‘তোমার ঘরে বসত করে ক’জনা, তুমি জানো না’

হা স না ত  আ ব দু ল  হা ই

আগে শুধু ভোরবেলায় ছিল, এখন বেশ কিছুদিন হলো বিকেলেও একসঙ্গে বের হচ্ছেন তাঁরা। ভোরবেলা একসঙ্গে বের হন প্রাতঃভ্রমণের জন্য, ধানম– লেকের পার ধরে চলে যান ৩২ নম্বর রোড থেকে ৮ নম্বরের কাছে রবীন্দ্র সরোবরে। সেখানে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে, যখন যা সুবিধা পান সেই অনুযায়ী, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। প্রায়ই গান হয় রবীন্দ্র সরোবরের চত্বরে, দুজনে সেই গান শোনেন, কখনো বাদাম কিনে খোসা ভেঙে খান। ফেরার সময় একই পথ, তবে তখন প্রাতঃভ্রমণকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, অধিকাংশই মহিলা, সিঙ্গল ফাইলে নয়, একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হেঁটে আসে তারা কেডস্ পরা দ্রুতপায়ে, কথা বলতে বলতে। তাদের জন্য পথ ছেড়ে দিয়ে পাশের গাছের নিচ দিয়ে হাঁটতে থাকেন দুজন। কখনো ফাঁকা দেখে কংক্রিটের বেঞ্চে বসে লেকের ঘন কালো পানিতে প্যাডেল বোট চালাতে দেখেন উৎসাহী কম বয়সী কয়েকজনকে। বিশাল কড়ই গাছের নিচে এরা বেস্ক নকশা করা জমিতে সকালের সূর্যের নরোম আলো আর ছায়া খেলা করে, যেখানে এরোবিক ব্যায়াম করেন কেউ কেউ, একা কিংবা দলবেঁধে। কোনো ঘোষণা নেই, নির্দেশ শোনা যায় না, কানে লাগানো হেড ফোনই বলে দিচ্ছে কখন কী করতে হবে। একটা কোরিওগ্রাফ রয়েছে তাদের কসরতের পেছনে। কাঁধ থেকে ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে মেডিক্যালের ছাত্ররা আসে, প্যান্ট-শার্টের ওপর সাদা অ্যাপ্রন, গলায় স্টেথেসকোপ, হাতে সুগার মাপার ছোট কমপিউটারাইজড যন্ত্র। মাঝে মাঝে তাঁরা মেডিক্যালের ছাত্রদের দিয়ে বস্নাড প্রেসার দেখেন, সুগার লেভেল চেক করেন। যেদিন সুগার নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই থাকে, দুজনেই খুব খুশি হন। আনিসুর রহমান বলেন, আজ হেভি ব্রেকফাস্ট করা যাবে। একটু মিষ্টিও চলতে পারে। হাবিবুল্লাহ খান হেসে বলেন, হ্যাঁ। তাই। এভাবে এত কড়াকড়ি করে খাওয়ার মধ্যে মজা নেই। মেডিক্যালের ছাত্ররা টাকা নিয়ে চলে যায়, যাওয়ার সময় বলে, আপনারা দুজনই ভালো আছেন। হাঁটবেন। রেগুলার হাঁটবেন। ওটাই বেস্ট মেডিসিন। আনিসুর রহমান তাদেরকে তাঁর কার্ড দেন। এটা তাঁর অভ্যাস! তাঁর সঙ্গী পছন্দ করেন না এই গায়ে পড়ে মেশা। আনিসুর রহমান সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক ছিলেন, অবসরে গিয়েছেন গত বছর। প্রায় একই সময়ে অবসর নিয়েছেন হাবিবুল্লাহ খান, একটা ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন তিনি। তাঁরা, অবসর নেওয়ার পর এসে উঠেছেন একই বহুতল বাড়ির দুই ফ্ল্যাটে, আনিসুর রহমান তিনতলায়, হাবিবুল্লাহ খান চারতলায়। ষোলোশো বর্গফুটের ফ্ল্যাট, ব্যালকনি আছে দক্ষিণ দিকে, মাঝে মাঝে বাতাস এসে শীতল করে দেয় গরমের দুপুর। দুজনেরই ফ্যামিলি ছোট, স্বামী আর স্ত্রী, ছেলেমেয়ে সব বিদেশে। কেউ আমেরিকায়, কেউ কানাডায়, কেউ বা অস্ট্রেলিয়ায়। পড়তে গিয়ে সেখানেই চাকরি নিয়ে থিতু হয়েছে। দু-তিন বছর পরপর আসে বাবা-মাকে দেখতে। ফোনে কথা বলত আগে, এখন বেশিরভাগ কথা হয় স্কাইপ অথবা ভাইবারে, এতে তারা একে অন্যের মুখ দেখতে পায়, কোনো খরচ লাগে না। ভাইবার ছাড়া অধ্যাপক আনিসুর রহমান তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে স্ট্যাটাস দেন মাঝে মাঝে। ছেলেমেয়ে আর পরিচিতজন যারা ফেসবুকে বন্ধু হয়েছে তারা মন্তব্য করে, লাইক দেয়, নিজেদের স্ট্যাটাস আপডেট করে নেয়। এই সোশ্যাল নেটওয়ার্কেও নিখরচায় যোগাযোগ রাখা যায়, তাছাড়া এর মধ্যে একটা বড় পরিধির ব্যাপার আছে। গেস্নাবাল ভিলেজ বলতে মার্শাল ম্যাকলুহান কী বুঝিয়েছিলেন, সেই অভিজ্ঞতা হয়। আনিসুর রহমান সকাল-বিকাল ফেসবুক চেক করেন, নতুন কিছু জানার থাকলে স্ট্যাটাস দেন। হাবিবুল্লাহ খানের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই। তিনি এর প্রতি আকর্ষণবোধও করেন না, বলেন, এসব নতুন প্রজন্মের জন্য। আমাদের মানায় না। অধ্যাপক আনিসুর রহমান অবাক হয়ে বলেছেন, টেকনোলজি ইজ নিউট্রাল। কোনো নির্দিষ্ট বয়সের মানুষের জন্য নয়। যে কেউ ব্যবহার করতে পারে। সিম্পল হয়ে গিয়ে, দামে সস্তা হয়ে এসব যোগাযোগমাধ্যম এখন শুধু ইউজার ফ্রেন্ডলি না। ইউনিভার্সাল। আপনি ভুল করছেন, একটা দারুণ অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত করছেন নিজেকে। শিখে নিন। হাবিবুল্লাহ খান কনভিনস্ড হন না, বলেন, সময় নষ্ট। এক ধরনের অ্যাডিকশন। নার্সিসিজম বটে। অধ্যাপক আনিসুর রহমান বলেন, বেশ তো। বেশি ব্যবহার করবেন না। বন্ধু বেছে নেবেন সতর্ক হয়ে। ছেলেমেয়েদের নিয়েই না হয় থাকবেন ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে।

শুনে হাবিবুল্লাহ খান কিছু বলেন না। আনিসুর রহমান বলেন, ফেসবুক আর অন্য সোশ্যাল মিডিয়া মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে। অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটছে। এই তো দেখেন না, মেক্সিকোর একটা মেয়ে এক বাংলাদেশি গ্রামের ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে এমন পর্যায়ে এসেছে যে, নিজ দেশ থেকে বাংলাদেশে এসে সেই ছেলের সঙ্গে দেখা করল। তার পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হলো। খুব অবস্থাপন্ন নয় পরিবারটি। গ্রামের বাজারে বাবার মুদির দোকান আছে। ছেলেটি এসএসসি পাশ করে সামান্য একটি চাকরি করে। মেয়েটি সুন্দরী, বয়সও বেশি না, অবস্থা ভালোই হবে। না হলে নিজখরচে এতোদূর আসতে পারবে কেন। গ্রামের মানুষ উপচে পড়ল তাকে দেখতে। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলো। ছেলে আর মেয়েটি দেরি না করে বিয়ে করে ফেলল। মেয়েটি এখন দেশে ফিরে গিয়েছে। ছেলেটি যাবে কিছুদিন পর। রূপকথার মতো শোনাচ্ছে না? আরো আছে, এটাও রিসেন্ট খবর। ইতালি থেকে এক বাঙালি ছেলে ফেসবুকে বন্ধু হয়েছিল বিক্রমপুরের এক গ্রামের কলেজপড়ুয়া মেয়ের সঙ্গে। ছেলেটি বাক্-প্রতিবন্ধী। বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে প্রেম হয়ে গেল। ঠিক ওই মেক্সিকান মেয়ে আর গাজীপুরের ছেলেটির মতো। ইতালি থেকে এসে বিক্রমপুরের গ্রামে গিয়ে দেখা করল ছেলেটি মেয়েবন্ধুর সঙ্গে। বাক্-প্রতিবন্ধী, কথা বলে কষ্ট করে। তার জন্য প্রেমে ফাটল ধরেনি। তারাও দুজনে বিয়ে করেছে। এসব মডার্ন ডে ফেয়ারি টেলস্ সোশ্যাল মিডিয়া আছে বলেই তো সম্ভব হচ্ছে। বলতে পারেন ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া পপ-কালচারের অংশ, খুব প্রভাবশালী অংশ। এর অপব্যবহার আছে, কিন্তু তার জন্য ভালো দিকগুলো খাটো হয়ে যাবে কেন?

আনিসুর রহমানের ফ্ল্যাটে বসে কথা হচ্ছিল। আজ তাঁরা হাঁটতে যাননি। সপ্তাহে একদিন তাঁদের ছুটি। সেদিন বাড়িতেই চা খেতে খেতে আনন্দ হয়, যেমন আজ হচ্ছিল। দুজনের এমন আড্ডা হাবিবুল্লাহ খানের ফ্ল্যাটেও ছুটির দিনে হয়। কখনো কখনো দুপুরে একসঙ্গে খান তাঁরা, তাঁদের স্ত্রী এসে যোগ দেন খাবার টেবিলে। তাঁরা যেমন প্রতিবেশী হিসেবে বন্ধু, তাঁদের স্ত্রী দুজনও বান্ধবীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন, যদিও একে অন্যকে ডাকেন ‘ভাবি’ বলে। হাবিবুল্লাহ খান হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, যাই বলেন, যত প্রশংসাই করেন আমাকে দিয়ে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলাতে পারবেন না। আমি এখনো মনে করি ওসব নতুন প্রজন্মের ফ্যাড, অ্যাডিকশন। পপ কালচার বলুন আর যাই বলুন। আমি বেশ আছি ফেসবুক ছাড়া। আপনি মাঝে মাঝে ফেসবুকের রূপকথা শোনাবেন, তাতেই হয়ে যাবে। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে অধ্যাপক আনিসুর রহমান বললেন, আপনি একটা জেনারেশন গ্যাপ তৈরি করছেন। এভাবে চললে স্ট্রেঞ্জার হয়ে যাবেন। নো ম্যান ইজ অ্যান আইল্যান্ড। সবার সঙ্গে মিশতে হবে। সবাইকে জানতে হবে। হাবিবুল্লাহ খান লিফটের দিকে যেতে যেতে বলেন, শিক্ষকতা করে আপনি বইয়ের জগতের বাইরে, আইডিয়ার পরিধি এড়িয়ে স্বাধীনভাবে কিছু ভাবতে পারেন না। আমি দেখেছি এটা আপনার একটা সমস্যা। ওই যে পপ কালচার না কি বললেন, ওর তৈরি একটা মেক-বিলিভ ওয়ার্ল্ডে বাস করছেন আপনি।

লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার আগে অধ্যাপক আনিসুর রহমান বললেন, মেক-বিলিভ নয়, বলুন, ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড। একই ব্যাপার। কিন্তু শেষেরটায় কালেকটিভ আইডেনটিটি আছে। ছাত্র বয়সে সিনেমায় দেখা ওয়ান্টার মিটির মতো নিজের অলস কল্পনার জগৎ নয়।

লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে প্রায়, হাবিবুল্লাহ খানের একটা ক্রশ সেকশন দেখা যাচ্ছে। তাঁর কথা শোনা গেল ভেতর থেকে। তিনি বললেন, আপনি ব্যতিক্রমী মানুষ। সেই জন্য ইন্টারেস্টিং। অপজিট পোলস অ্যাট্রাক্ট ইজ আদার। তাঁর নির্মল হাসির শব্দ শোনা গেল। আনিসুর রহমান গুনগুনিয়ে একটা গানের প্রথম লাইন গাইতে গাইতে ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করলেন।

তাঁর স্ত্রী বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, কিছু বলছো? প্রশ্নের মতো শোনাল তাঁর কথা।

আনিসুর রহমান সোফায় বসতে বসতে বললেন, কিছু না।

 

দুই

বিকেল বেলা ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন আনিসুর রহমান আর হাবিবুল্লাহ খান। কখনো পাশাপাশি, কখনো সামনে-পিছনে, যখন যেমন সুযোগ পাচ্ছেন। ফুটপাতে নানা পসরা সাজিয়ে বসে আছে হকার, আসা-যাওয়া করছে অন্য পথচারী। জোরে হাঁটার উপায় নেই, আর তার দরকারও নেই। তাঁরা ট্রেন বা বাস ধরতে যাচ্ছেন না। কিছুদিন হলো দুজনে যে অভ্যাস গড়ে চলেছেন, তার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন তাঁরা। অভ্যাসটা গড়ার পেছনে অধ্যাপক আনিসুর রহমানের উদ্যোগই বেশি। হাবিবুল্লাহ খান যাকে বলে উইলি-নিলি সম্মত হয়েছেন।

আনিসুর রহমান তাঁকে নিয়ে কফিশপে ঢোকেন। এক-একদিন এক-একটায়। সবই বিদেশি ফ্রাঞ্চাইজ। শুধু স্টার বাকস্ আসেনি এখনো। বাংলাদেশিদের মধ্যে কফি খাওয়ার অভ্যেস গড়ে উঠেছে হঠাৎ করে। চাহিদা এসেছে প্রথমে, না সরবরাহ? ব্যাংকার হিসেবে বুঝতে চেষ্টা করেন হাবিবুল্লাহ খান। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে পড়েছিলেন অর্থনীতিবিদ সেজের থিওরি। সাপস্নাই ক্রিয়েটস্ ইটস্ ওন ডিমান্ড। সেজ্ ল নামে খ্যাত। এখানেও কি তাই হয়েছে? মনের ভেতর চিন্তাটা বেশিদূর এগোয় না। এগ্ অর চিকেন ফার্স্টের মতো একটা ধাঁধা, সেভাবেই থাক বিষয়টা।

কফিশপগুলোতে ঢুকতেই কফির ঝাঁঝালো গন্ধ এসে নাকে ঢোকে, মস্তিষ্কের কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ে। মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। আঠা স্নিফ করার মতো নেশা হয়ে যায়। কিন্তু তার সঙ্গেই থাকে চকোলেটের সুন্দর মিষ্টি গন্ধ, যা টেস্ট বাড প্রফুলস্ন করে, অ্যাকস্টেসি এনে নেয়। দুই গন্ধ মিলে চমৎকার একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কিন্তু গন্ধ আকর্ষণ করলেও কফিশপের ভেতর যারা বসে তাদের দেখে তিনি বিব্রতবোধ করেন। ইতস্তত করেন বসবেন কি, বসবেন না। কাস্টমার সবই তরুণ, তরুণী। দেখেই বোঝা যায় কলেজ অথবা ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রী। চটপটে ভাব, তীক্ষন ধারালো দৃষ্টি, ফ্লুয়েন্ট ইংলিশে কথা বলছে। নতুন প্রজন্ম। তাঁদের সঙ্গে অনেক দূরত্ব। প্রথম দিন তাঁকে ইতস্তত করতে দেখে অধ্যাপক আনিসুর রহমান বলেছিলেন, কী হলো? অমন করছেন কেন? চলুন বসি গিয়ে। যা ভিড়। দেরি করলে জায়গা পাওয়া যাবে না। হাবিবুল্লাহ খান ফিসফিস করে বলেছিলেন, দেখেছেন?

কী?

সবই কম বয়সের ছেলেমেয়ে। আমাদের বয়সী কেউ নেই।

আনিসুর রহমান বলেন, তাতে কী? আমাদের বয়সী মানুষের প্রবেশ তো নিষেধ করা হয়নি এখানে। চলুন বসি গিয়ে।

ফাঁকা চেয়ার-টেবিল পেয়ে দুজনে বসেছেন এক কোনায়। অনেকেই তাকিয়েছে তাদের দিকে। এমনকি ওয়েটার ছেলেরাও। দেখে হাবিবুল্লাহ খান অস্বস্তিবোধ করলেন। বললেন, এখানে না এসে অন্য কোথাও যাওয়া যেত।

যেত। কিন্তু এই ক্রাউড দেখতে পেতেন না। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের এতো কাছে থেকে অবজার্ভ করার সুযোগ থাকত না।

কী লাভ এদের অবজার্ভ করে? আমরা সংবাদপত্রের রিপোর্টার নই। কোনো প্রতিবেদন লিখতে আসিনি। হাবিবুল্লাহ খান বলেন।

কিন্তু সেই জন্য নতুন জেনারেশনকে জানতে হবে না? চোখের সামনে নতুন লাইফ স্টাইল নিয়ে হাজির হয়েছে এরা। তা দেখব না?

দেখে লাভ? কত কিছু দেখার আছে, বিশেষ করে এদের লাইফস্টাইলই দেখতে হবে কেন? হাবিবুল্লাহ খান আস্তে করে বলেন।

এই জন্য যে এরাই ভবিষ্যৎ। এদের কথাবার্তা, দৃষ্টিভঙ্গি দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে। তুলবে বলছি কেন, গড়ে তোলা শুরু হয়ে গিয়েছে। আমরা লক্ষ্য করিনি। নিজেদের জীবিকা উপার্জন, পরিবার নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি। ছেলেমেয়েরা কাছে থাকলে তাদের দেখেও বোঝা যেত এই পরিবর্তন, কেননা তারা এদের মতোই নতুন লাইফস্টাইল গ্রহণ করত। একই জেনারেশন তো।

পপ কালচার? হাবিবুল্লাহ খান ঠাট্টার স্বরে বলেন। বলতে পারেন। পপ কালচারের এমবডিমেন্ট এরাই। দেখেন ওদের পোশাক, কাপড়-চোপড়। নীল জিনসের টাইট প্যান্ট হাঁটুর কাছে ছেঁড়া, মেয়েরা পরেছে বাঙালি ধরনের ফতুয়া। ছেলেরা বিদঘুটে স্লোগান লেখা টি-শার্ট। আই অ্যাম হাংগ্রি। আই অ্যাম আংগ্রি। ড্যাম ইউ। হোয়াট দি হেল। একসময়ে চে গুয়েভারার সাদাকালো রঙে ছাপানো মুখই ছিল তরুণ জেনারেশনের স্লোগান। এখন বিপ্লব না, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য, ক্ষ্যাপাটে স্বভাব, চমকে দেওয়া, শকড্ করার অংশ হিসেবে পরছে এরা কাপড়-চোপড়। আবার দেখেন হিজাব পরা মেয়েও রয়েছে কয়েকজন। মোটেও বিব্রতবোধ করছে না অত্যাধুনিক খোলামেলা, পোশাক পরা মেয়েদের সামনে। পোস্ট-মডার্নিজমে যে পস্নুরালিটির কথা বলে এরা তার দৃষ্টান্ত। কোনো এক ফর্মুলায় ফেলা যাবে না এদের। এরা ডাইভার্স, বহুধাবিভক্ত। এই বিভক্তি সত্ত্বেও দেআর রিলেটিং টু ইচ আদার। একের সঙ্গে অন্য পক্ষের একটা বোঝাপড়া, সমঝোতা হয়ে গিয়েছে, আধুনিকতায় ছিল স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন। উত্তর-আধুনিকতায় এসে তার স্থান নিয়েছে  ডিফারেনসিয়েশন। অবশ্য আমি উত্তর-আধুনিকদের আধুনিকতার বিরুদ্ধে সব সমালোচনা মানি না। আধুনিকতার উপাদান রয়ে গিয়েছে উত্তর-আধুনিকতায়। কালচারের একটা ধারাবাহিকতা আছে। অতীতের কাছে বর্তমান ঋণী। বেশ কিছুক্ষণ একটানা কথা বলে অধ্যাপক আনিসুর রহমান হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলেন যেন। লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, শিক্ষক ছিলাম তো, একটা লেকচার দিয়ে দিলাম। আপনি বিরক্ত হলেন।

হাবিবুল্লাহ খান বললেন, না, বিরক্ত হইনি। এসব কথা আমার কাছে নতুন। শুনতে ভালোই লাগছে। অভ্যস্ত নই বলে অস্বস্তিতে পড়ি মাঝে মাঝে। যাই বলেন, আপনি সত্যি ইন্টারেস্টিং। সব নতুন কথা বলেন, যা কখনো শুনিনি। বলে তিনি স্বগতোক্তির মতো বললেন, পপ কালচার!

অধ্যাপক আনিসুর রহমান বললেন, সবাই ভেবেছিল পপ কালচারের দিন শেষ। নাইন ডেজ ওয়ান্ডারের মতো তার স্ফুলিঙ্গের অস্তিত্বের ওপর যবনিকাপাত হয়েছে। হয়ে যেত। কিন্তু ইন্টারনেট এসে পপ কালচারের মোড় ফিরিয়ে দিয়েছে। ফোক কালচারকে আত্মস্থ করে পপ কালচার ডেমোক্রেটিক হয়ে গিয়েছে। ফ্রিঞ্জে থেকে চলে এসেছে মেইনস্ট্রিমে। তারপর বললেন, ছেলেমেয়েদের অবজার্ভ করুন, তাদের কথাবার্তা শুনুন। অঙ্গভঙ্গি দেখুন। ফর আস ইট ইজ এ হোল নিউ ওয়ার্ল্ড। কিন্তু এটাই রিয়েলিটি। আমরা রয়ে গিয়েছি পুরনো খোলস নিয়ে, সনাতন ধ্যান-ধারণা লালন করে। ম্যাট্রিক্স সিনেমা দেখেছেন? সেই সিনেমায় ম্যাট্রিক্স কর্তৃপক্ষ মানুষকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে দিতে চায় না, সবই নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। ব্যাপারটার সবই সায়েন্স ফিকশন নয়। বাস্তব ভিত্তি আছে। আমরা অদৃশ্যশক্তির দ্বারা ম্যানিপুলেটেড হচ্ছি, ম্যানিপুলেট করতে চাইছি। তাঁর কথার মাঝখানে ওয়েটার ছেলেটা এসে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, ওয়েলকাম টু আওয়ার কফিশপ। কী পছন্দ আপনাদের, বলুন।

কাপুচিনো কফি। সঙ্গে দুটো চিজ কেক। ছেলেটা অর্ডার নিয়ে চলে গেলে আনিসুর রহমান বললেন, আজ আমাদের দুজনেরই সুগার লেভেল উইদিন লিমিটস। একটু মিষ্টি খেতে পারি। বলে দুষ্টু ছেলের মতো হাসলেন তিনি।

হাবিবুল্লাহ খান বললেন, হ্যাঁ। খাওয়া যায়। তারপর বললেন, আপনি মনে হচ্ছে সিনেমার খুব ভক্ত। প্রায়ই দৃষ্টান্ত দেন।

হ্যাঁ। আমার বেশ বড় কালেকশন আছে। সব ধরনের বই। সোশ্যাল ড্রামা, অ্যাকশন, অ্যাডভেঞ্চার, হরর থেকে সায়েন্স ফিকশন। সিনেমা আগে হাই কালচারের অংশ ছিল, এখন পপ কালচার সেখানে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। না হলে ট্রান্সফর্মারের মতো ছবি এতো জনপ্রিয় হবে কেন?

হাবিবুল্লাহ খান বললেন, আমার স্ত্রীও খুব সিনেমার ভক্ত। এখন হিন্দি সিরিয়াল নিয়ে ব্যস্ত। তাঁর মতে, আগের মতো রোমান্টিক ফিল্ম আর তৈরি হচ্ছে না। সুচিত্রা-উত্তম জুটির মতো কেউ নেই। গ্রেগরি পেগ, অড্রে হেপবার্নের রোমান হলিডের মতো সিনেমা তৈরি হচ্ছে না।

আনিসুর রহমান বললেন, কী করে হবে? জীবন যে পালটে গিয়েছে। সেইসঙ্গে মানুষের টেস্ট। হিচককের সাইকো দেখে যারা আতঙ্কিত হয়েছিল এখন সে-ধরনের ছবি পানসে হয়ে গিয়েছে। হরর, সেক্স, ভায়োলেন্স এসব ডাল-ভাত হয়ে গিয়েছে। কথায় কথায় ফোর লেটার ওয়ার্ড। স্ট্রিট ল্যাঙ্গুয়েজ উঠে এসেছে ড্রয়িং রুমে। পপ কালচারের এই একটা দিক যা আমি মেনে নিতে পারিনি। রুচিতে বৈচিত্র্য থাক। তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু শালীনতা, সংযম, সহিষ্ণুতা থাকবে না কেন? ওয়াইল্ড ওয়েস্ট অদৃশ্য হয়েছে, কিন্তু ম্যাচো ল-লেস্  কালচারকে পুনর্জীবিত করা হবে কেন?

হাবিবুল্লাহ খান বললেন, ওয়াইল্ড ওয়েস্ট চলে গিয়েছে কিন্তু তাঁর স্থানে এসেছে আন্ডারওয়ার্ল্ড। দুটোর মূল্যবোধ কি একই না?

শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন অধ্যাপক আনিসুর রহমান। অবাক হয়ে বললেন, দারুণ একটা কথা বলেছেন আপনি। আমার মাথায় আসেনি। আপনি অবলীলায় মোক্ষম কথাটি বলে ফেললেন। ইউ আর অ্যা জিনিয়াস।

হাবিবুল্লাহ খান প্লেট থেকে চিজ কেক তুলে নিতে নিতে বললেন, লজ্জা দেবেন না। না বুঝেই বলে ফেলেছি। হঠাৎ করেই। কিন্তু পেরেকের মাথায় ঠিক ঘা দিয়েছেন। ইউ হ্যাভ অ্যা ডিসসার্নিং মাইন্ড। আনিসুর রহমান বলেন মাথা ঝাঁকিয়ে।

এতো বাড়িয়ে বলবেন না। টাকা-পয়সা পাইসের হিসাব করে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছি। ব্যালান্সশিটের বটম লাইন নিয়ে মগ্ন থেকেছি। আইডিয়ার জগতে আমি একেবারেই যাকে বলে স্ট্রেঞ্জার। আপনি উসকে দিচ্ছেন।

আনিসুর রহমান বললেন, কফিশপে এসে অস্বস্তিবোধ করছিলেন। এখনো সেই ভাবটা আছে? অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেননি?

হাবিবুল্লাহ খান বললেন, সময় নেবে।

 

তিন

অন্য এক বিকেল। ফুটপাত দিয়ে হাঁটছেন তাঁরা, সামনে অধ্যাপক আনিসুর রহমান, পেছনে হাবিবুল্লাহ খান। ভিড়ের জন্য পাশাপাশি হাঁটতে পারছেন না। তাছাড়া হকারদের পসরা সাজিয়ে রাখার জন্য হাঁটার মতো ফাঁকা জায়গাও কম। অলস ভঙ্গিতে হাঁটছেন অধ্যাপক আনিসুর রহমান। পর্যবেক্ষণ করছেন ফুটপাতের, তার পাশের দৃশ্য। কাপড় বিক্রি করছে অনেকে, রেলিংয়ে ঝুলিয়ে রেখে। ঝুড়িতে পদ্মপাতার মতো ছড়িয়ে রেখেছে নানা রঙের মোজা একজন। সত্মূপ করে ফেলে রেখেছে কালো, বাদামি রঙের জুতো, স্যান্ডেল। ফরেন ব্র্যান্ডের নাম লেখা ভেতরে। হাসপাপি, বালি, পিয়ের কার্দা, এসব। পস্নাস্টিকের গ্লাস, বোতল বিক্রি করছে একজন। আনারসবোঝাই ঠেলাগাড়ি সামনে নিয়ে কেটে দিচ্ছে খদ্দেরের হাতে ঠেলাগাড়ির হকার। ফুচকা বিক্রি হচ্ছে, তার সামনে তরুণ-তরুণীর ভিড়। অলস ভঙ্গিতে দেখতে দেখতে হাঁটছেন অধ্যাপক আনিসুর রহমান, কিন্তু সব কিছু তীক্ষন চোখে পর্যবেক্ষণ করছেন। হাবিবুল্লাহ খান আস্তে আস্তে বিরক্ত হয়ে উঠলেন। ‘চলুন ফুটপাত দিয়ে একটু হাঁটা যাক’ বলে তাঁকে নিয়ে বের হয়েছেন আনিসুর রহমান। তিনি সহজভাবেই নিয়েছিলেন কথাটা। এতোদিনে জেনে গিয়েছেন ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে ভালোবাসেন আনিসুর রহমান। তাই বলে এতো ঘন ঘন, এমন ভিড় ঠেলে ধুলো-বালি-ধুয়ো শরীরে মেখে নিয়ে? আপত্তি জানাবেন তিনি এরপর।

হঠাৎ থেমে গেলেন আনিসুর রহমান। ফুটপাতের পাশের রেলিংয়ে টানানো পটচিত্রের মতো রঙিন ছবি। রিকশা পেইন্টিংও রয়েছে সেইসঙ্গে। দুজন তরুণ ছবির সামনে দাঁড়িয়ে। তাদের শার্টে প্যান্টে পেইন্টের ছোপ লেগে আছে। আনিসুর রহমান তাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। ছবিগুলো সম্বন্ধে জানতে চাইলেন। কাছে এসে হাবিবুল্লাহ খানও শুনলেন। ছেলে দুজন কাছেই একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ট ডিপার্টমেন্টের ছাত্র। ছবি এঁকেছে তারাই, বিক্রির উদ্দেশ্যে। পড়ার খরচ চালায় এভাবে। আনিসুর রহমান একটা পটচিত্র কিনলেন। তাঁর নাম লেখা কার্ড দিলেন। বললেন, এসব ছবি নিয়ে তিনি তাদের সঙ্গে একদিন কোথাও বসে কথা বলবেন। ছবি হাতে আবার হাঁটছেন আনিসুর রহমান। সেই মন্থরগতি। এবারে হাবিবুল্লাহ খান তাঁর পাশাপাশি হতে পেরেছেন। আনিসুর রহমান বললেন, প্যারিস শহর যখন জনাকীর্ণ হয়নি, এখনকার মতো ট্রাফিকের ভিড় নেই, সেই সময় ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়া ছিল একটা প্যাসটাইম। এক ধরনের শৌখিনতা। ফরাসি ভাষায় তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ফ্ল্যানেউর’। তর্জমা করলে দাঁড়ায় ‘এইমলেস ওয়ান্ডারিং।’ যিনি হাঁটছেন, সব কিছু দেখছেন কিন্তু দেখার জন্যই দেখা, কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে না। বোদলেয়ারের প্রিয় ছিল এই উদ্দেশ্যহীন ফুটপাত ভ্রমণ। তিনি একজন মাঝারিমানের শিল্পী কনস্ট্যানটিন গাইসকে দেখেছেন তাঁর মতোই ফুটপাতের দৃশ্য দেখতে দেখতে হেঁটে যেতে। অন্য অলস ভ্রমণকারীরা যা করেননি, শিল্পী গাইস তাঁর দেখা পথদৃশ্যের ভিত্তিতে আর্ট সৃষ্টি করেছিলেন। কৌতূহল ছিল সেসব ছবি আঁকার পেছনের প্রধান প্রেরণা। বোদলেয়ার তাঁকে নিয়ে এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যা আধুনিকতার আলোচনায় এখনো উল্লিখিত হয়। লেখাটির নাম ছিল ‘পেইন্টার অব দি মডার্ন লাইফ’। গাইসের আঁকা এসব পথদৃশ্যের ছবির আলোচনার মাধ্যমে তিনি আধুনিকতার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম আধুনিক কবি, তাঁর শিষ্য আর্তুর র্যাঁবোর ভাষায় ‘প্রথম দ্রষ্টা তিনি, কবিদের রাজা, এক সত্য দেবতা।’

হাবিবুল্লাহ খান বললেন, বোদলেয়ার কি খুব বিখ্যাত কবি ছিলেন? তাঁর সম্বন্ধে এমন উচ্ছ্বসিত কথা। আনিসুর রহমান বললেন, বললাম না, তিনিই প্রথম আধুনিক কবি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ক্লেদজ কুসুম সরকার নিষিদ্ধ করেছিল যৌনতার খোলামেলা প্রকাশের জন্য। হ্যাঁ, তখনকার ফ্রান্স বেশ রক্ষণশীল, বলা যায় প্রতিক্রিয়াশীল ছিল। হাবিবুল্লাহ খান বললেন, তা আপনি এই দুটি ছেলের সঙ্গে ওই শিল্পী যাঁর কথা বোদলেয়ার লিখেছেন, তাঁর তুলনা করছেন?

পাগল। কিসের সঙ্গে কি। আমি বলতে চাইছি এরাও জীবনকেই ছবির বিষয় করেছে। তবে পপ কালচারের আদলে। এই অর্থে এরা উত্তর-আধুনিক। কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, তাদের পপ কালচারে ট্র্যাডিশনকে অস্বীকার করা হয়নি। বরং অতীতের পুনরুজ্জীবন ঘটানো হয়েছে। একে বলা যায় রেক্ট্রো-পপ কালচার।

হাবিবুল্লাহ খানের পায়ে ব্যথা করছিল বেশ কিছুক্ষণ থেকে। তিনি বললেন, আরো হাঁটবেন? অনেক দূর তো এলাম এইমলেস ওয়ান্ডারিং করে। বলে তিনি হাসলেন। আনিসুর রহমান বলেলেন, চলুন ফেরা যাক। এবার কোনো কফিশপে গিয়ে বসি। তারপর হাবিবুল্লাহ খানের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপত্তি নেই তো?

হাবিবুল্লাহ খান হেসে বললেন, পড়েছি মোগলের হাতে। আপত্তি করলে আপনি শুনবেন? না দুজনের এই সম্পর্কটা বজায় থাকবে?

আনিসুর রহমান ব্যথিত স্বরে বললেন, অমন করে বলবেন না। মনে হয় যেন সবকিছু আন্ডার কম্পালশন করতে হচ্ছে আপনাকে। আমি তা চাই না। আপনি যতক্ষণ এনজয় করবেন ততক্ষণই থাকবেন আমার সঙ্গে। তারপর হেসে বললেন, এতোদিনে বুঝে গিয়েছেন নিশ্চয়ই আমি একজন ক্ষ্যাপাটে মানুষ। এ বয়সে যা মানায় না তা-ই করি। শ্রিকের কাছে, মানে সাইকিয়াস্টিস্টের পরামর্শ নেব নাকি?

হাবিবুল্লাহ খান বললেন, নিতে পারেন। সেটাও হয়তো আপনার পপ কালচারের মধ্যে পড়বে। আনিসুর রহমান বললেন, আস্তে বলুন। কবরে শুয়ে ফ্রয়েড অস্বস্তিতে এপাশ-ওপাশ করবেন। তাকে নিয়ে ঠাট্টা করাটা মোটেও পছন্দ করতেন না তিনি। হাবিবুল্লাহ খান বললেন, ফ্রয়েড?

আনিসুর রহমান বললেন, তাঁর কথা পরে একদিন বলব। একদিনে এতো জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ঠিক হবে না।

 

চার

ফুটপাত দিয়ে দুজন হেঁটে যাচ্ছেন। সামনে আনিসুর রহমান, পেছনে হাবিবুল্লাহ খান। কারণ একটাই – ভিড়, হকার। পরপর কয়েকটা কফিশপ পার হয়ে গেলেন তাঁরা। আনিসুর রহমান রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখছেন, কখনো গতি শস্নথ করছেন, কখনো থেমে গিয়ে দেখছেন। হাবিবুল্লাহ খান বললেন, ফ্ল্যানিউর না কী যেন বললেন, এইমলেস ওয়ান্ডারিং। তাই করছেন নাকি এখনো? কফিশপ তো কয়েকটা পার হয়ে এলাম। আনিসুর রহমান বললেন, নতুন কোনো দোকান খুলেছে কিনা দেখছি। তারপর বললেন, এইমলেস ওয়ান্ডারিং বিষয়টা আপনি হাসির বিষয় বলে মনে করছেন দেখছি। হাবিবুল্লাহ খান হেসে বললেন, ঢাকায় ফুটপাতে এখন কেউ এইমলেস ওয়ান্ডারিং করে বলে মনে হয় না। খুবই বিপজ্জনক। আনিসুর রহমান বললেন, তা ঠিক। ষাট-সত্তরের দশকের ঢাকার কথা হলে হাসির বিষয় হতো না। তবে তখন ফুটপাত একেবারেই খালি থাকত। দেখার কিছু থাকত না। হাঁটতে হাঁটতে কিছু লেখার বা ছবি আঁকার কথা ভাববেন, এমন বিষয় ছিল খুবই কম। তারপর বলেন, এইমলেস ওয়ান্ডারিং নিয়ে সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য বই লিখেছিলেন লুই আরাগঁ। প্যারিসি-পেজান্ট। নতুন প্যারিস শহর তৈরির আগে, হাউসম্যানের নকশা অনুযায়ী পুরনো অ্যারোন্ডাইসমেন্ট এলাকাগুলো ভাঙার আগে তিনি পুরো প্যারিস শহরের ফুটপাত দিয়ে অলসভাবে হাঁটতে হাঁটতে যা পর্যবেক্ষণ করেছেন তাই নিয়ে লিখেছেন ওই বই। তখন তিনি পরাবাস্তববাদী। এর আগে ছিলেন ডাডা আন্দোলনের সদস্য।

ডাডা, মানে বাংলা দাদাগিরি?

না, না। ডাডা শিল্প একটা আভা-গার্দ শিল্প-সাহিত্য আন্দোলন। তাকে হটিয়ে দিয়ে আসে পরাবাস্তববাদ। এই লুই আরাগঁ বেশিদিন পরাবাস্তববাদীও থাকলেন না। রাশিয়া ভ্রমণের পর কমিউনিস্ট হয়ে গেলেন। এরপর যা লিখেছেন সবই সোশ্যাল রিয়েলিজমের আদর্শে। তার প্যারিস-পেজান্ট বইটা আমার কাছে আছে। পরাবাস্তববাদী সাহিত্যের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।

হাবিবুল্লাহ খান বললেন, বেশি বলবেন না। আমি কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি। এই বয়সে এতো নতুন আইডিয়া, শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনের কথা শুনলে মনের ভারসাম্য রাখতে পারব না। কফি খাচ্ছি, পপ কালচারের নমুনা দেখছি, এই-ই যথেষ্ট। আনিসুর রহমান হেসে বললেন, বয়স সত্তর হতে চলেছে, তাই বলে বুড়ো হয়ে যাননি। এখনো মনের নতুন জানালা খোলার সময় রয়েছে।

কথা বলতে বলতে আনিসুর রহমান পাশের দোকানের দিকে তাকিয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। টি-হাউস অব অগাস্ট মুন। বলে কী! এ যে আমাদের ছাত্রজীবনে দেখা সিনেমার নাম। মার্লোন ব্রান্ডো ছিল। দেখেছেন ছবিটা?

না। আমি সিনেমার খুব ভক্ত ছিলাম না কখনো। যাই হোক, এমন নাম দিয়ে দোকান দিয়েছে, তাও কফিশপ না চায়ের দোকান। চলুন দেখা যাক ভেতরের অবস্থা।

ভেতরে ঢুকে এবার তাঁরা ভিন্ন গন্ধ পেলেন, ভেষজ গন্ধ। নানা ধরনের চায়ের গন্ধ। ভেতরে খুব একটা ভিড় নেই। সামনেই খালি টেবিল পাওয়া গেল। মেন্যু হাতে নিয়ে আনিসুর রহমান দেখলেন সব ধরনের চা রয়েছে। চাইনিজ জেসমিন, জাপানিজ উলুং, দার্জিলিং, সিলন, কেনিয়া, ইংল্যান্ডের বেস্নন্ড কয়া আর্ল গ্রে, টেবিল, টোয়াইনিং, বাংলাদেশের ইস্পাহানি, কাজি অ্যান্ড কাজি। মেন্যু দেখা শেষ হলে তিনি কাউন্টারের দিকে তাকালেন, দুজন ছেলে আর একজন মেয়ে ওয়েটার। ট্রাউজার, শার্ট পরা, মাথায় বেসবল ক্যাপ। ছেলেগুলো মেয়েটার সঙ্গে খুনসুটি করছে বলে মনে হলো। মেয়েটি কাজ করতে করতে হাসছে। গায়ে মাখছে না ছেলেদের কথা। কফিশপে মেয়ে ওয়েটার দেখেননি, ক্যাশ কাউন্টারে বসে থাকতে দেখেছেন। এখানে মেয়ে ওয়েটার দেখে আনিসুর রহমান বললেন, মেয়েরা এখন সব চাকরি করছে। একে এক ধরনের এমপাওয়ারমেন্ট বলা যায়।

হাবিবুল্লাহ খান বললেন, সে আপনি বুঝবেন। আমি ভেতরের তাৎপর্য বুঝি না। মেয়েটার চাকরির দরকার ছিল। যা পেয়েছে তাই নিয়েছে। এর মধ্যে এমপাওয়ারমেন্টের বিষয় আছে কিনা তা আমার মাথায় ঢুকবে না।

আনিসুর রহমান বললেন, সবকিছুই ফেসভ্যালুতে নেবেন না। একটু তলিয়ে দেখার চেষ্টা করুন। কিওরিওসিটি। কিওরিওসিটি না থাকলে বাঁচার আনন্দই কমে যায়।

ওয়েটার মেয়েটা হাসিমুখে এগিয়ে এলো তাদের দিকে। আনিসুর রহমান তার অভ্যাস অনুযায়ী নাম জিজ্ঞেস করলেন। বাড়ি কোথায় জেনে নিলেন। মেয়েটি ছাত্রী, এখানে পার্টটাইম চাকরি করছে। না, পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য না। শুনে আনিসুর রহমান অবাক হলেন। বললেন, তাহলে?

রিফাত বলল, আমি, মানে আমরা কয়েক বান্ধবী মিলে একটা ব্যান্ড তৈরি করব। মিউজিক ব্যান্ড।

ব্যান্ড? গানের জন্য?

জি। ফিউশন গান। আমিই লিখব। আমাদের ব্যান্ডের বিশেষত্ব হবে, সব সদস্যই মেয়ে।

কী নাম হবে ব্যান্ডের?

‘আমরা।’

আমরা? আনিসুর রহমানের চোখে কৌতুক।

জি। ‘আমরা।’ সুন্দর না নামটা? তারপর বলল, আপনি ব্যান্ড গান শোনেন?

হ্যাঁ, শুনি। প্রায় সব ব্যান্ডের সিডি আছে আমার কাছে। মাইলস, সোলস থেকে শুরু করে চিরকুট, ওয়ারফেজ। ব্যান্ড মিউজিক তো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এখন।

রিফাত বলল, কিন্তু আপনাদের বয়সের অনেকেই পছন্দ করেন না। বিশেষ করে ফিউশন মিউজিক। বলেন, বিকৃত করা হচ্ছে মিউজিক। অপসংস্কৃতি বলেও সমালোচনা করছেন। আনিসুর রহমান বললেন, আমি করি না। আমি পপ কালচারের কোনো কিছুই অপছন্দ করি না। স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান, সুপারম্যান মার্ভেল আর ডিসি কমিকসের তৈরি কিছুই না।

রিফাত বলল, আপনি ব্যতিক্রমী মনে হচ্ছে। এখন বলুন কী খাবেন? মেন্যু তো দেখেছেন।

অর্ডার দিয়ে আনিসুর রহমান বললেন, এখানে কাজ করতে কেমন লাগছে তোমার? দেখা যাচ্ছে তুমি একাই মেয়ে। ছেলেরা বিরক্ত করে?

বিরক্ত? না। তবে খুনসুটি করে, ক্ষেপাতে চায়। আমি ক্ষেপি না। হেসে উড়িয়ে দিই। গায়েই মাখি না ওদের কথা।

কেন, ক্ষেপাতে চাইবে কেন ওরা?

ওদের জিজ্ঞাসা করুন।

রিফাত চলে গেলে একজন ছেলে ওয়েটার এলো। আনিসুর রহমান বললেন, চমৎকার পরিবেশ। এই একটা মডার্ন চায়ের দোকান দেখতে পেলাম। এমন নাম দিলো কে?

মালিক। তিনি সিনেমার ভক্ত। ছেলেটি বললো।

আনিসুর রহমান বললেন, তাই হবে। না হলে এতো পুরনো সিনেমার নাম মনে রাখবে কে? আচ্ছা একটা কথা বলি কিছু মনে করো না। আমার আবার নাক গলানোর অভ্যাস। ওই যে মেয়ে ওয়েটার। রিফাত। তার সঙ্গে তোমরা খুনসুটি করো কেন?

মজার জন্য। ছেলেটা হেসে বলে।

মজার জন্য? ওর মধ্যে মজার কী দেখলে? ও তো ভদ্র, নম্র হাসিখুশি স্বভাবের মেয়ে। নরমাল। উড়নচ-ী নয়।

ছেলেটি হেসে বললো, নরমাল? না, না। আপনি কিছুক্ষণ দেখেই ওর সবকিছু জানতে পারবেন না। রিফাত অন্য রকমের মেয়ে। অন্য দশজনের মতো না।

বেশ তো? ডিফারেন্ট হলোই না হয়। তার জন্য ঠাট্টা-রসিকতা করতে হবে?

মজা পাচ্ছি যে, সেই জন্য করছি। লেগপুলিং, এর বেশি কিছু না। ওর নিতম্বে চিমটি কাটছে না কেউ। তবে ঠাট্টা করি প্রায়ই ওকে নিয়ে। শি ডাজ নট মাইন্ড।

আনিসুর রহমান বললেন, তাই তো মনে হলো। খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

হবে না।

কেন?

বিকজ শি ইজ ডিফারেন্ট ফ্রম আদার গার্লস। ব্যাপারটা আপনাদের বুঝিয়ে বলা যাবে না। আপনারা বয়স্ক মানুষ। এসব বুঝবেন না। তাছাড়া কাস্টমারদের সঙ্গে নিজেদের বিষয়ে আলাপ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে আমাদের ওপর। আমরা শুধু আপনাদের সার্ভ করব। এর বেশি কিছু না।

হাবিবুল্লাহ খান বলেন, আমার বন্ধুর অভ্যাস হলো যেখানে যান আলাপ জমিয়ে বসেন। স্থান-কাল-পাত্রের কথা ভাবেন না।

ছেলেটি বলল, ডিউটি শেষ হলে আমরা সোশ্যালাইজ করতে পারি। কাজ করার সময় কাজটাই আগে। কিছু মনে করবেন না আমার কথায়।

না, মনে করার কিছু নেই। তুমি যাও তোমার কাজে। তোমার সময় নষ্ট হোক এটা আমরাও চাই না। ছেলেটা একটা ছাপানো ফরম দিয়ে বলল, এতে আপনারা দোকানের খাবার, পানীয়, সার্ভিস, সম্বন্ধে মন্তব্য লিখে পাশের বক্সে ফেলে দিতে পারেন। ম্যানেজমেন্ট দেখবে। প্রয়োজনে পরিবর্তন আনবে।

আনিসুর রহমান কাগজটা হাতে তুলে নিতে নিতে বললেন, একটা ব্যাপার স্পষ্ট হলো না। মেয়েটা অন্য মেয়েদের মতো না, এ-কথা বলছো কেন? আর হলোই না হয় ডিফারেন্ট, তাতে তোমাদের কী আসে যায়? সবাই এক রকম হবে? পস্নুরালিটি থাকবে না?

ছেলেগুলো উত্তর-আধুনিকতা নিয়ে কিছু পড়াশোনা করেনি। বুঝতে পারল না। বোকার মতো তাকিয়ে থাকল।

হাবিবুল্লাহ খান বললেন, আপনি অযথা মাথা ঘামান। চা খেতে এসেছেন, খান। এতো কথা বলাবলি কেন? এখানেও লেকচার দিচ্ছেন। আনিসুর রহমান মাথা নাড়লেন, বললেন, এতোদিনেও কি বুঝতে পারেননি, আমি শুধু কফি খেতে আসি না। অ্যাই কাম টু অবজার্ভ। আমি আপ টু ডেট থাকতে চাই। আমার ভেতরে একজন গবেষক কাজ করছে সব সময়। খুবই কৌতূহলী সে। সব বিষয়ে। হাবিবুল্লাহ খান বললেন, হ্যাঁ। তা টের পেয়েছি। মাঝে মাঝে আপনার এইসব কৌতূহলে ঝামেলাই আছে বলে মনে হয়। কিছু মনে করবেন না। বন্ধু বলেই বললাম।

না। মনে করছি না। তারপর সম্বিত ফিরে পাওয়ার মতো বললেন, আমরা শুধু নিজেরাই এনজয় করছি। ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমাদের বেচারি ওয়াইফ দুজনের কথা ভাবি না। হাবিবুল্লাহ খান বললেন, তারা দুজনে নিজেদের একটা পৃথক ভুবন তৈরি করে নিয়েছেন। আমাদের ওপর নির্ভর করছেন না। একসঙ্গে হিন্দি সিরিয়াল দেখছেন, খাওয়া-দাওয়া করছেন। দে আর এনজয়িং দেয়ার ফ্রিডম।

আনিসুর রহমান বললেন, তাদের জন্য দুটো কেক কিনে নিয়ে যাই কী বলেন? খুশি হবে।

হাবিবুল্লাহ খান বললেন, অতিভক্তি দেখে সন্দেহও করতে পারে। আনিসুর রহমান বললেন, না, না। তা করবে না। এতোদিনে আমাদেরকে চেনা হয়ে গিয়েছে।

চা খাওয়ার পর রিফাত বিল নিয়ে এলো। আনিসুর রহমান বললেন, ব্যান্ড তৈরি হয়ে গেলে জানাবে আমাকে। আমি শুনতে যাবো। তারপর তার হাতের দিকে তাকিয়ে বললেন, সিনেমার সিডি দেখছি। কী নাম? রিফাত একটু অপ্রস্ত্তত হয়ে বলল, এবারে কান ফেস্টিভ্যালে গ্র্যান্ড প্রি পুরস্কার পেয়েছে। বস্নু ইজ দা ওয়ার্মেস্ট কালার। তারপর বললো, আপনাদের জন্য না।

শুনে বেশ অবাক হলেন আনিসুর রহমান। রিফাতের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ভ্রম্ন কুঁচকে। তারপর উঠতে উঠতে বললেন, আবার আসব এখানে। বেশ ভালো চা। কফি খেতে খেতে একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে। হ্যাঁ, তোমাদের ফরম ফিলাপ করে ফেলেছি। এখন বক্সে ফেলব। আমাদের মতামত রয়েছে।

রিফাত বলল, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

 

ছয়

মলের নিচতলায় সিডির দোকানটা একসময় বেশ বড় ছিল, অনেক ছবির স্টক থাকত, ভেতরে কাজ করতো চার-পাঁচজন ছেলে। সব সিনেমার নাম, এমনকি বিষয়ও তাদের জানা ছিল। নাম বলতেই এনে দিত সামনে। কাস্টমারদের ভিড় থাকত প্রায় সব সময়। এখন সেসব বদলে গিয়েছে। দোকান ছোট আকার নিয়েছে, ছবির সংখ্যাও কম। কারণ, অধিকাংশ কাস্টমার এখন স্মার্ট টেলিভিশনেই পছন্দমতো সিনেমা দেখতে পায়। পেন ড্রাইভেও সংগ্রহ করে অনেকে। দোকানে এসে সিডি কেনার আগের চাহিদা নেই। কাস্টমার কমে যাওয়ায় বিক্রেতা ছেলেরা অনেকে চলে গিয়েছে অর্থাৎ চাকরি হারিয়েছে। টেকনোলজি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের দোরগোড়ায়। দাম কমছে। ব্যবহারকারীদের সুবিধা হয়েছে, কিন্তু ব্যবসায়ী আর চাকরিজীবীদের জন্য হয়েছে ক্ষতির কারণ।

পুরনো ছেলেদের মধ্যে মাত্র দুজন আছে এখন। সিডি এখন এক পাশের শোকেসে, অন্য পাশে বিক্রি হচ্ছে মোবাইল সেট ইত্যাদি। তিনি সিনেমার নামটা বলতে যে-ছেলেটা তাকে চেনে এবং সব সময় সিডি দেয় সে ইতস্তত করে বলল, আপনার জন্য?

হ্যাঁ। নয়তো কার জন্য নেবো? সবসময় আমার জন্যই নিই। ছেলেটি বলল, বইটা আপনার ভালো লাগবে না।

কেন, কান ফেস্টিভ্যালে প্রাইজ পেয়েছে। ভালো লাগবে না কেন?

ছেলেটা বললো, ছবিটা অন্যরকম।

আনিসুর রহমান বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি তো জানো আমি সব ধরনের ছবি দেখি। আমার কৌতূহল সবকিছুতে।

তা জানি স্যার। তবে এটা একেবারেই অন্য ধরনের। আনিসুর রহমান বিরক্ত হয়ে বললেন, সে আমি বিচার করবো। তুমি কথা না বাড়িয়ে দাও তো। আর হ্যাঁ জলের গান ব্যান্ডের অ্যালবাম এসেছে? আসলে একটা দাও। ছেলেটি বস্নু ইজ দা ওয়ার্মেস্ট কালার সিনেমার সিডি দিয়ে বলল, জলের গানের অ্যালবাম আসেনি। আনিসুর রহমান বললেন, ন্যান্সি আর তপুর সেই অ্যালবামটা, যেখানে আছে -‘ভেতর বলে আসুক না।’ সেটা দাও।

সেদিনই দুপুরে খাবার পর তিনি সিডি প্লেয়ারে ঢোকালেন নতুন কেনা সিডিটা। স্ত্রী বললেন, একটু ঘুমুবে না। বিকেলে তো আবার দুই বন্ধু বের হবে। একটু বিশ্রাম নাও। তুমি খুব দৌড়াদৌড়ি করছ। কখন যে অসুস্থ হয়ে পড়ো। তারপর দরজার দিকে যেতে যেতে বললেন, হাবিবুল্লাহ ভাবিদের ওখানে যাচ্ছি। টিভিতে সিরিয়াল শুরু হবে।

আনিসুর রহমান হেসে বললেন, তুমিও তো বিশ্রাম নেও না। এখন ছুটলে টিভিতে সিরিয়াল দেখতে। শুধু আমার কথাই ভাবো। তার স্ত্রী দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ভাবতে হয়। সারাটা জীবন ব্যস্ত থাকলে। বই-পড়া, লেখালেখি। ছাত্রীদের পড়ানো। এখনো রাত জেগে পড়ছো, লিখছো। এই কি অবসর নেওয়া?

আনিসুর রহমান প্লে বাটনে চাপ দিয়ে বললেন, জানোই তো, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। পড়াশোনা, লেখালেখি ছাড়া আমি আর কী করতে পারি? ওটাই আমার জীবন।

তাঁর স্ত্রী চলে গেলেন। ছবি শুরু হয়েছে। তিনি উৎসুক হয়ে দেখছেন। প্রথম প্রথম ভালোই লাগল। চমৎকার ফটোগ্রাফি। নতুন প্রজন্মের সব চরিত্র। পার্টি করছে, গান শুনছে। পান করছে, সিগারেট টানছে। দুটি মেয়ের মধ্যে বেশ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যে-মেয়েটি বয়সে বড় তার চুলে নীল রং ডাই করা। একটু পর তারা দুজন যা শুরু করল, তা দেখে তিনি হকচকিয়ে পেলেন, দারুণ শকড হলেন। ঘৃণা আর বিতৃষ্ণায় ভরে গেল মন। তিনি তাড়াতাড়ি সিডি প্লেয়ার বন্ধ করে দিলেন। ঝিম মেরে বসে থাকলেন সোফায়।

বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করলেন, একটা অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা হলে যেমন অস্বস্তি জেগে ওঠে, শরীর-মন অবশ করে দেয়, সেই ধরনের অনুভূতি হলো তাঁর। বিষয়টা সম্বন্ধে তিনি যে জানতেন না, তা নয়। বহুল আলোচিত বিষয়। হিন্দিতেও এ নিয়ে ছবি হয়েছে। মিরা নায়ারের ফায়ার। সেটা এমন বিশদ ছিল না, এমন খোলামেলা নয়। একটা শিল্পিত মান রক্ষা করে বাড়াবাড়ি হতে দেয়নি। কিন্তু যে-ছবি দেখলেন, সেখানে কোনো পরিমিতি বোধ নেই। রিফাত মেয়েটার কথা জানলেন। ওয়েটার ছেলেটার কথা মনে পড়ল। হ্যাঁ, এমন ছবি যে দেখে, সে-মেয়ে ডিফারেন্ট। খুবই ডিফারেন্ট। রিফাত কী? আর ভাবতে পারলেন না তিনি। অস্বস্তি বাড়ল। তারপর আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এলেন। নিজের বিশ্বাসের কথা মনে এলো : সব ধরনের মানুষ নিয়েই সংসার। কেউ ডিফারেন্ট হলেই তাকে ঘৃণা করার কারণ নেই। ভিন্ন রকমের রুচি তার পছন্দের নাও হতে পারে। কিন্তু তার জন্য একজনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় না। আগে যেত, যখন মানুষের সহিষ্ণুতা কম ছিল। এখন সময় বদলেছে। সংখ্যালঘু যারা, তারা নিজের মতো চলবে, এটা মেনে নেওয়া হয়েছে। ইউনিফর্মিটি নয়, পস্নুরালিজমকে গ্রহণ করা হয়েছে। না, তিনি রিফাত মেয়েটাকে ঘৃণা করতে পারছেন না, তার যে-পরিচয়ের ইঙ্গিত পাওয়া গেল, তা যদি সত্যিও হয়, তাহলেও তার অধিকার আছে তার মতো চলার, এ-কথা স্বীকার করতে হয়। হাবিবুল্লাহ খান হয়তো করবেন না, তার রক্ষণশীলতা গভীর। তিনি তার সঙ্গে এ নিয়ে কোনো আলোচনা করবেন না।

সেদিন বিকেলে আনিসুর রহমান, হাবিবুল্লাহ খানকে নিয়ে টি হাউস অব আগস্টে চা খেতে গেলেন। তিনি যে ক্ষেপে যাননি, ঘৃণা করছেন না রিফাত নামের মেয়েটাকে, এটা প্রমাণের জন্যই যেন গেলেন। বেশ স্বাভাবিক হয়ে বসলেন এক টেবিলে। রিফাত নেই, ওয়েটার ছেলে তিনজন কাজ করছে। একটা মেয়ে জিনস পরে একা এক টেবিলে বসে আছে। কিছু পর রিফাত ভেতর থেকে বের হয়ে এলো। কাজের ইউনিফর্ম বদলে নিজের জিনস আর টপ পরে নিয়েছে। তাদের দুজনকে দেখে হেসে বলল, আমার ডিউটি শেষ, আমি যাচ্ছি। আপনারা বসুন। ওরা সার্ভ করবে।

টেবিলে বসে থাকা মেয়েটা উঠে দাঁড়াল। রিফাত তার কাঁধে হাত রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওয়েটার ছেলেটা তাদের দিকে তাকিয়ে হাসল। আনিসুর রহমান যেন দেখেও দেখেননি, এমন ভান করলেন। খুব স্বাভাবিক স্বরে বললেন, আমার জন্য উলুং চা। উনি নেবেন আর্ল গ্রে আর দুজনের জন্যই চিজ কেক। বেশ ভালো তৈরি করো। আমাদের স্ত্রীদের জন্য নিয়েছিলাম। তারাও পছন্দ করেছে।

 

সাত

হঠাৎ খুব জ্বরে পড়লেন আনিসুর রহমান। শরীর কাঁপুনি দিয়ে তাপমাত্রা বাড়ছে। সেই সঙ্গে তীব্র মাথাব্যথা। হাবিবুল্লাহ খান বিকেলে এসে দেখে আনিসুর রহমানের স্ত্রীকে বললেন, ডেঙ্গু হতে পারে। খুব হচ্ছে এখন। একদিন দেখুন। জ্বর না কমলে হাসপাতালে নিতে হবে। ডেঙ্গুর চিকিৎসা বাড়িতে রেখে করা যাবে না। বস্নাড দিতে হতে পারে। তারপর আনিসুর রহমানের স্ত্রীর চিস্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঘাবড়াবার কিছু নেই। বেশ কমন এখন। আনিসুর রহমানের স্ত্রী বললেন, ছেলেমেয়েদের আসতে বলব?

হাবিবুল্লাহ খান বললেন, না। এমন কোনো সিরিয়াস অবস্থা না। ওদের আসতে হবে না। আর আমেরিকা, কানাডা থেকে ছুটি নিয়ে আসা তো খুব সহজ ব্যাপার না। ওদের শুধু জানিয়ে রাখলেই হবে।  জানাবেন, তেমন প্রয়োজন হলে আসতে বলবেন।

একদিন পরও অবস্থায় উন্নতি না হওয়ায় আনিসুর রহমানকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। ডাক্তার দেখেই বললেন, ডেঙ্গু। র‌্যাশ  উঠেছে। বস্নাড টেস্ট করে দেখতে হবে প্লেটলেট কত। বস্নাড টেস্টে দেখা গেল আনিসুর রহমানের প্লেটলেট অনেক কম। তাকে বস্নাড দিতে হবে। আইডি থেকে দেখা গেল তাঁর বস্নাড গ্রুপ এ-পজিটিভ। কে হবে ডোনার? ছেলে-মেয়ে কেউ আছে? ডাক্তার তাকালেন। আনিসুর রহমানের স্ত্রী বিপন্নের মতো বললেন, তারা দেশে নেই। বস্নাডব্যাংক থেকে কেনা যাবে না? ডাক্তার সাহেব কিছু বলার আগেই হাবিবুল্লাহ খান বললেন, আমারও একই বস্নাড গ্রুপ। এ-পজিটিভ। আমি দেবো। এ নিয়ে ভাববেন না ভাবি। আনিসুর রহমানের স্ত্রী কৃতজ্ঞস্বরে বললেন, আপনি দেবেন? আপনার অসুবিধা হবে না? হাবিবুল্লাহ খান হেসে বললেন, বস্নাড দিলে অসুবিধা হবে কেন? আমি তো রুগ্ণ নই।

আনিসুর রহমান প্রায় অচেতন হয়ে শুয়ে আছেন কেবিনে। ডাবল বেডেড, অন্য একজনের সঙ্গে শেয়ার করতে হয়। তারপরও অ্যাটেনডেন্টের রাতে থাকার জন্য একটা করে ছোট বেড আছে। আনিসুর রহমানের স্ত্রী সেখানে রাতে এসে থাকেন। হাবিবুল্লাহ খান দুবেলাই এসে দেখে যান। অনেকক্ষণ থাকেন। বস্নাড দেওয়া ঠিক হয়ে যাবার পর আনিসুর রহমানের স্ত্রী বললেন, আপনি খুব ভালো মানুষ। খুব উপকার করলেন। হাবিবুল্লাহ খান হেসে বললেন, এ এমন কি বিরাট কাজ। বন্ধুর জন্য এটুকু করব না? আনিসুর রহমানের স্ত্রী কৃতজ্ঞস্বরে বললেন, আপনার এই ঋণ শোধ করা যাবে না। হাবিবুল্লাহ খান ডাক্তারের পেছনে যেতে যেতে বললেন, থাক। এটা আর মেনশন করবেন না।

 

আট

আনিসুর রহমান বাড়ি ফিরে এসেছেন। ঘরে থেকেই রেস্ট নিচ্ছেন। হাবিবুল্লাহ খান দুই বেলা এসে দেখা করে যাচ্ছেন। আনিসুর রহমান বললেন, আপনার সকাল-বিকাল হাঁটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে আমার অসুখের জন্য। কয়দিন অপেক্ষা করুন। আবার শুরু হবে। দুর্বলতা কেটে যাক।

হাবিবুল্লাহ খান হেসে বললেন, হাঁটা বন্ধ হয়নি। দুই বেলা হেঁটেছি আপনাকে ছাড়াই। অভ্যেস হয়ে গিয়েছে তো, বিকেলে কফিশপ, ‘টি হাউস অব অগাস্ট মুন’ সব জায়গায় গিয়েছি। ওয়েটার ছেলেটা আর ওই মেয়েটা কি যেন নাম, হ্যাঁ, রিফাত। সে জিজ্ঞেস করেছে আপনার কথা। মনে হলো আপনার জন্য উদ্বিগ্ন সবাই। ফুটপাতের শিল্পী ছেলে দুটো তো হাসপাতালেই আসতে চেয়েছিল। আমি বলেছি, ভিজিটর যাওয়া নিষেধ। হ্যাঁ আমি অভ্যাসগুলো বজায় রেখেছি। যদিও একা একা হাঁটতে, কফি-চা খেতে কখনো ভালো লাগেনি। কিছুক্ষণ থেমে বললেন, ফ্রান্সের এক লেখকের কথা বলছিলেন। এইমলেস ওয়ান্ডারিং-এর ওপর একটা বই লিখেছিলেন। বইটা দেবেন তো, পড়ে দেখি। আমিও এইমলেস হেঁটেছি তো এ-কদিন।

শুনে অধ্যাপক আনিসুর রহমান খুশি হলেন। হাসিমুখে বললেন, নিশ্চয়ই পড়তে দেবো। আমার বাতিকগুলো আপনার ভেতর সংক্রামিত যখন হচ্ছে, তখন বই পড়া বাদ থাকবে কেন? স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান, ট্রান্সফর্মার এইসব পপ কালচারের নিদর্শন ছবি দেখার জন্যও সিডি দেবো আপনাকে। আপনার সিডি প্লেয়ার আছে তো? হাবিবুল্লাহ খান বললেন, একটা ছিল। অনেকদিন ব্যবহার করা হয় না। দেখতে হবে।

আনিসুর রহমান বললেন, দেখুন। মনের যত জানালা আছে সব খুলে দিন। আলো-বাতাস ঢুকুক ভেতরে। বয়স কমে যাবে। কাটাকুটি অপারেশনের পর চোখে যেমন বাইরের পৃথিবী উজ্জ্বল রঙে ঝলমল করে ওঠে তেমন হবে।

হাবিবুল্লাহ খান বললেন, কিন্তু ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবো না। আমার টেকফোবিয়া আছে। দেখেন না স্মার্টফোনই ব্যবহার করি না। আনিসুর রহমান বললেন, আচ্ছা ওটা না হয় থাক। দেয়ার ইজ লাইফ উইদাউট ফেসবুক। সেদিন বাইরে বের হলেন আনিসুর রহমান সাহেব। চা খেতে গেলেন ‘টি হাউসে’। রিফাত মেয়েটা দৌড়ে এলো তার কাছে। খুব আন্তরিক হয়ে বললো, হাসপাতালে ছিলেন, অসুস্থ হয়ে। আমরা শুনে উদ্বিগ্ন হয়েছি। আনিসুর রহমান বললেন, এইসব জ্বর-টর সবারই হয়। এমন সিরিয়াস কিছু না। হ্যাঁ, হতো যদি ক্যান্সার, উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ থাকতো। তারপর হেসে বললেন, আমি অনেক কাস্টমারের মধ্যে একজন। আমার জ্বরের খবর শুনে তোমরা উদ্বিগ্ন হতে গেলে কেন? তাঁর কথার মধ্যে আরো দুজন ছেলে ওয়েটার তাদের টেবিলের কাছে এলো।

রিফাত বলল, আপনাকে আমরা সাধারণ একজন কাস্টমার মনে করি না। আপনি আমাদের কত খোঁজ খবর নেন। তেমন করে আর কেউ তো নেয় না।

শুনে আনিসুর রহমান হাবিবুল্লাহ খানের দিকে তাকালেন। তাঁর মুখে তৃপ্তির হাসি।

রিফাত খুব খুশি হয়ে বললো, আমাদের ব্যান্ডের সব ইনস্ট্রুমেন্ট কেনা হয়েছে। কিবোর্ড, পারকাশন, ড্রামস, গিটার, সিনথেসাইজার,  মাইক্রোফোন আর সাউন্ড বক্স তো আছেই। আগামী সপ্তাহে মেয়েদের স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী কনসার্ট হবে আমাদের। আপনারা দুজন অবশ্যই আসবেন। আমি কার্ড নিয়ে আসবো দুটো। আনিসুর রহমান বললেন, লিড ভোকালিস্ট কে?

রিফাত বললো, কেন আমি? বিশ্বাস করতে পারছেন না বুঝি।

না, না। বিশ্বাস করবো না কেন। তোমার ট্যালেন্ট আছে, কথা শুনেই বোঝা যায়। লিডারশিপ কোয়ালিটিও আছে।

পাশ থেকে একজন ছেলে ওয়েটার হেসে বললো, অনেক ধরনের ট্যালেন্ট আছে এর ভেতর। তার স্বরে ঠাট্টা।

আনিসুর রহমান বুঝলেন ছেলেটা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তিনি বললেন, অনেক ট্যালেন্ট থাকা কি খারাপ কিছু? অমন করে ঠাট্টা করো না। রিফাত তোমাদের সহকর্মী।

হ্যাঁ সহকর্মী। বাট শি ইজ ডিফারেন্ট। ভেরি ভেরি ডিফারেন্ট। আপনাকে বলা যাবে না। বলে হাসাহাসি করলো দুজন।

কেন ডিফারেন্ট তা বলার দরকার নেই। কিন্তু তার ডিফারেন্ট হবার অধিকার আছে। নাকি?

ওয়েটার ছেলে দুজন কিছু না বলে চলে গেল। নতুন কাস্টমার ঢুকেছে। রিফাত তাঁর দিকে তাকিয়ে বলল, থ্যাংক ইউ। তারপর যেতে যেতে বললো, আমাদের ব্যান্ডের উদ্বোধনী কনসার্টে আসবেন কিন্তু। দুজনেই।

‘আমরা’ ব্যান্ডের উদ্বোধনী সন্ধ্যায় আনিসুর রহমান তৈরি হয়ে বসে আছেন। হাবিবুল্লাহ খানের জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি এলেন, গম্ভীর দেখাচ্ছে। সোফায় বসে বললেন, আপনি যান। আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। এমনিতেই ব্যান্ড-মিউজিক পছন্দ করি না; তার ওপর ওপেন এয়ার কনসার্টে যাওয়া! উৎসাহ পাচ্ছি না।

আনিসুর রহমান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, জোর করবো না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করুন, তা আমি চাই না। আপনার ভেতর অনেক পরিবর্তন এনে ফেলেছি, বাকিটুকু না হয় থাক। বলে তিনি উঠলেন। তার যেতে সময় নেবে। স্টেডিয়াম এখান থেকে দূরে। তিনি রিকশায় যাবেন।

সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। উজ্জ্বল আর্ক লাইটে স্টেডিয়াম ঝলমল করছে। লাল-নীল-হলুদ বেলুন উড়ছে। উৎসবের আমেজ চারিদিকে। দর্শক-শ্রোতারা ভরিয়ে ফেলছে স্টেডিয়ামের বসার জায়গা। এটাই প্রথম অল ফিমেল মিউজিক ব্যান্ড ঢাকায়। আইরিশ ‘কর’ অথবা আমেরিকান ‘ডিক্সি ডিকসে’র মতো। ভেঙে যাওয়ার আগে স্পাইস গার্লসও তাই ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে ‘আমরা’ই প্রথম একক মেয়ের দল। ঔৎসুক্য আর কৌতূহল সেই জন্য বেশি।

একটু পর মনে হলো কে যেন ঠেলছে পাশে থেকে। আনিসুর রহমান স্টেজ থেকে চোখ না ফিরিয়ে একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, ঠেলছেন কেন? অনেক জায়গা আছে।

পাশে থেকে হাবিবুল্লাহ খান বললেন, আপনার পাশেই তো বসতে হবে। না হলে একা একা নার্ভাস হয়ে যাবো যে।  আনিসুর রহমান হেসে তার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, এসেছেন? খুব ভালো হলো। একা একা গান শোনা জমতো না।

রিফাত মঞ্চে এলো ঝলমলে কাপড় পরে। হীরার মতো চুমকি বসানো। সাবলীল ভঙ্গিতে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে গাইতে শুরু করলো। প্রথমে গাইলো লালনের গান, ‘যেখানে সাঁইয়ের বারামখানা’। এরপর ‘পারে লয়ে যাও আমায়’। এটা শেষ হলে গাইলো ‘তোমার ঘরে বসত করে ক’জনা, তুমি জানো না’। এরপর আবদুর রহমান বয়াতীর ‘মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি কোন মিস্তরি বানাই আছে’। তারপর গাইলো নিজের লেখা কয়েকটি গান। সুরে ফোক মিউজিকের ফিউশন। আনিসুর রহমান গলার স্বর নামিয়ে বললেন, কেমন মনে হচ্ছে? হাবিবুল্লাহ খান বললেন, আমাদের বয়সী কাউকে দেখছি না। আনিসুর রহমান বললেন, তার জন্য গান শোনার মজা কি কমে যাচ্ছে? শুনুন। স্টেজের দিকে তাকিয়ে থাকুন। তাহলে শুধু গানের কথাই ভাববেন। অন্য কিছু চিন্তা মনে আসবে না। আমাদের দিকে কেউ তাকিয়ে নেই। রিফাত আবার গাইল, ‘তোমার ঘরে বসত করে ক’জনা, তুমি জানো না।’ বোঝা গেল এটা তার প্রিয় গান।

 

নয়

সকালে একসঙ্গে হাঁটতে বেরোবার জন্য এসে হাবিবুল্লাহ খান আনিসুর রহমানের স্ত্রীর কাছে শুনলেন তিনি অসুস্থ। জ্বর হয়েছে, বিছানায় শুয়ে আছেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, আবার জ্বর? এতো ঘনঘন অসুস্থ হচ্ছেন কেন তিনি? আনিসুর রহমানের স্ত্রী বললেন, হবে না। একটুও বিশ্রাম নেয় না। সকাল-বিকাল ঘুরছে। বাসায় এসে হয় লেখালেখি করছে। নয়তো ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। বই পড়ছে। হাবিবুল্লাহ খান বললেন, খুব বেশি জ্বর কি? চলুন তো দেখি।

বিছানার পাশে বসে কপালে হাত দিয়ে হাবিবুল্লাহ খান বললেন, নাহ। এমন কিছু বেশি না টেমপারেচার। ঠান্ডার জন্য হতে পারে। সর্দি-কাশি আছে দেখা যাচ্ছে। আদা-চা খাইয়ে দিন। না হয় কাজি অ্যান্ড কাজির তুলসী চা। কাজে দেবে। আর হ্যাঁ, বিশ্রাম করতে হবে। বলে তিনি উঠলেন। পাশেই আনিসুর রহমানের পড়ার টেবিল। সেখানে কিছু বই, একটা খাতা, কয়েকটা কলম। তিনি বইগুলো উলটে দেখলেন। প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে লেখা ‘পপ কালচার টু-ডে’। ভেতরের পৃষ্ঠার বিভিন্ন তারিখে লেখা নোট, ডায়েরির মতো। তিনি আনিসুর রহমানের দিকে তাকালেন। তিনিও তাঁকে দেখছেন। মুখে হাসি। হাতের আঙুল তুলে ‘ভি’ সাইন দেখালেন।

দুপুরে খাবার তৈরি করে নিয়ে এলেন হাবিবুল্লাহ খানের স্ত্রী। ডাইনিং টেবিলে রেখে বললেন, মাছ, পটোল ভাজা, কাঁচা আম দিয়ে মলা মাছ। জ্বরের মধ্যে খেতে ভালো লাগবে। আনিসুর রহমানের স্ত্রী বললেন, কেন কষ্ট করতে গেলেন? হাবিবুল্লাহ খানের স্ত্রী বললেন, অনেকদিন আপনাদের নিয়ে একসঙ্গে খাওয়া হয় না। জ্বরটা সারুক। আমাদের বাসায় আসবেন। আনিসুর রহমানের স্ত্রী বললেন, আমাদের বাসাতেও হতে পারে। হাবিবুল্লাহ খানের স্ত্রী বললেন, বেশ তো, দু-জায়গাতেই হবে। আগে যেমন হতো, মাঝখানে কেন যেন বন্ধ হয়ে গেল। আবার শুরু করা যাক।

বিকেলে হাবিবুল্লাহ খান আনিসুর রহমানের ফ্ল্যাটে ঢুকে চিনতে পারেন না। সিলিং থেকে লাল-নীল-হলুদ বেলুন ঝুলছে। ঘরভর্তি ছেলেমেয়ে। প্রায় সবাইকে তিনি চিনতে পারলেন। ‘আমরা’ ব্যান্ডের রিফাত আর তার মেয়েবন্ধুরা। কফিশপ, টি-শপের ওয়েটার ছেলেরা, ধানমন্ডি লেকে যেসব ডাক্তারিপড়ুয়া ছাত্র, সুগার টেস্ট করে তাদের তিনজন, ফুটপাতের ছাত্র-আর্টিস্ট চারজন। সবাইকে উৎফুলস্ন দেখাচ্ছে। আনিসুর রহমান ড্রয়িংরুমে মাঝখানের সোফায় বসে আছেন। তার মুখে হাসি। রঙিন পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা পরেছেন। অদূরে তাঁর স্ত্রী বসে। তিনি কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছেন বলে মনে হলো, ঠিক তাঁর মতো। এসব ছেলেমেয়ে এ-বাড়িতে নতুন।

হাবিবুল্লাহ খানকে দেখে আনিসুর রহমান উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, দেখেন ওদের কা-। আমার বার্থডে করতে এসেছে।

বার্থডে? কী করে জানলো আজ আপনার বার্থডে? আমিই তো জানিনে। তিনি বেশ অবাক হয়ে বললেন।

কী করে জানবেন? আমি তো বার্থডে অবজার্ভ করি না। ছেলেমেয়েরা বিদেশ থেকে ফেসবুকে ‘হ্যাপি বার্থডে’ জানিয়েছে। এরাও সেই গ্রিটিংস আর আমার ছবি দেখে চলে এসেছে। সঙ্গে কেকও এনেছে। রিফাত বললো, আমরা সবাই একসঙ্গে পরামর্শ করে আসিনি আঙ্কেল। কফিশপের, টি-শপের ছেলেরা পৃথক পৃথক এসেছে, কেউ কাউকে কিছু বলেনি। আমরাও এদের কাউকে বলিনি এখানে আসার কথা। এখানে এসে একসঙ্গে দেখা হয়ে গেল, যেন সবাই আমন্ত্রিত হয়ে এসেছি। সবাই অবাক আর খুশি।

কিছুক্ষণের মধ্যে ছেলেমেয়েরা টেবিলে প্লেট, গ্লাস সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আনিসুর রহমানের স্ত্রীকে কিছুই করতে দিলো না। কেক কেটে, দলবেঁধে ‘হি ইজ এ ভেরি জলি গুড ফেলো’ গান গেয়ে ছেলেমেয়ের দল ব্যস্ত হয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল। তাদের সবার কাজের সময় এখন। ঘরটা হঠাৎ নীরব হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেন তাঁরা। ততক্ষণে হাবিবুল্লাহ খান তাঁর স্ত্রীকে ডেকে এনেছেন। কফি টেবিলে লম্বা ডাঁটাঅলা নানা রঙের ফুলের তোড়া কয়েকটা। সেদিকে তাকিয়ে হাবিবুল্লাহ খান বললেন, ফুলদানি নেই, ভাবি?

আছে তো, বলে আনিসুর রহমানের স্ত্রী শোকেসের ভেতর থেকে বের করে আনলেন দুটো। পানি ভরে দিলেন হাবিবুল্লাহ খানের স্ত্রী। হাবিবুল্লাহ খান তোড়া থেকে ফুলগুলো ছাড়িয়ে ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখলেন। একটা ফুলদানি রাখলেন কফি টেবিলে, একটা ডাইনিং টেবিলে। সোফায় এসে বসে কিছুক্ষণ তন্ময় হয়ে দেখলেন। তারপর বললেন, খুব ফ্রেশ দেখাচ্ছে। ঘরটার চেহারাই বদলে গিয়েছে। মুড বদলে দিতে ফুলের মতো আর কিছু হয় না। দে আর বিউটিফুল।

সিডিতে গান হচ্ছে, আনিসুর রহমান নিজেই একসময় উঠে গিয়ে প্লেয়ার অন করেছেন। জয়তী মুখার্জ্জী গাইছে : ‘ঘরে কারো ঠাঁই হবে না। মনে ছিল এই ভাবনা। দুয়ার ভেঙে সবাই এসেছে। এসেছে।’ শেষের কথাটায় লম্বা টান। আবেগ-মেশানো এবং আনন্দিত। হাবিবুল্লাহ খান সোফায় বসে থাকা আনিসুর রহমানের দিকে তাকালেন। তাঁর মুখে মৃদু হাসি। তিনি ফুলদানিতে ফুলগুলি দেখছেন। নানা রং একসঙ্গে মিশে হোলি খেলছে। যারা এসেছিল, তারা চলে গিয়েছে। ঘরের ভেতর তাদের স্বর ভাসছে।

 

পাদটীকা :

শিরোনাম, একটি লালনসংগীতের প্রথম ছত্র, লিরিসিস্ট জাহেদ আহমদ। উদ্ধৃতি আর্তুর র্যাঁবোর উক্তি, বুদ্ধদেব বসুর বোদলেয়ার গ্রন্থ থেকে। r

Published :


Comments

Leave a Reply