দামু নাপিত

সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

দামু নাপিতকে আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখেছি। সে কোথায় কোন গাছতলায় বসে কার দাড়ি চাঁছত, জানি না; তবে আমাদের বাড়ি আসত পনেরো-বিশ দিন বা মাসখানেক অন্তর-অন্তর। খাড়া-খাড়া কাঁচাপাকা চুল, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, চোখদুটো লালচে মতন, দাঁতগুলো ক্ষয়া। বলতে নেই, সে দেখতে ছিল খুবই বিচ্ছিরি। অবশ্য নাপিত – যাকে আবার লোকে বলে : নাপ্তে, সে সুদর্শন হবে – কে-ই বা আশা করে! তার হাতে থাকত একটা ছোট কাঠের বাক্সো – তার মধ্যেই তার যন্তরপাতি। যতদূর মনে হয়, কাজটা সে করত ভালো-ই; স্বভাবেও ছিল বিনয়ী।

দামু নাপিত ছোটবেলায় আমাদের চুল কেটে দিয়েছে; আমার বোনকে একবার ন্যাড়া পর্যন্ত করে দিয়েছিল। ক্ষুর দেখে বোন ভয়ে কাঁদছিল; আর দামু তাকে সমানে বলে যাচ্ছিল : কাঁদে না, মা, এই তো হয়ে গেল! চুল-কাটার সময় দামু আমাদের বলত : উঁহু, একদম নড়বে না। – কিন্তু কে শোনে কার কথা! বারবার মাথা নাড়াতে থাকলে দামু এত শক্ত করে ঘাড়টা চেপে ধরত যে, বেশ ব্যথা লাগত; কিন্তু ভয়ে কিছু বলতে পারতাম না।

তারপর আমরা সবাই বড়ো হয়ে গেলাম। বাড়ির সামনে সেলুন থাকলে কে আর নাপিতের কাছে ঘাড় নিচু করে! দামুর তখন একমাত্র কাজ ছিল আমার মায়ের পায়ের নখ কেটে দেওয়া। না, শুধু নখ নয়। মায়ের পায়ে প্রায়ই কড়া পড়ত। আর সেই শক্ত সুপুরির মতো জিনিসটা নিখুঁতভাবে কেটে দিত দামু। সেসব দিনে দামুর বাক্সো থেকে বেরোতে শুধু ক্ষুর নয়, একটা নরুনও। একটা ছোট পাথরের টুকরো আর তোবড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের বাটিও বেরিয়ে আসত।

দামু বলত : একটু জল দ্যান, মা। – বাটি থেকে জল নিয়ে শক্ত কড়াটা সে বারবার ভিজিয়ে নরম করে নিত। পাথরে জল দিয়ে ঘষে ঘষে শানিয়ে নিত নরুনটাকে। তারপর শুরু হতো তার সার্জারি। আমরা অবাক হয়ে দেখতাম।

দুআনার বেশি দামু কোনোদিন পেয়েছে বলে মনে পড়ে না। কিন্তু তা নিয়ে তার মনে কোনো অসন্তোষ ছিল না। আমার ধারণা, দামুর দুঃখ ছিল একটা জায়গাতেই। দিদিদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু বিবাহ-অনুষ্ঠানে পরামানিকের ভূমিকায় তাকে কোনোদিন আমন্ত্রণ করা হয়নি। সে-কাজ করত পাড়ার সেলুনের এক ছোকরা : পরিতোষ, যে নাকি ‘জাতে নাপিত’।

আমরা শুনতাম, সেলুনে যারা চুল ছাঁটে বা দাড়ি কামায়, তারা সকলেই কৌলিক-বৃত্তিতে নাপিত নয়। কাজ শিখে ঢুকে পড়েছে। পরিতোষই ছিল জাত-পরিচয়ে নাপিত বা পরামানিক। তাই ডাক পড়ত তারই। বিয়ের তিন-চারদিন আগে গিয়ে চিঠি দিয়ে না হলেও মুখে অন্তত আমন্ত্রণ করে আসতে হতো তাকে। হিন্দু-বিয়েতে নাপিতের মর্যাদা কিন্তু পুরুতের থেকে কিছু কম নয়। নাপিত না থাকলে বিয়েই ধর্মসিদ্ধ হবে না। আর একটা খুব বড়ো কথা : বর-কনের সামনে নাপিত ছড়া কাটে আর অশ্রাব্য কথা বলে। সেই লাইসেন্স সমাজ তাকে দিয়েছে। তবে খুব বেশি বাড়াবাড়ি করলে কত্তাবাবুদের কেউ হয়তো বললেন : হয়েছে, এবার থামো হে! – ওইটুকুই। আহা, লোকসংস্কৃতি নিয়ে আজকাল এত বই বেরোয়, নাপিতের ছড়া কি কেউ সংকলন করে রেখেছে?

পরিতোষ প্রামাণিক যুবকটি ছিল বেশ স্মার্ট গোছের। সে জেনে নিত বিয়ের লগ্নটা কখন। তারপর পাটভাঙা শার্টপ্যান্ট পরে, চুলে টেরি কেটে, মুখে একটা মিচকে হাসি নিয়ে হাজির হয়ে যেত ঠিক সময়ে। পরিতোষের একটা গুণ ছিল। সে ছড়া কাটত, কিন্তু মুখ খারাপ করত না। তার বদলে ছড়ার ভেতর হঠাৎ করে ঢুকিয়ে দিত বৈজয়ন্তীমালা, ওয়াহিদা রহমান বা ওই জাতীয় কিছু নাম। এটা নিশ্চয় পরিতোষের নিজস্ব উদ্ভাবন। তাই তার একটা খাতির ছিল পাড়ায়। দামু নিশ্চয় সব খবরই পেত; সে যথেষ্ট আধুনিক নয় বলে তার হয়তো একটা দুঃখও ছিল। কিন্তু তা সে কোনোদিন প্রকাশ              করেনি। তারও হয়তো একটা আত্মমর্যাদাবোধ ছিল।

সেই মর্যাদার স্বীকৃতি দাম যে কোনোদিন দামু পেতে পারে, তা নিশ্চয় সে কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু তা-ই ঘটে গেল আমার ছোট্দির বিয়ের দিন। সকালে জানা গেল, পরিতোষের ভয়ানক পেট খারাপ, সে আসতে পারবে না। সেলুনের মালিক বিশুদা নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে আরেকজনকে পাঠাতে চাইলেন; কিন্তু যতদূর জানা যায়, সেই ছোড়াটা জাতে নাপিত নয়। তখন নাম উঠল : দামু। ধর-&ধর্ করে বস্তিতে ছুটে গিয়ে দামুকে বলা হলো : সন্ধে সাতটার মধ্যে তাকে আসতেই হবে।

আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম না। তাই তার ক্ষয়ধরা দাঁত আর হলুদ মাড়ি নিয়ে দামু তখন কীরকমভাবে হেসেছিল, বলতে পারব না। সন্ধেবেলা তাকে দেখে আপনা থেকেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল : এসেছো দামুদা! – এর আগে তাকে কোনোদিন দাদা ডেকেছি বলে মনে পড়ে না।

দামু সেদিন পরিপাটি করে দাড়ি কামিয়েছে, মোটামুটি পরিষ্কার ধুতি-শার্ট পরেছে, আর মুখভর্তি পান নিয়ে খুব গম্ভীর হয়ে আছে। দামুকে মনোনয়নের সময় কে যেন বলেছিল : ব্যাটা খিস্তি যা ছোটাবে না, বাপের নাম ভুলিয়ে দেবে! সেই আশঙ্কা হয়তো সত্যিই ছিল। কিন্তু দামু তার ছড়ায় একটিও অশিষ্ট শব্দ ব্যবহার করেনি। অন্তত সবাই তা-ই মনে করেছিল। আমার অবশ্য কিছু বলার আছে – সেটা পরে হবে।

দামু যা চেয়েছিল সেই টাকা, নতুন ধুতি সবই তাকে দেওয়া হলো। বারবার বলা হলো : খেয়ে যাবে, দামু – ভালো করে খেয়ো। – দামু বিনয়ে মাথা নিচু করল। তারপর তো বিয়েবাড়ি জমে উঠেছে। কে কার খবর রাখে! কিন্তু এক অপ্রতিরোধ্য ভূমিকায় নিজেকে স্থাপন করে দামু আবার স্বনামখ্যাত হয়ে উঠল ঘণ্টাখানেক পরেই। সংক্ষেপে বলছি, ঘটনাটা যা শোনা গেল, তা এই : খেতে বসে দামু হঠাৎ হড়হড় করে বমি করে ফেলেছে : মাল টেনে এসেছিল ব্যাটা, কী দুগ্গন্ধ রে বাপ্! এরপর সদ্য পারিতোষিক-ভূষিত দামুকে একরকম ঘাড়ে রদ্দা মেরেই বের করে দেওয়া হয়। তারপরও দামুর নামটা বিয়েবাড়ির বহুল বিচিত্র উচ্ছ্বাসধ্বনির মধ্যে উচ্চারিত হতে থাকে কিছুক্ষণ।

আমার এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, একটি সুভদ্র ভূমিকায় অভিনয় করার জন্যেই সেদিন দামুর প্রয়োজন হয়েছিল মদের মতো একটি উদ্দীপকের। কিন্তু সে সচেতন ছিল। প্রচুর পান খেয়েছিল এবং স্টেজে নামার আগে পর্যন্ত চুপচাপ ছিল। ছড়া-কাটার সময় তার মুখ দিয়ে একটা অশিষ্ট শব্দ প্রায় বেরিয়ে এসেছিল – আমি অন্তত সেটা ধরতে পেরেছিলাম। দামু বলতে চাইছিল : বিবাহের সঙ্গে জড়িত আছে যে-পবিত্র জীবধর্ম, সেই কাজটি বিয়ের আগে করলে গর্হিত বলে গণ্য হয়। দামু ‘চু’-পর্যন্ত বলে ফেলেছিল, তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে জুড়ে দেয় ম্। ফলে কথাটা দাঁড়ায় এই যে, বিবাহ-ই নর-নারীকে পরস্পরের মুখচুম্বনের অধিকার দেয়। এ তো রীতিমতো কাব্য! ছড়া কাটতে গিয়ে পদ্য বলছে যেন ব্যাটা নাপ্তে!

আগেই বলেছি, দামুকে লোকে নাপতেই বলত। ছোট্দির বিয়ের মাসখানেক পরে দামু এসেছিল এবং চৌকাঠে মাথা ঠেকিয়ে নিজের বাপ কেন, বংশ পর্যন্ত তুলে মার্জনা চেয়েছিল এই ভাষায় : ময় নাপ্তের ব্যাটা, মাফ করে দ্যান, মা-ঠাকরুন!