‘তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে’

সুধীর চন্দ

পদ্মার পারে লালন ফকির গান গেয়েছিলেন, –
‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
তারে ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতাম তারি পায়’
– এই অচিন পাখি রবীন্দ্রনাথকে চিরমুগ্ধ করে রেখেছিল। জীবনভর তিনি অচিন পাখির খোঁজ করে গেছেন। পেয়েছিলেন কি-না বলেননি। খোঁজাটাই আসল। আমরা রবীন্দ্রের মধ্যে অচিন পাখির ঠিকানার আভাস কখনোবা পেয়ে যাই। রবীন্দ্রনাথ অচিন পাখির হদিস পেয়েছেন নিশ্চয়, তবে তা কবুল করেননি। অচিন পাখি চিরকাল বিচিত্র পরিবেশে তাঁকে ডাক দেয়, দু-একবার সে ডাকের শরিক আমরাও হয়ে যাই। কখনো, – ‘একদিন বোলপুরের রাস্তা দিয়া কে গাহিয়া যাইতে ছিল…’ আবার কখনো কলকাতার রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ শুনতে পায় অচিন পাখির খোঁজে বিবাগী কারো গান। কখনো ‘বকুলবনের পাখি’কে অচিন পাখির কথা জিজ্ঞেস করেন। বকুলবনের পাখিই অচিন পাখি নয় তো! –
… শোনো শোনো ও গো বকুল-বনের পাখি
আরবার তারে ফিরিয়া ডাকিবে না কি?
যায় নি সেদিন যেদিন আমারে টানে,
ধরার খুশিতে আছে সেসকল খানে;
আজ বেঁধে দাও আমার শেষের গানে
তোমার গানের রাখি।…

সেই, ‘একদিন বোলপুরের রাস্তা দিয়া কে গাহিয়া যাইতে ছিল…’, ওই গানের রেশ তাঁর শান্তিনিকেতনে আরেককালে আমরাও কি শুনতে পাইনি!
– অবশ্যই শুনেছি, – শান্তিনিকেতনকে শিলাইদহ-পদ্মাপারের পুনর্জন্ম। শান্তিনিকেতন-পরিচিন্তার প্রাথমিক রূপায়ণ তো ঘটেছিল শিলাইদহ-পদ্মাপারে। সেই পদ্মাপার কখনো বুঝি এসে যায় বোলপুরের রাস্তায়, আবার কখনোবা ‘গোরা’র কলকাতায়।
শান্তিনিকেতনের শিক্ষাযাত্রায় সেই প্রথম থেকেই আসলের চাইতে ফাউয়ের পাওনাটা ছিল অনেক বেশি, অনেক আসল। সেই আসল এখনো যে নেই তা নয়। সেই ফাউ, সেই উদ্বৃত্তের পাওনা, পরীক্ষাপাশের বুড়ি ছোঁয়াকে অনেক পেছনে ফেলে যায়। শান্তিনিকেতনের অনিচ্ছুক মেয়াদ ফুরোবার পর বৃহত্তর জগতের মোকাবিলা করতে গিয়ে অবশ্যম্ভাবী বোধোদয় হয়, এই উপচেপড়া পাওনাই জীবনের ধন।
আমাদের কালে সেই উনিশশো চল্লিশের দশকের শেষদিকে, অর্থাৎ বছর ষাটেক আগে, শান্তিনিকেতনের গানের দুয়ার ছিল হাট করে খোলা। তখন রবীন্দ্রনাথের গান পুরো শান্তিনিকেতনের গান। তখন বিশ্বভারতীর বিভিন্ন বিভাগ ছিল, – পাঠভবন মানে স্কুল, শিক্ষাভবন – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত কলেজ, বিদ্যাভবন – øাতকোত্তর গবেষণা বিভাগ। আর শান্তিনিকেতনের বিশেষিত বিভাগ শিল্প প্রশিক্ষণের কলাভবন  এবং সংগীতভবন। কলাভবন এবং সংগীতভবনই বিশ্বভারতী – শান্তিনিকেতনের মুদ্রাচিহ্ন। অধিকন্তু চীন-ভারত ইতিহাসের গবেষণা বিভাগ চীনভবন। – সংগীত ও কলাভবনের দ্বার অন্যসব ভবনের উৎসুক শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত। তার জন্য অতিরিক্ত কড়ি গোনবার ব্যাপার নেই।
শান্তিনিকেতন আশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার শুরু থেকেই সংগীত, প্রশিক্ষণের অঙ্গ। দিনেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনবাসী হলেন এবং রবীন্দ্রনাথের গানের তরীর পালে নতুন হাওয়া লাগলো। দিজেন্দ্রনাথ সার্থক গায়ক ও গীতশিক্ষক অবশ্যই, অধিকন্তু তিনি এক অতুলনীয় শ্র“তিধর স্বরলিপিশিল্পী। তাঁকে পেয়ে রবীন্দ্রনাথের কাব্যগীতি-সুরের নির্মাণশালায় এক সৃষ্টি প্লাবন তো আসবেই। আর ব্যাপার হলো, রবীন্দ্রনাথ অনেক সময়েই গান তৈরি করে তার সুরটিকে পরে ঠিকঠিক মনে রাখতে পারতেন না, সুর অন্যরকম হয়ে যেত। একটি সুরের জায়গায় আর এক সুন্দর সুরান্তর এসে দখল নিত বটে, কিন্তু সুরস্রষ্টার কাছে হারানো সুরের দুঃখ সান্ত্বনাতীত। তবে সব দ্বৈত সুরই যে হারানো সুর তা নয়। কবি অনেক গানেই কালান্তরে সুরান্তর করেছেন, তাতে একই গানের ঘটেছে রূপান্তর – এক প্রায় নতুন গান, দুই ভিন্নতর অনুভবমাত্রা। এই ঘটনা কেবল রবীন্দ্রনাথের গানের বেলায়ই ঘটে যেতে পারে।
এইরূপ যমজ গানের কয়েকটির সঙ্গে আলাপ হলে মন্দ কি! –
দুই সুরের গান :
– বসন্তে কি শুধু কেবল ফোটা ফুলের মেলা রে –                                                               বাউল/ বাহার
– ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো আমার মুখের আঁচলখানি –                                         দেশ/ হাম্বির
– লক্ষ্মী যখন আসবে তখন কোথায় তারে দিবি রে ঠাঁই                                                 – ভৈরবী/ বাউল
– বসন্তে-বসন্তে তোমার কবিরে দাও ডাক –                                                    রামকেলী/ ইমন
– হে সখা, বারতা পেয়েছি মনে মনে – সোহিনী/                                                               বেহাগ
– আমার কী বেদনা সে কি জানো – কীর্তন/ সোহিনী
– ধূসর জীবনে গোধূলিতে – কাফি/ সোহিনী
– আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে – কাফি/ মল্লার ইত্যাদি
রবীন্দ্রের সুরান্তরিত গান বুঝি কবির, –
অতীতকালের স্বপ্ন এলে
নূতন কালের বেশে।
স্বরলিপিতে সুরকে ধরে রাখার কৌশলটি রবীন্দ্রনাথ আয়ত্ত করার খুব একটা প্রয়াস করেননি। স্বরলিপি-কুশলী দিনেন্দ্রনাথকে পেয়ে তাঁর গানের স্থায়িত্ব সম্বন্ধে তিনি নিশ্চিন্ত। উনিশশো চোদ্দ নাগাদ রবীন্দ্রনাথ যখন শ্রীনিকেতনে বাস করছেন তখন রোজ নতুন তৈরি গান গলায় নিয়ে তিনি গরুর গাড়িতে চড়ে শান্তিনিকেতনে দিনেন্দ্রনাথের ‘রেণুকুঞ্জ’ কুটিরে আসতেন। ঝড়জল মানতেন না, পাছে সুর লুকোচুরি খেলতে চায়। গালগল্প মনে হয় না কি! – তার অল্পকাল আগে রায়পুরের সিংহদের কাছ থেকে শ্রীনিকেতনের এই বাড়ি রবীন্দ্রনাথ ক্রয় করেন। রায়পুরের সিংহ অর্থাৎ লর্ড সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহদের একটি বাড়ি। পুনরুক্তিতে অন্যায় হবে না, শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতীর সম্পূর্ণ জমি ছিল রায়পুরের সিংহদের। শ্রীনিকেতনের আদি নাম সুরুল গ্রাম। এই বাড়ি আমাদের কালে শ্রীনিকেতন পল্লী উন্নয়ন বিভাগের অন্তর্গত ছিল।
শ্রীনিকেতনের এই বাড়ি রবীন্দ্রনাথের গোটাপঞ্চাশেক গানের আবির্ভাবের সাক্ষী। তাদের সুরকে কাগজে-কলমে চিরসঙ্গী করে রাখার জন্যই কবির দিনেন্দ্রনাথ-যাত্রা।
আচ্ছা, গরুর গাড়ির যাত্রী এই রবীন্দ্রনাথকে, রাস্তার পাশে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে আর একটুক্ষণ চেয়ে দেখতে কি ইচ্ছা হয় না! – গরুর গাড়ি, কারণ ওই ‘পথ’ অন্য কোনো বাহনের অগম্য। এমনকি হাঁটাও কষ্টকর। পায়েচলা মেঠো রাঙামাটির পথ, খানাখন্দে ভরা, গরু-মোষের গাড়ির চাকার গভীর চোরা ফাঁদ, দু-ধারে ঊষর ডাঙা প্রান্তর। সেই বিপথ ধরে দৈনিক আসা-যাওয়ায় গতির চাইতে দুর্গতি বেশি। – উনিশশো চোদ্দ নাগাদ ঝাঁকুনিসর্বস্ব ওই গরুর গাড়ির আরোহী নোবেল-লরিয়েট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই মাথাঠোকা ঝাঁকুনির মধ্যেও কিন্তু চলেছে গান তৈরি। তাদের কারো-কারোর সঙ্গে পরে আমাদের পরিচয় হয়েছে। গরুর গাড়ির কাছে সেজন্য আমাদের ঋণী থাকতে হবে। তাদের কয়েকটিকেও ডাকবো কি? –
‘গরুর গাড়ির গান’, –
– আমার সকল রসের ধারা
তোমাতে আজ হোক-না হারা…

– শরত-আলোর কমলবনে
বাহির হয়ে বিহার করে…

– আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে…

– পথ দিয়ে কে যায় গো চলে
ডাক দিয়ে সে যায়…

– তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে
টুকরো করে কাছি
আমি ডুবতে রাজি আছি…

–  তোমার এই মাধুরী ছাপিয়ে আকাশ ঝরবে,
আমার প্রাণে নইলে সে কি কোথাও ধরবে…

–  মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে
একেলা রয়েছ নীরব শয়ন-’পরে…

–  চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে…
এবং আরো অনেক।
আশ্চর্যের বিষয়, ‘গরুর গাড়ির গান’ প্রায় সবই আধ্যাত্মিকতার সংগীত। শ্রীনিকেতন রাস্তার সেদিনের উদাস নির্লিপ্ত সীমাহীন প্রকৃতি কবিকে হয়তো পৃথিবী পার করে দেয়।
আমাদের শান্তিনিকেতন, সরকারি স্বীকার না-পাওয়া এক শিক্ষাকেন্দ্র। সরকারি স্বীকৃতি নেই কিন্তু বিশ্বের স্বীকার-ধন্য একমেবাদ্বিতীয়ম এক বিশ্বভারতী। উপাচার্য রবীন্দ্রপুত্র রথীন্দ্রনাথ, পতœী প্রতিমা দেবী। আছেন ছিন্নপত্রের ইন্দিরা দেবী, রয়েছেন  শিল্পী-পথিকৃৎ নন্দলাল-সুরেন্দ্রনাথ কর-বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়-রামকিঙ্কর বেইজ। এবং ক্ষিতিমোহন সেন-প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়-হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়-রাণীচন্দ। তাঁরা সবাই              শান্তিনিকেতনের দৈনন্দিনতায় দেখা হয়ে যাওয়ার মানুষজন। অধিকন্তু বেশকিছু বিদেশি জ্ঞানসন্ধানী। আর চীনভবনের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক তান্ ইউন্ শানের চাইতে ‘শান্তিনিকেতনী’ আর কে!
আমাদের সময়ে দিনেন্দ্রনাথ ছিলেন না, কিন্তু ছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ। ছিলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী। এবং প্রতীকরূপী গায়িকাগণ, অপরূপ গীতভঙ্গি নিয়ে পরোক্ষ শিক্ষক। আর ছিলেন এস্রাজের সুরলোকের শিল্পগুরু অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
আমার সঙ্গে শান্তিনিকেতনের প্রথম আলাপ উনিশশো ঊনচল্লিশ সালে। শান্তিনিকেতনে মামার বাড়ি। আমার ন-দশ বছর বয়স। স্মরণের ধূসর অন্তরাল থেকে মনে আসে, গুরুপল্লীর সুরধুনী দি’রা তখন একটি গান গাইতেন, –
হায় হায় হায় দিন চলি যায়
চা-স্পৃহ-চঞ্চল চাতকদল চলচল চলছে…।
– আমার রবীন্দ্রসংগীত পশ্চাৎপটহীন বাল্যকালে এ-গানের সুরটি কিন্তু অজান্তে ফল্গু তানের মতো সুপ্ত রয়ে গিয়েছিল। ওই গান উনিশশো চব্বিশে ‘চা-চক্রের’ উদ্বোধন সংগীত। ‘চা-চক্রের’ কোনো নিজস্ব জায়গা ছিল না। বেণুকুঞ্জের পাশে ‘চা-চক্র’ স্থাপত্যটি দিনেন্দ্রনাথের স্মৃতিতে তাঁর পতœী কমলা বৌঠানের দানের টাকাতে তৈরি। রবীন্দ্রনাথ নাম দিলেন ‘দিনান্তিকা’। সে ঊনচল্লিশ সাল, আমার প্রথম শান্তিনিকেতন সন্দর্শন। ‘চা-স্পৃহ-চঞ্চল’ গানটি তখন নতুন করে আবার শান্তিনিকেতনের জীবনচর্চার সঙ্গে মিলে প্রতিধ্বনি তুললো। সেই সুর আমার আনপড় মনের কোণে লুকিয়ে রইল।
ওই সময়ে ‘দই চাই গো দই চাই’ ইত্যাদি চণ্ডালিকার গান তাদের বাউল-কীর্তন অঙ্গের বিশিষ্ট ভঙ্গি নিয়ে মনের গভীরে কোথাও একটা দাগ রেখে গিয়ে থাকবে, অনেক পরে তা বুঝতে পেরেছি।
সেই উনচল্লিশে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু আমাকে দেখা দেননি। তিনি ‘মংপু’ পাহাড়ে, মৈত্রেয়ী দেবীর আতিথ্যে।
তারপর তো উনিশশো একচল্লিশে ‘শান্তি পারাবারে’ তিনি তাঁর তরণী ভাসানোর কর্ণধারকে ডাক দিলেন, চোখের দেখা আর হলো না।
একান্ত কোনো নিদ্রাহীন আঁধারে ওই উনচল্লিশ ফিরে আসে, – তার গৈরিক রাঙামাটির পথের দিগন্তমুখীনতা, সাঁওতাল দলের দিনশেষে ঘরে ফেরার গলা মিলিয়ে গানের ঢেউ, সঙ্গী বাঁশির উদাস তান, স্তব্ধ তালপুঞ্জ, – সেই রাঢ় জল-মাটির অচেনা বর্ণ-গন্ধ, – এক স্বপ্ন ভালোবাসা।
উনিশশো আটচল্লিশে পুনরাবর্তন। শান্তিনিকেতন।
শিক্ষাভবনে বিএ ক্লাসের ছাত্র। হোস্টেলে থাকি। ভারতের নানান রাজ্য ও বিদেশি ছাত্ররা থাকে আমাদের সঙ্গে। আমার পাশের ঘরে থাকে ইন্দোনেশিয়ার ইভা বাগুস্ মন্ত্র। মন্ত্র পরে ভারতে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত হয়েছিল। আছে চীন থেকে আসা আমার ক্লাসের হাও-কাং-ফা এবং পে-মে-লং। আরো আছে আফ্রিকার কেনিয়ার ডেভিড ও-কেলো আর ঘানার এডোয়ার্ড কুফুর। কালের সঙ্গে পৃথিবী অন্যরকম, ওই নামগুলো ঠিক রয়ে গেছে মনের কোণে। মনে পড়ে তখনকার পূর্ববাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছিল বীথি মালিক – বড় পরিবারের ইন্টেলেকচুয়েল মেয়ে। এসেই কলেজ ম্যাগাজিনের কাজ হাতে নিয়েছিল। সে ছিল সপ্রতিভ এক born leader। তখনো বেশ কিছু পূর্ববাংলার ছাত্র শান্তিনিকেতনে আসতেন। তাঁদের একজন পরবর্তীকালের বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের অমর শহিদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও তাঁর ছোট ভাই লুৎফুল।
গাছের নিচে ক্লাস। ছেলেমেয়েরা গোল হয়ে মাটিতে বসে। সেখানেও ভারত ও বিশ্ব এক হয়ে গেছে। মাস্টারমশাইরা ‘দাদা’। যেন এক খেলাঘর। গানের এক আবহ দিনযাপনের পশ্চাৎপট।
রবিহীন শান্তিনিকেতন। রবি অস্তমিত, কিন্তু তার অস্তআভা দিগন্ত-আকাশকে রাঙিয়ে রেখেছে।
একদিন হোস্টেলের একটি দক্ষিণ ভারতীয় ছেলে আমাকে ডেকে বললো, ‘আমরা গানের ক্লাসে যাই, তুমি আস না কেন?’ ‘আমি গান তো কখনো গাইনি।’ ‘তা আমরাও কি গেয়েছি? চলো তুমিও যাবে।’ ওই দক্ষিণ ভারতীয় ছেলেই আমাকে ধরে শিক্ষাভবনের গানের ক্লাসে নিয়ে এলো। সেই শুরু। রবীন্দ্রসংগীতের ইন্দ্রজাল-দিগন্ত আমার ক্ষুদ্র গবাক্ষটির সীমানায় এসে দাঁড়ালো।
তখন তো রবীন্দ্রনাথের গান সারা শান্তিনিকেতনের গান। শৈলজারঞ্জন মজুমদারের পরিচালনায় সংগীতভবন সেই গানের প্রশিক্ষক, এবং সব বিভাগের গানপিপাসু তার শিক্ষার্থী। খালি গানই নয়, নৃত্য ও যন্ত্রসংগীতও সবাইকে ডেকে নেয়। রবীন্দ্রনাথের গানের এই সর্বজনীনতার প্ররোচক অবশ্যই শান্তিনিকেতনের বাঁধা বাৎসরিক গীতনৃত্যোৎসব, – বর্ষামঙ্গল-বসন্তোৎসব-বৃক্ষরোপণ-হলকর্ষণ এবং মাঝে-মাঝে দীর্ঘ প্রস্তুতির পর কোনো গীত বা নৃত্যনাট্যের প্রযোজনা। শান্তিনিকেতনের গীতনৃত্যোৎসব বিশ্বভারতীর প্রশিক্ষণের বিশেষিত অঙ্গ। সেই বিশেষণের দৈনন্দিনতা ভোরবেলার সব বিভাগের ক্লাস শুরু হওয়ার আগের সমবেত বৈতালিক গান এবং বুধবারের মন্দির অনুষ্ঠান। মূর্তিহীন বিশ্বজনীন মন্দির। প্রতিমাসে এক সপ্তাহ এক-এক বিভাগ বৈতালিক এবং সপ্তাহ শেষের বুধবার মন্দিরে গান পরিবেশন করে। সংগীতভবন ছাড়া অন্যান্য বিভাগের সাপ্তাহিক দুদিনের বিশেষ শেখা গান বৈতালিক ও মন্দিরের গানের ভাণ্ডার। যন্ত্রসংগীত হিসেবে, শিক্ষক মহাশয় এস্রাজ এবং গায়কদের মধ্যে কেউ তানপুরা বাজাতেন, – হারমোনিয়মের ব্যবহার ছিল না।
আমাদের গানের ঝুলি ভরা শুরু হয়েছে বৈতালিক ও মন্দিরের জন্য শেখা গান দিয়েই।
আমি সংগীতভবনের ছাত্র নই বলে গান শেখা নিয়মমতো হতে পারেনি। তবে ওই কালের শান্তিনিকেতনের অনুষ্ঠান তো সারা  শান্তিনিকেতনের অনুষ্ঠান – বিভাগ বা ভবন নির্বিশেষে। যাদের গলায় সুর আছে তারাই বর্ষামঙ্গলে বা বসন্তোৎসবের সমবেত সংগীতে স্থান পেত। কার গলা কেমন তার যাচাই হয়ে যেত ভোরের বৈতালিক ও মন্দিরের গানে, এবং ‘সাহিত্যিকা’ বা সভা-সমিতির উদ্বোধনী সংগীতে, আর শ্রাবণ ও বসন্ত পূর্ণিমা, সাতই পৌষের ভোর ও রাত্রির বৈতালিক ইত্যাদি বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিতে। মনে পড়ে, বর্ষামঙ্গলে প্রথমবার স্থান পাওয়ার কথা। কে মহড়াতে ডেকে নিয়েছিলেন সে তো মনে নেই। সংগীতভবনের দক্ষিণ-পুব কোণের হলঘরে রিহার্সেল। জনা পঞ্চাশেকের পেছনে বসে গলা মেলানোর চেষ্টা করছি। এক স্বর্গসভার গান উঠছে –
ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে
জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে
ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা
শ্যামগম্ভীর সরসা।
– আমার নন্দন অনুভূতির সুদূর অস্পষ্ট প্রান্তদেশ থেকে প্রবাহিত হচ্ছে এই বাকধ্বনি ও সুর-ইন্দ্রজাল। এই সংগীতের আড়ালে এতকাল ছিলাম কী করে!
সেই রিহার্সেল-সভার সুরাঙ্গনে সামনের সারিতে বসে গান গাইছেন এমন কয়েকজন যাদের শান্তিনিকেতনের দৈনন্দিনতায় রোজ দেখতে পাই। নীলিমা গুপ্ত আমাদের গাছতলার ক্লাসের সহপাঠী, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় মোহরদি, শুভময় ঘোষ-ভুলু, আমার ক্লাসের বন্ধু, বিশ্বজিৎদা কলেজ শেষ করে সংগীতভবনে। সেই গানের মহড়ার মোহাবেশে এই প্রতিদিনের চেনা মানুষেরা যেন অন্য এক সমতলে, আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই মহড়া অভিষেকেই আবছা মনে পড়ে শুনেছিলাম নীলিমার গান, – ‘ঝরে ঝরো ঝরো ভাদরবাদর, বিরহকাতর শর্বরী’ – অবিশ্বাস্য! এ-গান যে গাইতে পারে, সে তো আর পাঁচজনের মতো মানুষ নয়!  – ওই সুরসভায় যেন আমার অনধিকার প্রবেশ। কিন্তু প্রবেশ অবশ্যই, এক অজানিত অভিষেক।
সে সম্ভবত উনিশশো ঊনপঞ্চাশ সাল। শান্তিনিকেতনে দোল পূর্ণিমাতে বসন্তোৎসব। উৎসবমঞ্চ হলো গৌরপ্রাঙ্গণের মাঠ।
অনেকটা জায়গা গোল করে চেঁছে গোবরমাটি লেপে স্টেজ বানানো হয়েছে, যাত্রার আসরের মতো। কয়েকটি বাঁশের খুঁটিতে গোটা চার-পাঁচ ফ্লাডলাইট। অ-মাইক গান-বাজনা। আবছা সিংহসদন পশ্চাৎপট। সেদিকে গাইয়ে-বাজিয়ে দল। আর তিনদিক ঘিরে শ্রোতা-দর্শক। তাদের মাঝে আমিও, আমার তখনো কোরাসের দলে ডাক পড়েনি। নন্দনলোকের অশ্র“তপূর্ব গান উঠেছে, –
যদি তারে নাই চিনি গো সে কি আমায় নেবে চিনে
এই নব ফাল্গুনের দিনে – জানি নে, জানি নে।
– গানকে অভিষিক্ত করছে অতিজাগতিক নৃত্য। এই নৃত্যপরাদেরই কি প্রত্যহ গাছের নিচের ক্লাসে দেখতে পাই! চেনা কিন্তু অচেনা, ধরা-অধরা। বেণুবন গান ধরলো, –
দখিন-হাওয়া জাগো জাগো, জাগাও আমার সুপ্ত এ প্রাণ।
– তারি তালে প্রবেশ করলো ‘প্রদীপশিখা’, গলা মিলিয়ে নৃত্যভঙ্গিতে, – ‘ধীরে ধীরে ধীরে বও ওগো উতল হাওয়া।’
– সম্পূর্ণ মৃৎমঞ্চ পরিক্রমা করে, – ‘নিশীথ রাতের বাঁশি বাজে – শান্ত হও গো শান্ত হও।’
– কিন্তু দখিন হাওয়া সে মিনতি পরিহাস করে নিবিয়ে দিলো প্রদীপশিখাকে। নিবন্ত প্রদীপশিখার গান কিন্তু হার মানলো না। – আমি ভাবছিলাম, প্রদীপশিখা তো আমার নিত্যদিনের গাছতলার ক্লাসের সহপাঠিনী, নীলিমা। অন্য এক ডাইমেনশন থেকে তার গান – প্রদীপশিখার গান।
উনিশশো ঊনপঞ্চাশ সালে শান্তিনিকেতনে World Pacifists’ Conference হয়েছিল খুব বড় করে। তখন পৃথিবীর অনেক বড় মানুষকে দেখেছি। মন্দিরের পাশে পুরোনো মেলার মাঠে তাঁদের জন্য তাঁবুর ছাউনি পড়েছিল। শৈলজাদা গানের পর গান শিখিয়ে চলেছেন। রোজ শেষরাতে আমরা গৌর প্রাঙ্গণে মিলিত হতাম। তাঁর খঞ্জনিটি হাতে অবশ্যই শৈলজাদা হাজির। হোস্টেল থেকে ছেলেরা, শ্রীভবন থেকে মেয়েরা, খোল গলায় ঝুলিয়ে শ্যামদা, তাঁরই আকারের বিরাট এস্রাজ কোমরে বেঁধে বিনায়ক মাসোজি, বেহালা হাতে চৈতীদা, শিক্ষকগণ কেউ কেউ। গান ওঠে ‘ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর,’ বা, ‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি’। ক্যাম্প প্রদক্ষিণ করে আমরা শান্তিদূতদের ঘুম ভাঙাতাম। সেই শুকতারা-জাগা শেষরাতে দেশবিদেশের প্রতিনিধিরা তাঁদের তাঁবুর সামনে করজোরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সে এক নতুন উচ্ছ্বাসের জোয়ার। তারপর একদিন শান্তিসম্মেলনের পালা শেষ হলো। আশ্রমে এক শূন্যতা। আমাদের জন্য রইল একগুচ্ছ গানের পসরা।
ইতিপূর্বে একবার পূর্ববাংলার কথা এসেছিল, কিন্তু তা সম্পূর্ণ হয়নি। ‘বাংলাদেশ’ ছাড়া তো বাংলার কথা ফুরোয় না। এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে, শৈলজারঞ্জন গত সত্তর ও আশির দশকে প্রতি বছর বাংলাদেশে আমন্ত্রিত হয়ে আসতেন। তাঁকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সুকণ্ঠ রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীরা সব এসে তাঁর ছাত্র হয়ে যেতেন। সে এক জমজমাট ব্যাপার। ঢাকা রেডিও স্টেশনের কর্তা ছিলেন আবদুল আহাদ – শান্তিনিকেতন সংগীতভবনের প্রাক্তনি। তিনি রবীন্দ্র-গানের এক সার্থক রূপকার। এ যেন সংগীতভবনের এক শাখা হয়ে ওঠা। সংগীতভবনের আরেক প্রাক্তনীর উপস্থিতিও গভীর ছাপ ফেলে গেছে, – অকালপ্রয়াত আতিকুল ইসলাম। শৈলজারঞ্জনের আরেক অন্যতম প্রধান গুণগ্রাহী ওয়াহিদুল হক, বাংলাদেশের আদর্শতম শিল্পী সন্জীদা খাতুনের স্বামী। দুজনকে বলা যায় বাংলাদেশে তথা উভয় বঙ্গে রবীন্দ্রগানের পরম প্রবক্তা – শিল্পী-গবেষক। তাঁদের অনুপ্রেরণার সৃষ্টি ‘ছায়ানট’ সংগীত সংস্থার অনুরূপ সংস্কৃতিকেন্দ্র কলকাতায় বা অন্য কোথাও নেই, – গুণেও নেই, স্থাপত্যের দিক থেকেও নয়। সংস্থার শিক্ষার্থী সংখ্যা, গ্রন্থাগার, দুটি অডিটোরিয়াম ইত্যাদি নিয়ে এক মহতি সংস্কৃতি কমপ্লেক্স। – কোথাও না কোথাও থেকে রবীন্দ্রনাথ তৃপ্ত হচ্ছেন, তাঁর প্রিয়তম সৃষ্টি তাঁর প্রাণের শিলাইদহের দেশে সার্থকতা পেয়েছে।
এখন যে বাংলাদেশে রবীন্দ্রগানের কোটালের বান ডেকেছে তারই উৎসমুখের স্রোতধারারই ফল। সন্জীদা ও ওয়াহিদুল হকের রবীন্দ্রসংগীতের ওপর বিশ্লেষণধর্মী রচনা তুলনাহীন একা দাঁড়িয়ে। শৈলজারঞ্জন ও তাঁর শিষ্য এই দম্পতি বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীতের প্রতিষ্ঠার প্রধান স্থপতি।
এ হলো পেছন পানে তাকিয়ে শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথের গানকে আমার চিনবার পশ্চাৎপট। সবই অপরিকল্পিত ঘটে যাওয়ার কাহিনি। তবে এই অভাবিতই আমাকে সারাজীবনের প্রাণরস জুগিয়েছে।
মনে পড়ে, উনিশশো আঠারো সালে রবীন্দ্রনাথ এক গান গেয়েছিলেন –
তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে
মাটির এই কলস আমার ছাপিয়ে গেল কোন্ ক্ষণে…
– এই গান তাঁর অন্তরতম উপলব্ধি, – একবার তিনি গেয়ে উঠলেন তো অবশ্যই, তার ওপর তাকে কবিতায় ঢেলে সাজালেন, একবার নয়, দু-দুবার। একটি কবিতার নাম দিলেন ‘ঘটভরা’, আর একটি অনামীই রইল।
‘সারাদিন অনেক ঘুরে দিনের শেষে’ এখন উপলব্ধি হয়, সেই অলোক ঝরনাতলার খোঁজ তো আমরা পেয়ে গেছি তাঁর শান্তিনিকেতনে।
‘প্রয়োজন ছাপিয়ে’ সেই ঝরনাতলার ছিটেফোঁটাও যদি অঞ্জলিতে মেলে তাহলেও তো অনেক, –
নেব আজ অসীম ধারার তীরে এসে
প্রয়োজন ছাপিয়ে যা দাও সেই ধনে
তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে।’