দেবী : প্রতীকে, আখ্যানে রূপান্তরের গল্পকথা

একটা গল্পকে কী করে চলচ্চিত্র বলে ওঠা যায়? হতে পারে তা নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে ঘিরে কিংবা কোনো একটা ঘটনাকে ঘিরে। গল্প বলার ধরনে এবং গড়নে চলচ্চিত্র সামগ্রিক একটা রূপ লাভ করে গল্প বলার ক্ষেত্রে। গল্প নিয়েই যেহেতু আলোচনাটা শুরু হলো, এক্ষেত্রে বলে নেওয়া ভালো, এ-গল্প যদি ধার করা বা অবলম্বনের ওপর ভর করে নির্মিত হয় তবে তার কতটুকু দায়ভার থাকে মূলকে ধরে রাখার বা খেয়াল রাখার।

কথা বলতে যাচ্ছি যে-চলচ্চিত্র নিয়ে, এর শিরোনাম দেবী। ২০১৮-তে অভিনয়শিল্পী জয়া আহসানের প্রযোজনায় এবং
চলচ্চিত্র-নির্মাতা অনম বিশ্বাসের পরিচালনায় এটি হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলি সিরিজের দেবী উপন্যাসের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত। এই যে ‘মিসির আলি’; একটা বহুচেনা কিংবা বলা চলে একটা অঞ্চলের মানুষের বেশ পঠিত এক চরিত্র, যে-অঞ্চলে এ-চলচ্চিত্রও নির্মিত হলো – তার ভিত্তিতে ‘মিসির আলি’কে লেখকের লেখা মিসির আলি রূপে প্রকাশের কোনো দায় চলচ্চিত্র-নির্মাতার থাকে কি? ব্যক্তিগতভাবে যে-কোনো গল্প কিংবা চরিত্রকে ভেঙে কিংবা পুনর্নির্মাণের মধ্য দিয়ে নিয়ে গিয়েই চলচ্চিত্র নির্মিত হতে পারে। এতে বিশেষ ভাবনার কিংবা অসুবিধার কিছু নেই বটে! সাহিত্য বা অন্য যে-কোনো মাধ্যম থেকে চিত্রনাট্য লেখার ক্ষেত্রে চিত্রনাট্যকার, পরিচালককে এটুকু ছাড় দেওয়াই উচিত, অর্থাৎ যেটুকু তিনি বা তাঁর টিম গ্রহণ করে চলচ্চিত্রের গল্পকে এগিয়ে নিতে চাইছেন, সেটুকু নিয়েই গল্পটা গড়ে উঠতে পারে।

ভাবনা বরং যে-পয়েন্টে হতে পারে তা হলো, দর্শকমন বা পাঠকমন মিসির আলিকে যে সেই ‘মিসির আলি’রূপেই দেখতে চাইছিলেন, তার পেছনে পূর্বেই দর্শককে ভাবিয়ে রাখা ‘মিসির আলি প্রথমবার’ এই প্রচারের ভূমিকা কতটুকু। সেই বিজ্ঞাপন কিংবা প্রচারের ধাঁচ নিয়ে চলচ্চিত্রের প্রচার-প্রসারের টেকনোলজি বা কৌশলবিষয়ক অন্য আলোচনার অবকাশ অবশ্যই থাকে তবে  তা একেবারেই ভিন্ন প্রসঙ্গ। আপাতত আমরা গল্পে থাকতে চাই। তো চলুন দেখি চলচ্চিত্র দেবীর গল্প। যেহেতু উপন্যাসকে ভেঙেচুরে চলচ্চিত্রের গল্প দাঁড়াতেই পারে বলে মনে করি, এমনকি যে-কোনো সাহিত্য থেকেই দৈর্ঘ্যে ছোট্ট একটা অংশ ধার করে সমস্তটা অন্যরকমভাবে সাজিয়েও চলচ্চিত্র হতেই পারে, তাই উপন্যাসের সাপেক্ষে এ-গল্পের আলোচনায় যাচ্ছি না।

বরঞ্চ পোস্টার ডিজাইনগুলো একটু দেখে আসতে পারি। চলচ্চিত্র মুক্তির আগে কিংবা চলচ্চিত্র দেখার আগেই মনে হয়েছিল পোস্টার ডিজাইন গল্পের ভিন্ন ভিন্ন আমেজকে ধারণ করে দাঁড়িয়েছিল। অর্থাৎ দেবী চলচ্চিত্রের গল্প কী বলে, তা পোস্টার আলোচনা সাপেক্ষে কিছুটা ধারণা করে নেওয়া সম্ভব। একেবারে প্রথম পোস্টারে দেখা যায় মিসির আলিরূপে চঞ্চল চৌধুরী ক্যানভাস জুড়ে দাঁড়িয়ে।
মাথার চারপাশে উড়ছে পাখিরা আর একটা গোলকধাঁধা যেন চক্রাবৃত্ত আকার ধারণ করতে করতে মিলিয়ে যাচ্ছে, পাখি হয়ে মুক্ত হচ্ছে রহস্য! কিন্তু সিনেমার গল্প তো শেষ অবধি তা নয়! বরং আরেকটি পোস্টারও প্রকাশিত হয় দেবীর, যা অন্য এক আমেজের গল্পের দিকে দৃষ্টি কেড়ে নেয়। জলের ওপর রাণুরূপী জয়া আহসানের মধ্য থেকে জেগে উঠছে নীলুরূপী শবনম ফারিয়া। জলের ওপর দেবীর পুজোতে ব্যবহৃত লাল জবাফুল, জলের ভেতর হাতড়ে-ফেরা দুটো হাত। আদতে চলচ্চিত্রের গল্প আমাদের সেদিকেই নিয়ে চলে গেছে। দেবী নারীসত্তার গল্পই বলতে চেয়েছে!

দেবীর গল্পে রাণু এক অন্য অস্তিত্বের ডাক শোনে নিজের ভেতর কিংবা চারপাশে! এই ডাকের সঙ্গে তার অতীত জড়িত, এই মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার ব্যাপারে তার চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত বর আনিস শঙ্কিত ও চিমিত্মত। এদিকে দেখা যায় রাণুর সিক্সথ সেন্সও প্রবল।

এ পর্যায়ে চলচ্চিত্রে মিসির আলির প্রবেশ এই সমস্যার জট খোলার জন্য। মিসির আলি মনোচিকিৎসক নন বটে তবে তিনি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। মনোবিদ্যার শিক্ষক। রাণুর সঙ্গে তার আলাপপর্ব কিংবা কাউন্সেলিং সেশন শুরু হয়। একে একে বের হয়ে আসে রাণুর অতীত, তার কৈশোর, কৈশোরে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনা এবং অপরাধীর নাম। অপরাধী জালালউদ্দিনের কথা যে রাণুর মনোজগতে স্থায়ীভাবে গেঁথে আছে, তাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে মিসির আলির সঙ্গে রাণুর
কথোপকথনে। জলের ঘটনা আর মৃতদেহের সঙ্গে জালালকে মিশিয়ে এক অন্য সত্যকে মনোজগতে স্থান দেওয়া রাণুর মানসিক দ্বন্দ্ব এখানে পরিষ্কার।

আরেকদিকে নীলু, আনিস-রাণুদের বাড়িওয়ালার মেয়ে, সহজ-সরল নিত্যদিন যার যাপনে। সেই নীলু এক যুবকের প্রেমে পড়ে এবং রাণুর বিপদের আশঙ্কাকে সত্য করে দিয়ে বিপদেও পড়ে। রাণু এবং নীলুর জীবন এই স্থানে এক হয়ে যায় যে, নারীর জীবনে যৌন নির্যাতন কিংবা প্রতারণার গল্প আজীবনের এক মানসিক ট্রমা! মূল চলচ্চিত্রের গল্পের সারমর্ম মোটামুটি এই। তবে এখন যদি গল্পের ভিত্তিতে কোন জরার চলচ্চিত্র এটি, তা নিয়ে আলোচনা হয় তবে এ-আলোচনা হতেই পারে সাইকোলজিক্যাল ড্রামা নাকি সাইকোলজিক্যাল হরর ড্রামা কোন অংশটুকু অধিক শক্তিশালী। সে-আলোচনার আগে চলুন চলচ্চিত্রে গল্প বলার কলাকৌশল আর সাজসরঞ্জামগুলো দেখে আসি।

গল্প বলে যাওয়ার গাঁথুনি দেবী চলচ্চিত্রে চমৎকার! এটা স্বীকার করতেই হবে যে, ইদানীংকালের চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে গল্প বলে যাওয়ার কলাকৌশলে দেবী উলেস্নখযোগ্য। সম্পাদনা দারুণ! বিশেষভাবে উলেস্নখ করার মতো হলো এ-চলচ্চিত্রের
শব্দ-পরিকল্পনা। বিশেষত সিনেমা হলে একেক লেয়ারের শব্দগুলোকে পৃথকভাবে বুঝতে পারা। শব্দের আপ-ডাউনের ব্যাপারে সূক্ষ্ম সচেতন কাজ। অনেকবারই দর্শক আশপাশে তাকিয়েছেন। এই যেমন নীলুকে যখন ডাকছে তার ছোটবোন পাশের রুম থেকে, এসবই দর্শকদের চলচ্চিত্রকে উপভোগ করতে সাহায্য করেছে বলেই মনে হচ্ছিল। শব্দের এরকম ব্যবহার দর্শকের মাঝে সিনেম্যাটিক বাস্তবতার জায়গাটা স্পষ্ট করে তোলে। যুক্ত রাখে সেই আবহ কিংবা ঘটনার সঙ্গে।

রং নিয়ে ভাবনার ব্যাপার ছিল এই চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্রের কালার টোন জলের মতো মনে হচ্ছিল, জলের রঙের। যেহেতু জলের সেই ঘোলাটে চরিত্র এই চলচ্চিত্রের আমেজের সঙ্গে যায়। এটা বেশ! শট-পরিকল্পনা আর কম্পোজিশনেও বেশ যত্নের ছাপ ছিল। রাতের আঁধারে হঠাৎ দেখা যায় রাণু বিল্ডিংয়ের ছাদে দু-পা ঝুলিয়ে বসে আছে। রাণু আর পেঁচা পাশাপাশি থাকার সেই দৃশ্য কিংবা মিসির আলির ঘরে সেই যে ফ্রেম উইদিন ফ্রেমের কম্পোজিশনগুলো। এরকম বেশকিছু নান্দনিক শটের ব্যবহার আছে এ-চলচ্চিত্রে।

শিল্প-নির্দেশনার ক্ষেত্রে মিসির আলির থাকার জায়গা মিসির আলি চরিত্রের আমেজ রেখে তৈরি বলে মনে হয়েছে। কমোডের মধ্যে গোলাপগাছের চারা লাগানোর বিষয় কিংবা চারিদিকে সবুজ নিয়ে বসে থাকা মিসির আলি এক অন্য অর্থ নিয়েও উপস্থিত। মিসির আলি তো শেষমেশ নিজের মধ্যে তারুণ্যের কৌতূহলই ধরে রেখেছিলেন। তবে নেতিবাচক চরিত্র ইরেশ যাকেরের বাসার আবহ অনেকটাই গতানুগতিক মনে হয়েছে।

এই চলচ্চিত্রে মন্তাজের ব্যবহার নিয়ে কথা বলার শুরুতে গল্প বলার শুরু যে-দৃশ্য দিয়ে, তা নিয়ে এক ছটাক কথা থাকে! শুরুটা হয় ১৭৫৭ সালের এক ঘটনা দিয়ে। এক দেবী প্রতিমার সামনে এক বালিকার শিরশ্ছেদ দিতে উদ্ধত জল্লাদের কাটা মাথা গড়িয়ে পড়ে  মেঝেতে। বালিকা বেঁচে যায়। এই ১৭৫৭ কেন? সাধারণভাবে ধরে নিলে গল্পটা এমন হতে পারে যে, এই দেবীপ্রতিমা যা পরিত্যক্ত, সমাজের এক কোণে পড়ে থাকা, তা হয়তো এই ১৭৫৭ বা এর আগে থেকেই এখানে। যে ১৭৫৭ থেকে ইংরেজ শাসন শুরু হয়, যে ১৭৫৭ সাল থেকে বাংলার মানুষের পরাজয়ের ক্ষত আর ভবিষ্যতের ভয় কিংবা আশঙ্কার শুরু; সেই ১৭৫৭-তেও কোথাও না কোথাও প্রতিবাদের আগুনটুকুও অবশিষ্ট থেকেই গিয়েছিল কি? সেজন্যই কি এটুকু দেখা যায়, এক নৈঃশব্দ্যের রাতে এক অন্যায় সংঘটিত হওয়ার মুহূর্তে কোনো সত্তা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়।

সেই ১৭৫৭ সালে বা তৎকালীন সময়ে যখন আফগান সৈন্যরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্ম-গোত্র নির্বিশেষে অনেক নারীকে ধর্ষণ করে। যে-যুদ্ধ তখন শুরু হয় সে-সময় থেকে নারীর মধ্যে প্রতিরোধও কি শুরু হওয়ার ইঙ্গিত থাকে আসলে? কারণ এই নারী কিংবা দেবীর প্রতিমা কিন্তু ঘরে বসে থাকা, ধর্মাধর্মের পবিত্রতা মাখিয়ে মাথায় তুলে রাখা প্রতিমা নয়। পুজো করা কিংবা বিসর্জনে মহাসমারোহে ভাসিয়ে দেওয়া দেবীও নয়, এমনকি সাজানো-গোছানো মন্দিরেও ঠাঁই পাওয়া কেউ নয় সে। এ পোড় খাওয়া, পরিত্যক্তা, চুপচাপ গ্রামের এক কোণে সমাজ-শৃঙ্খল থেকে বিচ্ছিন্ন পড়ে থাকা এক সত্তা! যে সমাজবিচ্যুত এবং একা!

দেবীর এই যে প্রতীকী ইমেজ বা আদল এটুকু আগ্রহোদ্দীপক এক জায়গা এই চলচ্চিত্রের। এই দেবীর কাছে রাণু যায়, তার কৈশোরের অগ্রভাগে। যে-সময় শৈশব ছেড়ে কৈশোরে পা রাখতে না রাখতেই বেশিরভাগ বাঙালি নারী বাঁধা পড়ে যায়, সমাজ-সংস্কারের আগল তাদের পায়ে পায়ে জড়াতে থাকে। সেই সময় রাণু খেলতে নয় কেবল, গল্প করতে, এক অত্যাশ্চর্য পৃথিবী নিজের মধ্যে নিজে গড়ে নিতে যায় দেবী কিংবা দেবীরূপী নিজের মানসের কাছে। চলচ্চিত্রে এর প্রকাশও চমৎকার, যখন কৈশোরের ঘটনা বলতে গিয়ে খুব হারিয়ে যেতে যেতে রাণু বলছে – খেলতে যেতাম, ভাল্লাগতো তাই …

এরকম কথার পরে কিশোরী রাণুর প্রতিমার সামনে হেসে বেড়ানো, নেচে নেচে ঘোরা এক জাদুময় আবেশ তৈরি করে! বোঝা যায় রাণুর পৃথক, একান্ত নিজস্ব এক জগৎ ছিল কিংবা আছে! দেবী রাণুর নিজেরই মানসগঠন। নিজের মানসিক শক্তির জোর। যে-দেবী রাণুর মধ্যে, আশপাশেই আছে বলে ভাবতে থাকে সে তা কি তারই মধ্যে তৈরি হওয়া আরেক অস্তিত্ব নয়? সেই অস্তিত্ব যা তাকে শক্তি জোগায়, যা তার সিক্সথ সেন্সকে প্রগাঢ় করে তোলে।

এ-বিষয় আরো স্পষ্ট হয় তখনই যখন বোঝা যায় কিংবা ধারণা করা যায় যে, নিজের মানসিক শক্তির জোরেই সে মোকাবেলা করে যৌন নির্যাতনের। প্রতি নারীসত্তাই সেই জোর ধারণ করুক তাই স্বাভাবিকভাবে রাণুও চাইতে থাকে মনে মনে! রাণু বুঝতে পারে নীলুর বিপদ। যে-নীলু আনিস-রাণুদের বাড়িওয়ালার মেয়ে,
সহজ-সরল নিত্য যার যাপন। সেই নীলুকে দেখে কৈশোরের সেই সহজ-সরল রাণুকে খুঁজে ফেরা অস্বাভাবিক কিছু নয় একজন মানসিকভাবে অস্থির মানুষের জন্য। আবার নীলুর রাণুকে বলা যে তাকে দেবীর মতো লাগছে – এই কথাটাও রাণুর জন্য ট্রিগার পয়েন্ট, যেহেতু চলচ্চিত্রে দেখানো হয় রাণু বিশেষভাবে কথাটি লক্ষ করে।

নীলুর মাঝেও আদতে রাণু সেই জোর প্রত্যাশা করে কিংবা বিশ্বাস করে, তার পক্ষেই সম্ভব নীলুকে উদ্ধার করা যেহেতু সে নিজে নিজেকে উদ্ধার করতে পেরেছিল একসময়! তবে শেষ অবধি পরিচালক সে-জায়গায় গল্পকে রাখেন কি না তা নিয়ে জরাভিত্তিক আলোচনায় বিস্তারিত কিছু কথা বাকি থাকে! অন্যান্য মেটাফোরের আলোচনা এই ফাঁকে সেরে নেওয়া যায়।

এ-চলচ্চিত্রে জলও তার প্রতীকী চরিত্র নিয়ে উপস্থিত। জলের রহস্যও তাই রাণুর মানসিক জগতেরই খেলা! জলকে ঘিরে রহস্য সে নিজেই নিজের মধ্যে তৈরি করে। রাণু ভুলতে পারে না জালালউদ্দিনকে কিংবা সে-ঘটনাকে কখনো। জলের ভেতরের মৃতদেহ তাই তার মনে জালালউদ্দিন হয়ে তাড়া করে! এই যে জলের ভেতরের রহস্য তা তার মনোজগতে একটা মৃত, অবশ অথচ সেইসঙ্গে খুবই জীবন্ত এক অতীত রহস্যেরই জট!

এসব বিবেচনায় এখন অবধি এই চলচ্চিত্র সাইকোলজিক্যাল ড্রামাই হয়ে উঠতে পারত বেশ সফলভাবে! কিন্তু এটি সাইকোলজিক্যাল ড্রামা নয়, তবে কি সাইকোলজিক্যাল হরর ড্রামা?

হ্যাঁ, বিভাজনের এসব সংজ্ঞায়নে সেদিকেই যেতে হবে আপাতত! কেননা, এখানে অশরীরীর স্পষ্ট ছায়া দেখা যায়। হরর জরা ছাপিয়ে কেবল সাইকোলজিক্যাল ড্রামা জরার অন্তর্ভুক্ত এ-চলচ্চিত্রকে অনায়াসে করা যেত যদি না রানুর আশপাশে অযথাই দুটো বাচ্চার অবয়ব বা উপস্থিতি না থাকত।

হ্যাঁ, কেবল রাণু নয়, যেহেতু অৃন্য চরিত্ররাও সেই ছায়া দেখছে, তাই এ-ছায়াদুটোকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না কিছুতেই। যদিও চলচ্চিত্রে সামগ্রিকভাবে এ দুটো শিশুর ছায়ার উপস্থিতি পৃথক কোনো ডাইমেনশন যোগ করেনি আসলে। এমনকি আনিসও যখন রাণুর সঙ্গে সঙ্গে শব্দ শুনতে পায়, তাকে যদি দীর্ঘকাল রাণুর সঙ্গ আর রাণুর অসুস্থতায় আনিসের নিজের ক্লামিত্মর ফল ধরেও নিই, আরো একটি দৃশ্য একে জোর করে হরর জরার মধ্যেই নিয়ে ফেলে। তা হলো উড়ে আসা তীর আপনা-আপনি ইরেশ যাকের তথা আহমেদ সাবেতের শরীরে গেঁথে যাওয়া। এই চলচ্চিত্রের গল্প বলার ধরন, গল্পের গাঁথুনি চমৎকার এক সাইকোলজিক্যাল আখ্যানই হয়ে উঠছিল কিন্তু শেষমেশ এ-চলচ্চিত্র তা নয় বটে।

দেবীতে কুশীলববৃন্দের অভিনয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করলে প্রথমেই আসবে রাণু ওরফে জয়া আহসানের কথা। জয়া আহসানের এ-গুণ আছে যে, চরিত্রকে তিনি নিজের মতো করে একটা অবয়বে দাঁড় করাতে পারেন। রাণুর অস্থিরতা, মানসিক অবসন্নতা, শেষপর্যায়ে প্রচ- বিধ্বস্ততা – এরকম চরিত্র চিত্রায়ণে জয়া বেশ পারদর্শী ছিলেন এ-চলচ্চিত্রে। কৈশোরের রাণু চরিত্রে লাবণ্য চৌধুরীর অভিনয়ও ভালো ছিল।

আনিস ওরফে অনিমেষ আইচ রাণুর মধ্যবিত্ত সোজাসাপ্টা বরের চরিত্রে মানিয়ে গেছেন বটে। তবে ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি মাঝে মাঝে চরিত্রের চিত্রায়ণে ব্যাঘাত ঘটায়।

ইরেশ যাকের তথা আহমেদ সাবেতের অভিনয় একজন সাইকোপ্যাথের চরিত্রে বেশ গড়পড়তাই। যেটুকু মজা জমে তা গল্পের টার্নিং পয়েন্ট বা টুইস্টের জন্যই মনে হলো।

এ-চলচ্চিত্রে নীলু চরিত্রে শবনম ফারিয়া বেশ সাবলীল ছিলেন। সুন্দরভাবে চরিত্রটির যাত্রা নির্মাণ করতে পেরেছেন প্রথম থেকে শেষ অবধি।

মিসির আলি, যে-চরিত্র নিয়ে কল্পনা পরতে পরতে জমে ছিল, সে-চরিত্র প্রোটাগনিস্ট নয়, এ-চলচ্চিত্রে স্বাভাবিকভাবেই তার
ব্যাপ্তি অতটা গভীর ছিল না। বেশ কয়েকটি জায়গায় মিসির
আলিরূপে চঞ্চল চৌধুরীর সংলাপ প্রক্ষেপণ কিংবা অনুভূতি তেমন গভীরতা সৃষ্টি করেনি চরিত্রটিকে ঘিরে দর্শকের মনে। কিছু কিছু জায়গায় চরিত্রের প্রকাশ বেশ ভালো ছিল, যেমন রাণু বা জয়া আহসানের সঙ্গে অতীত কিংবা রহস্যকে ঘিরে কথোপকথনের অংশগুলোতে।

অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে নীলুর ছোট বোন বিলুর চরিত্রে অহনা তেমন একটা কাজ করার সুযোগ পাননি বলেই মনে হয়েছে।

চলচ্চিত্রটিতে আরেকটি বিশেষ ভালো লাগার জায়গা এর টাইটেল। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টাইটেলের প্রতি যত্মশীল থাকেন না নির্মাতারা। সেক্ষেত্রে দেবী ব্যতিক্রম। টাইটেলের গ্রাফিক্স ডিজাইন, ফন্ট নির্বাচন এবং সামগ্রিকভাবেই টাইটেলের পরিকল্পনা প্রশংসার দাবি রাখে।