্যের মুখোমুখি হয়, মানুষের পশুরূপ দেখে বিস্ময়ে হতবাক, ঘরে বউ হৈমকে খুনে টিকুরের সঙ্গে গোপন সঙ্গমে দেখে, মানুষ এতখানি খারাপ হতে পারে! নিশানাথের ঘরত্যাগী সর্বত্যাগী রূপ সুধন্যের বড় ভালো লাগে। একসময় তৃণভূমির রৌদ্রময় ব্যাপকতায় তার মন বড় বেশি উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, নিজেকে ধরে রাখতে পারে না, পাখির খাঁচা ভেঙে সে পাখি ধরার ব্যবসা ছেড়ে দেয়, তার মধ্যেও আরো চরিত্র সেলুলয়েডের ফিতের মতো আসতেই থাকে, গঙ্গু-প্রহ্লাদ-উদ্ধব-হাজি সাহেব। তৃণভূমি জুড়ে শুধু ভালোবাসা-ভাঙাগড়া, হাসি-কান্না, সংগ্রাম, বেঁচে থাকার অধিকার আর সামনে এগোনোর পদক্ষেপ। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে কখনো হঠাৎই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাসুলী বাঁকের উপকথা বা কালিন্দীর কথা মনে পড়ে যায়। প্রকৃতি আর মানুষকে খুব কাছ থেকে না দেখলে তো এমনভাবে বলা যায় না। বর্ণনাও বেশ কবিত্বময়, কবিতা যেন নূপুরের তরঙ্গে ছুটে-ছুটে আসে, এমন করে বুকের মধ্যে কে পারে অাঁচড় দিতে, জীবনশিল্পী না হলে কি পারে জীবনের ভেতরে একেবারে ঢুকে গিয়ে জীবনের গল্প বলতে? একটা উদাহরণ না দিলে কি পারা যায়, এমনই একটা প্যারা তুলে দিলাম –

শুক্লপক্ষ শেষ হয়ে কৃষ্ণপক্ষ এলো, বিস্তৃত প্রান্তরে মাথার ওপর রাতের আকাশে অজস্র উজ্জ্বল নক্ষত্র, নক্ষত্র দেখতে-দেখতে তার মন চলে যায় ইতিহাসের দিকে, আর্যরা নাকি এমনি পশুপালক ছিলো, এমনি বনে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতো তারা, নক্ষত্র দেখতো, নক্ষত্রের নাম রাখতো, ভাবতে অবাক লাগে, হঠাৎ নিজেকে মনে হয় সেই যূথবদ্ধ মানবগোষ্ঠীর দলভ্রষ্ট একজন। এতো দূরে চলে এসেছে, স্থানকালগত এতো গভীরতর দূরত্ব যে আর কেউ তাকে চিনতে পারবে না, সে কোথায় যাবে?

আর একটি প্যারাতে যে-বর্ণনা আছে তাও অসাধারণ, এখানে সেটুকু দিলাম : ‘বর্ষার আভাস দেখা দিলো এতোদিনে। টিয়াপাখিদের গায়ের রঙ অসম্ভব রকমের সবুজ হয়ে উঠলো, গাছপালায় ঘাসে নেশা ধরে গেলো রঙের, বিলের জল ঘোলাটে হয়ে পড়ছে, আকাশে মেঘের আনাগোনা, কিছুদিন পরই সারা তৃণভূমি জলময় হয়ে যাবে। অবশ্য বাথানটা উঁচু জায়গায়, ডুববে না, যদি ডোবার উপক্রম হয়, মানিকরা কিছুদিনের জন্যে গ্রামে চলে যাবে মোষ নিয়ে, কেউ-কেউ যাবে দূর বিহারের দুমকা-সাঁওতাল পরগনার পাহাড়ি অঞ্চলে, ওখানে অনেকের আত্মীয়-স্বজন আছে।’

এই ব্যানাকোশের বন আর বিল অঞ্চলের নিসর্গ প্রকৃতি যেমন মাঝে-মাঝে উদ্দাম হয়ে ওঠে, তেমনি উদ্দাম হয়ে ওঠে এখানকার মানুষ, হিন্দু-মুসলমান নরনারী, সবার ওপরই এই তৃণভূমির প্রভাব পড়েছে। হিজরোলের ছোট চৌধুরী আদিনাথ বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যা করে, তার দ্বিতীয় স্ত্রী সরযূ প্রতিশোধস্বরূপ সৎপুত্র নিশানাথকে চাবুক মেরে ক্ষতবিক্ষত করে, বাপের প্রতি অশ্রদ্ধা আর ঘৃণা থেকে নিশানাথ বন্দুক তোলে।

তৃণভূমি উপন্যাসে এটাই বড় সত্য, সামান্য একটা চন্দনা হয়ে যায় প্রধান চরিত্র, যে সত্যি-সত্যি ভালোবাসে নিশানাথকে, এই ভালোবাসার মধ্যে কোনো জোরজবরদস্তি ছিল না, প্রকৃতির মতো সহজ-সরল একটা প্রেমকে সিরাজ অত্যন্ত মানবিক দৃষ্টি দিয়ে দেখিয়েছেন। ভালোবাসা কারো ভয় করে না, সে সর্বদাই নির্ভীক এবং গতিশীল। নিশানাথ যেভাবে ভালোবেসেছে প্রকৃতিকে, তেমনি ভালোবেসেছে চন্দনাকে – এই দুই ভালোবাসার মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। তারপরও চন্দনাকে পাওয়া হয় না, চন্দনা সেই অধরাই রয়ে যায়, অথবা চন্দনা চেয়েও পেল না নিশানাথকে – কেউ কারো মনের কথা বলতে পারেনি, সবই কেমন ধোঁয়াটে রয়ে যায়। শুধু মনের ভেতরে ভালোবাসা মোমের আলোর মতো জ্বলতে থাকে। অসাধারণ একটা উপন্যাস তৃণভূমি, যার পরতে-পরতে অন্যরকম ভালোবাসা এবং আকর্ষণ রয়েছে, প্রকৃতি যে এভাবে টানতে পারে, তৃণভূমিতে সিরাজ তা তুলে এনেছেন এবং এখানেই তাঁর সাহিত্যজীবনের চরম সার্থকতা।