দ্বীপ গ্যালারিতে হামিদুজ্জামান খানের একক প্রদর্শনী বৃত্তের বাইরে, শূন্যতায়

মাটি থেকে উঠে আসা
অন্ধকার … শূন্যতা, শূন্যতায়
কিছু রেখা, কিছু নাম
অচেনা চোখের ভেতর দোলে
পেন্ডুলাম সময় – সংকেত মৃতপ্রাণ হিরণ্যগর্ভ
এ নিসর্গ সন্ন্যাসে পরিত্রাণ – বিমূঢ়তা হিরণ্যগর্ভ।
(‘বিমূর্ত পরিত্রাণ’, হোসাইন কবির)

হামিদুজ্জামান খানের এবারের প্রদর্শনীর কাজে এক রহস্যময় অন্ধকার টের পাওয়া যায়। মানুষের মুখ, জ্যামিতিক আকৃতি, কাঠ ও পাথরের বুক ভেদ করে বেরিয়ে আসে আলো। এ-প্রদর্শনীর শিরোনাম – ‘ফিলিং দ্য ভয়েড’ বা শূন্যতাবোধ। বিষয় হিসেবে তিনি এমন ভাবনা বেছে নেওয়ার জন্যে বেশ কয়েকটি মানুষের মুখ উপস্থাপন করেছেন। মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন পাথর, কাঠ, জলরং, তেলরং, অ্যাক্রিলিক। প্রতিনিয়ত দেখা ফর্মকে ভেঙে আরেকটি নতুন ফর্ম গড়েন, যার ভেতরে তিনি একধরনের শূন্য ফর্ম নির্মাণ করে দেন। প্রত্যেক মানুষ অনেকের ভিড়ে একা। একাকী শূন্য মানুষের অনুভূতি হামিদুজ্জামান মানুষের মুখের আকৃতিতে দেখতে পান। হঠাৎ দ্বিখ–ত হয়ে দুটি মানুষের রূপান্তর হওয়ার মুহূর্তও দেখা যায় তাঁর আঁকা মুখগুলোতে।
ক্যানভাসে হামিদুজ্জামান খান একসঙ্গে চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের মেলবন্ধন উপস্থাপন করেছেন। বিষয় নির্মাণে একই হলেও মাধ্যম ভিন্ন – এমন ধারণাকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। জলরং ছবিতে হামিদুজ্জামান সিদ্ধহস্ত। সে-পরম্পরা এ-প্রদর্শনীতেও দেখা যায়। এবারের কাজের বিষয় সম্পর্কে তিনি বলতে চান – ‘আধ্যাত্মিক মাত্রা’। দর্শকের কাছে এনেছেন ধ্যানী কাঠামোর দৃশ্যায়ন, ধ্যানী রূপের বিমূর্তায়ন।
অ্যাক্রিলিকে গড়া প্রথম কাজটিতে দেখা যায় ক্যানভাস দুটি রঙে ভাগ করা। মেটে হলুদ ও কালো রঙা দুটি ফর্মকে ভেঙে মাঝখানে কালো রেখা টেনে শূন্যতা তৈরি করেছেন, ছবিটির শিরোনাম ‘আনভেইলিং’। নিজেকে প্রকাশ করার এমন অন্তর্দ্বন্দ্বের উদ্ভাসন পপুলার আর্ট বা পপ আর্টের চিত্রভাষায় দেখা যায়। গত শতকের ষাটের দশকের এই শিল্প-আন্দোলনের নাম ‘মেটারিয়ালিজম’। কিন্তু হামিদুজ্জামান খানের এ-প্রদর্শনীর কাজকে পুরোপুরি দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদের সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না।
বৃত্তাকার শূন্য আকৃতির অনুভব, অপ্রচলিত আকৃতি যেটি সচরাচর আমরা দেখি না, সেসব আকৃতিকে উপস্থাপন করাই এ-কাজের ধরন। একটি ভারী পাথরখ- কেটে অপ্রচলিত আকৃতির গড়ন তৈরি করা, সেইসঙ্গে আরেকটি শূন্য আকৃতি বা ফাঁকা আকৃতি তৈরি তাঁর পাথরের ভাস্কর্যে দেখা যায়। কাঠের অজস্র ফর্ম তৈরি করে সেটি গ্যালারির এক কোণে দেয়ালে স্থাপন এক নতুন মাত্রা তৈরি করেছে। প্রদর্শনীর সর্বমোট ৫৪টি কাজের মধ্যে ১৭টি মুখের আকৃতিতে ভিন্ন রকমের প্রকাশভঙ্গি দেখা যায়, যাতে বারবার ফিরে এসেছে দ্বিখ–ত, শূন্যতার প্রতীক। বাস্তব মুখের আদল ঘিরে রং প্রয়োগে নিজস্বতা, এক ধরনের মস্নান, অন্ধকার, বুনটে গড়ে ওঠা মুখ আমরা দেখতে পাই। ৪৮নং কাজে মুখের অবয়ব কালোরঙা, একপাশে সাদা রঙের রেখা প্রকাশ পেয়েছে। কোনো কোনো মুখে সরু রেখা জড়িয়ে নতুন আবহ তৈরি হয়। কোনো কোনোটি কোঁকড়ানো, মোচড়ানো মুখ হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। মনে হতে পারে, এ-ধরনের কাজে রেখার অতি ব্যবহার বা রঙের প্রলেপে ক্যানভাস আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এটি শিল্পীর নিজস্ব কৌশলের প্রকাশ বলা যায়।
তাঁর জলরঙে করা ছবিতে একধরনের কোমল রূপ দেখা যায়। বৃত্তের ভেতরে শূন্য হয়ে থাকা আকৃতির সঙ্গে মিশে আছে সবুজাভ রঙের আকৃতি। হামিদুজ্জামান খান একইভাবে ‘বৃষ্টি’ শিরোনামের ছবিতে জলরঙের কোমলভাব দেখিয়েছেন। স্পষ্ট করে বৃষ্টির আবহ দেখাতে চাননি কেবল, বৃষ্টির মুহূর্ত কেমন করে মূর্ছনা তৈরি করে তা প্রকাশ করেন সাবলীলভাবে।
হামিদুজ্জামান খান ভাস্কর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন অনেক আগেই। বহিরাঙ্গন নকশাকার ভাস্কর হিসেবেও তিনি জনপ্রিয়। এ-প্রদর্শনীর কাজগুলোতে আমরা অভ্যন্তরীণ সজ্জা ও বহিরাঙ্গন সজ্জার সংস্করণ দেখতে পাই।
বৃত্ত, উল্লম্বরেখা, আড়াআড়ি রেখা, সিম্বল, বুনট রঙের মাঝে উষ্ণতা, শীতলতা নির্বাচন সবই এ-প্রদর্শনীর কাজে রয়েছে।
দৃষ্টিনন্দন কাজের পরিবর্তে নিরীক্ষার মাধ্যমে এক ধ্যানমগ্ন মনোজাগতিক অনুভূতি নির্মাণ হামিদুজ্জামানের কাজের বিশেষত্ব। এখানে এক কাজের সঙ্গে আরেক কাজের সম্পর্ক তৈরি করে দর্শকদের নতুন ভাবনা উপহার দেওয়া হয়েছে। হামিদুজ্জামান খান সৃষ্টির বিস্তর ভুবন থেকে নতুন করে ত্রিমাত্রিক ও দ্বিমাত্রিক তলের মাঝে আকৃতি ও রঙের বিন্যাস প্রদর্শন করেছেন, এতে দর্শক নতুন নিরীক্ষার সঙ্গে পরিচিত হলেন। ভাস্কর্যের সঙ্গে চিত্রকলার মিশেল জলরং ও অ্যাক্রিলিকের ব্যবহারে বুনট ও ফর্মের বন্ধন তৈরি করে হামিদুজ্জামান খানের সৃষ্টিতে নতুন এক প্রত্যয় তৈরি হলো। রাজধানীর দ্বীপ গ্যালারিতে গত ১১ অক্টোবর শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনী শেষ হয় ১৫ নভেম্বর ২০১৯।