দৃশ্যকলার বিশ্ববীক্ষা : আমাদের সমকাল

আবুল মনসুর

আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে ১৯১৭ সালে শিল্পপ্রেমিক ও বোদ্ধামহলের মুখের ওপর একটি প্রস্রাবাধার ছুড়ে মেরে ফরাসি শিল্পী মার্সেল দুঁ্যশ প্রশ্ন রেখেছিলেন : Can one make works which are not works of art? হতবিহবল পশ্চিমা শিল্পজগৎ তাড়াতাড়ি একে শিল্প বলে মেনে নেয়। মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিংশ শতাব্দীতে এমনসব কান্ডকীর্তি ঘটে চলছিল যে, এ-ঘটনাকে ততটা বিস্ময়কর মনে না-ও হতে পারে। এমনিতেই বিংশ শতকে যা ঘটেছে অন্যান্য যে কোনো শতকের  তুলনায় তা অনন্যতায় ভাস্বর। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ এই শতকে এমন এক গতি ও মাত্রা লাভ করেছে, যা আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়। আমাদের প্রাত্যহিক জীবন থেকে শুরু করে মনস্তত্ত্বের সংগঠনে পর্যন্ত এই বিপুল পরিবর্তনরাশির অভিঘাত এত প্রবল যে, অবচেতনেও আমরা এর প্রভাববলয় থেকে মুক্ত হতে পারি না। এর ইতি ও নেতি উভয়ই আমাদের সকল বোধ ও বিবেচনার ওপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।

শুধু বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে নয়, মানুষের সৃজনশীলতার সকল শাখায়ও বিংশ শতাব্দীর অর্জন উদ্ভাবনে ও বৈচিত্র্যে, পরিবর্তনে ও গতিশীলতায় এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। একবিংশ শতাব্দীতেও তা তেমনি পূর্ণবেগে ধাবমান রয়েছে। বিগত একশ’ বছরের অর্জন পূর্ববর্তী সকল সময়ের চেয়ে একান্তভাবেই ভিন্নতর। এতই ভিন্নতর যে এসবের সংজ্ঞা, আঙ্গিক, উপস্থাপন, মূল্যায়ন – সবই হয়ে পড়েছে সন্দেহ ও বিতর্কের আওতাভুক্ত। দৃশ্যশিল্প, অর্থাৎ চিত্র ও ভাস্কর্যকলার ক্ষেত্রেও একইরকম রূপান্তর ঘটেছে এই একশ বছরে। চিত্রী ও ভাস্কর প্রশ্ন তুলেছেন শিল্পের অভিধা ও আঙ্গিক নিয়ে, যা ওপরে উদ্ধৃত মার্সেল দুঁ্যশর ভাষ্যে আভাসিত। পুরুষদের একটি প্রস্রাবাধারকে ‘ফাউন্টেন’ আখ্যা দিয়ে শিল্পপ্রদর্শনীতে স্থাপনের মাধ্যমে আজ থেকে একশ বছর আগে দুঁশ যে-প্রশ্ন ছুড়েছিলেন তার অনুরণন এখনো ধ্বনিত হচ্ছে আর উত্তরও রয়ে গেছে অব্যাখ্যাত।

ইতিহাসের পরম্পরায় বলা যেতে পারে যে, য়ুরোপশাসিত শিল্পের সংকীর্ণ গলিপথ ছেড়ে বৈশ্বিক শিল্পবীক্ষার রাজপথে আরোহনই বিংশ শতাব্দীর শিল্পকলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের য়ুরোপীয় রেনেসাঁস থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত পাশ্চাত্য শিল্পের বিকাশ মোটামুটি একরৈখিকভাবে ঘটেছে বলা যেতে পারে। এই সময় থেকে চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে পশ্চিমা শিল্পের প্রধান অভীষ্ট ছিল দৃশ্যমান বাস্তবতার অনুরূপ প্রতিলিপি নির্মাণের দক্ষতাকে অর্জন। বিশেষ করে চিত্রকলার দ্বিমাত্রিক ভূমিতে ত্রিমাত্রিক বস্ত্তবিশ্বের এমন বিশ্বাসযোগ্য বিভ্রম সৃষ্টি করা যা দর্শকের দৃষ্টিতে একটি স্পর্শযোগ্য (tactile) অনুভূতির জন্ম দেয়। পরিপ্রেক্ষিত, অস্থিসংস্থান বিদ্যা ও আলোছায়ার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগের মাধ্যমে চিত্রে ও ভাস্কর্যে বাস্তবের হুবহু প্রতিরূপ নির্মাণের এই য়ুরোপীয় ধারণা উপনিবেশবাহিত হয়ে অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ প্রায় সমগ্র বিশ্বের শিক্ষিত মানুষের কাছে দৃশ্যকলার অবিসংবাদী পরমরূপ হিসেবে আসন পেয়ে যায়। যদিও প্রাচ্যের কোনো কোনো দেশে অধিকতর সংবেদী ও বাস্তবতা-অতিক্রমী সৃজনশীল শিল্পরূপের  অস্তিত্ব আগে থেকেই বিরাজমান ছিল, ঔপনিবেশিক হীনমন্যতার প্রভাবে তারাও নিজেদের শিল্পকে অসংস্কৃত ও য়ুরোপীয় উদাহরণকে শ্রেয়তর জ্ঞান করতে শিখল। পাশ্চাত্যবিশ্বে তখন পর্যন্ত বিশ্বশিল্পের পরম্পরাগত ঐতিহ্য বলতে গ্রেকো-রোমান আদর্শের আলোকে রেনেসাঁস-নির্ধারিত বাস্তবানুগতার ধারাবাহিকতাকেই বোঝানো হতো। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এসে কেবল প্রাচ্যদেশীয় ও অন্যান্য অ-য়ুরোপীয় শিল্পকে পশ্চিমা শিল্পের সমগোত্রীয় বলে স্বীকার করা হয়। তবে সেসবই ছিল শুধুমাত্র ভদ্রলোকীয় শিল্পের স্বীকৃতি; আদিম, উপজাতীয় ও লোকজ সমাজের অন্ত্যজ মানুষের সৃষ্টিকর্মকে মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম শিল্পের সঙ্গে একাসনে ঠাঁই পেতে পেতে ঊনবিংশ শতাব্দী শেষ হয়ে আসে।

অ-য়ুরোপীয় নানাবিধ শিল্পের প্রতি তাত্ত্বিক ও শিল্প-ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন অবশ্য আধুনিক শিল্পের দিক-পরিবর্তনে তেমন ভূমিকা রাখেনি। তাত্ত্বিক ও শিল্পবোদ্ধাদের অনুধাবনের অনেক আগেই কিছু পরিবর্তন-প্রত্যাশী শিল্পীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল, বিশেষ করে জাপানি কাঠখোদাই ছাপচিত্র এবং আফ্রিকীয় নিগ্রো ভাস্কর্য ও মুখোশের প্রতি। এছাড়াও তাঁরা ভারতীয় মিনিয়েচার, চৈনিক চিত্র ও ভাস্কর্য এবং পলিনেশীয় আদিম শিল্পের খোঁজ রাখতেন। জাপানি ছাপচিত্রে য়ুরোপীয় শিল্পীরা লক্ষ করলেন, দ্বিমাত্রিক চিত্রতলকে অক্ষুণ্ণ রেখে এবং চিত্রকে বাস্তবের সদৃশ না করেও শিল্পগুণসম্পন্ন করার কৌশল, পরিমিতিবোধ ও আলঙ্করিকতার সংমিশ্রণে পরিসরের অর্থপূর্ণ ব্যবহারের দক্ষতা। আফ্রিকার ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভিন্ন আদিম জাতিগোষ্ঠীর ভাস্কর্য ও মুখোশে ত্রিমাত্রিকতার জ্যামিতিক ব্যবহারে পৌরুষ ও দার্ঢ্যের প্রখর প্রকাশ এবং প্রচলিত সৌন্দর্যবোধের বিপরীতে রূপান্তরণ ও অতিশায়নের প্রয়োগে অতিলৌকিক অভিব্যক্তি ও নিহিত প্রাণশক্তির সম্মোহক রূপায়ণ তাঁদের বিস্মিত ও আকৃষ্ট করে। এই প্রথম তাঁরা শিল্পের এমন নিদর্শনের মুখোমুখি হলেন যা দৃশ্যমান বাস্তবতার মুখাপেক্ষী না হয়েও শিল্প হিসেবে যথার্থ ও অকৃত্রিম এবং নব্য-আধুনিক শিল্পের জন্য বাস্তবতার ঘেরাটোপের বাইরে তাঁরা যে অনুসন্ধানগুলি চালাচ্ছিলেন তার অনেক সমাধানই যেন দেখতে পেলেন এসব শিল্পে। ঊনবিংশ শতকের শেষ কয়েক দশকে ক্রিয়াশীল ইমপ্রেশনিজম অবশ্যই এই নবচেতনার প্রথম ফসল এবং এর অনুবর্তী পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা পশ্চিমা আধুনিক শিল্পের দিগদর্শনকারী অগ্রপথিক। জাপানি ছাপচিত্রকলা বহু ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীকে প্রভাবিত করেছিল। তবে রেনেসাঁস-নির্দেশিত বাস্তবতা থেকে বিচ্যুতি ও অচ্ছুৎ আদিম শিল্প থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণের প্রথম সাহসী পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন              পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীরাই – সেজান, ভ্যান গঘ, পল গগাঁ। এঁদের কাজের মাধ্যমেই পশ্চিমা পরম্পরাগত শিল্পের একদেশদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে পরিবর্তনের হাওয়াটি সূচিত হয়, যা বিংশ শতাব্দীতে এসে সমস্ত পশ্চিমা শিল্পেই এক যুগান্তকারী পরিবর্তন সংঘটিত করে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্তিমলগ্নে চলমান শিল্পধারায় ক্ষয় ও ক্রান্তির লক্ষণগুলি ফুটে উঠতে শুরু করেছিল বটে, তবু ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার সঙ্গে একটি সত্যিকার বিবাদ ও বিচ্ছেদ রচনার যুগান্তকারী ঘটনাপ্রবাহের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল একটি নতুন শতাব্দীর প্রস্ফুটনের যথাযথ কালটি পর্যন্ত। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেই সূচিত তিনটি শিল্প-আন্দোলন ফভিজম, ক্যুবিজম ও এক্সপ্রেশনিজমেই প্রকাশ পায় য়ুরোপীয় আধুনিক শিল্পে বাস্তবানুগতার দীর্ঘদিনের লালিত উত্তরাধিকারকে অস্বীকারের প্রথম প্রয়াস। আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, একটিমাত্র চিত্রকর্ম – ১৯০৭ সালে পিকাসোর অাঁকা ‘আভিয়োঁর রমণীকুল’ (Les Demoiselles d’Avignon)-কে প্রবল হইচইয়ের সঙ্গে পশ্চিমা শিল্পের এক যুগ-পরিবর্তনকারী মাস্টারপিস হিসেবে ঘোষণা করা হলো। পিকাসোরও আগে অবশ্য মাতিস ১৯০৫-০৬ সালে রচনা করেছিলেন ‘জীবনের সোজা’ (Joy of Life), যেখানে বাস্তব দৃশ্যরূপের সাদৃশ্য নির্মাণ এবং পরিপ্রেক্ষিত ও আলোছায়ার স্বভাবী বণ্টনের মাধ্যমে বস্ত্তর ত্রিমাত্রিকতাকে প্রতিভাত করার রীতিকে বর্জন করে লীলায়িত রেখার আধিপত্যে দ্বিমাত্রিক ও সরলীকৃত আকৃতির কাব্যিক ছন্দোময়তায় বিষয়ের ভাবকে পরিস্ফুট করার চেষ্টা করা হয়েছে। মাতিস এবং তাঁর ফভ্-বন্ধুরা পিকাসোর আগেই আদিম শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং তাঁদের নব্য শিল্প-ভাবনায় একে ব্যবহারের কথা ভেবেছিলেন, এর প্রতি প্রথম পিকাসোর মনোযোগ আকর্ষণও করেছিলেন মাতিস। এ-কথা ঠিক যে, পিকাসোর চিত্রকর্মটি তার সংগঠনে ও উপস্থাপনে সমসাময়িক সৌন্দর্যবোধ ও নারীত্বের আদর্শকে এমনভাবে আঘাত করেছিল যে, পাশ্চাত্য নান্দনিকতা একটা বড় রকমের ঝাঁকি খেয়েছিল। তবু এটিও ভোলা বোধহয় উচিত হবে না যে, পিকাসো সেজানের ঋণ স্বীকার করলেও আফ্রিকীয় ভাস্কর্য ও মুখোশের কাছে তাঁর ঋণ স্বীকার করেননি। মাতিসও তাঁর চিত্রে প্রাচ্যদেশীয় উদাহরণের প্রভাব স্বীকার করেননি। পিকাসোর ‘আভিয়োঁর রমণীকুল’কে মাস্টারপিস কতটা বলা যাবে সে-সম্পর্কেও প্রশ্ন উত্থাপন করা চলে বই কি। একই চিত্রে পাঁচটি রমণীমুখ বিভিন্ন শৈলীতে উপস্থাপন কতটা যৌক্তিক বা শিল্পসম্মত সে-জিজ্ঞাসা নিবিষ্ট দর্শকের মনে জাগতেই পারে।

তবে নতুন শতাব্দীর নবতর ভাবনার হাওয়া ততদিনে মানুষের চিন্তাবৃত্তির সকল দিকে দোলা দিতে শুরু করেছে। য়ুরোপীয় সভ্যতার অভ্যন্তর থেকেই সংকটের ও সংঘাতের বীজ উপ্ত হয়ে উঠছে, উপনিবেশগুলিতে ধূমায়িত হচ্ছে অসন্তোষ ও স্বাধীনতার স্পৃহা, য়ুরোপজুড়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে জঙ্গি সামরিকতন্ত্র, প্রথম মহাযুদ্ধের দূরাগত পদধ্বনি শোনা যেতে শুরু করেছে। এই ঘনায়মান সংকটের মুখোমুখি শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের কাছে সভ্যতার গৌরবগাথা ও মূল্যবোধকে মনে হলো মেকি ও অসহায়। পশ্চিমা শিল্পের লালিত নন্দনতত্ত্ব ও পরস্পরাকে মনে হলো যুগ-যন্ত্রণাকে অভিব্যক্তি প্রদানের জন্য ভোঁতা ও অপ্রতুল। এ-অবস্থায় নতুন এ-শিল্পভাষা যেন ক্লিষ্ট, জীর্ণ, সংক্ষুব্ধ সময়ের রাগত অভিব্যক্তি। এর মধ্য দিয়ে সূচিত হলো পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির অহংবোধ-পোষিত মূল্যবোধের বিকল্প সন্ধান, শিল্পের একরৈখিক পরম্পরা, অনুপ্রেরণা ও মূল্যায়নের প্রত্যাখ্যান এবং বিশ্বের সকল মানবের বৈচিত্র্যময় শিল্পপ্রচেষ্টাকে একই সমতলে বিবেচনার মানসিকতা। ফভ্-শিল্পীরা চিত্রতল থেকে মুছে দিলেন আলোছায়ার ত্রিমাত্রিক কুহক, বস্ত্তর গাত্রবর্ণকে অনুসরণ না করে বর্ণকে দিলেন স্বাধীন সত্তা। মাতিস, মারক্যুয়ে, রুয়া, ভ্লামিঙ্ক, দিরেইন, দ্যুফিরা অাঁকলেন দ্বিমাত্রিক চিত্রতলে উজ্জ্বল বর্ণের চোখ ঝলসে দেওয়া বিন্যাস। জার্মানির ড্রেসডেনে সংগঠিত হলো Die Brucke গোষ্ঠী, আদিম ও অসংস্কৃত শিল্পের দার্ঢ্য ও শক্তি আকৃতির দুমড়ানো বিন্যাসে রুদ্ধ আবেগকে দিলো বিস্ফোরক ভাষা। সমমনা আরেক দল মিলিত হলো ম্যুনিখে Blaue Reiter নাম নিয়ে। এক দলে কার্শনার, নোল্ডে, বেকম্যান, ককোশ্কা, অন্যদিকে কান্দিনিস্কি, পল ক্লি, যুদ্ধে প্রয়াত ফ্রাঞ্জ মার্ক, অগুস্ত ম্যাকে প্রমুখ। পিকাসো সহযাত্রী ব্রাককে সঙ্গে নিয়ে দৃশ্যমানতার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে কীভাবে বস্ত্তর সম্পূর্ণ সত্যরূপকে একই চিত্রতলে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করা যায় তার নিরীক্ষায় রত হলেন। সেখানেও উদ্ধারকারী ও সহায়ক হিসেবে আবিষ্কার করলেন আফ্রিকার আদিম মানুষের ভাস্কর্যকে। আর অনুপ্রেরণা হিসেবে রইলেন সেজান, মাতিসের ভাষায় Father of us all, আমাদের সকল সেজানের জ্যামিতিকতায় বস্ত্তর নির্যাসকে ধারণের অভীপ্সা, ভ্যান গঘের বর্ণের উচ্চকিত দীপ্রতায় আবেগের বিস্ফোরণ আর গগাঁর ১৮৯১ সালে তাহিতির স্বপ্নযাত্রার মধ্য দিয়ে য়ুরোপীয় আধুনিক শিল্পে পালাবদলের যে-অভীপ্সা ঘোষিত হয়েছিল তারই উদ্বোধন যেন ঘটলো নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকেই।

এর মধ্যে ১৯১৪ সালে শুরু হয়ে গেল প্রথম মহাযুদ্ধ। মহাযুদ্ধের হিংস্র উন্মত্ততা আর মানবিক মূল্যবোধের নিরর্থকতার মধ্যে শিল্পীর অসহায়তা মূর্ত হয়ে উঠলো বিদ্রূপ ও ব্যঙ্গ, ধ্বংসাত্মক ও আক্রমণাত্মক, কখনো কখনো আত্মবিনাশী কর্মকান্ডের মধ্যে, শিল্পের মহিমা বা চিরকালীনতাকে অস্বীকার, এমনকি নিজের শিল্পের ধ্বংস-সাধনের নানান ‘অ্যান্টি-আর্ট’ কর্মকান্ডে। ডাডা নামের এ-আন্দোলন সুইজারল্যান্ড থেকে সূচিত হয়ে প্রায় গোটা পশ্চিমা বিশ্বে ছড়িয়ে যায় এবং দৃশ্যকলাকে নিয়ে নানান উপহাসমূলক কর্মকান্ড থেকে খুলে যায় এই শিল্পের নতুন নতুন পথের সন্ধান। অর্থাৎ যা ছিল নেহাত নেতিবাচক কিছু নষ্টামি তা থেকে রসদ মিললো আগামী যুগের দৃশ্যকলার। ১৯১৭ সালে মার্কিনবাসী ফরাসি শিল্পী মার্সেল দুঁ্যশ কারখানায়-তৈরি একটি ইউরিনাল বা প্রস্রাবাধারকে উলটো করে স্থাপন করে নামকরণ করলেন ‘ফাউন্টেন’ বা ঝরনা। এর দ্বারা খুলে গেল রেডিমেড নামের তৈরি বস্ত্ত দিয়ে শিল্পনির্মাণ আর ফাউন্ড-অবজেক্ট নামের দু-দুটো শিল্পধারা। আজকে আমরা সমকালের শিল্পরূপ হিসেবে যে ইনস্টলেশন বা পারফরম্যান্স বলতে অজ্ঞান হচ্ছি, ডাডা শিল্পীরা আজ থেকে প্রায় শত বছর আগে তা করে গেছেন, যদিও নঞর্থক অর্থে। সে-বিবেচনায় আজকের প্রেক্ষাপটে ডাডা আন্দোলনকে ক্যুবিজমের চেয়ে এবং দ্যুশঁর ‘ফাউন্টেন’কে পিকাসোর              ‘আভিয়োঁর রমণীকুলে’র চেয়ে শিল্প-ইতিহাসে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মাস্টারপিস বলা যাবে কি না এ-বিষয়ে বিতর্ক জমতে পারে।

সে যা হোক, দু-দুটো মহাযুদ্ধের বিভীষিকা অতিক্রম করে বিংশ শতাব্দীর মানুষ তার ঊনবিংশ শতকীয় সকল মূল্যবোধই প্রায় বিসর্জন দিয়েছে। তার আস্থা গেছে টুটে শাস্ত্রে ও শ্রেয়বোধের অবশ্যম্ভাবিতায়, মানুষ হয়ে পড়েছে নিরাবলম্ব, আশ্রয়হীন ও একাকী। এই নির্জন-রক্তাক্ত-ক্ষুব্ধ-বিমর্ষ সমকালের সৃজন-বেদনাকে চিত্রে ও ভাস্কর্যে বিধৃত করছেন আজকের শিল্পী। সেটি করতে গিয়ে তাঁরা প্রেরণা নিচ্ছেন অ-য়ুরোপীয় বিভিন্ন  দেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যিক শিল্প থেকে, অনুন্নত, আদিম, অসভ্য মানুষের শিল্প থেকে, লোকসমাজের অসংস্কৃত শিল্প থেকে। পিকাসো-মাতিসের পরে সে-ধারা বয়ে চলেছে আমাদের একবিংশ শতকের শিল্পস্ফুরণের ত্রয়োদশ বছরটি পর্যন্ত। বস্ত্ততপক্ষে বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে আধুনিক শিল্পকলা যে অবয়ব ধারণ করে চলেছে, তার চেহারায় বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক-বহুত্বের যে-ছায়াপাত ঘটছে, সেটিই দৃশ্যকলায় তথা সামগ্রিক সংস্কৃতিচেতনায় বিগত শত-বছরের সবচেয়ে বড় অর্জন।

একবিংশ শতকের প্রথম দেড় দশক পার করবার মুখে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। নানান অর্জন সত্ত্বেও এ-প্রশ্ন বোধহয় প্রাসঙ্গিক হয়েই রইলো যে, বিগত একশ বছরে শিল্পকলার বিশ্ববীক্ষা যে সম্পূর্ণ হয়েছে এমন কথা বলা যাবে না। এখনো পশ্চিমা মূল্যায়নে য়ুরো-মার্কিন-কেন্দ্রিকতা একটি বড় জায়গা জুড়ে রয়েছে এবং আমাদের উত্তর-ঔপনিবেশিক মানস নির্বিচারে পশ্চিমের শিল্প-আন্দোলনের অনুগামী হওয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে সমান্তরাল সমসাময়িক শিল্পধারা নির্মাণে আগ্রহী হয়নি। এটি ঠিক যে, শতাব্দী-শুরুর আরেকটি পটপরিবর্তনের কালে দাঁড়িয়ে পশ্চিম থেকে দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পরিবর্তনের নানান ধ্বনি আভাসিত হচ্ছে। উত্তর-আধুনিকতার ব্র্যাকেটে কিছু শিল্পতত্ত্ব প্রচলিত ধারণা ও মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। ঊনবিংশ শতকীয় আধুনিকতা যে একরৈখিক নৈতিকতা, সত্যবোধ, যুক্তিবাদ, আধ্যাত্মিকতা, ঐতিহাসিকতা, বিশ্লেষণবাদিতা, মানবসমাজের একত্ববোধ ও মহৎ কীর্তিগাথার ঐতিহ্যবোধ নির্মাণ করেছে এই মতাদর্শ তার যৌক্তিকতা নিয়ে সন্দিহান। এই সর্বজনীন মূল্যবোধের বিপরীতে পোস্ট-মডার্নিজম বিশ্বকে দেখতে চায় একটি অনিশ্চিত, ঘটনাচক্রজাত, অস্থিতিশীল, অনির্ধারণযোগ্য বিভিন্নমুখী ধারণার সমাহার হিসেবে। এখানে মানব-সংস্কৃতি একটি অসংঘবদ্ধ বৈচিত্র্যময় কার্যকলাপ যা শুধুমাত্র কালিক ও স্থানিক পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণযোগ্য, এর কোনো ঐতিহাসিক বিচার বা মহিমা নেই। কোনো শিল্পেরই চিরায়ত গরিমা বলে কিছু নেই, তা সব সময়ই আপেক্ষিক। এই বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে পোস্ট-মডার্নিজম ‘হাই’ ও ‘পপুলার’ সংস্কৃতির বিভাজনকে ভেঙে দিতে চায়, শিল্পের অভিজাত ও ব্রাত্যের মূল্যায়নকেও একই সমান্তরালে দাঁড় করাতে চায়।

দৃষ্টিভঙ্গির এই ইতিবাচকতা দৃশ্যকলার ভুবনে এনেছে  বৈপ্লবিক পরিবর্তন। শিল্পের নব নব দৃশ্যরূপ – ইনস্টলেশন, বডি-আর্ট, সাইটস্পেসিফিক-আর্ট, ভিডিও, পারফরম্যান্স ইত্যাদি প্রকাশ-মাধ্যম দৃশ্যকলার গন্ডিকে অনেকটাই প্রসারিত রূপ দিয়েছে। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, চিত্র বা ভাস্কর্য কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। বরং পশ্চিমে এখনো প্রচুর শিল্পী রয়েছেন যাঁরা একেবারে বাস্তবধর্মী বা তার কাছাকাছি কাজ করেও সমকালের প্রথম সারির শিল্পী হিসেবে স্বীকৃত। বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকে আমাদের তরুণ শিল্পীরা তখনকার পশ্চিমের বিমূর্ততার অধ্যাস দ্বারা আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন, প্রায় সকলেই বিমূর্ত শিল্পের চর্চায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশকালের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় না এনে। আজ প্রায় ষাট বছর পরও দেখা যাচ্ছে আজকের নবীন শিল্পীকুলের অনেকেই একইরকমভাবে  পশ্চিম-বাহিত ইনস্টলেশন বা পারফরম্যান্স ইত্যাদিকেই সমসাময়িক হওয়ার মাপকাঠি ভেবে নির্বিচারে এর চর্চা করছেন। এ-ধরনের শিল্প মূলত সেলিব্রাল বা মননপ্রসূত; বুদ্ধিবৃত্তির নিবিড় অনুশীলন ও প্রয়োগের পারঙ্গমতা ছাড়া একে অর্থময়তায় জারিত করা সহজ নয়। ফলে যেসব উদাহরণ আমরা দেখছি তার অধিকাংশের মধ্যে স্থুল প্রাসঙ্গিকতা ও পশ্চিমের দুর্বল ছায়াপাত  ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়ে না। আজকের বিশ্বে জীবিত অন্যতম একজন শিল্পীর নাম ডেভিড হকনি। তাঁর মূল শিল্পচর্চা বাস্তবের একেবারে কোলঘেঁষা, কিছু ছবি আছে নিখুঁত বাস্তব ধারায় করা। পারফরম্যান্স বা ইনস্টলেশন না করে আশির কাছাকাছি বয়সেও তিনি প্রকৃতির মধ্যে ইজেল নিয়ে আউটডোরে কাজ করেন। আমাদের নবীন শিল্পীদের অনেকেই দারুণ প্রতিশ্রুতিশীল। তাঁরা যদি সমসাময়িকতার বিভ্রান্ত ও একপেশে ধারণায় চালিত না হয়ে নিজের যথাযথ ক্ষেত্র এবং মাধ্যমটি সঠিক বেছে নিতে পারেন, মাধ্যমের কুশলতার পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাটিকে আবশ্যকীয় মনে করেন আর বিষয়ের সঙ্গে স্থানিক ও কালিক প্রাসঙ্গিকতার সমন্বয় ঘটাতে পারেন তবে তাঁরাই হয়ে উঠবেন এদেশের সমকালের প্রতিনিধিত্বকারী যথার্থ শিল্পী।