দুয়ারে প্রস্তত গাড়ি

আফসানা বেগম

জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে দেখলাম ভাড়া করা মাইক্রোবাসটা গেটের সামনে দাঁড়ানো। দোতলা থেকে গাড়ির ছাদটা পরিষ্কার দেখা গেল। দুটো-তিনটে স্যুটকেস সেখানে এঁটেই যাবে, বাকি আমরা দুজনসহ ভেতরে। বড় আসবাবগুলো ট্রাকে ভরে পাঠিয়ে দিচ্ছিলাম তিনদিন ধরে। রাস্তার মাথায় একটা ছোট্ট সাইনবোর্ডে লেখা, ‘ট্রাকে ট্রাকে মালামাল পাঠানো হয়’। যেমন বারবার ট্রাকের কথা লিখেছে, তেমনই বারবার এসে মালপত্র নিয়ে গেল। অবশ্য মায়ের শখের কিছু কাচের জিনিস, তার মধ্যে মায়ের বিয়েতে উপহার পাওয়া টি-সেট থেকে শুরু করে জগ পর্যন্ত আছে, সেসব পুরনো পেপার পেঁচিয়ে, তার ওপরে পুরনো হয়ে যাওয়া চাদর আর পর্দায় আরো কয়েকবার পেঁচিয়ে কাগজের বাক্সে রাখা হয়েছিল। বাক্সগুলো মাইক্রোবাসে কয়েক ট্রিপে চলে গেছে আমার আর মায়ের থাকার জন্য ছোট্ট ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে। এবারের ট্রিপটাই হবে শেষ ট্রিপ। আর আজ এটাই হবে এ-বাড়ি থেকে আমাদের শেষ যাওয়া।

তাড়া নেই; তবু যাওয়ার জন্য মাকে নির্দিষ্ট সময়ের কথা বলে রেখেছিলাম। বাড়িতে না খেলে মায়ের অস্বসিত্ম হয়। তাই দুপুরের খাবারটা এ-বাড়িতে খেয়ে নতুন বাড়িতে গিয়ে রাতের আয়োজন করা যাবে ভেবে বিকেল থাকতে-থাকতেই সেখানে পৌঁছনোর ইচ্ছে ছিল। জানালা থেকে সরে বাড়ির ভেতরের দিকের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। লম্বা-চওড়া টানা বারান্দা, পিলারগুলো ইয়া মোটা। ছোটকালে ওই পিলারকে জড়িয়ে ধরে এক হাত দিয়ে আরেক হাত ছোঁয়ার খুব চেষ্টা ছিল আমার। ধীরে-ধীরে একদিন বুঝতে পেরেছি, এখন কেন, পূর্ণবয়স্ক হাতের দৈর্ঘ্য নিয়েও কখনো ওই পিলারগুলোকে জড়িয়ে হাতে হাত ছুঁতে পারব না। অথচ ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে বেড়ে ওঠা অপরাজিতা কিংবা সন্ধ্যামালতি অনায়াসে জড়িয়ে ধরত একটার পরে একটা সাদা পিলার। বর্ষা কি বসন্ত গিয়ে গাছ মরে গেলে টেনেহিঁচড়ে শুকনো লতাগুলো সরিয়ে আনলেও পিলারের গায়ে ধুলোর প্রলেপের মতো এলোমেলো বাদামি দাগ পড়ে থাকত। ধীরে-ধীরে একদিন সেই দাগগুলো চোখসহা হয়ে যেত; হতেই হতো কারণ প্রতিবছর বাড়ি রং করার মতো বাড়তি পয়সা আমাদের হাতে থাকত না। তবে আমাদের ধবধবে সাদা বাড়িকে আমরা হয়তো কল্পনায় আগের মতোই দেখতাম, প্রতি ঋতুর ফেলে-যাওয়া দাগগুলো উপেক্ষা করে। আমাদের বাড়ির পাশে একইরকমের ব্রিটিশ আমলের নকশার আরেকটি দোতলা বাড়ি ছিল। এই পাড়ায়, এই র‌্যাংকিন স্ট্রিট দিয়ে যেতে-যেতে এদিকে তাকালে মানুষের মনে যমজের চিন্তা আসত নিশ্চয়। তবে এক হলেও বাড়িদুটো ঠিক একরকম থাকত না। পাশের বাড়িটা প্রতি বর্ষার পরে নতুন রঙে সেজেগুজে তরুণী হয়ে উঠত। রাতের অন্ধকারেও তার ঝিলিক চোখ এড়াত না। কখনো দেরি করে বাড়ি ফিরলে পাশাপাশি দুটো বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হতো, তরুণী যেন মিটিমিটি হাসি নিয়ে বৃদ্ধাকে অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে দেখছে। উত্তর দিকের সেই বাড়ি এখন আর নেই। তীব্র শব্দে একদিন সেখানে লাগাতার হাতুড়ি পড়ল, মাটির সঙ্গে তাকে মিশিয়ে দিয়ে তবেই বারোয়ারি অ্যাপার্টমেন্ট তোলা হলো। বাড়ির পেছনের দিকে ফলের বাগানের পাঁচিলের পরেও উঠেছে আরেক উঁচু ইমারত। আমাদের দৃষ্টিকে বন্দি করার তাগিদে যেন দুদিক থেকে দেয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে। একসময় পাশের তরুণী বাড়িটায় দোতলার খোলা ছাদের মতো অংশে বাড়ির লোকদের ধোয়া কাপড় মেলা হতো। দোতলার এ-বারান্দায় বসে আমি দিনের পর দিন একটি মেয়েকে কাপড় মেলতে আর শুকোলে তুলে নিয়ে যেতে দেখতাম। আগে সে বালতি থেকে কাপড় নিয়ে দুই হাত দিয়ে খুব করে চিপত। প্রতিটি কাপড় চিপে নিয়ে তারপর ঝাড়া শুরু করত। সামান্য বিরতিতে ঝাড়াঝাড়ির শব্দ আর নিজের চারদিকে রহস্যময় কুয়াশা তৈরি করে একে-একে সব মেলে দিত। দেখতে-দেখতে সে-বাড়ির সব কাপড় হয়তো আমার চেনা হয়ে গিয়েছিল, তাকালেই বুঝতাম, ও, আজ সেই নীল শাড়িটা। পরদিন আবার হলুদ কি সাদা, আপন মনে ভাবতাম, আজ কালো মোজা, কাল ছিল সাদা আর বাদামি। পরে অবশ্য মেয়েটি আর কাপড় হাতে নিয়ে চিপত না, ঝাড়তও না, এনেই মেলে দিত। কাপড় ধোয়ার মেশিন চলে এসেছিল বুঝি বাড়িতে। কোনোদিন ফোঁটা-ফোঁটা বৃষ্টিতে কারো চিৎকারে দৌড়ে এসে সে কাপড়গুলো উঠিয়ে নিত। দমকা বাতাসে মেলে রাখা শাড়ি তাকে পেঁচিয়ে ধরত। সে হাল ছাড়ত না, বৃষ্টির ফোঁটার ছোটবড়ো জলছাপমতো বলপ্রিন্ট হওয়া শাড়ি কোনোরকমে টেনে নিয়ে ভেতরের দিকে দিত ছুট। বছরের পর বছর পাশাপাশি থাকার পরেও ভাড়াটিয়া সেই পরিবারটির সঙ্গে আমাদের কোনো জানাশোনা হয়নি। তবে বারান্দায় বসে দীর্ঘদিন ধরে দেখতে-দেখতে এমন হয়েছিল যে, তাদের গতিবিধি বলে দিতে পারতাম। তারপর একদিন তাদের চলে যেতে হয়েছে; ভারী দেয়ালগুলো গুঁড়িয়ে সেখানে ছয়তলা বাড়ি উঠে গেছে। আজ বহুদিন হলো সেদিকে টানা দেয়াল, ছোট-ছোট ফোকরের মতো বাথরুমের জানালা প্রতি তলায়। কেউ কারো দক্ষিণ দিকের বাতাসের প্রবাহ এভাবে ঠেকিয়ে রাখতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। তবে আমার কী, আমার কেবল যতটুকু, তা হলো, বহুদিন হয়ে গেছে সেদিকে তাকিয়ে আমি ভাবি না, আজ শাড়ির রংটা কী? কিংবা মোজার?

প্রায়ই আঙুল দিয়ে বারান্দার পিলারের গায়ে শুকনো লতার ফেলে যাওয়া আঁকাবাঁকা বাদামি দাগগুলো আমি অনুসরণ করতাম। তখনো বারান্দায় পিলারের পাশে দাঁড়িয়ে তাই করছিলাম। সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো বিসত্মৃত উঠোনটার দিকে চোখ গেল তখন। বাড়ির ছায়াটা উঠোনের প্রথম অর্ধেক দখল করে নিয়েছে। ছায়াটা আরেকটু এগোলেই শুকনো কুয়োতলাকে ছুঁয়ে দেবে। আর ঘড়িতে তখন বাজবে মোটামুটি সাড়ে চারটা। এই জানাটা আমার বহুদিনের গবেষণার ফল। শীতকাল এলে গবেষণাটা স্থগিত থাকত। কারণ সূর্যের সঙ্গে দৌড়ে পারতাম না। আমি দেখার আগেই কখন যেন আমাদের কুয়োতলা, উঠোনের মাঝবরাবর পাঁচিলঘেঁষা বিচ্ছিন্ন রান্নাঘর, রান্নাঘরের ঢালু ছাদের ওপরের শিম কিংবা লাউয়ের লকলকে ডগা, সিমেন্ট-বাঁধানো উঠোন আর সেই উঠোনের মাঝখানে সিমেন্টের উঁচু টবে ছড়ানো তুলসীগাছ, কাশি হলে লাল চায়ে দু-চারটা পাতা ছেড়ে দিয়ে চুমুক দেওয়া ছাড়া আমাদের জীবনে যার অন্য কোনো মাহাত্ম্য ছিল না, আমাদের লম্বা টানা বারান্দার ধবধবে সাদা পিলার, লোহার কারুকার্যময় কালো রেলিং, চকচকে লাল সিমেন্টের তেলতেলে মেঝে, সমস্ত কিছু অন্ধকারের গর্ভে চলে যেত। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবলাম, একটু পরে সত্যি তাই যাবে, নতুন বাড়িতে পৌঁছে জিনিসপত্র সাজানোর যথেষ্ট সময় পাব না, তাই যাওয়া দরকার। কিন্তু যে-বিষয়টা নিয়ে কোথাও যাওয়ার মুখে সারাজীবন ভুগেছি, একেক সময়ে রাগ হতো, বিরক্তি নিয়েই দিনের পর দিন বাড়ি থেকে বেরোতে হতো, সেই ঘটনাটা দেখতে পাচ্ছি না কেন? মা তবে কোথায়?

উঠোনের আনাচেকানাচে, রান্নাঘর পেরিয়ে ফলফলারির গাছগাছালির পায়ের কাছের শ্যাওলাধরা জায়গাগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিলাম। মা কোথাও নেই। এই সময়ে মায়ের আমাকে তাগাদা দেওয়ার কথা। অথচ নিশ্চুপ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে খানিকটা খটকা লাগল। কোথাও যাব বললেই মা আধাঘণ্টা আগে তৈরি হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাঁকডাক শুরু করে দেন। আর সত্যিই যদি সেই সময়ে আমি যাওয়ার জন্য প্রস্ত্তত না হই তবে দেরি হয়ে যাবে ভাবতে-ভাবতে শীতকালেও মায়ের ঘাম ছুটবে। তারপর তার মাথা ঘুরবে, বমিবমি লাগবে। তার কথামতো সময়ে লাফিয়ে বেরিয়ে যেতে পারলেই আর কোনো সমস্যা নেই। তাই আমাকেও আগেভাগে তৈরি হতে হয়, সে ডাক্তারের কাছেই হোক, হোক না বাজার বা কোনো আত্মীয়ের বাসা, এমনকি যেখানে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই, সেখানেও। কিন্তু সেদিন কেন জানি না, বেরোনোর সময় পেরোলেও স্তব্ধ বাড়িটায় মায়ের অসিত্মত্ব জানান দেওয়ার মতো কিছু দেখতে পেলাম না। দোতলায় সারিবাঁধা চারটা ঘর খাঁ-খাঁ করছে। পর্দাগুলো খুলে নেওয়ায় দাবার ছকের মতো সাদাকালো মেঝেতে পশ্চিম থেকে আসা রোদের ঝলকে কোনো-কোনো বর্গক্ষেত্র ঝলসে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকলে সাদা বর্গক্ষেত্রগুলো চোখ ধাঁধিয়ে দিলো। মা প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থেকে বিসত্মৃত মেঝেগুলো মুছিয়ে নিতেন, মুছতে-মুছতে সাদা বর্গক্ষেত্রগুলো আয়না হয়ে যেত, তাকালেই শরীর-মুখ।

মা হয়তো নিচতলায়। সিঁড়ির দিকে এগোতে গিয়ে বারান্দার লাল মেঝে মাড়িয়ে যাচ্ছিলাম। পেছনে তাকিয়ে মনে হলো, আর কি ওপরে আসব? প্রয়োজন নেই হয়তো। নিচ থেকে মাকে নিয়েই রওনা দেব। সিঁড়ির মুখে তাই থমকে দাঁড়িয়ে থাকলাম কয়েক মুহূর্ত। সিঁড়ির দেয়ালটায় নোনা ধরেছে অনেক বছর। পস্নাস্টার খসে পড়েছে এখানে-ওখানে। আর সেসব জায়গায় বর্ষাকালে শ্যাওলা জন্মে কার্পেটের মতো হয়ে যায়। অদ্ভুত এক শিল্প মনে হয় তখন আমার কাছে ওই দেয়ালটাকে; যেন দেয়ালজুড়ে বিভিন্ন দেশের ম্যাপ, সবুজে সবুজ! সেই শ্যাওলা-সবুজ কার্পেটের নরম শরীরে মাঝে-মাঝে আমি হাত বুলিয়ে নিতাম। সেদিন তেমন কার্পেট ছিল না, তবু হাত রাখলাম। শুনেছি বাবাকে ওপরতলার শোবার ঘর থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময়ে তিনি এই দেয়াল আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছিলেন আর তার হাত কেবলই পিছলে যাচ্ছিল মসৃণ দেয়ালে। প্রায় ঊনত্রিশ বছর পরে দেয়ালের গায়ে আমি বাবার সেই স্পর্শটা খুঁজছিলাম। কেমন একটা আফসোস হলো, এ-বাড়িতেই ছিলাম এতটা কাল, অথচ আগে কেন এখানটা এভাবে স্পর্শ করিনি আমি! বাবা হারিয়ে গেছে সেই কবে, বাবার গল্পই আমার কাছে চিরকাল, অথচ সেদিন যেন মনে হলো হঠাৎ করে বাবার স্পর্শটা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। চোখে পানি চলে এলো। বাবা হারিয়ে যাওয়ায় আমার জীবনে পিতার কোনো ভূমিকা ছিল না। তবে ছিলেন দাদু। যতবার তার বলে যাওয়া গল্পে বাবার চরিত্রটা সামনে আসত, তারও চোখ ভিজে যেত। শীতের সকালে লাল বারান্দায় রোদের ছোঁয়া লাগলে তিনি আমাকে কোলে নিয়ে চৌকির ওপরে বসতেন। যেহেতু একই গল্প বহুবার বলা হয়েছে, শুনে-শুনে মুখস্থও হয়ে গেছে, সে-কারণেই হয়তো তিনি গল্প শুরু করতেন মাঝখান থেকে; এই যেমন, কোনোদিন হয়তো বললেন, ‘বুঝলি রে, দাদাভাই, আমি পাশের ঘরেই ছিলাম, দৌড়ে এসে বললাম, তোমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমার ছেলেকে? ওরা কিছু বলল না। যখন আমি তোর বাবাকে টেনে ধরলাম, তারাও আরেকদিক থেকে টানা শুরু করল। অতজনের সঙ্গে পারলাম না রে। তবু চিৎকার করতে লাগলাম, কেন নিয়ে যাচ্ছ? কী করেছে ও? আমার চেঁচামেচিতে একজন উত্তর দিলো, বলল, ক্যালা, লইতেছি তো কী হইছে? এট্টু এইটা-ওইটা জিগাইমু আর কী। আমগো কইছে, আমরা লয়া যাইতেছি, হইছে? বাতচিত শ্যাষ হইলেই বাড়িত দিয়া যামু, অত চিন্তার কিছু নাইক্কা।’ এরপর দাদু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতেন। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হাতের উলটোপিঠে চোখ মুছে নিতেন। তারপর হতাশার গহিন থেকে খানিকটা অন্যরকম কণ্ঠস্বরে বলতেন, ‘আমরা দিনের পর দিন অপেক্ষা করলাম, এই বুঝি জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হবে। রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন পাক আর্মি চলে যাওয়ার পরপরই এখানে-ওখানে লাশ পড়ে থাকার খবর পেতাম। আমি দেখতে যেতাম, আমার ছেলের মুখ না দেখতে পেয়ে খুশিমনে বাড়ি ফিরতাম। আশেপাশের কত মানুষ তখন গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে, কেউ চলে গেছে কলকাতায়। আমরা কোথাও যাওয়ার কথা ভাবিনি, আমরা ভাবিইনি বাড়ি থেকে আমার তরতাজা ছেলেটাকে ওরা এইভাবে…।’

সেদিন মাকে নিয়ে কুমিল্লায় তার বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল বাবার। একে তো যুদ্ধের ডামাডোল, তার ওপর মায়ের পেটের মধ্যে আমি। বাবার বাড়িতে তাকে রেখে আসাটাই বাবা আর দাদুর কাছে সহজ মনে হয়েছিল। মা তার ভাইয়ের সঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছিলেন আগেই। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে বাবার কোনো কারণে দেরি হচ্ছিল, ওই সামান্য দেরিই কাল হলো তার। মা তো ট্রেনে উঠে গেলেন আর বাবাকে চলে যেতে হলো অজানার উদ্দেশে। বাবার লাশ যখন আরো অনেক লাশের সঙ্গে একটা জলা জায়গায় পড়ে থাকতে দেখা গেল, দাদু খবর পেলেন। প্রতিবার এখানে-ওখানে লাশ দেখতে যাওয়ার মতো সেদিনও দুরুদুরু বুকে তিনি সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। তবে মনে বিশ্বাস ছিল যে, প্রতিবারের মতোই দেখবেন অন্য মুখ। কিন্তু না, সেদিন হন্যে হয়ে খুঁজে ফেরা মুখটি উপস্থিত ছিল সেখানে, গাদাগাদি করে রাখা প্রায় উলঙ্গ শরীরগুলোর মধ্যেই মিলে গেল ছেলের লাশ। ছেলের মৃত্যুর কথা ভুলে গিয়ে তিনি বারবার উপস্থিত সবার কাছে একটাই প্রশ্ন করছিলেন, ‘আচ্ছা, মেরেই যদি ফেলবে, তবে তার আগে এত অত্যাচার করেছে কেন?’ তখন সেখানে মানুষজন দাদুর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল কি-না জানি না, কিন্তু গল্পের এই জায়গায় এসে তিনি বরাবর উন্মত্তের মতো বলতে থাকতেন, ‘আমার ছেলের থেঁতলানো আঙুল, আমার ছেলের পায়ের হাড়টা ভাঙা, একটা চোখ প্রায় বেরিয়ে এসেছে, ঘাড়ের মাংসপেশি উপড়ানো… কী দরকার ছিল, দাদাভাই, বল তো? গুলি করেই যখন মারবি, তখন কেন এত নির্যাতন?’

লাল বারান্দার একমাত্র আসবাব, দাদুর চৌকিটার দিকে আমি অপলক তাকিয়ে থাকলাম। পুরনো হতে-হতে চকোলেটের মতো রং ধরেছে। ওটা আমরা সঙ্গে নিচ্ছি না। আমাদের নতুন ছোট্ট বাসায় এত জিনিসের জায়গা হবে না। তাই যা কিছু খুব দরকারি নয় তা আমরা অনায়াসে ফেলে চলে যাব। ফেলে যাব তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সমস্ত দৃশ্য। এই যেমন এখনো তাকালে দেখা যায়, দাদুর মৃত্যুর পরে ওই চৌকিতেই তার মৃতদেহটা শোয়ানো ছিল। পাড়ার বয়সী লোকজন চৌকিটা ঘিরে দাঁড়িয়েছিলেন। অনেক সাদা পাঞ্জাবি, বিচিত্র রঙের পাথরের তসবি হাতের মুঠোয় ঝুলে-ঝুলে এগিয়ে যাচ্ছিল, হাহাকারে চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল, ‘আহা, বড়ো ভালো লোক ছিলেন!’ ‘সেই সাতচলিস্নশ থেকে চিনি তাকে, একসঙ্গেই তো এলাম এপারে। পুত্রের মৃত্যুশোক সহ্য করতে হয়েছিল বেচারাকে।’ সেই সমস্ত টুকরো-টুকরো কথা কানের পাশে বৃত্তাকারে ঘুরতে-ঘুরতে আমার নাকে যেন আগরবাতির গন্ধের ঘোর লাগল। নেশার মতো সেই গন্ধে আমার মাথা ঘুরে উঠছিল দাদুর মৃত্যুর দিনে। ছোট্টবেলার মতো মায়ের আঁচল ধরে বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘এই গন্ধ আমার ভালো লাগে না, মা, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে…।’ বলিনি আমি, কেবল মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। বললেও মা হয়তো আমার কথা শুনতে পেতেন না। বজ্রাহতের মতো দাদুর পায়ের কাছে চৌকির কোণটাতে হাত রেখে মেঝেতে বসে ছিলেন তিনি। মায়ের চোখে কোনো ভাষা ছিল না। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়ানোতে তিনি নির্বিকারভাবে একবার আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। মনে হচ্ছিল মা যেন আমাকে চেনেন না। শব্দহীন অশ্রম্ন গড়াচ্ছিল তার গাল হয়ে গলায়। আমি জানি না বাবার অন্তর্ধানের সময়ে মায়ের মুখ কেমন হয়েছিল, হয়তো এমনই অথবা হয়তো এতটা করুণ নয়। কারণ মা তো বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা জানতেই পারেননি। উৎকণ্ঠায় ছিলেন নিশ্চয়, ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, মানুষটা পৌঁছেনি। শুধু-শুধু অনেক ঢিলেমি করতে পারে লোকটা, এই ভেবে বিরক্তও হয়েছিলেন হয়তো। বাবার লাশ পাওয়ার খবর যখন চিঠিতে মায়ের কাছে পৌঁছেছে, দেশ তখন স্বাধীন। তাই খবরটা যাওয়ার পরে কেউ মাকে ঠেকাতে পারেনি; মায়ের বাড়িতে সন্তান জন্মানোর ইচ্ছেই উবে গিয়েছিল তার। আমাকে আট মাসের পেটে নিয়ে মা দাদুর কাছে ফিরে এসেছিলেন। বাড়ির সামনের শান-বাঁধানো সিঁড়ির কাছাকাছি দাদুকে পেয়ে সেখানেই বিশাল পেট নিয়ে মা লুটিয়ে পড়েছিলেন। দাদুর পা জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘ও সেদিন কেন এত দেরি করল, বাবা? বাড়ি থেকে আরেকটু আগে বেরিয়ে গেলে কী হতো? আগে-আগে বেরোলেই তো আজ ও বেঁচে থাকত, বাবা!’

তারপর থেকে মা এ-বাড়িতে দাদুর সঙ্গে থেকে গেলেন। মা ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই জন্ম হলো আমার, এ-বাড়িতেই। মায়ের অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে স্বাভাবিক সময়ের বেশ কিছু আগেই আমি তার কোলে চলে এলাম। সবকিছু ঠিকই ছিল কিন্তু যে-কোনো জায়গায় বেরোনোর অন্তত আধাঘণ্টা আগে বাড়ির বাইরে গিয়ে পায়চারি করার রোগে পেয়ে বসল মাকে। ছোটকালে সময়জ্ঞান ছিল না, তাই তখন মা বললেই লাফিয়ে বেরিয়েছি আর মায়ের অস্থিরতার মানেও বুঝিনি। কিন্তু একটু বড় হলাম, হাতে কালো রঙের ডিজিটাল ক্যাসিও ঘড়ি উঠল, ঘড়ি দেখে মাকে অস্থির হতে মানা করতাম। আর তাতে জুটত ধমক। হয়তো একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে যাব আমরা, সাধারণ ব্যাপার, কার্ডে লেখা থাকবে সন্ধ্যা সাতটা। কিন্তু আসলে কি সন্ধ্যা সাতটায় কেউ বিয়েবাড়ি যায়? যারা দাওয়াত দেয় তারাও হেলেদুলে আটটার দিকে আসতে থাকে, আর তখন কিনা দেরি করে দাওয়াতে যাওয়া, দেরি করে খাওয়াটাই দিনদিন ফ্যাশনে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু মাকে কে বোঝাবে সেসব কথা? সেরকম অনুষ্ঠানে বরাবর আমি আর মা গিয়ে বসে-বসে ডেকোরেটরদের শেষ মুহূর্তের সাজগোজ আর লাইটিংয়ের কাজ সারতে দেখতাম। আর আমরা যাওয়ার এক-দেড় ঘণ্টা পরে একে-একে লোকজনের আসা শুরু হতো। একইভাবে বাসস্ট্যান্ডে, স্টেশনে, ডাক্তারখানায়, সবখানে এক-দেড় ঘণ্টা বসে থাকা আমার কপালে লেখা হয়ে গেল। সবচেয়ে রাগ হতো স্কুলে গিয়ে বসে থাকতে। দফতরিদের সঙ্গে গল্প আর ক্লাসরুমে আগের দিনের ধুলো ঝাড়া দেখা ছাড়া কিছু করার থাকত না। তবে হ্যাঁ, কলেজে ওঠা নাগাদ বুদ্ধিমান হয়ে গেলাম, বাড়তি সময়টুকু রাস্তায় আড্ডা মেরে যাওয়া যায়, শুধু মায়ের চাওয়ামতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই হলো। কেবল তাড়াতাড়ি বেরোনো না, মায়ের আরো অনেক নিষেধাজ্ঞা ছিল আমার ওপর। বাবাকে যারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল তারা বন্ধু পরিচয়ে বাড়িতে ঢোকে, দলের মধ্যে বাবার একজন পাড়াতো বন্ধুও ছিল বটে। আর সে-কারণে আমি কলেজ পেরিয়ে গেলেও আমার কোনো বন্ধু বাড়িতে এলে মা আতঙ্কিত হয়ে যেতেন। যে আসত মায়ের আচরণে সে বুঝত যে, হুট করে এসে পড়ে কিছু একটা ঝামেলা বাধিয়ে ফেলেছে। দিনের পর দিন বিব্রত হতে হতো আমাকে। স্কুলে থাকতে বন্ধুরা আসতে চাইলে আমি নানান কথা দিয়ে কাটানোর চেষ্টা করতাম। তাই আমার দিন কাটত পেছনের ফলের বাগানে, পেয়ারাগাছের কোনো ডাল থেকে আমার একটা পা ঝুলে থাকত, মা রান্নাঘর থেকে সেই পায়ের দিকে নজর রাখতেন। তা না হলে আমার দুপুর থেকে ঢলে যাওয়া বিকেলগুলো কাটত ছাদে, ঘুড়ি ওড়ানোর ব্যস্ততায় কিংবা হা করে আকাশের একদিক থেকে আরেকদিকে মেঘের ছুটে যাওয়া দেখায়। কখনো কুয়াশায় ঘিরে আসত চারপাশটা, উঁচু বিল্ডিং ছিল না আশেপাশে, মনে হতো শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া, চারদিক থেকে সব যেন আমাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে। আমি ভয়ে ছোট্ট হয়ে যেতাম, শীতে কুঁকড়ে যেতাম, লাটাই ফেলে ‘মা মা’ ডেকে লম্বা সিঁড়ি বেয়ে দুমদাম নেমে আসতাম, ডাক শুনে মা দৌড়ে এসে এই সিঁড়িতেই আমাকে জাপটে ধরতেন। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, এই হিমের মধ্যেও মায়ের শরীর সবসময় এমন গরম কেন? কেন জড়িয়ে ধরলেই ঘুম এসে যায়!

ঠাটারীবাজারে দোকানের ব্যবসা আর আমি, এই নিয়েই ছিল দাদুর পৃথিবী। ওপরতলার লাল বারান্দার চৌকিতে বসে দাদু কেবল গল্পই বলতেন না, কখনো হাঁক দিয়ে উঠতেন, ‘হারমোনিয়াম আর তবলাটা নিয়ে আয় দেখি -।’ ভীষণ অনিচ্ছায় আমি ধীরে-ধীরে এগোতাম, মায়ের হাতে করা হাতি-ঘোড়া প্যাটার্নের নকশিকাঁথার ঢাকনা সরিয়ে রংচটা প্রাচীন হারমোনিয়ামটা বের করে আনতাম। হারমোনিয়ামের ওপরের কাচটা আমার হাতের চাপে কবে যেন আড়াআড়ি ফেটে গিয়েছিল, আর কখনো তা বদলানো হয়নি। গানও হয়নি আমার। হবে যে না, মা তা জানতেন কিন্তু দাদুর অবুঝ মন, তবলায় তেহাই দিয়ে দাদু বলে উঠতেন, ‘শোনো বন্ধু শোনো, প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা, ধর তো দেখি -’ আমি চরম অনীহা নিয়ে যন্ত্রের মতো আদেশ পালনের দায়ে গানটা শেষ করলে দাদু উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন, ‘শোন, তোর গলাটা না বড় হলে হবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো। শুধু সামান্য ঘষামাজা, সে আমি করে নেবোখন।’ মনে-মনে ভাবতাম, আমি সে-সুযোগ দিলে তো! আমি কোনোদিন দাদুকে বলিনি যে, আমার গানে মন নেই, ভালো লাগে না এসব আমার। বলা না বলার দ্বিধায় দিনগুলো কেটে যেত। আবার সন্ধ্যা নামত আর দাদু বলতেন, ‘কই রে, স্বাধীন, হারমোনিয়ামটা নিয়ে আয় দেখি। আর শোন, তবলার সাথে ড্রয়ার থেকে বোরিক পাউডার আর স্টিলের হাতুড়িটা আনিস।’

গানে আমার পরেও আর মন লাগেনি। কিন্তু এই সিঁড়িটার এই মাথায় দাঁড়ালে পাশের বাড়ির একটি মেয়েকে গলা সাধতে শুনতাম। গলা সাধার সেশনের পরে প্রায়ই সে ‘চলে যায় মরি হায় বসন্তের দিন…’ গাইতে থাকত। কি বর্ষা কি বসন্ত, তার ‘চলে যায় মরি হায় বসন্তের দিন’ গান আর ফুরাত না। সিঁড়ির রেলিংয়ে থুঁতনিটা ঠেকিয়ে আমি মন খারাপ করে শুনতে থাকতাম। সেই একবারই গান আমাকে ঘায়েল করেছিল হয়তো। কী চলে যায়, কেন চলে যায়, আমার জানা ছিল না বা বোঝা হয়নি। শুধু একরকমের চরম বিচ্ছেদ-রাগিণী যেন সমস্ত পৃথিবীটা ভরে দিত সেই সুরের সঙ্গে-সঙ্গে। সবকিছু বিবর্ণ লাগত। কী যেন নেই, কী যেন হারিয়ে যাচ্ছে, এই ভাবনা আমার চিন্তায়-চেতনায় ভর করত। ফিরে না পাওয়ার কল্পিত কষ্টে আমি শক্ত করে রেলিংটা চেপে ধরতাম আমার মাঝারি আকৃতির মুঠিতে।

আজকের প্রমাণ আকৃতির মুঠি দিয়ে সেই একই রেলিংটাকে চেপে শেষ পর্যন্ত নিচেই নেমে এলাম। ওপরের বারান্দার ঠিক নিচে একই রকমের আরেকটা বারান্দা। এখানে দাদুর ইজিচেয়ার। চেয়ারটা একটু বেশিই লম্বা। দাদু ছিলেন ইয়া লম্বা হোমরা-চোমরা মানুষ। এত লম্বা চেয়ারের জায়গা আমাদের ওই ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে হবে না। এই চেয়ারের চওড়া হাতলে সকালের চায়ের মগটা
থাকত। মা মগটা সেখানে রেখে নিজের কাপ নিয়ে উঠোনের দিকে ঢলে-পড়া সিঁড়িতে বসতেন, বারান্দার বাকি চেয়ারটাকে উপেক্ষা করে। দাদু আসতেন পেপার হাতে নিয়ে। তারপর ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে হেডলাইন ধরে শুরু করতেন বরাবর, ‘বুঝলে, বউমা, ফজলে লোহানী মরে গেল।’ তখন নভেম্বর আসতে না আসতেই শীত-শীত আবহাওয়া। মা গায়ের হালকা কাশ্মিরি শাল টেনে নিয়ে ধোঁয়া-ওঠা চা থেকে মুখ সরিয়ে বললেন, ‘সে কী, বাবা! আমরা কি আর যদি কিছু মনে না করেন দেখব না?’

‘তা কী করে দেখবে বউমা, লোকটা যে নেই! কিন্তু এ তো ভারি অন্যায় যে, এত অল্প বয়সে একটা গুণী লোক টুপ করে মরে গেল, তুমি কোথায় তার পরিবারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করবে, তা না নিজের সমস্যা নিয়ে আছ।’

‘সত্যি, বাবা, আমার খুব অন্যায় হয়ে গেছে। তা, এর মধ্যে যদি কিছু মনে না করেন চালিয়ে নেওয়ার মত কেউ তৈরি হলো কি?’

‘আবার ওই কথাই, বউমা? আরে ওই যে আছে না, সংকেত না কি যেন নাম? তবে লোহানীর মতো আর হবে না, বুঝলে? কিছু মনে করেন আর না করেনের মাঝখানে একটা যদি রেখে সে সমানে সবাইকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল। এ কি চাট্টিখানি কথা? আহা, আর দেখা হবে না!’

‘দেখলেন, বাবা? আপনিও কিন্তু কেবল নিজেরই কথা…।’

মায়ের আর দাদুর বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ শুনে-শুনে আমার সকাল হতো। সকালগুলো এই বারান্দায় আঁকা আছে। মোটামুটি একই রকমের ছবি, একটু এদিক-সেদিক। কোনো-কোনোদিন তাদের আলাপে যে ঝাঁঝ থাকত না, তা নয়। সেবার আমার খুব জ্বর হলো। দাদুর ডাক্তারবন্ধু ছোট-ছোট শিশি ভরে চিনির দানা দিয়ে জ্বর কমাতে পারলেন না। শেষে অসহায়ের মতো দাদুকে বললেন, ‘আমার বিদ্যা শেষ, তুমি বরং ওয়ারীর নামকরা ডাক্তার ফজলুল সাহেবের কাছে নিয়ে যাও ওকে।’ দাদু চুপচাপ মাথা নাড়লেন। তবে ডাক্তার নিজের মাথার টাকে হাত বোলাতে-বোলাতে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে মা ছুটে এলেন, ‘পাঁচদিন ধরে জ্বরে ভুগিয়ে তারপর কিনা উনি জবাব দিচ্ছেন, বাবা? এতদিন পরে তার মনে হলো যে ফজলুল ডাক্তার নামকরা?’

‘আরে বাবা বেচারা চেষ্টা তো করেছে, প্রতিদিন দু’বেলা এসে…’

‘আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম বাবা, চিনির দানা দিয়ে এই উথালপাতাল জ্বর ভালো হবে না। কিন্তু আপনি শুনলেন না।’

‘শোনো, বউমা, হোমিওপ্যাথি হলো গিয়ে সব চিকিৎসার বাপ।’

‘বাপকে দিয়ে যে চলছে না, সে তো বুঝতেই পারছেন, এবারে চলুন ছেলের কাছে নিয়ে যাই।’

‘সে ঠিক আছে, কিন্তু দুদিন পরপর যে এরকম জ্বর আসছে, এরকম জটিল ব্যাপার তো আমার ধারণা হোমিওপ্যাথিতেই সেরে উঠত -’

‘বাবা, আপনার বন্ধু বড় হোমিওপ্যাথ ডাক্তার, তিনি জবাব দিয়ে চলে গেছেন। আর আপনি এখনো এই ভাবনা নিয়েই পড়ে থাকবেন? ছেলেটা ক্রনিক জ্বরে মরে যাবে যে!’

‘সেই তো, আমাদের বংশে তো কারো এরকম বারে-বারে জ্বর আসার ব্যারাম দেখিনি!’

‘তবে কি আপনি বলতে চাইছেন এই ব্যারাম আমার বংশ থেকে এলো? আমার কোনোদিন জ্বর হতে দেখেছেন, বাবা?’

ঘরে শুয়ে উহ্-আহ্ করতে-করতে আমার বোঝার বাকি থাকেনি যে এবারে চিনির দানার মজা শেষ। বোতলে-বোতলে সিরাপ আসবে। আমি ফন্দি আঁটলাম কখন সেই সিরাপ কীসে জমিয়ে রাখব আর সুযোগ বুঝে ফলের বাগানের দিকে কখন রওনা দেব সেটা ফেলতে। বাগান ছাড়া আমাদের এই বাড়িতে মাটি নেই। তবে সুযোগ বুঝে সিমেন্টের উঠোনের শেষ প্রান্তে কোনোরকমে পৌঁছেই ঢেলে দিলাম অমৃতের বাটি উপুড় করে। কিন্তু মা যে কী, যখন মা নেই তখনো সঙ্গে থাকতেন। মাটিতে শুষে নেওয়ার পরও লালচে দাগ দেখে মা উপুড় হয়ে মাটিটা শুঁকলেন। আর তারপর ঠিকই ধরে ফেললেন রক্তবর্ণের দুর্গন্ধময় সিরাপ ফেলার ঘটনা। রাগে চোখ বড় করে বারান্দার দিকে ফিরতেই দাদুর ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকা আমার সঙ্গে চোখাচোখি। শরীরে অত তেজও নেই যে, প্রায় শোয়া অবস্থা থেকে উঠে দৌড় লাগাব। হাতেনাতে ধরা পড়ার পরে মায়ের কবল থেকে দাদুই রক্ষা করলেন, আমতা-আমতা করে বললেন, ‘আসলে এ তো দেখছি ওষুধই খায় না! তোমার বংশে ক্রনিক জ্বরের দোষ নেই, বউমা, এটুকু নিশ্চিত হওয়া গেল।’

মা হয়তো রাগে কথা হারিয়ে ফেলতেন দাদুর এই সমস্ত উপসংহারের পর। দাদুই বাকিটুকু যোগ করতেন, ‘এখন থেকে এর বিষয়টা আমিই দেখব।’

দাদু সত্যিই দেখতেন আমাকে। রাত-বিরাতে বারবার উঠে আমার গায়ে কম্বল টেনে দিতেন। সবসময় কাছে-কাছে থাকতেন। শনিবারে সন্ধ্যার পরে বসার ঘরে দাদুর বন্ধুবান্ধবরা আসত। রাত প্রায় বারোটা পর্যন্ত চলত তবলা, সারেঙ্গি আর হারমোনিয়ামের বাজনার সঙ্গে দাদুর দরাজ গলার গান। জ্বর এলে আমাকে কম্বল দিয়ে পোঁটলা করে কোলে বসিয়েই দাদু গান গাইতে থাকতেন। অসুস্থ আমার হাতেই হয়তো মন্দিরা ধরিয়ে দিতেন দাদু। কীর্তনের সঙ্গে তাল ধরে-ধরে আমি টুংটাং বাজিয়ে চলতাম। নিচতলার বারান্দার শেষ প্রান্তে বসার ঘর। সেদিকে তাকাতেই আমি যেন মন্দিরার শব্দ শুনতে পেলাম। আর দরজায় দাঁড়াতেই দাদুর কণ্ঠস্বর, ‘তোমার সুরের ধারা ঝরে যেথায় তারি পারে, দেবে কি গো বাসা আমায় একটি ধারে’… মন্দিরা বাজছে, তবলা বাজছে, দাদুর গলায় সুর ছলকে উঠছে, জমজমাট পরিবেশ আমার চারদিকে ছেয়ে গেল। ওই তো ওখানে, ওখানে সিল্কের কাপড়ে ঢাকা ডিভানের ওপরে হারমোনিয়াম বাজছে… আমি ছুটে গিয়ে ওই ঘরে ঢুকলাম। কিছুই নেই সেখানে। দাবার ছকের মতো সাদাকালো মেঝে এ-মাথা ও-মাথা ঝকঝক করছে। ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া বসার চেয়ারগুলোর চারটা করে পা আর বইয়ের শেলফের লম্বা-লম্বা হলদে দাগ পড়ে আছে কেবল জায়গায়-জায়গায়। মাথার ভেতরে দাদুর কণ্ঠস্বর আর আসরের হইহল্লা হুট করে বন্ধ হয়ে গেল। আর সঙ্গে-সঙ্গেই আগের সব মধুময় স্মৃতি হারিয়ে এই কদিন আগে ওই ঘরে ঘটে যাওয়া বিশ্রী ঘটনাটা সামনে এলো কেবল; গম্ভীর একটি গলা বলছে, ‘টাকা আমরা সঙ্গে এনেছি। সই করে নিয়ে নিন। নইলে রাস্তাঘাটের যা অবস্থা, কিচ্ছু বলা যায় না বাড়ি থেকে বেরোলে কী না কী হয়ে যায়!’

বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাদের সংসারে হু-হু বাতাস লেগে  থাকত। আর দাদুর অবর্তমানে যেন নিশ্বাস নেওয়ারও বাতাস রইল না। আমি আর মা স্তব্ধ হয়ে থাকলাম দিনকয়েক। কিন্তু কত আর পারা যায়, মা গেলেন দোকানের হিসাব-নিকাশ দেখতে। চিরকাল ঘরে থাকা মাকে একটুও বেমানান লাগল না কেন যেন। মা এমনভাবে শুরু করলেন যেন এই কাজের মধ্যেই ছিলেন তিনি। তবে ওই, তার বদৌলতে দোকানের কর্মচারীদের ঘণ্টাখানেক আগে আগে আসতে হতো। নাহলে তিনি গিয়ে নিজহাতে দোকানের তালা খুলতেন। দিনের পর দিন এই ব্যাপার ঘটতে থাকলে কর্মচারীরা নিশ্চয় লজ্জা পেয়েছিল। যেদিন যাওয়ার দরকার নেই, সেদিনও মা তাড়াহুড়ো করে দোকানের জন্য বেরিয়ে যেতেন। তবে বাড়িটাকে প্রাণময় করে রাখা দাদুর অনুপস্থিতি ছাড়া সব মিলিয়ে আগে বা পরেও আমরা ভালোই ছিলাম, আমাদের উপদ্রবহীন জীবনে ওই উটকো লোকগুলো যখন-তখন হানা দেওয়ার ব্যাপারটা ছাড়া।

তারা প্রথম এসেছিল দাদু বেঁচে থাকতেই। এই বসার ঘরেই দাদু তাদের সমাদর করে বসিয়েছিলেন। তিনজন মানুষ, হালকা গরমেও স্যুট-টাই পরা। তবে কথা বলছিলেন একজনই। দাদু জানতে চেয়েছিলেন, ‘কী ব্যাপার বলুন তো, মানে, আমার কাছে কোনো দরকার?’

‘জি আপনার কাছেই। তবে দরকার আপনারও।’

‘আমারও? আশ্চর্য, আমার তো জানা নেই!’

‘বললে বুঝতে পারবেন। আপনার এখানে তো জায়গা প্রায় দেড় বিঘা, না?’

‘এই বাড়ি? দেড় বিঘার সামান্য কম। কিন্তু কেন?’

‘দারুণ জায়গা আপনার। পশ্চিমে রাস্তা আর দক্ষিণ দিকে মাঠ। ওদিকটা তো সরকারি, তাই চিরকাল এ বাড়ির দক্ষিণ দিক খোলাই থাকবে মনে হয়। এর চেয়ে ভালো জায়গা এ-অঞ্চলে আর হতে পারে না।’

‘তাতে কী হয়েছে?’

‘ডেভেলপ করুন। নিজেই নিজের বাড়ি চিনতে পারবেন না এমন এলিভেশন করে দেব। আর্কিটেক্ট হিসেবে আপনি যার নাম করবেন তাকেই দেওয়া হবে। আর লাভ তো অনেক হবেই আপনার।’

‘নিজেই নিজের বাড়ি চিনতে না পারলে আর লাভ কী!’

‘আপনি বুঝতে পারছেন না। আমরা নিজে থেকে এসেছি আপনার বাড়িটা ডেভেলপ করে দিতে। এমনিতেও দেখুন অবস্থা কত খারাপ, পস্নাস্টার পর্যন্ত খসে পড়ছে, মাথার উপরে কবে ভেঙে পড়বে সে-খেয়াল আছে আপনার?’

‘তা কেন হবে? সে তো রেনোভেট করালেই হয়ে যায়। আমার সাধ্যে কুলোয় না, সে আলাদা ব্যাপার।’

‘আচ্ছা, আপনি কি এর পরিবর্তে ঝকঝকে নতুন একটা বাসায় থাকতে চান না? ঠিক এইখানেই, এই দক্ষিণ দিকে ধরেন আপনার একটা খোলা বারান্দা থাকল, ধরেন ছয় তলায়, নিজে যখন থাকলেন তখন নিচে কেন থাকবেন, সবচেয়ে ওপরের তলা আপনার জন্য বরাদ্দ হবে। দখিনের বাতাস খেতে-খেতে আপনি গ্যালারির মতো বারান্দায় বসে বিকেলে ওই মাঠে ছেলেদের ফুটবল খেলা দেখবেন, আর কী চাই এই বয়সে?’

‘ঠিক বলেছেন, এই বয়সে আমার আসলে কিছুই চাই না। এ- বাড়িতেই আমরা ঠিক আছি, ভালো আছি।’

‘আপনি হয়তো ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারছেন না। একটি পয়সাও আপনাকে খরচ করতে হবে না। ডিজাইন বুদ্ধি করে করতে পারলে অ্যাপার্টমেন্ট এখানে অনেকগুলো হবে কিন্তু। যা হবে তার মধ্যে আপনার ফোর্টি পার্সেন্ট, আমাদের সিক্সটি। হিসাবটা করে দেখাব?’

‘ভাই দেখুন, হিসাব দেখাতে হবে না আমাকে। আমি বলছি আমার জিনিস আমি বেচব না, তাহলে আপনি কিনছেন কী করে?’

লোকটা একটু হতাশ হলো। তবে পরমুহূর্তেই হতাশা ঝেড়ে বলল, ‘এটা তো আপনার এক্সচেঞ্জ প্রপার্টি, দলিল আছে?’

‘থাকবে না কেন? নিশ্চয় আছে।’

‘দেখতে পারি?’

‘জি না, পারেন না। আমি এই বাড়ির কোনো পরিবর্তন আনতে দেব না। আপনারা আসতে পারেন।’

‘পরিবর্তন তো আপনি ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না। এই পুরো শহরটাই বদলে যাবে। কিছুই আগের মতো থাকবে না। আপনি দ্রুত বুঝতে পারলে আমরা কাজ শুরু করতে পারি। অফারটা দিয়ে যাই, আপনি ভাবুন। পরে আসব আবার।’

ঠিক তখন মা চায়ের ট্রে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকলেন। দাদু দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘কোনো অফার চাই না। আপনারা যেতে পারেন। আমি আমার বাড়িতেই থাকব, আমার নাতিও এখানেই থাকবে। এটাই শেষ কথা।’

মা নিচু স্বরে বললেন, ‘বাবা, আপনি কিন্তু বেশি উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছেন। শান্ত হোন।’

‘শোনো, বউমা, চা এনেছ ভালো কথা, ওনাদের দাও। কিন্তু আর কখনো এনারা যেন এই বাড়িতে না আসেন, সেটা দেখো।’

দাদুর কথায় কাজ হয়নি। তারা এসেছেন। বহুবার এসেছেন। বলতে গেলে মাসে দুবার করে এসেছেন। কাকুতি-মিনতি করেছেন, ‘আর একবার ভেবে দেখুন। লাভটা কিন্তু অনেক বেশি হতো। এই পুরনো ঢাকায় তো অনেকদিন থাকলেন, ঘিঞ্জি আর ভিড় ছাড়া এখানে আছেটা কী? আপনাকে ধানমন্ডিতে বাসা ভাড়া করে দিই, কদিন ওদিকটায় থাকুন আরামে। বাড়ি তৈরি হয়ে গেলে নাহয় ফিরে এলেন, সোজা টপ ফ্লোরে। আবার চাইলে তার বদলে নতুন ঢাকায় একটা অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে নিলেন। আমাদের প্রজেক্ট তো সব এলাকাতেই চলছে। আপনার ইচ্ছা। তবে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে আমাদের একেকটা কাজ দেখলে।’

দাদুর ছিল সেই এক জবাব, ‘আমি না বেচলে আপনারা কিনবেন কী করে?’ তারাও ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেছেন, ‘এই দেখুন আপনার পাশের বাড়িটার অ্যাগ্রিমেন্ট হয়ে গেল। দুটো একসঙ্গে হলে কত বড়ো প্রজেক্ট হতো ভাবুন! যাই হোক, পেছনেরটাও হবো-হবো করছে, আপনি তো গর্তে পড়ে থাকবেন। ওপর থেকে মানুষজন আপনার বাড়ির ওপরে সিগারেটের ছাই কিংবা চিপস আর বাদামের খোসা ফেলবে, এটা চাচ্ছেন?’

‘ফেলুক। আরে ভাই, ঐতিহ্য বলেও তো একটা কথা আছে! আগের স্থাপত্য কিছুই থাকবে না? পুরনো ঢাকাকে নতুন বানিয়ে ইতিহাস ভুলিয়ে দেবেন?’

‘হা হা হা… কোথায় ঐতিহ্য থাকছে, চাচা? ওই আহসান মঞ্জিলটাই কেবল মাল্টি-স্টোরিয়েড হতে বাকি থাকবে হয়তো।’

‘এটা কোনো কথা হলো? কলকাতায় তো সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন আছে এখনো, ভিতরে যা খুশি করো, বাইরেটা ওরকমই থাকবে। ডালহৌসিতে গিয়ে দেখুন না -’

‘সেসব জানি না, তবে আমাদের এখানে কিছুই থাকবে না। রাজধানীর দিকে সারাদেশের মানুষ এগিয়ে আসছে, আরো বহু অ্যাপার্টমেন্টের প্রয়োজন। যা-ই হোক, আপনি কথা দিন, দিলে আমাদেরই দেবেন, আর কাউকে নয়। অন্য যে যা দিতে চায় আমরা তার ওপরে বিশ লাখ বাড়িয়ে দেব, কথা দিলাম।’

কিন্তু অনেক রকমের প্রলোভনেও দাদুকে মচকানো যায়নি। বারান্দায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে-দিতে দাদু মাকে বলতেন, ‘এই বাড়ি থাকবে না, এই উঠোন, আমার এই বারান্দায় রোদেলা সকাল, ওই ফলের বাগান… বলে কী! ফাজলামো নাকি?’

‘জি, বাবা, পুরোটাই ফাজলামো।’

‘শোনো, বউমা, আমি মরে গেলেও যেন এই বাড়ি না ভাঙা হয়। খেয়াল রেখো।’

‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, বাবা।’

‘যাক, ভরসা দিলে। ওরা বলছিল আজ সই করলে আগামী মাসেই ভাঙা শুরু করবে।’

‘সর্বনাশ! আপনি কী বললেন, বাবা?’

‘বললাম, আমি একটা লাউগাছ লাগিয়েছি, রান্নাঘরের দেয়াল বেয়ে উঠেছে লকলক করে, লাউ হোক, আমাকে খেতে দাও। এসব ভাঙাভাঙি এখানে চলবে না।’

‘হা হা হা… আট কোটি টাকা অফারের সাথে আপনার সাধের লাউ কি প্রতিযোগিতায় টিকবে, বাবা?’

‘টিকবে না মানে? টেকাতেই হবে। আসুক না দেখি আরেকবার, মজা বুঝিয়ে ছাড়ব।’

তাদের মজা বোঝানোর জন্য দাদুর কাছে কী পরিকল্পনা ছিল, আমার জানা হয়নি। কিন্তু তাদের হাতে ছিল এমন নীল নকশা যা আমাদের বিপদে ফেলতে যথেষ্ট। কুয়াশাঘেরা এক থমথমে সন্ধ্যায় তারা এক ফাইল নিয়ে উপস্থিত হলেন। এই বসার ঘরের মাঝখানের চেয়ারে বসেই দাদুর সামনে ফাইল মেলে ধরলেন। সেখানে দেখা গেল আমাদের বাড়ির দলিল, যার কাছে মর্টগেজ রাখা ছিল তার কাছ থেকে আনা। মা চমকে উঠে দাদুকে বললেন, ‘বাবা, আপনি বাড়ি মর্টগেজ রাখলেন কবে? আশ্চর্য, আমরা তো কিছুই জানি না!’ দাদু অসহায়ের মতো বললেন, ‘আমি কেন বাড়ি মর্টগেজ রাখতে যাব, বউমা, আমার কি অত টাকার কোনোদিন কোনো প্রয়োজন পড়েছে?’

রিয়েল এস্টেট কোম্পানির লোকগুলো হাসল। ‘অত উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই। মর্টগেজ তো আপনি রাখেননি, রেখেছিলেন এই বাড়ির আগের মালিক, ডক্টর নন্দী’, বলতে-বলতে ফাইল থেকে এক অ্যাগ্রিমেন্টের কপি বের করে দাদুর হাতে দিলেন একজন। দাদু আর মা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সেই কাগজটার ওপরে, হ্যাঁ, ৭ নম্বর র‌্যাংকিন স্ট্রিট, ডক্টর নন্দীরই সই, পরিষ্কার সব লেখা আছে কাগজে। সঙ্গে তারা বাড়ির আসল দলিলটাও দেখালেন। দাদুর ভুরু কুঁচকে গেল, নিজের মনে আওড়ানোর মতো করে বললেন, ‘এ কী করে সম্ভব, এমন কিছু তো আমাকে বলা হয়নি!’

‘তা বলবে কেন, ওপারে আপনার বাড়িটা পেয়ে গেছে না! আর কী?’

‘তা এখন কী করা যায় বলুন তো?’

‘কী আর, সুদে-আসলে মর্টগেজের টাকার অঙ্ক যা দাঁড়িয়েছে তা শোধ করতে হলে আপনার এ-বাড়ি ডেভেলপ করলেই হয়ে যায়। মানে টাকাটা আপনার হয়ে আমরাই শোধ করে দেবো। মাঝখান থেকে আপনি পেয়ে যাবেন অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্ট। দেখুন, আপনার কাছে যখন এসেছি তখন জেনেশুনেই এসেছি, যতটুকু জানি তাতে এই টাকা শোধ করার মতো আপনার…’

লোকটিও কথা শেষ করলেন না, দাদুও কিছু বললেন না।  আর মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বসে থাকলেন। উঁচু ছাদের বসার ঘরটিতে শীতল নিস্তব্ধতা নেমে এলো। স্তব্ধতার মাঝখান থেকে দাদুর স্পষ্ট উচ্চারণ শুনলাম, ‘আমি মামলা করব।’

লোকটি এমন বিশ্রী শব্দে হাসতে শুরু করলেন যেন বাংলা ছায়াছবির উঠতি ভিলেন, ‘কার বিরুদ্ধে? ডক্টর নন্দী? সে তো ভারতে মারা গেছে। মামলা ডিসমিস। আর যার কাছে মর্টগেজ রেখেছিল তিনি তো জীবিত। দলিলটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তারপর পেতেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন ডেভেলপের ব্যাপারে।’

‘আর হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো আপনারা ছুটে এলেন, তাই না?’

লোকটা উত্তর না দিয়ে ফাইলে কাগজগুলো গুছিয়ে রাখলেন। মিটিমিটি হাসি লেগে ছিল তার মুখে। দাদু তখন নিজেকে সামলে নিলেন, বললেন, ‘শুনুন, আমাকে দলিল দেখিয়েন না। আসল দলিল আমার কাছেও আছে। ভাববেন না, আমি নিজেই ব্যবস্থা করব। এ-বাড়ি যেমন আছে ঠিক তেমনই থাকবে।’

ফাইলপত্র বগলদাবা করে লোকগুলো বেরিয়ে গেল। দাদু চেনাজানা ভালো উকিল ধরলেন। কোর্ট আর রেজিস্ট্রি অফিসে দৌড়াদৌড়ি করতে-করতে কদিনেই কাহিল হয়ে পড়লেন। মাসখানেক লড়াই করার পরে এক ভোরে দাদু আর ঘুম থেকে উঠলেন না। মশারির ভেতরে মৃত দাদুকে আবিষ্কার করলেন মা। বাড়ি হারানোর শোকের সম্ভাবনার কাছে মৃত্যুর জয় হলো।

মা তবু হাল ছাড়লেন না, দাদুর হয়ে লড়ে গেলেন টানা চার বছর। কি শীত কি গ্রীষ্ম, কোর্টের তারিখ থাকলে মা আগে-আগে শূন্য কোর্টের বেঞ্চে গিয়ে বসে থাকতেন। আমার তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের জটিল পড়াশোনা। মাকে একাই এসব করতে হতো। বুঝতে পারছিলাম যে, আমরা হেরে যাচ্ছি, উকিলের অসহায় অবস্থায় সেটা স্পষ্ট হতো। অথচ মাকে বললে মা দাদুর আদেশের কথা মনে করিয়ে দিতেন, ‘আমি মরে গেলেও যেন এ-বাড়ি ভাঙা না হয়।’ আমাদের জন্য একটিই সুবিধা ছিল যে, কেসটা ঝুলে আছে, সমাধান হচ্ছে না, আর তাই আমরা আমাদের জায়গাতেই আছি। তবে একটা ভয় ছিল, কবে আমাদের সরে যেতে বলা হয়। রিয়েল এস্টেটের লোকেরা হয়তো অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন, পাশের বাড়িটার জায়গায় উঁচু ইমারত বানানোর কাজ শেষ। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে তাদের আট কোটি টাকার অফার বাড়তে-বাড়তে আঠারো কোটিতে উঠল। অথচ এতকিছুর পরও যখন সম্পত্তিটা হাতে লাগছে না, তখন একদিন বাড়িতে এসে ইনিয়ে-বিনিয়ে ওই কথা বলে গেলেন, ‘রাস্তায় বেরোলে যে কী হয় বলা যায় না -’

আজকাল রাস্তার কথা সত্যিই কিছু বলা যায় না। পুরনো ঢাকা থেকে আমার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে অনেকটা সময় লাগত। একদিকে মাকে একা ফেলে সেখানকার হলে উঠে যেতে পারতাম না, অন্যদিকে প্রতিদিন ফিরতে দেরি হতো। মা চিন্তায় থাকতেন। আমিও বাড়িতে একা মায়ের কথা ভেবে ভয় পেতাম। আমি তবু ভয়কে জয় করব বলেই ভেবেছিলাম। পড়া শেষ হলে চাকরি করব, টাকা জমিয়ে আমাদের কালিঝুলি মাখা বাড়িটাকে আগের সেই পাশের বাড়িটার মতো একটা তরুণী চেহারা দিয়ে দেবো, এই ছিল আমার গোপন পরিকল্পনা। চাকরিও পেয়ে গেলাম পড়া শেষ হতে না হতেই। কিন্তু মা একদিন নিচের তলায় দাদুর পড়ার আর নামাজের ঘরটা থেকে আমাকে ডাকলেন। গিয়ে দেখি নামাজের চৌকিটার ওপরে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছেন মা। আমি গিয়ে দাঁড়াতেই আমার দিকে ফিরলেন, চোখ মুছে ধীরে-ধীরে বললেন, ‘তুই তোর অফিসের কাছেধারে আমাদের জন্য একটা বাসা দেখ, খোকা। আর না।’ মায়ের ওই ছোট্ট ‘আর না’ কথাটুকুতেই আমি সমস্ত পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে এলাম।

সত্যি, অনেক হলো, আর না। কিন্তু মা কোথায়! শূন্য বসার ঘরে দাঁড়িয়ে নিস্তব্ধতা যেন আমার গলা টিপে ধরল। এই বাড়ি ছেড়ে গেলে এই ঘরে আমি আর এসে দাঁড়াব না, অপারগতা আর আমাকে এভাবে ছুঁয়ে দেবে না। মেঝের সাদা বর্গক্ষেগুলোর উজ্জ্বলতা কমে এসেছে তখন, কালোগুলো আরো ঘন কালো। জানালার দিকে চোখ গেলে দেখলাম আলো পড়ে এসেছে প্রায়। দ্রুত পাশের ঘরে ছুটলাম; দাদুর পড়ার ঘর, বইপত্র, শেল্ফসহ ট্রাকে চলে গেছে আগেই। শুধু নামাজের চৌকিটা পড়ে ছিল। সারা দিনরাত মানুষবিহীন চৌকিটাতে কাঠের পোকা কটর-কটর করে কামড় বসাতে থাকত। তাই ট্রাকে ওঠাইনি ওটা। মা ছিলেন সেখানেই, শান্ত হয়ে মেঝেতে বসে ছিলেন, হাত বোলাচ্ছিলেন চৌকিটার ওপরে। বসে থাকার ভঙ্গির চেয়েও শান্ত কণ্ঠে মা বললেন, ‘পোকা ধরেছে ধরুক, এই চৌকিটা নিতে হবে, খোকা। মারা যাওয়ার দিন ফজরের সময়েও তোর দাদু এখানে…’, মায়ের গলা ধরে এলো। আমি ভাবছিলাম মাইক্রোবাসে এই চৌকির জায়গা হবে কি? পরমুহূর্তেই আমার ভাবনা বদলে গেল। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, আজ তো বাড়ি থেকে বেরোনোতে মায়ের কোনো তাড়া নেই! r

Published :


Comments

Leave a Reply