নকশাকেন্দ্রের আঙিনায়

জাহিদ মুস্তাফা

জনমানুষের রুচিবোধ তৈরিতে চারুশিল্পীরা অগ্রসর ভূমিকা পালন করেন। এদেশে মানুষের মনের ভেতর শিল্পের ঠাঁই যেটুকু গড়ে উঠেছে, তাঁর স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও তাঁর সতীর্থ-শিল্পীরা। কলকাতা আর্ট স্কুলের আদলে ১৯৪৮ সালে ঢাকায় গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্ট প্রতিষ্ঠার পর চারু ও কারুশিল্পের নান্দনিকতা ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে দেওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হয় এখানে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নকশাকেন্দ্র। শিল্পী কামরুল হাসানের হাতে এটির গঠন ও বিস্তৃতি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের একটি শাখা হিসেবে এর যাত্রা আরম্ভ হয়।
শিল্পপণ্যের মধ্যে সুন্দর ও রুচিশীল নকশা প্রবর্তনের মাধ্যমে দেশি শিল্পায়নের বিকাশ সাধনে নকশাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা। কামরুল হাসানের হাত ধরে ক্রমান্বয়ে যুক্ত হন ভাষাসৈনিক শিল্পী ইমদাদ হোসেন, কাইয়ুম চৌধুরী, আবদুল মুকতাদির, মোহাম্মদ ইদ্রিস, রওশন আরা আমিন, কে এম জি মুস্তাফা ও গোলাম সারোয়ারের মতো গুণী চিত্রকররা। তাঁদের কেউ কেউ বেঁচে নেই, কেউ কেউ পেশা-বদল করেছেন, আবার অবসর নিয়েছেন কেউ কেউ। উত্তরসূরিদের হাতে এখনো বেঁচে আছে নকশাকেন্দ্র। এটি সুখের কথা। তবে একে একে নিভেছে দেউটির মতো – নকশাকেন্দ্র ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তির পথে যাত্রা শুরু করেছে, এ-বিষয়টি শিল্পী ও শিল্পবোদ্ধাদের জন্য দুঃখজনক।
নকশাকেন্দ্রে নানা সময়ে জড়িত ও যুক্ত চারুশিল্পী-নকশাবিদদের একটি সংগঠন ‘আঙিনা’। দুবছর ধরে তাঁরা চারুকলা প্রদর্শনীর আয়োজন করছেন ঢাকা আর্ট সেন্টারে। সেই ১৯৬০ থেকে এ-পর্যন্ত নকশাকেন্দ্রে নকশা-গবেষণায় নিয়োজিত শিল্পীদের সমন্বয়ে এ-প্রদর্শনী চলেছে ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর ২০১৩ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। সাত দিনব্যাপী আয়োজিত এ-প্রদর্শনীতে কুড়িজন শিল্পীর চল্লিশটি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। 

এ দলের বয়োজ্যেষ্ঠ শিল্পী কামরুল হাসান (১৯২১-৮৮)। বাংলাদেশের আধুনিক চারুশিল্পের অন্যতম প্রধান উদ্গাতা। সাতষট্টি বছর বেঁচেছেন। জীবনের প্রায় অর্ধশত বছর সক্রিয় ছিলেন ছবি অাঁকায়। লোকজ মোটিফকে আধুনিক রূপায়ণে প্রাণবান করে তাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন জনমানসে। বঙ্গললনার শাশ্বত রূপকে অনবদ্য অঙ্কনে তুলে ধরেছেন কমনীয় লালিত্যে। কন্যা-জায়া-জননীর তিনটি রূপকে তুলে ধরেছেন শিল্পিত শক্তিতে, মা তাঁর শিল্পীজীবনের অন্যতম সৃজন-শিল্পের বিশ্বসভায় আদরণীয়।

সমগ্র জীবনে নানা ধরনের কাজ করেছেন কামরুল। অসংখ্য বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন, অঙ্গসজ্জা করেছেন, কার্টুনও এঁকেছেন কামরুল ছদ্মনামে। বাংলার লোকশিল্পের মোটিফ ও অন্যান্য উপাদানের আধুনিক প্রয়োগ করে আমাদের চারুশিল্পকে স্বকীয় পথে চালিত করায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশের আধুনিক চারুশিল্পের ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ তিনি। ১৯৭০-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার বিভাগে সমমনা শিল্পীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণার যে-গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন, তা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছে। পাক শাসক ইয়াহিয়া খানের রক্তখেকো অবয়ব এঁকে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রেরণাদায়ী ভূমিকা পালন করেছেন। ভাবতে অবাক লাগে, সেই ষাটের দশকের শুরুতে তিনি বাঙালি মানসে শিল্পবোধ নির্মাণে নকশাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হননি, শিল্পপণ্যে যে বিরূপ নকশা প্রবর্তন করা যায়, তার গবেষণাও তিনি করেছেন। আঙিনার এ-প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছে কামরুল হাসানের অাঁকা নানা ডিজাইনের খসড়া। সুনিপুণ তুলির অাঁচড়ে দক্ষ হাতে মোচড়ে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন একেকটি নকশা। সে-নকশায় আছে বটপাতা, নারী অবয়বের আভাস, ল্যান্ডস্কেপের সংকেত। সব মিলিয়ে নতুন ধরনের নকশা প্রবর্তনের শিল্পিত প্রয়াস। এগুলো ১৯৬৩ সালের কাজ।
আরেক গুণী শিল্পী ইমদাদ হোসেন (১৯২৬-২০১১) নকশাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যুক্ত ছিলেন। মাঝে কয়েক বছর বাংলাদেশ টেলিভিশনের মুখ্য শিল্প-নির্দেশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আবার ফিরে গেছেন নকশাকেন্দ্রে। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁরও স্বপ্ন ছিল – দেশে রুচিশীল মানুষ তৈরির। কাজ করেছেন শিল্পের ব্যবহারিক উপযোগিতা নির্মাণে। তাঁর দুটি নকশা প্রদর্শনীতে শোভা পেয়েছে। পোস্টার রঙে আঁকা দুটি মাছের নকশা এবং কাপড়ে আঁকা পুতুলের নকশা। তবে কাজ দুটির সময়কাল পাওয়া যায়নি। লোকজ নকশা ও বর্ণলেপনের ধারণাকে আধুনিক ও নান্দনিকভাবে তুলে আনার প্রয়াস আমরা লক্ষ করি তাঁর ওই সৃজনে। তাঁর সমগ্রজীবন তিনি নিবেদন করেছেন এদেশের মানুষের মুক্তি, রুচি নির্মাণ ও সুন্দরের ধ্যানে।
সমকালীন বাংলাদেশের চিত্রকলার অগ্রজ শিল্পীদের অন্যতম কাইয়ুম চৌধুরীর কর্মজীবনের সূত্রপাত প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জার কাজে নিয়োজিত হওয়া। ১৯৫৪ সালে তিনি গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্ট থেকে চিত্রকলায় স্নাতক হন। ১৯৬০ সালে তিনি কামরুল হাসানের সঙ্গে নকশাকেন্দ্রে যোগ দেন। প্রায় তিন বছর এখানে নকশাবিদের পেশায় নিযুক্ত ছিলেন শিক্ষক জয়নুলের ডাকে। ১৯৬২ সালে যোগ দেন চারুকলার শিক্ষকতায়। ৩৭ বছর শিক্ষকতা শেষে অধ্যাপক হিসেবে ১৯৯৭ সালে তিনি অবসর নিয়েছেন।
জয়নুল-কামরুলের পথ ধরেই বাংলার শিল্পকে নিজস্বরীতির পথে আধুনিক অভিযাত্রায় এগিয়ে নিতে এদেশে যাঁরা সচেষ্ট, কাইয়ুম চৌধুরী (১৯৩২) তাঁদের অন্যতম। আমাদের প্রকাশনা-শিল্পকে বিশ্বমানে উন্নীত করার কর্মপ্রয়াসে তিনি সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে দেদীপ্যমান। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বাংলার লোকজ নকশাকে আধুনিক রুচিশীলভাবে তুলে আনায় সিদ্ধহস্ত শিল্পী হিসেবেও তিনি অতুলনীয়। সেই ১৯৬২ সালে নকশাকেন্দ্রে কর্মরত শিল্পী হিসেবে পোস্টার রঙে যেসব নকশা এঁকেছেন তার দুটি নমুনা প্রদর্শিত হয়েছে। এর একটি চিত্রে কলসি কাঁখে এক বঙ্গললনার পেছনে কলাগাছ ও গোলবৃত্তের নকশা। এরকম অবয়ব ও নকশায় তিনি এখনো ছবি অাঁকছেন দেদার। নকশাকেন্দ্রে থাকতেই যে তিনি নিজের অাঁকার ঢং রপ্ত করেছিলেন, এটি প্রতীয়মান হয়। প্রদর্শনীতে তাঁর আরেকটি কাজ একেবারেই সাম্প্রতিক। সেটির শিরোনাম ‘নিসর্গ’ (২০১৩)।
শিল্পী আবদুল মুকতাদির (১৯৩২) নকশাকেন্দ্রের শুরু থেকে চৌদ্দো বছর পর্যন্ত নকশাবিদ হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। বাংলাদেশে প্রিন্ট মিডিয়ার বিজ্ঞাপন শিল্পে তাঁর অবদান গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ফ্রিল্যান্স শিল্পী হিসেবে তিনি এখনো সক্রিয় আছেন শিল্প-সাধনায়। প্রদর্শনীতে তাঁর পুরনো কাজ দেখলাম না। তাঁর দুটি চিত্রকর্মই নতুন। শিরোনাম – ‘নিসর্গ!’ চিত্রপটে বর্ণতলে তার ওপর অসংখ্য রেখায় বুননের মতো নকশায় বাঁধেন তাঁর কাজকে। এটি তাঁর স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
মোহাম্মদ ইদ্রিস (১৯৩১) আরেকজন অগ্রজ শিল্পী। নকশাকেন্দ্রে ১৯৬১ সালে যোগ দিয়ে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন। প্রাচ্যরীতির জলরঙে এঁকেছেন ‘প্রসাধন’। মাটির ঘরের বারান্দায় বসে চুল দিয়ে বেণি করছেন এক তরুণী। তার সামনে আয়না, পেছনে কলস। দাওয়ায় এক মোরগ উলটোদিকে তাকিয়ে যেন তার সাজ দেখছে।

নকশাকেন্দ্রে আরেকজন গুণী শিল্পী যুক্ত ছিলেন, তিনি গোলাম সরোয়ার (১৯৪০-৯৫)। কামরুল হাসান-কাইয়ুম চৌধুরীদের প্রবর্তিত নকশা নিয়ে তিনি প্রচুর কাজ করেছেন। অসংখ্য রেখাচিত্রও এঁকেছেন তিনি তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে। কাগজে কালিতে অাঁকা শিরোনামহীন দুটি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে তাঁর। নিরীক্ষাধর্মিতায় ও গঠনে আকর্ষণীয় হয়েছে তাঁর চিত্রকর্ম। 

শিরিন সুলতান (১৯৪৬) নকশাকেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ নকশাবিদ ছিলেন। এখন অধ্যাপনা করছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যানভাসে তেলরঙে তিনি এঁকেছেন ‘মাটির টানে’ শিরোনামে দুটি চিত্রকর্ম। দৃষ্টিনন্দন দুটি চিত্রকর্মে বাংলার পটারি তুলে ধরেছেন কাপড়ের ভাঁজের সামনে। বিষয় গতানুগতিক হলেও পরিবেশনায় নতুনত্ব লক্ষণীয়।
কামালউদ্দিন আহমেদ বাটিক পদ্ধতিতে এঁকেছেন পুষ্পশোভিত ষড়ং। নকশাকেন্দ্রে বর্তমানে যুক্ত শিল্পী সাইফুল ইসলাম চৌধুরী এঁকেছেন ছাপাই ছবি, ড্রাই পয়েন্ট মাধ্যমে। নিসর্গকে তিনি দেখেছেন নারী, পাখি ও মাছের নানা ফর্মের সঙ্গে মিলিয়ে। এস এম সামসুদ্দিন এঁকেছেন মাছের ছবি প্যাস্টেল রঙে। তিনি বর্তমানে নকশাকেন্দ্রে প্রধান নকশাবিদ পদে কর্মরত। সুধীর কুমার দত্ত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তুলে ধরেছেন ক্যানভাসে তেলরঙে। শরণার্থীরা জীবন বাঁচাতে দলবেঁধে নিরাপদ গন্তব্যের পথে ছুটছে – এই বিষয় তাঁর চিত্রকর্মের। কামাল আকন্দ এঁকেছেন প্রসাধনরত নারীর অবয়ব, ক্যানভাসে তেলরঙে। আবদুস সাত্তার এঁকেছেন ‘পাখির ভালোবাসা ও শান্তি’ ক্যানভাসে, অ্যাক্রিলিক রঙে। নকশাধর্মী কাজ দৃষ্টিনন্দনও বটে। মনোজকুমার দত্ত এঁকেছেন নদী-নৌকো-নিসর্গ। শাম্মী ইয়াসমিন এঁকেছেন ইরানি নারীর সুন্দর অবয়ব অ্যাক্রিলিক রঙে ক্যানভাসে।
আলী আকতার শাহীন এঁকেছেন নদী-নৌকোর স্মৃতিতাড়নার ছবি – ‘লাইভলিহুড’। হয়তো শৈশবকেই তিনি এই নামে তুলে ধরেছেন। মিশ্রমাধ্যমে ক্যানভাসে আঁকা এ-কাজ। সাবিনা জাহান এঁকেছেন ‘স্বপ্ন’, ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে। আলো-আঁধারির মধ্যে নিসর্গের রূপ – যেন বিদ্যুচ্চমকের পরের অনুভূতি বয়ে আনে।

শাহিদা আখতার ‘শান্তির সন্ধানে’ এঁকেছেন ক্যানভাসে তেলরঙে। সমকালীন সমাজবাস্তবতায় শান্তির অন্বেষণ করেছেন শিল্পী তাঁর সৃজনের পথে। সাহিনা ইসলাম নিসর্গের নতুন জন্ম যেন কল্পনা করেছেন। তাঁর চিত্রকর্মও ক্যানভাসে তেলরঙে আঁকা।
শেষোক্ত শিল্পীদের মধ্যে দশজন এখনো নকশাকেন্দ্রে কর্মরত। তাঁদের সৃজনশীল চিত্রকর্মের পাশাপাশি ব্যবহারিক শিল্পে তাঁদের গবেষণা নকশাও জনসমক্ষে তুলে ধরা প্রয়োজন বলে মনে করি। তাঁদের এই একতাবদ্ধ প্রয়াসের জন্য অভিবাদন।