দেশভাগের তাত্ত্বিক উপন্যাস

শরীফ আতিক-উজ-জামান

 

দুই নগর

তানভীর মোকাম্মেল

ক্রিয়েটিভ ঢাকা লিমিটেড

ঢাকা, ২০১৬

২৫০ টাকা

 

বিগত শতাব্দীতে বাঙালির জীবনে ঘটে যাওয়া দুটি মানবিক বিপর্যয়ের একটি হলো একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙন, আরেকটি দেশবিভাগ। প্রথম বিপর্যয়ের জন্য ব্যক্তি বা সমষ্টির মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক কারণটি জোরালো ছিল, আর দ্বিতীয় বিপর্যয়টি ঘটেছিল মূলত রাজনৈতিক অবিমৃশ্যকারিতায়, যার ব্যাপকতা ও গভীরতা এতোই ভয়াবহ ছিল যে, উত্তর-প্রজন্ম এখনো সেই ক্ষত বহন করে চলেছে। একক ও যৌথ পরিবারের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে বিতর্ক বিশেষ কোনো উপসংহার টানতে না পারলেও পরিবর্তিত সামাজিক প্রেক্ষাপটে যৌথ পরিবারের ভাঙনকে সবাই স্বীকার করে নিয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন পক্ষে বা বিপক্ষে হওয়ায় সেভাবেই সবাই পারিবারিক পর্যায়ে সমঝোতা করে নিয়েছে; কিন্তু সাম্প্রদায়িক সত্তার ভিত্তিতে ভৌগোলিক বিভাজন কোটি-কোটি মানুষকে শুধু ভিটেমাটি ত্যাগেই বাধ্য করেনি, প্রাণ কেড়েছে, নিঃস্ব করেছে এবং অভিবাসী দেশে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করেছে। আর যারা জেদি মাছির মতো ভিটেমাটি আঁকড়ে থেকেছে, তারা পরিণত হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে। রাষ্ট্রের বৈধ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তারা নানা বৈষম্যের শিকার যেমন হন, তেমনি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হয়। পারস্পরিক সন্দেহ, ঘৃণা ও দ্বন্দ্ব তাদের সেই দূরত্বকে আরো বাড়িয়ে তোলে। তাই এখনো থেকে থেকেই ঘটে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন এবং পরিণামে তাদের বেদনাদায়ক দেশত্যাগ। ১৯৪৭ সালের সূচনালগ্নের সেই হত্যা-লুণ্ঠন-নির্যাতনের গস্নানি থেকে মুক্ত হতে পারছে না উত্তর-প্রজন্ম।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই ব্রিটিশরাজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে, ভারত থেকে তাদের সাম্রাজ্য গুটিয়ে নেবে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির নতুন মেরুকরণ, সাম্রাজ্যবাদের নিজস্ব সংকট ও ভারতের অভ্যন্তরে ব্রিটিশবিরোধী দীর্ঘ গণআন্দোলনের চাপ – সব মিলিয়ে ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরেই ভাইসরয় ওয়াভেল ক্ষমতা হস্তান্তরের ইঙ্গিত দিলেন। তিন মাসের মধ্যে ব্রিটিশ কেবিনেট মিশন এসে ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতি ও সংবিধান নিয়ে যে-প্রস্তাব দিলেন, কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কেউই তা পছন্দ করতে পারেনি। নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করে তারা সম্মতি জানালেন বটে, কিন্তু বিরোধের বীজ নিহিত ছিল ওই প্রস্তাবের মাঝেই। কংগ্রেস-মুসলিম লীগ অনড় অবস্থানে চলে গেলে সংঘাতের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতায় যে-ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় তার প্রভাবে নোয়াখালিতে হিন্দু নিধন এবং বিহার ও উত্তরপ্রদেশের গড় মুক্তেশ্বরে মুসলিমদের ওপর পৈশাচিক হামলা হয়। অক্টোবরে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ অন্যদের নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে যে-সরকার গঠন করল তা যে টিকবে না তা সবাই বুঝতে পেরেছিলেন। ১৯৪৭ সালের গোড়ার দিকেই ব্রিটিশরাজ বিকল্প ভাবতে শুরু করে। এক বছরের মধ্যেই ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা দিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ভিসকাউন্ট মাউন্টব্যাটেনকে ভাইসরয় করে ভারতে প্রেরণ করেন। তিনি এসে তিন মাসের মধ্যে দেশভাগের ঘোষণা দিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, দ্রম্নত ব্যবস্থা না নিলে দেশটা গৃহযুদ্ধের দিকে চলে যাবে। বিভাজনের পক্ষে তাঁর সায় ছিল না, ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উসকানি না থাকলে তিনি দেশভাগের মীমাংসায় রাজি হতেন না বলে পরবর্তীকালে নিজেই উলেস্নখ করেছেন। এর সত্যাসত্য নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে; কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই মীমাংসা সেই সংঘাতকে এড়াতে পারেনি, বরং হত্যা-লুণ্ঠন-ধর্ষণ-দখলদারি-বাস্ত্তত্যাগ মিলিয়ে ভয়াবহ এক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট থেকে শুরু করে ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দাঙ্গার রক্ত ধুতে-ধুতে ভারতবাসী পেল এক দ্বিখ–ত ভূখ-। এই বিভাজনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো পাঞ্জাব আর বাংলা। এখানকার জনগণের ওপর তার প্রতিক্রিয়া ছিল বেদনাদায়ক ও সুদূরপ্রসারী।

সাহিত্য মানুষের বিচিত্র অভিজ্ঞতার শিল্পরূপ। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই যে, বাঙালির জীবনে ঘটে যাওয়া এই মহাসংকট সাহিত্যে যেভাবে আসা উচিত ছিল সেভাবে আসেনি। কৃষণ চন্দর, সাদাত হাসান মান্টো, খাজা আহমেদ আববাস, ভীষ্ম সাহানী, খুশবন্ত সিংরা যেভাবে এই বিপর্যয়ের চিত্র এঁকেছেন বাংলা সাহিত্যে তাৎক্ষণিকভাবে রচিত কিছু ছোটগল্পে তার প্রতিফলন দেখা গেছে মাত্র। যদিও এক ঋত্বিক ঘটকই সেলুলয়েডে এই মর্মযাতনার অনেকটাই ধারণ করেছেন। সংগীত-চিত্রকলায় দেশবিভাগ অনুপস্থিতই বলা চলে, যদিও তার অব্যবহিত পূর্বেকার মন্বন্তর সব মাধ্যমেই অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে। মনোজ বসুর ‘ইয়াসিন মিঞা’, ‘বন্দে মাতরম’, এস এম বজলুল হকের ‘ভাগ না দিয়ে ভাগানো’, অঞ্জলি দেবীর ‘নবীন আশার খড়গ’, অপূর্ব কুমার মৈত্রের ‘স্বাধীনতার ব্যথা’, নরেন্দ্র দেবের ‘চলচ্চিত্র’, সুমথনাথ ঘোষের ‘উদ্বাস্ত্ত’, হরি নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘পুনশ্চ’, ‘ইতিহাস’ ও ‘লাঠিয়াল’, ঋত্বিক ঘটকের ‘স্ফটিক পাত্র’ ও ‘সড়ক’, ফণীন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের ‘গোপাল উড়ের লেন’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘খতিয়ান’, ‘স্থানে ও স্তানে’, সমরেশ বসুর ‘নিমাইয়ের দেশত্যাগ’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘গণনায়ক’, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘হেডমাস্টার’ ও ‘পালঙ্ক’, সিকান্দার আবু জাফরের ‘ঘর’, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ‘নেহায়েৎ গল্প নয়’, নূর আলীর ‘মোহাজের’, বেগম হাশমত রশীদের ‘ফরিয়াদ’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘ছুরি’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শ্বেতকমল’, ‘অধিকার’, প্রতিভা বসুর ‘দুকূল হারা’ ও ‘অপরাহ্ণে’ ইত্যাদি দেশভাগের গল্প। লক্ষ করার বিষয় হলো, অনেকেই এঁদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত লেখক নন। তাঁরা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, কিন্তু পরে সাহিত্যে থিতু হতে পারেননি বলে তাঁদের নাম বিস্মৃত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁদের গল্পও হারিয়ে গেছে। এঁদের অনেকের রচনাই দুষ্প্রাপ্য। আবার প্রতিষ্ঠিত লেখকদের গরহাজিরা বা সীমিত অংশগ্রহণ লক্ষণীয়।

উপন্যাস পেতে আমাদের ২০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। জ্যোতির্ময়ী দেবীর এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা (১৯৯৬), সেলিনা হোসেনের গায়ত্রী সন্ধ্যা (২০০৭), হাসান আজিজুল হকের সাবিত্রী উপাখ্যান ও শিউলী (২০০৬), মিহির সেনগুপ্তের বিষাদবৃক্ষ (২০০৩) ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হলো সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেলের দুই নগর (২০১৬)। একইসঙ্গে দুই বাংলা থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটির মূল বিষয় দেশভাগ। তবে দেশভাগের কোনো কাহিনি-পরম্পরা তিনি নির্মাণ করেননি। নতুন প্রজন্মের চোখ দিয়ে বিষয়টি দেখার প্রচেষ্টা যেমন আছে, তেমনি পূর্বপ্রজন্মের অনুভূতিকেও ধরতে চেয়েছেন। আবেগের বাতাবরণ নির্মাণ করতে চাননি, বরং একটি নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্ত বিষয়টিকে দেখতে চেয়েছেন। ধরতে চেয়েছেন দেশভাগ ও দেশভাগোত্তর সময়কালীন মানুষের মনস্তত্ত্ব – দুই বাংলাতেই। রাজনীতিবিদদের ভেদবুদ্ধির বিপরীতে আমজনতার মানবিক চেতনাকে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। দেখিয়েছেন সাম্প্রদায়িকতার বীজ মতলববাজদের মনোভূমিতে প্রোথিত, যাদের মধ্যে শিক্ষেত-অশিক্ষেত সবাই আছে। এই বিরোধিতায় তারা লাভবান হয়, আর নিরীহ-অসাম্প্রদায়িক মানুষ নিপীড়িত হয়। এখানে বিভাগোত্তর সময়কালে একটি শ্রেণির বিকাশকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন লেখক, যা নতুন ভাবনার খোরাক। দেশবিভাগকে তিনি সামনে এনেছেন কিছু প্রচলিত ভাবনার খোলস ভেঙে দেওয়ার জন্য।

কলকাতার ব্যারাকপুর কলেজের ইতিহাসের নবীন শিক্ষক জয়তী চক্রবর্তী ঢাকায় আসে ১৯৪৭-এর দেশভাগ ও নারী নিয়ে শিক্ষায়তনিক গবেষণাকর্মের জন্য। আমস্টারডামে কোর্স করতে গিয়ে পরিচয় হওয়া রুমানা ও তার শিক্ষক স্বামী আবিদ ঢাকায় তার থাকার সব বন্দোবস্ত করে দেয়। জয়তীর বাবার ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক অভিবাসী তরিকুল ইসলাম ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা রায়হান তাকে এ-কাজে বিশেষ সহযোগিতা করে। রায়হান ছুটির দিনে পুরনো ঢাকার শাঁখারি বাজারে নিয়ে যায়; শাহবাগ আন্দোলনের তরুণদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, যারা রাজাকারমুক্ত এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রত্যাশী; সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ আর ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ভেঙে ফেলা সাদা রঙের নৌকাসদৃশ ইন্দিরা মঞ্চের গল্প শোনায়; ঢাকেশ্বরী মন্দির দেখায়, আর ঢাকা নামের উৎপত্তির ইতিহাস বলে; শহিদমিনার, আরমেনীয় চার্চ, বাহাদুর শাহ পার্ক, আহসান মঞ্জিল, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঘুরিয়ে দেখায়। তারপর এক সকালে তারা দুজনে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় দাদুর বাড়ি আর বরিশালের গৌরনদীতে ঠাকুরদার বাড়ি দেখতে রওনা হয়। বুড়িগঙ্গা সেতু পার হয়ে বিক্রমপুর, ধলেশ্বরী পার হয়ে ওদের গাড়ি মাওয়ার দিকে ছুটে চলে। শীতের সকালের এই ভ্রমণ তাদের রোমান্টিক করে তোলে। রায়হানকে আড়চোখে দেখে জয়তী। গোঁফধারী মানুষের চুম্বন কেমন – ভাবে সে। প্রেমিক বিবেকের কথা মনে পড়ে। তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক এবং বিয়ে না করার পক্ষে যুক্তিগুলো নিয়ে আবার ভাবতে থাকে। ভাঙ্গায় পৌঁছে তারা ‘উদয়তারা হাইস্কুলে’ যাত্রাবিরতি করে। এই স্কুল জয়তীর দাদুর মায়ের নামে। সেখানে শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপে দেশভাগ প্রসঙ্গ উঠে আসে। গৌরনদীতে ঠাকুরদার ভিটেয় দখলদারের বিরূপ আচরণ, সাম্প্রদায়িক মন্তব্যে অস্বসিত্মর অভিজ্ঞতা এবং মায়ের অনুরোধে ভিটের এক মুঠো মাটি নিয়ে আসার আবেগ সামলে তারা ফিরে চলে। রাত হওয়ায় মাদারীপুরের এক এনজিওর রেস্ট হাউসে তারা রাত কাটায়। সেখানে রায়হানের সঙ্গে জয়তীর শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়। পুরনো প্রেমিকদের সঙ্গে তার সম্পর্কের একটি তুলনা সে দাঁড় করায়। সেখানে ‘অভিজ্ঞ’ রায়হানের প্রতি তার মুগ্ধতা প্রকাশ পায়।

তাদের পরিচয়ের সূত্রপাত অবশ্য আরো ছয় মাস আগে। যখন রায়হান ১৯৭১ সালের উদ্বাস্ত্তদের নিয়ে গবেষণা কাজের জন্য কলকাতা গিয়েছিল। দুই গবেষকের কাজের ধরনে মিল আছে, শুধু সময়টা আলাদা। সেখানে জয়তী কলকাতায় অপরিচিত রায়হানকে সহযোগিতা করেছিল। ন্যাশনাল লাইব্রেরির কার্ড করে দেওয়া, সরকারি আর্কাইভের বিভূতিবাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, একসঙ্গে তার গ্রামের বাল্যবন্ধু অবনী, যে ৪০ বছর আগে দেশ ছেড়েছে, তার সঙ্গে দেখা করতে বনগাঁ যাওয়া, গড়াইয়ের পারের স্মৃতি-রোমন্থন, কলকাতায় মুসলিম সম্প্রদায়ের সামাজিক অবস্থান নিয়ে অধ্যাপক অভিমন্যু চ্যাটার্জির সঙ্গে কথোপকথন, কলকাতা শব্দের উৎপত্তি নিয়ে প্রচলিত পুরাণের অবতারণা ইত্যাদি বিষয় দেশভাগকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। দেশভাগ নিয়ে নানাজনের মতামত উঠে আসে বটে; কিন্তু কোনো উপসংহার টানা হয় না। কিছু ভাবনা, কিছু বিতর্ক, কিছু জিজ্ঞাসা রেখেই উপন্যাসটি শেষ হয়।

দুই নগর প্রথাগত কোনো উপন্যাস নয়। একে বিশুদ্ধ কোনো সাহিত্য-শাখায় (Literary Genre) ফেলা যায় না। এটা না ঐতিহাসিক উপন্যাস, না জীবনী, না আত্মজীবনী। এতে ফিকশন ও নন-ফিকশনের মিশ্রণ রয়েছে। প্রচলিত কাঠামোয় যেমন পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা, চরিত্র, বর্ণনাকারী থাকে, তা আছে; কিন্তু প্রচলিত সূচনায় যেখানে চরিত্রের পরিচয়, পরিবেশ এবং প্রধানত মূল দ্বন্দ্ব বা সমস্যার বিষয়টি উন্মোচিত হয় তা নেই, নেই চরিত্রের মাঝে আত্মদ্বন্দ্ব, চরিত্রের সঙ্গে চরিত্র-সমাজ-প্রকৃতির দ্বান্দ্বিক অবস্থা, নেই ঊর্ধ্বমুখী ক্রিয়া যা উৎকণ্ঠা, যা সংশয় তৈরি করে। নেই চরম পরিণতি বা ক্লাইমেক্স, যেখানে প্রধান চরিত্ররা একটি দ্বন্দ্ব নিয়ে মুখোমুখি হয়, নেই নিম্নমুখী কর্মকা- কিংবা যৌক্তিক পরিণতি বা সমাপ্তি। এক কথায় কোনো জম্পেশ কাহিনি এ-উপন্যাসে নির্মিত হয়নি। জয়তী-রায়হানের মানবিক সম্পর্ককে অবলম্বন করে দেশভাগের মতো গম্ভীর বিষয়কে নানাজনের মন্তব্যের ভেতর দিয়ে প্রচলিত ভাবনার আদলকে পাশ কাটিয়ে একটি ভিন্নধরনের বস্ত্তনিষ্ঠ উপলব্ধির জায়গায় পাঠককে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক। দেশভাগ যে একটি অবিমৃশ্যকারী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল, যা এই ভূখ–র হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই বড় ক্ষতি করেছে, তা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে তিনি বলেছেন। একটি ইতিহাস-চেতনা এই উপন্যাসের পরতে-পরতে আমরা লক্ষ করি। আমেরিকার দক্ষেণাঞ্চলীয় লেখক, যেমন – উইলিয়াম ফকনার, করম্যাক ম্যকার্থি, মায়া অ্যাঞ্জেলু প্রমুখের লেখনীতে আমরা যেমন গভীর ইতিহাস-চেতনা; জন্মস্থানের প্রতি বিশেষ মমত্ববোধ; দৃঢ় নৈতিক-চেতনা; সম্প্রদায়ের মাঝে সুসম্পর্কে আস্থাশীলতা; পরিবার ও সম্প্রদায়ের নিরিখে ব্যক্তি-মানুষ, শ্রেণি ও স্থানের গুরুত্ব; অতীতের পুনঃপুন উপস্থিতি; সংস্কৃতি, ধর্মীয়-সামাজিক আচারের প্রতি শ্রদ্ধা, চরিত্রের অজানা বৈশিষ্ট্যের উন্মোচন ইত্যাদি লক্ষ করি, আলোচ্য উপন্যাসেও এই বিষয়গুলোকে তুলে আনার চেষ্টা রয়েছে, বিশেষ করে ইতিহাস। কাকতালীয়ভাবে কিনা বলা মুশকিল, উপন্যাসের প্রায় সব প্রধান চরিত্রই ইতিহাসের শিক্ষক। রায়হান, জয়তী, তার বাবা সত্যব্রত চক্রবর্তী, তরিকুল ইসলাম, বিমলেন্দু রায়, সঞ্জীব ভট্টাচার্য প্রমুখ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ইতিহাস পড়ান। অনুরাধা ভট্টাচার্যের অবশ্য ইতিহাসের অধ্যাপক না হয়ে উপায় ছিল না, কারণ তিনি জয়তীর গাইড। অভিমন্যু চ্যাটার্জি সমাজবিজ্ঞানের আর আবিদ অর্থনীতির অধ্যাপক। ছোট কলেবরের একটি উপন্যাসে এতো অধ্যাপক চরিত্রের কতটা প্রয়োজন ছিল তা ভাবার বিষয়। ইতিহাস-চেতনার জন্য ইতিহাস পাঠ যতটা জরুরি ইতিহাসের শিক্ষক হওয়া ততটা নয়। অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় প্রথম ইতিহাস বিভাগ খুলেছিলেন সবাইকে ইতিহাসের শিক্ষার্থী বানাতে নয়, প্রতিটি মানুষের জীবনে ইতিহাসচর্চার গুরুত্ব বোঝানোর জন্যও বটে। তবে দেশভাগ শুধু ইতিহাসের বিষয় নয়, রাজনৈতিক-সমাজতাত্ত্বিক-অর্থনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণও রয়েছে তার। সেদিকগুলোও তিনি স্পর্শ করেছেন। নিজেই প্রশ্ন করেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত ইতিহাস কী? কিছু গল্পই তো। অসংখ্য মানুষের অনেক বাস্তব দুঃখ-বেদনা, আনন্দ-সংগ্রাম, সবকিছু তো পরবর্তীকালে রূপ নেয় কেবল কিছু গল্পে এবং যে-গল্প যত নাটকীয়, সে-গল্প ততই আকর্ষণীয়।… মানুষ আসলে খুবই গল্পপ্রিয় এক প্রজাতি, সবকিছুর মধ্যেই যেন গল্প খুঁজে পেতে ভালোবাসে… ইতিহাসের নামে নানা রকম গল্প শুনতেই বেশি ভালোবাসে। পরিসংখ্যানের চেয়ে কল্পনা, সত্যের চেয়ে কাহিনি।’ তবে সেই পরিসংখ্যানের মধ্যে অতিরঞ্জন ও বাস্তবতার ঘাটতি –
দুই-ই থাকে। এখানেও মানুষ নিজের মতো করে নির্মাণ করতে চায় সবকিছু আর তাই বারংবার ভুলের ফাঁদে পা দেয়। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ, ১৯১৩ সালে হিন্দু মহাসভা, ১৯২৩ সালে বেঙ্গলপ্যাক্ট, ১৯৩৭ সালে কৃষকপ্রজা পার্টির গঠনপর্ব পেরিয়ে ১৯৪৬-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও পরের বছর দেশভাগের ধারাবাহিকতার উলেস্নখ করে লেখক তানভীর বলছেন যে, দুটি সম্প্রদায়কে বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে বাঙালি জাতিকে বিভক্ত করা হয়েছে, যার ক্ষত কখনো শুকাবে না। দেশভাগের কারিগররা মনে করেছিলেন যে, ভাগ করে দুই সম্প্রদায়কে দুদিকে বসবাসের ব্যবস্থা করাতে পারলে সংঘর্ষ-রক্তপাত এড়ানো যাবে। কিন্তু বাস্তবে হলো তার উল্টো। যে-ব্যবস্থা রক্তারক্তি ঠেকাবে বলে মনে করা হচ্ছিল তা-ই রক্তপাতের সম্ভাবনাকে আরো বাড়িয়ে দিলো। এই বিষয়টিকে বিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী ফরাসি দার্শনিক জ্যাক দেরিদা ‘Binary Opposition’ বা ‘যুগল বৈপরীত্য’ বলেছেন। ভারত ও পাকিস্তান থেকে পালটাপালটি ‘উপহার’ স্বরূপ নিরীহ মানুষদের হত্যা করে দুই ট্রেন বোঝাই করে পাঠানো হয়েছিল। সংঘর্ষের মাত্রা ইতোপূর্বেকার সমস্ত দাঙ্গার নৃশংসতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পাঞ্জাবে ‘আল্লাহু আকবরে’র বিপরীতে ধ্বনি উঠেছিল ‘জো বোলো সে নিহাল, সৎ সিরি আকাল’। সাহিত্য-রাজনীতি-দর্শন-ইতিহাস-সমাজতত্ত্ব-মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই এই ‘যুগল-বৈপরীত্যে’র উপস্থিতি লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটকে রাজা গোবিন্দমাণিক্য দেবী কালীর উদ্দেশে পশু বলি বন্ধের ঘোষণা দিচ্ছেন রক্তপাত বন্ধের জন্য, কিন্তু পুরোহিত রঘুপতি ও রানী গুণবতী তার বিরুদ্ধাচারণ করছেন। রঘুপতি গোপনে রাজাকে হত্যার জন্য ষড়যন্ত্র করছেন। অর্থাৎ রক্তপাত বন্ধের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ রক্তপাতের পথকে উন্মুক্ত করছে। দেশভাগের সেই রক্ত কি আমরা এখনো সাফ করছি না? আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামও সেই ‘Binary Opposition’ বা ‘যুগল বৈপরীত্যে’র ধারাবাহিকতা। জাতিসত্তার ধুয়ো তুলে যে-দেশটা ভাগ করা হলো তা ছিল একটি ভ্রান্ত দর্শন। এক সম্প্রদায়ের লোকেরা এক জাতি হয় না। হিন্দু-মুসলিম ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় হলেও বাংলাভাষী হওয়ায় তারা বাঙালি জাতি। কিন্তু মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও পশতু, পাঞ্জাবি, উর্দুভাসীরা এক জাতির ছিল না। তাই সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। আবার জাতীয়তাবাদও এক পর্যায়ে উগ্র হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ কি সেজন্য আমাদের বারংবার সাবধান করেননি? জাতীয়তাবাদ, তাঁর মতে, একটি চৈতন্যনাশক বিষয় যা মানুষের অনুভূতিকে ভোঁতা করে দিয়ে পরিশেষে উগ্রতার দিকে টেনে নিয়ে যায়। যখন উপন্যাসের সঞ্জীব ভট্টাচার্য বলেন, ‘জাতীয়তাবাদের শুরু রূপকথা দিয়ে আর শেষ হয় রক্ত ও কাঁদায়’, তখন সেই কথারই অনুরণন শোনা যায়। লেখক তানভীর মোকাম্মেল আমাদের সারাক্ষণই তা মনে করিয়ে দিয়েছেন।

তাঁর লেখনীতে দেশভাগ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের এমন কিছু ভূমিকার কথা উঠে এসেছে, যা প্রচলিত বিশ্বাসকে ভেঙে দিতে চায়। ‘…সোহরাওয়ার্দী আর শ্যামাপ্রসাদের কারণেই কলকাতার ছেচলিস্নশের ভয়াবহ দাঙ্গাটা ঘটেছিল। বাংলা বিভাগ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। পরে যে শরৎ বসু-সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমরা বাংলাকে এক রাখার শেষ চেষ্টা নিয়েছিলেন, তা আর সফল হয়নি, কারণ সোহরাওয়ার্দীকে বাঙালি হিন্দুরা আর বিশ্বাস করতে পারেনি।’ দেশভাগের জন্য ইংরেজ বা সিরিল র‌্যাডক্লিফকে এককভাবে দায়ী করার প্রচলিত মিথটিকে এখানে ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে। দুশো বছরের শাসনক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় বেদনা বোধ করায় দুষ্ট ইংরেজরা ভারতকে ভেঙে চিরস্থায়ী বিরোধের বীজ বপন করে যায় বলে যে-ধারণাটির সলতেয় সবসময় আগুন দেওয়ার চেষ্টা করা হয় তা সর্বৈব সত্য নয়। ভারতীয় রাজনীতির তাবড় নেতাদেরও যে অনেক দায় আছে তার দিকে তিনি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এখানেও ‘যুগল-বৈপরীত্য’ রয়েছে। দেরিদার বিনির্মাণবাদ এই যুগল-বৈপরীত্যের সীমানা মুছে দিয়ে দুইয়ের গুরুত্বকে সমানভাবে উপলব্ধি করতে শেখায়।

তো দেশভাগ আমাদের কী দিলো? বিভক্ত ভারত, না ‘স্বাধীনতা’? পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ? তা হয়তো, কিন্তু কিসের বিনিময়ে? উপন্যাসে সঞ্জীববাবু রায়হানকে বলেন, ‘আমরা চলে এসেছিলাম বলেই পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের আজ এতটা উন্নতি হতে পেরেছে। না হলে হতো না। এটা একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। রায়হান ভিন্নমত হতে পারে না। তবে এ-উন্নতি কিসের বিনিময়ে! এ কেমন উন্নতি যে, চিরচেনা এক প্রতিবেশীকে স্রেফ সংখ্যাধিক্যের জোরে তাড়িয়ে দিয়ে তার জমি, বাড়ি বা চাকরি দখল করে উন্নয়ন ঘটাতে হবে? এ উন্নতি কি ন্যায়সংগত? আর হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যাপক দেশত্যাগের ফলে পূর্ববঙ্গের যে গভীর ক্ষতিটা ঘটল, বিশেষ করে শিক্ষা ও
সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শূন্যতার যে বিশাল গহবর সৃষ্টি হলো সে-ক্ষতি আজো পূরণ হয়নি। এখন হাসান সাহেবের মতো স্বল্পমেধার মানুষেরাও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে যেতে পারেন যার প্রকৃতপক্ষে একজন কলেজশিক্ষক হওয়ারও যোগ্যতা নেই। আর সভ্যতা ও সংস্কৃতির সুকুমার দিকগুলো – সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, চারুকলা, এসবের মানের গভীরতার কী অবস্থা পূর্ববঙ্গে, আজকের বাংলাদেশে!’ এই কথাগুলো খুবই সত্য, কিন্তু এই বঙ্গের কজন মানবেন? এর ব্যাখ্যাও আমরা পেতে পারি দেরিদার কাছ থেকে। দেরিদা হাইডেগারের destruktion-এর আদলে deconstruction (destruction/ construction) বা বিনির্মাণবাদ তত্ত্ব হাজির করেছেন। হাইডেগারের ফবংঃৎঁপঃরড়হ মূলত ছিল ইতিহাসের মাঝে ইতিহাস অনুসন্ধান। পৃথিবীতে ব্যক্তিসত্তা রোজকার ঘটনাপ্রবাহের মাঝে প্রায়ই ফাঁদে পড়ে এবং উত্তরাধিকারসূত্রে লালনকৃত ঐতিহ্য ও চেনাজগতের সাহায্যে তাকে ব্যাখ্যা করে। এই অবস্থাকে হাইডেগার বলেছেন পতনতা (fallenness)।  যে যথার্থভাবে (authentically) বাঁচতে চায়, সে এই প্রাত্যহিকতা এড়িয়ে চলবে। দেরিদার বিনির্মাণবাদ হলো জিজ্ঞাসার কঠোর রূপ। যেহেতু বর্ণনারত (speaking subject) বিষয়ের এমন কিছু নীরব এলাকা আছে, যেখানে বিনির্মাণকারী শব্দ বা স্বনের (logos) বিধিবিধানের বিরুদ্ধে চাতুরী বা ধোঁকাবাজির (duplicity) কৌশল প্রয়োগ করে। কৌশল প্রণয়নকারী অভিজ্ঞতাবাদের অরক্ষণীয় অবস্থান অক্ষুণ্ণ রেখে যুক্তির সত্য  (truth of reason) ও বাস্তব সত্যের (truth of fact) মাঝে পার্থক্য মুছে দিয়ে শব্দ বা স্বনের ক্ষমতাকে ঠেকিয়ে রাখে। এখানে শব্দ বা স্বনের ক্ষমতা বললে বোঝায় ‘দেশভাগ’ ও ‘স্বাধীনতা’ শব্দ দুটোর ক্ষমতা। এই রাজনৈতিক সিদ্ধামেত্মর ফলে যাঁরা অন্য ভূখ– উদ্বাস্ত্ত হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদের কাছে এটা ‘দেশভাগ’, আর যাঁদের কোথাও যেতে হয়নি, কিছু হারাতে হয়নি, তাঁদের কাছে ‘স্বাধীনতা’। তানভীরের গ্রন্থ একটু হলেও আমাদের সেই উপলব্ধির দরজায় কড়া নাড়ে। সত্যব্রত, অবনী ও তরিকুল ইসলামদের বিষণ্ণতা রায়হানদের মতো কিছু মানুষকে স্পর্শ করলেও যাদের নড়তে হয়নি তাঁরাই তো ‘ঘটি’, ‘বাঙ্গাল’, ‘মোহাজেরে’র মতো অবমাননাকর শব্দের সৃষ্টি করেছে। এরা যেন নতুন এক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, যাদের গায়ে লেগে আছে উদ্বাস্ত্তর ছাপ।

ছোট কলেবরের এ-উপন্যাসে লেখক মূল বিষয় দেশভাগের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, করপোরেট সংস্কৃতি, সমাজে নারীর অবস্থান, গণতন্ত্র, সামরিক শাসন, জাতীয়তাবাদ, শাহবাগ আন্দোলন, নকশালবাড়ি আন্দোলন, প্রচলিত ধর্মচর্চার স্বরূপ, সমাজবিজ্ঞানের আপওয়ার্ড মবিলিটি ইত্যাদি বিষয় ছুঁয়ে গেছেন। ফ্রান্সিস বেকন, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, জেনারেল দ্য গল, গ্রামসি প্রমুখ উদ্ধৃতি হিসেবে এসেছেন। ডিকেন্সের আ টেল অব টু সিটিজের আদলে দুই নগর নামটি কাকতালীয় হতে পারে। তবে বাংলাদেশ অংশের চেয়ে কলকাতা অংশের ব্যাপ্তি খুবই কম। ৯০ পৃষ্ঠার উপন্যাসে ৫০ পৃষ্ঠার বেশি ধারণ করছে বাংলাদেশের কাহিনি, আর কলকাতা অংশ মাত্র ১৭ পৃষ্ঠার। ঠিক ভারসাম্যের প্রশ্নে নয়, আরেকটু বিস্তৃতি, বিশেষ করে ওখানে অভিবাসীদের সম্পর্কে নেটিভদের দৃষ্টিভঙ্গিটা ধরা দরকার ছিল। গম্ভীর বিষয়ের সঙ্গে হালকা বিষয়ও তিনি মিশিয়েছেন। নারীর চার পর্বের প্রেমতত্ত্বের জন্য লেখক প্রশংসা বা নিন্দা দুই-ই পেতে পারেন। ভাগ্যিস রায়হান-জয়তীর শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টিকে তিনি কোনো নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চাননি! নর-নারীর স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক উদ্দীপনা হিসেবে তুলে ধরেছেন বলে ধন্যবাদ। লেখনীটির সম্পাদনায় কিছু ত্রম্নটি লক্ষ করা গেছে। একই বক্তব্যের পৌনঃপুনিকতা রয়েছে। আরেকটু যত্নে সম্পাদনা করলে বিষয়টি টান-টান ও মেদহীন হতে পারত। বানানের ভুল রয়েছে। শুরুতে দেবব্রত চক্রবর্তী পরে সত্যব্রত হয়েছেন। এগুলো বড় কোনো ত্রম্নটি নয়। আমাদের পেশাজীবী সম্পাদকগোষ্ঠী তৈরি না হওয়ায় এই বিব্রতকর ভুলগুলো হজম করতে হয়। আগামী সংস্করণে ত্রম্নটিগুলো সংশোধিত হবে – এ-প্রত্যাশা রইল। এই উপন্যাস উপলব্ধির অনড় অবস্থান ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে তা হয়তো বড় আকাঙক্ষা, তবে নিশ্চয় সেখানে বড়সড় একটা ঝাঁকুনি দেবে।