দেবতুল্য শিল্পীর মহাপ্রয়াণ

সৈয়দ জাহাঙ্গীর

সফিউদ্দীন আহমেদ ছিলেন একজন ব্যতিক্রমধর্মী শিল্পী। যেমন কথায় তেমনি শরীরে, তেমনি কাজে। আশপাশের সব শিল্পী থেকে একেবারে পৃথক। বেশভূষায় যেমন অতুলনীয় পরিপাটি, তেমনি পরিপাটি তাঁর কাজ। তিনি ছিলেন যাকে বলে একজন পারফেকশনিস্ট। কোনো প্রকার অসংগতি বা অসম্পূর্ণতা তিনি কখনই বরদাস্ত করতেন না।
আসা যাক স্যারের সঙ্গে পরিচয়ের কথা। আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে গেলাম ১৯৫০-এ আমার অগ্রজ কবি সিকান্দার আবু জাফরের অনুপ্রেরণা আর নির্দেশনায়। তৎকালীন ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউটের দুই কামরা আর একটি বারান্দা নিয়ে শুরু হয়েছিল আর্ট স্কুল, গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্ট। প্রথম সাক্ষাতেই শিল্পী জয়নুল আবেদিন আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন সফিউদ্দীন আহমেদ ও আনোয়ারুল হক স্যারের সঙ্গে। ওই তিনজন শিল্পীরই নাম উল্লেখ করেছিলেন জাফরভাই, যখন আমাকে ঢাকায় এসে আর্ট কলেজে ভর্তি হতে বলেছিলেন, গ্রাম থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর।
আনোয়ার স্যার আমাকে নিয়ে গেলেন একটা কলসির ড্রইং করে ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য। কাজ খারাপ কি ভালো তা বোধহয় ওই সময় খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না। ছিল ছাত্র ভর্তি করতে হবে, মোটামুটি ড্রইং করতে পারলেই চলবে। তবে আমার ড্রইংটা আনোয়ার স্যার পছন্দ করেছিলেন। এবং জানতে চেয়েছিলেন আমি ইতিপূর্বে কারো কাছে ছবি অাঁকা শিখেছি কিনা। আমি ‘না’ সূচক জবাব দেওয়ায় তিনি খুশি হয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন আবেদিন স্যারের কাছে, বললেন, ‘ও ভালোই করেছে ড্রইং। ওকে ভর্তি করা যায়।’
ভর্তি হয়ে গেলাম। নিয়মিত ক্লাসে যাই, ড্রইং করি। সফি স্যারও নিয়মিত ক্লাসে আসেন এবং কোনো কোনো ছাত্রের ভুলত্রুটি সংশোধন করতে বলেন। এরপর সরাসরি তাঁর বিভাগেও অর্থাৎ গ্রাফিক ডিপার্টমেন্টে তাঁর নির্দেশনায় লিথোগ্রাফ, উডকাট এবং এচিংয়ে কাজ শিখি। ওই সময় দেখার সুযোগ হয় সফি স্যারের উডকাটের ছবিগুলো। এত সূক্ষ্ম এত পরিপাটি ড্রইং কেউ করতে পারে বিশ্বাসই হতো না তখন। সেই থেকেই তাঁর সম্পর্কে মনে গেঁথে যায় একধরনের গভীর শ্রদ্ধা।
আর্ট কলেজ থেকে পাশ করার পর অর্থাৎ ’৫৬-৫৭ সালের দিকে প্রায়ই যেতাম স্যারের বাসায় স্বামীবাগে। আলাপচারিতার মাঝে স্নেহভরে জানতে চাইতেন গান শোনার অভ্যাস আছে কিনা, বলতাম আছে – ওই সময় গ্রামোফোনে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ডিস্ক রেকর্ডের প্রায় সব গানই আমার মুখস্থ ছিল। আমার চাচা জালালউদ্দীন হাশেমী ওগুলো কিনে আনতেন আমাদের গ্রামের বাড়িতে রাখা মেশিনে বাজিয়ে শোনার জন্য। হেমন্ত, সন্ধ্যা, পঙ্কজ মল্লিক, কানাকেষ্ট প্রমুখ বহু শিল্পীর রেকর্ডও। কিছু কৌতুক, কিছু নাটকের রেকর্ডও। তাই আমরা যৌথ পরিবারের প্রায় অর্ধডজন ছেলেমেয়ে ওইসব গান গাইতাম এবং মুখস্থ করতাম। স্যার শুনে খুশি হয়ে তার সযত্নে ঢেকে রাখা মেশিনটা খুলে, ঢাকনা কাপড়টা সুন্দর করে ভাঁজ করে পাশের টেবিলে রেখে দিতেন এবং লং প্লে রেকর্ডগুলো বাজাতেন। এগুলোর বেশিরভাগই ছিল ইউরোপীয় ক্লাসিক্যাল সংগীত বেটোফেন, কাখ, মোজার্ট। ফাঁকে ফাঁকে চা খাওয়াতেন আর নিজের কাজ সম্পর্কে আলোচনা করতেন। দু-একবার তাঁর সদ্য করা ড্রইং এবং প্রিন্টও দেখাতেন। বিস্ময়ে অবাক হয়ে যেতাম ওইসব কাজের নির্মাণ-কৌশল, ড্রইং আর ছিমছাম ফিনিশিং দেখে। স্যারের বাড়িটা একটু নিচু এলাকায় হওয়ায় অতিবৃষ্টিতে ডুবে যেত। একবার বন্যায় তো পুরো বাড়িটাই ডুবে গেল এবং স্যার অন্যত্র সরে তো গেলেনই না বরং ওখানে থেকে বিষয়টি যতদূর সম্ভব উপভোগ করার চেষ্টা করলেন। কামরার মধ্যে পানি। বিছানার ওপর বসে ছিপ দিয়ে ছোট ছোট মাছ ধরা আর উঠানে জাল দিয়ে বড় মাছ ধরার অভিজ্ঞতা কাজে লাগালেন তাঁর পরবর্তী কাজে – ড্রইং এবং তেলরঙের কাজে। এবার তাঁর কাজ পেল প্রায়-বিমূর্ত আঙ্গিক। একই বিষয় নিয়ে তিনি এচিং অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে অনেক কাজ করলেন। এটা সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ফসল। কলকাতায় পঞ্চাশের মন্বন্তরের কাজ তিনিও করেছিলেন বলে শুনেছি, দেখিনি। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর অাঁকা তাঁর বেশ কয়েকটি কাজ দেখেছি।
আমি যখন শিল্পকলা একাডেমীতে, স্যার প্রায়ই আসতেন প্রদর্শনী দেখতে। একটা কথা প্রায়ই বলতেন; জাহাঙ্গীর তোমাদের গ্যালারির লাইটিংটা সঠিক না। লাইটিং হওয়া উচিত একটা সামগ্রিক লাইটিং, স্পট লাইট নয়। এতে ছবির ক্ষতি হয় আবার দেখতেও অসুবিধা হয়। বলেছিলাম, স্যার নতুন ন্যাশনাল গ্যালারি যখন হবে তখন ওই ব্যবস্থা করা যাবে। দুর্ভাগ্য ন্যাশনাল গ্যালারি নির্মাণের কোনো পর্যায়ে আমাকে যুক্ত হতে দেওয়া হয়নি। যদিও ওই গ্যালারির জন্য প্রজেক্ট প্রোফর্মা তৈরি করা, চার একর জমি শেরেবাংলা নগরে অনুমোদন নেওয়া – সবই আমি করেছিলাম। অজ্ঞাত কারণে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। আমি স্যারের সঙ্গে একমত হয়ে বলেছিলাম, আমি পূর্ব জার্মানির ড্রেসডেনে বাংলাদেশের চিত্রকলার প্রদর্শনী করতে গিয়েছিলাম। ওই গ্যালারিতেও যে-ধরনের আলোর ব্যবস্থা করা ছিল, ছবিটি টানানোর দেয়ালের পেছন থেকে আলো উঠে এসে সারাঘরকে একই মাত্রায় আলোকিত করা হয়েছিল সমগ্র প্রদর্শনী কক্ষগুলো।
স্যার প্রদর্শনীতে এসে অনেক দীর্ঘ সময় নিয়ে ছবিগুলো দেখতেন, যেন আত্মস্থ করতেন নিজের কাজকে আরো সমৃদ্ধ করার উদ্দেশ্যে। বলছি এ-কারণে যে, তিনি কোনো শিল্পীর কাজের সমালোচনা চট করে করতেন না। কোনো প্রশ্ন করলে একটু হাসি দিতেন, কিন্তু কিছু বলতেন না।
স্যার ধানমন্ডিতে তাঁর আধুনিক বাড়িতে উঠে এলে তাঁর বাসায় যাওয়া প্রায় হতোই না। মাঝে মাঝে চিত্রক গ্যালারিতে দেখা হতো। স্যার তখনো সুন্দর স্ত্রী করা জামা-কাপড় পরতেন – খদ্দরের ফুলহাতা শার্ট, সাদা প্যান্ট, সুন্দর পরিপাটি চেহারা। ব্যাক-ব্রাশ করা ঝাঁকড়া সাদা কালো চুল, পেছনের দিকে কোঁকড়ানো ফেঁপে থাকা, ঠিক নামজাদা অভিনেতাদের মতোই। তবে শরীরটা কেমন যেন শুকিয়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ গল্প করতেন। তিনি ওইদিন কী কী কাজ করে এলেন এবং কীরকম বিরক্তিকর এখনকার সময়ে কোনো কাজ করা, তার বিশদ বর্ণনা দিতেন।
এরপর অনেকদিন থেকেই স্যার অসুস্থ ছিলেন। বাইরে বেরোতেন না। আমারও আর যাওয়া হতো না, তবে চিত্রক গ্যালারিতে গেলে মুনির অথবা খোকন স্যারের ছেলেকে জিজ্ঞেস করতাম স্যারের শারীরিক অবস্থা জানতে। ভালো না, শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন বলে শুনতাম।
ইতোমধ্যে সুবীর এক অঘটন ঘটিয়ে ফেলল বেঙ্গল গ্যালারিতে, স্যারের প্রথম একক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এরপর আরো একটা এবং কলকাতায়ও স্যারের প্রদর্শনী হলো। এসব কাজই সম্ভব হলো মূলত বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অর্থাৎ আবুল খায়ের, মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এবং আবুল হাসনাতের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে। সম্প্রতি ইতালির প্রখ্যাত শিল্পকলা-বিষয়ক প্রকাশনা সংস্থা স্কিরা প্রকাশ করেছে সফিউদ্দীন আহমেদের সামগ্রিক কাজের ওপর একটি সুদৃশ্য মূল্যবান পুস্তক, যা বাংলাদেশের পুস্তক প্রকাশনা ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই পুস্তকে যেসব ছবি ছাপা হয়েছে তার সামান্য কিছু ছবি ২০০২ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত পুস্তকে ছিল। তবে এবার সংযোজন হয়েছে বহু ছবি যা দর্শক ইতিপূর্বে কখনো দেখেনি। স্যারের কাজের বর্ণনা দিতে গেলে দেখা যায়, চল্লিশের দশকের পর একটা পরিবর্তন এলো পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে, ঢাকার বন্যার ওপর অাঁকা ছবিতে। তাঁর বন্যা, নেমে যাওয়া বান, মাছ ধরার সময় (অ্যাকুয়াটিন্ট), কম্পোজিশন (অ্যাকুয়াটিন্ট) এই ধরনের ফর্ম মোটা লাইন-স্পেস দিয়ে ঘেরা। আবার সেতু পারাপার (এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট) আর হলুদ জাল প্রায় একই ধরনের ফ্রি-ফ্লোইং লাইন দিয়ে অপূর্ব এক গতিময়তা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে তাঁর ‘গুণটানা’ (এনগ্রেভিং) এক অবিশ্বাস্য হিন্দোলিত রেখা দিয়ে সুরের মূর্ছনার আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে। কাজটি যেন কম্পিউটারের মাধ্যমে করা হয়েছে। অথচ তিনি কম্পিউটার আবিষ্কারের অনেক আগেই কপার প্লেটের ওপর খোদাই করে এই অবিশ্বাস্য কাজটি করেছেন।
ভাষা-আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধের ওপর অাঁকা তাঁর ছবিগুলোতে তাঁর বিস্তৃত রেখার পরিধি সীমিত করে ছোট ছোট ফর্মে বিভক্ত করেছেন, চোখের সদৃশ। রেখার দৃঢ়তা আর স্বচ্ছ গতির কোনো পরিবর্তন হয়নি এতে। বিশদ আলোচনায় না গিয়ে শুধু বলতে চাই, স্যারের ‘বন্যা’ সিরিজের কাজে ‘মাছ ধরার জালে’ লক্ষ্য করা যায় কম্পোজিশনগুলো হরাইজন্টাল অর্থাৎ সমান্তরালভিত্তিক ছিল। কিন্তু এরপর ষাট, সত্তর, আশি এবং নববই দশকের কাজগুলোয় ‘সূর্য, গাছ ও মেয়ে, শরবতের দোকান, নারী ইত্যাদি কম্পোজিশন ছিল ভার্টিক্যাল বা লম্বাকৃতি। বিষয়বস্ত্ততেও ছিল অনেক ফারাক।
স্যারের শেষ জন্মদিন উপলক্ষে গিয়েছিলাম তাঁর বাসায়। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁর ওপর সদ্যপ্রকাশিত গ্রন্থ। বেশ হাত বুলিয়ে পাতা উলটে দেখলেন বইটা। খুব মনোযোগের সঙ্গে দেখলেন বইটা। অনেক শিল্পী, শিল্পবোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন সেখানে। জানালা দিয়ে আলো এসে স্যারের সাদা লম্বা চুলের ওপর পড়ছিল পেছন দিয়ে। অপূর্ব লাগছিল স্যারকে দেখতে। একটা ‘সেইন্টলি’ চেহারা স্যারের, যা আগে কখনো দেখিনি। 