দ্বন্দ্ব সংকট সম্ভাবনা

Jafrin Gulshan

জাফরিন গুলশান

এই শতকে বিশ্ব-শিল্পকলার বিষয় নিরপেক্ষ আঙ্গিকবাদী আন্দোলনগুলো উঠে এসেছে পুঁজিতন্ত্র ও যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার বিকাশের ধারায় প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায়। আরো যুক্ত হয়েছে স্ব-স্ব অঞ্চলের হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের যৌক্তিকতার প্রসঙ্গে এক ব্যাপক নাস্তি থেকে। বিষয়নিরপেক্ষতা ফলে পুনরায় বিষয়ে পক্ষপাতিত্ব করেছে। যন্ত্রসভ্যতার উল্লম্ফন সামাজিক বিন্যাসকে, ঐতিহ্যকে, মূল্যবোধ এবং মানবিক সম্পর্ককে যে তোলপাড়ের মধ্য দিয়ে নতুন চেহারা চরিত্র দিয়েছে তারই অব্যবহিত প্রতিক্রিয়ায় এবং সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী আচ্ছন্নতার প্রতিচিন্তায় ‘প্যারাডক্সিক্যাল নাও’ শিরোনামের দলবদ্ধ প্রদর্শনীর আবির্ভাব। সৃষ্টির বিষয় বা আঙ্গিক এবং মাধ্যম যা-ই হোক না কেন, কোনো সৃষ্টিই দেশকাল নিরপেক্ষ নয়। শিল্পে এই দেশকাল কখনো সরাসরি দেখা যায়, কখনো শিল্পীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নিজস্ব মনোস্তত্ত্বের রহস্যে আচ্ছাদিত থাকে কিংবা বলা যায়, কখনো রূপকপ্রতীকের আদলে দৃশ্যমান হয়। এই দলবদ্ধ প্রদর্শনীর তিন শিল্পী – ইয়াসমিন জাহান নূপুর, আনিসুজ্জামান সোহেল এবং ফিরোজ মাহমুদের সৃজনশীল অভিব্যক্তি অর্থাৎ শিল্পকর্মসমূহ বস্ত্তত এদিক থেকে প্রাথমিকভাবে দেশকালচিহ্নিত এবং দেশকালসাপেক্ষ।

আবার শিল্পীরা আন্তর্জাতিকতাকেও ধারণ করেছেন তাঁদের সৃষ্টিকর্মের নিরীক্ষাপ্রবণ আঙ্গিকের মাধ্যমে। কাজেই সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, অস্তিত্বের মধ্যে নিয়ত নিজ অবস্থানের প্রকাশ ঘটেছে এই প্রদর্শনীতে। প্রদর্শনীটি একটি কিউরেটরিয়াল প্রজেক্টের ফল। কিউরেশন করেছেন সাদিয়া রহমান। একাত্তর-পরবর্তী প্রথম প্রজন্মের তিন শিল্পীর চিন্তা-চেতনার সমন্বয়ে সমসাময়িক সমাজব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া ঘটেছে সমন্বিতভাবে। অবশ্য যেন নগরকেন্দ্রিক নান্দনিকতা গুরুত্ব পেয়েছে, যা একই সঙ্গে সময়োপযুক্ত আধুনিক। দেশকাল ও ইতিহাস বিচারে ‘আধুনিক’ শব্দটি নিজেও প্রায়োগিক অবস্থান বিচারে প্রশ্নবিদ্ধ। দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক আচ্ছন্নতা ও বিশ্বজনীনতা থেকে ইউরোপকেন্দ্রিক ঘটমান রুচি ও মাধ্যমের বিকাশে আমরা আধুনিকতার প্রসঙ্গকে বিচার করি। এই মানসিক পরাধীনতা আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের অর্থাৎ, উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তার বিশেষ সংকট হলেও এটি থেকে এখনই তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ‘প্যারাডক্সিক্যাল’ শব্দের আভিধানিক অর্থের দোদুল্যমানতা ও দ্বান্দ্বিক অবস্থানের সঙ্গে তাই প্রদর্শনীটির প্রেক্ষাপট সংযুক্ত হয়।

শিল্পী ফিরোজ মাহমুদ প্রদর্শনীতে ‘সিনারিও-ডিসটেন্স অফ পাস্ট’ সিরিজের মিশ্রমাধ্যমে কাজ করেছেন। রঙের স্বচ্ছতা, রেখার সূক্ষ্মতা, কাগজের উপরিতলে নানা বুনট বা টেক্সচার এবং সমন্বিতভাবে বিভিন্ন তলে দৃশ্যমান হয় শিল্পীর কাজের চিন্তা। ইতিহাস, বিশেষত পূর্ব-ঔপনিবেশিক ইতিহাসের দেখা মেলে নির্দিষ্ট কিছু বাস্তবানুগধর্মী চরিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে। বাংলার নবাবি আমলের ইতিহাসে আলোকপাত করেছেন তিনি, যেখানে হয়তো শেষ স্বাধীনতার আস্বাদকে পুনরায় খুঁজেছেন। মানুষ, ফুল, তরবারি, ঘোড়া, বাঘ, পাখি, পেঁচা, অট্টালিকা ইত্যাদি নানা বাস্তবানুগ আঙ্গিক এ-অঞ্চলের ইতিহাসে সম্পর্কিত হয়েছে। আবার নবাবকে স্কেট বোর্ডে দাঁড় করিয়ে শিল্পী আরো গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করেন। নকশাধর্মী আঙ্গিকগুলো বেশ দ্যোতনা সৃষ্টি করে। ফিরোজ মাহমুদ এ ধরনের কাজ দীর্ঘদিন ধরেই করেন। আবার ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেখানে ফিরোজ মাহমুদ ইতিহাসের অনেক পূর্বে কড়া নাড়ছেন, সেখানে আনিসুজ্জামান সোহেল সমকালীন সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে নিজ অবস্থান তুলে ধরেছেন। গাঢ় কালো চিত্রতলের ওপরে সূক্ষ্ম ও স্পর্শকাতর রেখায় চিত্রের মাধ্যমে কাজ করেছেন তিনি। ‘অ্যানোনয়মাস টিথ-২’, ‘কিপ স্ক্রিমিং-২, ৯’, ‘কনভারসেশন উইথ মাইসেলফ-১, ২’ – শিরোনামের কাজগুলোতে রেখাচিত্র তথা ড্রইংয়ে শিল্পীর দক্ষতার দেখা মেলে। একুশ শতকের জটিলতম বিশ্বপরিস্থিতিতে এদেশের একজন শিল্পীর যৌগিক  চিন্তার প্রতিফলন এই ছবিগুলো। কাজগুলোতে স্থানবিন্যাস গুরুত্বপূর্ণ। কোনো রং নেই, শুধু কালো জমিনে সাদা রেখাচিত্র একধরনের আত্মকেন্দ্রিক একাকিত্বের সংক্ষেপণ বা মিনিমাইজেশন সৃষ্টি করে। নিত্যদিনের ব্যবহৃত নানা বস্ত্ত, যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র ইত্যাদি তাঁর ছবির অনুষঙ্গ এবং তীব্র প্রকাশবাদিতা লক্ষণীয়। সোহেলের চিত্রকর্মে যন্ত্রসভ্যতার সংস্কৃতির প্রতিক্রিয়া নিগূঢ় উপায়ে নখরাঘাত করছে। সমসাময়িকতা ও ইতিহাসের মধ্য দিয়ে সময়কে খনন করেছেন শিল্পী ইয়াসমিন জাহান নূপুর। ফলে বিভিন্ন প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপনার নির্মাণশৈলী নূপুরের কাজে এসেছে। কিছু দ্বিমাত্রিক ড্রইং বা রেখাচিত্র রয়েছে, যেগুলো ঠিক সহজবোধ্য নয়, খানিকটা বিমূর্তায়নের কাছাকাছি। স্বল্প রং ও রেখার নিয়মানুবর্তিতা লক্ষণীয়। নূপুর ব্যক্তিগতভাবে নানাধরনের মাধ্যমে কাজ করেন। পারফর্মিং আর্ট, ইনস্টলেশনও করেন। ফলে এই প্রদর্শনীতেও দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক আঙ্গিকের দেখা মেলে। ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর জানালা, স্তম্ভ, গম্বুজশীর্ষ ইত্যাদিতে সোনালি কাগজে মুড়েছেন হয়তো অতীতের ইতিহাসকে বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে সোনালি বলে চিহ্নিত করার প্রয়াসে। বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীত যেন সবসময়ই সোনালি সময়ের স্মৃতি হাতড়ে ফেরে। কখনো ইতিহাসের গভীরে গেলে সেই সোনালি সময়ের আসল রূপ নির্ণয় সম্ভব হয়। বিষয়টি সম্পর্কিত একান্তভাবে শাসক ও শোষিতের ইতিহাসের সঙ্গে। শিল্পী হয়তোবা স্থাপনার ঐতিহ্যে বর্তমানের মেট্রোপলিটন নগরীর বিদঘুটে পরিস্থিতিকে চিন্তা করেন। কিছু কাজ ত্রিমাত্রিকভাবে ভাস্কর্যের গুণাবলি ধারণ না করলেও সেগুলো ইনস্টলেশনধর্মিতার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। মসলিন কাপড়ের ওপর ইংরেজি লিপিতে লেখাগুলো সরাসরি দর্শকের সঙ্গে শিল্পীর চিন্তার যোগসূত্র ঘটায়। এক্ষেত্রে শিল্পী জামদানি শিল্পীশ্রমিকদের সহায়তা নিয়েছেন। তিনি মনে করেন, নিজ কাজের সঙ্গে সামাজিক যোগসূত্র স্থাপনের এটি একটি পদ্ধতি। মসলিনের গৌরব ধ্বংসের ইতিহাসে ইংরেজিভাষী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কূটকচাল তো ভোলার নয়। এভাবে নানা রূপক, প্রতীক, রেখার সরলীকরণ, চিত্রের প্রয়োজনীয় আঙ্গিকসমূহ এসেছে তাঁর কাজে। ‘গোল্ডেন ডোরস’, ‘লুসিড ড্রিমস’, ‘মেমোরি অব দি আর্থ (সান)’, ‘মেমোরি অব দি আর্থ (ফ্রোজেন মাউনটেইন)’ ইত্যাদি শীর্ষক কাজ নুপূরের সৃষ্টিকর্ম।

যে-কোনো সৃষ্টিতে বিষয় এবং আঙ্গিক সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিষয় হলো আধেয় বা অবলম্বন, আঙ্গিক হলো প্রকাশের কৃৎকৌশল। এই দুইয়ের মধ্যে সঠিক সমন্বয় প্রয়োজন। ‘প্যারাডক্সিক্যাল নাও’ প্রদর্শনীটি এদেশের বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়ীভুক্ত। প্যারাডক্সের অসম্ভব সম্ভাবনার দ্বন্দ্বময় বিশ্লেষণে প্রদর্শনীটির অবস্থান নির্ণয়ের স্বাধীনতা তৈরি হয়। এই ধরনের প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে শিল্প ও শিল্পীদের ঘিরে পুরো প্রতিষ্ঠিত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বিচার সম্ভবপর হয়ে ওঠে। প্রদর্শনীতে ২৬টি ড্রইং ও ১০টি স্থাপনাকর্ম বা ইনস্টলেশন রয়েছে।

প্রদর্শনীটি বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসে ৭ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে।