দুর্লভ আলোর নাম আবুল মনসুর আহমদ

ইমরান মাহফুজ

আবুল মনসুর আহমদ বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময়ের অকুতোভয় এক যোদ্ধার নাম। উপমহাদেশে অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে এ-নাম। তাঁর স্বাতন্ত্র্য আমাদের কাছে এসেছে নানাভাবে। কখনো রাজনীতির মঞ্চে, কখনো সংবাদপত্রে, কখনো সাহিত্যে স্যাটায়ারিস্ট ও প্রবন্ধের চিন্তানায়ক হিসেবে। আইনজীবী হিসেবেও নামটি সুপ্রিয়। তাঁর জীবনের শুরুতে বাঙালি মুসলমানের চেতনায় উন্মেষযুগকে দেখেছেন, যৌবনে উপমহাদেশের স্মরণীয় আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থেকেছেন, পরিণত জীবনে সংবাদপত্রের সঙ্গে থেকে নানা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকা– নেতৃত্ব দিয়েছেন। সর্বোপরি একজন জীবনশিল্পীর চোখে চারপাশ গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন।

আবুল মনসুর আহমদের জীবনকাল বিশেস্নষণে দেখা যায়, একাধিক ক্ষেত্রে বিচরণ করতে গিয়ে তাঁর শক্তি-সামর্থ্য খ–ত হয়েছে। একেই বলা যায়, আবুল মনসুর আহমদের বিচরণক্ষেত্রগুলো পরস্পর সহায়ক ও সম্পূরক। এসবের সমষ্টিতেই জন্ম হয়েছে আত্মপ্রত্যয়ী সাহিত্যিক, অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকের। সম্ভবত অন্যসব পরিচয় ডিঙিয়ে একমাত্র সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদই যেন সর্বোপরি অধিষ্ঠিত নাম; আজকের যেমন, তেমনি অনাগত কালের জন্যও। মননশীলতার বিচারে আবুল মনসুর আহমদ নামের যে-বটবৃক্ষ – সময়ের মধ্যে থেকে সব সহজযোগ নাগালে থাকা সত্ত্বেও,  সময়ের অনাচারের বিরুদ্ধে, অবিচল বটের মতো স্থির ছিলেন। সম্প্রদায়ের প্রতি; প্রত্যক্ষ ও উচ্চকিত হৃদ্যতা থাকা সত্ত্বেও অসাম্প্রদায়িকতার পরিচয় দিয়েছেন। এ-প্রসঙ্গে এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বক্তব্যটি উলেস্নখযোগ্য : ‘পরশুরাম হিন্দু দেবদেবী নিয়ে অনেক কিছু বলেছেন, হিন্দু সম্প্রদায় তা সহ্য করেছে। আবুল মনসুর আহমদের দুঃসাহস সেদিন সমাজ সহ্য করেছিল। আজ কোনো সম্পাদক এমন গল্প ছাপতে সাহস করবেন কিনা এবং সমাজ তা সহ্য করবে কিনা সে-সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। আবুল মনসুরের আক্রমণের লক্ষ্য কোনো ব্যক্তি, ধর্ম বা সম্প্রদায় নয়, তাঁর বিদ্রোহ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। আয়না প্রকাশের এতকাল পরেও মনে হয়, এরকম একটি গ্রন্থের প্রয়োজন আজো সমাজে রয়ে গেছে।’

এছাড়া নন্দিত এই লেখক নেতাজি সুভাষ বসুর অনুরক্ত ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে তিনি কংগ্রেস আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় সদস্য হন। ১৯৪০ সাল থেকে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবেও কাজ করেন। মূলত তিনি
কৃষক-প্রজা আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে আসেন। ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খাঁর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হলে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী  হিসেবে দায়িত্ব পান। তিনি ছয়দিন ওই দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন। পরে (১৯৫৬-৫৭) তিনি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুপস্থিতিতে অল্প কিছুদিনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর স্থলাভিষিক্তও ছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য দল থেকে শুরু করে সুভাষ বসুর আকর্ষণে কংগ্রেস, পাকিস্তান আন্দোলন, কৃষক প্রজা পার্টি, মুসলিম লীগ এবং সর্বশেষ আওয়ামী লীগ গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। এ-প্রসঙ্গে উলেস্নখ করি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বক্তব্য : ‘দীর্ঘদিন তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। এক সময় কেন্দ্রের প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন। পরিণত বয়সে নিজের রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতিকথা লিখেছেন, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর। এই বইটির অনেক তথ্য অনেক ঘটনা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, মতভেদ রয়েছে, নতুন ব্যাখ্যাও রয়েছে। কিন্তু কেউ একথা অস্বীকার করেন না যে, এই বইটি পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক সাহিত্যের বহুদিনের অভাব ভালোভাবে পূরণ করেছে।’

আবুল মনসুর আহমদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও হাস্যরসাত্মক লেখক হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত। সাহিত্যের সে-দিকটা তিনি বেছে নিয়েছিলেন, সেটা ছিল সবচেয়ে কঠিন – ব্যঙ্গ-সাহিত্য। সাহিত্যের অন্যান্য আঙিনায়ও স্বাচ্ছন্দ্যে পদচারণা করেছেন তিনি। যে-অঙ্গনেই তিনি কাজ করেছেন, সেখানেই শীর্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ব্যঙ্গ-সাহিত্যে বলতে গেলে উভয় বঙ্গে তিনি ছিলেন উলেস্নখযোগ্য। তাঁর প্রতিটি স্যাটায়ারই কালোত্তীর্ণ। সমাজপতি, ধর্মগুরু, রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী যেখানেই তিনি কোনো দুর্নীতির সন্ধান পেয়েছেন সেখানেই তাঁর লেখনীর মাধ্যমে কশাঘাত করেছেন। তাঁর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের রসাঘাত কশাঘাতে পরিণত হয়ে সমাজকে পরিশোধিত করত। এ-আঘাত ক্ষয়িষ্ণু সমাজের অবক্ষয়িত মূল্যবোধ আচার-অনুষ্ঠানকেই আক্রমণ করেনি, যারা এসব প্রসঙ্গ নিয়ে মিথ্যার জাল বুনে বেসাতি করতেন, তাদের তিনি নাস্তানাবুদ করেছেন। এসব রচনার পাঠকদের মনে হবে, চরিত্রগুলো সবই চেনা – এদের কার্যকলাপও ছিল জানা।

অনায়াসেই বলা যায়, আবুল মনসুর আহমদ সমকাল, সমাজ, জনগণ ও রাজনীতিসচেতন গল্পকার। সমাজের অতি কাছে কথকের বসবাস। জীবনের কঠিন বাস্তবতায় হেঁটে চলায় নানা অনুঘটনা ভিড় করেছে তাঁর অভিজ্ঞতার ডালিতে। আর খোলা চোখে দেখা ঘটনাপুঞ্জ ও চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে তাঁর সাহিত্যকর্মে। এ-ব্যাপারে আয়না গ্রন্থ উলেস্নখযোগ্য। ‘আয়নার ফ্রেম’ নামক ভূমিকায় নজরুল ইসলাম স্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন – ‘এমনি আয়নায় শুধু মানুষের বাইরের প্রতিচ্ছবিই দেখা যায়। কিন্তু আমার বন্ধুশিল্পী আবুল মনসুর যে  আয়না তৈরি করেছেন, তাতে মানুষের অন্তরের রূপ ধরা পড়েছে। যে সমস্ত মানুষ হরেক রকমের মুখোশ পরে আমাদের সমাজে অবাধে বিচরণ করছে, আবুল মনসুরের আয়নার ভেতরে তাদের স্বরূপ মূর্তি মন্দিরে, মসজিদে, বক্তৃতার মঞ্চে, পলিটিকসের আখড়ায়, সাহিত্য সমাজে বহুবার দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।’

আবার খ্যাতিমান লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় বলেন, ‘আয়না লিখিয়া আবুল মনসুর আহমেদ প্রাতঃস্মরণীয় হইয়াছিলেন। ফুড কনফারেন্স লিখিয়া তিনি অমর হইলেন।’

 

আবুল মনসুর আহমদ ময়মনসিংহের আঞ্চলিক বুলিকে সাহিত্যের ভাষা করতে চেয়েছেন। এটা তাঁর অঞ্চলপ্রীতির নমুনা হতে পারে; কিন্তু আঞ্চলিক বুলিই ভাষাশৈলীর অন্যতম উপাদান, এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আংশিক হলেও সত্য, আবুল মনসুর  রচনায় দূরবর্তী দিগন্তে আঙুল নির্দেশ করেছেন। অর্থাৎ গতানুগতিক দেয়াল টপকে বাইরে যেতে চেয়েছেন বরাবরই। আবুল মনসুর মাতৃভাষার প্রতি গভীর আগ্রহ ও গতানুগতিক চিন্তা থেকে কিশোর বয়সেই স্কুলে বাংলায় মিলাদ পড়ানোর নিয়ম চালু করেছিলেন। এ-প্রসঙ্গে  ড. রফিকুল ইসলামের একটি বক্তব্য উলেস্নখ করা যেতে পারে – ‘একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে আবুল মনসুর আহমদ একুশ দফাতে পরিণত করেছিলেন। তাঁর সৃষ্টিশীল প্রয়াস স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার পেছনে অবদান রেখেছে। আমরা জাতীয়তাবাদের একটা মহান চেতনা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি। সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক হিসেবে মরহুমের লেখনীকে আমাদের উত্তরাধিকারী হিসেবে পেতে হবে।’

সত্যি আবুল মনসুর আহমদ তাই ছিলেন। আয়না, হুজুর কেবলা, নায়েবে নবীর মতো রম্য গল্পের জন্যই লেখক হিসেবে তিনি আমার মতো অনেকের কাছে নমস্য। বর্তমান সময়ে মৌলবাদের থাবায় যখন আতঙ্কিত মুক্তচিন্তার মানুষ, তখন থেকে বহু বছর আগে তিনি এ-ধরনের গল্প লিখে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। আজকের দিনে ধর্মের ব্যাপার নিয়ে এভাবে কল্পনা করাও অসম্ভব। কবি নজরুল তাঁর বহু আগেই তথাকথিত আলেমদের দ্বারা কাফের আখ্যায় চিহ্নিত হয়েছেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেন, ‘আবুল মনসুর আহমদ বাংলাদেশের স্যাটায়ার রচনার ক্ষেত্রে যে পূর্ব বাংলার পরশুরাম এ-সম্পর্কেও বোধ করি কেউ দ্বিমত হবেন না।’

অন্যদিকে রক্ষণশীল মুসলমান সমাজ চিত্রশিল্পের বিরোধিতা করলেও সে-সময়ে অনেক প্রগতিপন্থি বুদ্ধিজীবী এ-শিল্পমাধ্যমের সমর্থন জানান দৃঢ়ভাবে। কাজী নজরুল ইসলাম গোঁড়া রক্ষণশীল সমাজপতিদের উদ্দেশে লেখেন : ‘আজ বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে একজনও চিত্রশিল্পী নেই, ভাস্কর নেই, সংগীতজ্ঞ নেই, বৈজ্ঞানিক নেই, ইহা অপেক্ষা লজ্জার আর কী আছে? এসবে যাঁহারা জগৎপ্রেরণা লইয়া আসিয়াছিল, আমাদের গোঁড়া সমাজ তাহাদের টুঁটি চাপিয়া মারিয়া ফেলিয়াছে ও ফেলিতেছে। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমাদের সমস্ত শক্তি লইয়া যুঝিতে হইবে।’

কথাসাহিত্যিক আবুল ফজল চিত্রশিল্পের পক্ষে নিজের সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁর চৌচির (১৯৩৪) উপন্যাসের নায়ক তসলীমের যে-ভাবনা, সেখানে আছে চিত্রশিল্পের প্রতি সমর্থন। এ-বিষয়ে আবুল মনসুর আহমদের বক্তব্য, ‘মানুষের চিন্তা, অনুভূতি ও ভাবধারা প্রকাশের চিত্রশিল্প এমন উত্তম বাহন, তাহা কি মানুষের ধর্ম ইসলাম হারাম করিতে পারে? মানুষের ভাবধারার ইতিহাসে মানবচিত্তের অভিযানের এ অখ- বিকাশ, ইহার চর্চা ইসলাম নিষেধ করিতে পারে, এই কথা সে বিশ্বাস করিতে পারিতেছিল না। তাহার যেন কেন মনে হইতেছিল, এ আমাদের ইসলামকে বুঝিবার ও বুঝাইবার ভুল।’

শুদ্ধ চিন্তার আবুল মনসুর আহমদ সাংবাদিকতা করেছেন, রাজনীতি করেছেন, ওকালতি করেছেন এবং সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, এমন একজন মানুষ আবার সাহিত্যচর্চাও করেছেন। এজন্য তাঁকে ভালোভাবে বুঝতে হলে আলাদা-আলাদাভাবে অন্তত তিনটি জীবনী লেখা দরকার বলে অনেকে মনে করছেন, যার একটি হবে সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবে, একটি সাহিত্যিক হিসেবে এবং অপরটি রাজনীতিবিদ হিসেবে। পত্রিকার সম্পাদকীয় লেখা সম্পর্কে একটা মজার কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনি বলে গেছেন। আমাদের এখনকার সম্পাদকদের এ-কথাগুলো কাজে লাগতে পারে। তাঁর মতে : ‘সম্পাদকীয় লিখিতে হইলে সম্পাদকদিগকে সব বিষয়ে ‘প–ত’ হতে হয়। এঁরা সব ব্যাপারে সকলের স্বনিয়োজিত উপদেষ্টা। এঁরা জিন্না সাহেবকে রাজনীতি সম্বন্ধে, গান্ধীজীকে অহিংসা সম্বন্ধে, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রকে রসায়ন সম্বন্ধে, ডা. আনসারীকে চিকিৎসা সম্বন্ধে, হক সাহেবকে (এ কে ফজলুল হক) ওজারতি সম্বন্ধে, শহীদ সাহেবকে (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) দলীয় রাজনীতি সম্বন্ধে, মাওলানা আযাদকে ধর্ম সম্বন্ধে, এমনকি জেনারেল দ্য গলকে যুদ্ধনীতি ও স্টালিনকে কমিউনিজম সম্বন্ধে উপদেশ দিয়া থাকেন। সেই উপদেশ না মানিলে কষিয়া গালও তাঁদের দিয়া থাকেন। উপদেশ দেওয়া এঁদের কর্তব্য ও ডিউটি। সেজন্যই তাঁরা সম্পাদক। সেজন্যই ওঁদের বেতন দেওয়া হয়।’

প্রতিভার দিক দিয়ে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে তিনি উলেস্নখযোগ্য অগ্রণী ভূমিকা রেখে গেছেন, যা আজো আমাদের জন্য গ্রহণীয়।

 

দুঃসময়ে মানুষ চেনা যায় বটে, কিন্তু নিজের মাথাটা ঠিক রাখা দায় হয়ে ওঠে। তারপরও কেউ যদি হয় একজন ছাপোষা মানুষ, গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো সাহিত্যের ভূত কাঁধে সওয়ার হয়, তাকে যুদ্ধটা করতে হয় নিজের সঙ্গেই। বিশ শতকের সবার জন্যই এ-কথা সত্যি। দুটি কাঠি এগিয়ে আবুল মনসুর আহমদ একজন ভিশনারি বুদ্ধিজীবী হিসেবে জাতিকে যেমন পথ দেখিয়েছেন, তেমনি প্রকৃত রাজনীতিবিদ হিসেবে একুশ দফা, যুক্তফ্রন্ট সংগঠন, ছয় দফার প্রচারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর বন্ধু আতাউর রহমানের মতে – পূর্ব পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের ‘রাজনৈতিক হরিঠাকুর হয়েছিলেন আমৃত্যু। ভুল তো তার হতেই পারে, আর দোলন যে তার প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য!’

আবুল মনসুর আহমদের জীবন থেকে দেখি – দেশপ্রেম বুকে নিয়ে সারাজীবন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁর দেখা সমাজের প্রতিটি অসংগতি নিয়েই কলম ধরেছেন। সময়ের বুকে পা রেখে কুয়াশা ভেদ করে দেখেছেন আলো। সর্বত্র বিচরণে দিন-দিন তাঁর কলম হয়ে উঠছে দুর্ধর্ষ। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের প্রেরণা জুগিয়ে, সবার মাঝে দিয়েছে শুদ্ধচিন্তার খোরাক। স্বতন্ত্র কালচারের স্বপ্ন দেখে একাধিক গ্রন্থও রচনা করেন। এমারসন বলেন, ‘স্বকীয়তা ধরো, অনুসরণ ছাড়ো। অনুসরণ আত্মহত্যার শামিল।’ এক্ষেত্রে আবুল মনসুর আহমদের দৃষ্টিভঙ্গি চোখে পড়ার মতো। প্রকৃত দেশপ্রেম কী, তাঁর লেখা না পড়ে উপলব্ধি করা অসম্ভব।

আবুল মনসুর আহমদ এ-যুগের এক গভীর চিন্তাবিদ হিসেবে ব্যঙ্গসাহিত্যকেই বেছে নিয়েছিলেন সব অনাচারের বিরুদ্ধে হাতিয়াররূপে। পশ্চাদমুখী জীবনবিমুখ দৃষ্টিকোণ দেখে তিনি প্রতিবাদ করেছেন লেখায়। বহুমুখী এ-প্রতিভার কারণে তিনি নানান জায়গার নানা মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন। দেখেছিলেন জীবনকে খুব কাছ থেকে। অমত্মঃসারশূন্য মুসলমান সমাজের পশ্চাৎমুখী দৃষ্টিকোণ, জনসেবার নামে দেশবাসীকে বঞ্চনার প্রচেষ্টা তিনি অতি গভীর ও নিবিড়ভাবে দেখতে ও বুঝতে পেরেছিলেন বলেই ব্যঙ্গসাহিত্যকে তাঁর দেশসেবার আদর্শ বাহন হিসেবে নিয়েছেন। রচনাগুলো আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা হাসির সৃষ্টি করলেও লেখকের মর্মভেদী কান্না, কখনো স্পষ্ট, কখনো প্রচ্ছন্ন থেকে পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। তিনি হেসেছেন, হাসিয়েছেন, কিন্তু হৃদয়-নিংড়ানো কান্নাও কেঁদেছেন প্রচুর। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার চরণের সঙ্গে-সঙ্গে অনুভূতির কিছুটা মিল তাঁর রচনায় দেখা যায়। ‘বাইরে যবে হাসির ছটা, ভিতরে থাকে আঁখির জল’।

সৃষ্টিশীলদের কলম বা তুলিতে সবসময় সময়ের করুণ চিত্র ফুটে ওঠে। শিল্পী জয়নুল আবেদিন তাঁর অমর স্কেচে এঁকেছেন দুর্ভিক্ষের চিত্র, কবি ফররুখ আহমদ তাঁর বিখ্যাত ‘লাশ’ কবিতায়, আবুল মনসুর আহমদ ব্যঙ্গ গল্পে-গল্পে। তাঁর প্রায় লেখায়, দুর্ভিক্ষের চিত্রের সঙ্গে দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ীদের চিত্র, মৃত মানবতা ও চেতনার চিত্র যথাযথ তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। তিনি কথা বলেছেন স্বদেশ চেতনায় সাহসী কণ্ঠে। বিষয়টা আর একটু পরিষ্কার করি, খন্দকার আবদুল হামিদের (স্পষ্টভাষী) ভাষায় – ‘আবুল মনসুর আহমদ সাহেব দশ বছর আগে যাহা বলিয়া বা লিখিয়া গিয়াছেন তাহাই আজ বর্ণে বর্ণে সত্য হইতেছে। বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া ভাবি, এত আগাম সত্য তিনি কী করিয়া বলিয়া গিয়েছেন। সত্য প্রকাশে তিনি ছিলেন অকুতোভয়। অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয়স্বার্থেও ক্ষমতাসীন মহলকে সাবধান করিতে তাহার ন্যায় মহান প্রতিভাধর প্রবীণ প্রাজ্ঞ ব্যক্তিকেও কখনো কখনো হুমকির সম্মুখীন হইতে হইয়াছে। কিন্তু তিনি সেসব হুমকির জবাব তাঁর অননুকরণীয় মিছরির ছুরিতে ও ভঙ্গিতে এমনিভাবে দিয়াছেন যাহার মোকাবেলায় ক্ষমতামত্তরাও স্তব্ধ হইয়া পরাভব মানিয়েছেন। এক কথায়, জাতির বিবেকের সদা জাগ্রত প্রহরী।’

আবুল মনসুর আহমদ বাংলা সাহিত্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর লেখায় সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক আবহকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে যে-নবচেতনায় উপস্থাপন করতে চেয়েছেন, তা থেকে এখনো মুক্ত হতে পারেনি চারপাশ। দেদার চলছে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি, পির-ফকিরের দৌরাত্ম্য, রাজনীতির নামে ভ-ামি ও প্রতারণা; কিন্তু কেউ যেন নেই! পরজীবীরা কু-লী পাকিয়ে বসে আছে আবাদমাধ্যমে। ধারাবাহিক সিরিজ দেখেই চলছেন দর্শক। যেন কিছুই করার নেই, সবাই পাথর। তাই সময়ের মোকাবেলা বা প্রতিধ্বনি তোলার জন্য আবুল মনসুর আহমদকে পুনরায় আলোচনা, মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ জরুরি। এ প্রসঙ্গে ড. নুরুল আমিন বলেন, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেও ঐতিহ্যিক বিভাজন রেখা নিয়ে আমরা অনেকেই একমত পোষণ করি না; কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বের প্রশ্নে আমরা নির্দ্বিধায় একমত। আবুল মনসুর আহমদ একসময় সচেতনভাবে সেসব কথা চিন্তা করেছেন এবং বাস্তবে তাঁর চিন্তার যথার্থ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। সময়ের অভিঘাতে তাঁর চিন্তার মূল্যায়ন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। মার্কিন জাতির মতো যতই দিন যাচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ ততই বেশি করে ‘বাঙালি ইমার্সন’ আবুল মনসুর আহমদকে জানবার চেষ্টা করছেন। তাঁকে নিয়ে কেউ কেউ পৃথক সমাজ-দর্শনের যুক্তিতে রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যের প্রচ্ছন্ন চেহারাও উন্মোচনেও সচেষ্ট হচ্ছেন।’

এমনি গুণী মানুষের লেখা ও জীবনচিন্তা আধুনিক সমাজে আজো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তাঁকে নিয়ে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন আছে। এর সঙ্গে তাঁর সাহিত্য-সৃষ্টির ব্যাপক পঠন ও আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। r