নজরুল-বীক্ষা সমাচার

রাজিউল হাসান
নজরুল-বীক্ষা
সুব্রত কুমার দাস
গদ্যপদ্য
ফেব্রুয়ারি ২০১৩
ঢাকা
১৪০ টাকা

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় সংগীতজ্ঞ, সংগীতস্রষ্টা, দার্শনিক, সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে বিস্তর গবেষণার ফসল অধ্যাপক সুব্রত কুমার দাস-রচিত এবং গদ্যপদ্য থেকে প্রকাশিত নজরুল-বীক্ষা। সুন্দর এবং সাবলীল ভাষায় রচিত এ-গ্রন্থটি এগারোটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। পাঠক সাধারণত প্রবন্ধ, গবেষণা বা সমালোচনা জাতীয় গ্রন্থের দিকে আকৃষ্ট হতে চান না, কারণ এসব রচনা শুরু হয়ে বিরতিহীনভাবে অন্তে পতিত হয়। সে-বিচারে নজরুল বীক্ষা অবশ্যই পাঠক-সমাদৃত হওয়ার মতো একটি বই; কারণ বিভিন্ন পরিচ্ছেদে বিভক্ত হওয়ায় এখানে পাঠক পাঠজনিত ক্লান্তি অনুভব করবেন না।
গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদ ‘দেবকোটা : নেপালের নজরুল’। এ পরিচ্ছেদে লেখক নেপালের বিদ্রোহী কবি লক্ষ্মীপ্রসাদ দেবকোটা এবং বাংলাদেশের বিদ্রোহী কবি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন এবং কর্ম নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। এছাড়া এই পরিচ্ছেদে লেখক প্রমাণ করেছেন, বাঙালি কবি-সাহিত্যিকরাও পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের কবি-সাহিত্যিকদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারেন। অনেক সমালোচক মনে করেন, বাঙালি কবি-সাহিত্যিকরা পৃথিবীবিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক দ্বারা প্রভাবিত। মহাকবি দেবকোটা-রচিত ‘পাগল’ এবং নজরুল-রচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে এক্ষেত্রে লেখক প্রমাণ করেছেন, নজরুলের মাঝে যেমন বায়রন, শেলিকে খুঁজে পাওয়া যায়, দেবকোটার মাঝেও তেমন ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কিটসের পাশাপাশি নজরুল বিদ্যমান। এ পরিচ্ছেদে লেখক অভিমত জানাতে গিয়ে জাতীয় একটি ধারণাকে আরো জোরদার করেছেন। তা হলো,  আন্তর্জাতিকমানের অনুবাদকের অভাবজনিত কারণেই নজরুল এখনও নির্দিষ্ট গণ্ডির মাঝে সীমাবদ্ধ; নচেৎ জীবদ্দশায় ছিনিয়ে নিতে পারতেন নোবেল পুরস্কারের মতো বিশ্বনন্দিত বরমাল্য।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের শিরোনাম হলো ‘বিনয় সরকারের নজরুল-মূল্যায়ন’। বিশ্বপরিব্রাজক বিনয়কুমার সরকার জার্মানিতে বসেই নজরুলকে চিনে নিয়েছিলেন ‘বিদ্রোহী’ পড়ে। এ পরিচ্ছেদে লেখক বিনয় সরকারের পাণ্ডিত্য বর্ণনার পাশাপাশি বিভিন্ন আঙ্গিকে তাঁর নজরুল-মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন। এখানে জানা যায়, বিনয় সরকার নজরুলের মাঝে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর অতিপ্রিয় কবি মার্কিন হুইটম্যান এবং রবীন্দ্রনাথকে যুগলভাবে। পরিস্থিতির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতেই পরিচ্ছেদের কিছু কথা হুবহু তুলে ধরার প্রয়োজন অনুভব করছি : ‘তবে জীবনভর আয়ত্ত তাঁর জ্ঞানরাজির সংক্ষিপ্ত একটি রূপের সন্ধান পাওয়া যায় বিনয় সরকারের বৈঠক গ্রন্থে। প্রশ্নোত্তর আকারে লিখিত শপাঁচেক পৃষ্ঠার সে গ্রন্থের প্রথম খণ্ড ১৯৪২ সালে প্রকাশ পেলেও ১৯৪৪-৪৫ সালে দুই খণ্ডে দেড় হাজার পৃষ্ঠায় রূপ নেয় সে বৈঠক গ্রন্থ। গ্রন্থটিতে কাজী নজরুল ইসলামের প্রসঙ্গ এসেছে কুড়ি বার – কখনো ইঙ্গিতে, কখনো বিস্তৃতে। নজরুলের গান শোনা নিয়ে এক প্রশ্নোত্তরে তিনি ‘বিদ্রোহী’ প্রসঙ্গে জানান; ‘এই কবিতার চরম তারিফ করেছিলেন ফিউচারিলজম অব ইয়ং এশিয়া বইয়ে।’ প্রশ্নকর্তা সুবোধ কুমার ঘোষালের প্রশ্ন ‘চরম তারিফটা কী?’ – এর তাৎক্ষণিক উত্তর ‘নজরুল আধুনিক বাংলা কাব্যের যুগপ্রবর্তক।’
‘ফরিদপুরে নজরুল’ পরিচ্ছেদে এসে লেখক বর্ণনা করেছেন ফরিদপুরের ইতিহাসের কতখানি জুড়ে আছেন কাজী নজরুল ইসলাম। প্রসঙ্গক্রমেই চলে এসেছে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে নজরুলের পরিচয়ের ঘটনা, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে সম্পর্ক, বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মৃণাল সেনের প্রসঙ্গ ইত্যাদি। এছাড়া কবি নজরুলের রাজনৈতিক জীবনের কিছু চিত্রও উঠে এসেছে এখানে। ইতিহাসপাঠ সর্বদাই বিরক্তিকর বিরস রচনার কারণে; কিন্তু এ-পরিচ্ছেদে লেখকের সরস লেখনী পাঠককে দেবে ইতিহাসপাঠের প্রকৃত আনন্দ। সেইসঙ্গে অন্য আঙ্গিকে নজরুলকে চেনার একটা অবকাশ আছে পাঠকের জন্য। ঘটনা বর্ণনার ক্ষেত্রে লেখক উপস্থাপন করেছেন জসীমউদ্দীন, প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায় প্রমুুখের রচনা, স্মৃতিচারণ ইত্যাদি।
চতুর্থ পরিচ্ছেদে এসে লেখক সেসব সমালোচককে দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছেন, যাঁরা মনে করেন, নজরুল ইংরেজি ভাষা এবং পাশ্চাত্য সাহিত্য সম্পর্কে প্রতুল ধারণার অধিকারী ছিলেন না। এক্ষেত্রে লেখক মোবাশ্বের আলী, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়, শান্তিপদ সিংহ, সুশীলকুমার গুপ্ত প্রমুখের উদ্ধৃতি, প্রবন্ধ এবং স্মৃতিচারণকে প্রমাণস্বরূপ উপস্থাপন করেছেন; লিপিবদ্ধ করেছেন সেসব প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সাহিত্যিকগণকে, যাঁদের প্রসঙ্গ টেনেছেন নজরুল নিজের সৃষ্টি এবং কথায়। এই তালিকায় আছে শেলি, মিল্টন, নোগুচি, গোর্কি প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিকের নাম। এছাড়া লেখক নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন নজরুল কখন, কী প্রসঙ্গে পাশ্চাত্য সাহিত্যকে টেনেছেন নিজের কর্মে। উদাহরণস্বরূপ গ্রন্থের ‘নজরুল রচনায় ইউরোপীয় সাহিত্যের উল্লেখ’ শিরোনামের এই পরিচ্ছেদের ছোট্ট একটি অংশ তুলে ধরছি : ‘আত্মশক্তিতে ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ২০ আগস্ট প্রকাশিত পুস্তক পরিচয়ে ‘গণবাণী’র সমালোচনার উত্তরে নজরুল এ-পত্র লেখেন। পত্রটির শেষদিকে আছে : … যে-কোনো দেশের কোনো শ্রমিক কার্ল মার্ক্সের ‘ক্যাপিটাল’ পড়ে বুঝতে পারবে না। ঐ মতবাদটা যারা পড়বে, তারা কৃষক-শ্রমিক নয়, তারা লেনিন ল্যান্সব্যারির নমুনার লোক। কার্ল মার্ক্সের মতবাদ সাধারণ শ্রমিক বুঝতে না পারলেও তা দিয়ে তাদের মঙ্গল সাধিত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে।’
আবার এ পরিচ্ছেদের অন্য একটি স্থানে লেখা আছে : ‘১৯২৭ সালেই প্রকাশিত হয়েছিল প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁকে লেখা নজরুলের বিখ্যাত পত্রটি। নিজের সাহিত্যিক ও সামাজিক অবস্থান ও দায়িত্বকে সুস্পষ্ট করতে নজরুল সে-পত্রে বারবার বিভিন্ন প্রসঙ্গ টেনেছিলেন। ইউরোপীয়/ইংরেজি সাহিত্যের উল্লেখও ঘটেছে একাধিকবার। এক পর্যায়ে নজরুল লেখেন :
আমি যদি পাশ্চাত্য ঋষি হুইটম্যানের সুরে সুর মিলিয়ে বলি :
‘Behold, I do not give a little charity.
When I give I give myself’
তাহলে আমার সেটাকে অহঙ্কার বলে ভুল করবেন না।’
এভাবেই লেখক তাঁর পাঠককে বোঝাতে চেয়েছেন নজরুলের প্রতিভা এবং সেইসঙ্গে পাশ্চাত্য সাহিত্যে ও ইংরেজি ভাষায় নজরুলের জ্ঞান সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা সমালোচকগণকে ভুল প্রমাণ করেছেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদের শিরোনাম দিয়েছেন লেখক ‘কথাসাহিত্যে নজরুলের কৃতিত্ব’। এখানে তিনি কবি নজরুল নয়, কথাসাহিাত্যক নজরুলকে উপস্থাপন করেছেন। চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন নজরুলের রচনাশৈলী, ভাষার ব্যবহার, ঘটনার রহস্যময়তা এবং উপজীব্যতাকে। এ পরিচ্ছেদে এসে পাঠক জানতে পারবেন বাংলা কথাসাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামই প্রথম ব্যক্তি যিনি বিদ্রোহী মনোভাব নিয়ে উপন্যাস-গল্প রচনা করেছেন, প্রথম মুসলমান সাহিত্যিক হিসেবে খোলামেলাভাবে নিজের রচনায় উপস্থাপন করেছেন প্রেমকে, কথাসাহিত্যের ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি নিয়ে আসার প্রয়াস নিয়েছেন; আরবি, ফারসি শব্দের প্রচুর ব্যবহার করেছেন। এখানে নজরুলের প্রথম গল্প ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ থেকে শুরু করে প্রতিটি গল্প-উপন্যাসের রচনা বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করেছেন লেখক, যা পাঠককে কথাসাহিত্য এবং নজরুল সম্পর্কে গভীর জ্ঞানার্জনে সহায়তা করবে। তৎকালীন চলমান সাহিত্যের অন্যান্য কথাসাহিত্যিক হতে নিজেকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করে নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন নজরুল, সে-বিষয়েও লেখক গবেষণা করেছেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে লেখক নজরুলের সাহিত্যচিন্তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। নিখুঁতভাবে দেখিয়েছেন, নজরুল কীভাবে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে ‘সুন্দর’কে ব্যবহার করেছেন। এ কারণেই হয়তো এ-পরিচ্ছেদের শিরোনাম হয়েছে নজরুলের সাহিত্যচিন্তা এবং ক্রমপ্রকাশমান ‘সুন্দর’। পূর্ববর্তী পরিচ্ছেদগুলোর তুলনায় এখানে লেখক সহজ-সাবলীল প্রকাশ থেকে কিছুটা হলেও সরে গেছেন। হয়তো বিশ্লেষণের প্রয়োজনেই এমনটা করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। নজরুলের সাহিত্যচিন্তা মোটেই কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়। অতএব এ-বিষয়ে আলোচনা, গবেষণা করতে গেলে সহজ-সরল ভাষায় প্রকাশ দুঃসাধ্য একটা ব্যাপার। পরিচ্ছেদটিতে দেখা যায়, নজরুলের বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন আঙ্গিকে ‘সুন্দরে’র প্রকাশ এবং ব্যবহার। এছাড়া বিশ্বসাহিত্য নিয়ে নজরুলের ভাবনা, পাণ্ডিত্যের গভীরতা ইত্যাদি সুনিপুণভাবে গবেষণা করা হয়েছে বিভিন্ন উপাত্তের মাধ্যমে।
সহজ প্রকাশের সুবিধার্থে নজরুল-বীক্ষা গ্রন্থের সপ্তম, অষ্টম ও নবম পরিচ্ছেদ নিয়ে একত্রে আলোচনার প্রয়াস নিচ্ছি। এসব পরিচ্ছেদের শিরোনাম যথাক্রমে বাঁধনহারার ভূমিকা, বাঁধনহারার গঠনশৈলী এবং বাঁধনহারায় ‘বিদ্রোহী’র মানসভূমি। এখানে আবার লেখক ফিরে এসেছেন তাঁর সহজ এবং সাবলীল প্রকাশে। বাঁধনহারার ভূমিকা শিরোনামের পরিচ্ছেদে লেখক বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য আলোচনাপূর্বক সন্ধান করার চেষ্টা করেছেন কবি নজরুলের তুলনায় কথাসাহিত্যিক নজরুল ম্লান কেন। আলোচনায় দেখা যায়, কাজী নজরুল ইসলামই প্রথম কথাসাহিত্যিক, যিনি উচ্চ ও মধ্যবিত্ত আভিজাত্যকে এড়িয়ে জীবনঘনিষ্ঠ, ধর্ম-সম্পর্ক বেষ্টনীমুক্ত সাহিত্য রচনা করেছেন। তাঁর সাহিত্যে স্থান পেয়েছে নিæস্তরের খেটে-খাওয়া মানুষের জীবন। তিনিই প্রথম সাধুরীতির পরিবর্তে মানুষের মুখের ভাষাকে সাহিত্যে প্রয়োগ করেছেন। এত নতুন মাত্রা যোগ করা সত্ত্বেও নজরুলের কথাসাহিত্য কেন অবহেলিত, আসলেই তা গবেষণার বিষয়। এ পরিচ্ছেদে লেখক নজরুলের বাঁধনহারা সম্পর্কে বিভিন্ন পণ্ডিতের এবং পত্রিকায় প্রকাশিত মন্তব্য তুলে ধরেছেন; সেইসঙ্গে নজরুলের  গল্প-উপন্যাস রচনার সময়কাল নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। সপ্তম পরিচ্ছেদে গিয়ে লেখক বাঁধনহারার গঠনবৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ পরিচ্ছেদে পাঠক সত্যিই বাংলা সাহিত্যের এক নতুন সংযোজনের সঙ্গে পরিচিত হবেন। তা হলো পত্রোপন্যাস। নজরুলই যে প্রথম সফলভাবে এ-পদ্ধতি  প্রয়োগ করেছেন তাও বলেছেন লেখক। বাঁধনহারা মোট আঠারোটি পত্রের সমন্বয়ে নির্মিত একটি পত্রোপন্যাস, যা মোট নয়টি চরিত্র – ছয়জন নারী, তিনজন পুরুষের মাঝে আদান-প্রদান হয়েছে। পত্রের ভাষাতেই নজরুল বুঝিয়ে দিয়েছেন আঠারোাট পত্রের সমন্বয়ে রচিত হলেও বাঁধনহারার চরিত্রগুলোর মাঝে আরো অনেক পত্রের আদান-প্রদান ঘটেছে। ফলে পাঠক একধরনের রহস্যময়তা খুঁজে পাবেন এ-উপন্যাসে এবং সেইসঙ্গে গভীর চিন্তা করার অবকাশ পাবেন। এ পরিচ্ছেদে লেখক বাঁধনহারাকে নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি পত্রোপন্যাসের ইতিবৃত্ত এবং বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করেছেন। অষ্টম পরিচ্ছেদে লেখক বিদ্রোহী কবিতা এবং বাঁধনহারার মাঝে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় আমরা খুঁজে পাই একজন বিদ্রোহী মানুষকে, যিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন সকল শৃঙ্খল এবং সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে। চরম পর্যায়ের উত্তেজনা বিরাজ করে পুরোটা কবিতাজুড়ে। ঠিক একইভাবে বাঁধনহারায় কেন্দ্রীয় চরিত্র সৈনিক নুরুল হুদা যখন কাউকে পত্র লিখেছে বা তার কাছে পত্র এসেছে অথবা তৃতীয় কারো পত্রে তার প্রসঙ্গ এসেছে, তখন উত্তেজনা বিরাজ করেছে। এ পরিচ্ছেদে বিভিন্ন সাহিত্য-বিশেষজ্ঞের বরাতে বিদ্রোহী এবং ‘বাঁধনহারা’র বৈশিষ্ট্যগত মিল-অমিল নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন লেখক।
‘নজরুল ভাবনায় জাতীয় (বিশ্ব) বিদ্যালয়’ শিরোনামের দশম পরিচ্ছেদে লেখক উপস্থাপন করেছেন নজরুলের শিক্ষানুরাগ। এছাড়া এখানে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের দমননীতির একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। ইতিহাস রচনার আদলে লিখিত এ-পরিচ্ছেদটি পাঠককে আবার একটানে নিয়ে যাবে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে।  সে-সময়ে জাতীয় (বিশ্ব) বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের আগ্রহ ও ভূমিকাসহ এখানে লেখক তুলে এনেছেন শিক্ষাপদ্ধতি প্রসঙ্গে নজরুল কর্তৃক         প্রদত্ত দিকনির্দেশনা। নিজে সুশিক্ষা লাভ হতে বঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও নজরুলের শিক্ষানুরাগ প্রসঙ্গে সুপাঠ্য এ-পরিচ্ছেদে এসে কিছুটা হলেও আশ্চার্যান্বিত হবেন পাঠক।
একাদশ পরিচ্ছেদ, যার শিরোনাম ‘পশ্চিমা সমালোচকের নজরুল-বীক্ষা’, বলা যেতে পারে নজরুল-বীক্ষা গ্রন্থের উপসংহার। এখানে লেখক বর্ণনা করেছেন ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক উইনস্টন ই. ল্যাংলির নজরুলপ্রীতি, কী করে নজরুল সম্পর্কে তিনি আগ্রহী হলেন এবং লেখকের সঙ্গে অধ্যাপক ল্যাংলির পরিচয় ও সম্পর্কের বিবরণ। প্রসঙ্গক্রমেই চলে এসেছে নজরুলকে মূল্যায়ন করে অধ্যাপক ল্যাংলি কর্তৃক রচিত Kazi Nazrul Islam and the voice of poetry in the affairs of human kind
প্রবন্ধটি। এ পরিচ্ছেদে লেখক ল্যাংলি কর্তৃক নজরুলের সৃষ্টির বিভিন্ন গবেষণা এবং বিশ্লেষণকে তুলে ধরেছেন। এখানে অবাক করা ব্যাপার হলো, ল্যাংলি যে-দৃষ্টিভঙ্গিতে, যেভাবে বিশদ আকারে নজরুলকে মূল্যায়ন করেছেন, সেভাবে আমাদের দেশীয় কোনো পণ্ডিত কখনো পারেননি।
এবার আমার অনুভূতি প্রসঙ্গে আসি। গ্রন্থটি পড়ে একাধারে আমি অভিভূত, মুগ্ধ এবং সেইসঙ্গে কিছুটা অসন্তুষ্ট। প্রতিটা পরিচ্ছেদে যখন নজরুলের বিশেষ এক দিক নিয়ে মেতে উঠছিলাম, ঠিক তখনই উপসংহারে পৌঁছে যাচ্ছিলাম। স্বল্পপরিসরে আলোচনার এটা একটা সীমাবদ্ধতা। গ্রন্থটিতে যে এগারোটা পরিচ্ছেদ রাখা হয়েছে, লেখক চাইলে তার একেকটি নিয়ে একেকটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করতে পারতেন; নজরুল সাহিত্যকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করতে পারতেন। তবে সুপাঠ্য এ-বইটি নজরুলভক্ত, গবেষক এবং সাধারণ পাঠকের জন্য এক আশীর্বাদস্বরূপ। এখানে নজরুলকে এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা বেশিরভাগ পাঠকের অজানা। বইটির প্রতিটি পাতায় পাঠক রোমাঞ্চিত হবেন নতুন এক নজরুলকে পেয়ে। গ্রন্থটি প্রকাশের মাধ্যমে লেখক নজরুল গবেষণার এক নতুন দ্বার উন্মোচন করেছেন। অধ্যাপক সুব্রত কুমার দাসের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, এভাবেই তবে আরো বিশদ আকারে তিনি ভবিষ্যতে গবেষণার মাধ্যমে নজরুলকে পৌঁছে দেবেন আপামর জনতার কাছে এবং নজরুল-সাহিত্যকে করবেন আরো সমৃদ্ধ।