দেবশিশু

ইমদাদুল হক মিলন

এইটুকু ভুলের জন্য এত বড় মাসুল দিতে হবে কল্পনাও করেননি সাদেক সাহেব। তিনি কাজ করেন একটা পাবলিশিং হাউসে। নাম ‘ছাত্রবন্ধু প্রকাশন’। মূলত নোট গাইড প্রকাশ করে। এই লাইনে দেশের এক নম্বর প্রকাশনা। মালিকের নাম মশিউর রহমান। এখনো পঞ্চাশ হয়নি বয়স। তুখোড় তরুণ। ষোলো বছর আগে আমেরিকা থেকে পড়াশোনা শেষ করে এলেন। বিবিএ, এমবিএ দুটোই আমেরিকায়। রক্তে মিশে আছে ব্যবসা। বাবাও প্রকাশক ছিলেন। ব্যবসা তেমন বড় ছিল না তাঁর। ওই ব্যবসায়ই নতুন আঙ্গিকে শুরু করল ছেলে। ষোলো বছরে নোট গাইডের জগতে নাম্বার ওয়ান হয়ে গেল। এখন শত শত

কোটি টাকার মালিক। গুলশানে একবিঘার ওপর বাড়ি করেছেন। পুরানা পল্টনে ছয়তলা বিল্ডিং কিনে অফিস করেছেন। সাদা বিএমডব্লিউ চালান। রাজকীয় কারবার। দুহাতে টাকা ওড়ান, কিন্তু ব্যবসায় দশটা পয়সাও ছাড় দেবেন না। ওই একটা জায়গায় তিনি কঠিনতম মানুষ। ঈদে-পুজোয় স্টাফদেরকে বোনাস তো দেনই, নোট গাইডের সিজন শেষ করে এক্সট্রা টাকা দেন প্রত্যেককে। ওটা আলাদা। বেতন-বোনাসের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। এই কারণে স্টাফরা আছে মহাআনন্দে। যে যত ভালো কাজ করবে সে তত বেনিফিট পাবে।

সাদেক সাহেবও পাচ্ছিলেন।

তাঁর বেতন পঁচাশি হাজার টাকা। অফিসের কাছেই ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন। চারজন মানুষের সংসার। স্ত্রী আর দুই ছেলেমেয়ে। একজন বাঁধা কাজের বুয়া আছে বহুদিন ধরে। বাজারঘাট থেকে শুরু করে সবই সামলায় সে। সাদেক সাহেবের স্ত্রীর নাম রুমা। তিনি আছেন ছেলেমেয়ে নিয়ে। ছেলে পড়ে মতিঝিল আইডিয়েলে। এ-বছর ক্লাস নাইনে উঠেছে। ভালো ছাত্র। সাদেক সাহেব চাইছিলেন, ছেলে সায়েন্স পড়ুক,    ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার কিংবা অধ্যাপক হোক। ছেলে সরাসরি নাকচ করে দিলো। সে কমার্স পড়বে। এখনকার পৃথিবী নাকি কমার্সের পৃথিবী। বিবিএ, এমবির পৃথিবী।

ঠিক আছে। পড়ো। সাদেক সাহেবের আপত্তি নেই। পড়াশোনা এমন ব্যাপার, যে যা পড়তে চায় তাই পড়া ভালো। চাপিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। চাপিয়ে দিলে ক্যেরিয়ার তৈরি করা মুশকিল।

রুমা অবশ্য আপত্তি করেছিলেন। স্বামীর মতো তিনিও চাইছিলেন ছেলে সায়েন্স পড়ুক। ছেলেমেয়েদের ওপর মায়েরাই চাপ দেয় বেশি। অমিকেও চাপ দিয়েছিলেন। সাদেক সাহেব থামিয়েছিলেন। বাবা তার পক্ষ নিয়েছে দেখে অমি খুব খুশি। বলল, আমি বাবার এমডি সাহেবের মতো আমেরিকায় পড়তে যাব। পড়া শেষ করে বিজনেসে নামব। বিজনেসম্যান হব। এমডি সাহেব আমার আইকন। আমি তাঁর মতো হতে চাই।

মেয়ে পড়ে ক্লাস সিক্সে। তার নাম মম। সে বলল, ভাইয়া যা পড়বে আমি পড়ব তার উলটোটা।

রুমা বললেন, তাহলে তুই সায়েন্স পড়িস।

না, আমি পড়ব আর্টস। ইংরেজি লিটারেচার। ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হব।

আজ সকালবেলা এইসব মনে পড়ছে সাদেক সাহেবের। ফ্ল্যাটে তিনি একা। ছেলে চলে গেছে কোচিংয়ে। কোচিং শেষ করে স্কুলে ঢুকবে। রুমা গেছে মমকে স্কুলে দিতে। বুয়া বাজারে। ফ্ল্যাটে শুধুই সাদেক সাহেব। নিজের বিছানায় শুয়ে উদাস চোখে সাজানো সংসার দেখছেন। আজ থেকে সংসারে ঢুকে গেল অনিশ্চয়তা। এই বাজারে চাকরি চলে যাওয়া মানে ভয়াবহ ব্যাপার।

ঘটনা এখনো রুমাকে তিনি বলেননি। বলবেনই-বা কোন মুখে? খুবই লজ্জার ঘটনা। রুমা এসব ব্যাপার কখনো পছন্দ করেন না। তাঁর কথা পরিষ্কার। দরকার হলে একবেলা খাব, বাচ্চারা কষ্ট করে বড় হবে, সস্তা বাসায় থাকব, তাও কোনো রকমের দু-নম্বরী বা এদিক-ওদিক করা যাবে না। ছলচাতুরী বা হারামের পয়সা খাওয়া যাবে না। এজন্য রুমাকে না বলেই কাজটা সাদেক সাহেব করেছিলেন।

ঘটনা হলো, সাদেক সাহেবরা সাতজন এক্সিকিউটিভ আছেন যাঁরা সাত বিভাগের দায়িত্বে। সাদেকের দায়িত্ব ঢাকা বিভাগ। এই বিভাগে যত জেলা-উপজেলা আছে প্রত্যেক জায়গায় যাবে বিক্রয় প্রতিনিধি। চাহিদামতো বইয়ের দোকানগুলোতে পৌঁছে দেবে বই। নগদ টাকা নিয়ে আসবে হাতে করে। টাকা বেশি হলে আনবে পে-অর্ডার। এনে জমা দেবে বিভাগের দায়িত্বে থাকা এক্সিকিউটিভের কাছে। সে পাই টু পাই হিসাব নিয়ে টাকা জমা করে দেবে অ্যাকাউন্টসে।

দিন পনেরো আগে গাজীপুরের ওদিক থেকে তিন লাখ ক্যাশ এনেছে মনির নামে রিপ্রেজেনটেটিভ। সেখান থেকে দুই জমা করেছেন সাদেক সাহেব, বাকি এক লাখ ছোট ভাইকে ধার দিয়েছেন। ভাই উত্তরার ওদিকে এক বন্ধুর সঙ্গে বায়িং হাউসের ব্যবসা করছে। খুবই ছোটভাবে শুরু করেছে। নিজের লাখ সাতেক টাকা, বন্ধুরও ওরকম টাকা। মোট চৌদ্দ-পনেরো লাখ টাকার ব্যবসা। অফিস পিয়ন ইত্যাদি খরচা বাদ দিয়ে             বিশ-তিরিশ-পঞ্চাশ হাজার হয়তো রোজগার হয় একেকজনের। এই ব্যবসার ক্যাশ টাকা দরকার। যার যত ক্যাশ সে তত লাভবান।

ভাইয়ের নাম হারুন। আটকে গেলে সে মাঝে মাঝে সাদেকের কাছে আসে। সাতদিন-দশদিনের জন্য এক দু-লাখ নেয়। সাদেকের নিজের জমানো কিছু থাকে ব্যাংকে। ওসব থেকেই দেন। এবার তিন লাখ চেয়েছিল ভাই। সাদেক দু-লাখ তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে দিয়েছেন, বাকি এক লাখ অফিসের ওই ক্যাশ থেকে। দশদিনের মধ্যেই যেহেতু টাকা এসে যাবে, তখন জমা করিয়ে দিলেই হবে। এই ফাঁকে যদি ভাইটা কিছু রোজগার করতে পারে! আগেও দুবার এভাবে হারুনকে তিনি টাকা দিয়েছিলেন। অফিস টেরও পায়নি।

এবার, তিনবারের বার ধরা পড়ে গেলেন সাদেক সাহেব। অফিস জেনে গেল। হঠাৎ করেই মনিরকে ডেকেছিলেন হেড অব অ্যাকাউন্টস রায়বাবু। তোমার কালেকশনের এই অবস্থা কেন? দু’সপ্তাহে টাকা দিয়েছ মাত্র দু-লাখ?

মনির আকাশ থেকে পড়ল। দু-লাখ না তো স্যার, টাকা দিয়েছি তিন লাখ।

মনিরের কথা শুনে রায়বাবুও অবাক। তিন লাখ দিয়েছ?

জি স্যার। সাদেক স্যারের হাতেই দিয়েছি। স্যারের সই করা ভাউচার আছে আমার কাছে। ভাউচার দেখাব?

রায়বাবু চিন্তিত। দাঁড়াও, তার আগে সাদেক সাহেবকে জিজ্ঞেস করি।

সাদেক সাহেবকে ডাকলেন তিনি। ঘটনা কী সাদেক সাহেব? মনির দিয়েছে তিন লাখ, আপনি জমা করেছেন দু-লাখ। বাকি এক লাখ কোথায়?

লজ্জায় মাথা নিচু করলেন সাদেক। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, নিজের একটা বিশেষ দরকারে…। যা হোক দিন তিনেকের মধ্যে জমা দিয়ে দেব। ব্যাপারটা আপনি একটু ম্যানেজ করুন। অফিসের কারো কানে যেন না যায়। এমডি সাহেবের কানে যেন না যায়। প্লিজ, এই উপকারটা আমার করুন। আমি আপনাকে রিকোয়েস্ট করছি। এমন আর হবে না।

রায়বাবু গম্ভীর হয়ে রইলেন, কথা বললেন না।

ভদ্রলোকের পুরো নাম ধীরেন্দ্রনাথ রায়। তিনি হচ্ছেন এমডি সাহেবের এক নম্বর বিশ্বস্ত লোক। অফিসে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা এমডিকে তিনি জানাবেন না, এ হতেই পারে না। ছোট্ট একটা কাশি দেওয়ার দরকার হলেও এমডিকে না বলে তিনি দেবেন না। সাদেক সাহেবের অনুরোধ তিনি রাখলেন না, সেকেন্ডের মধ্যে তুলে দিলেন এমডির কানে। এমডি ডাকলেন সাদেক সাহেবকে। ঘটনা ঠিক?

এমডির রুমে স্প্লিট চলছে। প্রয়োজনের চেয়েও বেশি ঠান্ডা রুম। এই ঠান্ডায়ও ঘেমে গেলেন সাদেক সাহেব। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

এমডি বললেন, আপনি আমার পুরনো লোক। আমি ব্যবসা শুরু করার সময় আপনি, রায়বাবু, রহমান সাহেব আর টিপু আমার সঙ্গে। ষোলো বছরের পুরনো লোক। প্রতিষ্ঠানের     নাড়ি-নক্ষত্র সব জানেন। আমি কী পছন্দ করি না করি তাও জানেন। অফিসের কোনো অনিয়ম যে আমি একেবারেই সহ্য করব না, এই অফিসের সবাই তা জানে। আপনার এক লাখ টাকার দরকার ছিল আমার কাছ থেকে ধার নিতেন! এই কান্ডটা করতে গেলেন কেন?

সাদেক সাহেব কোনো রকমে বললেন, ভুল হয়ে গেছে স্যার।

আপনার মতো লোক এই ভুল করে কী করে?

আমি স্যার বুঝতে পারিনি। ভেবেছি দিন দশেকের ব্যাপার, টাকা হাতে এলেই জমা করে দেবো।

তার আর দরকার হবে না। কাউকে স্যাক করলে তিন মাসের বেতন দিয়ে দিই আমরা। ওখান থেকে এক লাখ কেটে বাকিটা দিন সাতেকের মধ্যে আপনি পেয়ে যাবেন।

সাদেক হাতজোড় করে বললেন, ষোলো বছরে এই আমার একমাত্র ভুল স্যার। এবারের মতো মাফ করুন। জীবনে আর এরকম হবে না।

এমডি কঠিন গলায় বললেন, সরি। আপনি যান। কাল দুপুরের পর এসে চিঠি নিয়ে যাবেন।

শুকনো মুখে বাড়ি ফিরলেন সাদেক সাহেব। স্বামীর মুখ দেখে রুমা বললেন, কী হয়েছে? চেহারা এমন কেন?

সাদেক সাহেবের একটা মুশকিল হলো, মনে চাপ পড়লে চেহারায় তা এমনভাবে ফুটে ওঠে, লুকাবার চেষ্টা করেও লাভ নেই। যে-কেউ মুখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবে ভদ্রলোকের কোনো সমস্যা হয়েছে। আর রুমা তো পুরনো স্ত্রী, তাঁর বোঝার কথা চোখের পলকে।

রুমার কাছে ঘটনা চেপে গেলেন সাদেক সাহেব। বললেন, শরীর ভালো লাগছে না। মাথাটা ধরে আছে। ক্লান্ত লাগছে খুব। এজন্য অফিস থেকে চলে এলাম। কাল দুপুর পর্যন্ত রেস্ট নিয়ে বিকেলের দিকে যাব অফিসে।

রুমা আর কথা বলেননি।

আজ সকালবেলা, এই এখন সাদেক সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন, চিঠি নিয়ে অফিস থেকে ফেরার পর আর কিছু লুকাবেন না রুমাকে। পরিষ্কার বলে দেবেন সবকিছু। লুকিয়ে লাভ কী? দুদিন আগে-পরে ঘটনা তো তাঁকে জানাতেই হবে। যদিও সব শুনে খুবই ক্ষিপ্ত হবেন রুমা, তিরস্কারে অন্তর জ্বালিয়ে দেবেন সাদেক সাহেবের। কী আর করা? ভুলের মাসুল তো দিতেই হবে। চাকরি হারাবার চেয়ে স্ত্রীর তিরস্কার কি বেশি?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা ছাড়লেন সাদেক সাহেব, ড্রয়িংরুমে এলেন। এসেই বাচ্চাটাকে দেখতে পেলেন। বছর পাঁচেক বয়স, মাথা ন্যাড়া, টুকটুকে ফর্সা, ছেলেবাচ্চা। পরনে ঢোলা সাদা     টি-শার্ট, প্যান্ট নেই। টি-শার্ট এত লম্বা, ওতেই প্যান্টের কাজ চলছে। চোখ দুটো বড় বড়, মুখ কী রকম ফ্যাকাশে।

এক পলক তাকিয়েই সাদেক সাহেব বুঝে গেলেন, বাচ্চাটা প্রতিবন্ধী।

এই বাচ্চা তাঁর ফ্ল্যাটে এলো কোত্থেকে? ফ্ল্যাটের দরজা কি খোলা ছিল? কই আগে তো কখনো বাচ্চাটিকে দেখেননি? কোন ফ্ল্যাটের বাচ্চা?

বাড়িটা ছ’তলা। প্রত্যেক ফ্লোরে চারটা করে ছোট ছোট ফ্ল্যাট। নিশ্চয় এই ফ্লোরেরই কোনো ফ্ল্যাটের বাচ্চা। হয়তো নতুন ভাড়াটে এসেছে, তাদের বাচ্চা হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে সাদেক সাহেবের ফ্ল্যাটে। দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে গেছে।

সাদেক সাহেব দরজার দিকে তাকালেন। দরজা অল্প ফাঁক হয়ে আছে। তার মানে বাজারে যাওয়ার সময় দরজা বন্ধ করতে ভুল গিয়েছিল বুয়া। সাহেব ফ্ল্যাটে আছেন দেখে তেমন সাবধান হওয়ার দরকার মনে করেনি। তাছাড়া বাড়ির সিকিউরিটি খুবই কঠিন। বাইরের কেউ ঢুকতেই পারবে না। কেউ কোনো ফ্ল্যাটে এলে নিচ থেকে ইন্টারকম করবে। যে এসেছে তার নাম-পরিচয় বলবে, ফ্ল্যাটের লোকজন পারমিশন দিলে তবেই তাকে সেই ফ্ল্যাটে পাঠাবে। তার মানে সাদেক সাহেবের অনুমানই ঠিক। নিশ্চয় তাঁদের ফ্লোরের কোনো ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটে এসেছে, বাচ্চা সেই ভাড়াটের। সাদেক সাহেব এই ফ্ল্যাটে আছেন বছর চারেক। ফ্ল্যাট মালিক বা পুরনো ভাড়াটে যাঁরা আছেন তাঁদের প্রত্যেককেই চেনেন। বাচ্চাকাচ্চাগুলোও পরিচিত। কিন্তু এই বাচ্চাটিকে দেখেননি কখনো। নিশ্চয় নতুন ভাড়াটের বাচ্চা।

সাদেক সাহেব বাচ্চাটির দিকে তাকালেন। মন খারাপ ভাব কাটাবার জন্য কথা শুরু করলেন তার সঙ্গে। নাম বলতে পারো, বাবু? নাম কী তোমার?

বাচ্চা কথা বলে না, সাদেক সাহেবের দিকে তাকায়ও না। তার মতো করে ধীর পায়ে এদিক যায়, ওদিক যায়। হাঁটাচলা স্বাভাবিক না, একটু দুলে দুলে এলোমেলো পায়ে হাঁটছে। গা থেকে কী রকম পবিত্র ধরনের গন্ধ আসছে। বোধহয় এই বয়সী শিশুদের পারফিউম দেওয়া হয়েছে গায়ে।

কিন্তু এরকম বাচ্চা ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলো, কেউ খেয়াল করল না? যদি কোনো বিপদ-আপদ হয়? সিঁড়ি ভেঙে ওপরের ফ্ল্যাটে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে, নিচে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে, লিফটে ওঠার চেষ্টা করতে পারে। ওই করতে গিয়ে ব্যথা পেতে পারে। বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে।

না না, এরকম বাচ্চা এভাবে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হয়নি।

সাদেক সাহেব ভাবলেন, বাচ্চার হাত ধরে বেরোবেন। কোন ফ্ল্যাটের বাচ্চা, খোঁজখবর করে সেই ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেবেন অথবা সিকিউরিটির লোকজনকে ফোন করে ঘটনা বলবেন, ব্যবস্থা যা করার ওরাই করবে।

বাচ্চাটি তখন সাদেক সাহেবের বেডরুমে গিয়ে ঢুকেছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে বেডরুম দেখছে। বড় বড় চোখে শুধুই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা। একটা জিনিসও হাত দিয়ে ছোঁয় না। মুখে হাসি-আনন্দ কিচ্ছু নেই, গম্ভীর-বিষণ্ণ মুখ।

সাদেক সাহেব পিছু পিছু এসেছেন। বাচ্চাটির চালচলনে কী রকম একটা অনুভূতি হচ্ছে তাঁর। অদ্ভুত ধরনের অনুভূতি। চাইছেন বাচ্চাটির খুব কাছে যেতে, তার হাত ধরতে, হাত ধরে বাইরে নিয়ে যেতে, কিছুই পারছেন না। একেবারে কাছে যখনই যেতে চাইছেন, পা থেমে যাচ্ছে আপনাআপনি। হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরবেন, হাত থেমে যাচ্ছে। অদ্ভুত ব্যাপার!

বেডরুম থেকে বেরিয়ে বাচ্চাটি ঢুকল মমর রুমে। এই রুমটা সবচেয়ে ছোট। তিন বেডরুমের ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটে ঢোকার পর ড্রয়িং আর ডাইনিং স্পেস তারপর পাশাপাশি তিনটা রুম। মাস্টারবেডের পশ্চিমে মমর ছোট রুম, অমির রুম সবার শেষে। কিচেনও ওদিকে।

মমর রুমে কিছু খেলনাপাতি আছে, ছবি অাঁকার জিনিসপত্র আছে। শিশুরা এসব দেখলে একবার না একবার হাত দেবেই। এই বাচ্চা তা করল না। আগের মতোই তাকিয়ে তাকিয়ে সব দেখল, দুলে দুলে হেঁটে চলে গেল অমির রুমে। এই রুমেও একই কারবার। কিছুই ছোঁয় না, শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।

অমির রুম থেকে বেরিয়ে আসার পর সাদেক সাহেব আবার চাইলেন তার হাত ধরতে। অবস্থা আগের মতোই। পা চলে না, হাত চলে না। মন কাজ করছে, শরীর কাজ করছে না।

আরে, এমন কান্ড তো জীবনে হয়নি!

মম খুব চকলেট পছন্দ করে। ফ্রিজে দু-চারটা চকলেট থাকেই। ফ্রিজ থেকে দুটো চকলেট বের করলেন সাদেক সাহেব। চকলেট খাবে, বাবু? খাও, চকলেট খাও।

এবারো একই অবস্থা। চকলেট ধরা হাত বাচ্চার নাগালের কাছে পৌঁছাবার আগেই থেমে যায়।

বাচ্চা তখন অপলক চোখে তাকিয়ে আছে সাদেক সাহেবের দিকে। সাদেক সাহেব আবার চেষ্টা করলেন চকলেট ধরা হাত তার দিকে বাড়াতে, হাত এগোল না। কিন্তু বাচ্চা এগিয়ে এলো তাঁর কাছে। ডান হাতে আলতো করে ছুঁয়ে দিলো তাঁর ডান হাত। সেই স্পর্শে সাদেক সাহেবের মনে হলো, কাল অফিসে যে-ঘটনা ঘটেছে, সেই ঘটনার ফলে শরীরে-মনে যে-চাপ পড়েছে তার কোনোটাই নেই। শরীর-মন দুটোই আনন্দে ভরে গেছে, প্রফুল্ল হয়ে গেছে।

এ সময় মোবাইল বাজল। ফোনটা বেডরুমে। সাদেক সাহেব ছুটে গিয়ে ফোন ধরলেন। রায়বাবুর ফোন। এমডি সাহেব আসতে বলেছেন। চলে আসুন।

সাদেক সাহেব কোনো রকমে বললেন, আসছি।

এমডি সাহেব ডাকলে তিনি একটু দিশেহারা হন। এখনো হলেন। কী রেখে কী করবেন, বুঝতে পারলেন না। সকালের নাশতা করেছেন, গোসল করা হয়নি। যেহেতু অফিসে যেতে হবে দুপুরের পর এজন্য শুয়েছিলেন। এখন আর গোসল করার সময় নেই। কোনো রকমে শার্ট-প্যান্ট পরে বেরিয়ে গেলেই হবে।

এসব চিন্তার ফলে বাচ্চাটির কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। মনে হতেই ডাইনিং স্পেসে এলেন। বাচ্চা নেই। দরজা আগের মতোই ফাঁক হয়ে আছে। তার মানে সে চলে গেছে। যাক। কোন ফ্ল্যাটের বাচ্চা, কার বাচ্চা এখন আর ওসব ভাববার সময় নেই, এমনকি বাচ্চাটির কাছে যাওয়া বা তার হাত ধরতে যাওয়ার সময়কার অদ্ভুত ঘটনাও সাদেক সাহেবের আর মনে পড়ল না। দ্রুত অফিসের পোশাক পরে ফ্ল্যাটের দরজা লক করে বেরিয়ে এলেন। ফ্ল্যাটের তিন সেট চাবির এক সেট তাঁর কাছে। রুমার কাছে আছে এক সেট, বুয়ার কাছে আরেক সেট। কোনো অসুবিধা নেই।

নিচে নেমে রিকশার জন্য দাঁড়িয়েছেন সাদেক সাহেব, সিকিউরিটি চিফ বাচ্চু বাইরে থেকে ফিরল। এই বিল্ডিংয়ের বহুদিনের পুরনো কর্মচারী। অত্যন্ত বিনয়ী, ভদ্র মানুষ। তবে নিজের কাজের ক্ষেত্রে কঠিন, কাউকে কোনো ছাড় দেবে না। বাড়ির নিয়মকানুন একচুল এদিক-ওদিক হতে দেবে না। এতগুলো ফ্ল্যাটের কোন ফ্ল্যাটে কে থাকেন, কার কী অবস্থা, কেমন ব্যবহার, কার ফ্ল্যাটে কে এলো গেল সব তার নখদর্পণে।

বাচ্চুকে দেখে শিশুটির কথা মনে পড়ল সাদেক সাহেবের। বাচ্চুকে জিজ্ঞেস করলেই তো জানা যাবে, তাদের ফ্লোরে নতুন কোনো ভাড়াটে এসেছে কিনা, ওরকম বাচ্চা আছে কিনা কারো।

বাচ্চু অবাক হলো। না তো স্যার! গত পাঁচ মাসে আমাদের বিল্ডিংয়ে নতুন ভাড়াটে আসেনি। আপনি যে-ফ্লোরে থাকেন ওই ফ্লোরে লাস্ট ভাড়াটে এলেন আকবর সাহেব, তাও দেড় বছর হয়ে গেল। আর ওরকম বাচ্চা এই বিল্ডিংয়ের কোনো ফ্ল্যাটে নেই স্যার।

সাদেক সাহেব চিন্তিত হলেন। তুমি সিওর?

অবশ্যই। আমি স্যার এই বিল্ডিংয়ের প্রত্যেক ফ্ল্যাটের খবর রাখি। কোন ফ্ল্যাটে কতজন লোক, কার কজন বাচ্চা, বাচ্চাকাচ্চাদের নাম পর্যন্ত আমার মুখস্থ। না স্যার, আমাদের বিল্ডিংয়ে প্রতিবন্ধী ধরনের কোনো বাচ্চা নেই। কেন বলুন তো?

ঘটনা চেপে গেলেন সাদেক সাহেব। না এমনি…।

আরো দু-একটি কথা হয়তো বলতেন, তার আগেই খালি রিকশা পেয়ে চেপে বসলেন।

বাচ্চু বলল ওরকম কোনো শিশু বিল্ডিংয়ে নেই, তাহলে কাকে দেখলেন সাদেক সাহেব? কে এলো তাঁর ফ্ল্যাটে? বেশ কয়েক মিনিট ধরে তাঁর ফ্ল্যাট ঘুরে ঘুরে দেখল যে-শিশুটি, সে তাহলে কে?

না, অফিস থেকে ফিরে ভালো মতো খোঁজখবর নিতে হবে।

 

দুই

বসুন সাদেক সাহেব।

সাদেক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। এমডির কথা শুনে একপলক তাঁর দিকে তাকালেন, বসতে একটু যেন দ্বিধা করলেন।

এমডি অমায়িক গলায় বললেন, বসুন বসুন।

সাদেক আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসলেন।

কী খাবেন? চা না কফি?

সাদেক অবাক। এই কি গতকালকার সেই মানুষটি? ঘটনা জানার পর যে-ব্যবহার করলেন, মাত্র এক লাখ টাকার কারণে ষোলো বছরের পুরনো কর্মকর্তা বিদায় করে দিলেন, সেই মানুষই আজ করছেন এই ব্যবহার?

সাদেকের কী রকম অভিমান হলো। মুখ তুললেন না তিনি, কোনো রকমে বললেন, না স্যার, কোনোটাই না।

আরে খান খান। নাকি গ্রিন টি দিতে বলব?

সাদেকের গলা থমথমে। লাগবে না স্যার।

গ্রিন টি খান। খুব ভালো ব্র্যান্ডের গ্রিন টি এনেছি।

ইন্টারকম করলেন এমডি। দু-মগ গ্রিন টি দাও।

হাতের কাছে হোয়াইট মার্লবোরোর প্যাকেট। সিগ্রেট বের করে ঠোঁটে লাগালেন তিনি। লাইটার টিপে সিগ্রেট ধরালেন। চেয়ারে গা এলিয়ে একটু যেন উদাস হলেন। নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, মন খারাপ?

সাদেক কথা বললেন না। অভিমান আরেকটু তীব্র হলো।

মন খারাপ হবারই কথা। আপনি পুরনো লোক। আমার স্বভাব জানেন। বিজনেসের ব্যাপারে কোনো অনিয়ম সহ্য করতে পারি না। অনিয়ম হয়েছে শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে এক সেকেন্ড দেরি করি না।

সাদেক কোনো রকমে বললেন, আমার ভুল হয়ে গেছে।

ভুল হতেই পারে। মানুষই ভুল করে।

আমি হাতজোড় করে মাফ চেয়েছি স্যার।

সিগ্রেটে বড় করে টান দিলেন এমডি। তা চেয়েছেন।

সাদেক এবার তাঁর মুখের দিকে তাকালেন। ষোলো বছরে আমার একমাত্র ভুল। নিজের কথা বলতে চাই না স্যার। আপনি সবই জানেন। কোম্পানি আজ এতবড় জায়গায় এসেছে এর পেছনে আমারও অল্পবিস্তর কন্ট্রিবিউশন আছে…

অল্পবিস্তর না, অনেকখানিই আছে।

আমার স্যার দুঃখটা এখানেই। আপনি আমাকে মাফ করে দিলে পারতেন।

কথা বলতে বলতে চোখে পানি এলো সাদেক সাহেবের। মাথা নিচু করে সামলাবার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। টপটপ করে চোখের পানি পড়তে লাগল।

এমডি বিব্রত হলেন। কাঁদবেন না সাদেক সাহেব, কাঁদবেন না। আই য়্যাম সরি।

সাদেক কান্না-জড়ানো গলায় বললেন, আমার কোনো সেভিংস নেই স্যার। আমি যদি অসৎ লোক হতাম, আপনার ফার্ম থেকে লাখ লাখ টাকা সরাতে পারতাম। কেউ ধরতে পারত না। ওসব কখনো ভাবিনি। ছোট ভাইটাকে হেল্প করার জন্য…

ব্যাপারটা আমি বুঝেছি।

দেশের যা অবস্থা, এই অবস্থায় চাকরি চলে গেল! কবে কোথায় চাকরি পাব, কে জানে! বউ-বাচ্চা নিয়ে চলব কী করে? খাব কী? বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ চালাব কেমন করে? আমরা একেবারেই নিম্নবিত্ত পরিবারের। দশটা টাকা দিয়ে হেল্প করার কেউ নেই। শ্বশুরপক্ষের অবস্থাও আমাদের মতোই।

দুহাতে চোখ মুছতে লাগলেন সাদেক সাহেব। আপনি স্যার একবারও আমার কথা ভাবলেন না।

সিগ্রেট অর্ধেকমতো খাওয়া হয়েছে। সেই সিগ্রেটই অ্যাশট্রেতে গুঁজলেন এমডি। ভাবিনি কে বলেছে? না ভাবলে আপনাকে ডাকলাম কেন?

ভেজা চোখে এমডির দিকে তাকালেন সাদেক সাহেব। গতকালকার ভঙ্গিতে হাতজোড় করলেন। আপনি আমাকে মাফ করে দিন স্যার। আমার বাচ্চাদুটোর কথা ভেবে…

আর বলবেন না। আমি খুবই লজ্জা পাচ্ছি।

এমডি সাহেবের পিয়নের নাম বজলু। সে দু-মগ গ্রিন টি নিয়ে এলো। যেমন নিঃশব্দে এলো, তেমন নিঃশব্দে নামিয়ে রেখে চলে গেল।

টিস্যু-বক্স এগিয়ে দিলেন এমডি। চোখ মুছুন।

গলায় যেন আদেশ। সাদেক সাহেব টিস্যু নিয়ে চোখ মুছলেন।

চা খান।

সাদেক চায়ের মগ টেনে নিলেন, চুমুক দিলেন না। এমডি চুমুক দেওয়ার পর দেবেন।

চায়ে চুমুক দিয়ে আবার উদাস হলেন এমডি। সাদেক মাথা নিচু করে বসে আছেন। দেয়ালঘড়ির কাঁটা মৃদু শব্দে এগোচ্ছে।

এমডি বললেন, আমার রুম থেকে বেরিয়েই নিজের টেবিলে গিয়ে বসবেন। কাজ শুরু করবেন। রায়বাবুকে আমি বলে দিচ্ছি। ওই এক লাখ টাকা কবে দিতে পারবেন?

দু-তিনদিনের মধ্যেই পারব।

তাড়াহুড়োর কিছু নেই। সপ্তাহখানেকের মধ্যে দিলেই হবে।

ওকে স্যার।

কখনো টাকার দরকার হলে সরাসরি আমাকে বলবেন। দশ লাখ পর্যন্ত আপনাকে আমি ধার দেব। তবে কথা হচ্ছে, যেদিন বলবেন সেদিনই ফেরত দিতে হবে। ওটা মিস করা যাবে না। দরকার হলে সময় বাড়িয়ে নেবেন।

ওকে স্যার, ওকে।

আরেকটা সুখবরও আপনাকে দিচ্ছি। অফিসের কাউকে বলিনি। জানে শুধু আপনার ভাবি। তাকে না জানিয়ে আমি কিছু করি না। অফিসের লোকদের মধ্যে আপনাকেই বলছি। কারো সঙ্গে শেয়ার করবেন না।

না  স্যার, করব না।

আপনারা সাতজন এক্সিকিউটিভ, রায়বাবু, আমার পিএস নওশাদ আর অ্যাডমিনের মিন্টু – এই দশজনের জন্য দশ কাঠার একটা প্লট বুকিং দিয়েছি বসুন্ধরার পি-ব্লকে। বেশ কয়েকটা কিস্তি দিয়ে দিয়েছি। জায়গা বুঝে পাওয়ার পরপরই পাঁচতলা দুটো বিল্ডিং করব। একেকজনকে একেকটা ফ্লোর দিয়ে দেব। কোম্পানি দাঁড় করাবার জন্য আপনাদের যা কন্ট্রিবিউশন, আপনারা এটা ডিজার্ভ করেন। আপনাদের ভবিষ্যৎ আমি গড়ে দেব। চিন্তা করবেন না।

সাদেকের চোখে আবার পানি এলো। এবার কৃতজ্ঞতায়। চায়ে তখনো চুমুক দেননি। এমডি বললেন, চা খান, চা খান।

সাদেক চায়ে চুমুক দিলেন।

এবার আপনাকে একটা ঘটনা বলি।

এমডির মুখের দিকে তাকালেন সাদেক।

আজ সকালের ঘটনা। গুলশান পার্কে হাঁটতে গেছি। পার্কটা আমার বাড়ির কাছে। মিনিট পাঁচেক লাগে হেঁটে যেতে। হেঁটে যাই, হেঁটেই ফিরে আসি। আজ হাঁটতে গিয়ে দেখি ক্লান্ত লাগছে। কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি। এ-বয়সে ঘুম ভালো না হলে পরদিন খুবই ক্লান্ত লাগে। হাত-পা ভেঙে আসে। তার ওপর ডায়াবেটিস আছে। ডায়াবেটিকদের তো সমস্যার শেষ নেই! এমনিতে ঘুম আমার ভালোই হয়। কাল হয়নি আপনার কারণে। খুবই রেগে ছিলাম আপনার ওপর। বারবার শুধু মনে হচ্ছিল, এই অনিয়মটা আপনি কেন করলেন!

আই য়্যাম সরি, স্যার।

নো নো, ইটস অলরাইট। শুনুন না, কী হলো তারপর। পার্কে একটা চক্করও দিতে পারিনি, দেখি পা ভেঙে আসছে। মনে হচ্ছে হেঁটে বাড়ি ফিরতে পারব না। সুলেমান ড্রাইভার তো আমার বাড়িতেই থাকে। পেছন দিককার সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে বাড়ির কাজের লোকজন, ড্রাইভার ওদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। ভাবলাম সুলেমানকে ফোন করে বলি, পার্কে এসে আমাকে নিয়ে যাও। একটা বেঞ্চে বসেছি, এ-সময় একটা বাচ্চা এসে দাঁড়াল সামনে। বছর পাঁচেক হবে বয়স। ছেলে, ছেলেবাচ্চা। টুকটুকে ফর্সা গায়ের রং। মাথাটা ন্যাড়া। সাদা ঢলঢলে একটা টি-শার্ট পরা। প্যান্ট পরেনি। বেশ বড় বড় সুন্দর চোখ। কিন্তু মুখটা রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে। যে-কেউ তাকিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবে, বাচ্চাটা স্বাভাবিক বাচ্চা না। প্রতিবন্ধী।

এমডির কথা শুনতে শুনতে চায়ে চুমুক দিতে ভুলে গেছেন সাদেক। এ তিনি কী শুনছেন? ঠিক এরকম একটা বাচ্চাই তো…

এমডি চায়ে চুমুক দিলেন। বাচ্চাটিকে দেখে আমি অবাক। কার বাচ্চা? কোত্থেকে এলো পার্কে? ফুটপাতের টোকাই ধরনের বাচ্চা যে না, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। ভদ্রঘরের বাচ্চা। মা-বাবার সঙ্গে এসেছে নাকি? এদিক-ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম বাচ্চার সঙ্গে কেউ আছে কিনা। তেমন কাউকে দেখলাম না। কৌতূহল হলো। জিজ্ঞেস করলাম, বাবু, তোমার নাম কী? বাচ্চা কথা বলে না। আমার দিকে তাকায়ও না। পার্কের গাছপালার দিকে তাকায়, লেকের পানির দিকে তাকায়। একটুখানি হেঁটে যায়, আবার ফিরে আসে। অর্থাৎ আমার কাছাকাছিই থাকছে। হাঁটাচলা স্বাভাবিক না। একটু যেন দুলে দুলে হাঁটছে। পা এলোমেলো। বাচ্চার গা থেকে সুন্দর একটা গন্ধ আসছে। বেশ পবিত্র ধরনের গন্ধ। বোধহয় শিশুদের দামি পারফিউম স্প্রে করা হয়েছে শরীরে।

সাদেক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন এমডির মুখের দিকে। তাঁর বলতে ইচ্ছে করছে, স্যার, ঠিক এরকম একটা বাচ্চা আমার ফ্ল্যাটেও এসেছিল আজ…

বাচ্চাটি তাঁর ফ্ল্যাটে যা যা করেছিল সব বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বলতে পারছেন না সাদেক। যখনই বলার চেষ্টা করছেন, মনে হচ্ছে কে যেন থামিয়ে দিচ্ছে।

এমডি চায়ে চুমুক দিলেন। চা খাচ্ছেন না সাদেক সাহেব?

সাদেক ব্যস্ত হলো। খাচ্ছি স্যার, খাচ্ছি।

সাদেক চায়ে চুমুক দিলেন।

এমডি বললেন, শিশুটি আমার সামনে এসে দাঁড়াবার পর থেকেই আমার শুধু আপনার কথা মনে পড়ছিল। বারবার আপনার মুখটা ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কেন আপনার কথা মনে পড়ছে, কেন আপনার মুখ ভেসে উঠছে চোখের সামনে। আর ওই যে হাঁটতে ইচ্ছে করছিল না, ক্লান্ত লাগছিল, হাত-পা ভেঙে আসছিল, সেই অনুভূতিটাও নেই। বেশ তরতাজা লাগছিল নিজেকে।

এমডি আবার চায়ে চুমুক দিলেন। মগভর্তি চায়ের অর্ধেকটা খাওয়া হয়েছে। সাদেক তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে। ইচ্ছে করছে শিশুটির কথা বলতে। কিন্তু অবস্থা ওই একই রকম। বলতে চাইছেন, পারছেন না। তবে তাঁর শুধু মনে হচ্ছে, এমডি এখনই বলবেন, শিশুটিকে আমি হাত বাড়িয়ে ধরতে চাইলাম…

ঠিক এই কথাটাই বললেন এমডি। বাচ্চাটি আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছে হলো, ওর হাতটা ধরি। এত সুন্দর গন্ধ শরীরে, প্রতিবন্ধী শিশু, জড়িয়ে ধরে একটু আদর করি। হাত বাড়িয়ে তার একটা হাত ধরতে গেলাম, আশ্চর্য ব্যাপার, দেখি হাত এগোয় না। কে যেন জোর করে থামিয়ে রাখছে। তিনবার চেষ্টা করলাম, পারলাম না। অদ্ভুত একটা পরিবেশ। ভেতরে ভেতরে খুবই অবাক লাগছে। এরকম অবস্থায় কখনো পড়িনি। আর শুধু মনে পড়ছে আপনার কথা।

এমডি এবার দ্বিতীয় সিগ্রেটটি ধরালেন। সিগ্রেটে টান দিয়ে এক চুমুক চা খেলেন। সাদেক সেই ফাঁকে মনে মনে বললেন, আমি জানি, তারপর কী ঘটেছিল। শিশুটি আপনার চোখের দিকে তাকিয়েছিল, আপনার ডান হাত ছুঁয়ে দিয়েছিল…

এমডি বললেন, বাচ্চাটি এদিক-ওদিক সামান্য হেঁটে একসময় আমার খুব কাছে এসে দাঁড়াল। খানিক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। ডান হাত বাড়িয়ে আলতো করে আমার ডান হাতটা একটুখানি ছুঁয়ে দিলো। স্পর্শটা কেমন যেন! খুব যে ঠান্ডা হাত বা গরম হাত তা না। কেমন যেন। অস্বাভাবিক। সেই স্পর্শে আমার ভেতরটা একটু যেন বদলে গেল। তখনো কিন্তু মনের মধ্যে আপনি, চোখের সামনে আপনার মুখ। আমার শুধু মনে হচ্ছে, আপনাকে আমি ক্ষমা করে দিই। এমন কিছু অন্যায় আপনি করেননি। এই সামান্য কারণে এতদিনকার পুরনো লোককে আমি বিদায় করতে পারি না, তার সংসার, বাচ্চাকাচ্চা আছে…

একটু থামলেন এমডি। আমি যখন এসব ভাবছি, দেখি বাচ্চাটা পার্কের ঝোপঝাড়ের দিকে যাচ্ছে। যায় আর আমার দিকে ফিরে ফিরে তাকায়। মনে হলো মোবাইলে বাচ্চাটার একটা ছবি তুলে রাখি। সে আমার দিকে আবার তাকাল, চট করে তার একটা ছবি তুললাম। তখন আমার আর মনে হচ্ছে না, কার বাচ্চা, কোত্থেকে এলো পার্কে, কোথায় চলে যাচ্ছে একা একা…। অদ্ভুত ব্যাপার না, বলুন?

সাদেক মাথা নাড়ল। জি স্যার, অদ্ভুত ব্যাপার।

ওই পার্কে বসেই আমি রায়বাবুকে ফোন করলাম। আপনাকে অফিসে আসতে বললাম, আমার সঙ্গে দেখা করতে বললাম। কারণ ওই বাচ্চাটি ঝোপঝাড়ের আড়ালে চলে যাওয়ার আগেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আপনার ব্যাপারে মনোভাবটা আমি বদলাব।

এমডি চায়ে চুমুক দিলেন, সিগ্রেটে টান দিলেন।

সাদেক ভেবেছিলেন অফিস থেকে ফিরে ভালোমতো খোঁজখবর নিতে হবে শিশুটির। বাচ্চুর তথ্যের ওপর নির্ভর করে থাকা যাবে না। এখন মনে হচ্ছে তার আর দরকার নেই। ওই শিশু এই জগতের কেউ না। তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। তার বাস অলৌকিক কোনো জগতে। বিপদে পড়া, অসহায় মানুষের পাশে সে এসে কখনো কখনো দাঁড়ায়। ভুল করা মানুষের ভুল শুধরে দেয়। মানুষকে ক্ষমা করতে শেখায়!

এমডি সাহেব ফোন অন করে সাদেকের দিকে এগিয়ে দিলেন। এই যে দেখুন, সেই বাচ্চার ছবি।

সাদেক জানেন, সকালবেলা যে-শিশু তাঁর ফ্ল্যাটে এসেছিল, ছবি সেই শিশুরই। তবু তিনি মোবাইল স্ক্রিনে তাকালেন। হ্যাঁ, এই তো সেই শিশুর ছবি!