…দ্বিতীয় প্রত্যাখ্যান আখ্যান

প্রথম দেখায় পছন্দ করার মতো ছেলে নয় আরেফিন। বরং দ্বিতীয়বার ফিরে না তাকানোর মতো যথেষ্ট কারণ আছে। তবে সে যখন কথা বলে, তার কথার বুদ্ধিদীপ্ত ধারে আর সূক্ষ্ম রসিকতার চালে চমকাতে হয়। বেশিরভাগ সময়। কাজেই পরিচয়ের তৃতীয় দিন অফিসে ঢোকার মুখে তাকে দেখে আরেফিন যখন বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উঠল, আজকের শাড়িটায় তোমাকে নানির মতো দেখাচ্ছে, শম্পা ভেবে পায় না, এটা কী ধরনের মন্তব্য বা রসিকতা হতে পারে। কমপিস্নমেন্ট যে নয়, সেটা অবশ্য একবারেই তার ইন্সটিংকট বলে দেয়। কিন্তু সাতসকালে অফিসে ঢুকতে না ঢুকতেই আরেফিনের কাছ থেকে এরকম অপ্রীতিকর কথা একদম আশা করেনি সে।

আশা না করার কারণ হচ্ছে, প্রথম দিন থেকেই তাকে শম্পার প্রতি সামান্য বেশি মনোযোগী মনে হয়েছিল। এটা অবশ্য শম্পার ধারণা। ধারণাটা ভুলও হতে পারে। দুনিয়াতে তুলনা করার মতো এত এত বিষয় বা ব্যক্তি থাকতে তাকে কেন নানির মতো দেখাবে, তা জানার তীব্র কৌতূহল শম্পা চেপে রাখতে পারে না। আরেফিনকে হালকাভাবে জিজ্ঞাসা করাতে সে তার কালো, পুরু ঠোঁটের কোণে একটা হাসির ঝিলিক এনে বলল, ‘শাড়ির রংটা কেমন যেন ম্যাড়ম্যাড়া! এই রঙের শাড়ি পরবে বুইড়া মানুষেরা। তোমার মতো ইয়াং তরতাজা লেডি কেন এসব শাড়ি পরবে!’

আরেফিনের কথা শুনে শম্পার আর কিছু বলার ইচ্ছা হয়নি। শাড়িটা সে অনেক পছন্দ করে সেবার পাবলিক লাইব্রেরির সামনে যে তাঁতমেলাটা বসেছিল সেখান থেকে কিনে ওইদিনই প্রথম অফিসে পরে গিয়েছিল। কেবল যেটা মনে হয়েছে, আরেফিন বোধহয় তার ওপর একটা অদৃশ্য অধিকার বা খবরদারি ফলাতে চাইছে। সে কী পরবে, কোন রংটা তাকে ভালো মানাবে ইত্যাদি আর কী। কিন্তু পরিচয়ের মাত্র তিনদিনের মাথায় এমন আশা একটু বেশি হয়ে যায় না?

বেশি হোক আর না হোক, এর পরের নানা ধরনের কথাবার্তা বিনিময় থেকে শম্পার ধারণা হয়েছে, আরেফিন মনে হয় তাকে খুব একটা অপছন্দ করে না। একজন সুযোগ্য অবিবাহিত তরুণী আরেকজন সুযোগ্য অবিবাহিত তরুণ সম্পর্কে এমনটা ভাবতেই পারে। কেননা, দুজনের বয়সসহ সার্বিক পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি এ-ধরনের ভাবালুতামিশ্রিত ভাবনার পক্ষে সবটুকু প্রণোদনা দেয়।

তবে ঘটনা পরিক্রমায় দেখা গেল, শম্পার একপক্ষীয় ভাবনার ভেতরে বেশ কিছুটা গলদ আছে। কারণ আরেফিন যে একই সঙ্গে তাদের আরেক সহকর্মী ফারহানার দিকেও সমান মনোযোগ দিয়ে যাচ্ছে, অথবা বলা যায় শম্পার চেয়ে একটু বেশি পরিমাণে, সেটা জলবৎ তরলং পরিষ্কার হয়ে গেল কিছুদিনের মধ্যেই।

সেদিন লাঞ্চ ব্রেকের সময় ফারহানার রুমে উঁকি দিয়ে ক্ষণিকের জন্য থমকে গেল শম্পা। আরেফিন সেখানে তার শ্যামলকান্তি মুখের ওপর আরো একপ্রস্ত কালি মেখে পুরো চেহারায় ঘোর অমাবস্যা নামিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি ফারহানার ডেস্ক ছাড়িয়ে তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে জানালা পেরিয়ে বাইরে কোথাও যেন হারানো। সে-দৃষ্টিতে একরাশ কষ্ট অথবা অভিমানের সুস্পষ্ট আভাস।

এ-বয়সে এরকম নীরব দৃষ্টির ভাষা হোক অথবা অভিব্যক্তি, ভুক্তভোগীরা দেখামাত্রই টের পেয়ে যায়। শম্পাও পেল। ওদিকে সুন্দরী, অহংকারী ফারহানা – কম্প্যাক্ট পাউডারের প্রলেপ ঠেলে যার ফর্সা গালের জমিনে উঁচুনিচু ইতস্তত ছড়িয়ে আছে হরেকরকম ব্রণবিহার, পেনসিল টানা ভ্রম্নজোড়া কুঁচকে তার সামনে টেবিলের ওপর খোলা ফাইলের ভেতরে নোটশিট উলটে-পালটে যাচ্ছে। খেয়াল করলে বোঝা যায়, অমনোযোগী দৃষ্টিতে সে আসলে কিছুই দেখছে না, অথচ দেখার ভান করছে।

নাটকের দৃশ্য দর্শনে অনুমান করে নিতে অসুবিধা হয় না যে, দুজনের কেউই কোনো একটা বিষয়ে সন্তুষ্ট নয়। এরকম একটি অস্বসিত্মকর পরিস্থিতির মাঝে হুট করে উদয় হয়ে শম্পা নিজেই খানিকটা অপ্রস্ত্তত হয়ে পড়ে। তার কী করা বা বলা উচিত, ভাবতে গিয়ে সে সামান্য সময় ব্যয় করে। তারপর স্বভাবসুলভ চটুল চালে আপাত-ভারি পরিবেশটা হালকা করতে বলে ওঠে,

‘আরে, কী ব্যাপার, তোমাদের মধ্যে কোনো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল নাকি?’

বলা বাহুল্য, ব্যাপারটা তাই ছিল। অর্থাৎ তাদের দুজনের ভেতর আসলেই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে বেশ কিছু সময় ধরে কথা হচ্ছিল। শম্পার তা জানা না থাকলেও ওই সময়টার জন্য এর থেকে উপযুক্ত প্রশ্ন বা মন্তব্য আর কিছুই হতে পারত না।

আরেফিন ঘাড় ঘুরিয়ে শম্পাকে দেখে নিয়ে একটু হাসার বৃথা চেষ্টা করে। সে হাসিতে না আছে প্রাণ, না কোনো আন্তরিকতার ছিটেফোঁটা। এটাকেই বোধহয় কাষ্ঠ হাসি বা বোকার হাসি বলে। অন্তত শম্পার কাছে সেরকমটাই মনে হলো। সত্যি কথা বলতে কী, আরেফিনের এমন ভ্যাবলামার্কা হাসি আর বোকার মতো চেহারা এর আগে শম্পা কখনো দেখেনি। বেচারা, কী না কী জানি বলতে গেছে ফারহানার কাছে! ধরাও খেয়েছে আচ্ছামতো। কিছু বলে দেওয়ার দরকার নেই। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।

আর, ফারহানার যা কথার ছিরি, ছুরির ফলা হয়ে একেবারে বুকের পাঁজরে গিয়ে আঘাত করে। অবশ্য এখানে কিছুক্ষণ আগে কী ঘটেছে শম্পার মতো আমরাও কিছুই জানি না। কেবল অনুমান করা যেতে পারে। যা হোক, দেখা গেল শুষ্ক হাসিটা হেসে নিয়ে আরেফিনই মুখ খুলল।

‘আসো, শম্পা, ভালোই হইল তুমি আসাতে। দেখো, প্রায় বিশ মিনিট ধইরা ফারহানার এখানে বইসা আছি। এখন পর্যন্ত এক কাপ চা-ও সাধে নাই।’

ফারহানার মেকআপ-চর্চিত সাদা ফ্যাকাশে মুখের ওপর এক ছোপ মেঘ এসে ভিড় করে। কফি কালারের ম্যাট লিপস্টিকে পুরো করে লেপা ঠোঁটজোড়া দাঁত দিয়ে একটু কামড়ে ধরে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে সে।

‘আমার পিয়নটা ব্যাংকে গেছে, এটা তোমাকে বলেছি, আরেফিন। তারপরও যদি তুমি বলো, তোমাকে চা দিতে পারিনি, তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই।’

ফারহানা ফাইলটা একপাশে সরিয়ে রেখে শম্পার দিকে তাকায়। মনে হলো, এরকম সময় শম্পার উপস্থিতিটা তার ভালো লাগছে না। শম্পা তা বুঝতে পেরে চলে যাওয়ার প্রস্ত্ততি নেয়।

‘ঠিক আছে, ফারহানা, থাক। ভেবেছিলাম চা-বিস্কুটের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করব। এখন তো দেখছি তোমার লোক নেই। তাহলে আজ বরং যাই।’

শম্পা আর আরেফিন একসঙ্গে বেরিয়ে আসে ফারহানার রুম থেকে। শম্পার মনের ভেতর কিছু একটা খচখচ করতে থাকে। এখন সে ঠিকঠিক বুঝতে পারে, কী ঘটেছে তাদের দুজনের মধ্যে। আশ্চর্য! এ-বিষয়টা এতদিন কেন তার একবারও মনে হয়নি? তাহলে সে যে আরেফিনকে কিছু একটা বলবে বলে ভেবে রেখেছে, সেটা কি আর বলা হবে না? আরেফিন কি এর মধ্যেই যা বলার বলে দিয়েছে, অথচ ফারহানা এখনো কিছু বলেনি – এরকম কিছু? কিন্তু ফারহানা তো মনে হয় অন্য কোথাও ঝুলে আছে। তাহলে?

 

দুই

অফিস শেষ হওয়ার আগে আগে আচমকা আরেফিন এসে হাজির শম্পার রুমে। শম্পা হ্যান্ডব্যাগটায় তার টুকিটাকি ভরে নিচ্ছিল। আরেফিনকে দেখে বরাবরের মতোই ওর মনটা খুশিতে ভরে গেল। যদিও সেদিন ফারহানার ওখান থেকে আসার পর থেকেই ভীষণ একটা অস্বসিত্মর ভেতর আছে সে। যেহেতু এ-কটা দিন আরেফিনের সঙ্গে তার দেখা বা কথা হয়নি, বিষয়টা একরকম ভুলেই থাকতে পেরেছিল। তবে পুরোটা নয়। আজ আরেফিনের চেহারা দেখামাত্র সব একসঙ্গে মনে পড়ে গেল। নিজেকে একটা মানসিক ঝাঁকি দিয়ে খানিকটা শক্ত হওয়ার বা দেখাবার চেষ্টা করল সে।

‘আরে, আরেফিন, একেবারে হাওয়া হয়ে গেলে যে! কোনো খোঁজখবর নেই।’

‘একই প্রশ্ন তো আমারও। তুমিই-বা এ-কদিন কই ছিলা? অফিসে আসো নাই নাকি?’

‘প্রতিদিন সময়মতো অফিসে এসেছি এবং সারাদিন অফিস করে বেলাশেষে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গেছি।’ শম্পা কিছুটা কঠিন স্বরে তার কথাগুলো উচ্চারণ করে। ভাবে-ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতে চায়, আরেফিনের শুধু প্রশ্নের খাতিরে প্রশ্ন করাটাকে সে আমলে নেয়নি মোটে।

‘আরে, আরে, রাগ করো কেন? আমিই তো ছিলাম না। দুদিন ছুটি নিছিলাম। মা-র শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। তাই দেখে আসলাম।’

‘কেন, কী হয়েছে ওনার?’

‘ওই তো বয়স হইছে; সঙ্গে ডায়াবেটিস, প্রেসার, হাঁটুর ব্যথা তো আছেই। এখন আবার তার লগে যোগ হইছে আমারে বিয়া দেওনের চিমত্মা। খালি ঘ্যানঘ্যান করে। বিয়া কর, বিয়া কর।’

আরেফিন এভাবেই ওর আঞ্চলিক উচ্চারণে অবলীলায় তার মনের ভাব প্রকাশ করে ফেলে। সবসময় তাই করে আসছে। অর্থ দাঁড়াচ্ছে, সে কখনো অন্য বেশিরভাগ তথাকথিত ভদ্রলোকের মতো মেকি প্রমিত ভাষায় কথা বলার ধার ধারে না। এটা অবশ্য তার নিজের কথা।প্রথমদিকে শম্পার শুনতে কেমন খটকা লাগত। মনে হতো, সুন্দর করে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারে না বলে এই অজুহাত। এখন অবশ্য সয়ে গেছে কানে। বরং ভালোই লাগে। অন্য সবার থেকে আলাদা। আর বিয়ের প্রসঙ্গে সামান্য ইঙ্গিতেই সে মনে মনে লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। বাইরে অবশ্য স্বাভাবিক দেখাবার সবটুকু চেষ্টা করে।

‘হুম, চিমত্মা তো হওয়ারই কথা। ছেলে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছে। ফার্স্ট ক্লাস অফিসার। মা তো এখন চাইবেই সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটা খুঁজে বের করে এনে ঘটা করে ছেলের বিয়ের আয়োজন করতে। তা তোমার সমস্যাটা কোথায়?’

‘সমস্যাটা যে কোথায় সেটা তো আমিও ঠিকঠাক বুঝতে পারতেছি না।’

‘কেন, না বোঝার কী আছে? যদি অসুবিধা না থাকে, বলতে পারো আমাকে।’ শম্পা খানিকটা বাজিয়ে দেখতে চায়, আরেফিন বাবাজি ধরা দেয় কিনা দেখার জন্য।

‘হুম, সেটাই তো বলতে আসছি। চলো, অফিসের পরে যাইগা কোথাও। তোমার যদি কোনো অসুবিধা না থাকে।’

আরেফিনের এই হঠাৎ আলটপকা প্রসত্মাবে শম্পার মনের আকাশে যেন এক হাজার তারাবাতি জ্বলে উঠল একসঙ্গে। ঝলকে উঠল হাজার রঙের স্বপ্ন, অফুরন্ত হাসি রাশি রাশি। একটা ব্যাখ্যাতীত সুখের মতো কিছু আচ্ছন্ন করে দিতে চাইল চেতনার চারিধার। এর নাম কি তাই লোকে যাকে বলে প্রেম, এক স্বর্গীয় অনুভূতির ছোঁয়ায় মন অবশ করা আবেশ? এই সাতাশ বছরের একটানা জীবনে কবার এলো এমন অনুভূতির পাগলপারা জোয়ার?

শম্পার এখন অত হিসাব কষে বের করার মতো যথেষ্ট সময় নেই হাতে। আরেফিন তাকে নিয়ে বাইরে কোথাও বের হতে চেয়েছে। এমন একটা মুহূর্তের জন্য, এমন একটা প্রসত্মাবের প্রত্যাশায় কতদিন ধরেই না সে মনে মনে অপেক্ষা করে বসে আছে। আর আজ যখন সেই রোমান্টিক ক্ষণ এসে দুয়ারে হাজির হলো, এখন কি তার ভাবাবেগে আপস্নুত হয়ে অতীতের ডায়েরি খুলে বসলে চলবে?

না। এমন সময় অতীতের খাতা খুলতে না চাইলেও আরেফিনের এক কথাতেই তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে রাজি হতে চাইল না শম্পা, তার মন। বরং সামান্য পরীক্ষা নিতে ইচ্ছা করল আরেফিনের। তাকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার এই ইচ্ছা প্রকাশ কি শুধু কথার কথা, নাকি সত্যি সত্যিই তার সঙ্গ কামনা করছে সে? তাছাড়া বলার সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলে আরেফিন ভেবে বসতে পারে অন্যরকম কিছু। তার দুর্বলতাকে এত সহজে খেলো করতে দিতে তার খানিকটা আপত্তি আছে।

‘কিন্তু আজই যেতে হবে? তুমি আমাকে একটু আগে বলতে… আমার আসলে আরেক জায়গায় যাওয়ার কথা…।’ মিথ্যে বাহানাটাতে শম্পা যতটুকু সম্ভব সত্যের প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করে। মনে মনে কষ্টে আড়ষ্ট হয়ে গেলেও।

‘আরে, অন্য জায়গা বাদ দাও। আরেক দিন যায়ো। আজকে আমার সাথে চলো। ফোন কইরা বইলা দাও যে আসতে পারতেছ না। চলো, চলো, উঠো।’

শম্পা খানিকটা বিহবল বোধ করে তার ভালো লাগার মানুষটার এমন জোরাজুরিতে। সত্যি এমন করে আগে আর কখনো আরেফিন তাকে কাছে টানেনি। আচ্ছা, কাছে টানার প্রসঙ্গ এলো কেন? তবে কি শম্পা আরেফিনের…? না, না, এত দ্রম্নত এসব চিমত্মা করা তার একদম ঠিক হচ্ছে না।

তবে এটাও তো ঠিক যে, আরেফিনের এই আপাত প্রেমপূর্ণ আহবান এক ঝটকায় সে অগ্রাহ্যও করতে পারছে না। এমন কোনো শক্তিই সে ভেতর থেকে অনুভব করতে পারছে না। সে চাইল কি চাইল না তাতে কিচ্ছু আসে-যায় না। তার মন যেতে চাইছে আজ তার স্বপ্নের মানুষটার হাত ধরে কোথাও থেকে ঘুরে আসতে। যেমনটা সে ইদানীং প্রায় কল্পনা করে থাকে; দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে যেতে যেতে মাঝেমধ্যে নিজেই লজ্জায় রঙিন হয়ে ওঠে।

‘ঠিক আছে, যাচ্ছি। তবে বেশি সময় থাকতে পারব না।’

‘সে দেখা যাবে পরে। আগে যাই চলো কোথাও।’

ইস্, শম্পার এ-মুহূর্তের দুচোখের ঝিলমিল আনন্দটা যদি কোনো ভাষায় অনুবাদ করা যেত! অথবা কোনো কবিতায় রূপান্তর! অথবা যদি পরিমাপ করা যেত কোন মাত্রার কম্পাঙ্কে তার হৃদযন্ত্রটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। অথবা হয়তো একটা-দুটা হৃৎস্পন্দন মিসও হয়ে যেতে পারে। কে জানে কেন এমন হয়!

 

তিন

স্বীকার করতেই হবে, শম্পার আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অসাধারণ। যে-চমৎকার অভিনয়গুণে সে এই সময়টাতে তার ভেতরে ঘটতে
থাকা, চুরমার হতে থাকা ভয়াবহ আবেগীয় সাইক্লোনটাকে বশ মানিয়ে নিল, তার প্রশংসা কোনো ভাষাতেই প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অথচ কী এক অদ্ভুত ভালো-লাগার ভেলায় ভেসে সে আজ এতদূর চলে এলো আরেফিনের সঙ্গে এক রিকশায় পাশাপাশি বসে।

আরেফিনের শরীর থেকে ভেসে আসা ঘামমিশ্রিত ডিওডোরান্টের সুগন্ধটা তার কাছে মনে হলো স্বর্গ থেকে হালকা হাওয়ায় উড়ে আসা এক পলকা সুরভির ছটা। বুকভরে সে ওই সুবাসটুকু পান করে যেতে থাকল। রিকশা থেকে নামার সময় আরেফিন যখন শম্পার দিকে তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলো, শম্পার কেবল মনে হলো, আহ্, এত সুখও আছে নাকি পৃথিবীতে!

দুদিন হলো সার্কভুক্ত দেশগুলোর হারবাল আর অরগ্যানিক দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে একটা মেলা শুরু হয়েছে শেরেবাংলা নগরে। আর কোনো জায়গা খুঁজে না পেয়ে আরেফিন তাকে নিয়ে ওখানেই গেল। অন্ততপক্ষে কোনো খাবারের দোকানের স্টলে বসতে তো পারা যাবে।

এরপর খুঁজে পেতে একটা কফির টেবিলে বসে গরম সমুচা খেতে খেতে আরেফিন যখন তার হৃদয়ের অর্গল খুলে দিলো, স্বাভাবিকভাবে শম্পার চুপসে যাওয়ার কথা ছিল। ফুটো হওয়া বেলুনের মতো। কিন্তু তা হলো না। বরং সে নিজেকে সামলে নিল মুন্শিয়ানার সঙ্গে দারুণ তৎপরতায়। আরেফিন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারল না শম্পার ভেতরে কী মাত্রার ওলট-পালট চলছে ওই সময়টায়। একেবারে সামনাসামনি তার চোখের সামনে বসে থাকা অবস্থায়। সমুচায় সস মেখে কামড় দিতে দিতে।

অথবা, সত্যিই কি আরেফিন বুঝতে পারেনি? এতদিনে একবারও তার প্রতি শম্পার কোনোরকম দুর্বলতার কোনো চিহ্ন তার চোখে ধরা পড়েনি? শম্পা কি এতটাই নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিল তার কথায়, আচরণে বা প্রকাশযোগ্য যে-কোনো অভিব্যক্তিতে? নাকি পুরো বিষয়টি বুদ্ধিমান আরেফিনের সচেতনভাবে উপেক্ষা করে যাওয়া কোনো একটি বিশেষ উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে? কে জানে!

‘শম্পা শোনো, তোমারে একটা কথা কই। সব শুইনা ভাইবা-চিমত্মা তুমি আমারে একটা মতামত দিবা। ফারহানা আমারে বুঝাবার চায়, সে নাকি কার গলায় এর মধ্যে ঝুইলা পড়ছে। আবার ঢং কইরা কয়, অলরেডি ইঙ্গেজড। আরে বাপ, এইটা বললেই হইল? একটা বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে হইব না ব্যাপারটার মধ্যে? সুলতান ডাকুর মতো গোঁফওয়ালা ওই বুইড়া ব্যাটার লগে ও বলে ইঙ্গেজড হইয়া গেছে! কও আমারে তুমি, এইটা কেউ বিশ্বাস করব, না করণের কথা?’ আরেফিন যেমন মাঝে মাঝে একনাগাড়ে অনেক কথা বলে ফেলে তারপর দম নেয়, এখনো সেরকম করল।

‘হতেও তো পারে। ও শুধু শুধু বানিয়ে বানিয়ে কথা বলবে কেন…।’ শম্পা আসেত্ম করে বলে আরেফিনের উত্তেজনার কারণটা অনুমান করে। চট করে সেদিন দুপুরবেলায় ফারহানার রুমের সেই দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দুয়ে দুয়ে চার ঠিক মিলে যায়।

‘আরে থোও, মাইয়া মানুষের ওসব ট্রিক আমার খুব ভালো কইরা জানা আছে। কম তো আর দেখলাম না। ওহ স্যরি, স্যরি, তুমিও তো মাইয়া। না, না, তোমার মধ্যে ওইসব প্যাঁচপুঁচ নাই। সেইটা আমি জানি। হইছে কী, ফারহানার ওইসব হামবড়া পেজগিমার্কা কথাবার্তা শুইনা, বুঝছ, মেজাজটা এক্কেবারে বিলা হওয়ার জোগাড়।’ আরেফিন গজরাতে গজরাতে অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়।

শম্পা বুঝতে পারে, আর একটা মুহূর্ত সে ওখানে থাকতে চাচ্ছে না। ভীষণ এক অর্থহীন অসিত্মত্বে যেন পরিণত হয়েছে তার চারপাশের সমস্ত কিছু। এই কফির কাপ, মুচমুচে সমুচা, সসের বোতল, চারপাশের লোকজনের কোলাহল, সবকিছু।

‘চুপ মাইরা গেলা কেন? কীভাবে আগাই কও তো?’ আরেফিন দ্বিতীয় সমুচায় আরেকটা কামড় দিয়ে জানতে চায়। তার ঠোঁটের ওপর-নিচে সমুচার গুঁড়া অংশগুলো লেগে থাকে। বদলে যাওয়া পরিবেশটা এমন না হয়ে যদি তার কল্পনার মতো হতো, তাহলে এখন হয়তো শম্পা হাতের টিস্যু পেপারটা দিয়ে সমুচার গুঁড়াগুলো ঝেড়ে দিত।

কিন্তু এ-সময় পুরো পরিস্থিতিটাই অন্যরকম চেহারা নিয়েছে। যদিও আরেফিনের আচরণে তার কোনো প্রতিফলন নেই। সে বরং মুখে লেগে থাকা সমুচার ভাঙা অংশগুলোর প্রতি কোনোরকম তোয়াক্কা না করে খেতে খেতেই কথা বলতে থাকে। আর শম্পার ভেতর সেই হাঁ-করা মুখের অসহ্য দৃশ্য এক বিশ্রী অনুভূতির জন্ম দেয়। ভালো লাগার সবকিছু চোখের নিমিষে প্রচ- বিরক্তি আর অসহ্যরকম যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সবকিছু মিলিয়ে সেখান থেকে ছুটে চলে যাওয়ার জন্য সে হঠাৎ চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

‘আরে, আরে, কী হইল তোমার? এমন লাফ দিয়া উঠলা কেন? শোনো, তোমার শুনতে ইচছা না করলে বলুম না। আর তোমার কিছু করা লাগব না। আমার নিজের ব্যাপার নিজেই সামাল দিমু। তোমারে বন্ধু ভাইবা শেয়ার করতে চাইছিলাম। ভাবছিলাম, কোনো শলা-পরামর্শ দিবা। এখন দেখতাছি, ভুল কইরা ফেলছি। চলো, তোমারে রিকশায় উঠায়া দিই।’

চার

ফারহানার রুমে ওর ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসা শম্পা। সব সময়ের অতি-ব্যস্ত ফারহানা এখনো ফাইলের ভেতর কিছু খোঁজার চেষ্টায় নিমগ্ন। কিছু একটা খুঁজে পেতেই হবে; থাক বা না থাক। ভদ্রতার কোনো বালাই নেই। সহকর্মী এসেছে; অল্প-স্বল্প গল্প-টল্প করে চলে যাবে। অথচ তার ভাবখানা এমন যেন এসবের পেছনে নষ্ট করার মতো অত সময় তার হাতে নেই। প্রকৃত ঘটনা তা নয়। তার পছন্দের লোকজনের সঙ্গে (এরা তেল-মাখন প্রদানকারী গ্রম্নপ অব কোম্পানি, যারা ফারহানার সবকিছুতেই মুগ্ধ!) ঠিকই হাহা-হিহি, নান্না মিয়ার বিরিয়ানি আর প্রেসক্লাবের শিঙাড়া-বেগুনি চলে।

শম্পা মোটামুটি বুঝে ফেলেছে, যে-কোনো কারণে হোক অথবা কোনো কারণ ছাড়াই, ওয়ার্কিং রিলেশনের বাইরে ফারহানা তার সঙ্গে খুব বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে জড়াতে আগ্রহী নয়। যদিও তাকে শম্পার ভালোই লাগে। হতে পারে শুরু থেকেই সে ক্যারিয়ারের ব্যাপারে অতিরিক্ত সচেতন থাকতে চায়। অযথা এমন কিছু করতে চায় না যাতে ভবিষ্যতে কোনোরকম সমস্যা হতে পারে। তা না হলে চাকরিতে ঢুকতে না ঢুকতে ‘হাইপার-অ্যাকটিভ’ বসের কাছ থেকে ‘প্রো-অ্যাকটিভ’ বিশেষণ বাগিয়ে নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।

কই শম্পার বস তো এমন কিছু বলে না তার সম্পর্কে। বরং তার মতামত পুরাই উলটা। ইনফ্যাক্ট, কোনো কাজ দিয়েই আজ পর্যন্ত তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি সে। তার বসের অভ্যাস হচ্ছে, আচমকা যখন-তখন ইন্টারকমটা বাজিয়ে জানতে চাওয়া, ‘হোয়াট কিপস ইউ বিজি?’ প্রথম প্রথম শম্পা তো কোনো মানেই বুঝতে পারেনি বসের এই কিম্ভূত আচরণের। তারপর একদিন সে নিশ্চিত হলো যে, দীর্ঘমেয়াদি ইগোইজমে ভুগতে থাকার কারণে ব্যক্তিগত জীবনে সেটল করতে না পেরে তিনি মূলত একজন ‘সিরিয়াস সাইকো’তে পরিণত হয়েছেন। সেদিন থেকে শম্পা আপ্রাণ চেষ্টা করে, বসের এ-ধরনের যাবতীয় অগ্রহণযোগ্য আচরণকে পুরোটাই করুণার দৃষ্টিতে দেখতে।

‘তুমি মনে হয় আজকে অনেক ব্যস্ত, যাই তা হলে।’ শম্পা বসের ভাবনা থেকে ফারহানার দিকে চোখ ফেরায়। এভাবে আর কতক্ষণ অপমান সহ্য করা যায়?

‘তুমি কি কিছু বলতে আসছিলা?’ ফারহানার কাটখোট্টা ফিরতি প্রশ্ন। শম্পার কথার কোনো জবাব না দিয়ে। সে ঠিকই অনুমান করে ফেলেছে, আজকে তার রুমে শম্পার আসার আসল কারণটি।

‘এসেছিলাম, কিন্তু তুমি এত ব্যস্ততা দেখাচ্ছ যে…’

‘ব্যস্ততা কেউ দেখায় না, শম্পা, এটা তোমার জানা উচিত।’ শম্পার কথা শেষ করতে না দিয়ে ফারহানার ইনটেরাপশান।

‘তুমি কি কোনো কারণে আমার ওপর বিরক্ত? কিন্তু আমার তো মনে পড়ছে না, আমি এমন কিছু করেছি বা বলেছি যাতে তুমি আমার সঙ্গে এমন করতে পারো।’ শম্পা একটু হাসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

‘না, তোমার ওপর না। আমার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে আছে আরেফিনের ওপর। সে আমার বিরুদ্ধে অফিসে নানা কথা বলে বেড়াচ্ছে। তুমি কিছু জানো না তা তো নয়। সে তো তোমার সঙ্গে অনেক কিছু শেয়ার করে বলে জানি। সেদিন দেখলাম, মেলায় একসঙ্গে বসে গল্পও করছ। আমি তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি, আমার সম্পর্ক আছে রায়হানের সঙ্গে। আমরা ক’দিন পরে বিয়ে করব। সে বিশ্বাসই করতে চাইছে না। রায়হানের অফিসেও লোক লাগিয়েছে যাচাই করার জন্য। আচ্ছা, জোর করে কি প্রেম করা যায়? আবার দেখি তোমার সঙ্গেও ফুসুরফুসুর করে। একটা বেয়াদব ছেলে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমি অথরিটির কাছে কমপেস্নইন করতে বাধ্য হবো।’ এতক্ষণ তেমন কিছু না বললেও এখন বলতে শুরু করে ফারহানার কথা যেন থামতেই চাচ্ছে না।

শম্পার ভেতর কিছু একটা হয়। সে ঠিক বুঝতে পারে না তার এখন কী বলা উচিত। তারপরও ফারহানার এতগুলো কথার জবাবে তার কিছু একটা বলা প্রয়োজন। বিশেষ করে ওই ‘ফুসুরফুসুর’ কথাটা তার পছন্দ হয়নি।

‘শুনলাম তোমার কথা। সবই বুঝলাম। কিন্তু কে কার সঙ্গে ‘ফুসুরফুসুর’ করবে সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। আরেফিনের বিষয়ে তোমার আপত্তি-অভিযোগ থাকতে পারে, সেটা তুমি তার সঙ্গে কথা বলে তাকেই জানাও। আমাকে এর মধ্যে টানছ কেন? আমি এসেছি তোমার সঙ্গে কথা বলতে। তোমার কাজ থাকলে চলে যাব। কিন্তু আমাকে কোথায় কার সঙ্গে দেখা গেল আর সেটা নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা কেন হবে তাও আমার মাথায় ঢুকছে না।’

ফারহানার রুমে আর একটা মুহূর্ত থাকা সমীচীন হবে না ভেবে শম্পা বের হয়ে নিজের রুমে চলে আসে। মনে মনে শপথ করে, এই শেষ। আর ওমুখো নয়। বাপরে, কী অহংকার! কোনো মানে হয় না। আরেফিনের ওপর এখন এত রাগ দেখালে চলবে কেন? নিজের থেকে কাছে যাওয়ার প্রশ্রয় দিয়েছে বলেই না আরেফিন সামনে এগিয়েছে। সেবার অফিসের বার্ষিক বনভোজনে গাজীপুরে গিয়ে কীরকম ন্যাকামোটাই না করল আরেফিনের সঙ্গে। একেবারে সবার সামনে। এখন কী ঝামেলা হয়েছে কে জানে! পুরনো প্রেমিক হাজির করে গা বাঁচাতে চাইছে। যত্তসব।

কিন্তু ফারহানার বিষয়ে মনে মনে যতই গজগজ করুক না কেন, শম্পার সব রাগ গিয়ে পড়ে আরেফিনের ওপর। একই সঙ্গে দুজন মহিলা সহকর্মীকে নিয়ে সে প্রেমের খেলা খেলতে চেয়েছে। যেখানে টিকে যায় আর কী! এখন শম্পার কাছে অনেক কিছুই খোলাসা হয়ে যায়। আরেফিন যে-কোনো একজনকে চেয়েছিল। এখানে কোনো ভালোবাসা ছিল না, ভালো লাগাও ছিল না। ছিল নিরেট প্রয়োজন। ফারহানা ছিল তার প্রথম পছন্দ। যখনই তার সম্পর্কের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল, এখন শম্পার দিকে ভিড়তে চাইছে।

শম্পাও তো মাথায় কম বুদ্ধি রাখে না। সে আজ ফারহানার রুমে গিয়েছিল তার মনোভাবটা বুঝতে। উচিত শিক্ষা হবে এখন আরেফিনের। দুই নৌকায় পা রাখলে এমনই হয়। এখন আমও গেল, ছালাও গেল। ফারহানার আচরণে এটা সবসময় বোঝা যেত, সে আরেফিনের সঙ্গে ফ্লার্ট করছে। সুযোগমতো সটকে পড়বে। অথচ শম্পার আবেগটা ছিল আন্তরিক; প্রথমবার প্রেমে পড়ার মতো। আরেফিন দুজনের কারো মনই ঠিকমতো পড়তে পারেনি। এখন পসত্মাক।

‘কী ব্যাপার, কাজ-কাম নাই নাকি? গালে হাত দিয়া কী এত ভাবতাছ?’ আচমকা আরেফিন শম্পার রুমে ঢুকে জানতে চায়। চোখে-মুখে সেই রোমান্টিক হাসি। শম্পা যেটাকে প্রেম বলে ভুল করেছিল।

‘কাজ থাকবে না কেন? কাজ মনে হয় শুধু তুমি আর তোমার ফারহানাই করো। আমরা খালি আঙুল চুষি আর গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়াই।’ শম্পা মুখের আগল খুলে দেয়। ওকে দেখে আজ এই প্রথম তার ভেতরে কোনো ভালো লাগা কাজ করল না। উলটা যেটা হলো, কেমন এক অসহ্য বিরক্তিতে মনটা ছেয়ে গেল।

‘আরে, আরে, কী ব্যাপার, এত খেপছ কেন? আর ফারহানাই-বা ঢুকল কেন এর মধ্যে? আমি তো দেখি বেদিশা হয়া গেলাম।’ অবস্থা সুবিধার না বুঝতে পেরে আরেফিন স্বভাবসুলভ রসিকতায় পরিবেশটা হালকা করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাতেও খুব একটা লাভ হয় না।

‘কেন, ফারহানা কী এমন মহারানী হয়ে গেছেন যে, তার কথা মুখে আনা যাবে না?’ শম্পা আরো ফুঁসে ওঠে।

‘আমি তো দেখতাছি মহাবিপদে পড়লাম। আচ্ছা, এত ক্যাচাল বাদ দিয়া আমারে এক কাপ চা দিতে বলো তো তোমার লোকটারে। আর তোমার যদি অন্য কিছু না থাকে, চলো আজকে একটা নাটক দেইখা আসি। মহিলা সমিতিতে ভালো একটা নাটক চলতাছে। নামটা যেন কী দেখলাম…।’

‘না, আরেফিন, আর নয়। অনেক হয়েছে এই নাটক দেখা। এবার আমি এই নাটকের অভিনয় থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। তোমাকে চা দিতে বলছি। আমি ডিজি স্যারের রুমে যাচ্ছি।’

বলতে বলতে শম্পা হাতে একটা নোটবুক আর কলম নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। প্রত্যাখ্যানের প্রস্তরাঘাতে আরেফিনের শ্যামলা মুখের উঁচু চোয়ালজোড়া ঘন নিকষ অন্ধকারে শক্ত হয়ে ওঠে।