দুর্ভিক্ষ ও জয়নুল

আবুল হাসনাত

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই। আচার্যের বহুমুখীন সৃজন ও কর্মধারা এদেশের শিল্প-আন্দোলনকে কতভাবে যে সঞ্জীবিত করেছে এ বলে বোধকরি শেষ করা যাবে না। তাঁকে নিয়ে তর্ক, আলোচনা ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের সময় আমরা তাঁর সৃজনে দুর্ভিক্ষের চিত্রমালার অবিনাশী রেখা নিয়েই সাধারণত আলোচনা করি। কিন্তু তিনি তাঁর সৃষ্টিবৈচিত্র্যের বৈভব দ্বারা প্রতিনিয়ত আমাদের প্রাণিত করছেন এবং এই শিল্পী দেশের শিল্প-আন্দোলনকে যে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন এবং বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিকে যে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, আচার্যের শতবার্ষিকীর আলোছায়ায় সে-প্রসঙ্গই আলোচিত হোক এবং ভবিষ্যতে কোনো গবেষক তাঁকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি জীবনী রচনা করুক – এ-প্রত্যাশা করি। আশা করা যায়, গ্রন্থটি হয়ে উঠবে তাঁর সময়কাল, চেতনা এবং শিল্পকর্মধারার শ্রেষ্ঠ একটি গ্রন্থ। যদিও সম্প্রতি ইতালি ও বাংলাদেশের যৌথ প্রয়াসে প্রকাশিত একটি ইংরেজি গ্রন্থ যথেষ্ট আদৃত হচ্ছে বিশ্ববাজারে, তবু শতবার্ষিকী উপলক্ষে আরো প্রাণদায়ী গবেষণা ও জিজ্ঞাসা-উন্মুখ গ্রন্থ প্রকাশিত হোক – এ তো প্রত্যাশা করাই যায়।

বাংলাদেশের শিল্প-আন্দোলনে জয়নুল আবেদিনের স্থান পথিকৃতের। তাঁর সৃজনশক্তি ছিল অসাধারণ। শৈল্পিক দক্ষতা ও প্রতিভার গুণে তিনি চল্লিশের দশকেই ভারতবর্ষের কলারসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন। রেখার দীপ্তি এবং মোটা ব্রাশের টান তাঁর সৃজনকে স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত করে তুলেছিল।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পশিক্ষার সূত্রপাত হয়েছিল। তিনি ১৯৪৮ সালে আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই সময়সীমা পর্যন্ত এদেশের চিত্রবিদ্যা চর্চা শুধু সঞ্জীবিত হয়নি, আধুনিক ও সমকালীন চিত্রকলা-আন্দোলনেও প্রাণসঞ্চার করে আসছে। আজ বাংলাদেশের চিত্রকলা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বমহিমায় উজ্জ্বল।

জয়নুল আবেদিন চল্লিশের দশকেই কলকাতা আর্ট স্কুলের যখন ছাত্র তখনই চমৎকার নিসর্গচিত্র অঙ্কনে পারদর্শিতা অর্জন করেন। এই দক্ষতা ও স্বতন্ত্র চিত্রভাষা সৃষ্টির জন্যই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তিনি যখন কলকাতা আর্ট স্কুলের নবীন শিক্ষক তখন তাঁর বড় কীর্তি দুর্ভিক্ষের চিত্রমালার সৃষ্টি।

মনুষ্যত্বের এমন লাঞ্ছনা ও অপমান জয়নুলের হৃদয়কে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। তিনি অতিসাধারণ কাগজে মনুষ্যত্বের এ-যন্ত্রণাকে শিল্পকুশলতার সঙ্গে তুলে ধরেন। এই স্কেচগুলো বিভিন্ন সংবাদপত্রে, বিশেষত পিপলস ওয়ার ও জনযুদ্ধ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে বাঙালির বিবেক নাড়া খায়। চট্টগ্রাম থেকে শিল্পী সোমনাথ হোর ও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষত মেদিনীপুর ঘুরে দুর্ভিক্ষপীড়িত অনাহারী ও মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের ছবি এঁকে পাঠান শিল্পী চিত্তপ্রসাদ। এই তিনজন দুর্ভিক্ষের চিত্র অঙ্কনে পারদর্শিতার পরিচয় দেন। এই চিত্রগুচ্ছ সেই সময়ের মানবিক বিপর্যয়েরও এক দলিল হয়ে আছে। জয়নুল আবেদিনের ব্রাশের টান যে এত শক্তিশালী হতে পারে, এত মর্মভেদী হতে পারে, এত বছর পরও এই ছবিগুলো সে-কথাই বলে। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে আরো কয়েকজন ছবি আঁকেন। কিন্তু সর্বাধিক আলোচিত হন জয়নুল। মোটা ব্রাশের টানের এই চিত্রগুচ্ছ খুবই মর্মভেদী।

জয়নুল একটি একক প্রদর্শনী করেন এসব ছবি নিয়ে। শিল্পানুরাগী ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত প্রবলভাবে আন্দোলিত হয়েছিল এই ড্রইং দেখে। এতদিন বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে সংবাদপত্রে এ-ড্রইংগুলো প্রকাশিত হচ্ছিল। একসঙ্গে মোটা ব্রাশের টানে মানবজীবনের ট্র্যাজেডি পর্যবেক্ষণ যে-কোনো হৃদয়বান মানুষকে দুর্গতদের জন্য সহানুভূতিসম্পন্ন করে তুলেছিল। বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল লঙ্গরখানা। পরিপার্শ্বের এই রূপায়ণ এতই বাস্তব ও নিখুঁত যে, জয়নুলের এই ড্রইংগুলো উত্তরকালের জন্যও হয়ে উঠেছিল মানুষের মর্মবেদনার উপলব্ধিজাত অনন্য সৃষ্টি। এই ড্রইংগুচ্ছ পরবর্তীকালের চিত্রীদের মানসভুবনে ছাপ ফেলেছে। যদিও তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষজনিত কারণে শীর্ণকায় মানুষের ক্ষুৎপিপাসার জন্য আর্তনাদ, ডাস্টবিনে কুকুরের যৎসামান্য উচ্ছিষ্ট খাদ্যের জন্য লড়াই প্রত্যক্ষণ এক অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেছিল। প্রতিদিনই একই দৃশ্য দেখছিলেন কলকাতাসহ বাংলার বৃহৎ শহরের নাগরিকরা।

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে সাম্প্রতিক নানা গবেষণা থেকে জানা যায়, মানুষের সৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষ রোধ করা সম্ভব ছিল। সরকারের ঔদাসীন্য, খাদ্যশস্য সরবরাহে ব্যর্থতা, যুদ্ধ, মুনাফালোভীদের খাদ্য মজুদ ও গণতন্ত্রহীনতা ছিল এই দুর্ভিক্ষের অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের মেদিনীপুর, বিক্রমপুরসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের গ্রামের কৃষিজীবী মানুষই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যৎসামান্য খাদ্যের আশায় ও বেঁচে থাকার আর্তি নিয়ে দলে দলে লোক পরিবার-পরিজন নিয়ে চলে এসেছিল বড় বড় শহরে। কঙ্কালসার এই মানুষগুলো খেতে না পেয়ে মরে থাকত ডাস্টবিনের পাশে, ফুটপাতে ও রকে। জয়নুল আবেদিন তখন নবীন যুবা, দারিদ্রে্যর এই লাঞ্ছনা তাঁকে প্রবলভাবে বিচলিত করেছিল। তিনি ছবি আঁকলেন এবং এই ড্রইংগুলো প্রকাশিত হলো সংবাদপত্রে। একই সময়ে স্টেটসম্যান এবং বামপন্থী পত্রিকায় সুশীল জানার আলোকচিত্র প্রকাশিত হয়েছিল। জয়নুল, চিত্তপ্রসাদ, সোমনাথ হোরের ড্রইং নাড়া দিলো মধ্যবিত্তের বিবেককে। এই আলোড়ন থেকেই লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল। এই লঙ্গরখানা খোলার ফলে লাখ লাখ মানুষ বেঁচে গিয়েছিল।

জয়নুল ১৯৪৩ সালের এই দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালা অঙ্কনের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে খ্যাতিমান শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ তাঁর শিল্পীসত্তাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। তিনি দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের বেঁচে থাকার আর্তিকে মোটা তুলিতে যেভাবে রূপায়িত করেছিলেন তার কোনো তুলনা নেই। এই চিত্রমালা একদিকে মানবিক বিপর্যয়ের আশ্চর্য দলিল হয়ে আছে, অন্যদিকে এই চিত্রমালা অঙ্কনের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা শিল্পী।

পরবর্তীকালে উনিশশো ষাটের ও সত্তরের দশকে বাংলাদেশের যে-কোনো জাতীয়  দুর্যোগ, সংগ্রাম ও স্বাধিকার আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। একই সঙ্গে তাঁর সৃজনও এই সময়ে নানা মাত্রিক ও অঙ্গীকারের চেতনালগ্ন হয়ে ওঠে।

বিশেষত সত্তরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত মানুষের জন্য তিনি প্রবলভাবে আন্দোলিত হয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী জাহানারা আবেদিন এক সাক্ষাৎকারে আমাদের জানান, দীর্ঘ ‘মনপুরা’ ছবিটি অঙ্কনের আগে কীভাবে তিনি যন্ত্রণাকাতর ছিলেন। এই যন্ত্রণাকাতরতা থেকে তাঁর অঙ্গীকার ও শিল্পীসত্তা আমাদের কাছে নবীন আলোক নিয়ে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। ‘মনপুরা’র প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর শিল্পীসত্তাকে প্রবলভাবে স্পর্শ করেছিল।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়েছিল ধর্মীয় আদর্শকে সমুন্নত করে। নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে চারুকলা-চর্চার অনুকূল পরিবেশ ছিল না। প্রথাশাসিত সমাজে ছবি আঁকাকে নিরুৎসাহিত করা হতো। এসব দিক থেকে দেখলে খুব সহজেই বোঝা যায়, ১৯৪৮ সালে মাত্র দুটি কক্ষ নিয়ে পুরনো ঢাকায় যখন চারুকলার স্কুলটি যাত্রা শুরু করেছিল, তখন এ ছিল সত্যিকার অর্থে এক দুরূহ কাজ। অন্যদিকে ধর্মীয় অনুশাসনের দেশে এ-শিক্ষালয়ের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়েও তখন অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। কেউ ভাবেননি মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি মহীরুহ হয়ে উঠবে, অগণিত শিক্ষার্থীকে আধুনিক শিল্পশিক্ষায় দীক্ষিত করবে। প্রতিষ্ঠাকালে এই স্কুলের ছাত্রসংখ্যা ছিল মাত্র আঠারোজন। প্রথম ব্যাচের ছাত্র আমিনুল ইসলামের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, আঠারোজন ভর্তি হলেও কিছুদিনের মধ্যেই কয়েকজন ছাত্র স্কুল ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। জয়নুল আবেদিনের নিরলস পরিশ্রমে গড়ে ওঠা শিল্পশিক্ষার এই উন্নত প্রতিষ্ঠানটি তাঁকে বিশিষ্ট করে রেখেছে। একই সঙ্গে এদেশে বর্তমানে আধুনিক শিল্পচর্চার যে-পরিবেশ গড়ে উঠেছে এ তারই অবদান। সেজন্য তাঁকে শিল্পাচার্যের সম্মান দেওয়া হয়েছে। সৃজনী উৎকর্ষ, নবউদ্ভাবনী কৌশল ও শিল্পে আধুনিকতার পথ প্রশস্ত করার জন্য তিনি ছিলেন অগ্রণী এক শিল্পী।

এখানে প্রসঙ্গত একটি বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। জয়নুল আবেদিন নবঅর্জিত রাষ্ট্রে এসে এখানকার নবীন বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে গভীর সখ্য গড়ে তোলেন। এঁদের একাংশের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল কলকাতায়। মননে উজ্জ্বল এসব বুদ্ধিজীবী জয়নুল আবেদিনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। জয়নুল আবেদিন একটি শিল্প-শিক্ষালয় গড়ে তোলার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করছেন। তাঁর এ-প্রচেষ্টায় প্রগতিশীল এসব বুদ্ধিজীবীর শুধু সমর্থন ছিল না, তাঁরা এ-আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। এঁদের কয়েকজনের উৎসাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের ডাইনিং রুমে একদিনের একটি প্রদর্শনীও হয়েছিল। এই প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য ছিল জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের চিত্রমালার সঙ্গে এখানকার বুদ্ধিজীবীদের সম্যক পরিচয়করণ।

জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ মহকুমায় ১৯১৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক স্কুলজীবনের শেষ পর্বে ১৯৩৩ সালে এক অনমনীয় জেদ নিয়ে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। তৎকালে চারুকলা নিয়ে  পঠন-পাঠনের বিষয়ে কোনো মুসলিম পরিবার থেকেই তেমন উৎসাহ দেওয়া হতো না। ধর্মভীরু মুসলিম পরিবারে ছবি রাখা, ছবি আঁকায় ছিল দুস্তর বাধা। প্রায় অসম্ভবের সাধনা। চারুকলায় অধ্যয়ন করলে আর্থিক দিক থেকে খুব যে লাভবান হবে – এ খুবই দুরাশা ছিল। সেজন্য আর্ট স্কুলে শিক্ষার জন্য জয়নুল আবেদিনকে বিরতিহীন সংগ্রাম করতে হয়েছে। পিতা ছিলেন অল্প বেতনের পুলিশ কর্মচারী। কলকাতায় পড়াশোনার জন্য যে অর্থসংকুলান করা প্রয়োজন তা তাঁর ছিল না। তাঁর স্ত্রীর একটি মনোগ্রাহী সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, সেজন্য ছাত্রাবস্থায় জীবনধারণ ও শিল্পশিক্ষা অব্যাহত রাখতে তাঁকে বিরতিহীন সংগ্রাম করতে হয়েছে। থাকতেন কলকাতার বালিগঞ্জের সন্নিকটে বন্ডেল রোডে একটি অপরিসর ঘরে। অন্যদিকে অবসর সময়ে নানা জায়গায় বাণিজ্যিক কাজ করে দৈনন্দিন খরচ নির্বাহ করতে হতো তাঁকে। পরে যখন বাণিজ্যিক কাজ করে একটু সচ্ছলতা এসেছিল, তখন তিনি সার্কাস রো-তে একটি বাড়িতে গিয়ে ওঠেন।

জয়নুল আবেদিন এক বিরল গুণের অধিকারী ছিলেন। সহজ ও স্বচ্ছন্দ ব্যবহার দ্বারা তিনি সহপাঠী ও শিক্ষকদের মধ্যে ভিন্ন এক আসন লাভ করেছিলেন। তিনি যখন খ্যাতিমান শিল্পী ও শিক্ষক হিসেবে কলকাতা আর্ট স্কুলে শিক্ষকতা করছেন, তখনো তাঁর ভেতর কোনো ধরনের অহংবোধ জন্মায়নি। সেজন্য তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। আর্ট স্কুলে অধ্যয়নকালে তাঁর শিল্পমনীষা, সৃজনশক্তি ও উৎকর্ষ দ্বারা শিল্পানুরাগীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। ১৯৩৩ সালে জয়নুল আর্ট স্কুলে ভর্তি হন, সে-বছরই অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৩৮ সালে অ্যাকাডেমির বার্ষিক প্রদর্শনীটি এই স্থানেই হয়েছিল। এ-প্রদর্শনীতে পুরস্কার অর্জন তাঁর শিল্পসাধনাকে অর্গলমুক্ত করে। শিল্পবোদ্ধা, শিল্প-শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী মহলের তিনি শুধু দৃষ্টিই আকর্ষণ করেননি, পরবর্তীকালে এই প্রদর্শনী তাঁর শিল্পীজীবনকে আলোকাভিসারী করেছে। ‘অন অ্যান্ড ওভার দ্য ব্রহ্মপুত্র’ শীর্ষক ছয়টি জলরং চিত্রের সিরিজ ছিল এ-প্রদর্শনীতে। এসব ছবির বিষয় ছিল এরকম : জেলেদের মাছ ধরা, জাল শুকানো, শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ, হাসপাতাল ও খেয়া পারাপার, শম্ভুগঞ্জে পাট ব্যবসায়ী গ্যাসপার সাহেবের কুঠি, নদীর অপর পারের কাশবন, পানিতে প্রতিফলিত নদীতীরবর্তী গাছের ছবি প্রভৃতি। ছুটিতে ময়মনসিংহে গিয়ে ১৯৩৮ সালে তিনি নদীতীরে বসে এ-ছবিগুলো এঁকেছিলেন।

জয়নুল যখন শিল্পী হিসেবে কলকাতার শিল্পীসমাজে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন, তখন দুটি শিল্পধারা বিরাজ করছিল। একটি ছিল অ্যাকাডেমিক ধারা, অন্যটি বঙ্গীয় চিত্রধারা। এই দুটি ধারার অন্তর্মুখী চাপ থেকে বেরিয়ে এসে তিনি নিজেই একটি শৈলীর জন্ম দেন। গ্রামবাংলার ও বিহারের সাঁওতাল পরগনার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় কিছুটা হলেও রোমান্টিক ভাবাবেগমুক্ত এক স্বভাবনিষ্ঠতা খুব সহজেই শনাক্ত করা যায়। এই সময়ের সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ জগতের অনুভব সূক্ষ্ম রেখায় প্রাধান্য বিস্তার করে। পূর্ববঙ্গের দিগন্তবিস্তৃত নিসর্গ এবং নদী বারংবার উঠে আসে তাঁর সৃষ্টিতে।

রেখার দীপ্তি ও জলরঙে জয়নুলের বিশিষ্টতা ছাত্রাবস্থায় তাঁকে খ্যাতির শিখরে নিয়ে যায়। এই শৈলীকে তিনি নানা দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করেছেন। আর্ট স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন এবং মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিতিলাভ করেন।

জয়নুল আবেদিন তাঁর নানা ধরনের সৃজন দ্বারা এই সময়ে এক মেধাবী ছাত্র হিসেবে শিক্ষকমন্ডলীতে বিবেচিত হয়েছেন। তাঁর মানস গঠনের ও শিল্পী হিসেবে এক প্রস্ত্ততিকাল ছিল এই সময়। তিনিও এ-আন্দোলনে সঞ্জীবিত হচ্ছিলেন। যে-বন্ধুবৃত্ত গড়ে উঠেছিল, তাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বামপন্থী। বামপন্থী বন্ধুদের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠলে এবং তাঁদের কর্মধারায় আস্থা থাকা সত্ত্বেও মানবতাবাদী মানুষ হিসেবেই সমাজের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেছেন।

সেজন্যই বোধকরি তাঁর দুর্ভিক্ষের চিত্রমালার অধিকাংশ ড্রইং প্রকাশিত হয়েছিল বামপন্থীদের সংবাদপত্রে এবং কমিউনিস্ট পার্টির প্রযত্নে ও সহযোগিতায় তাঁর প্রদর্শনী হয়েছিল কলেজ স্কোয়ারে। ধীমান ভাবুক গোপাল হালদার এবং কবি গোলাম কুদ্দুস দুর্ভিক্ষের মানবিক বিপর্যয় ও আবেদিনের ছবির শক্তিময়তা সম্পর্কে যে-আলোকপাত করেছিলেন তা সারস্বত সমাজে আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল।

জয়নুল আবেদিন কলকাতা আর্ট স্কুলে অধ্যয়নকালে তাঁর প্রত্যক্ষণে জন্মভূমির নদী ও নিসর্গ যেভাবে ধরা পড়েছিল, তা অঙ্কন করেছিলেন। তাঁর কৈশোর অতিবাহিত হয়েছিল পূর্ব বাংলার প্রকৃতির মধ্যে। গ্রামবাংলার প্রত্যক্ষ জগৎ তাঁর সৃজনে খুবই প্রভাব ফেলেছিল। এছাড়া গ্রীষ্মের ছুটিতে তিনি চলে যেতেন সাঁওতাল পরগনায়। বিহারের পার্বত্য অঞ্চলে সাঁওতালদের বসবাস ছিল। সাঁওতালদের সারল্যে ভরা জীবনাচরণ তাঁকে নানাভাবে আলোড়িত করেছিল। তাঁর ১৯৪৪ সালে করা তেলরঙের কাজ ‘দুমকা’ ও ‘সাঁওতাল রমণী’ অসাধারণ কাজ বলে বিবেচিত হয়েছিল। এই সাঁওতাল পরগনার নানা অনুষঙ্গ নিয়ে তিনি স্কেচ করেন। শিল্পচর্চার জন্য সাধনার সঙ্গে শিল্পকুশলতা তাঁর শিল্পীসত্তাকে উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করছিল। পরবর্তীকালে জল ও তেলরঙে এই স্কেচগুচ্ছকে রূপায়িত করেন। রোমান্টিক কল্পনার সৌন্দর্যধ্যানে ও শিল্পিত প্রকরণে এই কাজগুলো তাঁর যুবা বয়সের মনোগ্রাহী সৃজন ও শক্তিমত্তার প্রকাশ বলে বিবেচিত হয়েছে। অধ্যক্ষ মুকুল চন্দ্র দে এবং তাঁর অপর শিক্ষক রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী জয়নুলকে নিসর্গ এবং তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয়াবলি অঙ্কনে উৎসাহী করেন। এই সময়ের কাজের মধ্যে তিনি বিশিষ্টতাও অর্জন করেন এবং স্বকীয় এক ভাষা নির্মাণে সমর্থ হন।

জয়নুল আবেদিনের শিল্পিত মানস গঠন ও মানবিক বোধ কীভাবে তাঁকে একজন অঙ্গীকারে দৃঢ়চেতা শিল্পী করে তুলেছিল তা অনুধাবন খুবই জরুরি। আগে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে যে-বিলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রবাহ চলছিল, তা তাঁকে নানাভাবে আলোড়িত করেছে।

আমরা এ-কথা জানি যে, তিরিশ ও চল্লিশের দশক প্রবলভাবে পরিবর্তন ও বিপর্যয়ের কাল। তিরিশের দশকের শেষদিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। এ যুদ্ধ আমাদের দেশেও এক অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল। বিশ্বজোড়া মন্দার সঙ্গে ধ্বংস ও বিপর্যয় এদেশের জনজীবনে আছড়ে পড়ে, মানবিক সম্পর্কে চিড় ধরায়। মধ্যবিত্ত ও মানবিক মূল্যবোধও ধসে পড়তে থাকে। নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে অভাবের তাড়না থেকে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। গ্রামের চিরায়ত রূপ ধসে পড়ে। গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ শহরে চলে আসে খাদ্য ও চাকরির আশায়। পরিবারের রূপ বদলাতে থাকে। গ্রাম থেকে খাদ্যের জন্য চলে আসা বহু নারী শুধু বেঁচে থাকার জন্য দেহব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত করে। চল্লিশের দশকের খ্যাতনামা কয়েকজন কথাসাহিত্যিকের গল্প ও উপন্যাসে আমরা এ-অবক্ষয়ের রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করেছি। অন্যদিকে স্বদেশি আন্দোলনের তীব্রতা দেশে দেশে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রসার ঘটায়। আশারও সঞ্চার হয়। ফ্যাসিবাদী আগ্রাসী আক্রমণ, বিপক্ষে সাম্যবাদী যুদ্ধবিরোধী মানবতাবাদী আন্দোলন এবং অভিযান – এসবও এদেশের সমাজ ও সৃজনধারাকে আলোকিত করেছে।

‘ক্যালকাটা গ্রুপে’র সদস্যদের মধ্যে কয়েকজনের দুর্ভিক্ষ বিষয়কে কেন্দ্র করে যেসব ছবি আঁকতেন, কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা জনযুদ্ধ ও পিপলস ওয়ারে তা নিয়মিত প্রকাশিত হতো। ক্যালকাটা গ্রুপের পাশাপাশি জয়নুল আবেদিন, চিত্তপ্রসাদ, সোমনাথ হোর প্রমুখ শিল্পী তাঁদের স্কেচ ও ছবির মাধ্যমে সেদিন প্রকাশ করেছিলেন দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধের ভয়াবহ দিক। তাঁদের ক্ষুধার্ত ও পীড়িত মানুষই হয়ে দাঁড়িয়েছিল ছবির প্রধান বিষয়বস্ত্ত।

তেতাল্লিশে যখন দুর্ভিক্ষ হলো, বাংলাদেশে তখন জয়নুল আবেদিন বাংলার সন্তান হয়ে এর দায় ধমনিতে ধারণ করে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর বয়স তখন মাত্র ঊনত্রিশ। বিবেকের তাড়না একজন সৃজনশীল মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে পরিবর্তন-প্রয়াসী করে তুলতে পারে – জয়নুল যেন তার জ্বলন্ত নিদর্শন। এতদিন তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল নিসর্গ ও রোমান্টিক কল্পনা। তা রাতারাতি পালটে গেল। তাঁর হৃদয়-যন্ত্রণায় তিনি যেন প্রতিবাদী-বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। এক আত্মসচেতন বোধ তাঁকে নিরন্ন-নিপীড়িত মানুষের জন্য সহমর্মী করে তুলেছিল। এ-চেতনাকে মোটা ব্রাশে যেভাবে চিত্রায়িত করেছিলেন তিনি, সমকালীন বেশ কয়েকজনের সৃষ্টিতেও তা রূপায়িত হয়েছিল। শিল্পমূল্যে বা জীবনের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলনে এসব ছবি মূল্যবান দলিল হয়ে আছে। কিন্তু জয়নুল আবেদিনের স্বতঃস্ফূর্ত মোটা ব্রাশের টান যে জীবন-যন্ত্রণাকে সাধারণ কাগজে তুলে ধরেছিল তা হয়ে উঠেছিল নানা দিক থেকে তাৎপর্যময়। তাঁর সৃজনক্ষমতা এই সময় থেকে আরো বলীয়ান হয়েছে এবং বিপুল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। তিনি হয়ে উঠলেন রূঢ়, নির্মম বাস্তবতার প্রধান রূপকার। মোটা ব্রাশের জয়নুলীয় শৈলী হয়ে ওঠে সত্যিকারভাবেই একদিকে অর্থময়, অন্যদিকে বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। অনেকেই এ-সময়ে দুর্ভিক্ষকে বিষয় করে এঁকেছেন এবং কাল, সময় ও শিল্পচেতনার দিক থেকে এসব চিত্রেরও মূল্যবান গুরুত্ব আছে। কিন্তু জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা সবদিক থেকে হয়ে  উঠেছিল অনন্য। সে-সময়ের শিল্পী চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য, সোমনাথ হোর, অবনী সেন, দেবব্রত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ এ-দায় এড়াতে পারেননি। তাঁরাও দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকেছিলেন।

দুর্ভিক্ষবিষয়ক চিত্রমালা নিয়ে রচিত গ্রন্থ কালচেতনার শিল্পী বইয়ের ভূমিকায় কলা-সমালোচক অশোক ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘বাংলার সাহিত্য শিল্পের যে ধারা বয়ে আসছিল, তার মধ্যেও দেখা দিলো নতুন প্রবণতা। লেখক-শিল্পীদের এক বড় অংশ যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতায় কলাকৈবল্যের পথ ছেড়ে বাস্তবধর্মিতার পথে এগোলেন, এমনকি শ্রেণিবিভক্ত সমাজে বঞ্চিত শ্রমিক-কৃষকদের স্বার্থকে নিজের স্বার্থ হিসেবে ঘোষণা করে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনের শরিক হলেন। বাংলার  কবিতা-কথাসাহিত্যে, নাটকে-গানে যুগান্তর ঘটল। চিত্রকলাও পিছিয়ে থাকল না। দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক দিনগুলোতে মতাদর্শ-নির্বিশেষে অনেক অগ্রগণ্য শিল্পীই বুভুক্ষু মানুষের ছবি আঁকলেন; যেমন দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, অতুল বসু, গোবর্দ্ধন আশ, সুধীর খাস্তগীর, গোপাল ঘোষ, রথীন মৈত্র, সূর্য রায়, ইন্দ্র দুগার ও রামকিঙ্কর। এঁরা দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকেছিলেন মূলত সময়ের মানবিক প্রেরণায়। তুলনায় আমাদের আজকের নির্বাচিত চারজন শিল্পীর সমগ্র জীবনধারা ও শিল্পসাধনাই গড়ে উঠেছে সেদিনের সেই মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। এঁরা সেদিন থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত দরিদ্র মানুষের সঙ্গেই একাত্ম থেকেছেন, তাঁদের দুঃখ-বেদনা, আশা-আনন্দ, বাঁচবার আন্দোলন – সবকিছুকেই করে নিয়েছেন শিল্পের প্রধান বিষয়। এঁরা, বলা বাহুল্য, এক স্বতন্ত্র ধারার শিল্পী, যে-ধারা পৃথিবীর দেশে দেশে কলাশিল্পের মূলধারার সঙ্গে কখনো মিলিত হয়ে, কখনো সমান্তরালে বয়ে চলেছে। বাংলায় সেই ধারার সূত্রপাত ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে – যখন সরকারি আর্ট স্কুলে বাস্তববাদী ছবি আঁকার শিক্ষা নিয়ে বাঙালি তরুণেরা বেরোতে শুরু করেছেন।’

জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে কলকাতার বাম ধারার চিত্রশিল্পীদের সখ্য গড়ে উঠলেও তিনি রোমান্টিক ধারায় ছবি এঁকে চলেছিলেন।

১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ তাঁর শিল্পীসত্তাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। বাংলার গ্রামের নিম্ন আয়ের ও নিম্নবিত্তের মানুষ যৎসামান্য খাদ্য সংগ্রহের আশায় কলকাতায় ছুটে আসতে থাকে। সরবরাহ ব্যবস্থায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় এবং একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্য মজুদ করায় খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করে। সরকারের ভ্রান্ত খাদ্যনীতিকে এ-দুর্ভিক্ষের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করে পরবর্তীকালে অনেকে বলেছেন, জয়নুল কিছুদিনের জন্য ময়মনসিংহে চলে আসেন। দুর্ভিক্ষের এই রূপ দেখে তিনি বিচলিতবোধ করেন। দুর্ভিক্ষজনিত কারণে কলকাতার রূপ বদলে যেতে থাকে। শতসহস্র মানুষ ভিক্ষা করতে শুরু করেন। চাল ও সামান্য খাদ্যের জন্য আহাজারি করেন। এক মুঠি চাল দিতে না পারলে শুধু ভাতের ফ্যানের জন্যও কাকুতি-মিনতি করেন। খাদ্যের অভাবে শীর্ণ-দীর্ণ শত-সহস্র মানুষ কলকাতা শহরের পথে-ঘাটে এ-সময় মারা যান। শহরের নানা জায়গায় মৃত মানুষকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। ডাস্টবিনের সামনে শীর্ণকায় এই মানুষেরা কুকুরের সঙ্গে, কখনো কাকের সঙ্গে উচ্ছিষ্ট খাবার খুঁজতে থাকে।

এই দুর্ভিক্ষ কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের হৃদয়কেও প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল। ১৯৪৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ৩৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক একটি বিবৃতি দিলেন সংবাদপত্রে এবং দেশের মানুষকে সহায়তা করার জন্য আকুল আবেদন জানান। এই বিবৃতিটির ঐতিহাসিক মূল্য আছে।

১৯৯৩ সালের নভেম্বরে প্রতিক্ষণ সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল ‘অখন্ড বাংলায় শিল্পীর তুলিতে স্মৃতিতে পঞ্চাশের মন্বন্তর’ শীর্ষক সমীর ঘোষের একটি লেখা। এই লেখাটিতে আচার্য জয়নুল আবেদিন প্রসঙ্গে যেমন উল্লেখ আছে, তেমনি সেই সময়ের প্রাসঙ্গিক চেতনা খুবই হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে তুলে ধরা হয়েছে।

শতবার্ষিকীর আলোছায়ায় কিছু কথা

জয়নুল আবেদিনের বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের সৃষ্টিতে লোকশিল্পের আত্তীকরণ ও আধুনিক বোধের যে-প্রকাশ আমরা পর্যবেক্ষণ করি তা শুধু মনোজ সুষমামন্ডিত নয়, এদেশের চিত্রকলায় নব্যধারাও বটে। পরবর্তীকালে এ-ধারারই বলিষ্ঠ রূপকার হয়ে ওঠেন কাইয়ুম চৌধুরী, রশিদ চৌধুরী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, রফিকুন নবীসহ অনেকে। ষাটের দশকের কয়েকজন শিল্পীর মধ্যেও এ-ধারার প্রকাশ ঘটে। এ-ধারার আধুনিকায়নের যে-অভিব্যক্তি, আমরা মনে করি বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের বিশিষ্টতা, চারিত্র্য এবং বৈশিষ্ট্যের শনাক্তকরণে এ শক্তিশালী প্রকাশও বটে।

জয়নুল আবেদিনের আরেক বৃহৎ কীর্তি চিত্রবিদ্যার শিক্ষালয়টিকে সত্যিকার অর্থেই একটি আধুনিক শিক্ষালয় হিসেবে গড়ে তোলা। প্রথম আবর্তনের মেধাবী কয়েকজন যখন উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের জন্য পাশ্চাত্যে পাড়ি জমান আবেদিনের তাতে উৎসাহ ছিল। দু-একজন শিল্পীর সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, পরিগ্রহণ ও ঐতিহ্যে আস্থার জন্য তিনি শিক্ষক হিসেবে যে আদর্শিক চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্য শিক্ষণীয় করে তুলতে চেয়েছিলেন তা তা্দের মানস গঠনে সহায়ক হয়েছিল। জয়নুলের শিল্পাদর্শকে করোটিতে ধারণ করেই তাঁদের মানসযাত্রা ও সৃষ্টি বলীয়ান হয়েছে। একটি বিষয়ে আমি তর্ক তুলতে চাই। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় আবর্তনের ছাত্ররা যে-ভিত রচনা করেছেন এদেশের চিত্রশিল্পে বিশেষত আধুনিকতায় ঐতিহ্য ভাবনায় ও শিকড় সন্ধানে, পরবর্তীকালে তা গতানুগতিক একটি বৃত্তে আবদ্ধ হয়েছে। ভাঙা ও গড়ার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের চিত্রশিল্পকে আরো বেগবান করার ও নবীন কোনো পথ নির্মাণের তাগিদ আমরা প্রত্যক্ষ করলেও তা খুব তীব্র নয়। পঞ্চাশের দশকের যে একঝাঁক শিল্পীকে দেখেছি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পরিগ্রহণের মধ্য দিয়ে এদেশের চিত্রশিল্পে নতুন নতুন মাত্রা সঞ্চার করতে বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিতে, তা এখন আর দেখা যায় না। সে কি কেবল এজন্য যে, জয়নুলের মতো শিক্ষক ও অনুপ্রেরণাসঞ্চারী শিল্পী শিক্ষাঙ্গনে হয়ে পড়েছে বিরল।

এছাড়া সংখ্যাতত্ত্বের দিক থেকে দুটি বিষয় আমাদের কাছে প্রণিধানযোগ্য হয়ে ওঠে। জলরঙে জয়নুল নিসর্গ অঙ্কনে যে-পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন চল্লিশের দশকে, তারই পরিশীলিত রূপ দেখতে পাই পরবর্তীকালে। এ যেন উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হয়েছে নানা পরিপ্রেক্ষিতে। লোকশিল্পের আদল থেকে তিনি পরিগ্রহণ করেছেন, ভাংচুর দেখি সৃষ্টিকর্মে, কখনো বিষয়ে। অন্যদিকে নিম্নবর্গীয় কৃষিজীবীকে তিনি কোনোভাবেই ছেড়ে যাননি। বাল্য ও কৈশোরে যে নদী, নিসর্গ ও মানুষজনকে অবলোকন করেছিলেন, তা হয়ে উঠেছিল তাঁর উপজীব্য। নিম্নবর্গীয়রা শ্রদ্ধেয়ভাবে পরিস্ফুট হয়েছে তাঁর সৃষ্টিতে। প্রতিবাদ নেই বটে, তবে এই রূপায়ণে বিশ্বস্তভাবে নিম্নবর্গীয় জীবন প্রতিফলিত হয়েছে।

এছাড়া বাংলার লোকশিল্পের ও ঐতিহ্যিক প্রবাহের প্রতি তাঁর অনুরাগের যে-বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল, তা তাঁর শিক্ষার্থী ও দেশের সংস্কৃতজনের মধ্যে নবীন আলোকে ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে। বর্তমানে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সমাজে লোকশিল্প নিয়ে যে আনুকূল্যের প্রবাহ ও উৎসাহ এ জয়নুলেরই অবদান। জয়নুল এখানেও অনন্য।

জয়নুল আবেদিনের সৃজন ও সৃষ্টির স্বল্পতা নিয়ে নানা অভিযোগ শোনা যায়। প্রতিভার বহুকৌণিক স্ফুরণ সত্ত্বেও তিনি সৃষ্টির ক্ষেত্রে অফুরান হতে পারেননি। সাংগঠনিক কাজে তাঁর প্রতিভা ও কর্মপ্রবাহ অপচয়িত হয়েছে এমত কথাও শোনা যায়। এ-অভিযোগ ভিত্তিহীন, তাঁর সৃষ্টি গুণগত মানে অসামান্য, আধুনিকতার উজ্জ্বল প্রকাশে অন্যতম প্রধান শিল্পীপুরুষও বটে।

শতবার্ষিকীর আলোছায়ায় আচার্য জয়নুল আবেদিনকে বিচ্ছিন্নভাবে নয়, সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা প্রয়োজন। তাঁর সৃষ্টি, তাঁর ব্যক্তিত্ব, লোকশিল্প ও ঐতিহ্যভাবনা এবং দেশ আত্মার মর্মবেদনা ও সংকট উত্তরণের জন্য তাঁর ভাবনা নিয়ে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে চর্চা হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে আমরা মনে করি।

জয়নুল আবেদিনের সৃষ্টির নানা ধারার মূল্যায়ন ও তাঁর সৃষ্টির প্রবাহকে বলীয়ান করলে আমাদের চিত্রকলা-আন্দোলন আরো অধিক খরপ্রবাহিনী এবং আধুনিকতার বহিঃপ্রকাশে উজ্জ্বল হবে সন্দেহ নেই। শতবার্ষিকীতে আমরা এই কামনা করি। r

 

জীবনপঞ্জি

১৯১৪         জন্ম : ২৯ ডিসেম্বর, কিশোরগঞ্জ। পিতা : শেখ তমিজউদ্দিন আহমদ, মা : জয়নবুন্নেসা। পিতৃনিবাস : ময়মনসিংহ শহরসংলগ্ন কাঁচিঝুলি গ্রাম। মাতামহের বাড়ি : ময়মনসিংহ শহরের আকুয়া মাদ্রাসা কোয়ার্টার। ১৯২৫ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবন অতিবাহিত হয় কিশোরগঞ্জ, কেন্দুয়া, মিঠামইন ও শেরপুরের থানা সদরে।

১৯২২        শেরপুর রামরঙ্গিণী এম. ই. স্কুলে ভর্তি ও সেখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠগ্রহণ।

১৯২৬        ময়মনসিংহ শহরের আকুয়া মাদ্রাসা কোয়ার্টারে পিতা কর্তৃক গৃহনির্মাণের পর সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু। ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি ও সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন। চিত্রাঙ্কনের প্রতি ঝোঁক।

১৯৩০-৩১   ১৯৩০ সালে ময়মনসিংহের মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি ও সেখানে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন। বোম্বে ক্রনিকল পত্রিকা গলফ খেলার চিত্র-অঙ্কন নিয়ে প্রতিযোগিতা আহবান করলে তাতে অংশগ্রহণ করে পুরস্কারলাভ। বাড়ির কাউকে কিছু না বলে কলকাতা গিয়ে আর্ট স্কুল পরিদর্শন। পাঠ্যগ্রন্থের প্রতি অমনোযোগ ও শিল্পচর্চার প্রতি প্রবল আগ্রহ লক্ষ করে মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক কর্তৃক জয়নুলকে আর্ট স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারে তাঁর পিতার কাছে সুপারিশ। ১৯৩১ সালে চাকরি থেকে তাঁর পিতার অবসরগ্রহণ।

১৯৩২-৩৮  ১৯৩২ সালের জুলাই মাসে কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৩৮ সালের মে পর্যন্ত সেখানে অধ্যয়ন। ময়মনসিংহ জেলা বোর্ড থেকে মাসিক ১৫ টাকা হারে বৃত্তি লাভ। থাকেন : ৩১ ওয়েলেসলি স্ট্রিটের এক মেসে এবং পরে বন্ডেল রোডে। আউটডোর স্টাডি : কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, ময়মনসিংহ এবং সাঁওতাল পরগনার দুমকায়। কমার্শিয়াল কাজ : হানাফি পত্রিকায় কার্টুন, টেবিল ল্যাম্পের শেড চিত্রণ, বুলবুল পত্রিকায় স্কেচ প্রভৃতি। ভাইদের লেখাপড়ায় ও সংসারে আর্থিক সহায়তাদান। চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ বর্ষ পর্যন্ত ফাইন আর্ট বিভাগে অধ্যয়ন। ১৯৩৭ সালে ছাত্র থাকাবস্থায় আর্ট স্কুলের অস্থায়ী শিক্ষক নিযুক্ত।

১৯৩৮        আর্ট স্কুলের চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন। কলকাতায় অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টের উদ্যোগে আয়োজিত সর্বভারতীয় বার্ষিক প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে ‘অন অ্যান্ড ওভার দি ব্রহ্মপুত্র’ শীর্ষক ছটি জলরংচিত্রের জন্য স্বর্ণপদক (গভর্নরস গোল্ড মেডেল হিসেবে পরিচিত) লাভ। ১৪ নং সার্কাস রোডে বসবাস শুরু।

১৯৩৯        কলকাতা আর্ট স্কুলের শিক্ষক আবদুল মঈনের অকালমৃত্যুর (১৬ মার্চ) ফলে সৃষ্ট শূন্য পদে স্থায়ী নিয়োগলাভ। ব্রিটিশ সরকারের তিন বছর মেয়াদের স্কলারশিপ পেয়েও, বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায়, ব্রিটেন যাত্রা স্থগিত।

১৯৪৩        বাংলার মন্বন্তরকে কেন্দ্র করে কলকাতার রাজপথের অনাহারী মানুষদের নিয়ে আঁকেন প্রচুর স্কেচ ও কয়েকটি দুর্ভিক্ষ-চিত্র। দুর্ভিক্ষের স্কেচ ছাপা হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা Peoples War ও জনযুদ্ধে; তাছাড়া The Statesman-সহ বিভিন্ন পত্রিকায়। কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে দুর্ভিক্ষের চিত্র নিয়ে কলকাতার কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ এবং তাঁর চিত্রমালা দর্শকদের দ্বারা বিপুলভাবে প্রশংসিত।

১৯৪৪        জয়নুলের ১২টি দুর্ভিক্ষ-চিত্রের প্রতিলিপিসহ ইলা সেন-রচিত Darkening Days of Bengal প্রকাশিত।

১৯৪৫        ৩ থেকে ৮ মার্চে কলকাতার মোহাম্মদ আলী পার্কে অনুষ্ঠিত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের তৃতীয় সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত ‘আমাদের দেশ’ শীর্ষক শিল্প-প্রদর্শনীতে জয়নুলের দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালা স্থান পায়। সাঁওতাল পরগনার দুমকায় গিয়ে সাঁওতালদের নিয়ে চিত্র-অঙ্কন।

১৯৪৬        মার্চ মাসে অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস সোসাইটির উদ্যোগে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক শিল্প-প্রদর্শনী ও প্রথম সর্বভারতীয় শিল্প-সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ। বছরের শেষদিকে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অনুষ্ঠিত মুসলিম আর্ট এক্সিবিশনে অংশগ্রহণ। ৮ অক্টোবর ঢাকানিবাসী তৈয়বউদ্দিন আহমদের কন্যা জাহানারা আহমদের (জ ১৯৩১) সঙ্গে পরিণয়। ২৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে নববধূর গৃহপ্রবেশ এবং সেইদিনই কলকাতায় জয়নুলের বন্ধু ও গুণগ্রাহীদের দ্বারা নবদম্পতিকে অভিনন্দিত করে ১৬ জনের কবিতা ও ২ জনের গদ্য নিয়ে পুস্তিকা প্রকাশ। নভেম্বর-ডিসেম্বরে ইউনেস্কোর উদ্যোগে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আধুনিক চিত্র-প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ।

১৯৪৭        জানুয়ারিতে নববধূকে নিয়ে কলকাতা গমন ও তারক দত্ত রোডের এক বাসায় বসবাস। মার্চ মাসে অল-ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস সোসাইটির উদ্যোগে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত আন্তঃএশীয় শিল্প-প্রদর্শনীতে ‘শাল বৃক্ষরাজির মধ্য দিয়ে’ শীর্ষক ছবির জন্য জলরঙে (পাশ্চাত্য) দ্বিতীয় পুরস্কার অর্জন। লন্ডনের বার্লিংটন হাউসে অনুষ্ঠিত সমকালীন আধুনিক ভারতীয় প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ। ১৯৪৭-৪৮-এ লন্ডনের রয়্যাল অ্যাকাডেমি অফ আর্টস আয়োজিত খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তানের শিল্প-প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ। দেশবিভাগের ফলে কলকাতা আর্ট স্কুলের চাকরিতে অপশন দিয়ে আগস্টে ঢাকা আগমন ও নরমাল টিচার্স ট্রেনিং স্কুলে ড্রইং-টিচার হিসেবে যুক্ত হন। ৪০/২ আবদুল হাদি লেনে শ্বশুরালয়ে বসবাস। ১ অক্টোবর প্রথম সন্তান সাইফুল আবেদিনের জন্ম।

১৯৪৮        জানুয়ারিতে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত বেঙ্গল ড্রইং ও পেইন্টিং প্রদর্শনীতে (১৯০০-৪৮) অংশগ্রহণ। ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক পরিচয় উপলক্ষে আয়োজিত ফজলুল হক হলের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এবং সেখানে এক বিকেলের একটি শিল্প-প্রদর্শনীর আয়োজন। ১৪ আগস্ট ঢাকার গভর্নর হাউসে ভারতবর্ষে মুসলিম কৃতিত্বের বিষয় অবলম্বনে আঁকা তাঁর একশটি পোস্টার-চিত্রের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত। তাঁর নেতৃত্বে অন্য শিক্ষকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠা ও সেপ্টেম্বর থেকে যাত্রা শুরু। তার আগে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য ও বেতার বিভাগের প্রচার শাখার আর্ট ডিজাইনার নিযুক্ত হয়ে আগস্টে করাচি গমন।

১৯৪৯        ২৮ ফেব্রুয়ারি করাচি থেকে প্রত্যাবর্তন ও ১ মার্চ আর্ট ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ পদে যোগদান।

১৯৫০        দ্বিতীয় সন্তানের (পুত্র) জন্ম ১৪ জানুয়ারি ও মৃত্যু ২৬ জানুয়ারি। ফেব্রুয়ারি থেকে আজিমপুর সরকারি কলোনির ৪২ নং ভবনের তিন তলার এক ফ্ল্যাটে বসবাস শুরু। তাঁর নেতৃত্বে ডিসেম্বরে ‘ঢাকা আর্ট গ্রুপ’ গঠন; তিনি সভাপতি মনোনীত।

১৯৫১        ১৬-২১ জানুয়ারি ঢাকায় আর্ট গ্রুপের প্রথম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত। ১৮ জানুয়ারি মধ্যম পুত্র খায়রুল আবেদিনের জন্ম। সাংস্কৃতিক সম্মেলন (১৬-১৭ মার্চ) উপলক্ষে চট্টগ্রাম গমন।  এ-বছরের প্রথমার্ধে ঢাকার ৭৩ শান্তিনগরে পুরনো ভবনসহ দেড় বিঘা আয়তনের একটি প্লট ক্রয়। এক বছরের স্কলারশিপ নিয়ে ৩ আগস্ট লন্ডন গমন এবং সেখানে স্লেড স্কুল অফ আর্টে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ। ৩-৮ ডিসেম্বর রয়্যাল ইন্ডিয়া পাকিস্তান অ্যান্ড সিলোন সোসাইটির উদ্যোগে লন্ডনের ইমপেরিয়াল ইনস্টিটিউটে একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত। এ-বছরে আঁকা তাঁর উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম : সাঁওতাল দম্পতি, দুই সাঁওতাল রমণী, কালবৈশাখী, কলসি কাঁখে নারী, বিদ্রোহী গরু, মই দেওয়া, প্রসাধন প্রভৃতি।

১৯৫২        ১৪-২৬ জানুয়ারি লন্ডনের বার্কলে গ্যালারিতে আরেকটি একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত। ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি ও তুরস্ক সফর। ভেনিসে ইউনেস্কোর উদ্যোগে আয়োজিত আন্তর্জাতিক শিল্প-সম্মেলনে যোগদান। আগস্টে দেশে প্রত্যাবর্তন।

১৯৫৩        ৯ জুলাই জন্ম কনিষ্ঠ পুত্র মইনুল আবেদিনের। মেয়ো স্কুল অফ আর্টের উদ্যোগে লাহোরের আলহামরায় একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত (১৪-২১ সেপ্টেম্বর)। এ-বছরে আঁকা তাঁর উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম : পাইন্যার মা, মা ও শিশু, আয়নাসহ বধূ, বনপথে একাকিনী, কেশবিন্যাস, চিন্তা, সাপুড়ের মেয়ে, গুণটানা প্রভৃতি।

১৯৫৪        ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে চারুকলা ইনস্টিটিউটের নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। মাজহারুল ইসলামের আধুনিক নকশায় নির্মিত এ-ভবনের নির্মাণকাজ জয়নুল নিজে দুবছরেরও অধিককাল তদারক করেন। ২৩-২৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ঢাকার সাংস্কৃতিক সম্মেলনের একটি অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন। মধ্য আগস্টে ঢাকায় নিখিল পাকিস্তান প্রথম শিল্প-প্রদর্শনীর আয়োজন।

১৯৫৫        আগস্টে ঢাকার সেগুনবাগিচায় আর্ট ইনস্টিটিউট ভবনে প্রথম লোকশিল্প-প্রদর্শনীর আয়োজন : মূল উদ্যোক্তা জয়নুল। পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিলের উদ্যোগে করাচিতে তাঁর একক প্রদর্শনীর আয়োজন। এ-উপলক্ষে সপরিবারে মাসব্যাপী করাচি সফর।

১৯৫৬        অক্টোবরে চারুকলা ইনস্টিটিউটের নিজস্ব ভবন শাহবাগে স্থানান্তরিত। তার আগে ২৫ আগস্ট এক বছরের রকফেলার ফাউন্ডেশনের অধীনে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, কানাডা, ব্রিটেন, জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ইতালি, সুইজারল্যান্ড ও স্পেন সফরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ। ১১ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহে পিতৃবিয়োগ। ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত টোকিওর দাইমারু ডিপার্টমেন্ট              স্টোরে তাঁর একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সানফ্রান্সিসকো মিউজিয়াম অফ আর্টসে অনুষ্ঠিত আরেকটি একক প্রদর্শনী।

১৯৫৭        ৮ থেকে ২৯ এপ্রিল ওয়াশিংটনের স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনে একক চিত্র-প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত। মে মাসে নিউইয়র্কে এবং জুন মাসে জার্মানিতে ছোট আকারের দুটি চিত্র-প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত। আগস্টে দেশে প্রত্যাবর্তন।

১৯৫৮        শাহবাগের আর্ট ইনস্টিটিউটে একটি  লোকশিল্প-প্রদর্শনীর আয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলের জীবন সদস্য মনোনীত। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত সাহিত্য-সম্মেলনে (২-৪ মে) যোগদান এবং একটি অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন ও প্রবন্ধ পাঠ।

১৯৫৯        পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট প্রদত্ত সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরস্কার ‘প্রাইড অফ পারফরমেন্স’ লাভ। সর্বোচ্চ সরকারি খেতাব ‘হিলাল-ই-ইমতিয়াজ’-এ ভূষিত। ‘সংগ্রাম’ (কাদায় আটকে পড়া গরুর গাড়ি) শীর্ষক বিখ্যাত চিত্রটি এগ  টেম্পেরায় অঙ্কন (১৯৫৫-তে সলিমুল্লাহ হল বার্ষিকীর প্রচ্ছদে এরই একটি রূপ এঁকেছিলেন ব্রাশে)।

১৯৬১        আমন্ত্রিত সরকারি অতিথি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর। মস্কোতে তাঁর একটি একক চিত্র-প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত; স্বর্ণপদক লাভ।

১৯৬২        ঢাকার সেগুনবাগিচায় গ্যালারিসহ আর্ট কাউন্সিলের নিজস্ব ভবন-প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন।

১৯৬৩        আর্ট ইনস্টিটিউট ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে কলেজে রূপান্তরিত। ইতিপূর্বেকার পাঁচ বছরের কোর্সটি প্রাক-বিএফএ ও বিএফএ ডিগ্রি কোর্সে রূপান্তরিত।

১৯৬৪        পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইন আর্ট বিভাগ চালু করার দায়িত্ব নিয়ে আগস্টে পেশোয়ার গমন ও সেখানে সাত মাস অবস্থান।

১৯৬৫        ফেব্রুয়ারির শেষে পেশোয়ার থেকে ঢাকা প্রত্যাবর্তন।

১৯৬৬        আরসিডিভুক্ত দেশসমূহের (পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্ক) পঞ্চম দ্বিবার্ষিক চিত্রকলা-প্রদর্শনীর বিচারক হিসেবে তেহরান গমন।

১৯৬৭        ৪ নভেম্বর সরকারি চারু ও কারুকলা কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ। অনানুষ্ঠানিকভাবে কলেজের শিক্ষার্থীদের দ্বারা ‘শিল্পাচার্য’ উপাধিতে ভূষিত।

১৯৬৮        টেলিভিশন, ফিল্ম ও পাবলিকেশন্সের জন্য  পাকিস্তান সরকারের অনারারি আর্ট অ্যাডভাইজার নিযুক্ত। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এ-দায়িত্ব পালনকালে অধিকাংশ সময় করাচিতে অবস্থান।

১৯৭০        ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ‘নবান্ন’ শীর্ষক প্রদর্শনী-আয়োজনে নেতৃত্ব দান। এ-উপলক্ষে ৬৫ ফুট দীর্ঘ ‘নবান্ন’ শীর্ষক স্ক্রোলচিত্র অংকন। আরব লীগের আমন্ত্রণে ৯ মে থেকে আড়াই মাসব্যাপী মিশর, জর্ডান, সিরিয়া ও লেবানন সফর। সফরকালে প্যালেস্টাইন উদ্বাস্ত্ত শিবিরসমূহ ও গেরিলা-যুদ্ধের এলাকা পরিদর্শন, তাদের নিয়ে চিত্র-অঙ্কন ও কায়রোতে প্রদর্শনী আয়োজন। ১১ নভেম্বরের উপকূলীয় ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তান্ডব প্রত্যক্ষ করার পর তা নিয়ে ‘মনপুরা ’৭০’ শীর্ষক ৩০ ফুট দীর্ঘ স্ক্রোলচিত্র-অঙ্কন (চিত্রটি আঁকা হয় মুক্তিযুদ্ধের পরে)।

১৯৭১         ফেব্রুয়ারিতে মওলানা ভাসানী-আহূত ময়মনসিংহের এক জনসভায় বক্তৃতা প্রদান এবং ‘হিলাল-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা। ১২ মার্চ বাংলা চারু ও কারুশিল্পী সংগ্রাম পরিষদ-আয়োজিত ‘স্বাধীনতা’ শীর্ষক মিছিলে নেতৃত্বদান। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ঢাকাতেই অবস্থান। তবে ২৯ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার ওপারে এক আত্মীয় বাড়িতে অবস্থান; তার মধ্যে ২ এপ্রিল জিঞ্জিরায় পাকবাহিনীর গোলাগুলির মধ্যে পড়েন।

১৯৭২        জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণের সেরা নকশা-বাছাই কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন। ফেব্রুয়ারিতে ফেসিয়াল প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে এপ্রিলে সরকারি উদ্যোগে চিকিৎসার জন্য লন্ডন গমন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আঁকা শিশু-কিশোরদের ছবি সঙ্গে নিয়ে গিয়ে লন্ডনের কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউটে তা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর হাতে-লেখা সংবিধান-তৈরির সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন। নভেম্বরে তাঁর ওপর দুবছরের জন্য অর্পিত হয় বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্বভার।

১৯৭৩        এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক তিন বছরের জন্য ভিজিটিং প্রফেসর নিযুক্ত। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনারারি ডি. লিট. ডিগ্রিতে ভূষিত। ডিগ্রি গ্রহণ (১৫ মে) উপলক্ষে সস্ত্রীক ভারত সফর। নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠিত সমকালীন শিল্পকলা-প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ এবং প্রদর্শনী-উপলক্ষে ভারত সফররত বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বদান।

১৯৭৪        বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী-গঠনের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন এবং একাডেমীর কাউন্সিল-সদস্য মনোনীত।

১৯৭৫        ১৭ মার্চ জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত। আমন্ত্রিত সরকারি অতিথি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর। যাত্রা শুরু তাঁর দুই স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানের : সোনারগাঁয় ‘বাংলাদেশ লোকজ চারু ও কারুকলা ফাউন্ডেশন’ (সরকারি গেজেট প্রকাশ : ১২ মার্চ) এবং ময়মনসিংহে ‘জয়নুল সংগ্রহশালা’ (উদ্বোধন : ১৫ এপ্রিল)। সেপ্টেম্বর থেকে অসুস্থতাবোধ। ডিসেম্বরে ফুসফুসে ক্যান্সার রোগ শনাক্ত।

১৯৭৬        জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দুমাস লন্ডনে চিকিৎসা গ্রহণ। ৭ মে ঢাকার পিজি হাসপাতালে ভর্তি; ২৮ মে জীবনাবসান।

১৯৭৭        জানুয়ারিতে শিল্পকলা একাডেমীতে শিল্প-প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত।

সংগ্রহ :      ন্যাশনাল মিউজিয়াম, ব্রাসেলস (বেলজিয়াম); সিনসিনেট মিউজিয়াম (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র); সানফ্রান্সিসকো মিউজিয়াম অফ আর্টস (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র); লাহোর মিউজিয়াম (পাকিস্তান); জাতীয় জাদুঘর (ঢাকা); জয়নুল সংগ্রহশালা (ময়মনসিংহ) প্রভৃতি। এছাড়া দেশে ও বিশ্বের বহু স্থানে শিল্পানুরাগীদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে তাঁর ছবি সংরক্ষিত আছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য : ডিউক অফ এডিনবরার ব্যক্তিগত সংগ্রহ।

সংকলক : সৈয়দ আজিজুল হক