অনুবাদ : সুব্রত বড়ুয়া
আমরা হারিয়েছি আমাদের সাহিত্যজগতের সবচেয়ে দুর্মুখ মানুষটিকে এবং তাঁর অনুপস্থিতির এই শূন্যতা আমাদের জীবনকে নিক্ষক্ষপ করেছে বিষণ্ণতা ও একাকিত্বের মধ্যে। তাঁর দুর্মুখতার স্বরূপ এমন ছিল যে, তা এমনকি সেই মানুষদের মধ্যেও ঈর্ষার আগুন সৃষ্টি করত যাঁরা ছিলেন অত্যন্ত মিষ্টভাষী ও শান্ত প্রকৃতির। দুর্মুখ মানুষদের অনেককে আমরা জানি। আমাদের নোংরা ও কালিমালিপ্ত সমাজ মরুভূমির ক্যাকটাস ও কাঁটাযুক্ত ঝোপের মতোই অসংখ্য দুর্মুখ মানুষের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু তাঁদের কারো মধ্যেই মান্টোর অহংকার ছিল না – তিনি জানতেন কীভাবে সেই কাঁটাগুলোকে পুষ্পে পরিণত করা যায়। তিনি অশস্নীল ও আক্রমণাত্মক কথাগুলিকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারতেন যেখানে সেগুলি রূপান্তরিত হতো সাহিত্য ও শিল্পে। তাঁর পাঠকরা কখনো কখনো ক্রুদ্ধ ও ধৈর্যচ্যুত হয়ে পড়তেন এবং এরপর এমন সময়ও আসত, যখন তাঁকে তাঁরা ভালোবাসতেন কেবল তাঁর লেখার জন্যই। তবে, তাঁর পাঠকরা কখনো তাঁর কোনো গল্প পড়তে গিয়ে তা অসমাপ্ত রেখে ছেড়ে উঠতে পারতেন না।
যখন কোনো সাময়িকী এসে পৌঁছাত, তখন প্রথমেই পড়া হতো মান্টোর লেখাটি। আমরা খুঁজে বের করতে তৎপর হয়ে উঠতাম মান্টো কাকে এবার ধোলাই করেছেন। কাকে এবার তিনি দুরমুশ করেছেন! সমাজের কোন গোপন দিকটি তিনি এবার উন্মোচিত করেছেন! মানুষ মান্টোর নতুন বইয়ে হাত ছোঁয়ানোর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে, যেমনটি তারা করে তাদের প্রিয় মানুষটির জন্য, সেই মানুষ যিনি তাদের শহরে এসে উপস্থিত হন আগাম কোনো বার্তা না পাঠিয়েই। মানুষ তাঁর দিকে ছুটে যায়
তাড়া-খাওয়া জনতার মতো।
এবং সেই দুর্মুখ মানুষটি এখন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। বহু মানুষ তাঁর জন্য শোক প্রকাশ করছেন ও কাঁদছেন। তিনি আর কখনো গল্প লিখবেন না। আর কখনো তাঁর নতুন বই প্রকাশ করবেন না। কখনো কোনো মানুষ আর তাঁর দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হবেন না। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলাও আর দায়ের হবে না। আর কখনো এমন একজন বুদ্ধিমান পাগল যাবেন না পাগলাগারদে। আর কখনো এমন একজন অদম্য মদ্যপায়ী কোনো পানশালায় পা ফেলবেন না। কখনো আর তাঁর মতো কেউ বন্ধুসমাবেশে হাজির হবেন না যিনি ঝগড়া করবেন তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে, এমনকি তাঁদের ওপর তাঁর ভালোবাসার বৃষ্টি বর্ষণ করার সময়ও। এখন রয়েছে কেবল তাঁর স্মৃতি যা এই আনন্দসঞ্চারী কথাকার রেখে গেছেন আমাদের জন্য।
মান্টো ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান, আদরণীয় কিন্তু ক্রুদ্ধস্বভাব একটি বালকের মতো, যার ছিল পিতার প্রতি অনেক অভিযোগ ও ভাইদের প্রতি অসূয়া এবং যে তার প্রতি সংঘটিত কিছু অবিচারের ক্রুদ্ধ প্রতিবাদে তার সব খেলনা ভেঙে ফেলেছিল। যে মা তাকে ভালোবাসত এবং যে মাকে সেও গভীরভাবে ভালোবাসত বিশেষ এক গর্ব ও আত্মসম্মানের কারণে, সেই মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আদর জানাবার ব্যাপারে এই ছেলেটির মনে দ্বিধা থাকত। এবং এখন, মনে হয়, সে সবাইকে জানিয়ে দিতে চায় যে সেই খেলনাগুলোর প্রতি কখনো তার কোনো আকর্ষণ ছিল না। বস্ত্তত, সে দাবি করে যে, খেলনাগুলো তার কাছে কুৎসিত মনে হতো এবং এই কথাটা সে ঘোষণা করতে চায় যে, ‘এই চেয়ারগুলো অনেক বেশি সুন্দর; এই বিছানাটাও একটি খেলনার মতো যা নিয়ে আমি খেলতে পারি। দেখো, এই অসুস্থ একজিমার ক্ষত দ্বারা আক্রান্ত কুকুরটা তোমাদের চেয়ে বেশি সহানুভূতিশীল; এই খোঁড়া বিড়ালটাও অনেক বেশি সুন্দর।’
যখন সে বুঝতে পারত যে, সবাইকে নিজ নিজ মনোযোগ পরিত্যাগ করে তার দিকে তাকাতে ও তার মূল্যবান সংগ্রহগুলো বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে বাধ্য করতে পেরেছে, তখন তার মুখে হালকা একটু হাসি ছড়িয়ে পড়ত। এই অভ্যাস তাঁর মধ্যে ছিল এমনকি যখন তিনি বড় হয়ে গিয়েছিলেন। মনে হতো, এভাবেই তিনি সমাজের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণ করছিলেন তাঁর অশস্নীল ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে।
তাঁর প্রথমদিককার লেখাগুলোর মধ্যে কখনো কখনো এরূপ অশস্নীল ভাষার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। অন্য কিছু লেখকের মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। কিন্তু মান্টো তাঁর এই বৈশিষ্ট্যকে অসম্ভব উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন এবং উর্দু সাহিত্যে অমর, অতুলনীয় কিছু চরিত্র সৃষ্টি করার কাজে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। আগামী প্রজন্মগুলো মান্টোর কাছ থেকে অনেককিছু শিখতে পারবে; কিন্তু মান্টো নিজে কখনো আর আমাদের কাছে ফিরে আসবেন না। তারা মান্টোর কাছ থেকে শিখবে কী লিখতে হবে এবং কীভাবে তাদের লেখা উচিত হবে, সেইসঙ্গে তারা শিখবে কী তাদের লেখা উচিত হবে না। এতদ্সত্ত্বেও দুঃখের বিষয় হলো, তারা কেউই ঘাড়তেড়া, তীক্ষনবুদ্ধি, বিদ্রূপপূর্ণ, ঝাঁঝালো – এবং একই সঙ্গে সুমিষ্ট হবেন না, যেমনটি মান্টো ছিলেন।
মান্টো তাঁর সাহিত্যজীবন শুরু করেন রুশ ও ফরাসি লেখকদের রচনা অনুবাদের মাধ্যমে। তাঁদের শৈলী ও বর্ণনার ধরন বা কৌশল তাঁর প্রথমদিকের রচনাগুলোতে সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান। অবশ্য এই লেখকদের দলের কেউই, একমাত্র ব্যতিক্রম গোর্কি ছাড়া, বুর্জোয়া যুগের বাস্তববাদী সমালোচনার হাত থেকে রেহাই পাননি। এই কাঠামোই মান্টোর প্রথমদিকের সৃজনশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়কে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।
সে ছিল সত্যিই এক অদ্ভুত সময়! ইউরোপের ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ তখন ব্যাপক পরিবর্তনের কাল অতিক্রম করছিল আর ক্রমশ তা রূপান্তরিত হচ্ছিল ফ্যাসিবাদে। এই রূপান্তরপর্বও অনেক তরুণ বিদ্রোহীকে ঠেলে দিচ্ছিল নাশকতা ও নৈরাজ্যবাদের দিকে, যা শিল্প ও সাহিত্যের জগতে প্রকাশ পাচ্ছিল ফরাসি দাদাবাদ (দাদাইজম) ও সুররিয়ালিজমের মাধ্যমে। এই আন্দোলনগুলির উপলব্ধি ও যৌক্তিকতার মূল নিহিত ছিল প্রকৃত প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করতে ও মানব অস্তিত্বের ঐতিহাসিক বিবর্তনের স্বরূপ বুঝতে না পারার মধ্যে। এছাড়াও, তখনকার ভারতে তৎকালীন দৃঢ়মূল সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ওপর আস্তরণ পড়েছিল বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের কুষ্ঠসদৃশ পরতগুলোর। এর ফলে শুধু যে স্বাধীনতার জন্য বিপস্নবী সংগ্রামের সূচনা ঘটেছিল তা নয়, বরং একই সঙ্গে তা সাহিত্যে রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদ ও রোমান্টিক বিপস্নবসমূহের প্রকাশও সম্ভব করেছিল।
এর ফলেই রুশ বিপস্নব, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-, ভগৎ সিং, ক্রোপোটকিন, ভিক্টর হুগো, গোর্কি এবং রোমানভের গল্প ‘উইদআউট চেরি বস্নুজোমস’ [চেরি না ফুটলেও] হয়ে উঠেছিল মান্টোর মানসিক ও আবেগমূলক সৃজনদিগমেত্মর ভিত – যখন প্রায় কুড়ি বছর আগে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল আলীগড়ে। মান্টো তাঁর প্রথমদিককার লেখায় যেসব ছন্নছাড়া মানুষের চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন তাতে গোর্কির প্রভাব স্পষ্টভাবেই দৃশ্যমান ছিল। হয়তো এমনও হতে পারে যে, এসব চরিত্র সৃষ্টিতে আমার অজানা অন্য কিছু কারণও ছিল যা তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। মান্টো এসব উপাদান একসঙ্গে জড়ো করেছিলেন এবং তাঁর নিজের জীবনের তিক্ততা ও সমাজব্যবস্থার অবিচারের সঙ্গে যুক্ত করে বয়নের মাধ্যমে তাকে একটি নতুন ও স্পষ্ট বৈশিষ্ট্যময় ব্যক্তিত্বে রূপ দিয়েছিলেন, যা পরিচিত হয়েছিল লেখক সাদত হাসান মান্টো নামে।
তাঁর বিশেষ ও অনন্য ব্যক্তিত্বই তাঁকে সাহস জুগিয়েছিল কোনোকিছু ও সবকিছুকে চ্যালেঞ্জ জানানোর; পরাজয় মেনে নিয়ে মাথা নিচু করার মানুষ ছিলেন না তিনি; কোনো কিছু চাইতেন না; নিজের প্রাপ্য দাবি করার মতো মানুষও তিনি ছিলেন না। তাঁর উপস্থিতির বিশটি বছর ধরে তিনি দেখেছেন বহু নতুন প্রভাব ও পরিস্থিতি, যা ছায়া ফেলা অব্যাহত রেখেছিল তাঁর জীবনে। গোর্কি, রাশিয়ার বিপস্নব, ভিক্টর হুগো ও জালিয়ানওয়ালাবাগ ধীরে ধীরে পেছনে চলে যেতে থাকল এবং ভগৎ সিং, ক্রোপোটকিন ও রোমানভ চলে এলো ক্রমশ আরো বেশি করে সামনে।
১৯৪০-এর পর এই তালিকায় যুক্ত হলেন সমারসেট মম। ভগৎ সিংয়ের হিংসাশ্রয়ী পদ্ধতির প্রতি আমাদের সমর্থন না-ও থাকতে পারে, কিন্তু তাঁর দেশপ্রেমের প্রতি আমরা কখনো কোনো সন্দেহ করতে পারি না। একইভাবে, মান্টোর সঙ্গে গুরুতর সাহিত্যিক ও আদর্শগত পার্থক্য কারো থাকতে পারে; কিন্তু তাঁর আন্তরিকতা, সততা, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম ও প্রবল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাব ইত্যাদি মেনে নেওয়ার ব্যাপারে কারো মনে কোনো দ্বিধা থাকা উচিত নয়। অতঃপর সমাজকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে তার অবশেষ এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেওয়ার যে-মানসিকতা মান্টোর ছিল তা বুঝতে পারা কঠিন হয় না। অবশ্য তিনি যেমন সে-সমাজকে পুনর্নির্মাণ করতে পারতেন না, তেমনি নগ্নতাকে নতুন পোশাক দিয়ে ঢেকেও দিতে পারতেন না। তিনি ছিলেন আমাদের সময়ের সামাজিক বাস্তবতার এক অসাধারণ অগ্রদূত এবং তাঁর সাহিত্যিক যুদ্ধংদেহী বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। হৃদয়ের অন্তর্গত সৌজন্যবোধ ও মানবপ্রেম তাঁকে নিরন্তর তাগিদ দিয়ে চলেছিল সাহিত্যিক রণমুখিতার দিকে এগিয়ে যাবার।
১৯৪০-এর পর তাঁর গল্পগুলোর সার্থকতা বিচারের জন্য তিনি নিজস্ব মাপকাঠি তৈরি করে নিয়েছিলেন : তাঁর গল্পগুলো যত বেশি মতভেদ ও আলোড়নের ঝড় তুলত তত বেশি সার্থক হতো সেগুলো। একবার, ১৯৪৫ বা ১৯৪৬ সালে, বম্বেতে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘সরদার, এই গল্পটি লেখার ব্যাপারটা কোনো মজা করার বিষয় ছিল না। কেউ আমাকে গালমন্দ করেনি এবং আমার নামে কেউ মামলাও ঠুকে দেয়নি।’
রাজিন্দর সিং বেদী যেমন করতে পারতেন মান্টো সেভাবে তাঁর দুঃখভারাক্রান্ত, বিমর্ষ চরিত্রগুলোকে বিদ্ধ করতে এবং মানব হৃদয়ের আন্তরিকতার প্রমাণ তুলে ধরতে পারতেন না। আবার ইসমত চুগতাইয়ের মতো নিষ্পাপ পাপীদের আশ্রয় দিতে এবং মাতা মেরির গাত্রবস্ত্রের পবিত্রতা দিয়ে তাদের ঢেকে রাখতে মান্টো পারতেন না। আবার অবশ্যই কিষণ চন্দরের মতো তাঁর কলমকে তিনি ব্যবহার করতে পারতেন না আরো বেশি আশাব্যঞ্জক ও সুন্দর ভবিষ্যতের ছবি তুলে ধরার উদ্দেশ্যে, উত্তেজনায় ফুঁসে উঠতে থাকা এই সমাজের সব কষ্টকে এক জায়গায় নিয়ে আসার জন্য তাঁর কলমকে ব্যবহার করতে। মান্টো জনগণের বেদনার চেয়ে বরং মানসিক বিকৃতির প্রতিই অধিক আকৃষ্ট হতেন। সুস্থ মানুষগুলির চেয়ে অসুস্থ মানুষদের হৃদয়ের গোপন পথপরিক্রমা করতেই মান্টো অধিক আনন্দ পেতেন। তাঁর গল্পের নায়কেরা ঠিক ভবঘুরে বলতে যা বোঝায় তা ছিল না। তারা ছিল সমাজবিরোধী ও অপরাধী। তিনি তাদের তাঁর গল্পে তুলে এনে সমাজের দিকে ছুড়ে দিতেন এবং তা করার পর তিক্ত ও বিদ্রূপাত্মক হাসিতে ফেটে পড়তেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, যারা বিশ্বাসের পোশাক পরিধান করে আছে তারা আসলে পুরোপুরি প্রতারক এবং তিনি যখনই কারো মধ্যে অলৌকিক সত্তার প্রতি ভক্তি কিংবা ভয় খুঁজে পেতেন, তখনই তাদের নগ্ন করে ছেড়ে দিতেন।
মান্টোর কাছে সমাজ ছিল একটি পচা পেঁয়াজের মতো। এমনকি, চমৎকার দক্ষতা ও নৈপুণ্যের সঙ্গে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর সময় তিনি হাসতেন এবং বলতেন, ‘দেখো, তোমাদের সমাজ এই ছাড়ানো খোসার সত্মূপ ছাড়া অন্য কিছু নয়।’
পেঁয়াজের সেই খোসা-ছাড়ানো শাঁসবস্ত্তটি ও তার খোসাগুলো আজো অবশ্য তেমনটিই আছে এবং সেটি এমন মায়াবিভ্রমও সৃষ্টি করে চলেছে যে, শাঁসবস্ত্তটিতে শক্ত ও মূল্যবান কিছু আছে। কিন্তু যে-আঙুলগুলো চমৎকার নৈপুণ্যের সঙ্গে খোসার পর খোসা ছাড়িয়েছিল সেগুলি এখন কবরে হিমশীতল হয়ে পড়ে রয়েছে; এবং প্রত্যেক লেখকই কামনা করেন যে, তাঁর আঙুলগুলো মান্টোর জাদুর সঙ্গে একাকার হয়ে যাক, এমনকি তা কেবল একদিনের জন্যও যদি হয়।
মান্টোর মহত্ত্ব নিহিত তাঁর সেই দক্ষতার মধ্যে যে-দক্ষতার সাহায্যে তিনি তাঁর চোখের সামনে সমাজের নগ্ন শরীরটিকে অনাবৃত করে ফেলেন। তিনি গণিকালয়, বাজার, পানশালা, বাসগৃহের চার দেয়াল ও সমাজের প্রতিটি অন্ধকার কোণের ভেতর থেকে মানুষের মৃতদেহগুলি বের করে নিয়ে আসেন এবং সেগুলিকে প্রকাশ্য স্থানে দাঁড় করিয়ে দেন ও ঘোষণা করেন, ‘দেখো, এখানেই আছে সেই মানুষগুলো যারা একসময় পশু ছিল।’
মান্টো সত্যকে এর সবচেয়ে পবিত্র ও যথার্থ রূপে ধারণ করতে সমর্থ ছিলেন না। তিনি নির্যাতনকে শুধু বিচ্ছিন্নভাবেই দেখেছিলেন, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন এবং এরপর তা পরিত্যাগ করেছিলেন। এসব জিনিস কোনো-না-কোনোভাবে আমাদের নিষ্ঠুর ও নির্দয় করে তুলতে পারে, যেভাবে আমরা দারিদ্র্য, নিষ্ঠুরতা ও নোংরা বস্ত্তর প্রতি অসচেতন হয়ে উঠি যেহেতু আমরা সেগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি ও সেগুলোকে সহ্য করতে শুরু করি অধিক উদ্বেগ ছাড়াই। রাস্তায় পড়ে থাকা একটি মৃতদেহ অতিক্রম করে আমরা এগিয়ে যাই; একটি ক্ষুধার্ত মানুষকে দেখেও আমরা খাওয়া অব্যাহত রাখি। একইভাবে, লেখকরাও তাঁদের লেখায় বারবার নির্যাতিত চরিত্রগুলোর ছবি আঁকতে আঁকতে এমনভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন যে, এমনকি সময় সময় চরম নিষ্ঠুরতা ও অত্যন্ত দুঃখজনক বিয়োগান্ত ঘটনাও তাঁদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি নাও করতে পারে।
এই কারণেই মান্টো যেমন কয়েকটি খেলো গল্প লিখেছেন, তেমনি অসাধারণ কিছু গল্পও লিখেছেন। যদি তিনি একদিকে ‘নয়া কানুন’, ‘তরক্কি পসন্দ’, ‘কবরিস্তান’, ‘মুত্রি’, ‘খোল দো’, ‘মজেল’ ও ‘টোবা টেক সিং’-এর মতো ব্যতিক্রমী গল্প লিখে থাকেন; পক্ষান্তরে তেমনি অন্যদিকে সাজ্জাদ জহিরের ভাষায় ‘বু’ এবং ‘হতক’-এর মতো ‘বেদনাদায়ক কিন্তু অবান্তর’ গল্পও লিখেছেন। এসব ছাড়াও তিনি লিখেছেন ‘সরকন্দে কে পিছে’র মতো ‘আতঙ্কজনক কিন্তু অর্থহীন’ গল্প, যেখানে তিনি দিয়েছেন একটি পাত্রে মানুষের মাংস রান্না করার বর্ণনা। তিনি কখনো এমন সংবেদনশীল একজন মানুষ হয়ে ওঠেন যে, ট্রেনে বসে থাকা একটি ছেলের হৃৎপি–র স্পন্দনও তিনি অনুভব করতে পারেন, যে-ছেলেটির বাবা তার সঙ্গে খেলতে পারছেন না। অন্যান্য কিছু সময়ে মান্টো এতই হৃদয়হীন হয়ে পড়েন যে, এমনকি ১৯৪৭-এর দাঙ্গার সময় সংঘটিত গভীর বেদনাদায়ক ঘটনা বর্ণনার সময়ও তিনি ঠাট্টা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেন না। তিনি ক্রিয়াকর্ম ও দ্বন্দ্বসংঘাতের মানবজগতে এমনভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন যে সেসবের মধ্যে তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছিলেন, এবং এই প্রক্রিয়ায় সেসবের কারণ ও অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যগুলি দেখতে পাননি। এরকম লেখক একই সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন উভয় ক্ষেত্রেই
শান্ত-সুবোধ ও নির্দয় হতে পারেন।
এবং এরপর তেমন একজন লেখক এমন ব্যক্তিমানুষে রূপান্তরিত হন যিনি তাঁর বন্ধু ও শত্রম্ন উভয়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাঁর আত্মকেন্দ্রিকতা তাঁকে প্রগতিশীল বা মৌলবাদী কারো সঙ্গেই যেতে দেয় না। অতএব, মান্টোও এই উভয় দল থেকে দূরে চলে গিয়েছিলেন এবং তাঁর নিজের বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত উচ্চারণেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এসব সিদ্ধান্ত গল্পের আকৃতি নিয়েছিল এবং কখনো কখনো তা হতো সঠিক ও সুন্দর, কিন্তু অন্যান্য সময়ের জন্য তা হতো ভুল ও কুৎসিত।
শিল্পের সৌন্দর্যের দিক থেকে মান্টো ছিলেন অনন্য ও অতুলনীয়। তাঁর মতো কেউ ছিলেন না। মান্টো তাঁর ভাষার সরলতা, নৈপুণ্য ও প্রাঞ্জলতার দ্বারা যে-অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারতেন, অন্য কোনো লেখকের তা করার ক্ষমতা ছিল না। মান্টোর তীক্ষন ও বিচক্ষণ চরিত্রনির্মাণ, তাঁর সুনির্মিত গল্পকাঠামো, গল্পের বর্ণনা, বিস্ময়কর বিদ্রূপাত্মক, সূক্ষ্ম ও খোঁচা দেওয়ার ভঙ্গি এবং কাব্যিক মাধুর্য ছিল একান্তই তাঁর নিজস্ব। মাত্র কয়েকটি শব্দেই তিনি একটি চরিত্রের অবয়ব তৈরি করতে পারতেন। তিনি যেভাবে চাইতেন সেভাবে তাঁর গল্পের বর্ণনা রূপায়িত করতেন এবং তাঁর গল্প পড়ার পর একজন পাঠকের মনে হতে পারে – সেগুলো পড়ার জন্য লেখা হয়নি। সেগুলো পড়ে মনে হবে যেন সাধারণ কোনো গল্প, কিন্তু একই সঙ্গে মনে হবে সেগুলো ব্যতিক্রমী যেন পর্বতের গা-বেয়ে নেমে চলা ঝরনা কিংবা কোনো বাধাবিপত্তি ছাড়াই বেড়ে ওঠা একটি গাছ। ভালোমন্দ বিচারের কোনো রকম দ্বিধাবোধ ছাড়াই তাঁর গল্পগুলোর অনন্যতা স্বীকার করে নিতে হয়। এবং এই অর্জন কোনো সামান্য অর্জন নয়। বস্ত্তত, এ হচ্ছে একজন শিল্পীর পরিচয়।
মান্টো ছিলেন একজন সংবেদনশীল মানুষ আর সেজন্যই দুবার তাঁর স্থান হয়েছিল উন্মাদ-আশ্রমে। তিনি ছিলেন নির্ভীক এবং সেজন্য অনেকবার তাঁকে আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে। তিনি ছিলেন অনড় ও জেদি একজন মানুষ; ফলে বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর ক্রমাগত ঝগড়া-বিবাদ হয়েছে। তাঁর আত্মসম্মানবোধ ছিল উঁচু এবং সেজন্য উপবাসে দিন কাটাতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর
তৃষ্ণা ছিল অফুরন্ত; সেজন্য তিনি অনবরত পান করে যেতেন। বেঁচে থাকার জন্য যে প্রবল উদ্দীপনা প্রয়োজন তিনি তা জাগিয়ে রাখতে পারেননি। এজন্যই তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন শিল্পী এবং এ-কারণেই এমনকি মৃত্যুর পরও তিনি বেঁচে রয়েছেন।
এবং এখন, আপনারা নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন – কেন তিনি এমন দুর্মুখ ছিলেন। কারণ এই সমাজ তাঁর প্রতি দুর্ব্যবহার করেছে, তাঁকে তিরস্কার করেছে, যেমনটি তারা করেছে আরো লাখ লাখ কোটি কোটি মানুষের প্রতি। মান্টোর এই দুর্মুখতা তেমন কোনো ক্ষতিসাধন করেনি। বস্ত্তত, এর উপকার, এই দুর্মুখতা দ্বারা যদি কোনো ক্ষতিসাধিত হতে পারত তার চেয়ে, অনেক অনেক বেশি। মান্টোর দুর্মুখতা আমাদের সাহিত্যের বিরল, তুলনাহীন ও আকাঙিক্ষত সেই সম্পদের মতো যা আমরা মূল্যবান প্রাপ্তি হিসেবে বাঁচিয়ে রাখব। এবং এতেও কোনো সন্দেহ নেই যে, নিশ্চয়ই সে-দুর্মুখতা আমাদেরও বাঁচিয়ে রাখবে!
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.