দুটি কবিতা

দিলারা হাফিজ
মেয়ে তুমি বড় হচ্ছো
এতোটা বয়স হয়নি মেয়ের
এখনো বোঝে না সে যে
কি কথা যায় না বলা তার স্বরে
কী কথা বলতে হবে কানে কানে
এখনো বোঝে না সে যে
ভাইটি কেন বা হিসি করে রোজ
উঠানে দাঁড়িয়ে
মা তাকে কেন যে বাধ্য করেন
আড়ালেতে গিয়ে
শিশিরের মতো নিঃশব্দ ত্যাগে
এখনো বোঝে না সে যে;
রঙিন খেলা যত সব তার
সবই কেন হাঁড়ি নয়তো পাতিল
মাটির পুতুল ঘটি আর বাটি
এখনো বোঝে না সে যে;
মেয়ে বলে তাই হা-ডু-ডু অথবা
কুস্তি লড়াই ফুটবল খেলা
সকলই বারণ মার্বেল মানা
ছেলে নয় বলে ডিসুম-ডাসুম
সকলই কসম
নিষিদ্ধ কেন পিস্তলে হাত দেওয়া
এখনো বোঝে না সে যে
এখনো বোঝে না সে যে
হঠাৎ কখনো মেহমান এলে
পোলাও-কোর্মা রাঁধা হলে পরে
মেহমান নিয়ে প্রথমে বসেন
বাবা আর ভাই
বুকের মাংস আর দুটি রান
বিধির বিধানে তারা পেয়ে যান
সবশেষে আমি আর মাকে কেন
খেতে হয় শুধু
গলার হাড্ডি মুরগির মাথা কলিজা ও গিলা
এখনো বোঝে না সে যে ॥

নারী

শেষবার আমি সত্য উচ্চারণ করেছি
খনার কর্তিত জিহ্বায়…
তোমরা কি আমাকে এখন চেনো আর,
অনেক আগেই আমি ছেড়ে গেছি
তোমাদের বিস্ময় ভার…
বলা ভালো ছাড়িয়ে গেছি আমি
পরস্পরের দ্রোহের সংসার
কে পায় আমাকে আজ?

যখন আপনা মাংসে হরিণা বৈরী
তখনো চর্যাপদের সাড়ে ছেচল্লিশটি পদজুড়ে
আমারই কা-য়া-তরুবর-পঞ্চ-বি-ডাল –
মেলে দিয়েছে চৌষট্টি… পাখুড়ি
মধ্যযুগের দেড়শো বছরের অন্ধকার বুকে নিয়ে
অন্য কেউ নয় – একা আমি মর্মতলে
ধরে আছি শূন্যপুরাণ আর
মহুয়া মদিনার আত্মপীড়নের স্মৃতিগাথা

ভারতচন্দ্রের আদিরসের অর্গল ভেঙে
বিদ্যাসুন্দরের পূতিগন্ধময় শরীর মাড়িয়ে
রবীন্দ্রনাথের লাবণ্য একা নয় শুধু
অরণ্যবন্দি বাতাসের চাপা দীর্ঘশ্বাসের মতো
আমরা অনেকে যূথবদ্ধ বেরিয়ে পড়েছি
শেষের কবিতার জ্যোৎস্নালোকে –

নিজের নির্জনে পলায়নপর অমিত রায়
আত্মপ্রেমে ভাসিয়ে দুকূল
তেইশ বসন্তে জেনে যায় শরীরসর্বস্ব নয়
পবিত্র এক ধর্মগ্রন্থের মতো হৃদয়ই পাঠ্য প্রথম

গ্রহণের চাঁদের মতো শরীরের আড়াল থেকে
ছুটে বেরিয়ে এসেছে যখন হৃদয়
শাপগ্রস্ত ঋষি রাজন্যের পাপে তখন
নগরী কাঁদে প্রচণ্ড খরায়
তখনো ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’র খরভূমিতে দাঁড়িয়ে
আমার মতো কেউ একজন
ঋষ্যমূক পর্বত থেকে ডেকে আনে বৃষ্টির দেবতা
আর্দ্র করে মহাপৃথিবীর করতল…
যুদ্ধ আর মহামারীর মতো উত্তর-তিরিশের
দ্বিধা ও সন্দেহের চাকতি নিক্ষেপ শেষ হলে
মধ্যসমুদ্রের দিশেহীন হালভাঙা নাবিকের মনে
দারুচিনি দ্বীপের মতন জেগে ওঠে
নাটোরের বনলতা সেন –
দুচোখে তার সবুজ ঘাসের দেশ শান্তির নীড়

আমি না ছাড়ি বিশ্বাস
আমাকে না ছাড়ে অবিশ্বাস
এ রকম মেঘকৃষ্ণ দ্বিধার কাল যখন
তখনো পিতা কিংবা পুত্র অথবা
প্রেমিক চিলপুরুষের ইচ্ছের বলয়ে কাঁদে
নামগন্ধহীন এই তুচ্ছ জীবন

না বিংশ শতাব্দী না একুশ শতক
উত্তর-আধুনিক সময়ের সাম্পান যখন
ঐতিহ্যেই ভাসমান
তখনো আত্মপীড়নের ক্রান্তিকুলায়
ভিক্ষাপাত্র হাতে কেবলই আমি
খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান…।