থমকে থাকা মানুষ আর দেয়াল

মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও।

মানুষই হাত পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও।

মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।

– ‘দাঁড়াও’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়

সভ্যতার শুরু থেকে মানুষই আবাদ করেছে পৃথিবীর ভূমি। কর্ষিত মাটিতে ফসল ফলিয়ে আজকের পৃথিবী গড়ে তুলেছে সেই মানুষ। রুহুল আমিন কাজলের মানুষ নিয়ে ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে এবারের প্রদর্শনীর দুরকম কাজে।

দেয়ালের সামনে মানুষের দীর্ঘ সারি আমাদের জানান দেয়, আশ্চর্য এক
পৃথিবীর সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। দুনিয়ার দেশে দেশে মানুষের সঙ্গে মানুষের সখ্য, আবার মানুষই মানুষের প্রতিপক্ষ হয়ে আছে। কাজলের ফ্রেমবন্দি বা ফ্রেম ছাড়া কাজগুলোতে আমরা মানুষের সারি দেখতে পাই। উদ্বেগজনক
অথবা হতাশাগ্রস্ত মানুষ সারিবদ্ধভাবে হেঁটে চলে প্রামেত্ম। সামনে এসে দেখতে পায় এক দীর্ঘ দেয়াল। ওই দেয়াল নিয়ে কাজলের শিল্পকর্ম। প্রদর্শনীকক্ষক্ষর শুরুতেই একদল মানুষের দীর্ঘ দেয়ালের সামনে জটলা। গ্যালারির পূর্ব-পশ্চিম দু-দেয়ালের মাঝখানে কাজলের ‘ওয়াল অব ফ্রিডম’ সিরিজের কাজগুলো রাখা। এখানে দেখা যায় কাজগুলো কোনোরকম ফ্রেম ছাড়াই দেয়ালে রাখা হয়েছে ছাইরঙা জমিনে এঁটে দিয়ে। মাধ্যমগত ভিন্নতা ছাড়াও কাজের কৌশলে এনেছেন ব্যতিক্রমী ভাবনা।

রুহুল আমিন কাজল আশির দশকে নিজ দেশ ছেড়ে সুদূর ডেনমার্কে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তিনি সড়কে ছবি এঁকে দর্শকপ্রিয়তা পান। রোড পেইন্টিংয়ে তিনি অর্জন করেছেন ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রুহুল আমিন কাজলের ‘পাবলিক আর্ট’ কর্মসূচি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

এবারের ‘ওয়াল অব ফ্রিডম’ সিরিজের কাজে কাজল
রং-প্রয়োগের বাড়াবাড়ি করেননি। বহু রঙের ব্যবহার থেকে দূরে সরে তিনটি রং বেছে নিয়েছেন। ধূসর, কালো ও সাদা। এ তিনটি রং এখানে ব্যবহৃত হয়েছে। দেয়াল প্রসঙ্গে শিল্পী বলেন, ‘দেয়াল হলো সভ্যতার অতি প্রাচীন একটি রূপ, এটি মানুষকে বিভ্রান্ত করে, বদল করে, বিশৃঙ্খলায় উদ্বুদ্ধ করে। এটি মানুষের মাঝে এক হাহাকার ও বিচ্ছিন্নতা এনে দেয়। বার্লিন প্রাচীর থেকে আমরা পৃথিবীর সভ্যতার উদাহরণ হিসেবে নিতে পারি।’ ‘ওয়াল অব ফ্রিডম’ সিরিজের কাজের সামনে রুহুল আমিন যে দেয়ালের আকৃতি ব্যবহার করেছেন তাতে পেনসিলের ভেতরের লিড, রঙিন প্যাস্টেল, পেনসিল ও জলরং ব্যবহার করেছেন। এতে প্রথাগত রং-প্রয়োগের নিয়মকানুন ভেদ করে এক বুনটপ্রধান ক্যানভাস তৈরি হয়েছে।

জলরঙে আঁকা মানুষের ফিগারগুলোতে অ্যাম্বুস পদ্ধতিতে মানুষের মাথাকে ত্রিমাত্রিক রূপ দিয়েছেন। ফলে এ-কাজে পরিপ্রেক্ষিত সৃষ্টি হয়েছে।

প্রদর্শনীর শিরোনাম দিয়েছেন – ‘গ্রিডম অ্যান্ড ফ্রি ফেসেস’। গ্রিডম শব্দটি আভিধানিক না হলেও শিল্পীর ব্যাখ্যা হলো – ফ্রিডম শব্দটি যেহেতু আমাদের কাছে আর অতিদূরের বিষয় সেহেতু ‘গ্রি’ হলো লোভ বা আকাঙক্ষা, সে-শব্দটিকে যুক্ত করে গ্রিডম শব্দ তৈরি করেছেন।

‘ওয়াল অব ফ্রিডম’ সিরিজের মোট ১৩টি কাজ এ-প্রদর্শনীতে রেখেছেন। প্রতিটি কাজ একটি অন্যটির চেয়ে আলাদাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কাজগুলোতে বাস্তবধর্মী গঠনের ইঙ্গিত আছে। একপর্যায়ে বাস্তব আকৃতিকে ভেঙে দিয়ে আকাশ, দেয়াল, দেয়ালের বুনট ও মানুষকে আলাদা ফর্ম তৈরি করে দেখিয়েছেন। এক আকৃতি আর অন্য আকৃতিতে যেমন ঐক্য আছে, তেমনি মানুষ ও দেয়ালের সঙ্গে এক ধরনের ঐক্যবদ্ধ রূপ দর্শক দেখতে পান। এ-প্রদর্শনীর
আরেকরকম কাজ হলো ‘ফ্রি ফেসেস’ বা মুক্তরেখায় আঁকা মুখ। এখানে মুখের ভঙ্গি স্পষ্ট করে গড়ে তোলার চেয়ে কীভাবে কী পদ্ধতিতে প্রতিকৃতি আঁকার কাজটি শিল্পী করেছেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ।

রঙিন কালি, কালার প্যালেট, সঙ্গে জমিন হিসেবে বেছে নিয়েছেন ভারী কাগজ। কালার প্যালেট থেকে রং ধীরে ধীরে ঢালতে থাকেন। এতে ক্রমে তৈরি হচ্ছে মানুষের মুখের বিভিন্ন অংশ। প্যালেটের ধার দিয়ে বেয়েপড়া রঙের সাহায্যে সরু রেখা তৈরি হয়ে মানুষের মুখের সূক্ষ্ম রেখার উপস্থিতি নিশ্চিত করেন।

মুক্তরঙের প্রয়োগের সঙ্গে কোনো তুলির স্পর্শ ছাড়াই এ-প্রতিকৃতিগুলো এঁকেছেন কাজল। প্রতিকৃতি সম্পর্কে কাজলের
মত, ‘আমি চেষ্টা করেছি কালার প্যালেট এবং কালি ও দুয়ের স্বতঃস্ফূর্ত নিরীক্ষায় মনোযোগ দিতে। এ-কাজগুলোতে আমার আনন্দ হচ্ছে, সূক্ষ্ম রেখা আর রং নিজেই সখ্য গড়ে তুলেছে।’ এখানে মুখ আঁকায় নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির হুবহু আদল অনুসরণ করেননি; এটি শিল্পীর লক্ষ্য ছিল না। শিল্পী এ-মুখগুলোতে প্রকাশ করতে চেয়েছেন তাবৎ মানুষের মুখে যে রেখা ও রং আছে, তা। তাতে এক ধরনের ভাষা আছে। মানুষের মুখের ভাষা আর মননের ভাষা খুঁজতে চেয়েছেন কাজল। এতে সৃষ্টি হয় এক ভাবব্যঞ্জনা। প্রধান মুখাবয়ব।

‘ওয়াল অব ফ্রিডম’ ও ‘ফ্রি ফেসেস’ দুরকম কাজের মাঝে রুহুল আমিন কাজল অতিনিকটবর্তী মানুষের বৈশ্বিক ও ব্যক্তিগত সংকটের রূপ প্রকাশ করেছেন। ফলে কাজগুলো বিষয়প্রধান হয়ে ওঠার পাশাপাশি নিরীক্ষাধর্মী শিল্পচর্চার উদাহরণ বলা চলে।

পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষের প্রতিবন্ধকতা মানুষই। কাজল তাই বিষয় হিসেবে মানুষ বেছে নিয়েছেন। প্রকৃতি আর মানুষ এই দুয়ে মিলে গড়ে উঠেছে পৃথিবী। লোভাক্রান্ত মানুষের স্বার্থে স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। আবার মানুষই সে-স্বাধীনতা অর্জন করে। তাই হয়তো এ-প্রদর্শনীর শিরোনাম – ‘গ্রিডম অ্যান্ড ফ্রি ফেসেস’।

রাজধানীর লালমাটিয়ায় অবস্থিত শিল্পাঙ্গন গ্যালারিতে গত ১৫ মার্চ শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনী শেষ হয় ২৪ মার্চ।