নদী কারো নয়

সৈয়দ শামসুল হক

৩০

বুড়ির চরে রাত তখন কাঁথার মতো পুরু, হালকা শীতের দিনে পুরনো কাঁথার মতোই আরামে জড়িয়ে ধরে আছে বুড়ির চরের কুটিরে কুটিরে মানুষের ঘুমশরীর। নারী তার শিশুসন্তানের মুখে স্তন গুঁজে দিয়ে অকাতর হয়ে আছে ঘুমে, স্বামীটি তার কতকাল বৃষ্টি নাই সেই দুঃস্বপ্নের তাড়কা মাছিগুলো তাড়িয়ে চলে, বাপোদাদার সমৃদ্ধকালের স্বপ্ন দেখার চেষ্টায় কেবলই এপাশ-ওপাশ করে। আধকোশা নদীটিতে রাতের নক্ষত্রগুলো প্রতিফলিত হয়ে থাকে,  যেন কোনো পরীস্থানের দর্পণ ভেঙে পড়েছে নদীর ঘুমস্থির জলের বুকে।

জলেশ্বরী ইশকুলের মাঠে শিশির পড়ে ফোঁটায় ফোঁটায়, অচিরে এই শীতকালে আয়নার মতো জমে যাবে ঘাসের ওপরে এই শিশির, ভোরে যখন মানুষের পা পড়বে, মটমট করে ভেঙে যাবে পায়ের নিচে। বাজারে নিশুত লাগা পথের ওপর এখনো পড়ে আছে পচা পোকা খাওয়া ফেলে দেয়া আনাজ, সন্ধেবেলায় বসেছিলো যে মাছের বাজার, ঘরে ঘরে রন্ধনের জন্যে যে কিনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, এখনো মাছের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে, জলজ সুঘ্রাণে পরিণত হয়েছে অাঁশের স্মৃতিবাহী বাতাস। অদূরেই বাবা শাহ কুতুবউদ্দিনের মাজারের সিঁড়িতলে গোল হয়ে ঘুমিয়ে আছে কুকুরের পাল। সারাদিন তারা তাড়া খেয়েছে বাজারি মানুষের, হালুইকরের, মাংসের ব্যাপারীর, কোথাও তাদের আদর হয় নাই, অবশেষে ক্ষুধার্ত দিনের পরে তারা আশ্রয় পেয়েছে বাবার কাছে – আহ্, বাবা কুতুবউদ্দিনের কাছে মানুষ বা প্রাণী ভেদ নাই। ওই দ্যাখো তারা বাবার করুণায় কী শান্ত নিমগ্ন ঘুমে। আর ওই যে বটগাছ, কতকালের কে জানে, ওরই কোটরে যে পলস্নীগায়ক অন্ধ কানাট্যাংড়া বাস করতো, হাটের দিনে গান করতো, একাত্তরের ওই যে সে-যুদ্ধের গীত পদ রচনা করে গাইতো, ওই যে মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিনের বীরগাথা সে হাটের দিনে আসর করে গাইতো, কতকাল সে আর নাই, নীরব, নিস্তব্ধ, আজ রাত যখন নিশুতি, হাওয়া যখন স্মৃতিভার নিয়ে থমথম করছে, তারই ভেতরে কানাট্যাংড়ার দোতরার ডোলোলং ডোলোলং বুঝি কান পাতলে শোনা যাবে।

আর, ওই ক্যাপটেন! মুক্তিযুদ্ধের ক্যাপটেন মজহার – তারও পায়ের শব্দ এই নিশুতি রাতে আবার জেগে ওঠে। কতকাল সে আর বেঁচে নাই, মুক্তিযুদ্ধের পরে পরে, একাত্তরে বিজয়ের ডিসেম্বর পরে পরেই তার পদচারণা ছিলো জলেশ্বরী শহরের পথে পথে, সতর্ক পাহারায় ছিলো সে যেন কোনো রাজাকার কি পাকিস্তানি দালাল আবার সমাজে জায়গা করে নেবার জন্যে নিঃশব্দে জমায়েত হতে না পারে। তার ছিলো একটাই বিচার। ক্ষমা নাই। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়াতেও ছিলো না তার আস্থা। একাত্তরের বিজয়ের পরেও সে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করে নাই। তার ছিলো একটাই যুক্তি – যুদ্ধকালে রাজাকারদের যদি হত্যা করেছি, বিজয় এসে গেছে বলেই সে হত্যার কাল পার হয়ে যায় নাই, এখনো তারা আমার বধের পাত্র – এই ছিলো তার স্থির সিদ্ধান্ত। কিন্তু সে একা এবং জলেশ্বরী বাংলাদেশের অগণিত জনপদের সামান্য একটি অংশ মাত্র। জলেশ্বরীতে সে রাজাকারদের শনাক্ত করে করে তার রাইফেলের বুলেটের লক্ষ্য করে তুললেও, জলেশ্বরীকেও সে সম্পূর্ণ রাজাকারমুক্ত করতে পারে নাই – বিশাল বাংলাদেশের তো কথাই নাই! মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিনের ছেলে শামসুদ্দিনকে এখনো মোকাবিলা করতে হচ্ছে পুরাতন আর নতুন রাজাকারদের যারা এই বাংলাদেশে বিশ্বাস করে নাই কি এখনো করে না।

রাতের এই জনহীন শব্দহীন কিন্তু স্মৃতিভারে নত নিশুতিকালে জলেশ্বরী শহরের পথে পথে এখনো বুঝি ক্যাপটেনের পদচারণার শব্দ পাওয়া যায়, আর শোনা যায় তার সেই ডাক – এ-এ-এ-রে-এ-এ। সেই ডাকে মায়ের স্তনলগ্ন শিশুর মুখে অস্ফুট ফুটে ওঠে ফেরেশতার বেহেশতি হাসি, দম্পতির শয্যায় জাগে সাত সাগর বাণিজ্য নৌকার দুলুনি, রক্তস্নাত বাংলা মায়ের কপালে দেখা দেয় পূর্ণিমার চাঁদ, বৃদ্ধেরা কবরের ভয় আর করে না, বিচার দিনের শংকা তারা ভুলে যেতে থাকে রাতগভীরে ক্যাপটেনের দূরগত ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত ডাকে, তখন তারা আশ্বস্ত হয়ে ওঠে যে, হাসরের মাঠে দাঁড়িয়ে তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিজয়ী সন্তানদের দেখা পাবে, আধকোশা নদীটিও সেই ডাকে ভুলে যায় একাত্তরে তার বুকের ওপর দিয়ে যে শত শত লাশ ভেসে গেছে, নদীটিও তার দীর্ঘ কান্না থামিয়ে কুলুকলু ধ্বনি ফিরে পায়, এই ধ্বনি শহরের ওপর দিয়ে প্রতি রাতে বহে যায় আজো।

সমস্ত শহর গভীর ভেতরে নড়ে ওঠে রাত যখন এমতো হয়। জলেশ্বরীর আনোয়ার হোসেন রোড জেগে ওঠে একাত্তরের সেই আনোয়ারকে নিয়ে – আহ্, সে-কথা মনে করতে নাই, কী নির্মম মৃত্যু তার পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে, তবু সে জয় বাংলা ভোলে নাই, আর্তকণ্ঠ, তবু সে শেষনিঃশ্বাসে কী অঘোর বিশ্বাসেই না উচ্চারণ করেছিলো – জয় বাংলা। আজো মধ্যরাতে সেই জয় বাংলা ধ্বনি জেগে ওঠে শহীদ আনোয়ার হোসেন রোডের প্রতি ধূলিকণায়। যে শোনে সে শোনে। মানুষ শোনে কি শোনে না, ইতিহাস কান পেতে শোনে। শহীদ গেদু মিয়া লেন – আহ্, বিহারি কসাই তাকে জবাই করেছিলো এই সড়কের পাড়ে মাড়োয়ারিদের পাট গুদামের বারান্দায়। গভীর রাতে এখনো ফোয়ারার মতো তার রক্ত ছোটে কণ্ঠনালি থেকে, সেই রক্ত কোনো নক্ষত্র মেখে ওঠে, রাতের আকাশে লাল হয়ে মিটমিট করে ঘুমন্ত জলেশ্বরীর ওপরে। চাঁদবিবির পুকুর – না আগে এই নাম ছিলো না পুকুরটির, লোকে পচা পুকুর বলেই জানতো, তারপর একাত্তরে পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে ধর্ষিত চাঁদবিবি আত্মহত্যা করেছিলো এখানে, মানুষ তাকে রক্ষা করতে পারে নাই, আশ্রয় তাকে দিয়েছিলো পচা পানায় পানায় ঢাকা, দুর্গন্ধ কালো হয়ে যাওয়া এই পুকুরের পানি, এমন নিশুতি রাতে পুকুর থেকে লোবানের ঘ্রাণ জেগে ওঠে জলেশ্বরীতে।

গভীর রাতে কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমানের ফোন পেয়ে পথে নামে তাঁর কেয়ারটেকার সোলেমান মিয়া। আমরা তো শুনেছি আধকোশার পাড়ে বাংলাবাড়িতে এসে মকবুল হোসেনকে সে বলছে মনিবের ফোনের বিবরণ – সায়েবে কইলে, বুড়ির চরে কাজী আছে না? – কোন কাজী? – আরে, বিয়া পড়ায় যে কাজী। তার কাছে যা! – কইলোম, রাইত তো অনেক, নিন্দ যায় বুঝি! – নিন্দের গুষ্টি মার। তার ধরি আন। – শুনিয়া হতভম্ব হয়া গেইলোম। বিয়ার কাজী এত রাইতে! তাকে ধরিয়া আনা! সায়েবকে পুছ করিলাম, কোনঠে আনিম! সায়েব চড়াও হয়া কইলে, রেললাইনের পাশে মেহেরম্নলস্না জিপ নিয়া আছে, কাজীকে আনিয়া জিপে বসেয়া রাখ। – অচিরেই আমাদের জানা হবে জলেশ্বরীর এই কাজী সাহেবকে, সেই কাজী, বিবাহ সম্পাদনের জন্যে আরো দুজন কাজী এ শহরে থাকলেও সবাই চায় হাফেজ আবুল কাশেম বলরামপুরীকে দিয়েই তাদের ছেলে বা মেয়ের বিবাহটি পড়ানো হবে। বলরামপুরীর এই খ্যাতি বা প্রতিষ্ঠার কারণ তার মোনাজাত বয়ানের প্রতিভাটি। এমন সুরেলা কণ্ঠ, এমন বাক্যবিন্যাস, এমন ছন্দশীল গতি, লোকে বিবাহের মতো আনন্দঘন অনুষ্ঠানেও কেঁদে জারেজার হয়ে যায়, তাদের বিশ্বাস হয় স্বয়ং খোদাতালাও মুগ্ধ হয়ে যান বলরামপুরীর মোনাজাতের আবেদন নিবেদনে, সাত আসমানের চূড়ায় বসেও খোদাও অস্থির হয়ে পড়েন, হয়তোবা নেমেই আসেন মাটির ধুলার আসরে বাসরে।

তবে হাফেজ আবুল কাশেম বলরামপুরীর খ্যাতি অতটা নিটোল নয়, কারণ সে বিদেশি! বিদেশি মানে? আমরা জানি তার জন্ম জলেশ্বরীতেই, এখানেই সে কিশোরকাল কাটিয়ে ঢাকায় যায় আলিয়া মাদ্রাসায় পড়তে, সেখানে চূড়ান্ত টাইটেল পরীক্ষা দিয়ে কামেল পাশ করে ফিরে আসে জলেশ্বরীতেই। ইচ্ছা করলে সে ঢাকায় থেকে যেতে পারতো, তার পরীক্ষা পাশের ফল এতটাই ভালো হয়েছিলো যে ঢাকার মিয়া সাহেব ময়দানের পীর সাহেবকে যখন সালাম করতে গিয়েছিলো, তিনি তাঁকে বলেছিলেন – বাবা, আপনি থাকিয়া যাউন, নূতন দ্যাশ, এখন ইসলামের ঝান্ডা প্রতিষ্ঠার সময়, রাজধানীতে থাকিয়া সুন্নতের জামাত কায়েমের কাজে শরিক হন। এই পীরসাহেবের হাতেই বয়াত নেয় আবুল কাশেম, এই পীরসাহেবই ঢাকায় তাকে আশ্রয় দেন, সময়-অসময়ে নগদ। নেক সাহায্যও করেন, কিন্তু তাঁর পরামর্শ সে গ্রহণ করে নাই। জলেশ্বরীতে ফিরে এসে গৌরব করে বলে – ছোটখাটো মিথ্যা কথায় দোষ নাই, ঘাড়ের ওপরে বসা ফেরেশতারও এত সময় বা কলমের এত কালি নাই যে তুচ্ছ অপরাধও লিপিবদ্ধ করে, আবুল কাশেম খানিক বাড়িয়ে কি আগাগোড়া মিথ্যে করেই লোকজনকে অবসরে অবকাশে বলে, বয়তুল মোকাররাম তো চেনেন! জাতীয় মসজিদ! সেই মসজিদের খতিব সায়েব মোকে ডাকিয়া নিলে, বলিলে যে এই মসজিদে আসিয়া তুমি মোয়াজ্জিনের দায়িত্ব নেও, মুঁই তোমাকে পারমেন্ট চাকরি দিলোম। তা শুনিয়া মুঁই তাকে কইলোম, হুজুর, হিজরত করিছিলেন মোহাম্মদ মোস্তফা রসুলুলস্নাহ, হামাকে না সেই আদেশ করেন। তাঁই মদিনায় গেইলেও তাঁর মন পড়ি থাকতো মক্কায়, প্রতি সেজদায় নয়নে তাঁর মক্কা ভাসি উঠিতো। মুঁই নাদান বান্দা, খোদার দরবারে পাপী বলিয়া চিহ্নিত, তেও মোরও সেই এক কথা, জন্মভূমির টান, মুঁই দ্যাশে ফিরি যামো।

দ্যাশ! জন্মনাড়ি যেখানে পোঁতা তাকেই আমরা দেশ বলি, বিশাল দেশের ভেতরে সেটাই আমাদের আসল দেশ। সামান্য মানুষ আমরা, সামান্যই আমাদের কাছে গৌরবে হয়ে ওঠে বিশাল, আমাদের জন্মগ্রামটিও হয়ে ওঠে মুখের বর্ণনায় শুধু নয় অন্তরের স্থাপনেই – দেশ! তারপরও হাফেজ বলরামপুরী জলেশ্বরীর নিন্দুক আর প্রতিপক্ষের অপর দুই কাজীর কাছে ও প্রচারে – বিদেশি! এ কেমন? তবে লক্ষ্য করি তার নামের ওই বলরামপুরী অংশটি। হ্যাঁ, বলরামপুর! কুচবিহারের বলরামপুর! আর, কুচবিহার নয় র‌্যাডক্লিফের লাল পেনসিলের খোঁচায় তৈরি পাকিস্তানের বা বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের ফসল আমাদের এই বাংলাদেশের। কিন্তু বলরামপুর নামটি আমাদের চেনা চেনা লাগবে, স্মৃতির ভেতরে আলোড়ন আমরা টের পাবো নামটি উচ্চারিত হওয়া মাত্র। আমাদের মনে পড়ে যাবে, ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ গানটি যে রেকর্ডে গেয়েছিলেন, সারা বাংলা আসামের মুসলমানদের মাতিয়ে রেখেছিলেন যিনি ওই গানে, আজো রমজানের শেষে হেলাল চাঁদটি দেখামাত্র রেডিও টেলিভিশনে বেজে ওঠে যে গান – যদিও তা এখন অপর গায়কের কণ্ঠে – প্রথমে গেয়েছিলেন হলুদ মার্কা রেকর্ডে সেই ব্রিটিশ আমলে, বাংলার বুলবুল যাঁকে বলেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, সেই আববাসউদ্দিনের জন্ম হয়েছিলো কুচবিহারের ছোট্ট শহর বলরামপুরে। আর, ওই বলরামপুরেই ছিলো আবুল কাশেমের বাপদাদাদের বাড়ি। সাতচলিস্নশে ব্রিটিশ বিদায় নিলো ভারতবর্ষ থেকে, বিদায় নিলো কিন্তু টুকরো করে গেলো তারা দেশটাকে, পাকিস্তান হিন্দুস্থান হলো, চোখের পলকে দেশের এক অংশ হয়ে গেলো বিদেশ, দলে দলে মুসলমানেরা হিন্দুস্থান থেকে হিজরত করে এলো পাকিস্তানে, নাম হলো তাদের মোহাজের, কী না হিজরতকারী! আর, হিন্দুরা পাকিস্তান থেকে বন্যার স্রোতের মতো যেতে শুরু করলো হিন্দুস্থানে। মানুষে মানুষে আর নয়, ভাগ এখন হিন্দু আর মুসলমানে; দেশটারই ভাগ শুধু নয়, ভাগ এখন ধর্মে ধর্মে।

মহারাজার অধীন দেশ কুচবিহারে হিন্দু আর মুসলমান সমান অধিকারে বাস করেছে স্মরণের ওপারে যতদূর স্মরণ করা যায়, ছিলো তারা এক, হয়ে গেলো দুই। আবুল কাশেমের বাবা আবুল হাশেমও মুসলমানদের হিজরতের ঢলে শামিল হয়ে কুচবিহার ছেড়ে তথা হিন্দুস্থান ছেড়ে চলে এলেন পাকিস্তানে। পাকিস্তান মানে দূর করাচি লাহোর যে মুসলমানদের চোখে সামনে ভেসে উঠতো তখন, এমনকি ঢাকার ছবিও যে ঝলমল করে উঠতো বাংলার মুসলমানের কল্পনায় – আহ, কতদিন পরে ঢাকা ফির রাজধানী! অতীতের সুবাহ বাঙালার রাজধানী! মুসলমান রাজত্বের সেই ঢাকা ফির রাজধানী! খোদা মুখ তুলিয়া চাইছে হে! মুসলমানের গৌরবের দিন ফিরি আসিছে হে! না, সেই করাচি বা ঢাকা নয়, জলেশ্বরী! জলেশ্বরীতে পরিবার-পরিজন নিয়ে এসে উপস্থিত হয় মহারাজার বেতনভোগী বলরামপুরের প্রাইমারি ইশকুলের হেডমাস্টার আবুল হাশেম। বলরামপুর থেকে দীনহাটা, তারপর পায়ে পায়ে পাকিস্তানের সীমান্ত পার হয়ে হরিষাল গ্রাম, সেখানে মোহাজের ক্যাম্পে কয়েক সপ্তাহ থেকে আবুল হাশেম বছরখানেকের জন্যে ডেরা বাঁধে হস্তিবাড়িতে, তারপর মহকুমা সদর জলেশ্বরীর প্রান্তে রেললাইনের পাশে বুড়ির চর প্রাইমারি ইশকুলে চাকরি পেয়ে এখানেই জমি কিনে বাড়ি করে সে। আর, এখানেই জন্ম হয় তার ছেলে আবুল কাশেমের। বড় ছেলেটি হরিষালের মোহাজের ক্যাম্পে কলেরায় পড়ে মারা যায়। বড় মেয়ের বিবাহ সে দেয় কুচবিহারেই থেকে যাওয়া আবুল হাশেমের বড় ভাই আবুল হোসেনের ছেলে আবুল ইনসানের সঙ্গে। না, কুচবিহার হিন্দুস্থানের ভাগে গেলেও আবুল হোসেন বলরামপুর ছাড়ে নাই, বস্ত্তত আবুল হাশেমের বৃহত্তর পরিবারের কেউ মাটি ছেড়ে চলে যায় নাই।

তবে আবুল হাশেমই বা কেন একা তার পরিবার নিয়ে চলে আসে পাকিস্তানে? এর কোনো স্পষ্ট উত্তর নাই। এ প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট করে আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারে নাই – অন্তত কুচবিহার ছেড়ে আসা আরো যে কটি পরিবার জলেশ্বরী বা রংপুরে এসেছে তাদের কাছেও এ জিজ্ঞাসা করে উত্তর পাওয়া যায় নাই। বরং সবার চোখে মুখেই অপ্রস্ত্তত অপ্রতিভ এক চনমনে ভাব লক্ষ করা যাবে – আজো প্রাচীন যারা আছে তাদের যদি এ প্রশ্ন করা হয়। আমরা উত্তরটার কিছু কিছু অনুমান করতে পারি। সবার প্রথমেই আসে পাকিস্তানি জোশের কথা, সেই জোশ একেকজন একেক রকমে অনুভব করেছে, উত্তেজিত হয়েছে কেউ, কেউ ততটা হয় নাই, যারা হয়েছে তারা সেই ঝোঁকেই দেশ ছেড়ে পাকিস্তানের অজানা পথে পা বাড়িয়েছে। এবং অচিরকালে যখন সেই ঝোঁক কেটে গেছে, অচিরকালে যখন তারা বুঝতে পেরেছে ঝোঁকের বশে উত্তেজিত হয়ে কান্ডজ্ঞান হারিয়ে মানুষ যেমন খুন করে বসে, তেমনি তারাও বাপদাদার স্মৃতি খুন করে দেশ ছেড়েছে। আবার এমনও হয়েছে, হিন্দু মুসলমানের বিবাদটা স্বার্থবাদীরা খুঁচিয়ে সৃষ্টি করেছে – নতুন পরিস্থিতিতে, দেশত্যাগের ফলে শূন্যমাঠে ব্যবসা বাণিজ্য চাকরির ব্যাপক সুযোগ করে নেবার জন্যে। আবার, অনেকেই স্বপ্ন দেখেছে নতুন দেশে তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে বেহেশতি ভূমি – সুযোগের অবাধ প্রবাহ, অযোগ্যের জন্যে যোগ্যতারও অধিক সুযোগ। কিন্তু অচিরেই সবার মোহভঙ্গ ঘটে, এমনকি পাকিস্তান হবার বছরখানেকের মাথাতেই পূর্ববাংলায় শোচনীয় হয়ে পড়ে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি। প্রথম কথাই ধরা যাক, সোহরাওয়ার্দীকে পূর্ব বাংলায় আসতে না দেওয়া। কোন সোহরাওয়ার্দী? সেই সোহরাওয়ার্দী যিনি ব্রিটিশ আমলে পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে সারা বাংলা চষে বেরিয়েছেন। কোন বাংলা? বৃহৎ বাংলা – আজকের ভারতের পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ নিয়ে যে অখন্ড বাংলা। আর, ইতিমধ্যেই অনেকের কানে পৌঁছে গেছে সেই ইতিহাস – বৃহৎ বাংলাকে অখন্ড রাখবার উদ্যোগটি, যার পুরোভাগে ছিলেন সোহরাওয়ার্দী আর আবুল হাশিম যাঁর কথা এর আগেই আমরা বলে নিয়েছি। আবুল হাশিম? কারো উচ্চারণে হাশেম! আমরা নিয়তি-নির্দিষ্ট নামের এমতো সমাপাতনে একটু অবাকই হবো, কেননা আমরা দেখে উঠছি যে, হাফেজ আবুল কাশেম বলরামপুরীর হিন্দুস্থানত্যাগী পিতার নামটিও আবুল হাশেম।

তিনি দেশ ছেড়েছিলেন – সেই অর্থে দেশ যেখানে আমাদের জন্মনাড়ি পোঁতা – একটি হতাশা থেকে। দীর্ঘকাল তিনি প্রাইমারি ইশকুলে মাস্টারি করেছেন। উনিশশো ছেচলিস্নশ সালে মহারাজা তাঁর পূণ্যাহের দরবারে ঘোষণা দিয়েছিলেন বলরামপুরের ইশকুলটিকে মাইনর ইংলিশ স্কুলে রূপান্তরিত করা হবে। আবুল হাশেম গিয়েছিলেন দরবারে, মহারাজার পূণ্যাহের শেষ সেই স্মৃতি আবুল হাশেম ভোলেন নাই, বছর বছর নতুন ছাত্রদের কাছে গল্প করতে বিরাম নেন নাই। লাল শালুর টুকরোয় আবুল হাশেম মহারানী ভিক্টোরিয়ার একটি রুপার টাকা পেশ করেছিলেন মহারাজার নজরানা হিসেবে। সোনালি জরি বসানো লাল মখমলের চাঁদোয়ার নিচে মঞ্চের ওপরে রুপার সিংহাসনে বসে আছেন মহারাজা, মহারাজার মাথায় কুচবিহারের ঐতিহাসিক মুকুট ঝলমল করছে, বুকের ওপরে রুপার বড় একটি তারকা, দুহাতের দশ আঙুলের প্রতিটিতে জ্বলজ্বল করছে হীরা, পান্না, নীলা, চুনি, আরো কত পাথর। মহারাজাকে ঘিরে তাঁর চার কোণে দরবারি পোশাকে সজ্জিত চারজন সিপাহি খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সারিবদ্ধ হয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে প্রজারা, তাদের পরিচালনা করছেন আর কেউ নয়, স্বয়ং মহারাজার ছোটভাই ডাকনামেই যিনি সারা কুচবিহারে খ্যাত – ভিক্টর মহারাজা। আবুল হাশেম যখন মঞ্চের নিচে পায়ের কাছে পৌঁছেছিলো, ছোট্ট একটা হোঁচট খেয়েছিলো কার্পেটের কোনায় পা বেধে, আর সেটি দেখে মহারাজা যে চকিতে একটু উদ্বিগ্ন হয়ে তার দিকে তাকিয়েছিলেন, আবুল হাশেম সে-কথা ভোলে নাই। তারপর শালুতে রাখা রুপার টাকাটি মহারাজার সমুখে তুলে ধরতেই তিনি তাঁর আংটি শোভিত হাতটি বাড়িয়ে একটু ছুঁয়ে দিলেন, তারপরই টপ করে টাকাটি নিয়ে নিলো নিচে বসা মুহুরিটি, খাতায় লিখে নিলো নাম। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই ছবিটি ছিলো উজ্জ্বল তার মনে, ছিলো – কারণ প্রতি পূণ্যাহেই আবুল কাশেম উপস্থিত থাকলেও আর নজরানা দিলেও এটিই ছিলো দেশভাগের আগে মহারাজার শেষ পুণ্যাহ। আর কী যে খুশি হয়েছিলো আবুল হাশেম যখন মহারাজা তাঁর ভাষণে অনেক নতুন কিছু পরিকল্পনার কথা বললেন এবং ভুললেন না বলরামপুরের কথা, বলরামপুরের প্রাইমারি ইশকুলটির কথা। প্রজাদের সমুখে মহারাজা বরাবরই ভাষণ দিতেন রংপুরি ভাষায়। – তোমরা জানিবেন, পুত্রকন্যা সমান তোমরা হামার অন্তরে আছো। হামার সকল ধেয়ান তোমার উন্নতির লাগি, খুশির লাগি, আর তোমার সুন্দর জেবনের কারণে মোর সকল কাজ বহাল আছে জানিবে। – অতঃপর সেই ঘোষণা, বলরামপুরের প্রাইমারি ইশকুলখানাও এই নগদ বচ্ছর হতে মাইনর ইশকুল করিবার ঘোষণা মুঁই দিলোং। আবুল হাশেম বড় আশা করেছিলো, মাইনর ইশকুল হলে হেডমাস্টার পদে নিয়োগটা সে পাবে। কিন্তু সে আশা তার পূরণ হয় নাই। সাতচলিস্নশের জানুয়ারিতেই জানা যায় কলকাতা থেকে বিএ পাশ করা এক যুবককে আনা হচ্ছে মাইনর ইশকুলের হেডমাস্টার পদটিতে। এর কয়েক মাসের মধ্যেই যখন পাকিস্তান হয়ে যায়, আবুল হাশেমের মনে হয় হিন্দুর রাজত্বে মুসলমানের উন্নতির কোনো আশা নাই।

হিন্দুর রাজত্ব? হ্যাঁ, কুচবিহারের মহারাজা তো হিন্দুই, আর তাঁর রাজ্যের সকল ক্রিয়াকর্মই হয় হিন্দু আচারক্রমে। প্রতিমাপূজা বিরোধী এক ঈশ্বরের পূজক ব্রাহ্মধর্মের আচার্য কেশব সেনের কন্যার যখন বিবাহ হয় কুচবিহারের মহারাজার সঙ্গে, সেই কেশব সেনকেও কলকাতা থেকে কন্যাকে কুচবিহারে এনে প্রতিমার সমুখে প্রতিমা সাক্ষী বিবাহ দেন হিন্দুধর্মমতে। কিন্তু তখন কুচবিহারের কোনো মুসলমান প্রজা মনেও করে নাই যে, এটি হিন্দুর রাজত্ব আর এখানে আচার আচরণ সবই হয় হিন্দুর বিধান অনুসারে; তারা ভেবেছে মহারাজা তাঁর ধর্মমতেই তো বিবাহ করবেন, আর আমরাও ঈদ রোজা রমজান মহরম করবো আমাদের ইসলামি বিধানমতে। কোরবানি? হ্যাঁ, ভারতবর্ষের কোথাও কোথাও গরু জবাই নিয়ে গোলমাল থাকলেও কুচবিহারে কোনো আন্দোলন ছিলো না এ নিয়ে। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ছিলো এমন বন্ধন যে পরস্পরের রীতি-রেওয়াজকে সম্মান করতো দুই পক্ষই – মসজিদের সামনে পূজার ঢোলে বাড়ি দেয় নাই হিন্দুরা, নীরবে পার হয়ে গেছে রাস্তাটা, আর মুসলমানেরাও কোরবানির দিনে গরু জবাই যদি দিয়েছো তো দিয়েছে হিন্দুর চোখের আড়ালে, মুসলমান অন্তর থেকে এটুকু অনুভব করেছে, হিন্দু যদি গোমাতা বোধ ধারণ করে তবে তার সাক্ষাতে গরু জবাই করে মনে আঘাত দেওয়া মানুষের কাজ নয়। কিন্তু আবুল হাশেমের মনে হিন্দু-মুসলমানের কতকালের এই পারস্পরিক সম্প্রীতির ইতিহাস তলিয়ে যায় হেডমাস্টার হতে না পারার কারণে। সে সিদ্ধান্ত নেয় – কুচবিহারে আর নয়, তার আশা হয় পাকিস্তানের নতুন দেশে তার স্বপ্ন পূরণ হবে। ভাইবোন আত্মীয়স্বজন ফেলে সে পায়ে হাঁটা পথ ধরে কুচবিহার রংপুরের সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে আসে। কিন্তু এখানেও তার জন্যে অপেক্ষা করছিলো দুর্ভাগ্য, হেডমাস্টার সে হতে পারে নাই। জলেশ্বরীর বুড়ির চরে মাইনর ইশকুলটির হেডমাস্টার হবার জন্যে সে আপ্রাণ তদবির চালায়, কত ছোটাছুটি করে, মুসলিম লীগের নেতা নজির মিয়ার বাড়িতে কত ধরনা দেয়, শেষ পর্যন্ত বিহারের কাটিহার থেকে আসা অনবরত পান চিবানো পানের রসে ঠোঁট লাল, উর্দুতে বাতচিৎ করা, ছাইরঙা জিলজিলে আচকান পরা বিহারি এক যুবককে বড় সমারোহ করে চাকরিটি দেয়া হয়। পাকিস্তানের ওপর থেকেই মন উঠে যায় আবুল কাশেমের। আমরা সাধারণ মানুষেরা ইতিহাস পাঠ ও বিচার করে রাজনৈতিক মত পালটাই না, আমরা আমাদের নিজস্ব বাস্তবতা থেকেই ওই পাঠ পেয়ে যাই, আবুল হাশেমও পায়। আমরা অনুমান করতে পারি, পূর্ববাংলায় চুয়ান্নর প্রাদেশিক নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়, যে যুক্তফ্রন্ট পাকিস্তানের জন্মকারক মুসলিম লীগের সর্বাংশে ভরাডুবি ঘটায়, সেই নির্বাচনে আবুল হাশেম মুসলিম লীগ প্রার্থী নজির মিয়াকে ভোট না দিয়ে ভোট দেয় যুক্তফ্রন্টের আবদুর রহমান মিয়াকে। শুধু আবুল হাশেম কেন, পূর্ববাংলার সকল মানুষেরই পাকিস্তান মোহ কেটে গিয়েছিলো পাকিস্তানের সাড়ে ছ-বছরের মাথায়, নইলে সেদিন হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর দল এমন নিরংকুশ বিজয় লাভ করেছিলো কী করে?

আবুল হাশেম পারতপক্ষে বলরামপুরের স্মৃতি বিলাস আর করেন নাই, যেমন আমরা করে থাকি আমাদের জন্ম এলাকাটির জন্যে। জলেশ্বরীতে জন্ম নেয়া তার ছেলে আবুল কাশেমও বলরামপুরের নামটি ভিন্ন আর কোনো বিবরণ বা কাহিনি বাবার কাছে পায় নাই। কিন্তু এই আবুল কাশেমই যখন ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কামেল পাশ করে, কোরানে হাফেজ হয়ে, মাথায় সবুজ পাগড়ি বেঁধে, চোখে নীল সুরমা আর জিরো পাওয়ারের চশমা পরে, জলেশ্বরীতে ফিরে আসে, তখন বলরামপুরকে তার মনে পড়ে। মনে পড়ে, কারণ – তার পেশায় নামটা জবরদস্ত হওয়া চাই, নামের আগে হাফেজ তো ছিলোই, কিন্তু তার কানে হাফেজ আবুল কাশেমটি খুব শ্রদ্ধা উদ্রেককারী শোনায় না, তার মনে পড়ে বড় বড় পির-মওলানারা নামের শেষে জন্মস্থানের বা বিদ্যাগ্রহণের স্থানিক নামটি যোগ করেন, যেমন দেওবন্দী কি এনায়েতপুরী কি শর্ষিনা কি ফুরফুরা, আবুল কাশেমের তখন বলরামপুর মনে পড়ে যায় এবং সেটিকেই তার নামের অংশ সে করে তোলে – হাফেজ মওলানা আবুল কাশেম ইবনে আবুল হাশেম বলরামপুরী। তার পাগড়িটিও অধিক পুরু করে তোলে সে, এবং প্রথম স্ত্রীর পরে, তার বন্ধ্যত্ব দোষ দেখিয়ে দ্বিতীয় বিবাহও করে, এবং তৃতীয় বিবাহটিও করে এবার কোনো অজুহাত না দেখিয়েও। নারীটি তার কাজী অফিসে তালাকের জন্যে এসেছিলো, তার খর যৌবন রূপ-সৌন্দর্য আর স্বাধীনপ্রিয়তা দেখে আবুল কাশেম কাবু হয়ে পড়ে এবং ইদ্দতকাল পার হবার পরেও অপেক্ষা না করে তাকে ঘরে তোলে। এখানেই বলে রাখা দরকার, নতুন নতুন বিবাহজনিত ঝামেলা ও বিবাদ সত্ত্বেও আবুল কাশেমের এই স্ত্রী এখন তার পূর্বতন দুই স্ত্রীর সঙ্গে বড়ই মিলমিশে রয়েছে। কারণ? আর কিছুই নয়, চতুর্থ স্ত্রী! সংখ্যায় চার না হলে সংসার পুরা হয় না! আর এই নবাগত স্ত্রীটিকে যে কোথা থেকে আবুল কাশেম সংগ্রহ করেছে, পূর্ণ যুবতীও নয়, বালিকাই এখনো বলা যায় – অনেক তত্ত্ব-তালাশের পর তার আগের তিন স্ত্রী আবিষ্কার করে যে আম্বিয়া নামে এই স্ত্রীর দেশ হচ্ছে কুচবিহার! ভারতের কুচবিহার! হ্যাঁ, দাওয়াতি এক সফরে ভারত সীমান্তের লাগোয়া বাংলাদেশেরই হরিষাল গিয়েছিলো আবুল কাশেম, সেখান থেকে এই বালিকাকে সে নিয়ে আসে, তবে সে বাংলাদেশের নয়, ভারতের – ইন্ডিয়ার – হিন্দুস্থানের! এবং বিনা পাসপোর্টে সে সীমান্ত পার হয়! আমরা এ-বিষয়ে এখনই মনোযোগ দেবো কি আরো পরে – দেখা যাক কথনে আমরা কখন এটি আনবো। আপাতত এ নিয়ে আবুল কাশেমের বাড়িতে দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দিয়েছে। ঈশান কোণে ক্রূর একটি মেঘ আমরা দেখতে পাচ্ছি।

গভীর রাতে তার মনিব কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমানের মোবাইলে আবুল কাশেমকে হাজির করবার হুকুম পেয়ে কেয়ারটেকার সোলেমান এখন রাতের জলেশ্বরীতে খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়ায়। মাথার ওপরে হাজার হাজার নক্ষত্র জ্বলছে, যেন আগুনবাজি হচ্ছে, আর চারদিক কী নিস্তব্ধ কী ঘুমন্ত কী স্তম্ভিত, কান পাতলে শুধু ক্যাপটেনের এ-এ-রে-রে-এ নয়, কানাট্যাংড়ার দোতরার ভৌতিক ডোলোলং ডোলোলং নয়, শীতের দিনে কাঠের আগুনের মতো নক্ষত্রগুলোর ফুটফাট করে ফুটবার শব্দ পর্যন্ত হয়ে চলেছে। সোলেমানের গা শিউরে ওঠে। r (চলবে)