দ্বিজেনের স্বর্গদর্শন

বাদাম বিক্রি করতে বেরিয়ে দ্বিজেন ভুল করে পুরনো বাসস্ট্যান্ডে চলে এসেছে। একেবারে রানী-পুকুরপাড়ের তেমাথার মোড়ে। সাধারণত এই মোড়ে সে আসতে চায় না। ভুল করে কখনো চলে এলে মন খারাপ হয়ে যায়। যেমন এখন এই পড়ন্ত দুপুরে তার মন খারাপ হয়ে গেল।

এই মোড়ে কখনো তার একটা সেলুন ছিল! ছিল বলতে সেলুনটা এখনো আছে, ‘টিপটপ সেলুন’। তবে সেটা আর তার হয়ে নেই। কথাটা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা ঠেকল দ্বিজেনের। আর ঠিক তখনই কে যেন তার নাম ধরে ডাকল, কে গো – দ্বিজেনদা নাকি!

দ্বিজেন চমকে উঠল। আজকাল কেউ তাকে আর নাম ধরে ডাকে না। নাম ধরে ডাকবে কী, এখন তো সে হকার। হকারি করে বেড়ায়। লোকে তাকে ‘বাদামওয়ালা’ বলে ডাকে। তাহলে হঠাৎ তার আসল নামে কে ডাকছে?

এদিক-ওদিক তাকায় দ্বিজেন। শেষ পর্যন্ত দেখতে পায় তার সেই পুরনো সেলুন থেকে তাকে ডাকছে সেলুনটার বর্তমান মালিক সুনীল।

পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে যায় দ্বিজেন। তার পায়ে জড়তা। পা ফেলতে খুব আড়ষ্ট লাগে। তবু সেদিকেই এগিয়ে যায়, পাশ কাটিয়ে অন্য কোথাও যাওয়ার কোনো উপায় নেই বলে।

এখন সেলুনে একটাও খরিদ্দার নেই। খরিদ্দার বসা বেঞ্চে একা বসে আছে সুনীল। বসে বসে বিড়ি টানছে, দ্বিজেনকে আসতে দেখে বলে উঠল, বসো – দ্বিজেনদা। কতদিন দেখিনি তোমাকে! এদিকে আসো না নাকি?

দ্বিজেন বসবে কী, দাঁড়িয়েই তার ক্ষীণদৃষ্টিতে সেলুনটাকে দেখছে। কত আশা করে তেমাথার মোড়ের পুকুরপাড়ের রাস্তার ধারের এই জায়গাটার দখল নিয়েছিল। লোকে বলে রানীপুকুর। রানী কোথায় কে জানে! তবে এখন সেটা বারো ভূতের সম্পত্তি। যদিও রানীর রিসিভার আছে। শিকারপুরের বিশু ভক্ত। তাকে টাকা খাইয়ে যে যেমন পেরেছে, পুকুরের পাড় তো পুকুরের পাড়, পুরো পুকুরটারই দখল নিয়েছে। সে নিজেও পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে এই জায়গার খাজনার পাকা রসিদ পেয়েছিল হাতে। মাসে পঞ্চাশ টাকা খাজনা। মলিস্নকপুরের সেন্টু মিস্ত্রিকে দিয়ে ঘর তুলেছিল। আর লতিবেরপাড়ার কার্তিক মিস্ত্রি কাঠ-কাচ দিয়ে সাজিয়েছিল তার এই সেলুনটা। সামনের উত্তম ঘোষের দোকান থেকে কিনেছিল একটা টেপরেকর্ডার। সবসময় গান বাজত। শুরুটা ভালোই হয়েছিল। সবসময় ভিড় লেগে থাকত। কিন্তু ওই যে বলে না, সবার কপালে সুখ সয় না! হঠাৎ ধরা পড়ল চোখের রোগ। শিরা শুকিয়ে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া।

ভালো করার খুব চেষ্টা করেছিল। লোকালেই জয়দেব ডাক্তারকে প্রথম দেখিয়েছিল কিছুদিন। তারপর বহরমপুরে অঞ্জন ডাক্তার। কিন্তু চোখ ভালো হওয়া তো দূরের কথা, ধীরে ধীরে অবস্থা আরো বেগতিক হচ্ছিল দেখে শেষ পর্যন্ত বারাকপুরে ‘দিশা’। সেখানেও তেমন কোনো ফল পায়নি। শুধু পুরোপুরি অন্ধ হওয়া থেকে বেঁচেছিল। যদিও ওই ক্ষীণ দৃষ্টিতে ক্ষিরকর্ম করা সম্ভব হয়নি আর। অগত্যা সেলুন বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিল সুনীলের কাছে। ইচ্ছে ছিল একবার চেন্নাই কিংবা নেপাল গিয়ে শেষ চেষ্টা করে দেখার। যদি দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়, তাহলে অন্তত রাস্তায় ইট পেতে বসেও রোজগার করতে পারবে। সেলুনটাকে দেখতে দেখতে পুরনো কথা মনে করে ফাঁকা ফাঁকা ঠেকা বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল দ্বিজেনের।

সুনীল আবার বলল, বসো – দ্বিজেনদা। একটা বিড়ি খাও।

বিড়ি হাতে নিয়ে খরিদ্দার বসা বেঞ্চে সুনীলের পাশে বসল দ্বিজেন। বুকে ঝোলানো বাদামের ঝুড়িটা নামিয়ে রাখল নিচে। সুনীলের দেওয়া বিড়িটা নিজের পকেট থেকে দেশলাই বের করে ধরাল।

জায়গাটা পুরনো বাসস্ট্যান্ড। তে-মাথার মোড়। দ্বিজেন যেখানে বসে আছে, সেখান থেকেই তার ঝাপসা দৃষ্টিতে সে দেখছে। উত্তম ঘোষের রেডিও-টিভির দোকানটা বন্ধ। বোধহয় অনেকদিন থেকেই বন্ধ। উত্তমের সেই অকালমৃত্যুর পর থেকেই বোধহয়। না হলে তার দোকানের সামনে রাজ্যের এত আবর্জনা জমবে কেন? ওপাশে গণেশের বিস্কুটভাটিটা যেমনকার তেমনি আছে। তবে এ-পাশের ‘সোনী ড্রেসেস’ কখন ‘হাজী বিরিয়ানি’তে রূপান্তরিত হয়েছে। তার পাশেই পলানের মিষ্টির দোকান আগের চেয়ে আর একটু ঝা-চকচকে হয়েছে। তার পাশে রাকিবের জুতোর দোকানটা রীতিমতো খাদিমের শোরুম। বাঁদিকে মন্মথের সাইকেলের দোকানটা যেমনকার তেমনি আছে। মন্মথ তার দোকানে একটা টেবিলে লটারির টিকিট সাজিয়ে রেখে সাইকেল মেরামত করছে। সুকুমারের ফলের দোকানটারও কোনো পরিবর্তন নেই। দু-চার ছড়ি পচাগলা কলা ঝুলছে। নিচে বসে সুকুমার হাতপাখা নাড়াতে নাড়াতে ঝিমোচ্ছে। ডানদিকে উত্তম হালদারের মুদিদোকান বদলে হয়েছে তেলে-ভাজার দোকান। উত্তম উনুনে আঁচ দিয়ে বেসন মাখছে। অরুণের চায়ের দোকানটা আগের চেয়ে জমজমাট হয়েছে। তবে দোকানে অরুণ নেই। অরুণ থাকবে কী, সে তো কবেই মদ খেয়ে মরে গেছে। এক মহিলা দোকান সামলাচ্ছে। নিশ্চয়ই অরুণের বউ। বেশ কয়েকজন চা-পায়ী বসে আছে সামনে পাতা বেঞ্চে। চা খাচ্ছে। বিড়ি টানছে। নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। শুধু দ্বিজেনের কোনো গল্প নেই। আর গল্পহীন জীবন যে কত ভয়ংকর, ঝাপসা চোখে এসব দেখতে দেখতে হাড়ে হাড়ে অনুভব করছে সে।

– কিছু বলো দ্বিজেনদা। চুপচাপ আছো যে!

সুনীল বলে উঠল। কী জানি, হয়তো ভেতরে ভেতরে দ্বিজেনের জন্য তার কষ্ট আছে।

কিন্তু দ্বিজেন কী বলবে? তার বলার আছেইবা কী? সেদিনের বাজারে মাত্র এক লাখ টাকায় সেলুনটা সুনীলের নামে লিখে দিয়েছিল। আর ওই এক লাখ টাকায় নিজের চোখের চিকিৎসা করাতে যা ধার হয়েছিল, শোধ দিয়েছিল। বাকি টাকায় চেন্নাই কিংবা নেপালে চোখ দেখাতে যাবে ভেবেছিল। যদিও বহরমপুর-বারাকপুর গেলেও শেষ পর্যন্ত চেন্নাই কিংবা নেপাল যাওয়া হয়নি। কেননা ততদিনে চোখ ঠিক হলেও যে রাস্তায় ইট পেতে বসে রোজগার করতে পারবে, সেই বিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলেছিল। না হলে হয়তো আজ তারও একটা গল্প থাকত। হঠাৎ দ্বিজেনের মনে হয়, তাহলে সুনীলের কোনো গল্প নেই কেন? এই সেলুনটার বর্তমান মালিক যখন সে, তার তো একটা গল্প থাকা উচিত!

কৌতূহল পেয়ে বসে দ্বিজেনের। সুনীলকে বলে, আর একটা বিড়ি দিবি ভাই?

সুনীল যেন বিড়ি দেওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল। বলল, কেন দেবো না? এই নাও। বলে বিড়ির বান্ডিল আর দেশলাই ধরিয়ে দিলো দ্বিজেনের হাতে।

সুনীল যেভাবে বিড়ির বান্ডিল আর দেশলাই তার হাতে ধরিয়ে দিলো তা দেখে দ্বিজেনের মনে হলো, সুনীল বুঝি তাকে অন্ধ ভাবছে! তারপর মনে হলো, ভাবছে ভাবুক। অনেকেই তো ভাবে! না হলে দুটো আধুলি আঁঠা দিয়ে জোড়া লাগিয়ে পাঁচ টাকার কয়েন বানিয়ে লোকে তার কাছে বাদাম কিনবে কেন?

না, একথা দ্বিজেন সুনীলকে বলে না। অন্যকিছুও বলে না। বরং জিগ্যেস করে, তোর খবর বল ভাই – শুনি। এদিকে অনেকদিন আসিনি। কিছু শোনাও হয়নি।

সুনীল বলল, কী আর বলব দাদা? কোনোরকমে দিনগুজরান। জাতব্যবসাতে আর সুখ নাই। দেখছোই তো – দুপুরে খেয়ে এসে বসেছি। একটাও খরিদ্দার নাই।

সত্যিই তারও কতক্ষণ আসা হয়ে গেল, কিন্তু একজন খরিদ্দারও এসে ঢোকেনি সেলুনে। কী ব্যাপার? জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারল না দ্বিজেন, তাই তো রে – কী ব্যাপার মানুষজন আজকাল সেলুনে চুলদাড়ি কাটায় না নাকি?

– কাটায় দাদা। তবে আমার সেলুনের মতো ক্ষুর-কাঁচিতে নয়, মেশিনে কাটায়।

মেশিনে চুলদাড়ি কাটায়! দ্বিজেন অবাক না হয়ে পারে না। জিজ্ঞেস করে, মেশিনে চুলদাড়ি কাটায়! সেটা আবার কেমন?

– রথবাজার সুপার মার্কেটে চলে যাও। তাহলে নিজের চোখেই দেখতে পাবা দাদা। খলিফাবাদের খালেক বিশ্বাস একেবারে  ঝা-চকচকে সেলুন বানিয়েছে।

– খলিফাবাদের খালেক বিশ্বাস সেলুন বানিয়েছে? সে তো অন্য কিসের ব্যবসা করত!

– হ্যাঁ, দুনম্বরি ব্যবসা! ওই করেই এখন মেলা টাকার মালিক। এখন আবার সেলুনের মালিক হয়েছে। আট-দশজন ছেলেমেয়ে ভাড়া করে এনেছে কলকাতা থেকে। তারাই মেশিনে চুল কাটছে, দাড়ি ছাঁটছে, ম্যাসাজ করছে, ফেসিয়াল করে দিচ্ছে। খালেক বিশ্বাস শুধু ক্যাশ সামলাচ্ছে।

দ্বিজেন সুনীলের কথা শুনছে বটে, কিছু বুঝতে পারছে না। খালেক বিশ্বাস জাতে ক্ষিরকার নয়, চাষা। তার বংশে সবাই চাষ-আবাদ করেছে। এখনো করে। খুব বেশি হলে আমের সময় আমের ব্যবসা। পাটের সময় পাটের ব্যবসা। শুধু খালেক ওসব কিছু করেনি। ছোটবেলায় হুগলি না হাওড়ায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গেছিল। তারপর একটু বড় হতেই রামনগরের সেন্টু ঘেটালের সঙ্গে মিশে কীভাবে দুনম্বরি কারবার করে ‘খালেক বিশ্বাস’ হয়ে উঠেছিল। কলকাতা-লখনৌ, সীমামেত্মর ওপারে রাজশাহী-ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। কখন কিসের কারবার করত ঠিক ছিল না। তবে উপার্জন যে করত খুব, তাকে দেখলেই লোকে টের পেত। টিপটপ শার্ট-প্যান্ট পরে গলায় সোনার চেন ঝুলিয়ে মোটরবাইকে দাপিয়ে বেড়াত এই গঞ্জ-শহর। সে-ই কি-না সেলুন বানিয়েছে শহরের সবচেয়ে দামি জায়গা সুপার মার্কেটে! খুব কৌতূহল হয় দ্বিজেনের। সে সুনীলের সেলুনে আর বসে থাকতে পারে না, ‘আসছি রে’ বলে বেরিয়ে যায়।

 

দুই

দুপুরের ভাত খেয়ে বাদাম বিক্রি করতে বেরিয়ে দ্বিজেন ভুল করে পুরনো বাসস্ট্যান্ডে এসে এখন আবার ভুলে গেছে যে, সে একজন বাদামওয়ালা। তার গলায় ঝোলানো বাদামের ঝুড়ি, তবু। অন্যদিন এ-অবস্থায় পথ চলতে চলতে ‘বাদাম! বাদাম!’ বলে চিৎকার করে, আজ সেটাও ভুলে গেছে। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। একজন, দুজন তাকে ‘বাদামওয়ালা – ও বাদামওয়ালা!’ বলে ডাকলেও সে শুনতে পেল না। তাদের মধ্যে একজন শামিত্মবাবুর মোড়ের সারবালা স্বপন বিশ্বাস, একসময় তার সেলুনে চুলদাড়ি কাটাত, দুপুরে খাওয়ার পর ঘণ্টাখানেক ভাতঘুম দিয়ে এসে দোকানে বসতেই সেই স্বপন বিশ্বাসের দাঁত শিরশির করে ওঠে। ওই সময় তার সামনে দিয়ে দ্বিজেনকে বাদাম বিক্রি করতে যেতে দেখে হাঁক দিয়ে ডেকে বাদাম কিনে খায়। আজকেও হাঁক দিলো, কিন্তু সুনীলের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। এমনকি রথবাজারে ঢুকতে গলির মাথায় জয়দেব ডাক্তারের চেম্বারের পাশে চশমার দোকানদার কাশীকাকা কি জানি কেন তাকে ডাকলেও সে শুনতে পেল না। কাশীকাকার দাঁত নেই যে বাদাম খাবে! হয়তো দ্বিজেনের চোখের কতদূর কী উন্নতি হলো, জানতে চাইত। দ্বিজেন যে-চশমাটা পরে আছে, সেটা ওই কাশীকাকার দোকান থেকেই করানো।

এসবও  দ্বিজেনের ভাবনায় নেই। তার দৃষ্টিশক্তি কম হলেও সে কিন্তু দেখতে পাচ্ছে রথবাজারের সম্রাট মার্কেটটাকে। ওটা আগে কাছারিবাড়ি ছিল। এক-দুনম্বর কারবারি সেটা কিনে ভেঙে ফেলে সুপার মার্কেট নির্মাণ করেছে। একেবারে তিনতলা বিল্ডিং। একতলায় বাজার। দোতলায় ব্যাংক, অফিস। তিনতলায় ব্যাংক স্টাফ-অফিসারদের থাকার ঘর। এলাহি ব্যাপার। যখন নির্মাণ হয়, শুনে একবার দেখতে গেছিল। তখন তার দৃষ্টিশক্তি এতটা ক্ষীণ হয়নি। হাতে ক্ষুরকাঁচি ধরতে পারত।

সেদিনের সেই দেখা এখন তার চোখে জ্বলজ্বল করে ভাসছে। কিন্তু যেটা বুঝতে পারছে না তা হলো, খলিফাবাদের খালেক বিশ্বাসের সেলুনের ব্যাপারটা। মুসলমান হয়ে চুলদাড়ি কাটানোর ব্যবসা! তার ওপর অমন পয়সাওয়ালা লোক হয়ে।

 

তিন

সুপার মার্কেটের বিশাল কাচের দরজার সামনে দারোয়ান দাঁড়িয়ে ছিল। দ্বিজেনকে এগিয়ে আসতে দেখে সে লাঠি উঁচিয়ে একেবারে তেড়ে গেল, এই ভাগো হিয়াসে! এখানে তোমার কী কাম আছে?

দ্বিজেন এই দারোয়ান লোকটিকে চেনে। নাম দেবু সিংহ। দেওয়ানসরাই মোড়ে বাড়ি। আগে বিএসএফে চাকরি করত। মাস-ছ-মাস অন্তর বাড়ি এলে তার কাছেই চুলদাড়ি কাটাত। অথচ এখন সুপার মার্কেটের গার্ড কাম দারোয়ান হয়ে তাকেই চিনতে পারছে না!

এসব ব্যাপারে দ্বিজেন আজকাল আর অবাক হয় না। তার সেলুনে যারা একসময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মেরেছে, তার পয়সায় চা খেয়েছে, বিড়ি টেনেছে, তারা এখন রাস্তায় সামনাসামনি পড়ে গেলেও চিনতে পারে না। মুখের কথাটাও বলে না পর্যন্ত। পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ভাবে, শালা কানা বোধহয় কিছুই দেখতে পায় না! দেবু সিংহও হয়তো সেটাই ভাবছে। তবু সে বলে উঠল, চিনতে পারছ না, দেবুদা! একসময় তুমি আমার সেলুনের খরিদ্দার ছিলে।

তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে দেবু সিংহ বলল, যখন ছিলাম তখন ছিলাম। এখন যাও তো!

দ্বিজেন কাকুতি-মিনতি করে, খালেক বিশ্বাসের সেলুনে যাব দেবুদা। সামান্য একটু কাজ আছে। একবার যেতে দাও। সত্যি বলছি, যাব আর আসব।

দেবু সিং এবার যেন একটু নরম হয়। জিজ্ঞেস করে, কী কাজ?

দ্বিজেন বলে, কী করে মেশিনে চুলদাড়ি কাটা হয় একবার চোখে দেখব।

দেবু আর কিছু বলে না, শুধু কাচের দরজাটা ফাঁক করে ধরে।

 

চার

সুপার মার্কেটে ঢুকে দ্বিজেন তার ক্ষীণদৃষ্টির চোখেও ঝালাফালা দেখে। ভেতরে কত দোকান! কত রকমের দোকান! সব কাচঘেরা। দিনের বেলা তবু দোকানের ভেতরগুলো আলোয় আলোময়। চোখে ঝালাফালা দেখারই কথা। কোনোটা রেডিমেড কাপড়ের দোকান। কোনোটা জুয়েলারির দোকান। কোনোটা কম্পিউটারের দোকান। কোনোটা আবার শুধুই খেলনার দোকান। মিষ্টি-কোল্ডড্রিংকের দোকানও আছে। যেখানে একই সঙ্গে ডালপুরি, চা-টাও পাওয়া যায়। স্টিলের চেয়ারে বসে কাচের টেবিলে রেখে অনেককেই খেতে দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু খালেক বিশ্বাসের সেলুনটা কোথায়? সেটার নামইবা কী? খুঁজে পাচ্ছে না কেন?

দ্বিজেন হন্যে হয়ে খুঁজছে। আর সে দেখতে পাচ্ছে, কাপড়ের দোকানের নাম ‘ইজ্জত’। জুয়েলারির দোকানের নাম ‘ঝকমক’। খেলনার দোকানের নাম ‘ছেলে ভোলানো’। খাবারের দোকানের নাম ‘খাই খাই’। এসব দেখে তার মনে হচ্ছে, সে যেন অন্য এক দুনিয়ায় এসে পড়েছে। হয়তো স্বর্গেই। যেখানে সবাই কেমন যেন কাচঘেরা! বন্দি! অথচ সবার চোখ-মুখে কত সুখ! এত সুখ যে বাইরের হাজার হাজার চিৎকার-কান্না, তারা শুনতে পায় না। তেমনি সে যাদের দেখতে পাচ্ছে, তাদের কথাও বাইরে ভেসে আসছে না। তবে তার দৃষ্টি ক্ষীণ হলেও খালেক বিশ্বাসের সেলুনটা বাদে আর সবকিছু সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। আর তার মনে হচ্ছে সে যেন স্বর্গদর্শন করছে।