দয়ালের বাড়িতে একটা ভিড় জমে ওঠে

ঝর্না রহমান 

জাইলা পাড়ায় দয়াল রাজবংশীর বাড়িতে একটা দুর্দান্ত ভিড় জমে ওঠে।

আজ অবশ্য এ-সময় দয়াল রাজবংশীর বাড়িতে কোনো লোকসমাগমের কথা নয়। শুধু আজই বা কেন, দয়াল রাজবংশীর বাড়িতে কখনই লোকসমাগমের কথা নয়। যে-সমস্ত কারণে মানুষের বাড়িতে লোকজনের ভিড় জমে, যেমন জন্ম মৃত্যু বিয়ে অন্নপ্রাশন পূজাপার্বণ – ইত্যাদি উপলক্ষে আচার-অনুষ্ঠান – সে-সমস্ত কারণ এ-বাড়িতে একেবারে যে ঘটে না তা নয়,  কিছু তো প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটেই, সাংসারিক প্রয়োজনে কিছু আচার-

অনুষ্ঠানও করতে হয় – তবে তাতে না থাকে কোনো ঘটা, না থাকে কোনো ছটা। জন্ম বলো মৃত্যু বলো আচার-অনুষ্ঠান বলো – সবই হলো দায়। ধম্মের দায়। বিধানের দায়। ভগবানের দয়া পেতে হলে এসব দায় তো পালন করাই লাগে। তার জন্য ভিড়ের দরকার কী?

দয়ালের বউ কল্যাণী আর তার তিন মাথাওয়ালা বুড়ো বাপ বেতো রোগী সনাতন রাজবংশী ছাড়া এসবের জন্য আর কারো দায় থাকে না।

তবে দয়ালের ওপর ভগবানের দয়া নেই, যে-কারণে দয়ালের বউয়ের ছাওয়াল-পাওয়াল বাঁচে না। বিয়ের পর সাত বছরে কল্যাণী তিনটি ছেলে বিইয়েছে। দুটো অাঁতুড়েই মরেছে, তিন নম্বরটি একটু দেরি করে হাঁটা শিখলো, কল্যাণী ছেলে কোলে চার মাইল পথ পায়ে হেঁটে পুরনো কালীমন্দিরে পুজো দিয়ে এলো। আর তার পরদিন কল্যাণীর উঠোন লেপার ফাঁকে দুবছরের সবেমাত্র হাঁটাশেখা পোলা মা কালীর বরে তুরতুর করে হেঁটে নেমে গেল বাড়ির পেছনে পগাড়ে। উঠোন লেপা শেষ করে কল্যাণী গোবরমাখা বালতি নিয়ে পগাড়ে গিয়ে মরা ছেলে তুলে এনে আছড়ে পড়ে সদ্য লেপা উঠোনে।

বছরখানেক পর সেই ছেলেই যেন আবার কল্যাণীর তলপেটে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। কল্যাণী পেটে হাত বুলোতে বুলোতে মনে মনে পাথুরে ভগবানের পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলে, হে দয়াল, ইবার আমারে এট্টা ম্যায়া দেও, ম্যায়ার ছাতা। আমি তার নাম রাখমু ছাইছাতা। তারে তুমি চোহে দেইখো না দয়াল।

আর ঘরের দয়াল তার পেট হাতিয়ে বলে, পোলা, ইবারও তুই পোলা বিয়াইবি। প্যাট দ্যাখস না, কিমুন কুমইরা পোকের বাসার লাহান চোক্কা অইয়া রইছে। কোনো তফাৎ দেখতাছস?

কল্যাণী নিজের পেটে হাত দিয়ে পরখ করে। তার মনে হয়, না, এবার যেন পেটটা একটু ল্যাটাপ্যাটা। যেন একটু অন্যরকম। দয়ালকে বলেও সে-কথা।

কিন্তু দয়াল যেন তাতে খুশি হয় না মোটেও। যেন ছেলে হয়ে মরে গেলেও ভালো। মেয়ে হলে বেঁচে থাকবার কীই-বা দরকার।

তাই কিছুটা উদাসীনতা নিয়ে বলে, অউক, পোলা মাইয়া যা-ই অওনের অউক, ভগবান য্যান তারে দীর্ঘজীবী করে। আর তরেও কই, অত ধুমুসধামুস কইরা চলিস না। সাবধানে থাকিস।

কল্যাণী কী আর ধুমুসধামুস চলে! ঘরসংসারের নাড়াঘাটা এসব না করলে কি আর চলে?

তারপরেও কল্যাণী সাবধানে থাকে। ঘাটে নামে গুনে গুনে পা ফেলে। ঢেঁকির লোট মাটি দিয়ে বুজিয়ে রাখে। কাম নাই ঢেঁকি পারায়া।

লখা বলদটা দিনে দিনে যেমন মুষ্ক জোয়ান হয়ে উঠছে, তাই ওটা যতই আবাল আবুইধ্যা পোলার মতো কল্যাণীর গা চাটতে আসুক না কেন, কল্যাণী বেশি কাছে ঘেঁসে না। দূর থেকেই জাবনা গোলা জলটা বালতি থেকে চাড়িতে ছুড়ে মারে। লখা দুই নাক দিয়ে ভোঁস-ভোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে চাড়ের জাবনায় মুখ ডুবিয়ে দেয়। তারপর মাথা তুলেই গোঁয়ারের মতো এক ঝাড়া দিয়ে তিমি মাছের মতো জল ছিটিয়ে দেয়।

কল্যাণী মুচকি হেসে বলে, রাগ দেহ পোলার, আরে আবাল, তর কোন হুঁশ আছে, কাছে গেলেই চাটন-মাটন দিবার কালে দিবি প্যাটের মইধ্যে গুঁতা লাগাইয়া। তার বাদে অইব আমার সাড়ে সববনাশ।

লখার গোঁ তবু কমে না। অগত্যা কল্যাণীকে লখার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হয়। লখার মেহেদিরঙা চামড়ায় তাতে ঝিলিমিলি কাঁপন জাগে। আর চোখ দুটো কেমন মেয়েমানুষের চোখের মতো ঘন কালো হয়ে গলে পড়তে চায়।

লখা বোবা প্রাণী হলে কী হবে ওর ওই যে এক জোড়া কাজলমাখা চোখ, যা দেখলেই মনে হয়, তার ছেলেদের জন্মের পর রাই-সইষ্যার ত্যালে পাকানো সইলতার আগুনে কলার ডাউগায় যে কাজল তুইলা চৌক্ষে মাখায়া দিত সেই কাজল যিনি কল্যাণী তারেও মাখায়া দিছে।

চাইর বছর ধইরা লখা আছে দয়ালের বাড়িতে। হারাধন মিস্ত্রি বাপঠাকুরদার ভিটিখান আববাস শিকদারের কাছে জলের দরে বেইচা দিয়া ইন্ডিয়া যাবার কালে তিন মাস বয়সী বাছুরখান দিয়া যায় দয়ালেরে। বলে, দয়াল রে, পূর্বপুরুষের ভিটা আমি রাখতে পারলাম না, তয় লখারে থুইয়া গেলাম। তর বউয়ের পোলা বাঁচে না। লখারে পোলা জ্ঞান কইরা পালতে কইস। স্যায়ই থাকপো তগো কাছে আমাগো স্মৃতি। লখা কী বুঝলো কে জানে, পয়লা দিনেই কল্যাণীর পেটের কাছে মাথা গুঁজে দিয়ে ধাপ ধাপ করে দম টানতে লাগলো।

এই চার বছরে দেখা গেল মৃত ছেলেদের জন্য মাঝে মাঝে পেট পুড়লেও লখাকে নিয়ে কল্যাণীর দিন দিব্যি কেটে যাচ্ছে।

দয়াল অভ্যাসমতো জাল মেরামত করে, চাঁইয়ে শলা ঢোকায়, পলোর নড়োবড়ো বেড়িখানা গুনার প্যাঁচ দিয়ে দিয়ে শক্ত করে তোলে। তবে মৎস্য শিকারের এসব হাতিয়ার ব্যবহার করার মতো জলাশয় আর এখন পাওয়া যায় না। বেউথা নদী শুকিয়ে সেই কবেই হয়ে  গেছে শীর্ণ খাল। দাশরাসহ আশেপাশের আট-দশটা গ্রাম বেষ্টন করে থাকা খালটি ভরা বর্ষা ছাড়া একটা নালা মাত্র। শিবনাথের বাড়ির বাঁধানো বড় পুকুরটি ছাড়া এ-গ্রামে কোনো পুকুরও নেই। জহর সাদেকী হুজুরের বন্দেগিখানার পরিসর অতি দ্রুত বাড়তে থাকায় ওই পুকুর এখন বারো মাসই মুরিদানদের দখলে। শুকনো, হাজামজা দু-চারটি পুকুর পগাড়ই এখন গ্রামের সাধারণ মানুষের সম্বল। আর জাইলা পাড়ার এই অবশিষ্ট চার-পাঁচ ঘর রাজবংশী – এরা সাধারণই কী আর অসাধারণই কী, এরা তো সংখ্যালঘু ছাড়া অন্য কোনো শ্রেণিতেই পড়ে না। কাজেই তাদের কাজকাম সব আসগর মল্লিকের বাঁশতলার পানাপুকুরেই সারতে হয়।

আসগর মল্লিক বেঁচে থাকতেও এই পানাপুকুরটা নিয়ে তেমন ব্যস্ত ছিলেন না। ছেলেপুলেরা কেউ দেশের বাড়িতে থাকেই না। সবই শহরবাসী বা প্রবাসী। আববাস শিকদার, মোকাদ্দেস চেয়ারম্যান আর মিন্টু মাতবরের  নির্বাচনী হিসাব-নিকাশের হাতের পাঁচ এই পাঁচ ঘর রাজবংশী নিয়ে এই ছোট্ট এক মুষ্টি নিকিরিপাড়ার লোকজনের প্রতি আসগর মল্লিকের বরঞ্চ একটা সদয় দৃষ্টি ছিল। বেচারা জাইলা পাড়া। ওদের জাল ফেলার জন্য জলাশয় না থাকুক, ঘটিবাটি ধোয়াপাখলা আর দিনান্তে  মেয়ে-বউদের গা ধোয়ার জন্যও তো একটু জল চাই, না কি! তা ওরা করুক ব্যবহার। ওরাও মানুষ। এক আল্লারই সৃষ্টি সবাই। নইলে ওরা যাবে কোথায়!

আসগর মল্লিকের ছেলেপুলেরা সবাই শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত। বাবার মৃত্যুর পর এরা আর কেউ তেমন দেশগ্রামে আসে না। বাড়ি থাকে তালামারা। কাজেই আসগর মল্লিকের পানাপুকুরে দয়ালের লখা বলদের গা ধোয়ালে বা ছিদাম রাজবংশীর পেটকাচড়া ছোট পোলাটার ল্যাঙট-ম্যাঙট ধুলে কিংবা মলিনা পিসির এক খোয়াড় হাঁসের পাল সারাদিনে পাঁক ঘুলিয়ে জল দই বানালে কারো কিছু বলার থাকে না। 

তবে দয়াল ছিদাম কালীপদ নিবারণ ভূষণ এরা সবাই জানে, মল্লিক বাড়ির জলটা রোদটা বাঁশতলার ছায়াটা দোপের জলাজঙ্গলের শাকপাতাটা তারা খাচ্ছে ঠিকই, তবে খেতে হবে খুঁটার দড়ি ঠিক রেখে। ঠ্যাং যেন আর এক ইঞ্চিও না বাড়ে।

ঢপ-কীর্তনের ঢোল করতাল মিরদঙ্গ – এইসব বেদাত আওয়াজ যেন কানে না আসে। উলুমুলু শুনলে তো কথাই নাই। জিবলাই না শেষে কাটা পড়ে জাইলা পাড়ার বউঝিগুলার।

সনাতনের ভিটাখানের কোনায় পাটখড়ি আর পলিথিনের থানে একটা পুরান কালীর পট আর মা লক্ষ্মীর একটা পোড়ামাটির মূর্তি আছে। সকাল-সন্ধ্যায় তাতে দুটো নয়নতারা আর কালীগঙ্গার জলের ছিটে দেওয়া যায়, কেউ সেই পট ছিঁড়ে দিতে আসে না, এটা কি কম কথা! কল্যাণীর তেলজলসিন্দুর আর সাঁজবাতির আলো আছে বলেই না জাইলা পাড়ায় দিব্যি তুলসী চারাও হাত-পা ছড়িয়ে নাচে।

দুগ্গা দুগ্গা, ষাষ্টাঙ্গে গড় করি মা তোকে। হায় রে হারাধন, কোতায় রইছস রে পরিমল, গৌরীর বাপটার হাতে কিমুন মাছ উঠতো না রে দয়াল! আইচ্ছা গৌরীরে কি আর বিয়া দিবার পারছে! আহা রে কিমুন সোনার পিত্তিমা মাইয়াটা! ডাঙ্গরডাও হইতে দিলো না। দয়ালের বউ রে, মাইয়ার নাম মোখেও লইস না রে মা, পোলা অউক, অইয়া অইয়া মইরা যাইক তাও ভালো। তবু জাইলা পাড়ায় মাইয়া অওনের দরকার নাই।

দুই হাঁটুর ফাঁকে ঘাড় গুঁজে রাখা তিন মাথাঅলা সনাতন আপনমনে গজগজ করে আর মাকুতে সুতো প্যাঁচায়। এই সুতো দিয়ে সনাতন কী করবে তা সে নিজেও জানে না। তবু তিন কালের অভ্যাস বলে একটা কথা।

কল্যাণী সনাতনের কথাগুলো শোনে কিন্তু  মানে না।

তার পেটের ভেতরে পোলা না, একটা মাইয়াই আছে – এ-কথা সে পেটটাকে রোজদিনই বিশ্বাস করানোর তালে থাকে। গম্বুজের লাহান উঁচা হয়া ওঠা গর্ভটারে কল্যাণী হাতিয়ে হাতিয়ে একতাল প্যাকের লাহান ল্যাতাপ্যাতা বানায়া দিবার চায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নাভিখান। চিৎ পড়া কড়ির লাহান ফুইটা আছে। কল্যাণী নাভিটাকে উলটে দিতে চায়। ল্যাটাপ্যাটা গোল প্যাট আর উপতা নাভি মাইয়ার নিশানা। এদিকে সা জোয়ান হয়ে উঠেছে লখা। কল্যাণী পেট বাঁচিয়ে লখাকে খইলটা ভুসিটা দিয়ে জাবনা গুলে দেয়। লখা এক গরাস জাবনা খচরমচর করে কোঁৎ করে গিলে ফেলেই কল্যাণীকে খোঁজে। কাছে না থাকলেই ডাকাতের মতো হারে রে রে করে একটা গোঁয়ার-হাম্বা দিয়ে মাথা দিয়ে গুঁতোতে থাকে চাড়ি।

কল্যাণী দৌড়ে আসে। লখা অমনি মুখে জমিয়ে রাখা পানি ভুচুৎ করে ছিটিয়ে দেয় দুপাশে। কল্যাণীর পেটের ভেতর ছানাটাও হাঁটুভাঙা দ হয়ে উথালপাথাল লাথি মারতে থাকে। অন্দরে-বাইরে দুই জীবের যেন এক অদৃশ্য লড়াই লেগে যায়।

কল্যাণীর কেমন যেন সন্দেহ হয়, লখাতে আর তার পোলাতে একটা নিয়তির চক্রপাক আছে। লখাকে আচানকই মনে হয় য্যান শত্তুর। এই লখার আথাল সাফ-সুতরা কইরা না গোবর লইয়া উঠানে নামছিল কেবল কল্যাণী, আর সেই ফাঁকে পোলা গিয়া ডুইবা মরলো পগাড়ে। অখন স্যায় করুক ডাকাইতের লাহান দুরমুইশাপানা।

কুঁজো পিঠে ঢুকুশ-ঢুকুশ করে সনাতনই লখাকে ঘাসপাতা যা দেবার দিক। কল্যাণী গোবরটুকু তুলে নিয়ে যায়। ঘুঁটের তাল বানিয়ে চাপড়া চাপড়া বসিয়ে দেয় ঘরের বেড়ায়।

ঘাস আনতে গিয়ে কখনো সনাতনের দুপুর পেরিয়ে যায়। কোথায় পাবে সে এত ঘাস। কচুরিপানাই বা পাবে কোথায়। তার জন্য কে-ই বা জলমহালে কচুরিপানার চাষবাস করে বসে আছে। দয়াল জাল নিয়ে দূরদূরান্তে জলাশয়ের খোঁজে বেরোলে জালে বেঁধে কখনো কখনো কচুরিপানা নিয়ে আসে। কিন্তু সে তো মাঝেমধ্যে। আর বলদটাকে এই হাতির খোরাক খাইয়ে এত জোয়ানটা বানানোর দরকারই বা কী? দয়ালের তো আর খ্যাত পাথার নেই যে হাল বলদ দিয়ে চষবে। এই খাওনটা একটা গাইয়ের মোখে দিলে তা ফেরত আসতো বাঁটেই।

অ দয়াল, যা কই শোন, দামড়াটারে বেইচা এ্যাটা গাইগরু কিন রে ছ্যামড়া। বউটার আহুজ আসতে আছে। দুধটা কামে লাগবো। ইটু দুধ দিয়া সন্ন সিন্দুর খলে মাড়াইয়া খাইলে আমার শেলেষাটাও ইটু কমতো রে দয়াল।

বাপের কথায় প্রথমে খেঁকিয়ে উঠেছিল দয়াল।

ক্যান, বুইড়া অইছে বইলা কি বলদটার জন্য দুইডা ঘাস জোগাড় করা পারবো না সে? তবে কি সে ঘোড়ার ঘাস কাটপো?

কল্যাণী নিরস্ত করে স্বামীকে। এ কী নিমপাতা মুখ গো! বাপ অইল ভগমান! তারে অমান্যি!

তো মান্য করে হবেটা কী?

হবে তো! হারাধনের কথাটা তো এই কটা বছরে একদিনের জন্যও ভোলেনি দয়াল। সংসারে একটা বোবা প্রাণী, কতই বা সে খাবে। তার তিন তিনটা পোলা থাকলে ওরা কি দুটো দুধভাত, একটু চিনিচাম্পা কলা আর ভেজা আলোচালের পেসাদ খেতো না। এ তো দুটো ঘাসপাতা খড়বিচুলি! হারাধন কি বড় মিত্রজন ছিল না?

তবে? হারাধনের আবালটাকে কল্যাণী কি নিজের পোলা-ই জ্ঞান করে না?

নিশ্চিত জ্ঞান করে। লখাকে নিয়েই তো আছে চার চারটা বছর!

কিন্তু অখন তো প্যাটেরটার কথাও ইট্টু ভাবন-চিন্তন লাগে। গাইগরু পালনপোষণ তো বাপ ঠাকুরদার আমল থনেই মা ভগবতীর আরাধনা বইলাই মনে কইরা আসা হইতাছে। জাল তো অখন কেবল আড়ার শোভা। বাবাঠাকুরের কথামতোন বলদটা বেইচা একটা গাইগরু কিনো। কামে দিব।

কল্যাণীর কথার পাশাপাশি সনাতন আর একটা আশঙ্কার কথা বলে। সময় থাকতে বলদটা বেচতে না পারলে দেখা যাবে কবে দয়ালের ভাঙা আথালের খুঁটিটা উপড়ে কে বা কারা লখাকে হাপিস করে দিয়েছে। তখন দয়াল যাবেনে কার কাছে।

এইটা একটা ভাবনা বটে। এমন তো দয়ালদের জন্য হামেশাই ঘটবার বিষয়। মাটির ভাটিতে দু-কলসি জল ঢেলে কাহাইলে কোটা গাব গুলিয়ে কষ বার করছিল দয়াল। হাত দুখানা ঝেড়ে আবালটার দিকে জরিপের নজর দেয়।

বড় নধর হইছে হাছাই। কত দর উঠবার পারে কও ছে।

কল্যাণী লখার দিকে তাকিয়ে কেমন শিউরে ওঠে। লখা কেমন ডাকাইতের লাহান চায়া আছে। নড়ে ওঠে পেটের ছানাটা। দুগগা দুগগা! হরেদরে আরও চাইরডা মাস প্যাটটা টানন লাগবো, তার বাদে ভগবান যদি মোখ তুইলা চায়, সুখেলাভে খালাস হইব কল্যাণী। থাক বাছা, মায়ের নাড়িখান কামড় দিয়া সিজিল-মিছিল হইয়া এই কয়ডা দিন পইড়া থাক জাদু আমার। পেটের ওপর আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় কল্যাণী।

এখন দয়ালের উঠোনের একপাশে গোবর জলে লেপাপোছা বেদির ওপর ময়ূরের লাহান পেখম ছড়ানো তুলসী গাছখান কেমুন ঝিম মাইরা আছে। তারই তলে দুই হাঁটু মুড়ে দ হয়ে পড়ে আছে কল্যাণী।

লখার গুঁতাটা খায়াই মাটিতে দাপায়া পইড়া কল্যাণী এমুন গাও মোচড়াইতে লাগলো, দুই ঠ্যাং প্যাট বরাবর জাইতা ধইরা জম্মের চাপ। য্যান কল্যাণী নিজেই নিজের খালাস করবো। কচি বাচ্চা চাপ খায়া প্যাটেই গইলা গেল জল হয়া। সেই বাচ্চার রক্ত কি লখার চায়া কোনো অংশে কম নিহি?

জাইলা পাড়ার মলিনা পিসি আর ছিদামের বউ মিলে কল্যাণীকে টেনে-ছেঁচড়ে রক্তকাদার খাবুরটা থেকে নিয়ে এসেছিল তুলসীতলায়। কল্যাণী যেন পা দুটোর মধ্যেই ঠেসে দিয়েছিল সমস্ত শক্তি। ও দুটো আর টেনেও সোজা করা যায়নি। গাব গোলানো মাইটালটার কাছে তুমুল দুরমুশ করা জায়গাটার ওপরে কাদামাটির ফাঁকফোকরে সর পড়া দইয়ের মতো ঘন হয়ে জমে আছে রক্ত। রক্তে রক্ত মিশেছে। লোকজন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে সেই রক্ত।

আজ তো সরকারি ছুটি ছিল। জাইলা পাড়াটুকু ছাড়া সর্বত্র চলছিল ঈদের আয়োজন। বাড়ির উঠোনে পালানে রাস্তার ধারে  গরু-ছাগল কোরবানি চলছিল। লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে তাই দেখে। কোরবানির ঈদের আনন্দই হলো গরু-খাসির জবাই দেখা। চার পা দড়াদড়ি দিয়ে বেঁধে মাথাটা ঠেসে ধরে একবার মাটিতে ফেলতে পারলেই হয়, মৌলবির ছোরার তলায় একবার কেমন ঘোলা চোখে দিষ্টি দেয় প্রাণীগুলো। তার খানিক বাদেই দিব্যি থরে থরে ভাগে ভাগে সজ্জিত হয়ে ওঠে মাংস। লোকজনের আজ গোস্ত খাওয়া ছাড়া অন্য কোনো কাজকম্মের কথা ভাববারও কথা না।

তিনদিনের সরকারি ছুটি। অফিস-আদালত দোকানপাট সবই বন্ধ। ঈদ করনের জন্য লোকসকল যার যার বাড়ি গিয়া বইসা রইছে।

তাও দেখ কোত্থেকে মাছের গন্ধ পেয়ে বিলাইর লাহান সাংবাদিক আইসা জুটছে দয়ালের বাড়িতে। তাগো হাতে নানা কিছিমের দুই তিনখান ক্যামেরা। তারা য্যান খালি দয়ালের বাড়িখান না, পুরা গেরামখানের ছবি তুইলা আইজ ভাসায়া ফালাইব। দুইদিন বাদেই সংবাদপত্র ভইরা কেবল এই দাশরা গেরামের ছবি, এই দয়াল রাজবংশীর বাড়িখানের ছবি থাকবো – না কী কও! মনে কয় সবার চায়া বেশি ছবি থাকবো এই দয়ালের বউ কল্যাণীর। দেখ না কত ছবি তোলতে আছে তার! কি ভাইগ্য এই নির্বইংশা দয়াল জাইল্যার কও! অর তিন পুরুষে কেউ কোনোদিন ছবি তোলছে?

মলিনা পিসি তুলসীতলায় হাঁটু মুচড়ে দ হয়ে পড়ে থাকা কল্যাণীর মাথার কাপড়টা যত্ন করে তুলে দিয়েছেন। মাইয়া মাইনষের ধম্মই তো থাকে মাথায়। মাথার অাঁচলে। অখন তুলুক কত ছবি তোলবার পারে তুলুক।

আহারে, বউটা তো কোনোদিন বেচাল চলে নাই। বাড়ির এই উঠান আর পালানটুক ছাইড়া কল্যাণী তো খালপাড়ের আলাদ্দির দোকানটাতেও যেতো না। হাঁস-মুরগির ছানা ফুটাতো, আচারটা বড়িটা আমের দিনে কচি আমের ফলসিটা বইচা আর তিত পুঁটির শুঁটকিটা – এই নিয়েই তো ছিল সে। আর ছিল তার লখা। লখারে লইয়া আছিল তার যত ভাবনা। লখার জাবনাটা অইব কী দিয়া, এর তার বাড়ির ফ্যানটা, চাউলপাত ধোয়া পানিটা, তরিতরকারির ছিলকামিলকা সব চায়া-চিন্তা নিয়া আইসা চাড়িটা সগল সুমায় ভইরাই রাখতো কল্যাণী। লখায় তো আছিল কল্যাণীর জানটা।

কিসের! উলটা কইলা। আসলে কল্যাণীই আছিল লখার জান। তা নইলে জান নেওনের মুহূর্তে কেমনে দুই ফাঁক করা গলা লইয়া স্যায় লৌড়াইয়া তিন বাড়ি পার হয়া আইসা কল্যাণীর বোকের মইধ্যে মোখ গুইঞ্জা দিলো?

এই ভয়াবহ দৃশ্যটি যে যেখান থেকে দেখেছে সেখানেই তার রক্ত হিম হয়ে গিয়েছে।

শুধু কি জনমনিষ্যি? দাশড়া গেরামের পুব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণের খেত পাথার বিরিক্ষি লতা পাখপাখালি জলা জাংলা কেউ কি আল্লার দুইন্যায় এমুন দৃশ্য কোনদিন দেখছে? দেখে নাই।

কত রংবেরঙের গরু-ছাগল এই গেরামের খ্যাতে মাঠে বাড়ির পালানে চইরা বেড়াইছে। ঘাসপাতা খায়া প্যাট ফুলাইয়া এখানে সেখানে বইসা বইসা জাবর কাটছে। বাছুরগুলান গাইয়ের ওলানে গুঁতা দিয়া দিয়া দুধ খাইছে। কত মধুর দৃশ্য! এই গাঁয়ের খ্যাত পাথার ভাইঙ্গা দুই ফাঁক করা গলা লইয়া একখান বলদ দৌড়াইতেছে আর আসমান ভাইঙ্গা পড়তাছে তার লহু, আর মাটি ফাইটা উঠতাছে তার ডাক, এমুন কি কেউ কোনোদিন দেখছে?

আরে বলদ, বলদ না, ক লখা। লখারে কোনোদিন জানোয়ার বইলা জ্ঞান করছে দয়ালের বউটা? স্যায় না পোলার শোক ভুইলা থাকতো। লখার যে নানান পদের কুয়ারা আছিল বউডার লগে। মাতা ঘসতো, গাও চাইটা দিতো, কাছে না গেলে তো খাওন ফালাইয়া আবালডা কুইদা উঠতো।

সনাতন টালুমালু চোখে চারপাশে চেয়ে কথা বলে। সবার কথা শোনে। সাংবাদিক, পুলিশ আর কৌতূহলী জনতা এরা সনাতনের কাছেই গোটা ব্যাপারটা জেনে নেয়। সনাতন ছাড়া এখন এসব বলার মতো আছেই বা কে? দয়াল তো লখার পুরো জবেহ দৃশ্যটি দেখার পর সেই যে ঘরের ভেতরে যেয়ে মেঝেতে আছড়ে পড়েছে তার আর লড়ন-চড়ন নাই। ছিদাম আর তার বউতে মিলে এখন তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা চলছে।

তা দয়ালকে তো কল্যাণীই পরামর্শ দিয়েছিল বলদটা বেচে দিয়ে একটা গাই গরু কেনার, না কি?

হ্যাঁ, তা দিয়েছিল বটে। সনাতনই একদিন কথায় কথায় কথাটা বলেছিল। সা জোয়ান হয়ে উঠছিল লখা। খেতে চাইতো বেশি বেশি। লাঙল টাননের নাই, গাড়ি বাওনের নাই, তারে আর ঘরে রাইখা কাম কী? বদলে একখান গাই কিনুক দয়াল।

প্রথমে আবেগে টান পড়লেও পরে দয়াল বাস্তবতাটা বুঝেছিল।

দুদিন আগে আচানক গাহাক চলে এলো বাড়িতে। আর সে গাহাক হলো গ্রামের প্রতাপশালী মহাজন আববাস শিকদার। সঙ্গে তার রাখাল মইত্যা। লখাকে ঠেসে ধরে মুখ ফাঁক করে বয়স যাচাই করতে গেলে এক ঝামা-গর্জন দিয়ে কামড়ে দিয়েছিল রাখালটার হাত। আর তাতে হা-হা করে হেসে উঠেছিল আববাস শিকদার। লখার গায়ে বিশাল দুটো চাপড় মেরে রাখালটাকে লক্ষ করে বলে উঠেছিল।

তার দাঁত উঠছে কি না সেইটা ভালো কইরা বুঝায়া দিছে। এখন তুই ভালো কইরা দাঁত মাইজা ঘইষা ল রে মইত্যা। গোস্ত অইব না অইলেও এক মণ।

পাঁই করে ঘর থেকে বের হয়ে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল কল্যাণী।

হায় হায় গো, আমার কী সর্বনাশ অইল, আমার লখারে কারা নিবার আইছে গো। আগো কই গেলা তুমি? অ বাবা, তারা কী কামে এহানে আসছে। তাগো চইলা যাইতে কন। লখারে তো আমরা বেচুম না।

সনাতন করবেটা কী? সে দাওয়ায় বসে ছেঁড়া জাল হাতাতে হাতাতে দুর্বল গলায় দয়ালকে ডাকে।

দয়াল তখন বাড়িতে নেই। আর থাকলেই বা কী? দয়ালের সাধ্য কী গরুখান আর তার আথালে রাখে। যেখানে কি না শিকদারের পছন্দ হয়ে গেছে বলদখান। দয়াল তার গরু বেচার ইচ্ছা করুক আর না করুক, তাতে কিছুই যায় আসে না। শিকদার কোরবানি দেবার জন্য গরুটা পছন্দ করেছে এটাই আসল কথা। শিকদার পছন্দ করেছে আর সেই জিনিস তার বাড়িতে উঠবে না, এমন অনিয়মের কথা তো কেউ কখনো শোনেনি। সে একখান গরুই হোক কি দয়ালের বউটাই হোক একই কথা। খুঁটার দড়ি খুলে বিষম টানাটানি করে লখাকে নিয়ে যাবার মুহূর্তে দয়াল এক পাঁজা ঘাসপাতা নিয়ে এসে হাজির হয়। মইত্যা এক ঝটকায় সে ঘাসের বোঝাটা মাথায় নিয়ে আবার লখার দড়ি ধরে টানতে গেলে সে এক গোত্তা মেরে দয়ালের কাছে এসে দাঁড়ায়। শিকদার তখন দয়ালকেই হুকুম করে গরুটাকে তার বাড়ি  পৌঁছে দিয়ে আসার জন্য। ন্যায্য দাম দিয়ে দেবে।

কিন্তু দয়াল তো একবারও শিকদার সাবকে তার গরু বিক্রির কথা বলেনি! কাউকেই এখনো বলেনি!

তা না বলুক। তার আগেই বলদটা বড় পছন্দ হয়ে গিয়েছে। কোরবানির হাটের গরুগুলার গায়ে সব মদ খাওয়া মাংস। মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়ায় আলু চিটাগুড় আর অ্যালকোহল মিশায়া খাওয়াইয়া গরুগুলার হাড্ডিও থলথলা মাংস বানায়া ফেলে। ওই গরু খাইতে লাগে ছাবাছাবা। দয়ালের গরুটার বড় চিকনাই। একেবারে রসালো মাংস।

কল্যাণী দুই পা মেলে দিয়ে বিলাপ করতে বসলে দয়াল কীভাবে যায় তারই আদরের বলদখান হাতে ধইরা পরের বাড়ি দিয়া আসতে! দয়াল কেবল দুই হাত জোড় করে শিকদারের উদ্দেশে মিনমিন করে বলতে থাকে, লখারে লইতে চান ন্যান, তয় তারে জবো দিয়েন না জনাব। পরিবার তারে পোলা জ্ঞান করে। তার কলিজাটা ছিদ্র করবেন না।

আরে কয় কী! জাইলার পুতে গরুর লগে থাইকা থাইকা নিজেও গরু অইছে আর অর জরুরেও গরু বানাইছে। আরে গরু, গরুর জন্মই তো হইছে গোছ খাওনের জন্য! তো গরুরে জবো দিব না তো কি পূজা দিব?

শিকদার, মইত্যা রাখাল আর শিকদারের জোয়ান পোলা ইসমাইল – এই তিনজনে মিলা লখারে ছ্যারছ্যারাইয়া টাইন্যা লয়া যাবার পর কল্যাণী সাইঞ্ঝা বেলা তমাত উঠানে গইড় পাইড়া কান্দে। লখার খুঁটার সাথে মাথা কুইটা কপাল ফাটায়া ফেলে। তার মোখে একটাই বিলাপ, কী করলাম, হায় হায় আমি কী করলাম! পাতকী আমি আমার লখারে খুন করলাম।

লখাকে নিয়ে যাবার দুদিন বাদে কোরবানির ঈদ। এই দুদিনে কল্যাণী ভূমিশয্যা ছেড়ে ওঠে না। না নাওয়া-খাওয়া না তেল-পানি। একবার ভাত রাঁধা হয়নি দেখে সনাতন খেপে গিয়ে ধমাধম করে হাঁড়িপাতিল আছড়ে কল্যাণীকে মুখ করেছে। সোয়ামি-শ্বশুরকে অভুক্ত রেখে আর নিজে উপোস থেকে প্যাটের ছাওয়ালটাকেও মেরে মহাপাতকী হবার সাধ জেগেছে কল্যাণীর।&

ঈদের দিন সকাল থেকে কল্যাণীর চোখের জল আর থামছে না। দাওয়ায় বসে বসে লখার কত না স্মৃতিকথার পাতা আজ সে মেলে ধরে। লখার কাজলমাখা চোখ দুটা, তার ঢেউ তোলা হাম্বা ডাক যা শুধু কল্যাণীর জন্যই ডাকতো, আর লখার দুষ্টুমি … কত না মজা করে ঢুঁসা মারতো কল্যাণীর পেটে, হায়রে চাড়ি রে, ওরে চাড়ির জাবনা গোলা জল রে, কে-ই বা তোকে খাবে আর রেগে গিয়ে সেই জল তুলে নাক-মুখ দিয়ে পিচকিরির মতো কে-ই বা কল্যাণীকে ছিটিয়ে দেবে।

সুয্যিটা চালার মাথায় উঠে এলে দয়াল দুটো শুকনো চিড়ে চিবিয়ে এক ঘটি জল খেয়ে জালটা কাঁধে করে বেরিয়ে যায়। সনাতন ঢুকুস ঢুকুস করে আর দুটি চিড়া ভেজায়। আথালের ঝোপ থেকে দুখানা বিচাকলা এনে বাঁশের চালুনে ঘসে ঘসে লেই বের করে আনে। গরুর শোকে পুতের বউ আউলা হলো কিন্তু প্যাট তো এসব বুঝবে না।

এরই মধ্যে ছিদামের বড় পোলাটা এসে গাড়লের লাহান খবর শুনায়া গেল, লখারে জবো দেওয়ার জন্য মসজিদের আঙিনায় নিয়া আসছে শিকদারের লোকজন। লখার দুই চোখ বায়া গাবের কষের লাহান নাকি কালো জলের ধারা নামছে।

খবর শুনে কল্যাণী আথালে এসে আছড়ে পড়েছে। জাবনার চাড়টা জড়িয়ে ধরে মড়াকান্না কাঁদতে লেগেছে।

এই আড়াই দিনে কল্যাণীর গোপুত্র শোকটা জেলেপাড়ার লোকজনের কাছে ম্যাড়মেড়ে হয়ে এসেছে। যেই দ্যাশে যেই ভাও। তারা যখন হাড়িকাঠে পাঁঠার গলাটা ঠেসে দিয়ে এক কোপে কল্লাটা ধড় থেকে আলাদা করে দেয়, সেই পাঁঠাও তো কেউ না কেউ পালন পোষণ করে না কি! পালা জীবের জন্য মায়ামহববত থাকবেই। আর আল্লাখোদা ভগবানের তরে উচ্ছুগু্য করা জীবের জন্য কান্নাকাটিরও তো বিধান নাই।

তাই আজ একাই কল্যাণী আছাড়ি-পিছাড়ি করে। ঘরসংসারের কাজ ফেলে কেউ আর আজ দয়ালের উঠোনে এসে দাঁড়ায় না। সনাতন লেগে পড়ে একটা পাতনা বড়শির ছিপ চাঁছতে। আর দয়াল তো গেছে মাছের সন্ধানে।

আচমকা একটা শোরগোল। সেইসঙ্গে হেই হেই ধর ধর সর সর। সনাতন কান পেতে ভালো করে বুঝবার আগেই পাড়ার কোন পোলা এসে যেন বলে গেল, লখা ছুইটা গেছে। লখারে জবো দেওন যায় নাই। মলবিরের  ছোরাসহ উলটাইয়া ফালায়া দিয়া দড়িকাছি ছিঁড়া লখা পাথার ভাইঙ্গা ছুটছে।

কল্যাণী আলুথালু বেশে আথাল থেকে উঠে দাঁড়ায়। লখারে লখা!

শোরগোল! শোরগোল!

উন্মত্ত একটা ঝড়ের মতো লখা ছুটে এসে আছড়ে পড়ে কল্যাণীর গায়ের ওপর। লখার সাথে উঠোনে পটকন খেয়ে পড়ে কল্যাণী। লখার গলা দিয়ে গলগল করে রক্ত ঝরতে থাকে। আর কল্যাণী পেট চেপে ধরে আর্তনাদ করে কুঁকড়ে দলামোচড়া করে ফেলে দেহ।

কল্যাণীর দাপানি থামতে বেশিক্ষণ লাগে না।

লখা দাপাতেই থাকে। ওর গলায় আড়াই পোঁচের এক পোঁচ সবে দিতে পেরেছিল মৌলবি। অসুরের মতো এক ঝটকায় মৌলবিকে উলটে ফেলে পায়ে দড়ির ফাঁস ধরে রাখা দুই রাখালকে শিঙের গুঁতোয় ঘায়েল করে ছুট লাগিয়েছে। ফাঁক হয়ে যাওয়া গলা নিয়েও ঠিক ছুটে এসেছে তার আপন জায়গাটায়। আপন মানুষটার কাছে।

দেহের সব রক্ত বেরিয়ে যাবার আগেই নিস্তেজ হয়ে আসা জীবটি দয়ালের উঠোনেই পুরোদস্ত্তর জবাই হয়ে যায়। এবার আর ওটাকে বাঁধাছাঁদারও দরকার পড়ে না। শিকদার নিজেই আল্লাহু আকবার বলে ছুরি চালিয়ে দিয়েছে। পশুটাকে যত তাড়াতাড়ি কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়া যায়।

তাছাড়া দয়াইল্যার বউয়ের কথাটাও তো ভাবতে হইবো। শত হইলেও পুত্রস্নেহ দিয়া মানুষ করছে না বলদটারে! যত তাড়াতাড়ি তার চৌক্ষের সামনে থাইকা গরুটারে সরানো যায় ততই ভালো।

আর দম বের হওয়া মাত্র লখাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গেছে শিকদারের লোক। শুধু উঠোনের একপাশে কাদামাটিতে গাঢ় থকথকে সিঁদুরের মতো এক ঢল রক্ত জমে থাকে।

থাউক, রক্তটুক এইহানেই পইড়া থাউক। এই কল্যাণীর হাতে খাইয়া পইড়াই না লখা এত বড় জুয়ানডা অইছে। শইলডা ভরা আছিল দশ কলস লোহু। দেহ না, কত রক্ত ঝইরা গেল তাও তা ফুরায় না।

আর ভগবানের বহুৎ দয়া রে দয়াল। কল্যাণীরে এই কঠিন দৃশ্য দুই চোখ মেইলা চায়া দেখা লাগে নাই। তার আগেই সে শান্তিধামে চইলা গেছে।

আর বউটার গর্ভের জীবটা? দেখ, আহা রে, কেমুন চাকা চাকা লোহু।

দেখ, তোমরাই দেখ, জাইলা পাড়ায় আর দেখবার লাহান আছেই বা কী! আইজ জবর একটা দেখবার লাহান ঘটনা ঘটছে।

দয়ালের বাড়িতে ভিড় বাড়তেই থাকে। নানা কিছিমের লোকজন। একসময় কোনো একটা টিভি চ্যানেলের  ক্যামেরাও চলে আসে। চারপাশ ঘুরেঘুরে দৃশ্যগ্রহণ চলতে থাকে। মোকাদ্দেস চেয়ারম্যান ঘটনাস্থলে চলে এসেছেন। সব কিছু সুশৃঙ্খল হয়ে ওঠে। শিকদার দয়ালের কাঁধে দরদি হাত রেখে কটি লালসাদা নোট তাসের মতো মেলে ধরেন। এরপর মাইক্রোফোনের সামনে চেয়ারম্যান সাহেবের ভাষণ। দয়ালের বউয়ের সৎকারের খরচের টাকা তিনি আর শিকদার মিলেই বহন করবেন। উৎসবের সাজে গণ্যমান্যজনাদের চেহারা ছবি ক্যামেরায় দারুণ বর্ণময় দেখায়।

এরপর বহুকাল পরে দাশড়া গ্রামে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সূচনা হয়। দয়াল রাজবংশীর বাড়িতে পরিপূর্ণভাবে কল্যাণীর সৎকার অনুষ্ঠানের আয়োজন চলতে থাকে। শাঁখা-সিঁদুর আর রক্তচন্দনের ফোঁটা দিয়ে সাজানো হয় কল্যাণীকে। নারীকণ্ঠের  সুরেলা উলুধ্বনি আর পুরুষকণ্ঠের উচ্চ হরিবোলের মধ্য দিয়ে আসগর মল্লিকের বাঁশতলায় জ্বলে ওঠে দয়ালের বউয়ের চিতা। বাঁশতলাটা তো পতিতই থাকতো! এই পতিত জায়গাটায় চিতা জ্বললে কীই বা এমন অসুবিধা!

গোটা ব্যাপারটার তদারকে থাকেন মোকাদ্দেস চেয়ারম্যান আর আববাস শিকদার। ক্যামেরায় ধারণকৃত দৃশ্যপটে দয়াল আর সনাতনও থাকে বটে। তবে তারা থাকে শোকাচ্ছন্ন। তারা থাকে দুই হাঁটুর ফাঁকে মাথা ঢুকিয়ে বসে। চিতার আগুনের আভায় তাদের মুখগুলো কেমন জল গোলানো রঙের ছবির মতো গড়িয়ে পড়ে যায়।

তবে এই চলমান টেলিদৃশ্যে একটা সাবজেক্টের বড় অভাব থেকে যায়। আর সে হলো লখা।