দেশভাগের রক্তাক্ত পদচিহ্ন

দেশভাগ তো শুধু সিরিল র‌্যাডক্লিফের তৈরি সীমারেখা নয়, ছিন্নমূল মানুষের মনেরও দ্বিধাদীর্ণ বিভাজন। তবু, কিছুকাল আগে পর্যন্তও তথ্যনিষ্ঠ, লেখ্যাগার-নির্ভর/ আর্কাইভনির্ভর, তথাকথিত উচ্চমার্গীয় ইতিহাস দেশভাগজনিত ব্যথা, বেদনাবোধ এবং সর্বোপরি মানসিকতার ইতিহাস রচনার কলাকৌশল ঠিক আয়ত্ত করতে সমর্থ ছিল না। সুখের কথা, মহাফেজখানার দলিল-দস্তাবেজের বাইরে অন্য ধরনের তথ্যসূত্রের সাহায্যে এই মানবিক ট্র্যাজেডিকে ধরার প্রয়াসও শুরু হয়েছে আসেত্ম-আসেত্ম। দেশভাগের গল্প বলতে গিয়ে কান্তি পাকড়াশির দ্য আপরুটেড (১৯৭১) উদ্বাস্তু মানুষের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেয়। ভারত ও পাকিস্তানে দুই পাঞ্জাবের উদ্বাস্তু মহিলাদের অভিজ্ঞতাকে উলটেপালটে দেখে সেই প্রয়াসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেন উর্বশী বুটালিয়া, রিতু মেনন, কমলা ভাসিনরা, আর প্রায় একই সময়ে জ্ঞানেন্দ্র পা–ও বলেন যে, দেশভাগের আগুনে দগ্ধ হয়েছেন এমন মানুষদের দৃষ্টিকোণ থেকেই খুঁজে পেতে হবে দেশভাগের অন্যতর মানবিক ইতিহাস। নববইয়ের দশকে মূলত স্মৃতিকথাকে ভিত্তি করে উদ্বাস্তুদের ইতিহাস লিখলেন নীলাঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, যশোধরা বাগচি, শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত, প্রফুলস্ন চক্রবর্তী, দীপেশ চক্রবর্তী প্রমুখ। জয়া চ্যাটার্জি রচনা করলেন দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িকতার রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত। এভাবেই তৈরি হওয়া দেশভাগের বিভিন্ন প্রান্ত ও পর্বের ইতিহাসচর্চার সঙ্গে স্মৃতিকথনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কসূত্রের ধারায় আনাম জাকারিয়া নামের সাতাশ বছরের এক তরুণী হারপার-কলিন্স থেকে প্রকাশ করেছেন একটি গবেষণাগ্রন্থ, যার নাম দ্য ফুটপ্রিন্ট অব পার্টিশান, যাতে ১৯৪৭ সালের ৬৮ বছর পরে চার প্রজন্মের স্মৃতি-সত্তা-অভিজ্ঞতায় বিভাজনের নানা দাগ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আন্তরিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

আনাম জাকারিয়া পাকিস্তানের লাহোরে জন্ম নেওয়া ও ইসলামাবাদে বসবাসকারী একজন উন্নয়নকর্মী ও সংঘাতজনিত আঘাতে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক সেবাদানকারী একজন বিশেষজ্ঞ। কানাডার ম্যাকগ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর এই তরুণী ‘এক্সচেঞ্জ ফর চেঞ্জ’ প্রজেক্টের প্রধানরূপে ‘ওরাল হিস্টরি’ বা ‘কথ্য ইতিহাস’ চর্চা বেছে নিয়েছেন দেশভাগের ক্ষত ও যন্ত্রণাগুলোর প্রজন্ম-প্রজন্মব্যাপ্ত অভিজ্ঞতা বয়ান করার জন্য। আমার সঙ্গে ই-মেইলে আলাপকালে আনাম স্পষ্টত জানিয়েছেন, ‘সরকারি ইতিহাস ও পাঠ্যপুস্তকের ভাষ্যে সত্যের মূল বিন্দুটি অস্পষ্ট। ঘটনার মানবিক ছাপ কাগজের পাতায় আসেনি, যা এখনো অঙ্কিত রয়েছে রক্তাপস্নুত হৃদয়সমূহে।’ আনামের বইটির কথা আমাকে প্রথম জানান আমাদের কমন-গুজরাতি-ফ্রেন্ড, বারোদার ড. নিধি সুন্দরনেকার তেরে এবং তারপর একাধিকবার আমার সঙ্গে আনামের আলাপের সূত্রে এটা স্পষ্ট যে, তিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার হিংসা-বিদ্বেষের বীজটিকে শনাক্ত করতে চান এবং সেটিকে মানবমনের পাটাতন থেকে উপড়ে ফেলতে ইচ্ছুক। নিজের বইটিকে নিয়ে তিনি পাকিস্তানের প্রধান প্রধান শহরে পাঠকের মুখোমুখি হয়েছেন এবং দেশভাগের নানা স্তরে পৌঁছে বিভাজনসৃষ্ট বিদ্বেষের জায়গাটিকে উত্তরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন।

দ্য ফুটপ্রিন্ট অব পার্টিশান গ্রন্থের কাঠামোটি দেশভাগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিঘাতপ্রাপ্ত ১৪ জনের নিবিড় জবানবন্দিতে রচিত। সদ্য নোবেল সাহিত্যবিজয়ী বেলারুশীয় সভেতলানার মতো তিনিও ঘটনার সাক্ষী ও সংশিস্নষ্টদেরই প্রাধান্য দিয়েছেন। দ্বিতীয় স্তরের সূত্রের কাছে না গিয়ে বরং প্রাথমিক সূত্রের প্রতি বিশ্বস্ততা তাঁর গ্রন্থের মূল শক্তি। নিজের পরিবার ও আত্মীয়-পরিম-লে দেশভাগে আক্রান্ত মানুষের সঙ্গে মিশতে মিশতে তিনি এমন আরো অনেকের কাছ থেকে বিষয়টি জেনেছেন, যাঁরা ছেড়ে-আসা-দেশে আর কখনো যেতে পারেননি। পরদেশকে নিজের দেশ ভেবে মৃত্তিকাচ্যুতির বেদনাবাহী মানুষজনের উপাখ্যান তাঁর বইটির প্রধান উপজীব্য। নিজে যে-ভাষায় বইটিতে উপসংহার টেনেছেন, তা হলো, ‘দেশভাগ আসলে একটি ‘ভায়োলেন্ট ট্র্যাজিডি’।’

লক্ষ করলে দেখা যাবে, এ-যাবৎ ১৯৪৭ সালের দেশভাগ নিয়ে যত ঐতিহাসিক এবং সমাজতাত্ত্বিক আলোচনা হয়েছে, তার অধিকাংশই পাঞ্জাবকেন্দ্রিক। পুবের উদ্বাস্তুদের সংখ্যা ও যাত্রাপথের ভয়াবহতা তুলনামূলকভাবে কম ছিল বলেই হয়তো বঙ্গ-বিভাজন এই ইতিহাসচর্চায় কম জায়গা পেয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। বরং সাতচলিস্নশে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে পূর্বাঞ্চলের বাংলা ছিল প্রান্তিক ও অনেকাংশেই অনালোচিত। আনাম জাকারিয়া আমার এক প্রশ্নের জবাবে সোজাসাপ্টাভাবেই জানিয়েছেন, ‘বঙ্গ-বিভাজনের বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় জায়গা না দিলে দেশভাগ বা পার্টিশানের ইতিহাস কখনোই স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না।’ তাঁর ইচ্ছা আছে, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের দিক থেকেও দেশভাগের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে গবেষণা করার। ‘তা হলেই দক্ষিণ এশিয়ায় সাতচলিস্নশের দেশভাগের সামগ্রিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারা যাবে,’ এটাই তাঁর মত।

ইতিহাসের সত্যান্বেষী ও নির্মোহ ধারার বাইরে সাহিত্যের নানা অঙ্গনে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের দেশবদলের স্মৃতি, দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গের (তখন পূর্ব পাকিস্তান) অভিমুখে পাড়ি দেওয়ার মর্মপীড়াদায়ক কাহিনির মতোই পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের দেশান্তরের কিছু বিবরণ এসেছে। ‘দেশ’ নামক বস্তুটির জন্য পৃথিবীর সমস্ত বাস্তুহারা ছিন্নমূল মানুষের নিরন্তর অন্বেষণ এবং তার ব্যর্থতার হাহাকার প্রতিধ্বনিত হয়েছে স্মৃতিমালাতেও। এটাও লক্ষ করার বিষয় যে, পূর্ব ভারতের দেশভাগ ও ভিটে থেকে উৎখাত-হওয়া হিন্দু শরণার্থীদের কাহিনি যেমন জটিল মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে চলে-যাওয়া বাঙালি মুসলমানদের গল্প তেমনই জটিলতর। উভয় সম্প্রদায়ই স্বাধীনতার স্বাদ নিয়েছে এবং শরণার্থীও হয়েছে। এক জীবনে আশ্রয়চ্যুত হয়ে নোঙরহীন নৌকোর মতো অনিশ্চিতের পথে চলে নিজস্ব মাটি খোঁজার অভিজ্ঞতা ইতিহাসের কাছে কখনো কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। ব্যক্তি অনেক কিছুই ভুলতে পারে, কিন্তু ইতিহাসকে বিস্মৃতির দায় এড়াতে হয়।

আনামের গ্রন্থসূত্রে প্রাসঙ্গিক রাহুল রায়-সম্পাদিত ও কলকাতার গাঙচিল-প্রকাশিত পশ্চিম থেকে পূর্ববঙ্গ : দেশবদলের স্মৃতি বইটির কথাও উলেস্নখ করা, যেখানে বিস্মৃতির ঐতিহাসিক দায় মোচনের চেষ্টা গভীরতর। দেশভাগের পর শিশুবয়সে শান্তিপুরের পৈতৃক ভিটের পাট চুকিয়ে পরিবারের সঙ্গে রাজশাহী চলে যাওয়ার কথা বিস্মৃত হন রহমত আলি : ‘ভুলে গেছি, নাকি ভুলতে চেয়েছি? ওই দিনটাকে আমি মনে রাখতে চাইনি বলেই কি ভুলে গেছি?’ (পৃ ১৩৫) কিন্তু একাত্তরে পদ্মার চরের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আবার জন্মভিটেয় ফেরার সময় কষ্ট আর আনন্দের এক অবর্ণনীয় দোটানা আচ্ছন্ন করে তাঁকে। এই দোলাচলের গভীরে নিহিত থাকে শৈশবে দেখা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতি এক দুর্বার টান, যা মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত কথকের স্মৃতিচারণে স্পষ্ট। তাই হাসান আজিজুল হকের বাল্যস্মৃতিতে ধরা থাকে পূজারি ব্রাহ্মণ পাঠশালার গুরুমশাইয়ের লক্ষ্মীপুজো শেষে গুরুমার সন্দেশ, নাড়ু, নকুলদানা প্রসাদ বিতরণ, কিংবা সন্ধেয় মুদির দোকানে কাশীদাসী মহাভারত পাঠের মৃদু একঘেয়ে সুর (পৃ ৫২)। একদার স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্মৃতিপটে আঁকা স্টেশনের পাশেই দুর্গাপুজোর ম-পে আরতিনৃত্য, আর কদমা-বাতাসা খেতে খেতে বন্ধুদের সঙ্গে মেলার মাঠ চষে বেড়ানো (পৃ ৭৯)। রহমত আলির মনে পড়ে, ‘প্রথম যখন পূর্ববঙ্গে গেছেন, তখন তাঁদের বাড়ির হিন্দু ম্যানেজার বিশ্বেশ্বরকাকার বাড়ির কথা, সরস্বতী পুজোর সব ব্যবস্থাই করে দিতেন তাঁর বাবা।’  দেশভাগের রক্তাক্ত বেদনার সঙ্গে রয়েছে এরকম সম্প্রীতির অনেক গল্পও। এমন এক সম্প্রীতি, যেখানে দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায় একে অপরের জীবনে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে, রাজনীতির দ্বৈরথে বিদীর্ণ হয় না, তখন আশাবাদের একটি সুবাতাস প্রবাহিত হওয়ার প্রত্যাশা জাগে। কিন্তু অতীতের বাস্তবতায় আশাবাদের আড়ালেই দেখা যায় রুক্ষ প্রান্তর, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, দাঙ্গার কালো ছায়া, বিভাজনতত্ত্ব, চকিতে ছড়িয়ে পড়া গুজব, রাস্তার পাশে পড়ে-থাকা লাশ দেখে ভয়ে চমকে ওঠা, অদ্ভুত আঁধারের মতো মনে বিছিয়ে-থাকা আতঙ্কের এই ইতিহাস দক্ষিণ এশিয়ায় খুবই চেনা, কয়েক দশক ধরে পড়তে পড়তে ক্রমশ গা-সওয়া হয়ে গেছে। আনাম জাকারিয়া তাঁর বইয়ের যে ই-ভার্সন আমাকে পাঠিয়েছেন, সেটা পড়তে পড়তে  প্রশ্ন জাগে, এই একদা-বাস্তুচ্যুত কথকদের কি কোনো ‘দায়িত্ব’ আছে নিজেদের বিপন্নতার আখ্যানকে বেদনাবিধুর, মরমি ভঙ্গিতে পরিবেশন করার? এ-প্রশ্ন উত্থাপন করছি এজন্য যে, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ নিয়ে যত আকুলতা তার ছিটেফোঁটাও পূর্ববঙ্গীয় সাহিত্যে নেই। কেন নেই? এখানে কি শরণার্থীদের পুনর্বাসন সমস্যা ছিল না? রিফিউজি ক্যাম্প বানানোর দরকার পড়েনি? অচেনা জীবনে মানুষের নতুন জীবন সংগ্রামের প্রয়োজনও পড়েনি? ১৯৬১ সালের জনগণনা সম্পর্কে জয়া চট্টোপাধ্যায়ের (বাঙলা ভাগ হল) দেওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গের চারটি জেলায় জনস্ফীতি যখন ক্রমবর্ধমান, ঠিক সেই সময়েই পূর্ববঙ্গে (বর্তমান বাংলাদেশে) সেই সংখ্যা নিম্নমুখী। অতএব, উদ্বাস্তু সংকটই না থাকলে আর তার অভিঘাত পুবের সাহিত্যে ঘটবে কী করে? তা ছাড়া বাল্য বা শৈশবের বাস্তুচ্যুতির পর যথাসময়ে সবাই সুস্থিত হয়েছেন নতুন জীবনে, তাই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে স্মৃতিচারণ করলেও হৃদয়ের একদা-রক্তক্ষরণের সত্যনিষ্ঠ, আকুল বিবরণ দেওয়ার দায় কি থাকে? অনেকেই কবি জীবনানন্দ দাশের কথা (‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে?’) মেনে চললেও সবাই তা মানবে কেন? পাকিস্তানের তরুণ গবেষক আনাম জাকারিয়া হৃদয়ের বেদনা ছেঁকে ঠিকই রক্তাক্ত পদচিহ্ন খুঁজে বের করেছেন।

আনামকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, ‘দেশভাগ কি জরুরি ছিল? দেশভাগের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়াকে মানুষ এখন কীভাবে দেখছে?’ সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, ‘এই প্রশ্নের উত্তর রাজনীতির মধ্য থেকে পেতে হবে। মানবিক দুঃখ-বেদনার মাঝে উত্তরটি নেই।’ খুবই কৌশলী জবাব। কিন্তু পশ্চিম থেকে পূর্ববঙ্গ : দেশবদলের স্মৃতি পড়ার সময় কিছু উত্তর পাওয়া গেছে। বইটিতে অন্তর্ভুক্ত তিন মহিলা ও দশজন পুরুষ লেখকের সকলেই দেশান্তরি হয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ নিয়মিত, কেউ কেউ অনেক বছর পরে ফিরে এসেছেন, দেখতে চেয়েছেন কেমন রয়েছে তাঁদের স্মৃতির শহর বা জনপদ। অনেকের লেখাতেই উঠে এসেছে দেশভাগ কীভাবে তাঁদের পারিবারিক জীবনকে বিপর্যস্ত করেছে। মোবারক হোসেনের আফসোস যেমন, দেশভাগের জেরে মায়ের সঙ্গে আর শেষ দেখা হলো না : ‘মা-বাবার স্নেহ সব বিসর্জন দিতে হয়েছে দেশভাগের কারণে। সতেজ জীবন পরবাসে শুষ্ক, শীর্ণ জীবনে পরিণত হয়েছে’ (পৃ ৮৮)। অথচ, যে-জীবন এখানে ‘পরবাস’ বলে স্বীকৃত, ‘অপশন’ দিয়ে স্বেচ্ছায় সেই জীবনে চলে গিয়েছিলেন অনেকেরই বাবা, দাদা, চাচা। বুলবন ওসমান যেমন, ১৯৫০-এ বাবার পিছু পিছু কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে পাড়ি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘স্বর্গোদ্যান’ থেকে তাঁর বিদায়। ওসমান অকপটে জানাচ্ছেন, ‘বাংলা বিভাগের ফলে দু’বাংলার প্রায় প্রতিটি পরিবার এভাবে বিভক্ত হয়ে আছে… এ এক গস্নানিময় জীবনগাথা’ (পৃ ৬৯)। অথচ রুবেয়া মঈন দৃঢ়ভাবে জানান, দেশভাগ ‘আমার কিন্তু মনে হয় জরুরি ছিল’ (পৃ ৯৭)। প্রবীণ লেখক হায়াৎ মামুদও অকপট, ‘দেশভাগ অনিবার্য ছিল। যা অনিবার্য তা তো ঘটবেই’  (পৃ ১০৪)। একদা পূর্ববঙ্গ, পরে পূর্ব পাকিস্তান ও অধুনা বাংলাদেশের প্রধানত মুসলিম লেখকদের লেখায় দেশভাগের ‘অনিবার্যতা’র এই গ্রহণ বা সহজ স্বীকৃতি তাঁদের স্মৃতিচারণকেও এক বিশেষ চরিত্র দেয়, তাঁদের বাস্তুচ্যুতির আবেগমন্থনকে এক বিশেষ পরিমিতি ও প্রতিক্রিয়ায় জারিত করে। রুবেয়া সখেদে বলেন, দেশভাগ ‘আমার শৈশবকে করেছে দ্বিখ–ত’ (পৃ ৯১); হায়াৎ স্বীকার করে নেন তিনি রুটলেস, ‘আমার কোনও শিকড় নেই’ (পৃ ১০৩); আবার মোবারক হোসেনের হৃদয়ের বেদনা তাঁর লেখনী থেকে নিঃসৃত হয়ে আসে : ‘দেশত্যাগের যন্ত্রণা এমন এক অনুভূতি, যে না করেছে সে কোনওদিন তা বুঝবে না… দীর্ঘ হাঁটা পথ… সে যেন আর শেষ হয় না’ (পৃ ৮৭)। এই আবেগ বেদনাবিধুর তো নিশ্চয়ই, কিন্তু অবিরল রক্তক্ষরণ বা হাহাকার সেখানে নেই; যেমনটি আছে পাঞ্জাবের বা ভারতের পশ্চিমাংশের ক্ষেত্রে। স্ট্যানলি উলপার্টের বিবরণ লক্ষ করলে কারণটিও অজানা থাকার কথা নয় : ‘সরকারি দায়-দায়িত্ব এবং ভূখ- ভারতের জন্য শতকরা ৮২.৫ ভাগ এবং পাকিস্তানের জন্য ১৭.৫ ভাগ হারে বণ্টন হচ্ছিল। রাতারাতি রেলওয়ে, কলম, পেন্সিল, টাকা, পাউন্ড, দ্রব্য, সামগ্রীর ন্যায় সিভিল সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, রাজস্ব বিভাগ ইত্যাদি ভেঙ্গে দিতে হয়। এক মাসের মধ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী পুঞ্জীভূত সয়সম্পত্তি, দালানকোঠা দুটি পৃথক জাতির অভ্যুদয়ের জন্য ‘সিজারিয়ান অপারেশন’ করতে হয়। এমতাবস্থায় লক্ষ-লক্ষ শিখ, হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি, পাঞ্জাবি  তাদের জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য সব ছেড়ে যৎসামান্য হাতে নিয়ে দারাপুত্রপরিবারসহ অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটতে বাধ্য হয়। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে প্রায় এক কোটি লোক বাড়ি-ঘর পরিবর্তন করে এবং তন্মধ্যে প্রায় দশ লক্ষ লোক তাদের কাঙ্ক্ষিত দেশে জীবিত পৌঁছাতে পারে নি। সাম্প্রদায়িক প্রভাবে প্রভাবান্বিত পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের পাঞ্জাব সীমান্ত বাহিনী জড়ো করা হয় লোকবিনিময় যাতে শান্তিপূর্ণভাবে হয় তার তদারক করার জন্য। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই এই সৈন্যদল ব্যারাকে বসে বসে তাদের হাতিয়ার ও বুট সাফ করে। আর এদিকে ট্রেনভর্তি পাকিস্তান গমনরত মুসলমান উদ্বাস্তুদের শিখ ও হিন্দুরা নৃশংসভাবে কেটে টুকরো টুকরো করে একই ট্রেনে সেইসব লাশ ভর্তি করে লাহোরে পাঠিয়ে দেয়। রক্ত, মৃত্যু, দুঃখ, বেদনা, লুটতরাজ, ধর্ষণ ইত্যাদি স্বাভাবিক ঘটনার মতো অবিরাম ঘটতে থাকে।’

পূর্বাঞ্চলে দেশভাগের সাহিত্য বা ঐতিহাসিক গবেষণায় অনেক ক্ষেত্রে তালাশ করে বহুমাত্রিক বিবরণ কমই পাওয়া যাচ্ছে। ট্রেন টু পাকিস্তানের মতো ‘ট্রেন টু কলকাতা’ বা ‘মার্চ টু ঢাকা’ নামে কেউ কিছুই লেখেনি। ব্যক্তিগত দুঃখবোধ আর পাওয়া-না-পাওয়ার হিসাব দেশভাগের কিয়দংশ হলেও হতে পারে, সবকিছু নয়। স্মৃতিকথনের মধ্য দিয়ে জাতিরাষ্ট্রের হয়ে-ওঠার প্রক্রিয়াটির সমান্তরাল, বিকল্প এক ইতিহাসের সন্ধান চালানোও জরুরি ঐতিহাসিক কাজ। এ-কাজ কিছুটা করেছেন বদরুদ্দীন উমর। তাঁর ভাষ্যে নির্মোহভাবে বিবৃত হয়েছে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, উদারমনস্ক পরিবারের ছত্রচ্ছায়ায় লালিত লেখকের বাল্য এবং কৈশোর, যেখানে সদাশান্ত বর্ধমান শহরের ওপর তিরিশ-চলিস্নশের দশক জুড়ে নেমে আসতে থাকে রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত আর দাঙ্গার ছায়া, পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁদের বাড়ি, পিতৃব্যসম পুরনো পারিবারিক হিন্দু বন্ধু অবলীলায় খুলে ফেলেন বন্ধুত্বের মুখোশ, গান্ধী হত্যার সংবাদ পেয়ে বিষাদাক্রান্ত হলেও একটু পরেই হত্যাকারীর নাম ও ধর্মপরিচয় শুনে স্বসিত্মর নিঃশ্বাস ফেলেন তরুণ বদরুদ্দীন, ‘যাক, প্রতিশোধমূলক নিধনযজ্ঞের খাঁড়া অন্তত এ যাত্রা নেমে আসবে না মুসলমানদের উপর।’ (তিনি সঠিক ছিলেন। পরে যখন ইন্দিরা গান্ধী শিখ প্রহরী কর্তৃক নিহত হন, তখন ভারত ভেসে গিয়েছিল প্রতিশোধের তা-বে।) বদরুদ্দীনের সত্যনিষ্ঠ স্বীকৃতিটিও প্রণিধানযোগ্য : ‘এই বাঁচার তাগিদেই পারিবারিক সিদ্ধান্ত হল বর্ধমানের পাট গুটিয়ে ঢাকায় পাড়ি দেওয়ার। আসলে নিরাপত্তার অভাব ও সেইসঙ্গে অপমানবোধ স্বাভাবিক চিমত্মাশক্তিকে খুব দুর্বল করল’ (পৃ ১৭৭), অকপটে লিখেছেন বদরুদ্দীন। রুবেয়া মঈন বা হায়াৎ মামুদের মতো যাঁরা দেশভাগকে ‘জরুরি’ বা ‘অনিবার্য’ ভেবেছিলেন, এই ‘স্বাভাবিক চিমত্মাশক্তি’র স্খলনের স্বীকারোক্তি তারই উলটো পিঠ। দেশভাগের কারণ নিয়ে নানাবিধ ভাবনার এই উচ্চাবচ দোলাচলের বহুমাত্রিক ছবি ধরে রাখা সত্যের তাগিদেই আবশ্যক। হাতড়ে হাতড়ে দেশ ছেড়ে যাওয়া বাঙালি মুসলিম সমাজের একটা আদল খোঁজার চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে প্রাপ্তির বিষয়গুলোও চিহ্নিত হওয়া দরকার।

এটা খুবই সত্য যে, অত্যল্প সময়ের মধ্যেই প্রদেশগুলোকে ভাগ করা হলো; অসামরিক ও সামরিক বিভাগকেও দ্বিধাবিভক্ত করা হলো; সম্পদ বখরা করারও কথা ছিল। এই সময়সীমা পাকিস্তানের জন্য নিদারুণ সমস্যা সৃষ্টি করে। ভারতের মতো উত্তরাধিকারসূত্রে পাকিস্তান কোনো রাজধানী ও সরকার পায়নি। পায়নি এমন আর্থিক সম্পদ, যা দিয়ে দ্রম্নত প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ফেলা যায়। উপরন্তু কোটি কোটি উচ্ছিন্ন (মুসলমান) শরণার্থীর সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানে প্রবেশ এই শিশুরাষ্ট্রের ওপর ত্রাণ ও পুনর্বাসনের সমূহ বোঝা চাপিয়ে দেয়। যশোবন্ত সিংহ তাঁর জিন্নাহ পাকিস্তা গ্রন্থে স্বীকার করেছেন, ‘এখন, পিছনে তাকিয়ে মনে হয়, সে সময়েই ভারত কিছু ছাড়তে পারতো। গোটা উপমহাদেশে রক্ত ও নৃশংসতা মানবিক সংবেদনশীলতাকে এমন অসাড় করে দিয়েছিল যে, উদারতা দেখানোর দরকার ছিল। কিন্তু পাকিস্তান তার রাষ্ট্রীয় পথে যাত্রা শুরু করার সময় আগের একান্নবর্তী পরিবারের শরীকদের (ভারতের) কোনও শুভেচ্ছা বা সম্পদ বণ্টনজনিত সাহায্যও পায় নি। বরং তিক্ততা ও শত্রম্নতা সম্বল করেই তাকে এগুতে হয়েছে। পাকিস্তানের সামনে তখন বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিজের পায়ে দাঁড়ানো।’

পাকিস্তানের দুই অংশে দেশভাগের ক্ষত যে রক্তাক্ত চিহ্ন এঁকেছে, আনাম জাকারিয়া তাঁর ফুটপ্রিন্ট অব পার্টিশান গ্রন্থে তার একটি চিত্র দেখিয়েছেন। অন্য কাউকে বাকিটুকু দেখাতে হবে। কারণ বাংলাদেশ ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান হয়ে যে ক্ষতের উত্তরাধিকার বহন করছে, সেটা তো মানুষের মন বা আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক শরীর থেকে এখনো মুছে যায়নি!