দখিনের জানালায় দীর্ঘশ্বাস

এক.

 

সদ্য টানানো জানালার রঙিন পর্দাগুলোর দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্টি ফুটে উঠলো আমিরুল ইসলামের চেহারায়। ঠোঁট টিপে হাসলেন কতক্ষণ। পিছন ফিরে টয়লেটের দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। খালি পায়ে টয়লেটের শ্যাওলা ধরা স্যান্ডেল পরতে পরতে আবার তাকালেন ঝোলানো পর্দাগুলোর দিকে। নিজের মনেই মাথা দুলিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলেন।

 

টয়লেটের কাজ সারার সময়ও তার মাথায় রঙিন পর্দাগুলোর কথা খেলতে লাগলো। প্যানে বসেই হঠাৎ খেয়াল করলেন মাথা সমান উঁচুতে ছোট্ট একটা ফোঁকর আছে টয়লেটের। পাশের বিল্ডিঙের প্লাস্টারবিহীন ইট চোখে পড়ছে ফোঁকর দিয়ে। ব্যাপারটা কেনো জানি পছন্দ হলো না আমিরুল ইসলামের। তাড়াহুড়ো করে বের হলেন টয়লেট থেকে। বিছানার উপর জড়ো করে রাখা পর্দার স্তুপ থেকে একটা পর্দা তুলে নিয়ে ঝুলিয়ে দিলেন বাথরুমের দেয়ালে। সন্তুষ্টি ভাবটা ফিরে এলো তার চেহারায়। পর্দার একটা পাশ ঝুলে গিয়ে ফ্লোরে লেগে আছে। লাগুক। পাত্তা দিলেন না তিনি।

 

কাজ সেরে হাত ধুতে গেলেন। জোরে কল ছেড়ে পা ধুলেন। পা ধুতে ধুতেই খেয়াল করলেন পানির ছিটকায় পর্দা ভিজে যাচ্ছে। ভিজা হাত দিয়েই তাড়াহুড়ো করে পর্দাটা খুলে আবার রুমে নিয়ে এলেন তিনি। একেবারে বাদাম-বুটের দামে কিনেছেন বলে পর্দাটা নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।

 

জানালা ছাড়াও আর কোথায় পর্দা লাগানো যায় ভাবতে লাগলেন আমিরুল ইসলাম। চার দেয়ালের ছোট্ট রুমে আতিপাতি করে খুঁজেও পর্দা ঝোলানোর জায়গা পেলেন না। উল্টো হামিদা বেগমের ছবিটার দিকে চোখ পড়ল। আহা বেচারি, বেঁচে থাকলে কী খুশিই না হতো! পর্দা কিনে এতোগুলো টাকা নষ্ট করার জন্য ধমকও দিতেন তাকে। গজগজ করতে করতেই হয়তো খুব যত্ন নিয়ে পর্দাগুলো ভাঁজ করে উঠিয়ে রাখতো সে।

 

সেই রাতে ভালো ঘুম হলো না আমিরুল ইসলামের। তিনি দুঃস্বপ্ন দেখলেন। জেগে জেগে উঠলেন সারা রাত। দখিনা বাতাস জানালার পর্দা উড়িয়ে নিতে চাইছিল। না পেরে পর্দার কোণগুলো দিয়ে আমিরুল সাহেবের বুক-পেট-মুখ আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো শুধু।

 

তিনি পর্দার আলতো ছোঁয়া টের পেলেন না। তবে দখিনা বাতাসের তোড়ে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো বার বার।

 

 

দুই.

 

বায়তুল মোকাররমের উল্টো দিক। সন্ধ্যা হতেই সারি সারি লাইট জ্বলে উঠে ফুটপাতের দোকানগুলোর। সাদা ধবধবে লাইটগুলোর মাঝে একটা ষাট পাওয়ারের “না লাল – না হলুদ” রঙের বাল্বও জ্বলে উঠে। একসার সাদা লাইটের মাঝে সেই রঙ ছন্দপতন ঘটায় পথিকের। চোখে পীড়া দেয়।

 

পেঁচিয়ে রাখা গাট্টির দড়ি খুলে বিভিন্ন ডিজাইনের ব্যবহার্য পুরনো পর্দা নিয়ে সেখানেই বসেন আক্তার আলি। সাদা আর কমদামি বাল্বের আলোয় ভূতুড়ে চেহারা পায় বর্ণিল পর্দাগুলো। এই ভূতুড়ে চেহারাতেই নিরাপদ বোধ করেন আক্তার আলি। পর্দাগুলো এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে রেখে তিনি একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় তার ছোট ছেলে।

 

প্রতি পিস পর্দার দাম বার বার ঘোষণা করতে করতে দিনে বেশ কয়েকবার গলা ভাঙ্গে আট বছর বয়সী শিশুপুত্রের। বিরতিহীন উপর্যুপরি চিৎকারে শুধু পর্দার দাম “পঞ্চাশ” শব্দটাই হারিয়ে যায় ক্লান্ত অবসন্ন কণ্ঠ থেকে। তখন বাচ্চা ছেলে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে দোকানের সামনে।

 

দূর থেকে দৌড়ে আসেন আক্তার আলি। ধমক লাগান, “কি রে, বই রইছত কিল্লাই? কথা বারোয় না মুহেত্তে? ভাত খাস নো?”

 

ছোট্ট ছেলে আবার পঞ্চাস শব্দের জিগির তোলে। পথচলতি কোন কোন আমিরুল ইসলাম সেই জিগিরে মুখ তুলে তাকান। কেউ বা তাকান না।

 

 

তিন.

 

বিকেলে অফিস থেকে ফিরে বাসার ভিতরে ঢুকেই হতভম্ব হয়ে গেলেন রওশন আরা। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের তেরছা আলো হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছে ঘরের পর্দাহীন ন্যাংটো জানালা দিয়ে। লাঞ্চবক্সের ব্যাগটা হাত থেকে পড়েই গেলো একরকম। কষ্টের টাকায় বড় শখ করে কেনা হয়েছিলো পর্দাগুলো। জানালা খোলা পেয়ে বাইরে থেকেই টেনে ছিঁড়ে নিয়েছে কেউ।

 

টাকাগুলির কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক থেকে। খোলা জানালা দিয়ে আসা ঝাপটা দখিনা বাতাস ছিনিয়ে নিলো সেই দীর্ঘশ্বাস। কতক্ষণ ঘুরলো এই ঘরের ভেতরেই। তারপর আলতো ছোঁয়া হয়ে অপর জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেলো কোনো এক আমিরুলের দিকে।