নদী কারো নয়

সৈয়দ শামসুল হক
\ ১৯ \

আধকোশা নদীকে শাসন করবার কী প্রস্তাব আছে মইনুল হোসেন মোক্তারের, সে-বিষয়ে বার লাইব্রেরিতে উপস্থিত উকিল-মোক্তারদের বিশেষ উৎসাহ লক্ষ করা যায় না। তারা মুহূর্তের জন্যে আড্ডার আমেজ থেকে জেগে ওঠে বটে, অচিরে চোখ ফিরিয়ে নেয়। এর কারণও আছে। প্রথমত, উপস্থিত প্রায় সবারই বাড়ি নদী থেকে অনেক দূরে; নদীভাঙনে ব্যক্তিগতভাবে তারা কেউই ক্ষতিগ্রস্ত নয়। যে দু-একজন ব্যতিক্রম, তারাও নদীতীর থেকে বাস উঠিয়ে নেওয়ার জোগাড় প্রায় সেরে উঠেছে। দ্বিতীয়ত, মইনুল হোসেনের মোক্তারের মোক্তারিখ্যাতি জলেশ্বরীসহ আশপাশের চোদ্দ গ্রামে যতই থাকুক, তার একটি পার্শ্বখ্যাতিও আছে – ছিটগ্রস্ত হিসেবে। ছিটগ্রস্ত? কথাটা তবে এখানেই বলে নিতে হয়। মক্কেল সাক্ষী হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কী বলবে, মইনুল হোসেন বাড়ির এজলাসে বসে তার মহড়া নেয়। এটা সব উকিল মোক্তারই করে থাকে; সাক্ষীকে পাখি পড়িয়ে তবে তারা হাকিমের সমুখে উপস্থিত করে। মইনুল হোসেনের বৃত্তান্ত এই যে, সাক্ষী যদি বয়ান ভুলে যায় তবে তাকে সে আচ্ছামতো জুতাপেটা করে; কখনো নিজের হাতে, কখনো মুহুরি আবজল মিয়ার হাতে। সাক্ষী বেচারা জুতো সয়, কারণ মইনুল হোসেনের হাতে মামলার পরাজয় ক্বচিৎ। আবার যে-মামলায় পরাজয় নিশ্চিত, যে-মামলা জলেশ্বরীর আর কোনো উকিল-মোক্তার নিতে রাজি নয়, সে-মামলা মইনুল হোসেন আগ বাড়িয়ে নেয়; বলে – মুঁই হারি গেইলেও খুশি! সত্য যে জয়যুক্ত হইবে, তারে কারণে এই মামলা নিলোম! সত্যের প্রতিষ্ঠা যাঁই না দেখিতে চায় তার জনমে বৃথা! মইনুল হোসেনের ছিটগ্রস্ততার খ্যাতি আরো এক কারণে – এজলাসে হাকিমের সমুখে বক্তৃতা দিতে দিতে, বিষয়কে জোরালো বা রসালো করতে হঠাৎ তার গান গেয়ে ওঠা। এখন কারো হয়তো মনে নাই, কিশোরকালে মইনুল হোসেন কুশান পালার এক দলের সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিলো, নিরুদ্দেশ ছিলো বহুদিন। পরে কুচবিহারের দিনহাটায় আছে বলে যখন সংবাদ পাওয়া যায় তখন তার বাবা আইনুল হোসেন তাকে সেখান থেকে কানে ধরে ফেরত নিয়ে আসে। স্কুলে আবার ভর্তি হয় মইনুল হোসেন, কিন্তু গান সে ভোলে না। কুশানপালায় রামের দুই পুত্র লবকুশ বর্ণনা করে রামায়ণের কাহিনি; জগতের মানুষের হেন প্রসঙ্গ নাই, যার মন্তব্য নাই কুশানপালার গানে। মইনুল হোসেন এজলাসে মামলার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সুযোগমতো গানের কলি গেয়ে ওঠে – এ নিয়ে বার লাইব্রেরিতে তাকে নিয়ে হাসাহাসির অন্ত নেই।
তবে নদীর কথা। মইনুল হোসেন ওই যে বার লাইব্রেরিতে বলে, কথা আর কিছুই নয়, সর্বনাশা নদীর কথা! আধকোশার কথা! আধকোশার ভাঙনের কথা! এই পাগলিকে শাসন করিবার কথা! আর তারে জন্যে মোর একখান প্রস্তাব আছে। বিশদ তবে খুলিয়া কই। সেই বিশদে যাবার আগে নদীর বিষয়ে কিছু কথা আরেকবার শুনে নেওয়া যায়। নদীর কত না রূপ, এক তার বাহিরে, অপর তার মানুষের মনে। মইনুল হোসেনের ভিটা যখন আধকোশার গর্ভে দ্বিতীয়বারের মতো যায়, যখন সে বন্ধু মোক্তার দেবদত্তর বাড়িতে শরণার্থী হয়ে উঠেছে আর নতুন বাড়ি করার জন্যে জমি দেখে বেড়াচ্ছে, জমি একটা নদীর কাছেই শস্তায় পাওয়া যাচ্ছে, মইনুলও প্রায় রাজি – জমিটা সে কিনেই ফেলবে, দেবদত্তই তখন মইনুলকে সতর্ক করে বলেছিলো – নদীর এত কাছে ফির না ঘর তোলো! নদীর গতিক তো জানো! দুই-তিন বচ্ছরেই ফির আসি ছোবল দিবে। নদী নয় তো, গোক্ষুরা সাপ! বিষ ঢালিবেই! – আমরা এখানে একটু থেমে লই; নদীর তবে এ উপমাও হয় – সাপ!
আমাদের মনে পড়বে, সেই দুর্ভিক্ষের বছরে, পঞ্চাশের সেই মন্বন্তরের কালেও নদীর বিরাম ছিলো না, বরং সে-বছর যেন বাংলার মানুষের মতো আধকোশাও ছিলো দীর্ঘ এবং আশাহীন অনাহারে; সে-বছর আধকোশা এক লপ্তে পুরো একটা মহল্লাই গিলে খেয়েছিলো। মইনুল হোসেন মোক্তারের বাড়িটাও সে-বছর আধকোশার উদরে যায়। সে তার বসত সরিয়ে যেখানে নতুন বাড়ি করে, সে-বাড়িটাও বছর তিনেকের মাথায় নদীর গর্ভে বিলীন হয়। পঁয়তাল্লিশ সালের কথা; মইনুল হোসেন বর্ষার এক মাঝরাতে জেগে উঠে দ্যাখে, নদীর ছোবল তার ভিটের গোড়ায় প্রবল আঘাত হানছে। আমাদের আজকের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক মকবুল হোসেন তখন মায়ের কোলে দুগ্ধপোষ্য শিশুটি। তাকে কোলে নিয়ে মা ভীতস্বরে চিৎকার করে ওঠে – আল্লা গো! আর বিপরীতে মইনুল হোসেন তীব্রকণ্ঠে গাল দিয়ে ওঠে – হারামজাদি! না, স্ত্রীর প্রতি নয়, নদীর প্রতি, আধকোশার প্রতি। – হারামজাদি, ফির খেপি উঠিছে। এইবার তোরে একদিন কি মোরে একদিন! কত খাবু তুই মাটি! এইবার মুই দেখি নেমো! চোখের সমুখে নদীর গহবরে তলিয়ে যায় মইনুল হোসেনের ভিটা। টিনের বাড়ি, কোমরভাঙা হয়ে একবার থিরথির করে কাঁপে, নদীর বুকে নত হয়ে পড়ে উত্তর কোণ, যেন জলে মুখ দেখতে বড় সাধ তার, অনেকক্ষণ ওই অমন ভঙ্গিতে স্থির হয়ে থাকে ঘরখানা, তারপর হুস করে ডুব দেয় ঘূর্ণিজলে, ঘূর্ণিটা গভীর হয়ে ওঠে মুহূর্তে, যেনবা জলের শরীরে বিপুল এক নাভি রচিত হয়, তারপর চক্কাস করে শব্দ ওঠে, লোলুপ জিহবায় গ্রাস টেনে নেবার শব্দ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে বহুক্ষণ ধরে। নদীকে তখন উত্তর বাংলার চিরকালের মঙ্গাপীড়িত অনাহারীজন বলে মনে হতেই পারে আমাদের।
সে কী গ্রাস নদীর! একেক গ্রাসে বাড়ি সাবার! প্রথমে নদীর বুকে নামে পাহাড়ি ঢল। প্রথমে কিছুই বোঝা যায় না। বৃষ্টি হচ্ছে, দিনমান বৃষ্টি। এ-অঞ্চলে একবার বৃষ্টি শুরু হলে অন্তত তিনদিনের আগে তার বিরাম নাই, কখনো কখনো সাত-আট দিন। বৃষ্টি শুরু হয় প্রথমে মুষলধারে, তারপর টিপিটিপি গুঁড়িগুঁড়ি, হঠাৎ এক-আধবার আবার সেই মুষলধারে। নদীর পানি বাড়তে থাকে ক্ষীণ মাত্রায়। অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ কি শেখে? – শেখে না। কতকাল থেকে মানুষ দেখে এসেছে নদী একদিন চন্ডমূর্তি ধারণ করবে অকস্মাৎ, কিন্তু প্রতিবারের মতো এ-বছরও তারা সে-কথা মনে আনে না, মনে করে ওঠে না। জীবনযাত্রা আগের মতোই এক লয়ে চলে। শনি-মঙ্গলে হাট বসে বর্ষার মধ্যেই। জেলেরা উৎসাহী হয়ে ওঠে মাছ ধরতে। বর্ষার কালে মাছ ঠেলে ওঠে নদীতে। বৃষ্টির ছাঁট রোহিত শোল বোয়াল চিতলেরা পিঠ পেতে নিতে ভাসান দিয়ে ওঠে। বড় সুখ বৃষ্টির অাঁচড়ে। মানুষেরও বড় সুখ – বৃষ্টির দিনে গা মুড়ে গোল হয়ে বসতে, বিড়ি টানতে, সিঁদলের ব্যঞ্জন দিয়ে ভাত মুখে তুলতে। তারপর হঠাৎ মাঝরাতে তাদের সুখের আড়তে আগুনের তপ্ত গোলা ছিটকে পড়ে। কামানেরই গোলা হেন গুমগুম শব্দ ওঠে রাতের সুমসুম স্তব্ধতা গুঁড়িয়ে। ধড়াস্ ধস্ মাটি ভেঙে পড়তে থাকে আধকোশার বুকে। আধকোশা যেন দৈত্যের মতো থাবা বাড়িয়ে খাবলে টেনে নিতে থাকে মাটি, একেক গ্রাসে খেতে থাকে আস্ত একটা বটগাছ, ওই একটা বাড়ি, ওই একটা সড়কের পাড়। নদীর প্রান্তঘেঁষা মানুষেরা জেগে উঠে দ্রুতহাতে সরাতে থাকে বাড়ির মালামাল। মায়েরা শিশুদের বুকে তুলে ছোটাছুটি করে আর্তচিৎকার তোলে। এখনো নিরাপদ যারা, তারা ছুটে আসে নদীর পাড়ে। রাতের অন্ধকারও যেন নদীর ওই ভাঙন দেখবে বলে আকাশে রচনা করে ভোরের আগেই ফিকে আলো – আকাশটা হয়ে ওঠে চাপা আলোয় উদ্ভাসিত। সে-আলোয় দূর থেকে ছুটে আসা মানুষেরা নদীর ভাঙন দেখে বলাবলি করে – এবার তবে কতটা মাটি নদী খাবে!
এ যেন মইনুল হোসেনেরই অন্তর্গত বিস্ময়-উক্তি – এই সেই আধকোশা! কত মাটি খাবে! আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে যখন বৃষ্টির ঢল নামে, গ্রীষ্মে যখন হিমালয়ের বরফ গলতে থাকে, সারাটা শীতকাল মরে পড়ে থাকা এই নদী তখন হঠাৎ যৌবন পাওয়া নারীর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। চোখের পলকে কানায় কানায় ভরে ওঠে তার দেহ। তারপর জিনে ধরা যুবতীর মতো সে খলখল হেসে উঠে প্রান্তর ভেঙে ছুটতে থাকে। ভাঙন! ভাঙনই বটে। যুবতীর শরীরের বস্ত্র যখন খসে পড়ে, দৌড়ের বেগে তার যৌবনবতী নিতম্ব স্তনের হেলন-দোলনে তখন পুরুষজনের শ্লীলতা চুরমার হয়ে যেতে থাকে, কামনা-বাসনার মত্ততায় তারা তখন জ্যোৎস্নাপাগল হয়ে পড়ে; কিন্তু নদীর এ-খর যৌবন তাদের ভীত করে, তারা প্রত্যক্ষ করে ওঠে কেয়ামত, কোরানের সুরায় বর্ণিত সেই ভয়াবহ ঘটনা – যখন পর্বত হবে বিচলিত, যখন মৃত্তিকা হবে বিদীর্ণ, মানুষ তখন দিগ্বিদিকহারা হয়ে ছুটবে – সেই কেয়ামত তখন অনুষ্ঠিত হতে আছে বলে তারা বিস্ফারিত চোখে অবলোকন করবে। তখন আধকোশার বুকে উত্তর থেকে ছুটে আসা প্রবল ঢল, যেন জল নয় অগ্নি! – পাটল তার বর্ণ, পাটল জলে উন্মত্ত ঘূর্ণি, রাতারাতি নদী তখন বিস্তার পায় অর্ধক্রোশ, তখন আধকোশা নামে সত্যকার সে হয়ে ওঠে অর্ধক্রোশব্যাপী, উন্মত্তের মতো পাড় ভেঙে চলে। আর, এ সকলই শুরু হয় গভীর রাতে – যেন ডাকাতের মহড়া; কামানের শব্দের মতো গুমগুম শব্দ ওঠে জলেশ্বরীর আকাশে-বাতাসে, ঘুমের ভেতরে মানুষেরা ধড়মর জেগে ওঠে বিছানায়, চারদিকে রব ওঠে ভীত আর্ত – গেলো গেলো! ধড়াস্ ধস্ মাটি ভেঙে পড়তে থাকে নদীর বুকে, যেন কতকালের ক্ষুধার্ত সে, বৃক্ষ বাড়ি সড়ক গিলেও উদরপূর্তি নাই তার – আরো আরো আরো চাই। ভাঙতে ভাঙতে গিলতে গিলতে নদী যেন এই জনপদবাসীর মতোই কতকাল মঙ্গার কবলে ছিলো; মানুষ যেমন অনাহার সইতে সইতে একসময় পাগল হয়ে যায়, কচুঘেচু যা-ই পায় গোগ্রাসে গিলতে থাকে, কিংবা অনাহার আরো অসহন হয়ে পড়লে মানুষ যেমন মহাজনের ঘরের ওপর চড়াও হয়ে পড়ে, আগুন দেয় চালের গুদামে, লুট করে শস্যের ভান্ডার, নদীও যেন তেমনই।
তবে আরো আছে। নদীর জল সেদিন স্তব্ধ, বুকে তার স্রোতের টান নাই, ঢেউ নাই। খাপখোলা তলোয়ারের মতো ঝকঝক করছে আধকোশা, দেখলেই বুক কেঁপে ওঠে – এই বুঝি সটান লাফিয়ে উঠে বিদ্যুৎবেগে আঘাত করবে, দ্বিখন্ডিত করে ফেলবে সবকিছু, গলগল করে রক্তধারা ছুটবে চরাচর প্লাবিত করে। এরকম মনে হওয়াটা সেই সাতচল্লিশ সালে অবাক হবার মতো নয়। দেশ তো শুধু মাটি নয়! মায়ের মতো দেশ। জননী জন্মভূমি – লোকেই তো এমন বলে। জননীর মতো তার কোলে আশ্রয় পায়। ও মা, তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি, আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি! এ তো কেবল কবির কথা নয়, জ্যোৎস্নায় আপ্লুত রাতে গান গেয়ে ওঠা নয়! সেই দেশ যখন রাজনীতির কারণে দুভাগ হয়ে যায় – মাটি যে জননী – রক্ত তো পড়বেই! রক্ত পড়ে। সেই রক্ত হিন্দুর বুকে মুসলমানের ছুরিতে কি মুসলমানের গর্দানে হিন্দুর খাঁড়ার আঘাতে শুধু নয়, সে তো ছিলোই – মাটি থেকেই রক্তের ধারা, দ্বিখন্ডিত মাটি-লাশ থেকে রক্ত পড়ে, রক্তে ভেসে যায় দেশ-মানুষের হৃদয়। কিন্তু শরীরের রক্তও মাটি ভেজায় – পাঞ্জাবে সেই সময়ের খোঁজ যারা রেখেছে তারা জানে। পাঞ্জাবের সে-কথা লিখবেন খুশবন্ত সিং, লিখবেন ভীষ্ম সাহানি আর কৃষণচন্দর আর সাদাত হোসেন মান্টো। আমরা জলেশ্বরীর কথা এখন লিখছি। আজ এত বছর পরেও সেদিনের সেই রক্ত আমাদের কলমে।
আর এ-কলমে আমরা আধকোশা নদীর কথা লিখছি, লিখছি এই নদীর পাড়ে জলেশ্বরীর কথা, জলেশ্বরীর মইনুল হোসেন মোক্তারের কথা। আমরা তার ছেলে ঔপন্যাসিক মকবুল হোসেনের সঙ্গে এসেছি জলেশ্বরীতে। তার বাবার মৃত্যু হয়েছিলো আধকোশা নদীর পানিতে। নদীতে তখন আষাঢ়ের ঢল। উত্তরে হিমালয় থেকে বরফগলা পানিতে তুমুল উত্তাল নদী। সেই নদীতে কেন তার বাবা নেমেছিলেন, এ কাহিনি সে শুনেছে জলেশ্বরীর ধনী কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমান মিয়ার জামাই গফুরের কাছে। গফুর ঢাকা এসেছিলো চাকরির সন্ধানে। মকবুলকেই সে মুরুবিব হিসেবে ঠাউরে নিয়েছিলো। আপনি যদি একটু চেষ্টা করেন তাহলে ব্যাংকের চাকরিটা আমার হয়ে যায়। তারই ফ্ল্যাটে উঠে এসেছিলো, আশ্রয় নিয়েছিলো গফুর। হাজার হোক গফুর তার জন্মশহরের মানুষ। যদিও সে জলেশ্বরীতে বহুদিন যায় না, তবু দেশের মানুষ বলে কথা। তাছাড়া ঢাকাতে তার থাকার জায়গা নেই। চাকরি সন্ধান করছে, অতএব পকেটেও পয়সা নেই। অগত্যা তার বাড়িতেও থাকা-খাওয়া। প্রথম রাতেই খাবার টেবিলে গফুর বলেছিলো, আহ্, আপনার বাবার কথা মনে করে এখনো টাউনের বুড়া মানুষেরা কান্দে! কেন কাঁদে? তার মৃত্যুর কথা মনে করিয়া কান্দে তারা। আইজকাল তো সকল কথাই সকলের বিস্মরণ হয়া গেইছে। বুড়া সকল চলিয়া গেলে কারো কিচ্ছু স্মরণে আর থাকিবার নয়। অতঃপর গফুর মৃত্যুকাহিনির অবতারণা করে। তার মনে হয়, বেকার যুবকটি তার বাড়িতে থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে একটি লোমহর্ষক কাহিনি উপহার দেয়। এমত আমরা সকলেই করি। উপকার যার কাছে পাই তাকে আমরা তার সন্তোষজনক বিষয়-কথাই শোনাই।
কিন্তু তার মনে একটি প্রশ্নেরও উদয় হয়। পিতার অপঘাতে মৃত্যুর কথা কি কারো জন্যে সন্তোষজনক হতে পারে? গফুর সবিস্তারে বয়ান করে চলে। আমরা শুনেছি তখন ভরা বর্ষাকাল। নদী পাগল হয়া গেইছে। ঘোলা পানি চক্কর মারি মারি ছুটিয়া চলিছে। সেই পানিতে, আহ্, ক্যানে যে তিনি ঝাঁপ দিয়া পড়ে তার নির্ণয় না হয়। কাঁইও না কবার পায়। বুড়া মানুষেরাও আপসোস করি কয়, মাথাটায় বা তাঁর বিগড়ি গেইছিলো। শুনতে শুনতে মকবুলের স্মরণ হয় মায়ের সেই শেষ কথা – একবার পাকিস্তানে, একবার ইন্ডিয়ায়! আহ্, একটি দেশ দুই ভাগ হয়ে যায়! আমরা একসময় দেখতে পাবো, পাকিস্তান- হিন্দুস্থান হবার সাতচল্লিশের সেই দিনটিতে মইনুল হোসেনকে আধকোশা নদীর পাড়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। কাছেই কাছারির মাঠে তখন ব্রিটিশের পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা তোলার উৎসব। শহরের সমস্ত লোক সেদিন কাছারির মাঠে, কেবল মইনুল হোসেন ছাড়া। কেন? কেন সে উৎসবে শামিল হয় নাই, এ-বৃত্তান্ত আমরা পরে জানবো।
মইনুলের ছেলে মকবুল একটি ধাঁধার মতো কতকাল করোটিতে বহন করে চলেছিলো তার মায়ের শেষ ওই কথাটি। কতকাল ধরে থেকে থেকে তাকে আছাড় দিয়েছে হাসপাতালে মায়ের সেই শেষ মুহূর্তটি আর শেষ ওই কথাটি। একবার পাকিস্তানে, একবার ইন্ডিয়ায়। গফুরের কাছে সবিস্তারে সব শুনবার পরেও সে কোনো কূল পায় না। গফুরও তো সেদিনের যুবক। তারও তো সব শোনা কথা। এবং উপকারীর জন্যে ইনিয়ে-বিনিয়ে অতিরঞ্জিত করে সব বলা। সত্যের ভাগ বা আভাস বা তাতে কতটুকু! পাকিস্তান থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে, পূর্ব পাকিস্তানের জলেশ্বরী থেকে ভারতের কুচবিহারে, মাকে নিয়ে সে যাচ্ছে একাত্তরে। একাত্তরের এপ্রিল মাসে। মান্দারবাড়ির আকবর হোসেন জলেশ্বরীর মানুষগুলোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। সে খুব অবাক হয়েছিলো অজানা-অচেনা ওই যুবকটিকে দেখে। যুবকটিকে দেখে নয়, তার হাতে রাইফেল দেখে। রাইফেলটি যেন তার হাতে থাকবার কথাই নয়। বরং একটা বাঁশি তার হাতে হলেই যেন মানাতো। মাথায় লম্বা চুল। চোখে যেন কাজলটি পরানো। কাজল সে পরেনি, স্বাভাবিক সে কাজল। ছিপছিপে শরীর। ঠোঁটে লালিমা। এমন যুবক আমরা কত দেখি বাংলার গ্রামেগঞ্জে। এদের চোখে স্বপ্ন। কণ্ঠে গান। এলাকার সাংস্কৃতিক আসরে এদেরই আমরা দেখি। কিংবা আকবর হোসেনকে কখনো দেখিনি, যদিওবা দেখে থাকি, ভুলে গেছি। কেবল অনুভব এই যে, যুবকটি বাঁশি বাজায় অথবা তবলা পেটায় অথবা গান গায় কিংবা কবিতা আবৃত্তি করে। স্বপ্নদূতের মতো তাকে মান্দারবাড়ি থেকে হরিষালের পথে শরণার্থীর দল আবিষ্কার করে। সে-রাতে ভরা পূর্ণিমা ছিলো। আকবর বলে, পূর্ণিমায় কানাহোলা ধরে। চেনা পথও অচেনা হয়ে যায়। আপনারা সেই তখন থেকে এক রাস্তাতেই ঘুরছেন। আমার সঙ্গে আসুন। আমি বর্ডারে নিয়ে যাচ্ছি। এখান থেকে বেশি দূরে নয়। তখনো তার শোনা হয়নি, তখনো তো মায়ের মৃত্যুকাল নয় যে শুনবে – একবার পাকিস্তানে, একবার ইন্ডিয়ায়।
সীমান্ত যখন একাত্তরে সে মাকে নিয়ে পেরোয়, সে একা তো নয়, আরো পঞ্চাশজনের মতো মানুষ, তখন তার বয়স হবে পঁচিশ। ইতিহাস সে জানে। ভারত পাকিস্তান সে দিবালোকের মতো বাস্তব বলেই অনুভব করে। এই বাস্তবতার ভেতরেই সে বড় হয়েছে। সীমান্ত পেরিয়ে ভ্রমণের জন্যে পাসপোর্টও সে করেছে। কয়েকবার কলকাতায় গিয়েছে। বিশেষ করে তার একদার সেই প্রেমিকা সহেলির জন্যে একবার শাড়ি কিনতে। বালুচরি শাড়ি। ঢাকায় পাওয়া যায়নি। সহেলির সে ছিলো একরোখা শখ। একটা বালুচরি শাড়ি তার চাই-ই চাই। জীবনে তার সেই প্রথম শাড়ি কেনা। মাকে সে কখনই শাড়ি কিনে দিতে পারেনি। না ঈদে, না অন্য কোনো দিনে। মা বলেছেন, ছেলের হাতে শাড়ি নেয়ার মতো হতভাগী আমি নই। তোর বাবার টাকা এখনো আমাকে সুদ দেয়। সেই টাকায় আমি যখন শাড়ি কিনি আমার মনে হয় তোর বাবাই আমাকে কিনে দিচ্ছেন। মায়ের এই অদ্ভুত জেদটির কথা সে আজও বুঝে উঠতে পারে না। তবে অবিরাম অনুভব করেছে তার মা স্বামীকে মৃত বলে মনে করেন না।
মা কেন বাবাকে মৃত মনে করেন না, এও আমাদের ভাবায়। এটা কি এমন যে, স্বামীর মৃত্যু তিনি মেনে নিতে পারেন নাই? – যেমন অনেক নারীই পারে না! নাকি এর সঙ্গে ওই দেশভাগের কোনো এক গোপন গূঢ় যোগ রয়েছে যা মকবুল এখনো জানে না। আহ, সহেলি! জলেশ্বরীতে এসে কতবার মকবুলের মনে পড়বে সহেলির কথা। প্রথম প্রেম তো প্রথম প্রেমই। আর প্রথমের অংকন বড় গভীর হয় মানবজীবনে। আধকোশা নদীর পাড়ে বাংলাবাড়ির বারান্দায় বসে মকবুলের মনে পড়বে সহেলির সাঁতার শেখার গল্প – কপোতাক্ষ নদীতে, সাগরদাঁড়িতে। নাকি সে কবতক্ষ এবং নদী নয় – নদ! সতত হে নদ তুমি পড়ো মোর মনে! মাইকেল! মাইকেল মধুসূদন দত্ত। যশোরে সাগরদাঁড়ি কবতক্ষতীরে জন্ম তার! পঙ্ক্তিটি কি ঠিক ঠিক মনে করতে পারছিলো মকবুল যখন সহেলি তার জন্মগ্রামের নদীটির কথা বলছিলো। এখনো সে ভুলতে পারেনি সহেলির কথা। না, প্রেম নয়, প্রেমের সেই প্রত্যাখ্যান নয় – এ সকল কিছুই সে মনে রাখেনি স্পষ্ট করে। কিংবা রাখলেও তার মনে হয়ছে, ও-সকলই অন্য কারো কথা কিংবা অন্য জীবনের। অন্য জীবনেরই! কেননা ততদিনে সে বিয়ে করেছে নাসরিনকে। সংসার আমাদের ভুলিয়ে দেয় পেছনের দিনগুলো, কেননা সংসার বড় বাস্তব, আর স্মৃতি হচ্ছে সাবান ফেনায় গড়া রঙিন বল মাত্র। সামান্য ফুঁয়েই ভেঙে ভেসে যায়। যা ছিলো বিশাল গোলক, একটা ফুঁ পেলেই তা দু-এক বিন্দু সামান্য পানি হয়ে ঝরে পড়ে যায়। কিন্তু নিঃশেষে ঝরে যায় কি? মকবুলের মনে হয়, দেশভাগ হয়ে যেমন এতকালের একটা স্বদেশের একটা অংশ পর হয়ে যায়, আশাহীনভাবে বিদেশ হয়ে যায় – ভালোবাসার মেয়েটিরও অপরের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়াটাও বুঝি তেমনই – পরনারী হয়ে যাওয়া। এমনকি মকবুলের এমনও মনে হবে, তার মেয়ে প্রিয়লি যে একদিন ঘর ছেড়ে চলে যায়, সেই যাওয়াটার শোকও হয়তো এমনটাই।
কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমানের কেয়ারটেকারকে মকবুল দেখে নদী থেকে ডুব দিয়ে উঠতে। লোকটা যখন পাশে এসে দাঁড়ায় মকবুল তার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেয়। – আপনার নামটা আমার জানা হয় নাই। এর উত্তরে লোকটি বলে, সোলেমান বলিয়া বাপে নাম রাখিলেও এখন মোকে কেয়ারটেকার বলিয়াই টাউনের সকলে বোলায়। আগেকার দিন হইলে হামার বর্ণনা হইতো সরকার। এলায় সরকার আছে ঢাকায়। বঙ্গবন্ধুর সরকারকে তো গুলি মারিয়া পতন করিলো শয়তানের দল। তবে রাজনীতির কথা হামার এখতিয়ারে নয়। সে সকল কথা আপনার সাক্ষাতে কওয়াও উচিত হয় না। তবে ডর একখান লাগে। – কী রকম ডর? কেন ডর? কীসের ডর? মকবুলের কৌতূহল হয়। লোকটি বলে, পাঁও ধরিয়া না নদী হামাকে টানি নেয়, আর না উঠি আসিবার জো থাকে! এই যে আধকোশা নদী দ্যাখেন। ফজরের অক্তে কী সোন্দর ছবি হয়া আছে। – হাঁ, হাঁ, মকবুলের মনে পড়ে ছেলেবেলায় তার অাঁকা নদীর দৃশ্যের কথা। – জগৎ ঘুরে পড়ে মকবুলের ভেতরে। ছেলেবেলা, বড়বেলা, বিষাদ, বিচ্ছেদ আর প্রেম, তার মেয়েটি, আহা সেই দুঃখী তার মেয়েটি, আছাড় খেয়ে পড়ে। লোকটি নদীর দিকে আঙুল তুলে দেখায়। নদী বছর বছর মানুষ খায়! একটা মানুষ তার খাওয়া চায়ই চাই। – বলেন কি? বছর বছর মানুষ খায় নদী? – হাঁ, নিত্য বছর! ফি বছর! – নদীর দিকে তুলে ধরা আঙুলটি লোকটি হঠাৎ দ্রুত ফিরে নেয়। বোধহয় নদীকে অমন উদ্ধতভাবে আঙুল দেখানোটা ঠিক হয় নাই। নদী রুষ্ট হতে পারে। নদীরও কি মানুষের মতো রোষ নাই! লোকটি বলে চলে, আপনাকে না বলিলে নয়, আপনি বুঝিবেন, কারণ আপনি বই ল্যাখেন। – হাঁ, হাঁ, কথাটা কী কন! – কথাটা তবে এই, রোজ ফজরে গোসল করিতে আসি। নদীতে যে ডুব দেওয়া লাগে, ডুব দেই, কিন্তু প্রতিবার ডুব দিবার কালে আচমকা এই ডর ঝাঁপেয়া পড়ে মনে, যদি আর উঠিতে না পারি, যদি নদী আমাকে টানি নেয়, সেই যে বছর বছর একটা মানুষ ধরি খায়, সেই মানুষটা যদি আমাকে বলিয়াই নির্ণয় করে নদী! – মকবুলের বুকের ভেতরে যেন মুষ্ঠাঘাত হয়। তার বাবা মইনুল হোসেনের কথা মনে পড়ে। আধকোশার জলে নিষ্প্রাণ ভাসমান তার বাবার লাশ। সময়টা কি ফজর ছিলো, না মগরেব? উভয়কালেই আকাশ থাকে রাঙা। লাল টকটকে। লাল রক্ত ঝরে পড়ে।
ঠিক তখনই ভোরের নিস্তব্ধতা ভেঙে স্বর্গীয় একটি সুর, অমৃতের সূচীমুখ একটি রেখা, প্রবাহিত হতে থাকে। যেন উজ্জ্বল সোনালি রঙের চিকন একটি রেখা, জীবন্ত, চঞ্চল, ভোরের ধূসরতার বুক চিরে এগিয়ে চলেছে।… ইউটি টিট্ টিট্…হু হু পিইট্…পিট্ পিট্ সিউটি…গিইএ…পিট্!…তারপর ছোট্ট একটা শিস, আবার প্রথম থেকে… ইউটি টিট্ টিট্। কেয়ারটেকারের মুখ মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নিজের ঊরুতে নিজেই জোর একটা চাপড় দিয়ে চাপাস্বরে বলে ওঠে, আরে! আরে! কতদিন বাদে! হিমালয়ের জঙ্গল থেকি! সেথাকার জঙ্গলে থাকে। দ্যাখেন তার কেমন ধারা! মানুষে না পারে পাসপোট ছাড়া বডার পার হইতে। বডারে গেইলেই চক্ষু রাঙা করি বন্দুক তুলি ধরি কয় বোলে তফাৎ! নিজ নিজ জাগায় থাকেন! আর এই পাখি দ্যাখেন পাখায় উড়িয়া বডার পার হয়া হামার মুলুকে! হঠাৎ ব্যাকুল হয়ে লোকটি চারদিকে তাকায়। আরে গেইলো কোথায়! কই? কই? কোন্ঠে? তখন মকবুল বলে, আমি বোধহয় দেখেছি, একটু আগেই দেখছিলাম, এখন আর দেখছি না, এই তো ঝোপের ওই গাছটাতে বসে ছিলো এতক্ষণ। বলতে বলতে মকবুল চারদিকে চোখ পাঠায়। জাহাজের সন্ধানী আলোর মতো তার চোখ অদেখাকে ছিন্ন করে চলে। তারপর সে দেখতে পায়। তার চোখের আলো ঘনীভূত হয়ে পাখিটির ওপরে পড়ে। আরে! ওই তো! ওই! ওই! ওই যে! পাখিটিকে সে কামরাঙা গাছের ডালে দেখতে পায়। লাল সেই পাখিটি। ভোরের সেই পাখিটি। গান গাইবার জন্যে তখন থেকে যে গলা ফোলাচ্ছিলো সেই পাখিটি। কেয়ারটেকারও তাকে দেখতে পায়। সে আলতো করে হাততালি দেয় খুশিতে। কিন্তু নিঃশব্দ হয় তার হাততালি, পাখিটি যেন উড়ে না যায়। দ্যাখেন, দ্যাখেন, ছার! ইন্ডিয়ার পাখি উড়ি আসি হামার দ্যাশে হামার মুলুকে। মুলুকে তো মুলুকে, হামার নিজবাড়ির কামরাঙা গাছে! জানেন তো, সব পাখি না কামরাঙা গাছে বইসে। সেই পাখি বইসে যে হামাকে সাগাই বলিয়া জানে। সাগাই মানে বোঝেন তো? সাগাই মানে আত্মীয় হয়। – আহ্লাদ করে সে মকবুলকে বলতে থাকে, কতদিন বাদে দেখা গেইলো গো! বড় বিরল পাখি এই মুলুকে। ইন্ডিয়ার পাখি! কতদিন বাদে! (চলবে)