দার্শনিকের জ্ঞানচর্চা

সনৎকুমার সাহা

 

রমেন্দ্রনাথ ঘোষ

দার্শনিক প্রবন্ধাবলি

সম্পাদনা : হাসান আজিজুল হক

মহেন্দ্রনাথ অধিকারী

 

ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ

ঢাকা, ২০১৪

 

৫২৫ টাকা

 

Ramendra Nath Ghose : Philosophical Essays

সম্পাদনা : হাসান আজিজুল হক মহেন্দ্রনাথ অধিকারী

ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ

ঢাকা, ২০১৪

৫৫০ টাকা

 

ডক্টর রমেন্দ্রনাথ ঘোষ (১৯৪১-২০১১) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়াতেন। তিনি যখন বাগেরহাট থেকে বিএ পরীক্ষায় প্রথম হয়ে এখানে এমএ পড়তে আসেন, সেই ১৯৬০ সাল থেকেই তাঁকে চিনতাম। ছোট জায়গা। মেধার খ্যাতি তাঁর আগে আগে চলত। তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু মাস্টার্স কোর্স চালু ছিল। সবে দুবছর চলছে। হাতেগোনা কটা বিষয় মাত্র। যাঁরা ভালো ফল করত পরীক্ষায়, তাঁরা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করত। হাটে-বাজারে-দোকান-পাটেও। রমেনকে নিয়েও একটা কৌতূহল তৈরি হয়। বিদ্বজ্জনদের কাছে আরো বেশি। তবে শুরুতেই দেখি, কারো মনের মতো হওয়ার চেষ্টা তিনি আদৌ করেন না। চলেন তিনি আপন খেয়ালে। এবং সেই খেয়াল পুরোটাই জ্ঞানের রাজ্যে। তাতে আবার দর্শনের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর  বিচার-বিবেচনারই প্রাধান্য। বিজ্ঞ অধ্যাপকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ঠিকই। তবে আমরা যারা এলেবেলে, দূরে সরি। তিনি এসব খেয়ালও করেন না। হঠাৎ কখনো সামনাসামনি পড়লে তাঁর চিন্তার বিষয় নিয়ে কথা উঠলেই আর দেখতে হতো না। বিষয়ের মূলে গিয়ে তিনি থামতেন। আমরা অবাক হতাম। প্রত্যাশিতভাবেই এমএ পরীক্ষায় তিনি ঈর্ষণীয় ভালো ফল করে – প্রথম শ্রেণিতে প্রথম – প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুযোগ পেলেন। তিনিও অন্য কোনো দিকে তাকালেন না। যেন বিদ্যাচর্চাই তাঁর অনিবার্য নিয়তি। বাস্তবে এতেও যে কিঞ্চিৎ হিসেবি হওয়া দরকার, এটা তাঁর কখনো মাথায় আসেনি। গরুড়ের ক্ষুধা নিয়ে দর্শনের সব শাখাতেই তিনি নাক ডুবিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। ফাঁকি দিয়ে সহজে কার্যোদ্ধারে তাঁর উৎসাহ ছিল না। অমৃতের শেষ বিন্দুটুকুও শুষে নিতে তিনি উন্মুখ থাকতেন।

তারপরেও বিদ্যা-শৃঙ্খলার বিধি মেনে চলেছেন তিনি বরাবর। কী প্রাচ্যদর্শনে, কী পাশ্চাত্য দর্শনে। এখানে কোনো যৌক্তিক স্খলনের সঙ্গে এতটুকু আপোষ করেননি। বিদ্যার প্রাথমিক উৎসে পৌঁছতে তাঁর চেষ্টায় কখনো কোনো ঘাটতি ছিল না। চারপাশের পরিবেশ সবসময়ে অনুকূল থাকত না। এতে তিনি আহত হতেন। তবে কখনো হতোদ্যম হননি। যথারীতি ডক্টরেট তিনি করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রখ্যাত অধ্যাপক শিবজীবন ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে মহাযান বৌদ্ধ-দার্শনিক নাগার্জুনের দ্বন্দ্ব-মীমাংসা সূত্রের ওপর তাঁর অসাধারণ কাজ। একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে এটি এখন দর্শনের সব উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই স্বীকৃত। এছাড়া অক্সফোর্ডে অধ্যাপক স্ট্রসন ও বিমলকৃষ্ণ মতিলালের সঙ্গেও তিনি একান্তে ন্যায়-দর্শনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। ভারতীয় দর্শনের ওপর বাংলা একাডেমির প্রকাশনায় তাঁর লেখা বইটি বাংলাভাষায় অতুলনীয় বলেই পন্ডিত মহলের ধারণা। এছাড়া অবসরে যাওয়ার পর বড় আকারে একটা কিছু করার ছক তিনি মনে মনে অাঁকছিলেন। ঘরের লাইব্রেরিও সেই অনুযায়ী সাজিয়েছিলেন। কিন্তু তা আর হলো না। দুরারোগ্য পার্কিনসন্স রোগে তাঁকে ধরল। হৃদযন্ত্রও বিকল হতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ২৫ অক্টোবর, ২০১১ তাঁর জীবনাবসান। তাঁর মননের অভিযান অসম্পূর্ণই রয়ে গেল। হয়তো অনেকেরই এমন হয়। কিন্তু আমাদের একটা আক্ষেপ থেকে যায়, এত বড়মাপের এক মনীষী, তাঁর মেধা ও প্রতিভার পরিচয় খুব কম জনই জানল। হয়তো তাঁর আগ্রহের বিষয় এর একটা কারণ। জনরুচি ধর্মের প্রথাশাসিত  আচার-বিশ্বাসে নিরাপত্তা খোঁজে। বুদ্ধিমান-বিজ্ঞজনেরা ছোটেন অর্থকরী বিদ্যার পেছনে। গণপাঠকের আনুকূল্য দাবি করে এক ধরনের তরলিত বাক্-মদিরা। এতে তাঁর আগ্রহ ছিল না। আপন চিন্তাকে খুব উঁচু তারে বেঁধে, আরো ওপরে ওঠার পথ তিনি খুঁজেছেন জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও। এমন কঠিন পথে চলতে ছাত্রছাত্রীরাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলত। ফলে বৃহৎ সমাজে তিনি একরকম অপাঙ্ক্তেয়ই ছিলেন। অবশ্য দর্শনের প্রকৃত বোদ্ধাদের কাছে তাঁর শ্রদ্ধার আসন অটুট ছিল। কিন্তু সমাজে ওই বোদ্ধাদের সংখ্যা ও অনুপাত, দুটোই দ্রুত ক্ষীয়মাণ। শুধু হাতেগোনা কিছু বিরল প্রতিভা তাঁর কদর বুঝতেন। যেমন, চট্টগ্রামে প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম, ঢাকায় প্রফেসর গোবিন্দচন্দ্র দেব ও প্রফেসর আবদুল মতীন, রাজশাহীতে প্রফেসর মফিজুদ্দিন আহমদ। তাঁদের যুগ, বোধহয়, আজ অতীত। উত্তর-আধুনিক দর্শনের নামে আজকাল কেউ কেউ ঢাক বাজান। আমার মনে হয়, তা বৃহৎ ফাঁকিবাজি, অথবা, ধুরন্ধর ফন্দিবাজ কর্তার ইচ্ছায় কর্ম।

অবশ্য কর্মজীবনে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন, এমন কথা বলা যায় না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসরের সর্বোচ্চ মর্যাদায় থেকে তিনি অবসরে যান। ১৯৭১-এ উদ্বাস্ত্ত হয়ে সপরিবারে যখন তিনি ভারতে, তখন বরোদা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাময়িক অধ্যাপনার সুযোগ পান। ওই অল্প সময়েই তাঁর মেধা ও পান্ডিত্যের পরিচয়ে মুগ্ধ হয়ে তাঁরা তাঁকে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু সদ্য স্বাধীন মাতৃভূমিতে তাঁর ‘যেটুকু সাধ্য’ তা ঢেলে দেওয়ার ব্যাকুলতা নিয়ে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে তিনি ফিরে আসেন। দর্শনের রীতিসিদ্ধ চর্চায় তিনি ছিলেন ক্লান্তিহীন। দেশে এবং বিদেশেও তাঁর বহু প্রবন্ধ/ ভাষ্য গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়। কিন্তু  তাদের প্রতিধ্বনি বা প্রতিক্রিয়া এখানে খুব একটা পাই না। কোনো দার্শনিক-তর্কের পরিবেশ তৈরি হয় না। তিনি একরকম অনালোচিতই থেকে যান।

তাঁর চলে-যাওয়ার পর এর আক্ষেপ সবচেয়ে বেশি বাজে তাঁর পরিবার-পরিজনের ভেতরে। তাঁর সহধর্মিণী শ্রীমতী ছন্দা ঘোষ নিজেও দর্শনপাঠে কৃতী। তাঁদের সবার ইচ্ছার কথা তিনি নিজেই জানিয়েছেন এখানে। তিন ছেলে ও পুত্রবধূরাও সমান উৎসাহী। প্রধানত তাঁদের উদ্যোগেই অধ্যাপক ঘোষের ইতস্তত ছড়ানো-ছিটানো বেশকিছু দার্শনিক প্রবন্ধ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সম্পাদনার ও উপযুক্ত প্রকাশনের, যাতে তা উৎসাহী পাঠকের দৃষ্টির আড়ালে চলে না যায়। এ-সমস্যারও সমাধান মেলে। বলা যায়, বেশ সহজেই। স্কুল-কলেজে পড়েছে, এমন বাঙালি, সে যে-দেশেরই হোক, হাসান আজিজুল হকের নাম জানে না, খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তিনিও দর্শন পড়িয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। অধ্যাপক ঘোষ ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। বাংলা কথাসাহিত্যে, বলা যায়, গোটা গদ্যসাহিত্যে হাসানের অসামান্য অবদানের কথা এখানে তুলছি না। রীতিনিষ্ঠ দর্শনচর্চাতেও তিনি যে অগ্রগণ্য, এ-কথাটা তাঁর কথাসাহিত্যিক পরিচয়ের আড়ালে প্রায়ই যে চাপা পড়ে যায়, তা আমরা খুব একটা খেয়াল করি না। পাঁচ খন্ডে ডক্টর গোবিন্দচন্দ্র দেব-রচনাবলির তিনি সম্পাদক। তাঁর সামর্থ্যের পরিচয় এতেই যথেষ্ট ফুটে ওঠে। এছাড়া প্রাচীন গ্রিক দর্শনের প্রেক্ষাপটে তাঁর লেখা সক্রেটিস বইটি শুধু দর্শনের ছাত্রের নয়, যে-কোনো পাঠকেরই মনোযোগ আকর্ষণ করে। তাঁর লেখা শুদ্ধ দার্শনিক প্রবন্ধও অন্য মাত্রা পায়। রমেন ঘোষের প্রবন্ধাবলির মান তাঁর জানা ছিল। আমাদের মননের ধারাবাহিকতার চর্চায় তারা হারিয়ে যাবে, এটা তিনি মানতে পারছিলেন না। উপযুক্ত সম্পাদনায় তাদের গুছিয়ে বের করা হোক, মনেপ্রাণে তিনি এমনটিই চাইছিলেন। কিন্তু এ-কাজে তাঁর চেয়ে যোগ্য কারো কথা তো ভাবা যায় না। অথচ শারীরিক অসুস্থতায় তিনি তখন কাতর। উপায় একটা হয় ডক্টর ঘোষের সাক্ষাৎ ছাত্র ও দর্শন বিভাগে দীর্ঘদিনের এক সহকর্মী প্রফেসর মহেন্দ্রনাথ অধিকারী স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়ালে। হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে তাঁর যুগ্ম সম্পাদনায় তৈরি হয় দুই খন্ডে রমেন্দ্রনাথ ঘোষ দার্শনিক প্রবন্ধাবলি। প্রথম খন্ডের সব লেখা বাংলায়। তাঁর ইংরেজিতে লেখা প্রবন্ধগুলো একত্রে দ্বিতীয় খন্ডে – Ramendra Nath Ghose : Philosophical Essays। ঢাকার ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ বইটি ছেপে বের করে (ডিসেম্বর, ২০১৪)। অবশ্য আর্থিক দায় বহন করে রমেন ঘোষের পরিবার। গোটা কাজে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন তাঁর আর এক গুণগ্রাহী, ডক্টর অনুপম হাসান। এটা যে কতবড় কাজ, তা সবাই আমরা বুঝে উঠতে পারি কিনা জানি না। তবে তাঁরা যে এই মহৎকর্তব্য সফল করে তুলেছেন, এতে তাঁদের সবার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খবরে নাক গলাবার অধিকার এর বেশি আমার নেই। কিন্তু রমেনের স্মৃতি তাগাদা দেয়, যেন আমার কথাও কিছু বলি। তাই শুদ্ধতাবাদীদের কাছে মার্জনা চেয়ে নিই। তাঁরা অবশ্য বাকি সবটাই খারিজ করে দিতে পারেন।

আগেই বলেছি, সম্পাদকদ্বয় অধ্যাপক ঘোষের রচনাগুলো বাংলা ও ইংরেজি, দুই খন্ডে আলাদা-আলাদা করে সাজিয়েছেন। এটা কিন্তু বিষয়ের কোনো বিভিন্নতা নির্দেশ করে না। একই প্রসঙ্গ নিয়ে দুই ভাষায় তিনি লিখেছেন। তবে প্রেক্ষাপটে ও বক্তব্যে তফাৎ আছে। তাই পুনরাবৃত্তি ঘটে না। আর দর্শনে পারঙ্গম বলেই হয়তো ভাষা শক্ত-হাতে বাঁধা। অতিকথন একেবারে নেই। যৌক্তিক পারম্পর্য কোথাও বিন্দুমাত্র শিথিল হয় না। কিন্তু গদ্যের গাম্ভীর্য ও লাবণ্য ধরা থাকে ঠিকই। এটা ইংরেজিতে আরো বেশি। বোঝা যায়, ওই ভাষায় দর্শন পাঠের ঐতিহ্য তিনি কত গভীরে আত্মস্থ করেছেন। বিষয়-বিচারে বাংলায় কোনো ছাড় দেননি। কোনো গাফিলতি কোথাও নেই। তবু মনে হয়, ইংরেজি রচনাগুলোয় পাঠকের বোধ ও বিচারের ভিত্তিভূমিটি তিনি শুরুতেই তুলনায় উঁচু মাপে ধরে নিয়েছেন। অনুমান করি, শুধু বাঙালি নয়, বিশ্বের বাঘা-বাঘা পাঠকের কথা মাথায় রেখে তাঁর ওই লেখাগুলোর নির্মাণ। তাই তিনিও শুরু করেছেন অনেকটা ওপর থেকে। এজন্য লেখা কিন্তু দুর্বোধ্য হয়নি। অথবা তা বাক্সর্বস্ব পান্ডিত্যের প্রদর্শনীও থাকেনি। চিন্তার স্তরটা উঠে আসে মাত্র। লেখক যে চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পান না, এটাও আমরা বুঝি। এ-কথা বলায় বাংলা রচনাগুলো তুলনায় তরল, এমন কিন্তু আমি বোঝাতে চাইছি না। শুধু বলা, তাঁর পাঠকমন্ডলীর গ্রহণক্ষমতার ভিত্তি-মানটা তিনি মনে রেখেছেন। চিন্তায় ও প্রকাশে তাঁর সততা টাল খায়নি কোথাও এতটুকু। তাছাড়া নিরাবেগ-নির্বস্ত্তক ধারণারাশিকে (বিষয়বস্ত্তনির্ভর হতে পারে, কিন্তু ভাবনা তা থেকে নিষ্কাশিত তার যৌক্তিক সমন্বয়, তা নির্বস্ত্তক) বোধগম্য করে তোলায় তিনি পুরোপুরি তাদের অনুসারী থেকেছেন। কোথাও কোনো ছাড় দেননি, বাড়তি কিছু যোগও করেননি। বক্তব্য তাঁর সুচিন্তিত, সুগঠিত; এবং সিদ্ধান্ত প্রত্যয়সিদ্ধ ও অনন্যনির্ভর। সুশৃঙ্খল চিন্তা প্রকাশের ভাষা হিসেবে যে-কোনো আগ্রহী পাঠকের কাছে এ অনুসরণীয় বলে মনে হতে পারে।

আমি কিন্তু এখানে ইংরেজি-বাংলা প্রবন্ধগুলো একসঙ্গে মিলিয়েই কথা বলব। অবশ্য যতটা আমার সাধ্যে কুলোয়। কোনো-কোনো লেখা আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। সেগুলো নিয়ে মন্তব্য করতে যাওয়াটাই আমার পক্ষে চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতা। আশা করি, যোগ্যতর পাঠকেরা সেগুলো নিয়ে আলোচনা করবেন। আরো কিছু প্রসঙ্গ আছে, যেগুলো পূর্ণদৃষ্টিতে বিবেচনার জন্য প্রেক্ষাপটের আরো বিস্তার চায়, অথবা, চলকসমূহের কালিক-প্রবাহে তাদের সম্পর্ক সম্বন্ধে পরিবর্তমান বিন্যাস। দার্শনিকরাই, আশা করি, এসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন।

 

দুই

প্রথমেই বলে রাখি, অধ্যাপক রমেন্দ্রনাথ ঘোষ ছিলেন দর্শনশাস্ত্রে প্রথাসিদ্ধ পন্ডিত। আমাদের পঠন-পাঠনে উচ্চতর স্তরে গুণের বিচার হয় এই ধারাতেই। এ-অঞ্চলে গত শতকে যাঁরা দার্শনিক বলে নাম করেছেন, বাইরেও যাঁদের খ্যাতি, এরকম পান্ডিত্যই তাঁদের আলাদা করে চেনায় – যেমন, সুরেন দাশগুপ্ত, সর্বেপল্লী রাধাকৃষ্ণণ। অগাধ জ্ঞান তাঁদের, যা বিস্ময় জাগায়। অধ্যাপক ঘোষও এই গোত্রের। রবীন্দ্রনাথ বা গান্ধীর নাম অবশ্য এই সারিতে আসবে না, কারণ দর্শনশাস্ত্রে কৃতবিদ্যপন্ডিতের কোনো তক্মা তাঁদের ছিল না।

অধ্যাপক ঘোষ একাধারে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের পরিমন্ডল, সমস্ত খুঁটিনাটিসমেত নিজের ভেতরে সাগ্রহে লালন করেছিলেন। এই দুখন্ড প্রবন্ধ-সংকলনে তার নির্ভুল ছাপ আমরা পাই। সম্পাদকেরা তাদের আবার দুটো আলাদা ভাগে ভাগ করেছেন : বাংলায় (১) দর্শন, ও (২) নৈতিকতা, সমাজ, সংস্কৃতি; এবং ইংরেজিতে প্রথমভাগ, Philosophy এবং দ্বিতীয়, Culture, Society and Politics. বিভাজনের এই ধাঁচ নিয়ে, বোধহয়, প্রশ্ন তোলা যায়। দর্শনের জীবন্ত অনুশীলন আজ প্রধানত নৈতিকতা নিয়ে, – তার ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক- ফলে সামঞ্জস্য-অসামঞ্জস্য নিয়ে, ব্যক্তির বিষয় নির্বাচনে স্বাধীনতা ও তার ভালো-মন্দ নিয়ে – নিজের কাছে, সমষ্টির কাছেও। কারণ, ‘জেনেশুনে বিষ করেছি পান’, এ-অভিজ্ঞতা কোনো না কোনোভাবে সবারই হয়। আর, না জেনে গরল বা অমৃতপান সব মর্ত-মানুষেরই ভাগ্য-লিখন। সময় বহমান। সিদ্ধান্ত ও পরিণামকে কতদূর একসঙ্গে দেখি? প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মানুষের যাত্রা। প্রযুক্তি পালটায়; পালটায় কর্মধারাও। আমাদের সিদ্ধান্তের সীমা তবে কোথায় টানি, কীভাবে টানি? এগুলো আজকের মানুষের কাছে মৌলিক প্রশ্ন। দার্শনিক প্রশ্নও। এদের অন্য খোপে পুরে দেওয়া কতটা সমীচীন, তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ বোধহয় থেকে যায়। অবশ্য অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের গতিরেখা রমেন্দ্রনাথ ঘোষ কদাচিৎ টেনেছেন। অর্জন ও বিসর্জনের চেহারাটার দিকেই তাঁর নজর। তবু তাঁদের দার্শনিকত্ব থেকে যায়। আমার মনে হয়, পাশ্চাত্যদর্শন, ভারতীয় দর্শন, নৈতিক দর্শন, এরকম ভাগ বোধহয় বেশি সংগত হতো। বাংলাদেশের দার্শনিক-প্রেক্ষাপট নিয়েও অধ্যাপক ঘোষের ভাবনা আছে। মোটেও তা গতানুগতিক নয়, এবং হাজার বছরের সীমারেখাও তিনি টানেননি। তবে এ-বিষয়ে লেখা খুব বেশি নেই। গোটা বইয়ের ঝোঁকও এখানে সামান্য। ভারতীয় দর্শনের অনুক্রমে মাঝখানে একটা বিভাজনরেখা টেনে, অথবা কিছুটা ফাঁক দিয়ে এদের সাজালে সেটিই বোধহয় বেশি মানানসই হতো। ইউরোপীয় দর্শনে যেমন গ্রিক, ইতালি, জর্মন, ফরাসি বা ব্রিটিশ ভাবনা আলাদা-আলাদা দেখার সুযোগ থাকলেও তা যথার্থ হয় না, একে অন্যে তারা পুষ্টি জোগায়, হয়তো অপুষ্টিও, ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের দর্শনের বেলাতেও ব্যাপারটা প্রায় একরকম। যদিও বাংলাদেশের দর্শনের নিজস্ব একটা পরিচয় যে উঠে আসে না, তা নয়। তবে আর একটা প্রশ্ন মাথা চাড়া দেয়। বাঙালি দর্শনের ঐতিহ্য থেকে বাংলাদেশের দর্শনকে কি আমরা গ্রহণ-বর্জনের দাঁড়িপাল্লায় তুলে নিক্তি মেপে ছেঁকে তুলব? তুলতে চাইলেই কি তা বিশ্বাসযোগ্য হবে? অধ্যাপক ঘোষ তেমনটি করেননি, এবং এটিই যথার্থ বলে আমি মনে করি। ছেলেবেলায় দেখেছি, বাঘা-বাঘা বাংলাদেশি পন্ডিত নিখাদ পাকিস্তানি দর্শন ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য  খুঁজতে গলদঘর্ম হচ্ছেন। ফলাফল বৃহৎ নেতির উন্মাদনা। চূড়ান্ত পরিণামের একটি, আজকের বাংলাদেশ, ওই নেতির ভূত পাকিস্তানকে তাড়া করছে আজো। অথচ আমরা জানি, পাকিস্তানে হরপ্পা-মহেন-জো-দারো এই উপমহাদেশের প্রাচীন সভ্যতার প্রথম গৌরবদীপ্ত নিদর্শন। মহাভারতের কাহিনির বৃহদাংশের প্রেক্ষাপট আজকের পাকিস্তান। সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রথম নির্ভরযোগ্য প্রণেতা পাণিনির জন্ম সেখানকার উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে। এঁদের অস্বীকার করে পাকিস্তান ধনী হয়নি। অস্বীকার করলে ভারতও তার সংস্কৃতির পূর্ণতার অধিকার হারাবে।

অধ্যাপক ঘোষের বাংলা-প্রবন্ধখন্ডের শুরু ইম্যানুয়েল কান্টের ওপর দুটো গুরুত্বপূর্ণ লেখা দিয়ে। বেশ পরে আছে প্রাচীন গ্রিক দর্শনের পরিচয়। মাঝখানে আধুনিক যুক্তিপদ্ধতির অগ্রবর্তী সীমায় প্রতিজ্ঞানির্ভর অবরোহণের, এমনকি সাংকেতিক ও গাণিতিক ক্রমানুসরণের, দুরূহ পাঠ। আমার মতো আনাড়িকে তা পরাস্ত করে। অবশ্য হেগেল ও মার্কসের ইতিহাসের দর্শনের ওপর একটি সুচিন্তিত ধারণাপত্রও মাঝখানে ঢুকে পড়ে। আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে খাপছাড়া। কার্যত তা নয়। ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট বা চিন্তার মুক্তির প্রধান দার্শনিক প্রতিনিধি কান্টই। সত্য কথা, বিজ্ঞানে কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩), কেপলার (১৫৭১-১৬৩০), গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২), নিউটন (১৬৪৩-১৭২৭) তাঁর আগেই বিজ্ঞানে যুগান্তকারী পথপ্রদর্শকের কাজ করে গেছেন। প্রভাব যে দর্শনে পড়েনি, তাও নয়। ব্রিটিশ দার্শনিক হব্স (১৫৮৮-১৬৭৯), লক্ (১৬৩২-১৭০৪) ও হিউম (১৭১১-৭৬) তাঁর আগেই খোলা মনে দর্শন পাঠের পথ খুলে দিয়েছেন। হব্স ও লক্কে তো বস্ত্তবাদীই বলা যায়। ব্রিটিশ দর্শনের অনাত্মবাদী বাস্তব অভিজ্ঞতা-নির্ভর হওয়ার দিকে ঝোঁকটা শুরু তাঁদের দিয়েই। হিউম অনাত্মবাদে পুরোপুরি আস্থা রাখেননি। তবে বস্ত্তজগতের ক্রিয়াকর্মে অতিলৌকিক কারণের পেছনেও ছোটেননি। এসব প্রেক্ষাপট আত্মস্থ করে একটা সমন্বিত ধারণাবিশ্ব গড়ে তোলেন কান্ট (১৭২৪-১৮০৪)। তা প্রকৃতপক্ষে এই জ্ঞানকান্ডের সম্যক পরিচয় বলে মনে করা যায়। তবে তাঁর পদ্ধতি প্রত্যয়-নির্ভর। এই প্রত্যয় প্রত্যক্ষণের সীমাকে (ফেনোমেনন) ছাড়িয়ে গেলে তিনি তার মৌলিক, কিন্তু অদৃশ্য-অজ্ঞাত সত্তায় আস্থা রাখতে বাধ্য হন। পদ্ধতির শুদ্ধতা অবশ্য বজায় থাকে। তবু সাধারণীকৃত অজ্ঞেয়তাকে মেনে নেওয়ায় তিনি বিপথগামী হলেন কি না, এ-প্রশ্ন ওঠে। প্রবন্ধ দুটিতে অধ্যাপক ঘোষ বাহুল্যবর্জিত ভাষার শৃঙ্খলা অক্ষুণ্ণ রেখে পাঠকের জিজ্ঞাসু মনকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছেন।

পরের প্রবন্ধ ‘বোসেন্স্কির মতে অবভাসতত্ত্বীয় পদ্ধতি’। ‘অবভাস’ শব্দের চেয়ে ইংরেজিতে ফেনোমেনোলজি – শব্দটিরই বেশি চল। যাই হোক, এতে প্রত্যক্ষণের সীমা অতিক্রম না করেও নৈতিক সত্যের দায়িত্বের সঙ্গে ব্যক্তিতার যোগসূত্র রচনার প্রয়াস লেখক ব্যাখ্যা করেছেন। একজিস্টেনশিয়াল (বাংলা প্রতিশব্দ এখানে ব্যবহার করছি না। পরে আলোচনা করব) দর্শনে এর প্রয়োগ সর্বাত্মক। অধ্যাপক ঘোষের ইংরেজি প্রবন্ধ-সংকলনে প্রথম রচনাটিই কিন্তু একজিস্টেনশিয়ালিজমের ওপর। বিষয়ী বা ব্যক্তিতার মৌলিক ধ্রুবত্ব নয়, পরিপার্শ্বের চলমান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় তার স্বয়ংশাসিত সিদ্ধান্ত চয়নের স্বাধীনতা ও তার প্রয়োগের ধারাবাহিকতাই লেখকের নিবিষ্ট বিবেচনা আদায় করে নেয়। নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকেও এই দার্শনিক মতবাদের ওপর আরো একটি লেখা আছে। ব্যক্তির চয়ন-বিশ্ব আত্মস্বার্থতাড়িত থাকে না। একই সঙ্গে তা সমগ্রের অস্তিত্বও বিবেচনায় নেয়। শুধু বিবেচনা নয়, নৈতিক দায়িত্বও। তবেই তার বিষয়ী-সত্তার পূর্ণমুক্তি। বিষয়-বিষয়ী ভেদের অবসান। আমরা জানি, সার্ত্র তাঁর দার্শনিক অবস্থানে অবিচল থেকেও মার্কসীয় সামষ্টিক উত্তরণের প্রক্রিয়ার যথার্থতাকে মেনে নিয়ে তার দিকে ঝুঁকেছিলেন। এতে কোনো স্ববিরোধ ছিল বলে তিনি মনে করেন না। কিন্তু এভাবে দেখলে নৈতিক প্রাক-ধারণা কি একটা এসে যায় না? ব্যক্তিতা কি নিজের ফাঁদে ধরা পড়ে আত্মখন্ডনের শিকার হয় না? বাংলায়, এবং ইংরেজিতেও, বেশকটি রচনা আছে দার্শনিক চিন্তাপদ্ধতি নিয়ে। যুক্তি দাঁড়িয়েছে বেশিরভাগ অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষণের সীমায়। মনে হয়, ব্রিটিশ দৃষ্টবাদের ঐতিহ্যে এবং ওই বৃত্তে তাঁর পন্থা-পদ্ধতির অনুশীলন। কোথাও কোথাও তা গাণিতিক সম্পর্ক-সম্বন্ধের মৌল কাঠামোতেই শুধু সংলগ্ন থাকে। অনেক জায়গাতেই মর্মোদ্ধার আমার আয়ত্তের বাইরে থেকে যায়। অবশ্য এই সূত্রে ম্যুর, রাসেল, হোয়াইটহেড, এসব দিকপাল মহারথীর চিন্তা-প্রক্রিয়া ও ধ্যানধারণার সঙ্গেও একটা পরিচয় ঘটে। আমার মতো পল্লবগ্রাহীর এটা বাড়তি লাভ। ম্যুরের স্বনিহিত কল্যাণবোধের আলোচনায় তিনি বাংলাদেশের দুই ভাষ্যকার ডক্টর হুসনা বেগম ও ডক্টর আবদুল হামিদের বিচারকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। তাঁর বিষয়-ভাবনা কোথাও একদেশদর্শী থাকেনি।

দর্শন-অংশে অধিকাংশ বাকি লেখা ভারতীয় ধ্যান-ধারণা ও তাতে বাঙালি-মেধার অবদান নিয়ে। অনুপাতে তা ইংরেজিতেই বেশি। অনুমান করি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই দিকে তাঁর বিশেষজ্ঞতা তাঁকে খ্যাতির আসনে বসিয়েছিল। ফলে ইংরেজিতে দর্শনচর্চা তাঁর ভারতীয়, বিশেষ করে বৌদ্ধ প্রশ্ন মীমাংসার দিকে বেশি ঝুঁকেছে। তবে রচনা কোথাও পক্ষপাতদুষ্ট নয়। তিনি তাঁর বিচার-বিশ্লেষণে যৌক্তিক ন্যায়ের ওপরেই নির্ভর করেছেন। কোথাও নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ দিয়ে বিচারধারাকে প্রভাবিত করেননি।

একটা লেখা তাঁর ‘মধ্যযুগে বাংলার হিন্দুদর্শন’। ‘হিন্দু’ শব্দটি গোলমেলে। তবু এর পরিচয়জ্ঞাপক ব্যবহার একরকম সবাই মেনে নেয়। তাতে বিভ্রান্তি, অশান্তি, অনাসৃষ্টি যে ঘটে না, তা নয়। তারপরও তা যুগ-যুগ ধরে বাস্তব; যদিও তার অতীত গৌরবের যে-ইতিহাস বা পুরাণ আমরা শুনি, তার ঘটনাকালে হিন্দু শব্দটির কোনো জাতিগত অস্তিত্ব ছিল এমন কোনো নিদর্শন মেলে না। যাই হোক, চলতি প্রথা মেনেই অধ্যাপক ঘোষ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, কিন্তু দর্শনের তথ্য-অনুশীলন কোনো সংকীর্ণ গন্ডিতে বেঁধে রাখেননি। এখানে তিনি আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর হিন্দুধর্ম বইতে যে ব্যাপক দৃষ্টিতে ‘হিন্দু’ শব্দটি প্রয়োগ করেছেন, মোটামুটি তারই অনুসরণ করেছেন। ফলে দার্শনিক-ঐতিহ্যের আলোচনা শুধু যে বিস্তৃতি পেয়েছে তাই নয়, যৌক্তিক কাঠিন্যও তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তার উত্তরাধিকার এই বাংলাদেশে সবাই আমরা আজো বয়ে বেড়াই। যে যা-ই হই না কেন, তা আমাদের গৌরব বাড়ায়। অধ্যাপক ঘোষের রচনাটির অন্তর্দৃষ্টি তা আমাদের চিনে নিতে পথ দেখায়।

তাঁর ভারতীয় দর্শনের বিচার-বিশ্লেষণে বৌদ্ধ-অবদান তুলনায় গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। স্বয়ং তিনি ওই শাখাতে কাজ করেছেন অক্লান্ত। কাজেই এটা প্রত্যাশিতই। তবে বৌদ্ধদর্শন তাঁর আপন মহিমাতেই ভাস্বর, এখনো মানুষের মেধাবৃত্তির সামনে প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। অবশ্য এ-কথাটি ওই দর্শনের মূল তত্ত্বভূমিকেই খন্ডন করে। কারণ তাতে চূড়ান্ত বিচারে ‘না’ বা ‘হ্যাঁ’, কিছুই নেই। তাহলে বৌদ্ধদর্শনও নেই। তা নৈরাত্মিক, আবার নৈরাত্মিকতাও একইভাবে তাৎপর্যহীন। বুদ্ধবাণী নির্দেশ করে মাঝামাঝি পন্থা বা মধ্যপন্থা। বাস্তব আপেক্ষিক। তাই জীবনে পূর্ণ সত্য বলে কিছু নেই। বিশ্বপ্রকৃতিতেও নয়। ক্রমাগত অবস্থান্তর ঘটে চলে। চূড়ান্ত মুক্তি নির্বাণে। এক নির্গুণ শূন্যতায়। তাতেই বোধিসত্ত্বের বিলীন হয়ে যাওয়া। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে, আনুমানিক ১৫০ খ্রিষ্টাব্দে আবির্ভাব ঘটে বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের। বলা যেতে পারে, বৌদ্ধ দর্শনকে বিকল্প সম্ভবপর চিন্তাসূত্র ও জীবনযাপনের সংগত পথ হিসেবে তিনিই পূর্ণতা দেন। ইংরেজি ও বাংলা, দুই ভাষাতেই অধ্যাপক ঘোষের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দার্শনিক কাজ তাঁকে নিয়ে। ইংরেজিতে একাধিক। বিষয়ের ভেতরে ঢোকা দুরূহ। তবু বিষয়ের ও তা উপস্থাপনার গুণে তারা আগ্রহী পাঠকদের চুম্বকের মতো টেনে রাখে। মনে হয় অকৃতার্থ জীবন অর্থহীন হয়েও নিরর্থক নয়।

একটা বিষয়, অধ্যাপক ঘোষ আলোচনায় না আনলেও প্রাসঙ্গিক হবে মনে করে, বিশেষ করে নৈতিক দর্শনের নানা তাগিদ পরে থাকায়, এখানে মনে আসে। প্রত্যক্ষের আপেক্ষিকতায় নির্বাণের পথে প্রাণের উদ্বর্তনের পথ কী? এখানেও বুদ্ধবাণী, মধ্যপন্থা। একদিকে অহিংসা, সত্য, অস্তেয়; অন্যদিকে অষ্টাঙ্গ মার্গ : সত্য দৃষ্টি, সৎবাক্য, সৎস্মৃতি, সৎসংকল্প, সৎজীবন, সৎব্যায়াম, সৎকর্ম, সম্যক সমাধি। এবং তা অনিত্য সংসারেই কোনো ফলের আশা না করে নিরাসক্তভাবে অনুসরণ করা। প্রচলিত মূল্যবোধের এ প্রতিপক্ষ নয়, তবে প্রচলিত প্রথার শাসনকে সরাসরি অমান্য করে। জাতিভেদ প্রথার বিভাজনকে অস্বীকার করে। অবশ্য ‘জন্মান্তর ও কর্মবাদ’ তাত্ত্বিক পাটাতনে উপেক্ষিত হয় না। নৈর্ব্যক্তিকভাবে আজো কি হয়? ডারউইনের (১৮০৯-৮২) বিবর্তনবাদ প্রাণের অগ্রযাত্রায় একভাবে বৌদ্ধ আপেক্ষিকতাকে আত্মস্থই করে। তবে হারবার্ট স্পেনসারের (১৮২০-১৯০৩) ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’ তত্ত্ব অতি স্থূল   ভাব-বিকার। বৌদ্ধদর্শনের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র তার নেই। ডারউইনের বিবর্তনবাদকে অতিদূর দিয়েও তা স্পর্শ করে না।

বাংলা সংকলনে ‘শংকরের অদ্বৈত দর্শনে ব্রহ্ম এবং ঈশ্বর’ প্রবন্ধটিও চিত্তাকর্ষক। আমাদের চিন্তায় তরঙ্গ তোলে। শংকর ঈশ্বরকে স্থাপন করেছেন আমাদের অনুভবের সীমায়, যদিও অকল্পনীয়। ঈশোপনিষদের ধারাই যেন অনুসরণ করেন তিনি এখানে। ‘ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ’ – জগতে যা কিছু অনিত্য আছে, সবই ঈশ্বরের আচ্ছাদনের পাত্র। বিশ্বব্রহ্মান্ডের সবকিছুকে যে-কেউ চিন্তা করতে পারলে তার মতো করে একটা বস্ত্ত সমগ্রের কল্পনা করতে পারে। একইভাবে ঈশ্বরকেও তার ওপরে একটা আবরণ মনে করা তার পক্ষে অসম্ভব নয়। শংকরের ঈশ্বর এই ধারণাজগৎকে অবলম্বন করেই। কিন্তু তাঁর ব্রহ্ম অকল্পনীয়, নির্গুণ। যেন কল্পনাতেও ‘ফেনোমেননের’ সীমা অতিক্রম করে বৌদ্ধ শূন্যতার সবটায় তার নির্বিকার, অবিকল্প, অনন্ত অবস্থান। এই ব্রহ্মবাদের জন্যে তাঁকে ‘প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ’ এই অভিধাও পেতে হয়েছে। তবে এখানে আর একটা সংযোগও মাথায় রাখতে হয়। শংকরের আবির্ভাব কেরালায় খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শেষের দিকে। আরব বণিকেরা তার আগেই ইসলামের বাণী সেখানে নিয়ে এসেছে। তার প্রভাবও শংকরের ওপর পড়ে থাকবে, বিজ্ঞজনদের এ-অনুমান উড়িয়ে দেওয়ার নয়। অধ্যাপক ঘোষ তাঁর এই প্রবন্ধে বিচার-বিশ্লেষণে সব দিক পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন।

বইটির দুই খন্ডের দ্বিতীয়ভাগের দিকে এবার একটু চোখ বুলোই। আগেই বলেছি, বাংলায় এ-অংশের শিরোনাম ‘নৈতিকতা, সমাজ, সংস্কৃতি’; এবং ইংরেজি খন্ডে  ‘Culture, Society and Politics’, তাঁর আলোচ্য বিষয়গুলোর কিছু কিছু উল্লেখ করি : ক. বাঙালির দার্শনিক আদর্শ : সামাজিক মানবতাবাদ, খ. রাসেলের                 নৈতিক দর্শনের ভিত্তি, গ. বিদ্যাসাগরের নীতিবোধ এবং কর্মনিষ্ঠা, ঘ. কল্যাণ-অকল্যাণ, ঙ. নৈতিক মতাদর্শের দার্শনিক পশ্চাদ্ভূমি, চ. অমর একুশের মূল্যবোধ এবং আদর্শ। একই রকম ইংরেজিতে a. The Philosophical Basis of Bangladesh Movement, b. The Secularist Heritage of the 19th Century Renaissance Movement in Bengal, c. Humanity as an end. এছাড়া Philosophy অংশে আরো আছে Mill’s Ideal of Collective Happiness and the Alleged Fallacies ও  Morality and Existentialism.

এ থেকেই ব্যক্তি নয়, সমষ্টি নিয়ে তাঁর ভাবনাবিশ্বের একটা আন্দাজ হয়তো মেলে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তাঁর রচনাগুলোয় যুক্তিতিরিক্ত আবেগের প্রকাশ হয়তো অপ্রত্যাশিত ছিল না। বোধহয় অনভিপ্রেতও নয়। কিন্তু তিনি তাঁর বিদ্যাশৃঙ্খলার যৌক্তিক সীমা কোথাও লঙ্ঘন করেননি। কোনো লেখা অকারণ স্বপ্নের জাল বোনে না। ইচ্ছাপূরণের উত্তেজনাও ছড়ায় না।

এখানে লেখাগুলো থেকে আলাদা-আলাদা তথ্য বা তত্ত্ব বেছে না নিয়ে প্রশ্ন-মীমাংসায় সরলীকরণের ঝুঁকি নিয়ে কিছু বলি। সবচেয়ে প্রকট হয়ে চোখে পড়ে এটা মিলের সমষ্টি-সুখের আদর্শের বিবেচনায়। আপাতদৃষ্টে মানবতাবাদী সকলেই এতে উচ্ছ্বসিত সমর্থন জোগাবে। কিন্তু এর সর্ববাদীসম্মত কার্যকর নীতিসূত্র এখনো কি কোথাও মিলেছে? কাউকে অসুখী না করে এক বা একাধিকজনের সুখ মেলা কি সম্ভব, বিশেষ করে সুখ যা থেকে মিলতে পারে, তার পরিমাণ যেখানে সীমিত এবং সবাইকে তার সমান ভাগ দেওয়া সম্ভব নয়। দেওয়া সম্ভব হলেও প্রশ্ন থাকে, সবাই কি একইভাবে একই পরিমাণ সুখী হয়? তার হিসাব করি কীভাবে? অপরিমেয় বিষয় বাদ দিলেও নেহাত বাজারের হিসেবেও তা আয়ত্তে আসে না। কারণ, সবার ক্রয়ক্ষমতা সমান নয়। বিক্রেতার জোগানও ইচ্ছামতো বাড়ানো যায় না। পছন্দেরও একটা ভূমিকা আছে। সবার প্রয়োজন সব বিষয়ে একরকম হবে, এটাও আশা করা যায় না। সমস্যাটা বাজার-অতিরিক্ত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও মেটে না। বরং আরো জটিল হয়ে হুড়মুড় করে তা সবার মাথার ওপর ভেঙে পড়বে, এই আশঙ্কায় সব সময় সন্ত্রস্ত থাকতে হয়। ব্যাপারটা তাই বোঝা সহজ হলেও করা সহজ নয়। এখন অবধি অসাধ্যই রয়ে গেছে। জন রউলস তাঁর A Theory of Justice (১৯৭১)-এ প্রস্তাব দিয়েছেন : একটা সমাজে সব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় সমান অধিকার ভোগ করবে। একে তিনি বলেছেন সমাজে সার্বিক নৈতিকতার অলঙ্ঘনীয় শর্ত। এরই সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন তিনি এক বৈষম্যের শর্ত, তার ভিত্তি (১) মেধা ও যোগ্যতা, এবং (২) অপরিহার্য প্রয়োজনের তারতম্য, যেমন অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্যে বা তুলনীয় ক্রয়ক্ষমতা-বঞ্চিত জনগণের জন্যে বিশেষ সুবিধার নীতিমালার প্রয়োগ। এও আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্যই মনে হয়। কিন্তু বাস্তব অতি সরল প্রতারক। কিছুতেই সব প্রান্ত এক জায়গায় মিলতে দেয় না।

যাই হোক, প্রশ্নের একটা কোনা তুলে ধরে আলোচনার আরো সম্ভাবনার পথ খোলা রেখে আমরা দার্শনিক রমেন্দ্রনাথ ঘোষের বাংলায় ও ইংরেজিতে প্রকাশিত দুখন্ড প্রবন্ধ সংকলন নিয়ে আমাদের কথার এখানেই ইতি টানতে পারি। কিন্তু দার্শনিক দাবি করেন যুক্তিসিদ্ধ তর্ক। তা এড়িয়ে গেলে তাঁর অসম্মান। অধ্যাপক ঘোষের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা অটুট রেখে আমরা তাই এবার দু-একটা সংশয়ের কথা সামনে আনি। তিনি যে তার সুযোগ করে দিয়েছেন, এতে তাঁর ভাবমূর্তি মহত্তর ও উজ্জ্বলতর হয়।

 

তিন

একথা কোনোক্রমেই বলা যাবে না, অধ্যাপক রমেন্দ্রনাথ ঘোষ ইম্যানুয়েল কান্টকে যথাযোগ্য গুরুত্ব ও তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে কোথাও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁকেই তিনি বলেছেন আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের, ব্যাপক অর্থে গোটা বিশ্বে দর্শনচর্চায়, আধুনিক ধ্যান-ধারণার অগ্রনায়ক। মেধার বিশুদ্ধ যৌক্তিক পথ অনুসরণ করে তিনি ঈশ্বরের কোনো প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাননি। অজ্ঞেয়বাদীই থেকে গেছেন বরাবর। কিন্তু এই কান্টই, অধ্যাপক ঘোষ ক্ষোভের সঙ্গে জানান, ‘আধুনিক দর্শনে ইম্যানুয়েল কান্ট একটি স্তম্ভস্বরূপ, কিন্তু তিনি তো প্রকারান্তরে ক্রিশ্চান সন্ন্যাসীর নীতিকে প্রচার করেছেন। শুকনো কর্তব্যের খাতিরে কর্ম করার চেয়ে কোনো মহৎ আবেগের প্রেরণায় কর্ম করাকে কি অধিকতর নীতিসম্মত মনে হয় না? নৈতিক নিয়মের ওপর খাড়া করলেন ঈশ্বর-প্রমাণ তত্ত্বটিকে। সুইচ অফ-অন করে এরকম লুকোচুরি খেলার কী প্রয়োজন ছিল কান্টের? বিশুদ্ধ বুদ্ধির সমালোচনায় অমরতা, ঈশ্বর, ইচ্ছার অনন্ত স্বাধীনতা যাকে তিনি একরকম অসম্ভব বললেন, ব্যবহারিক প্রজ্ঞার দোহাই  দিয়ে সেসব তত্ত্বকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে সুড়সুড় করে খিড়কির দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে একেবারে দর্শনের সামনের আঙিনায় নিয়ে এলেন, যেন এসব তত্ত্বের আলোক ব্যতীত একেবারে পথ চলা দুষ্কর।…’ (পৃ ২৬০-৬১)।

আমার মনে হয়েছে, সব গোলমালের মূলে রয়েছে ঈশ্বর (অথবা God, অথবা এই ভাবব্যঞ্জক অন্য কোনো) শব্দ। যখন শুদ্ধ যুক্তিক্রিয়ায় এর প্রয়োজনীয়তা তিনি খুঁজে পান না, তখন তিনি কোনো দ্বিচারিতার আশ্রয় নেন না। এই ধারণা ছাড়াই তিনি, অর্থাৎ মানুষ বিশ্বব্রহ্মান্ডের রহস্য নিজেকে কেন্দ্রভূমিতে রেখে সেখান থেকে যতদূর সম্ভব জানতে পারে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ‘ঈশ্বর’ শব্দটি আসছে ওই কেন্দ্রভূমিতে মানুষেরই প্রয়োজনে। এখানে শব্দটি কিন্তু উদ্দেশ্য (Subject) নয়, বিধেয় (Object বা Predicate)। মানুষই তাকে মাথার ওপর বসায়, অন্তত যতদিন তার প্রয়োজন আছে ততদিন।

এইখানে রবীন্দ্রনাথকে একটু টেনে আনি। অনেকে আপত্তি করবেন, জানি, তবু। বলবেন তাঁরা, নিশ্চিত ভাববাদী বলে যাঁর স্বীকৃতি, কান্টের প্রসঙ্গে তাঁর কথা তোলা ওই ভাববাদের অনুষঙ্গেই কান্টের পক্ষে দাঁড়ানো। জবাব দেবার আগে আমার বিনীত প্রশ্ন, শুদ্ধ মুক্তচিন্তার সামনে এই ভাববাদ-বস্ত্তবাদ বিভাজনটাই অবান্তর হয়ে যাচ্ছে না কি?

রবীন্দ্রনাথের ‘আমি’ কবিতাটি (বাংলা ১৩৪৩) অনেকেরই পড়া। মূল কথা দিয়েই কবিতার শুরু : ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে।/ আমি চোখ মেললুম আকাশে – জ্বলে উঠল আলো/ পুবে পশ্চিমে।/…’ এ কোন বিশ্ব? কোন আকাশ? কোন ‘আমি’? স্পষ্টতই তা ‘আমি’ অর্থাৎ মানবকেন্দ্রিক। আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত আলাপেও (১৯৩০) তাঁর বক্তব্যে তিনি কোনো অস্পষ্টতা রাখেননি; অধ্যাপক ঘোষও তাঁর উদ্ধৃতি দিয়েছেন (Philosophical Essays, p 315))। এবং এখানে এই মানবচৈতন্যই ঈশ্বরের ভূমি, এবং তা তাঁর নিজের প্রয়োজনেই। এই প্রয়োজনের সদর্থক তাগিদ নৈতিক – ethical। তাকে বাস্তব philosophical করতেই নানা জনের কাছে নানাভাবে ঈশ্বর ঢুকে পড়েন। ‘আমি নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হতো যে মিছে’ – এ-কথাও রবীন্দ্রনাথেরই। স্পষ্ট গদ্যে বর্ণপরিচয়, দ্বিতীয় পাঠে বিদ্যাসাগরও বোঝাতে চেয়েছেন, ‘ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ।’ ঠাকুর রামকৃষ্ণ ভক্তজনকে বলেন, ‘তোমার চৈতন্য হোক।’ এখন মানুষের এই ‘চেতনা’ বা ‘চৈতন্য’ বিশ্বাতিগ, না, বিশ্বাভিগ? অবশ্যই বিশ্বাভিগ। তারই সীমার প্রেক্ষাপটে আসে ঈশ্বরের ধারণা।

কিন্তু সমস্যা একটা ঢুকে পড়ে। কোনো দুই মানুষ একরকম নয়। অভিজ্ঞতার জগৎ প্রত্যেকের আলাদা-আলাদা। তাহলে কি যত ‘ফেনোমেনন’, তত ঈশ্বর? এমনটি উদ্ভট কল্পনা। মানবিক যুক্তিসিদ্ধ এইটিই, দৃশ্য-অদৃশ্য সমগ্র বিশ্বচৈতন্যে যা কিছু ধারণ করে, তার অন্তর্গত মৌল-প্রাণদ প্রেরণা একটা কাজ করে এবং তা পঞ্চভূতে অন্তর্গত ঐক্যসূত্র। তবে তা আপেক্ষিক। বস্ত্তচৈতন্যের বিকাশের সঙ্গে-সঙ্গে তারও রূপান্তর ঘটে। ঘটে চলে। যদি কখনো এমন হয়, মানুষের কাছে ঈশ্বর-ভাবনার প্রয়োজনীয় শর্ত আর নেই, তবে তাও তখন আর বাস্তবজীবনে প্রাসঙ্গিক থাকবে না। এই ঈশ্বর তাই অনিবার্যত মানবনির্ভর বৌদ্ধ শূন্যবাদেও এ খাপ খেয়ে যেতে পারে। তাদের অস্তিত্ব মেনে নিয়ে মানব-নিরপেক্ষ বস্ত্ত-নিরপেক্ষ বস্ত্ত-ও-প্রাণচেতনার ব্যাখ্যায় এর প্রয়োজন নেই। সেখানেই কান্টের things in themselves-এর অন্বেষণ। এতে কোনো ঈশ্বরের যৌক্তিক অবস্থান তিনি খুঁজে পান না। অজ্ঞেয়বাদীই থেকে যান।

দ্বিতীয় যে-বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইছি তা কোনো প্রশ্ন নয় বরং আমারই একটা খটকা। এটা existentialism-এর বাংলা প্রতিশব্দ নিয়ে। আমি যে এখানে কোনো প্রতিশব্দ ব্যবহার করিনি তা আগেই বলে রেখেছি। বোধহয়, বিভিন্ন সময়ে লেখা বলে, অধ্যাপক ঘোষ কোথাও তার বাংলা করেছেন ‘অস্তিত্ববাদ’, কোথাও ‘অস্তিত্বীবাদ’, কোথাও বা ‘অস্তিতীবাদ’। আমার কাছে এটা বড় গোলমেলে ঠেকে। অবশ্য যে-কোনো রকম দার্শনিক রচনা আমার যে খুব কম পড়া, এটাও বলে রাখি।

‘অস্তিত্ববাদ’ শব্দটির চলই বোধহয় বেশি। কিন্তু একটা বিপরীত সমস্যা কি এতে লুকিয়ে থাকে না? চলতি প্রয়োগে ‘আস্তিক’ শব্দের অর্থ ঈশ্বরবিশ্বাসী। (বিপরীতে ‘নাস্তিক’)। এ থেকে অস্তিত্ববাদের অর্থ যদি কেউ করেন, ঈশ্বরের অস্তিত্ববিষয়ক ধ্যান-ধারণা, তবে ফ্যাসাদটা বেশ বড় রকমেরই লাগার আশঙ্কা। ‘অস্তিত্বিন্’ নামে একটা তৎসম শব্দ বানানো যায়। তার প্রথমার একবচনে হতে পারে ‘অস্তিত্বী’। মানব-অস্তিত্ব যদি প্রত্যয় হিসেবে উহ্য থাকে, তবু এটা তৈরি করা এক বিশেষ্যপদ। ‘অস্তিত্ব’ও বিশেষ্য – existence-এর প্রতিশব্দ।

‘অস্তিতীবাদ’ কিন্তু আমাকে ধাঁধায় ফেলে। যদি বলি ‘অস্তীতিবাদ’ (অস্তি+ইতি) : অর্থাৎ প্রতিটি ব্যক্তিমানুষ আছে এইটিই চরম কথা) তাহলে একটা সংগতি মেলে। কিন্তু ‘অস্তিতী’ কেন আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি।

তবে আরো একটা জায়গায় ধন্দ কাটে না। Existentialism-এ existential বিশেষণ। অনুমান, মানব-অস্তিত্বের ওপরে নয়, শুদ্ধ অস্তিত্বের ফলে ভেতরে বিষয়ীসত্তায় সংক্ষোভের যে লাক্ষণিক বিপর্যস্ততার গুণবাচক পরিচয় তাকে অবলম্বন করেই এই তত্ত্বের প্রাণসম্পদ ও রূপকাঠামো নির্মাণ। আমরা খেয়াল করি, ইংরেজিতে শব্দটি existencism নয়, existentialism : অর্থাৎ বিষয়  existence নয়, existential; তা বিশেষণ। এর সঙ্গে মিল রেখে আমরা কিন্তু বলতে পারি ‘আস্তিত্বিকবাদ’। তবে শেষ বিচারে বিদ্বৎসভায় প্রচলনের নিরিখে যা অনুমোদন পায়, তা-ই গ্রাহ্য।

যাই হোক, এই অসামান্য রচনাগুলো একত্র করে সম্পাদকদ্বয় যে আমাদের পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন, এর পেছনে শুধুই পেশাদারি দায়িত্ব কাজ করেছে বলে আমি মনে করি না। প্রকৃত গুণগ্রাহিতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁদের মানবিক শ্রেয়োবোধ। এ দুষ্প্রাপ্য। কথাটা শ্রদ্ধার সঙ্গে বারবার স্মরণ করি। প্রফেসর ঘোষের পরিবার-পরিজনের কথাও ভাবি। এই দুই খন্ড বই তাঁদের মুখে, আশা করি, একটু হাসি ফোটাবে। আমরা তৃপ্তি পাব।

তবে হয়তো তাড়াহুড়োয় একটু-আধটু ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়ে গেছে। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে এদিকে যাতে নজর পড়ে, সেই আশা নিয়ে এখানে তার উল্লেখ। –

বইয়ের সম্পাদকদ্বয়ের একজন তাঁর পূর্বসূরি, অন্যজন উত্তরসূরি। কিন্তু সম্পাদকীয় পাঠে মনে হয়, তা কেবল পূর্বসূরির অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা। দ্বিতীয় সম্পাদকের কথা আলাদা করে লেখা থাকলে, আমার মনে হয়, প্রফেসর ঘোষকে আরো একটু নিবিড়ভাবে আমাদের জানার সুযোগ হতো।

বইয়ের অঙ্গসৌষ্ঠব চমৎকার। খুব ভালো লাগে। কিন্তু মনে হয়, এ-জাতীয় বইয়ের বেশি চল না থাকায় ছাপার ভুল একটু বেড়েছে। অবশ্য লেখক কী বলতে চান, তা বুঝতে কোথাও অসুবিধা হয় না।

এমন বইয়ের পাঠকসংখ্যা বাড়লে বুঝব, আমাদের চিন্তায় সাবালকত্ব আসছে। শুধু সাক্ষরতার হার বাড়লেই তা নিশ্চিত হয় না।