নদী কারো নয়

সৈয়দ শামসুল হক

\ ৪০ \

মুসলমানগণের নাম! এইসব নাম এত অপরিচিত এক হিন্দু দারোগার কাছে, যে-দারোগা তার পুরো চাকরি জীবন পার করেছে মুসলমান অধ্যুষিত এই বাংলায়? মন্মথ দারোগার কাছে এটি অস্বাভাবিক বা বিস্ময়কর মনে না হলেও আমাদের মনে ঐতিহাসিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দেবে। কিন্তু এ সকল এখন নয়, কিংবা এই গল্প কথনে তার ইঙ্গিত দিয়ে রাখাই শুধু, শ্রোতা বরং খানিক থেমে ভাবুন অথবা ইতিহাসের বই ঘাঁটুন। ততক্ষণে আমরা গল্প লয়ে এগিয়ে যাই।

দারোগাবাবুটির সমুখে সিনেমার মতো দ্রুত কিছু দৃশ্য একে অপরের ওপর লেপটে প্রক্ষেপিত হয়ে চলে। কবেকার সেই চোদ্দই আগস্টের সকালবেলা, আধকোশা নদীর পাড়, যুবতী হিন্দু বিধবা মুকুলের মাকে মুসলমান যুবকেরা লুট করে নিয়ে গেছে সংবাদ পেয়ে সে ঘোড়ার পিঠে ছোটাছুটি করছে, আবার এইখানেই তার সাক্ষাৎ হচ্ছে ওয়াহেদ ডাক্তারের সঙ্গে যে কিনা গান্ধী জিন্না দুজনেরই পশ্চাৎদেশে বাঁশ দেবার মতো চিকিৎসা বিধান করছে একদলা থুতু ও অনুচ্চার্য গালি উগরে, আবার চোদ্দই আগস্ট পেরিয়ে মাসাবধি কাল যেতেও পারে নাই, মহকুমা হাকিম নেয়ামতউল্লাহ তাকে ডেকে বলছেন শহরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বুঝি শুরু হয়, ওদিকে বাতাসেও রব উঠেছে যে হরিষালে গিয়ে স্বাধীন রাজ্য ঘোষণা করেছে ওয়াহেদ ডাক্তার এবং কিং ওয়াহেদ নামে বিচার আচার খাজনা তোলা শুরু করে দিয়েছে, একেবারে রাজদ্রোহিতা আর কী! এর মধ্যেই চলচ্চিত্রের মূল ছবির মতো মন্মথ দারোগার চোখের সমুখে নাচ করছে বাবা কুতুবুদ্দিনের মাজারে প্রণত মুকুলের মা! এই ছবিটাই শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়, অন্যান্য ছবির সমপাত ভেঙে স্পষ্ট হয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকে।

এই নারী ব্রাহ্মণের বিধবা, শুদ্ধাচারী, নিষ্ঠাবান – সে কেন এক মুসলমান পীরের মাজারে? তাও ভক্তিভরে প্রণত! মন্মথ দারোগা মেলাতে পারে না হিসাবটি। মাজারের পরিচ্ছন্নকর্মী মঞ্জুর মিয়াকে সে দাঁড় করায়। – মোর দেরি হয়া যায়! হুজুর এলায় আসি পড়িবে, তার আগে ধোয়া পাকলা সমুদয় সারি ফেলা, কন কী কইবেন? বলতে বলতে লোকটি মন্মথ দারোগাকে ঠেলে একেবারে চত্বরের বাইরে এনে ফেলে। চত্বরটি সড়ক থেকে একতলা প্রমাণ নিচু বিধায় এখান থেকে সড়কে ওঠার সিঁড়ি শুরু হয়েছে। সিঁড়ির ওপারে ঘোড়াটিকে দেখা যায় না বটে কিন্তু তার হাঁক শোনা যায়। ঘোড়াটি হাঁক দিয়ে ওঠে। কে জানে অবোলা প্রাণী কী করে জেনে যায় যে তার মনিবটি কাছেই এসে গেছে! মন্মথ দারোগা গলা খাঁকারি দিয়ে ঘোড়াটিকে জানান দেয় যে সে তার সন্ধানী হাঁকটি শুনতে পেয়েছে। মন্মথ প্রশ্ন করবে কি তার আগেই মঞ্জুর মিয়া নিজেই তার কৌতূহলের জবাব দেয় – জানেন তো বাবা কুতুবদ্দি বড় জাগ্রত পীর, তার কাছে হিন্দু মোছলমান ভেদ নাই! হুম জাতীয় শব্দ করে ওঠে মন্মথ দারোগা। মনে মনে বলে, ভেদ নাই মানে? খুব আছে! শালারা গরু খায়! গোমাতা গরুর গলায় ছুরি দিতে তাদের এতটুকু বাধে না! তার এই স্বগতোক্তি আমরা উপেক্ষা করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারি। হা, হায় রে, এই ভেদাভেদটি তবে কার রচনা? এই দীর্ঘশ^াস খোদ ইতিহাসেরই।

মঞ্জুর বলে চলে, আপনে যার তলাশে মাজার পজ্জন্ত আসিছেন সেই বেটিছাওয়া হিন্দু হইলেও মান্নত করিতে কতদিন এই মাজারে আসিছে, ফির মান্নত পুরা হইলেই বাবার দরগায় শিন্নি দিতে আসে। আইজও তাঁই সেই শিন্নি দিবার কারণেই ফজর বেলা হেথা আসিছিলো। যদি পুছ করেন এত ফজরে ক্যান? তবে শুনি রাখেন, টাউনে বহু বদনজরের হিন্দু আছে তারা পাছে কোনো কথা তোলে তাই সে যখন আসে সুজ্জ উঠিবার আগে আসে ঝ্যান কারো দিষ্টিতে না পড়ে। তবে আইজ সুজ্জ উঠি গেইলেও তাঁই যে মাজারে মাথা পাতিয়ায় ছিলো, তা দেখি মুইও আচ্চজ্য হয়া যাই। তাকে পুছ করি। সে তখন কয়, বাবা, মোর ব্যাটা মুকুল, তাকে জানে ধরিয়া একা একায় কুচবিহারে দীনহাটায় পাঠাই। বোঝেন তো দীনহাটা এলা হিন্দুস্থান। দীনহাটায় মামার বাড়ি পৌঁছি মুকুল খবর পাঠাইছে, মাগো, মুই নদী ধরিয়া যাইতে যাইতে শিতাই আসি পড়ি, তার বাদে সেখান হতে এক গাড়োয়ান দয়া করি মোকে দীনহাটা নামেয়া দেয়। দারোগাবাবু, বোঝেন তো, মায়ের পরান, ব্যাটার জইন্যে সুতার উপর ঝুলি থাকে, কখন বা টস্ করি সুতা ছিঁড়ি পড়ি যায়। এলা জান শান্তি হয়া বাবার মাজারে শিন্নি দিতে আসে। বিত্তান্ত এই। এলা তফাত হন। খাকি উর্দি পরি হাঁটুর কাছে কাটা প্যান্ট পরি হান্টার হাতে বাবার মাজারে না অধিক থাকেন।

সিঁড়ি বেয়ে সড়কে উঠে মন্মথ দারোগা ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়। সে সম্পূর্ণ বিস্মরণ হয়ে যায় তার ওপরে দুটি গুরু দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। প্রথমেই – ওয়াহেদ ডাক্তার! হরিষালের দিকে সিপাহিসহ যাত্রা, লোকটিকে গ্রেফতার করা। দ্বিতীয়, শহরে দাঙ্গার সম্ভাবনা নির্মূল করা আর তাই সে মাজারে এসেছিলো। সে এসেছিলো হাকিম নেয়ামতউল্লাহর কাছে সংবাদ শুনে যে শহরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হতে পারে, যদি দাঙ্গারই ব্যাপার তবে তা শুরু করবার আগে মুসলমান যুবকেরা মাজারেই প্রথমে জমায়েত হবে, এখান থেকেই তারা ছুরি তলোয়ার নিয়ে রে-রে-মার-মার করে বের হবে। কিন্তু তার মাথা গুলিয়ে যায় মুকুলের মাকে মাজারে দেখে। নারীটি যে মাজারে মাঝেমধ্যেই আসে, মঞ্জুর মিয়ার কাছে সেটা শুনে তার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। মন্মথের মনে পড়ে, মাত্র কিছুদিন আগেই এই হিন্দু নারীটিকে সে দেখেছে নদীর পাড়ে মুসলমান এক গৃহস্থ বাড়িতে ধনকাটা মুসলমান যুবকদের আসরে বসে থাকতে, তাদের হাত থেকে ডাব নিয়ে খেতে, হাসাহাসি করতে। সেটা ছিলো পাকিস্তান হবার চোদ্দই আগস্ট ভোরবেলা। মাথার ওপরে চড়চড় করে রোদ তখন। চলছিলো রোজার মাস, মুসলমান যুবকেরা রোজা ছিলো কি ছিলো না, মুকুলের মায়ের সঙ্গে তারাও ডাব খাচ্ছিলো কিনা, এখন মনে হয়, না তারা নিজে ডাব খায় নাই। হিন্দু নারীটিও খায় নাই! পরিষ্কার ছবি, নারীটি ডাব হাতে লয়, কিন্তু মন্মথ এখন কল্পনায় দেখে নারী ডাবটিকে ফিরিয়ে দেয়। কেন? তবে নারীও বুঝি রোজা! অসম্ভব কী! যে হিন্দু নারী ব্রাহ্ম নারী ব্রাহ্মণের বিধবা মুসলমান পীরের মাজারে এসে মাথা পেতে পড়ে থাকতে পারে, সে যে গোপন কলমা পড়ে মুসলমান হয় নাই, এ কথা কে বিশ^াস করবে? আর যে কেউ বিশ^াস করুক, মন্মথ দারোগা কখনোই নয়। অবশ্যই মুকুলের মা মুসলমান হয়েছে। শহরে কংগ্রেসের নেতারা যে বলে, সুভাষ বোসের ফরোয়ার্ড ব্লকের তরুণেরা যে মুকুলের মায়ের বাংলাঘর ভাড়া নিয়ে রসের আসর বসিয়েছে, তা যদি সত্যি হয়, বিধবার যদি কামের জোয়ার এতটাই উথলে ওঠে, তবে আর তার পক্ষে কলমা পড়ে মোছলমান হওয়াটা তো দূরের কথা নয়! শালার শালা ধনকাটার দল! শাউয়ায় খন্তার মতো চলে!

এক শহরে বাস ব্যতীত মুকুলের মায়ের সঙ্গে মন্মথ দারোগার কোনো সম্পর্ক নাই। মুকুলের মা তার কেউ নয়। তবু মন্মথের মনে হয় সে নিঃস্ব হয়ে গেছে, তার হাত থেকে এক নারীকে ওরা কেড়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু উপায় নাই। ভীষণ দুর্বল বোধ করে সে নিজেকে। এখন পাকিস্তান। হলেও মাত্র মাসাবধি কাল এ পাকিস্তানের বয়স, এখনই তার বাল গজিয়েছে! মুসলমানেরা চারদিক থেকে সব দখল করে নিচ্ছে। মনিবের মর্জি ঠাহর না পেয়ে ঘোড়াটি মৃদু চালে চলছিলো। হঠাৎ তার পাঁজরে বুটের লাথি পড়ে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে মন্মথ দারোগা। সে ঘোড়া ছোটায় উচ্চবেগে। তার লক্ষ্য এখন নদীর পার নয়, নদীর ওপারে দূর হরিষালও তার গন্তব্য এখন নয়, যে-হরিষালে ওয়াহেদ ডাক্তার নিজ স্বাধীন রাজ্য ঘোষণা করে রাজা সেজে বসে আছে। তাকে দমন করবার, পাকড়াও করে তাকে জলেশ্বরী নিয়ে আসবার হুকুম সত্ত্বেও সে এখন সে-মুখো নয়। এমনকি থানাও তার গন্তব্য নয় এখন। ঘোড়া ছুটিয়ে মন্মথ দারোগা তার কোয়ার্টারে এসে ঢোকে। হাঁক দেয়, উমা! উমা!

আজ সকালে হরেন মাঝি বৃহৎ এক রুই মাছ এনে থানার বড় দারোগার কোয়ার্টারে ভেট দিয়েছিলো। – মা মাগো জননী মাও গো, আইজের সেরা মাছখান তোমার ভোগে দিনু হে। দারোগাবাবুকে তাড়না করি কইবেন, হরেন মাঝির দিকে ঝ্যান দিষ্টি রাখে। না রাখিলে তার সাড়ে সবেবানাশ! মাছ দেখে খুশিতে বাগবাগ হয়ে মন্মথ-পত্নী উমা বলে, কেনেরে বাবা, তোর আবার বিপদ কীসে? – বিপদ কী নয় মা? হরেনমাঝি গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলে, ওসমান মোক্তারের কি নাম শুনিছেন? তার দুই ব্যাটা। আশরাফ আর আফতাব। আশরাফ তো পাটের দালালি করে। আফতাব তাস পিটি বাজারে আড্ডা আর গপসপ করি দিন গুজার করিতো। এইখানে হরেন মাঝি চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিপাত করে, গলা নামায়, তারপর বলে, অ্যালা তো পাকিস্তান হইছে, মুল্লুক অ্যালা মোছলমানের। আর মোছলমান বলিয়াই আফতাব মিয়ার গলা আসমান পজ্জন্ত চড়িছে। তাঁই এবার নদীর উপর থাবা মারিছে। বাপোদাদার আমল হতে যে মাছ ধরিয়া মাছ মারিয়া মাছ বেচেয়া দিন গুজার করিতোম, তার আর আশা নাই। আইজ রাইতে নাকি আফতাব মিয়া হামার জালের ঘেরে লোক পাঠাইবে। কয়, তামাম মাছ আজির দিন হতে তার! তার-এ!

বহু সংসারে স্বামী মশা, বৌ জমাদার! মন্মথের সংসারে এটি অচল। মন্মথই সর্বেসর্বা, তবে এ তথ্য হরেন মাঝির কাছে নাই। তার ধারণা, দারোগাবাবু যত শক্তিমান তার অধিক শক্তিমান তার স্ত্রী উমা ঠাকরুন। মন্মথের আগে জলেশ্বরীতে যে বড় দারোগা ছিলো – নকুলচন্দ্র – সে তো স্ত্রীর ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকতো, তাই গরিবের যত দেনদরবার চলতো তার স্ত্রীর কাছে। নকুলের পরিবারকে একবার ধরতে পারলেই কাজ উদ্ধার। নকুলের আগে যে মুসলমান দারোগা ছিলো – হোসেনউদ্দিন খাঁ – সেও বিবির কাছে শীতল শরবৎ হয়েই থাকতো। অতএব এই ধারায় হরেন মাঝি যে উমা ঠাকরুনের কাছেই বিচার পেশ করবে, আফতাব মিয়ার নদী জবরদখল ঠেকাবার আর্জিতে যে বৃহৎ রুইটি এনে দারোগার পরিবারের পায়েই ফেলবে, এতে আর অবাক হবার কী আছে। ঠাকরুনও এতবড় মাছটি পেয়ে খুশিতে চারগলা হয়ে বলেছিলো, বাবু আসিলেই তোমার কথা কবো। বাবু একটা বিহিত করিবেই।

তারপর মাছটি আর দাসীর হাতে না দিয়ে, বড় বঁটি বের করে, উমা ঠাকরুন নিজেই কুটতে বসেছিলো। কুটছিলো আর মনে মনে ভাবছিলো, মাছের দাগা ভাজা হবে আর মুড়ো দিয়ে ডাল। মন্মথ আবার মুড়িঘণ্টের পাগল। ঘরে সোনা মুগ ছিলো না, সিপাইকে পাঠানো হয়েছে বাজারে মুগডাল কিনতে। কেনা তো কথার কথা। দারোগার বাড়িতে এক সের মুগডাল যাবে, তার দাম নেবে! এমন দোকানি কে আছে যার ঘাড়ে একটার বেশি মাথা! কিন্তু আজ একটা হোঁচট খেতে হয়। সিপাহি রামদাস খালি হাতে ফিরে আসে। বলে, মাঈজি, নেহি দিয়া। – কী নেহি দিয়া? – উয়ো শালা বিনা পয়সা দাল দেনে এনকার কিয়া। শুনে হতভম্ব উমা। এও কি সম্ভব? ডালের দাম চেয়েছে? আচ্ছা, দেখা যাবে। আসুক দারোগা আজ বাড়িতে। তাকে দিয়ে দোকানিকে রামধোলাই দেওয়াবে সে। আপাতত মুগডাল না হলেই নয়। অতএব নাখোশ উমা গজগজ করতে করতে পয়সা বের করে দেয়। পয়সা মানে আস্ত একখানা টাকাই। রাজা ষষ্ঠ জর্জের মুন্ডু অাঁকা টাকা। হায় হায়, ব্রিটিশ রাজা গো, তোমার টাকা এখনো চলে, কিন্তু তোমার সেই দাপট আর চলে না, রাজার মাথাওয়ালা টাকা ভাঙিয়ে দারোগার বাড়িকে বাজার করতে হচ্ছে!

বিষম গজগজ করতে করতে উমা রুই মাছটিকে বঁটিতে ফেলছিলো, মনটা তেতো হয়ে উদ্ভ্রান্ত থাকার কারণেই কিনা কে জানে, ঘ্যাঁস করে হাতটা কেটে গেলো। এমনভাবে কাটলো যে মাছ কোটা পড়ে রইলো, জলপট্টি লাগিয়ে উমা এখন সর্দারি করতে লাগলো দাসীর ওপর। – ও কী করে কাটছো বাছা? ওই তোমার কাটার ধরন? পেটি গাদা চাকা করে কাটতেও শেখোনি? উমা নদীয়ার মেয়ে। স্বামীর চাকুরি সূত্রে দেশে দেশে ঘুরে ভাষাটি বারোয়ারি রকম হয়ে পড়েছিলো তার, কিন্তু শরীর বেজুত হলে, যেমন এখন এই বঁটিতে হাত জখম হবার কালে, আর রাতদুপুরে স্বামী কাছে টানলে তার ভাষাটি নদীয়ায় পায়? কথায় বলে নদীয়ার শান্তিপুর! শান্তিপুরের বুলি আর ধুতি! মিঠে! মিঠে! ফিনফিনে! – ঞ্যাঁগো, তোমরা এ দেশে রুই মাছের মুড়োটা বুঝি কানকো ঘেঁষে কাটো? খবোদ্দার! ঘাড়ের কাছে সোয়া তিন চার আঙুল রেখে তবে বঁটি সই করো!

এমন সময় বাহির বাড়ি থেকে স্বামীর উত্তেজিত স্বর, উমা! উমা! এ ডাক এমন নয় যে ঘেমে নেয়ে কাজ থেকে ফিরেছে – টুল দাও, জল দাও, জুতো মোজা খুলে নাও। এ ডাক যেন তরাসে ডাক! কীসের তরাস? দিব্যি তো কর্তা গেলেন মহকুমা হাকিমের বাংলোয়। সেখান থেকে তো তরাস নিয়ে ফেরার কথা নয়। তবে? ধড়মড় করে উমা উঠে দাঁড়ায়। মন্মথ এসে ভেতরের উঠানে পা রাখে। পাকশালের বারান্দায় দাসী বঁটি ছেড়ে রক্ত হাতেই ঘোমটা টেনে দেয়। পলকের মধ্যে দৃশ্যটা দেখে নিয়ে মন্মথ দারোগা শোবার ঘরের দিকে দপদপ করে পা ফেলে। যেতে যেতে বলে, শুইনা যাও!

নদীয়ার মেয়ে পাবনার স্বামী, স্বামীর মুখের ভাষা চিরকালই তার কানে বেজেছে, আজ কিন্তু ভাষার জন্যে নয় স্বরটির জন্যে তার প্রাণ কেঁপে উঠলো। পাকশাল থেকে উঠান পেরিয়ে শোবার ঘরের দিকে যাবে, এমন সময় ঘরের চালে কাক ডেকে উঠলো কা-কা করে। দূর দূর দূর! যা যা! কাকেরও আজ মতিচ্ছন্ন দশা। একটা বাচ্চা মেয়েও একটুখানি হাত নাড়ালেই কাক যেখানে ধাঁ করে উড়ে যায় শত হাত দূরে, আজ দারোগার স্ত্রীর অমন খেদানিতেও কাকটি সরে না নড়ে না ওড়ে না। চালে বসে ডাকতেই থাকে কা-কা-কা। ঘরের ভেতর থেকে স্বামীর উত্তেজিত গলা ভেসে আসে, কই? কী হইলো? উমা আতান্তরে পড়ে যায়। আগে ঘরে যাবে, না, কাক তাড়াবে। অলুক্ষণে ডাকটাই জয়ী হয়। ঢিল খোঁজার সময় নাই, উমা কাকটির দিকে ঢিল ছোঁড়ার অভিনয় করে। তখন কাকটি কেবল একটু সরে বসে, চালের ওপর তার অবস্থানটি সে ছাড়ে না। হতাশ হয়ে উমা ঘরে ঢোকে।

মন্মথ বলে, আর দেরি কইরে লাভ নাই। গাট্টি বান্ধো। – কী কও? – গাট্টি! গাট্টি! চাট্টিবাট্টি তোলো। এই দ্যাশে আর না। মন্মথ দারোগা ধপাস করে বিছানার ওপর বসে পড়ে। রাতের বাসি বিছানা এখনো গোছানো হয় নাই। তার ওপরেই স্বামীকে বসে পড়তে দেখে উমার মনে অলক্ষণের ভারা পূর্ণ হয়। মাছ কুটতে বসে হাত অতখানি কেটে ফেলা, ঘরের চালে নাছোড় কাকের কা-কা, এখন বাসি বিছানায় স্বামী! উমা প্রায় কেঁদে ফেলে, স্বামীর হাত ধরে বলে, কী হয়েছে গো! – কী আর হবে! শুরু হয়া গেছে! হিন্দুরা দলেদলে মোছলমান হইতাছে। হিন্দু নারীসকল পীরের মাজারে যায়া ধন্না দিতাছে। সুন্দরী যুবতী হিন্দু বিধবারা মোছলমানের জলসায় টপ্পা গাওনর লাগি তৈয়ার! আর কী শুনতে চাও! পাকিস্তান! পাকিস্তান বোঝো! তোমারেও বিবি সাজতে হইবো এই দ্যাশে। আর এক মুহূর্ত না! নদীয়া!

নদীয়া! প্রতিধ্বনি করে ওঠে উমা। তার বাপের দেশ নদীয়া। উমা তার স্বামীকে দেখে এটাই বুঝে এসেছে যে, পাবনার মানুষ এমন জেদি যে শ্বশুর বাড়ি যায় না। তার সেই স্বামীর মুখে শ্বশুরবাড়ির নাম! মন্মথ বলে, নদীয়ায় তোমাকে থুয়ে হিন্দুস্থানের অপশন দিয়া আর যে কয় বছর চাকরি আছে ইন্ডিয়ায় চাকরি করবো। পাকিস্তানে আর না! তারপর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, তবে যাইতে হবে কাউকে কিছু জানান না দিয়া। আইজ রাইতের গাড়িটাই ধরবো। যদি কেউ জিগ্যাস করে বলবো, রংপুরে হাসপাতালে যাই, পরিবারের অসুখ। উমা তখন পট্টি বাঁধা নিজের হাতখানা তুলে ধরে স্বামীর ষড়যন্ত্রে জোগান দিয়ে বলে, বঁটিতে হাত কাটছে, সেপটিক হইতে পারে কইও। উমাও লক্ষ করে না যে সে নদীয়ার নয়, স্বামীর বহু দেশ ঘোরা ভাষাতেই কথা বলছে এখন।  (চলবে)