নদী কলস্বরা বাংলার রূপ

জাহিদ মুস্তাফা

নদীমাতৃক বাংলার জলকলস্বরা রূপের দেখা মেলে দক্ষিণে। সে-দক্ষিণেই সাতক্ষীরার তালা উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীরের জন্ম ১৯৩৫ সালে। তখন আমাদের নদীগুলো আরো মুখর ছিল, ছিল উদ্দাম গতিময়। এ-দেশের জলকাদামাখা জীবনের ভাষ্য রচনা করেছেন তিনি। সাধারণ বাস্তবতা থেকে সরে গিয়ে বিমূর্ততার দিকে হাত বাড়িয়েছেন। নশ্বর চোখে যা দেখেন, তার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার মরমি মন যোগ করে নিজেকে নির্মাণ করেছেন শিল্পী।

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গেও তিনি অাঁকেন। সে-অাঁকায় মানুষের জাগতিক বাঁচার লড়াইয়ের গল্পের পেছনে শিল্পীর ক্ষোভ মিশ্রিত হয়েছে। সেই চিত্রপটের উপরিভাগে আগুনে জ্বলছে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রাম। তার নিচে নাফ নদ, চিত্রপটের প্রায় শেষপ্রান্তে উদ্বাস্ত্ত রোহিঙ্গার ঢল। এ-ছবিটা পৃথিবীবাসী টিভিতে নিত্য দেখছেন আগস্ট মাস থেকে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী আর সে-দেশের উগ্র নাগরিকদের তা-বে বাস্ত্তচ্যুত লাখ লাখ রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশের কক্সবাজার সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। বড় ক্যানভাসে পলায়নপর রোহিঙ্গাদের এই ছবিটা এঁকেছেন বর্ষীয়ান শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর। এটি প্রদর্শিত হয়েছে তাঁর ৪২তম একক চিত্রপ্রদর্শনীতে। অমানবিক এ-ঘটনা শিল্পীকে আকুল করেছে। তাঁর মনে পড়েছে ১৯৭১ সালের কথা। সে-সময় এক কোটি বাঙালি জীবন বাঁচাতে ভারতে ঠাঁই নিয়েছিলেন। শিল্পীর এ-কাজটি এই অমানবিক দেশান্তরির একটি দলিল হয়ে থাকবে।

ঢাকার প্রগতি সরণিতে এথেনা গ্যালারির নতুন নাম হয়েছে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় নিহত অবিন্তা কবিরের নামানুসারে। নতুনভাবে শুরু করা অবিন্তা গ্যালারি অব ফাইন আর্টসের আয়োজনে ১১ নভেম্বর, ২০১৭ শনিবার সন্ধ্যায় ‘সময়ের অতীত স্মৃতি’ শিরোনামে এ-প্রদর্শনীর শুভ উদ্বোধন হয়। এতে নানা মাধ্যমে সাম্প্রতিককালে অাঁকা শিল্পীর ষাটটি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। এর মধ্যে অ্যাক্রিলিক রঙে অাঁকা ত্রিশটি চিত্র শিল্পী ক্যানভাসে এঁকেছেন, সাতটি এঁকেছেন কাগজে, স্পেচুলা দিয়ে ড্রয়িং করেছেন তেইশটি।

এ-প্রদর্শনীর বেশিরভাগ কাজে প্রতিফলিত হয়েছে বাংলার মাঠ-মাটি, নদী-চর আর এ-অঞ্চলের মানুষের গল্প। শিল্পী গত দু-দশক ধরে অমত্ম্যজ মানুষ ও প্রকৃতির ছবি অাঁকছেন। এর আগে তাঁকে আমরা জানতাম বিমূর্ত ঘরানার রূপদর্শী এক শিল্পী হিসেবে। পাশ্চাত্যশিল্পের প্রভাবে গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এ-দেশের তরুণশিল্পীদের হাত ধরে এখানে বিমূর্তশিল্পের ভিত গড়ে ওঠে।

সৈয়দ জাহাঙ্গীর এই শিল্পধারা চর্চার একজন সৃজনকর্মী। সত্তর ও আশির দশকে ফর্ম ও রেখার ছন্দময়তা নিয়ে তাঁর অাঁকা অনেক চিত্রকর্ম আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। নববইয়ের দশকের শেষদিকে শিল্পী পরিবর্তন আনেন তাঁর চিত্রকলায়। বিমূর্ততার বাইরে বেরিয়ে এসে মূর্ত গড়নের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। তিনি প্রথমে তাকালেন আমাদের প্রকৃতির দিকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকনের পাশাপাশি প্রকৃতির কোলে বসবাসকারী সাধারণ মানুষকে এই নিসর্গের নিবিড় আত্মীয়রূপে জ্ঞান করে নতুন চিত্রনির্মিতির পথে পা বাড়িয়েছেন শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর।

এক্ষেত্রে তাঁর অাঁকা চিত্রকর্মগুলো ইলাস্ট্রেটিভ বা সচিত্রকরণের মতো নয় বরং শিশুচিত্রকলার মতো সহজ, সরল, প্রাঞ্জল অথচ সুদৃঢ়। জীবনানন্দের বাংলার মাঠ-ক্ষেত-নদী ভালোবেসে প্রান্তিক মানুষের জীবনধারাকে চিত্রপটে তুলে আনেন তিনি।

এ-প্রদর্শনীর কাজগুলোয় নদীতীরবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী প্রান্তিক মানুষের গল্প করেছেন শিল্পী চিত্রের ভাষায়। ‘অতীত স্মৃতি’ শিরোনামে এ-প্রদর্শনীর চিত্রকর্মগুলোর গল্প বা ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন হলেও চিত্রগঠনে আমরা নীল আকাশ, স্বর্ণাভা-মাটি আর স্বচ্ছনীল জলের আবহ দেখি। নদীর পটভূমিতে সংগ্রামী মানুষের কর্মমুখর সুখী জীবনকে চিত্রিত করেছেন শিল্পী।

এই সুখী-সুন্দর জীবনকে শিল্পী প্রত্যক্ষ করেছেন দূর-শৈশবে কপোতাক্ষ নদের তীরে তাঁর জন্মভিটার কাছে। সেই সময়টাকে যেন পুনরুদ্ধার করে চলেছেন তাঁর অাঁকায়, বিষয়ে। এ এক অনিবার্য দায় সৃজনশীল মানুষের। পরিণত বয়সে এসে দরোজায় কড়া নাড়ে ফেলে আসা দিন, শৈশবের স্মৃতি। কবির কবিতায় যেমন আসে, শিল্পীর ছবিতেও সে-সময়ের চালচিত্র ফুটে ওঠে। যেমন নদীর তীর ধরে হাঁটা, ফেরিঘাটে অপেক্ষা, বন্যাপস্নাবিত মানুষ, নদীভাঙন ঠেকানোর সংগ্রাম, মাছধরা, নদী থেকে খাবার পানি সংগ্রহ – এসব বিষয় নদীমাতৃক বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে।

প্রান্তিক মানুষের জীবনযাপনে যেমন আনন্দ আছে, তেমনি বেদনাও আছে। নবান্ন কৃষকের জন্য এক আনন্দদায়ক উৎসব। এই শিরোনামে শিল্পীর দুটি কাজ আমরা গ্যালারিতে পেলাম। নদীপাড়ের মাঠে কৃষকের ফসল তোলার ছবি তুলে ধরেছেন তিনি। পাশাপাশি নদী দখল, নদীতীরের ইটভাটায় পরিবেশদূষণ – এসবও শিল্পীর দৃষ্টিতে পড়েছে, ছবিতেও এসেছে।

‘ঘরেফেরা’ চিত্রে রাখালের সঙ্গে সন্ধ্যাকালে নদী সাঁতরে একপাল গবাদিপশুর পার হওয়ার প্রাঞ্জল এক দৃশ্য এঁকেছেন শিল্পী। দূরে দিগন্তরেখা, আকাশে মেঘাবৃত পূর্ণিমার চাঁদের মৃদু আলোয় মায়াবী একটা পরিবেশ তৈরি করেছে। তবে ‘আবাস মধুর আবাস’ শিরোনামে অাঁকা বাবুইপাখির বাসা নিজ ঘরের প্রতি জীবনের ব্যাকুলতা তুলে ধরেছে। জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘বনলতা সেনে’র-এর শেষপঙ্ক্তি – ‘সব পাখি ঘরে আসে – সব নদী – ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন’ এই উচ্চারণ যেন প্রতিধ্বনিত হয়েছে এই চিত্রে।

এ-প্রদর্শনী চলেছে ৯ ডিসেম্বর, ২০১৭ শনিবার পর্যন্ত।