নতুন অনুবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মোহীত উল আলম 

ফকরুল আলম এবং রাধা চক্রবর্তী রবীন্দ্র-সাহিত্য নতুনভাবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করার জন্য একটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। তাঁরা দ্য এসেনশিয়াল টেগোর শিরোনামে আটশো উনিশ পৃষ্ঠার কলেবরে এক খন্ডে সমাপ্ত রবীন্দ্রনাথের বিভিন্নধর্মী রচনার ইংরেজি অনুবাদ সম্পাদনা করেছেন। শক্ত মলাটে বাঁধাই এ অমনিবাস খন্ডটি প্রকাশ করেছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসের পক্ষে বেলন্যাপ প্রেস। প্রকাশকাল ২০১১। গ্রন্থটির কোথাও মূল্যমানের উল্লেখ নেই।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ নিজেই উদ্যোগী ছিলেন। তাঁর গীতাঞ্জলি গ্রন্থেরই কিছু হেরফের করে তিনি ইংরেজিতে সং অফারিংস নামক গ্রন্থটির পান্ডুলিপি তৈরি করলেন, যেটি শুধু যে ইংরেজি সাহিত্যজগতে তাঁকে পরিচিত করে তোলে তা-ই নয়, তাঁকে নোবেল পুরস্কারও পাইয়ে দেয়। কিন্তু সে-মাহেন্দ্রক্ষণের বছর ১৯১৩-এর দশ বছর পুরো হতে না হতেই যখন পশ্চিমা বিশ্ব রবীন্দ্রনাথকে ভুলতে শুরু করে এবং অনেককাল পরে তার একটি হদিস বের করার জন্য যখন বুদ্ধদেব বসু উদ্যোগ নেন, তখন তিনি রবীন্দ্রনাথের নিজের কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে কয়েকটি সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করলেন। বুদ্ধদেব বললেন, রবীন্দ্রনাথ প্রথম ভুলটি করেছিলেন যে, তিনি নিজের ভালো কবিতাগুলি অনুবাদ না করে অপেক্ষাকৃত সাধারণ কবিতাগুলি অনুবাদ করেছিলেন। অর্থাৎ অনূদিত কবিতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ সুবিবেচনার পরিচয় দেননি। দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথ ভালো ইংরেজি জানলেও ততটা ভালো জানতেন না, যা ইয়েটসকে প্রাথমিকভাবে আলোড়িত করলেও পরবর্তী দশকের প্রধান কবি এলিয়টের

মনোরঞ্জন করতে পারে। আরেকটি কারণ আমরা বলতে পারি যার জন্য রবীন্দ্রনাথ দায়ী ছিলেন না। তাঁর কবিতা যখন ইংরেজি সাহিত্যে আলোড়ন তুলতে শুরু করে তখন ইউরোপ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে, সে অস্থির সময়ে বিপরীত দিক থেকে ইংরেজ মনীষার প্রাণ ছুঁয়েছিল রবীন্দ্রনাথের লিরিকস তাদের গীতলতা ও মরমি ভাবদর্শন নিয়ে, যা ইয়েটসের ভাষায় ছিল ‘ফুল অব সাটলটি অব রিদম, অব আনট্রান্সলেটেবল ডেলিকেইসিস অব কালার, অব মেট্রিক্যাল ইনভেনশন’ যা তিনি স্বপ্নের জগতে দেখেছেন কিন্তু বাস্তবে নয়। ইয়েটস রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ধর্ম ও কাব্যের ঐন্দ্রজালিক সংমিশ্রণ দেখে উদ্বেলিত হয়েছিলেন, কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর মতে, ওই আবেগটিই ছিল নেতিবাচক, কারণ পশ্চিমা পাঠক রবীন্দ্রনাথকে কবিরের মতো ধর্মগুরু-কাম-কবি ভাবতে শুরু করে। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ অর্জন ও তাঁর দেহত্যাগের মধ্যকার সময়টুকুতে ইউরোপ শুধু যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ করল তা নয়, তারা পৌঁছে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জঙ্গম পরিস্থিতির সম্মুখে এবং তার মধ্যে প্রাচ্যের ঋষি কবি রবীন্দ্রনাথের শান্তির ললিত বাণী শুনবে সে-ধৈর্য তখন পশ্চিমা সমাজে কোথায়!

তবে রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাঁর ইংরেজির ক্ষমতা নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন না। ১৮ নভেম্বর ১৯১৫ সালে লেখা একটি চিঠিতে (পত্রস্থ পৃষ্ঠা ১০৬) ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রিজেসকে রবীন্দ্রনাথ সবিশেষ লিখলেন যে, তাঁর কিছু পান্ডুলিপি দেখে যদি তিনি একটু ভাষাটা ঠিক করে দেন তাহলে তিনি খুব উপকৃত হন। বলছেন, বিষয় অনুবাদে তাঁর অসুবিধা না হলেও ইংরেজির ব্যাকরণ (যেমন অব্যয় পদ) ও বাগ্ধারার (ইডিয়ম এবং ফ্রেস) সঠিক ব্যবহার নিয়ে তিনি নিশ্চিত নন। (ফকরুল আলম ইউল্যাব ইংরেজি বিভাগের জার্নাল ক্রসিংসে প্রকাশিতব্য প্রবন্ধে এ-বিষয়ে আলোকপাত করে বলছেন, রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে লেখার ওপর ক্রমশ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন, এবং অধ্যবসায় ও অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি তাঁর ইংরেজিকে বিশ্বমানের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।) তারপরও রবীন্দ্রনাথ প্রায় দু’হাজার পৃষ্ঠাব্যাপী ইংরেজি লেখেন, যার প্রধানতই গদ্য, এবং সেগুলি দশ খন্ডে প্রকাশিতও হয় টেগোরস ইংলিশ রাইটিংস শিরোনামে। এবং বর্তমান খন্ডেও বিভিন্ন শাখায় রবীন্দ্রনাথের বহু মূল ইংরেজি রচনা ছাপা হয়েছে, যেমন, ‘মাই স্কুল’। আর বুদ্ধদেব বসুর ওপরে উল্লিখিত সমালোচনারও যেটি সীমাবদ্ধতা সেটি হলো, তিনি অনুধাবন করতে পারেননি যে, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একটি অতিকায় উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল বিশ্বব্যাপী পরিচিত থাকার। ‘বিশ্ব’, ‘বিশ্বলোক’, ‘বিশ্বসভা’ ইত্যাদি শব্দ তাঁর গানে ও কবিতায় অজস্র ছড়িয়ে আছে। একই চিঠিতে তিনি ব্রিজেসকে লিখছেন (আমার বাংলা) : ‘আমি জানি আমার ভাষা থেকে আমি যা পাওয়ার তার চেয়ে বেশি পেয়েছি, কিন্তু আমার কখনো লোভ করা উচিত নয় কুড়ে পেতে তোমাদের ভাষায়ও সে জায়গা নিতে, যার জন্য আমি যোগ্য নই।’ চাপা আকাঙ্ক্ষা না থাকলে এ বিনয়টা আসতে পারে না। অমিত চৌধুরী তাঁর বিশ পৃষ্ঠাব্যাপী ‘পোয়েট্রি অ্যাজ পোলেমিক’ শিরোনামের উপক্রমণিকায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এ-কথা বলতে চেয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সাহিত্যের মূল সুর ছিল পরিব্রাজকতা বা সঞ্চরণশীলতা, যা ‘বলাকা’ কবিতার বহুল উদ্ধৃত পঙ্ক্তিনিচয়, ‘হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে’ (‘নট হিয়ার, বাট সামহোয়ের এলস, সামহোয়ের ফারদার অ্যাওয়ে,’ অনুবাদক : ফকরুল আলম) নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। 

তাহলে বলা যায়, ফকরুল আলম এবং রাধা চক্রবর্তী এমন একটি কাজ সম্পাদন করেছেন যা শুধু দুরূহ নয়, যা আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজেরও একটি অভিলাষের পরিপূরণ। দায়িত্বটি বিশাল, তাই তাঁদের সম্পাদকীয়তে ফকরুল এবং রাধা খুব সতর্কতার সঙ্গে এ-প্রশ্নটির উত্তর দিতে চেয়েছেন যে, কেন পূর্বেকার অনেকগুলো রবীন্দ্র-সাহিত্য অনূদিত গ্রন্থের চেয়ে বর্তমানের দ্য এসেনশিয়াল টেগোর বিশিষ্টতার দাবি রাখে। এ-আলোচনার মধ্যে তাঁরা বলতে চেয়েছেন যে, আগের অনেকগুলো অনুবাদের ক্ষেত্রে (যেমন ম্যাকমিলানের প্রকাশিত খন্ডটি) বিষয় নির্বাচনে রবীন্দ্রনাথকে প্রতিনিধিত্ব করে সেরকম রচনার স্থান হয়নি। আবার অনুবাদের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের রচনার মূল মেজাজ বাংলার প্রকৃতি, বাংলার মানুষের সাধারণ জীবন এবং প্রাচ্যের ভাববাদী জীবনদর্শনের অনুবাদ যে-ভাষায় রূপান্তরিত হওয়া উচিত ঠিক সেরকম হয়নি; ফলে বিদেশি পাঠক ঠিক ভারতবর্ষীয় বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথকে না পেয়ে পশ্চিমায়িত একজন ভাষান্তরিত কবিকে পান এবং সেজন্য বলা যায়, বিদেশি পাঠকের কাছে আগেকার অনুবাদ খন্ডগুলির মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ সঠিকভাবে উপহৃত হননি।

সম্পাদকদ্বয় গ্রন্থটিতে মোট দশটি অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সমগ্র রবীন্দ্রনাথকে সংকুলান করেছেন। প্রতিটি অনুচ্ছেদের শুরুতে ছোট ছোট ভূমিকায় বলা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের উল্লিখিত শাখায় পদচারণা সম্পর্কে। অনুচ্ছেদগুলোর শিরোনাম হলো : প্রথমটি, অটোবায়োগ্রাফি : চারটি রচনা। দ্বিতীয়টি, লেটারস, ২১টি চিঠি। তৃতীয়টি, প্রোজ, সংখ্যা ১২টি। চতুর্থ, পোয়েমস, ৫২টি। পঞ্চম, সংস, পাঁচটি। ষষ্ঠ, প্লেইজ, ২টি। সপ্তম, স্টোরিজ, ১০টি। অষ্টম, নভেলস, চারটি উপন্যাসের কিয়দংশ। নবম, হিউমার, সাতটি। দশম, ট্র্যাভেল রাইটিং, নয়টি। সবশেষের পৃষ্ঠাগুলিতে  আছে রবীন্দ্র জীবনপঞ্জি, টীকা, শব্দার্থ, ভবিষ্যৎ পাঠ, ঋণ স্বীকার এবং অনুবাদক-পরিচিতি। অনুবাদকের সংখ্যা মোট ৩০ জন, যাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে আছেন ফকরুল আলম এবং রাধা চক্রবর্তী স্বয়ং, এবং আরো আছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কায়সার হক, সুকান্ত চৌধুরী, সোমদত্ত মন্ডল ও শর্মিষ্ঠা পাঞ্জা। বিশিষ্ট ভারতীয় ইংরেজি লেখক অমিতাভ ঘোষ ও অমিত চৌধুরীসহ আরো অনেকে তাঁদের দক্ষ অনুবাদের মাধ্যমে এ-গ্রন্থটির মান বর্ধন করেছেন।

মূল ভাষার পাঠক যখন অনূদিত গ্রন্থে নিজের সাহিত্য পাঠ করেন তখন তাঁর পক্ষে মূল ভাষা ও অনূদিত ভাষার মধ্যে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের ফলে যে একটি নির্ভেজাল দেয়াল তৈরি হয় সেটা মানা সম্ভব হয় না। যেমন একজন বাঙালি পাঠক পাবলো নেরুদার কবিতা পাঠ করলে তিনি মেনে নেবেন যে, বাংলা ভাষা ও স্প্যানিশ ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে তফাৎ আছে, এবং সে-তফাৎটা মেনে নিয়েই তিনি নেরুদার কবিতা উপভোগ করছেন। কিন্তু বাঙালি পাঠক যখন রবীন্দ্রনাথকে ইংরেজি ভাষায় পাঠ করবেন, তখন তাঁর কেবলই অনূদিত কবিতাটির সঙ্গে মূল কবিতাটিকে পাশাপাশি রেখে বিচার করতে মন চাইবে যে, অনুবাদকর্মটি উতরেছে কি না। দ্য এসেনশিয়াল টেগোর পাঠ করার সময় এ তুলনামূলক কাঠামোয় যেতে প্ররোচিত না হয়ে উপায় ছিল না, কিন্তু সেটা সংবরণ করতে হয়েছে রবার্ট ফ্রস্টের সে-কথাটি মনে রেখে যে, ‘মূলের সঙ্গে অনুবাদের দূরত্বই হচ্ছে যেখানে কবিতা বাস করে।’ তারপরও যে প্ররোচিত না হয়ে থাকা গেছে, সেটা নয়।

রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্যস্মৃতি’র সঙ্গে বাঙালি পাঠকের ঘনিষ্ঠ পরিচয়। এ নামে এটি স্কুলে পাঠ্য ছিল আমাদের। রচনাটি আসলে ছেলেবেলা নামক আত্মস্মৃতিমূলক গ্রন্থের প্রথম রচনা, যেটি ‘বয়হুড ডেইজ’ নামে অনুবাদ করেছেন রাধা চক্রবর্তী। তাঁর অনুবাদ শুধু মূলানুগামী নয়, যথার্থ সাহিত্যিক অনুবাদও। ‘শ্যাকরাগাড়িকে’ ইংরেজিতে ‘হ্যাকনি ক্যারেজিস’ বললে বিদেশি পাঠক ধারণা পেয়ে যাবেন কোন ধরনের শকটকে বোঝানো হচ্ছে। গৃহশিক্ষক মাস্টারমশাইয়ের ক্লাসের কথায় আসি। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘মাস্টারমশাই মিট্মিটে আলোয় পড়াতেন প্যারী সরকারের ফার্স্ট বুক। প্রথমে উঠত হাই, তারপর আসত ঘুম, তারপর চলত চোখ-রগড়ানি।’ রাধার অনুবাদ : ‘In the dim, flickering light, our tutor, Mastermoshai, taught us the First Book of Pyari Sarkar. I would yawn, then become drowsy, and afterwards, rub my eyes to stay awake’ (p 49). 

উপরোক্ত একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো হচ্ছে যে, সারা বইটিতে অনুবাদের এমনতরো সবল, স্বচ্ছ ও সাবলীল মান বজায় রাখা হয়েছে। ‘মাস্টারশাই’য়ের ইংরেজি মাস্টারমশাই চলছে, কারণ বিশ্বব্যাপী অনুবাদকর্মের ব্যাপারে অলিখিত সিদ্ধান্ত হয়েছে, অনুবাদের ক্ষেত্রে যেন সাংস্কৃতিক নিজস্বতা অক্ষুণ্ণ রাখা হয়। খাদ্যদ্রব্যের বেলায় বিশেষ করে এ-কথাটি মানা হচ্ছে। এ যেমন ‘শিঙাড়া’ এখন ইংরেজিতেও শিঙাড়া। কিন্তু বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র রচনাবলীর ত্রয়োদশ খন্ড থেকে উদ্ধৃত বাক্যাংশটির ‘মাস্টারমশাই’ শব্দটির পাশে পাদটীকার চিহ্ন দিয়ে বলা হয়েছে যে, এ মাস্টারমশাইয়ের নাম ছিল অঘোরবাবু, যে-তথ্যটি রবীন্দ্রজীবনীকারদের জন্য প্রয়োজনীয়, কিন্তু হয়তো বিদেশি পাঠকের জন্য প্রয়োজনীয় নয়; সেজন্যেই কি বাদ দেওয়া?

ছিন্নপত্রের অনুবাদ করেছেন টর্ন লিভস নামে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। পনেরোসংখ্যক চিঠিটি যেখানে রবীন্দ্রনাথ অবসাদের প্রশংসা করছেন (যেমন করেছিলেন ইংরেজ কবি জন কিটস ‘ঔড অন ইনডোলেন্স’ লিখে) সেখানে একঝাঁক হাঁসের খালের পাড় থেকে কোলাহল করে জলে নামা এবং আবার ওঠা, এবং তা করে চারদিকের দুপুরবেলার অবসাদগ্রস্ততাকে ভেঙে দেওয়ার বর্ণনা চমৎকার ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে : ‘Only a small flocks of ducks shows a semblance of activity — they squawk rather loudly and with increasing enthusiasm dip their heads into water, pulling them up at once and shaking them violently’ (p 68). 

পুরো বইটিতে অনুবাদের এমন চমৎকার উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। যেমন ছোটগল্পগুলোর অনুবাদে। ‘মধ্যবর্তিনী’ গল্পটির অনুবাদ করেছেন নবনীতা সেন ‘দ্য ইন-বিটউইন ওয়াইফ’ নামে, যেটি খুবই মূলানুগ এবং চমৎকার ইংরেজিতে অনূদিত। অনুরূপভাবে আশাহত করেননি অমিতাভ ঘোষ ‘হাংরি স্টোন’ নামে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটির অনুবাদে। তদ্রূপ সফল অনুবাদ হয়েছে অরুণা চক্রবর্তী কর্তৃক ‘নষ্ট নীড়’ গল্পটি ‘আ ব্রোকেন নেস্ট’ নামে, এবং ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পটির ‘দ্য ওয়াইফস লেটার’ নামে অনুবাদ করেছেন সুপ্রিয়া চৌধুরী। এ অনুবাদের একটি অংশ মূলের সঙ্গে তুলে ধরা যাক : গল্পটির প্রধান চরিত্র মৃণাল লিখছে : ‘আমার একটা জিনিষ তোমাদের ঘরকন্নার বাইরে ছিল, সেটা কেউ তোমরা জান নি। আমি লুকিয়ে কবিতা লিখতুম। সে ছাইপাঁশ যাই হোক-না, সেখানে তোমাদের অন্দরমহলের পাঁচিল ওঠে নি। সেইখানে আমার মুক্তি; সেইখানে আমি আমি।’ সুপ্রিয়ার অনুবাদে : ‘I had one possesion beyond your household, which none of you knew about. I used to write poems in secret. Whatever rubbish they were, the walls of your women’s quarrels had not grown round them. In them lay my freedom — I was myself in them.’ এখানে, ধরুন, বিদেশি বাংলা-না-জানা পাঠক কখনো জানতে পারবেন না যে ‘তোমাদের অন্দরমহলের পাঁচিলে’র ইংরেজি ‘দ্য ওয়ালস অব ইয়োর উইমেনস কোয়ারেলস’ ঠিক সুবিধামতো অনুবাদ হয়নি, কিংবা ‘সেইখানে আমি আমি’কে ইংরেজিতে ‘আই ওয়াজ মাইসেলফ ইন দেম’ অনুবাদ করলে ঠিক সে-কথাটাই স্বীকার করে নেওয়া হয় যে, অনুবাদের বেলায় ঠাঁটটা অনুবাদ করা যায়; কিন্তু রক্তটা অনুবাদ করা যায় না, যে-কারণে ইয়েটস তাঁর গীতাঞ্জলির ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের বচন ও গীতলতাকে ‘আনট্রান্সলেটেবল ডেলিকেসিজ’ বা অনুবাদে অসম্ভব অনুভূতি হিসেবে প্রকাশ করেছিলেন।

যে-চারটি উপন্যাসের অংশবিশেষ অনুবাদ করা হয়েছে সেগুলি হলো : গোরা, যোগাযোগ, শেষের কবিতা এবং চার অধ্যায়। এগুলির ইংরেজি নাম যথাক্রমে গোরা (রাধা চক্রবর্তী), কানেকশনস (কায়সার হক), ফেয়ারওয়েল সং (রাধা চক্রবর্তী) এবং চার অধ্যায় (রিমলি ভট্টাচার্য)। এ-অনুবাদের ক্ষেত্রে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়নি যে, অনুবাদকেরা কী পুরো উপন্যাসটি অনুবাদ করেছেন এবং তার অংশবিশেষ এখানে ছাপিয়েছেন, নাকি এ-সংকলনের জন্য শুধুমাত্র নির্বাচিত অংশটি অনুবাদ করে ছাপিয়েছেন। এ-প্রশ্নটি উঠে এলো এ-জন্য যে, যতটুকু জানি কায়সার হক পূর্বেই সম্পূর্ণ যোগাযোগ অনুবাদ করে প্রকাশ করেছেন; অন্যদের ক্ষেত্রেও তাই কি না? শেষের কবিতা থেকে অনূদিত অনুচ্ছেদগুলোতে সে-অনুচ্ছেদটি, অর্থাৎ শেষ অনুচ্ছেদটি, থাকলে ভালো হতো যেটাতে ‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও’ কবিতাটি আছে। এটি রবীন্দ্রনাথের এত মহৎ একটি কবিতা যে, তার রসগ্রহণ থেকে বিদেশি পাঠককে বঞ্চিত না করাই ভালো ছিল। আর যেহেতু শেষের কবিতার শিরোনামটির অনুবাদ দ্য ফেয়ারওয়েল সং করা হয়েছে সেজন্যে এ-কবিতাটির সংযোজন আরো প্রযোজ্য ছিল।

সম্পাদকদ্বয়কে ধন্যবাদ জানাতে চাই ‘হিউমার’ বা রসবোধের ওপর একটি অনুচ্ছেদ রাখার জন্য। বস্ত্তত রবীন্দ্রসাহিত্যের সর্বত্র ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে অপূর্ব রসবোধ। সেটা তাঁর ভ্রমণকাহিনি, উপন্যাস, ছোটগল্প এবং প্রবন্ধের সর্বত্র আছে, আরো আছে নাটকে ও বক্তৃতায়। এমনকি তাঁর শিশুতোষ রচনায়ও রসবোধের ছড়াছড়ি। শিশুকে অক্ষর শেখাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। আসলো ‘ঋ’ বর্ণ। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন – ‘মেঘ ডাকে ঋ’ এবং এর পরের চরণ : ‘খোকা পড়া শেখে নি।’ অপূর্ব রসবোধ তৈরি হলো, মেঘ ডাকা, তার সঙ্গে ঋ বর্ণের অদ্ভুত আকৃতির মিল এবং শিশুর (শিশু যে সে ‘ছেলেবেলা’র রবীন্দ্রনাথ) পাঠের প্রতি স্বাভাবিক অমনোযোগিতা নিয়ে। কোন মা তাঁর শিশুকে ‘ঋ’ বর্ণটি এভাবে পড়ানোর সময় না হেসে পারবেন! যা হোক,  এ-অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সে বিখ্যাত কবিতাটি – ‘জুতা আবিষ্কার’, অনুবাদ করেছেন রাধা চক্রবর্তী। খুব উতরেছে অনুবাদটি।

রবীন্দ্রনাথ মূলত কবি। তাই তাঁর পরিচয় বিশ্বলোকে এখনো কবি হিসেবে। সেজন্যে বর্তমান গ্রন্থে কাব্যভাগের অনুবাদের কীর্তি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া আবশ্যক। আগেই বলেছি, মোট ৫২টি কবিতার অনুবাদ হয়েছে যার সিংহভাগ সম্পন্ন করেছেন ফকরুল আলম। বাকি অনুবাদকদের মধ্যে আছেন কায়সার হক, সুকান্ত চৌধুরীসহ আরো কয়েকজন। রবীন্দ্রনাথের অতিপরিচিত মহৎ কবিতাগুলির মধ্যে আছে : ‘নির্ঝরের স্বপভঙ্গ’ (দ্য ফাউন্টেইনস অ্যাওকেনিং : ফ. আ.), ‘সোনার তরী’ (দ্য গোল্ডেন বোট : ফ. আ.), ‘দুই পাখি’ (দ্য টু বার্ডস : ফ. আ.), ‘যেতে নাহি দেব’ (আই ওন্ট লেট য়ু গো! : ফ. আ.), ‘দুই বিঘা জমি’ (মাই লিটল প্লট অব ল্যান্ড : ফ. আ.), ‘১৪০০ সাল’ (আ হান্ড্রেড ইয়ারস ফ্রম নাউ : ফ. আ.), ‘বলাকা’ (আ ফ্লাইট অব গিজ : ফ. আ.), ‘বাঁশি’ (উইন্ড ইন্সট্রুমেন্ট : ফ. আ.), ‘সাধারণ মেয়ে’ (অ্যান অর্ডিনারি উইম্যান : ফ. আ.), ‘ক্যামেলিয়া’ (ফ.আ.), ‘পঁচিশে বৈশাখ’ (দ্য টোয়েন্টি ফিফথ অব বৈশাখ : ফ. আ.), ‘আমি’ (আই : কা. হ.), ‘আফ্রিকা’ (রুমানা সিদ্দিক), ‘ওরা কাজ করে’ (দে ওয়ার্ক : সুপ্রিয়া চৌধুরী), ‘প্রথম দিনের সূর্য’ (দ্য সান অব দ্য ফার্স্ট ডে : ফ. আ.), ‘দুঃখের অাঁধার রাত্রি’ (ডার্ক নাইট অব সরো : ফ. আ.), ‘তোমার সৃষ্টির পথ’ (অন দ্য ওয়ে টু ক্রিয়েশন : ফ. আ.)।

মূলত রবীন্দ্রনাথের প্রধান কবিতাগুলিই অনুবাদ করেছেন ফকরুল আলম। তিনি এর মধ্যে কবিতার অনুবাদক হিসেবে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বিশেষ করে কয়েক বছর আগে প্রকাশিত তাঁর জীবনানন্দ দাশের কবিতার অনুবাদগ্রন্থ পাঠকমহলে সুনাম কুড়িয়েছে। এখানেও তাঁর অনুবাদ ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করার কিছু নেই। প্রতিটি অনূদিত কবিতাই নিটোল ইংরেজিতে উপস্থাপিত হয়েছে, এবং সব অনুবাদই বিশ্বসাহিত্য সভায় রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে পরিচিত করাবে। তবে  এ-কথা স্বীকার করতে হবে যে, সাহিত্যের অন্যসব বিষয়ের চেয়ে কঠিন হলো কবিতার অনুবাদ করা। এ কঠিন কর্মটি ফকরুল আলম অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে সাঙ্গ করেছেন। তারপরও একটি ছোট অভাবের কথা বলছি। ইংরেজি কথনের সঙ্গে রাবীন্দ্রিক গীতলতার সম্পর্ক প্রায় এ-মেরু ওই মেরুর মতো। এ কঠিন সংযোজনের এবং রূপান্তরের কাজটি ফকরুল আলম অনায়াসে করেছেন, কিন্তু এ অনায়াসলব্ধতা কবিতার প্রাণকে ইংরেজিতে নিয়ে আসার ব্যাপারে যেন বাদ সেধেছে। অনুবাদের ভাষাটা আরেকটু কাব্যমন্ডিত করা যায় কি-না এ-পরামর্শ ফকরুল আলমের জন্য রইল। আর কবিতার অনুবাদ তো আক্ষরিক হবে না সেটা সবাই জানে, কিন্তু তাই বলে যেটা মূলে নেই সেটা স্বতঃপ্রতিপাদ্য হিসেবে নিয়ে আসাও বাঞ্ছনীয় নয়। ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর’কে ‘ও, হাউ ডিড দ্য সানস ফার্স্ট রে’ অনুবাদ করলে বাংলাভাষী পাঠক হোঁচট খাবে ‘রবির কর’ কী করে ‘সূর্যের প্রথম কিরণ’ হলো তা নিয়ে, আর বিদেশি পাঠক জানতে পারবেন না যে, রবীন্দ্রনাথ বস্ত্তত ‘প্রথম’ কথাটা বলেননি। অনুবাদকের জন্য কঠিন কাজটি হলো ‘প্রথম’ না বলেও ‘প্রথমে’র অভিঘাত সৃষ্টি করা। যেমন, ‘দুই বিঘা জমি’র এ পঙ্ক্তিটি ‘নমোনমো নম, সুন্দরী মম, জননী জন্মভূমি’র অনুবাদ এসেছে এভাবে : ‘আই থট অ্যাজ আই ওয়েন্ট : লাভলি মাদারল্যান্ড বেঙ্গল – আই বাউ টু ইউ লাভিংলি!’ ইংরেজির লিটারালনেস বা ডিকশনের ওজন সময় সময় ফকরুল আলমের অনুবাদে স্বচ্ছন্দ আবেশ তৈরি করার বদলে খানিকটা কাব্যরহিত মেজাজের সৃষ্টি করেছে বলে ধারণা হয়। আবার কবিতাগুলোর শিরোনাম অনুবাদ করার সময় সে একই আত্মসচেতনতা কাজ করেছে বলে মনে করা যেতে পারে। যেমন, ‘দুই বিঘা জমি’র স্বচ্ছন্দ অনুবাদ ‘টু বিঘাস অব ল্যান্ড’ করলে অসুবিধা কী ছিল! একই কারণে প্রশ্ন উঠবে, ‘বাঁশি’কে সরাসরি ‘ফ্লুট’ না বলে যখন ‘দ্য উইন্ড ইনস্ট্রুমেন্ট’ বলা হলো তাতে একটি যন্ত্রের আবহ আনা হলো, এবং এর ফলে হারিয়ে গেল ‘বাঁশি’র সে রাখালিয়া সুর, যে-সুর কবি ইয়েটস, এজরা পাউন্ড এবং ফরাসি লেখক আন্দ্রে জিদকে মুগ্ধ করেছিল।

কায়সার হকের ‘রূপ-নারানের কূলে’ কবিতাটির ‘অন দ্য ব্যাংকস অব রূপ-নারান’ অনুবাদে বিখ্যাত পঙ্ক্তিনিচয় ‘সত্য যে কঠিন,/ কঠিনেরে ভালো বাসিলাম -/ সে কখনো করে না বঞ্চনা’ এসেছে এভাবে : ‘ফর ট্রুথ ইজ টাফ;/ অ্যান্ড আই লার্নট টু লাভ দিস হারশনেস -/ ইট নেভার বিট্রেইস।’ তিনি কেন দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে ‘টাফনেস’ না বলে ‘হারশনেস’ বললেন জানি না, কিন্তু এর ফলে রবীন্দ্রনাথ ‘কঠিন’ ‘কঠিনেরে’ বলে যে দ্বিত্ব-ধ্বনিগত ঝংকার তৈরি করেছেন সেটি হারিয়ে গেল। ‘কঠিন/ কঠিনেরে’ অনুবাদ কি ‘টাফ/ টাফনেস’ ভালো হতো না?   

যে-কোনো সম্পাদনা কর্মের একটি রাজনৈতিক বক্তব্য থাকে। আলোচ্য সম্পাদনাগ্রন্থটি অনুবাদকর্ম হলেও এর একটি রাজনৈতিক অভীপ্সা বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের রচনার নির্বাচনে। রবীন্দ্রনাথকে একাধারে কবি-সাহিত্যিক, দার্শনিক ও সমাজ-সংস্কারের ব্যাপারে উদ্যোগী পুরুষ হিসেবে দেখার একটি ক্ষেত্র তৈরি করবে এ-গ্রন্থটি। এর ফলে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ একজন সমসাময়িকতা-পরিপুষ্ট লেখক হিসেবে বিবেচিত হবেন বিদেশি পাঠকের কাছে। রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিকতা-সংশ্লিষ্ট এ-ভূমিকায় উপস্থাপন খুবই যৌক্তিক হয়েছে বলে ধারণা হয়।

যেমন, রবীন্দ্রনাথের সমাজে শোষিত জনগণ এবং নারীর অবনমিত অবস্থান সম্পর্কে পাঠক জানতে পারবেন কবিতায় ‘দুই বিঘা জমি’, ‘ওরা কাজ করে’, ‘সাধারণ মেয়ে’ পড়ে, গল্পে ‘স্ত্রীর পত্র’ পড়ে, উপন্যাসে ঘরে বাইরে পড়ে, কিংবা নাটকে রক্তকরবী পড়ে; ঠিক সেরকম পাঠক রবীন্দ্রনাথের অসাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পর্কে জানতে পারবেন, ‘হিন্দুস অ্যান্ড মুসলিমস’ প্রবন্ধটি, কিংবা ‘দ্য টেইল অব আ মুসলিম উইম্যান’ গল্পটি পড়ে। এ প্রেক্ষাপটের আলোকে হয়তো ‘শা-জাহান’ কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত করা যেত। আর রবীন্দ্রনাথের (উগ্র) জাতীয়তাবাদ নিয়ে ভীতি আর আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে প্রশ্রয়সূচক অভিব্যক্তি সম্পর্কে বিদেশি পাঠক জানতে পারবেন ‘দ্য প্রবলেম অফ সেলফ’, ‘ন্যাশনালিজম ইন দ্য ওয়েস্ট’, ‘দ্য নোবেল প্রাইজ অ্যাকসেপট্যান্স স্পিচ’, ‘ক্রাইসিস ইন সিভিলাইজেশন’ প্রবন্ধগুলি পাঠ করে। এ অনুচ্ছেদে ‘রিলিজিয়ন অব ম্যান’ প্রবন্ধটিও অন্তর্ভুক্ত হতে পারত।

দ্য এসেনশিয়াল টেগোর সর্বতো বিচারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাবলির এক অনুপম সংগ্রহ। কিন্তু সকল দিক থেকে এ অতিঋদ্ধ সংকলনের একটি ঘাটতি হয়েছে অমিত চৌধুরীর ‘পোয়েট্রি অ্যাজ পোলেমিক’ শীর্ষক উপক্রমণিকাটি অন্তর্ভুক্ত করে। তাঁর প্রবন্ধ আদ্যোপান্ত পাঠ করে মনে হয়েছে তিনি রবীন্দ্র-সাহিত্য সম্পর্কে সড়গড় নন, এবং তিনি সে-ভুলটাই করেছেন যেটি বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ : বিশ্বকবি ও বাঙালি’ শীর্ষক প্রবন্ধে না করার পরামর্শ দিয়েছেন। বুদ্ধদেব বলছেন, রবীন্দ্রনাথ হচ্ছে নদীর স্রোতের মতো। কোথাও আঙুল দিয়ে বলা যাবে না যে, ‘এই হলেন রবীন্দ্রনাথ’। রবীন্দ্রনাথ অতুলনীয় কারণ কোনো একটা একক রচনা দিয়ে তাঁকে চিহ্নিত করা যাবে না, যেমন ফাউস্ট দিয়ে করা যাবে জার্মান কবি গ্যেটেকে, রবীন্দ্রনাথকে বরঞ্চ চিহ্নিত করতে হবে তাঁর ‘ব্যাপ্তি, বৈচিত্র্য ও পরিমাণ’ নিয়ে। আর অমিত চৌধুরী ‘বলাকা’ কবিতার পরিব্রাজনতার (যার উল্লেখ আগে করেছি) ওপর নির্ভর করে রবীন্দ্রনাথের কাব্যভাষা নিয়ে যে তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন, এবং যেভাবে আধুনিক যুগের প্রধান ইংরেজ কবি এলিয়টের রচনার সঙ্গে বারবার সমীকরণ টেনেছেন তাতে রবীন্দ্রনাথকে পশ্চিমা পাঠকের কাছে খুবই খন্ডিতভাবে উপস্থাপন করার মওকা তৈরি হয়েছে। পাঠক মনে করবেন, রবীন্দ্রনাথ বুঝি কেবল ভাষা নিয়ে পরীক্ষারত একজন অস্তিত্বশীল আধুনিকমনস্ক কবি ছিলেন। লেখাটিতে কবিতা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্য নিয়ে তো কোনো আলোচনা নেই, বরঞ্চ মনে হবে যেন কবি রবীন্দ্রনাথ বুঝি কেবল এলিয়ট-ধরনের শক্তিশালী কোনো আধুনিক কবি। অথচ যেজন্যে এ-তুলনাটা গর্হিত সেটি হচ্ছে, এলিয়ট একটি সাহিত্যের একটি যুগের প্রধান কবি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ একটি জাতির সর্বযুগের প্রধান কবি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা চলবে সব জাতির প্রধান কবিদের, এটা নিঃসংশয়ে বলা যায় : গ্রিসের হোমার, ইতালির ভার্জিল এবং দান্তে, জার্মানির গ্যেটে, ইংরেজদের শেক্সপিয়র কিংবা ঔপন্যাসিক হলেও রাশিয়ার তলস্তয়ের সঙ্গে। আর একটি কথা, দ্য এসেনশিয়াল টেগোর হলো সর্বজনীন, সর্বকালিক একটি প্রকাশনা ও উপস্থাপনা, এটার দাবি অনেক ব্যাপক; তাই তার সঙ্গে অমিত চৌধুরীর ব্যক্তিগত অনুভূতি-নির্ভর একটি একান্ত ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান সংকলনটির বিষয়গত মেজাজের সঙ্গে যায় না।  প্রকাশনা-কর্তৃপক্ষ এ অসচেতনতা পরিহার করতে পারলে ভালো হতো।

পরিশেষে সম্পাদকদ্বয়ের পরিশ্রম ও আন্তরিকতা ও লক্ষ্যের মাহাত্ম্যকে শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন জানানোর লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথের একটি গানের কলি দিয়ে আলোচনা শেষ করছি : ‘আমি আমার ভুবন শূন্য করেছি তোমার পুরাতে আশ।’