নদী কারো নয়

সৈয়দ শামসুল হক

 

\ ৪১ \

 

অদূরে ধড়াস ধস্ একটা শব্দ ওঠে, কিসের শব্দ ঠাহর হয় না, ঠাহরের আগেই কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমান চমকে নড়ে ওঠেন, এবং সেটি কুসমি লক্ষ করলো কিনা তাও তিনি ভেবে দেখে ঈষৎ ক্রুদ্ধই হলেন নিজের ওপরে। রাতে এমন শব্দ কত হয়, কত জানা-অজানা পশু শব্দ করে, ডেকে ওঠে, নদীর অতলে মাছ তড়পায়, বাতাস এসে পাড়ে বাঁধা নৌকার গায়ে ধাক্কা দেয়, কি নদীর পাড়েই হঠাৎ ধস নামে আচমকা, এ সবের কী নির্ণয় আছে। আজ সাইদুর রহমান কুসমির ঘরে এসেছেন শেষবারের বোঝাপড়া করতে, বোঝাপড়া কি কুসমিকে আত্মসাৎ করতে, কুসমিকে কি তার ছেলের নামে নদীপাড়ের অঢেল জমিজমাকেই আসলে।

কিন্তু যুবতী বিধবা, তায় সুন্দরী, তায় আবার ঘন রাত, নির্জন বাড়ি, ব্যাপারটা খুব উষ্ণতা ছড়িয়ে রাখে সাইদুর রহমানের শরীরে। রেখে চেখে দেখার একটা মজাও তার মনে ধরে। তিনি রাজ্যের গল্প করতে থাকেন কুসমির সঙ্গে – জলেশ^রীর গল্প, সাতচলিস্নশের গল্প, হিন্দু-মুসলমানের গল্প, জিন্না-গান্ধীর গল্প, এমত কালে রাতের গভীর থেকে শব্দটা সাইদুর রহমান শুনতে পান এবং তিনি চমকে ওঠেন, গল্পে বিরতি দিয়ে সত্মব্ধ হয়ে বসে থাকেন। তারপর সেই ধস শব্দের পর হা হা একটা ধ্বনি ওঠে, হাসিরও নয়, হাহাকারেরও নয়, রক্ত শীতল করা হাহা হাহা নক্ষত্রজ্বলা আকাশের বিপুলতা ছুঁয়ে বহে যায়। নদীর পানি চ্ছলচ্ছল করে ওঠে। প্রথমে শোনা ওই ধড়াস ধস কিংবা নগদ এই হাহা রব যদিবা তিনি শনাক্ত করতে পারেন নাই, নদীর জলের শব্দ তিনি পরিষ্কার ধরতে পারেন। শুধু এইটুকু তাঁকে ভাবিয়ে রাখে যে, নদীই বা কেন জলের ভাষায় কথা কয়ে ওঠে এখন।

নদী! আধকোশা নদী। এই নদী সাতচলিস্নশের চোদ্দই আগস্টের পরে আর তার নয়, পাকিসত্মানের নয়, হিন্দুস্থানের নদী! হা হা করে হাসে ওয়াহেদ ডাক্তার – কিসের পাকিসত্মান আর কিসের হিন্দুস্থান, এ হামার রাজত্ব, মুঁই হেথায় রাজা, মুঁই নিজেকে রাজা ডিক্লেয়ার দিলোম। পাগলা মোখলেছ কাছারির মাঠে জামগাছতলায় বসে ছিলো। ওয়াহেদ ডাক্তার তাকে বলে, এই যে বিটিশ দ্যাশ হতে চলি গেইলো, এই যে হাকিম সায়েবে কইলো আজ ছে আপলোগ আজাদ হ্যয় – কথাটা কী বুঝিলো তুঁই? কিছুক্ষণ থম্ ধরে থেকে মোখলেছ বলে, যা বোঝার তা বুঝিছোঁ। – না, তুই বুঝিস নাই। বুঝিবি দুইদিন বাদে। আমি হরিষাল ফিরি যাই। সেথা হতে আজাদির নয়া ঘোষণা মুঁই দেমো। আমরা কুসমির ঘরে সাইদুর রহমান কন্ট্রাক্টরের মুখে যে এত কিসসা গল্প শুনছিলাম, তার সার কথাও বক্তার মুখে আমরা শুনেছি – বুঝলু রে কুসমি, তোমার তখন তো জন্ময় হয় নাই, সে বড় পাগলা সময় গেইছে! বলিলেও না প্রত্যয় হয়! হবার কথাও নয়। ওয়াহেদ ডাক্তার তো জলেশ্বরী হতে হরিষাল গেইলো ঝ্যান পঙ্খীর পাখায় ভর করিয়া নদী পার হয়া। মনে পড়ি যায়! সে এক সময় গেইছে রে, কুসমি! গল্প করতে করতে চায়ের নেশা লেগেছিলো, চা আনতে কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমানের সমুখ থেকে উঠে যায় কুসমি। – আপনে বইসেন খানিক, চা নিয়া আসি। বিস্কুট কি দেমো? তিনি হাত নেড়ে অস্পষ্ট একটা ভঙ্গি করেন, যার অর্থ দিতেও পারো নাও পারো। কুসমি তাঁর দিকে খানিক নজর ফেলে দেখে নেয়। – আচ্ছা, তুই চা আনিস পরে, আরো কিসসা শুনি রাখ। সাতচলিস্নশের সেই পাগলা টাইমের কথা বলিয়াও শ্যাষ হবার নয়! মনে হয় কন্ট্রাক্টরকে আজ গল্পে পেয়েছে। কিন্তু এত রাত পর্যমত্ম তার ঘরে বসে থাকা আর গল্প করার মতলবটা কুসমি ভালো করে ঠাহর করতে পারে না। আজও কি তার সেই প্রসত্মাব যে, কুসমি রে, আর দোনোমনা না করিস, তুই মোছলমান হয়া যা! নাকি, আবার সেই নিকার প্রসত্মাব? কুসমি এখনো জানে না যে কন্ট্রাক্টর বিবাহ পড়ানোর কাজীকে মোবাইলে এত্তেলা দিয়ে এনে ফেলেছে কিছুক্ষণ আগেই। গভীর রাতে কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমানের ফোন পেয়ে পথে নামে তাঁর কেয়ারটেকার সোলেমান মিয়া। সায়েবে কইলে, বুড়ির চরে কাজী আছে না? – কোন কাজী? – আরে, বিয়া পড়ায় যে কাজী। তার কাছে যা! – কইলোম, রাইত তো অনেক, নিন্দ যায় বুঝি! – নিন্দের গুষ্টি মার। তাকে ধরি আন। – শুনিয়া হতভম্ব হয়া গেইলোম। বিয়ার কাজী এত রাইতে! তাকে ধরিয়া আনা! সায়েবকে পুছ করিলাম, কোনঠে আনিম! সায়েব চড়াও হয়া কইলে, রেললাইনের পাশে মেহেরম্নলস্না জিপ নিয়া আছে, কাজীকে আনিয়া জিপে বসেয়া রাখ। হাফেজ আবুল কাশেম বলরামপুরী নামে এই কাজী সাহেব ছাড়াও বিবাহ সম্পাদনের জন্যে আরো দু’জন কাজী জলেশ^রীতে থাকলেও সবাই চায় একে দিয়েই তাদের ছেলে বা মেয়ের বিবাহটি পড়ানো হবে। বলরামপুরীর এই খ্যাতি বা প্রতিষ্ঠার কারণ তার মোনাজাত বয়ানের প্রতিভাটি। তবে কন্ট্রাক্টরের ক্ষেত্রে মোনাজাতের সুনামের চেয়ে বড় বিবেচনা বলরামপুরী তাঁর বশের মানুষ, কুচবিহার থেকে আসার পর এদেশে তার জায়গাজমি সবই হয় সাইদুর রহমানেরই কৃপায়। তাছাড়া একাত্তরে রাজাকার বলেও যে একটা শোনশোন বদনাম ছিলো বলরামপুরীর, সেটাও মিথ্যা প্রমাণের জন্যে চেষ্টা তদ্বির টাকা খরচ সবই করেছে কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমান, অতএব এ একেবারে তাঁর হাতের মানুষ, লোকটা বলবানও বটে, ঘাড়ে গর্দানে নিরেট পেশিময়, প্রয়োজনে কুসমিকে তার ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাবার জন্যে লোকটা এক ভরসা বৈকি। তবে  আমাদের কাছে বলরামপুরীর এক বিশেষ প্রতিভার কথা এখানেই বলে রাখা যাক – প্রয়োজনে একই হাদিসের ভিন্ন দুই অর্থ সে সমান জোরালো গলায় ভরা মজলিশে উপস্থিত করতে পারে! সংকেত দিয়ে রাখি, বলরামপুরীর এই বিশেষ প্রতিভাটি আমাদের গল্প কথনের কোনো এক পর্যায়ে জরম্নরি হয়ে দেখা দিতে পারে।

কুসমি বোধহয় একটা নড়াচড়া কি মানুষের কণ্ঠস্বর টের পেয়েছিলো কিছু আগে। এটা বোধহয় কন্ট্রাক্টরের কেয়ারটেকার সোলেমান মিয়ার পায়ের শব্দ কি গলা খাঁকারি। বহুদিন থেকে বিধবা, একা থেকে থেকে কুসমির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টি বড় সজাগ – পায়ের শব্দেই সে ঠাহর করতে পারে কে এলো। পায়ের শব্দেরও যে একটা ভাষা আছে কি পাসপোর্টের মতো একটা ছবি আছে, এটা একা যুবতীর চেয়ে আর কে ভালো জানে। তার বুকের ভেতরে ঢেঁকির পাড় পড়তে থাকে। কন্ট্রাক্টর আজ নিজেই খবর দিয়ে এসেছে, এসেছে অধিক রাতে, রাত এখন ঢলতির দিকে, কন্ট্রাক্টরের ওঠার নাম নাই, তার গল্পেরও বিরাম নাই। আজ একটা বিপদই ঘটবে তার। ওদিকে ঘরের ভেতরে অসুস্থ বৃদ্ধ দাদু হরিচরণও খকখক করে যে সন্ধ্যাবধি কেশেই যাচ্ছিলো, আর মুখে অবিরাম অশস্নীল খিসিত্ম করেই যাচ্ছিলো, তার খানিক বারান্দাতে বসা কুসমি আর কন্ট্রাক্টর দুজনেরই কানে যাচ্ছিলো, এখন ওই পায়ের শব্দটির পরে পরেই যেন হরিচরণও নীরব হয়ে গেছে। কুসমি ছনমন করে ওঠে। কন্ট্রাক্টরের দিকে সে সন্ধানী চোখে তাকিয়ে থাকে। কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমানও ফ্যালফেলে চোখ ফেলে নারীটিকে দেখতে থাকে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। দীর্ঘশ্বাসটি উভয় তরফেই, গভীর সত্মব্ধতার ভেতরে শ্বাস ফেলার শব্দটা ঘোর হয়ে উত্থিত হয়। কুসমি অপ্রস্ত্তত হয়। উঠে যায়। সে কন্ট্রাক্টরের নজর থেকে নিষ্ক্রামত্ম হয়ে যায়।

গভীর রাতের একটা শব্দ আছে। খুব ঠাহর করলে শোনা যায়। মনে হয় যেন দূরে অতিদূরে কোন এক গাছী করাত দিয়ে কেটে চলেছে একটা গাছ। তারই সিরসির আওয়াজে চিরে যেতে থাকে রাতের ঘোর সত্মব্ধতা। কানেও বুঝি এ করাত চেরার বিরামহীন শব্দ পশবার নয়, বুকের ভেতরেই তা শ্রোতব্য। কুসমির বুক চিরে যেতে থাকে। কতদিন কত রাতে কন্ট্রাক্টর এসেছে তার ঘরে, আনতাআবড়ি কত গল্প করে গেছে। আজ যেন ভিন্ন মতলব তাঁর। মুখে গল্পেরও শেষ নাই, অচিরে বিদায় নেবারও বিন্দুমাত্র তাড়া নাই। কুসমি রান্নাঘরে যাবার জন্যে উঠেছিলো, কিন্তু অলক্ষেই তার পা ঘরের ভেতরে যায়। ঘরের ভেতরে হরিচরণের সাড়া নাই। অনেকক্ষণ তার সাড়া পায় নাই কুসমি। কিছু আগেও অশ্রাব্য গালাগাল করে উঠেছিলো হরিচরণ। – মাঙের কুটকৃটানি তোর হামার জানা আছে! মুই মরি গেইলে যা করার করিস, মুই বাঁচি থাইকতে নয়! ঘেন্না ধরে যায় কুসমির। আবার মায়াটিও একেবারে বিলীন হয়ে যায় না। তার মায়ের বাবা হরিচরণ, সাক্ষাত নাতনিই তো সে। বুড়ামানুষটা একেবারে অচল হয়া গেইছে সেই কতকাল! হাতে ধরি খাবার না দিলে খাইবার শক্তি নাই!

কুসমি ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়ায়। হরিচরণ নিঃসাড় পড়ে আছে বিছানায়। ভয় হয়। এত নিঝুম হয়ে পড়ে আছে, প্রাণ আছে তো? কুসমি ঝুঁকে পড়ে বুড়ার মুখখানা অন্ধকারে ঠাহর করবার চেষ্টা করে। মুখ ভালো করে দেখা যায় না। অন্ধকার কী কুটিল ও নিরন্ধ্র।

হরিচরণের মুখের ওপর কুসমি হাত পেতে অনুমান করবার চেষ্টা করে শ্বাস বইছে কিনা। না! শ্বাস তো বইছে। হাতটা তখন সরিয়ে নেবে কি নিয়েইছে, খপ করে তার হাত ধরে ফেলে হরিচরণ। চমকে ওঠে কুসমি। হঠাৎ মনে হয়, দাদু নয়, ভূতের হাত, আচমকা খামচে ধরেছে। কুসমি হাতটা ছাড়িয়ে নেয় দ্রম্নত, কিন্তু দাদু আবার খামচে ধরে। খসখসে গলায় চাপাস্বরে বলে ওঠে, ছিরিচরণ! আসিছিস, সোনা! কুসমির বুক থেকে নিঃশ্বাস পড়ে। বুক তার ঝড়ের মুখে গাছের ডালের মতো আছাড়িবিছাড়ি করে ওঠে। তার ছেলে শ্রীচরণের নাম ধরে ডেকে উঠেছে বুড়া। বুকের মধ্যে শ্বাস চেপে কুসমি বলে, কুনঠে তোমার ছিরিচরণ! তাঁই মামার কাছে। ইন্ডিয়ায়! আসিবে কোথা হতে? – তবে যে মুই আওয়াজ পাইলোম! – কী শুনিতে কী! – বারান্দায় তবে ও কাঁই কথা কয়? – কাঁইও নয়। জল দেমো? জল খাও। খায়া নিন্দো যাও। কুসমি জল গড়িয়ে মুখে ধরে। না, জেগে নাই। ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন শাড়ির অাঁচল দিয়ে হরিচরণের মুখখানা মুছে দেয় কুসমি। চোখের সমুখে একের পর এক পুত্রের মৃত্যু দেখেছে হরিচরণ, অমলের মৃত্যু দেখেছে, একটা দেশ ভাগ হতে দেখেছে, জ্ঞাতিগুষ্টি ইন্ডিয়া পালাতে দেখেছে। আর কত শোকতাপ সহ্য করতে পারে একটা শরীর। অমল! অমলের কথা, স্বামীর কথা মনে হতেই কুসমির বুক হা হা করে ওঠে। দ্রম্নত মাথা নাড়ে সে। না! সে ভাঙবে না। কাঁদবে না! চোখের জল ঝরার সময় তার নাই। সে রান্নাঘরে যায়।

যখন চা নিয়ে আসে, দেখে কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমান খলখলে গলায় বলেন, আইসো, বড়ো দেরি করিলে চা বানাইতে। কুসমি বলে, চা খান। রাইত অধিক হয়া গেইছে। – অধিক! সাইদুর রহমান হেসে ওঠেন। বলেন, সেই কথা তো শ্যাষ হয় নাই। – কোন কথা? – ক্যান, সেই পাগলা সময়ের কথা। সেই যে পাটিশান হইলো, পাকিসত্মান হিন্দুস্থান হইলো, তার কথা তো ভোলো নাই। তবে শোনো, মঙ্গলবার হাটের দিন, এলাও মোর মনে আছে। নগদ বিয়া করিছোঁ মুই তখন। পরিবারের প্যাটে বাচ্চাও আসিছে। ভরা মাস। দুই এক সপ্তার ভিত্রেই বাচ্চা হইবে।

হাটে গিয়েছিলেন নবীন যুবক সাইদুর রহমান, উদ্দেশ্য গাভিন একটা ছাগী কিনবেন। সেকালে শিশুর জন্যে মায়ের দুধ ছাড়া আর কিছু নাই। এখনকার মতো বিলাতি দুধের টিন বাজারে অঢেল নাই কি একেবারেই নাই। মায়ের বুকের দুধ আর সময়ে শটির গুঁড়ো পানিতে গুলিয়ে খাওয়ানো। সাইদুর রহমানের ইচ্ছা নয় গরিব মানুষের মতো শটি খাওয়ানো। তার প্রথম বাচ্চা হতে যাচ্ছে, তারই জন্যে গাভিন ছাগীর খোঁজ। মায়ের বুকের দুধ তো আছেই, ছাগীর দুধ অবসরে অবসরে দেয়া যাবে। সেই ছাগীর খোঁজে হাটে যান সাইদুর রহমান। ছাগলের হাট বসে হাটের একপ্রামেত্ম, বাবা কুতুবুদ্দিনের মাজারের সিঁড়ির পাশে। ছাগীর খোঁজ করবেন কি, হঠাৎ এক আজান পড়ে মসজিদে। এশা নামাজের সময় তখনো হয় নাই, এর মধ্যে আজান! কিসের আজান? হাটের মানুষ চঞ্চল হয়ে পড়ে। ঝড়ের সময় আজান দেয়া হয়, অসময়ের আজান – আলস্না হে, ঝড় থামান! তারই কারণে আকুল আজান। কিন্তু কোনো ঝড় তো নাই। জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি। ঝড়ের সময়। কিন্তু গত কয়েকদিন থেকে আকাশে মেঘের চিহ্নমাত্র নাই। তবে অসময়ে আজান কেন? তবে কি ভূমিকম্প? পায়ের নিচে মাটি দুলে উঠলে এমন আজান দেয়া হয় বটে, কিন্তু পায়ের নিচে মাটি তো মাটির মতোই নিষ্কম্প নির্বিকার। তবে?

বাবা কুতুবুদ্দিন মাজারের খাদেম সাহেবকে দেখা যায় সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়াতে। দেখা যায় কি, তাঁর বুলন্দ গলার আওয়াজ পেয়েই হাটের মানুষ ফিরে তাকায়। দেখে, সিঁড়ির মাথায় খাদেম সাহেব দাঁড়িয়ে দু’হাত গোল করে মুখের কাছে ধরে উচ্চস্বরে বলছেন, পাকিসত্মান! পাকিসত্মান! মুহূর্তের মধ্যে হাটের কলরব সত্মব্ধ হয়ে যায়। খাদেম সাহেব বলতে থাকেন, এই মাত্তর খবর হয়, ইংরাজ ঘোষণা দিছে, পাকিসত্মান হইবে! হামার নজির মিঞাকে ডাকি হাকিম সাহেব জানাইছে, পাকিসত্মান মানি নিছে ইংরাজ! আলস্নার দরবারে শুকরানা নমাজ হইবে বাদ এশা। শুকরানা নমাজ! বাদ এশা! পাকিসত্মান! পাকিসত্মান!

কুসমিকে কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমান বলে চলেন, গেইলো হামার ছাগী কেনা! হাটের মানুষ চঞ্চল হয়া পড়িলো। পাকিসত্মানের দাবি ইংরাজ মানি নিছে, ইয়ার পরে ফুর্তি আর দ্যাখে কাঁই। যুবকেরা টিনের চোঙা ধরি ফুকাইতে লাগিলো। হিন্দুর সমাজে চিমত্মা বাধি গেইলো। যাওবা আশা ছিলো জিন্নার কথা ইংরাজ না মানিবে, তামাম মুলুকে হিন্দুস্থান হইবে – ভাসি গেইলো! মুঁইও খুশির খবরটা বাপজানকে দিবার জইন্যে ছুটি আসিলোম বাড়িতে। আসিয়াই তো মাথায় হাত! পরিবারের গব্ভোপাত হয়া গেইছে। সেই যে বাচ্চার জইন্যে আগাম ছাগী খরিদ করিতে যাই – শ্যাষ! প্যাটের বাচ্চা পড়ি গেইছে। ব্যাটা হবার কথা ছিলো। চিন্নও ছিলো ব্যাটার। নাশ হয়া গেইলো। তাকে নিয়াই বাড়ির মানুষ সোরগোল করিতে লাগিলো। বাপজানকে আর পাকিসত্মানের সম্বাদ দেওয়া হইলো না। তার বাদে পাকিসত্মানও সময় কালে দুই মাসের মাথায় হয়া গেইলো। কাছারির মাঠে হাকিম সাহেব পাকিসত্মানের নিশান উঠাইলো। হিন্দু ঘরের আশা ছিলো জলেশ্বরী পড়িবে হিন্দুস্থানের ভাগে, পড়িলো পাকিসত্মানে। পড়িলো তো পড়িলো, আধখাবলা হয়া পড়িলো। জলেশ্বরী পাকিসত্মানে, আর জলেশ্বরীর নদী আধকোশা পড়িলো হিন্দুস্থানে ইন্ডিয়ায়। বোঝেন তবে? বোঝেন! টাউন পাকিসত্মানে, টাউনের নদীখান গেইলো হিন্দুস্থানে! আর সেই নদীর পাড়ে সত্মব্ধ মারি খাড়া হয়া রইলেন মইনুল হোসেন মোক্তার। তার চোখের না পলক পড়ে! এই নদী তবে আর হামার নয়! হিন্দুস্থানের!

মুকুলের মা, টাউনের আরেক সুন্দরী যুবতী বিধবা, ছেলেকে এই আধকোশা নদী পার করে হিন্দুস্থানের পথে তুলে দিতে এসেছিলো, আমরা নদীপাড়ের সে দৃশ্যে দেখেছি পাকিসত্মানের ভয়ে ভীত নারীটিকে। – যা বাপ, নদী পার হয়া ওপারে যা। একখান খেওয়া নাও ধরি ওপারে যায়া বসি থাক। আমি পাছে পাছে আইসোঁ। –  একোসাথে যাই না কেনে, মা? – না, বাপ, একোসাথে গেইলে সবার নজরে পড়িবে। তুই আগোতে যা। – তুমি? – মুঁই পাছে পাছে।  – জিনিশপত্তর? বালক হলে কী হয়, মুকুলের বিষয়জ্ঞান টনটনে। অবোধ বয়সেই যে ছেলে পিতৃহারা হয়, বিষয়জ্ঞান তার আপনা থেকেই আসে। মা বলে, বিষয়ের কীবা আছে! আইজ হউক কাইল হউক বাড়ি যাইবে মোছলমানের ভোগে! বাড়ি তো আর বগলে করি নিয়া যাবার নয়! – বাসনকোসন! – বাসনকোসন প্রাণে বাঁচিলে আবার হইবে। তবু মাটির ওপর পা অাঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকে মুকুল। তখন গালে একটা চড় বসিয়ে দেয় মা। – অলক্ষ্মীর ঝাড়! মোছলমানের হাতে বিনাশ হবার ঝইন্যে তাল তুলিছিস!

নদীর কিনারে মুকুল। পেছনে জলেশ্বরী শহর। এই নদী আধকোশা! এ নদী এখন হিন্দুস্থানে। জলেশ্বরীর পাকিসত্মানের মাটি থেকে পা তুলে নদীর জলে নামে মুকুল। হাঁটু পর্যমত্ম নামে। তার হাফপ্যান্ট ভিজে যায়, কিন্তু লক্ষ নাই। তার কাছে মনে হয় নদীর জল কী শীতল! কত শীতল! কত আপন! মায়ের হাতের সেই চড়  – চড়ের তোড়ে তার গাল এখনো রাঙা, এখনো জ্বলুনি তার যায় নাই। বাড়ি ছেড়ে আসবার কালে আর কিছু নয়, তার বইখাতা নিয়ে এসেছিলো; বইগুলো পাড়ে নামিয়ে মুকুল দুই হাতে নদীর জল তোলে, অাঁজলা ভরে তোলে আর গালের ওপর ঝাপটে ঝাপটে মারে। আহ, শীতল! শীতল হয় চড়ের জ্বলুনি, মুকুল শীতল হতে থাকে। নদীর জলে হাঁটু ডুবিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে, অাঁজলায় জল তুলছে আর গাল ভেজাচ্ছে। আহ্, এই না হলে হিন্দুস্থানের নদী, হিন্দুস্থানের জল! শীতল! কী শীতল!

আর সেই হিন্দুস্থানে যাবার জন্যে এখন আমরা মন্মথ দারোগাকেও দেখি। সদ্য জন্ম নেয়া পাকিসত্মানের ভাগে পড়া এই জলেশ^রীতে এখন ধুন্ধুমার ব্যাপার। শহরে হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা লাগার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মহকুমা হাকিম নেয়ামতউলস্নাহ এখনো জানেন না যে, এই রটনার পেছনে আছে মুসলিম লীগের নেতারা। তারা চায় পাকিসত্মান মানে পবিত্র স্থান, অতএব একে পবিত্র রাখা, অন্যকথায় এ দেশ হিন্দুমুক্ত করাটা এখন তাদের পবিত্র দায়িত্ব। তবে খুনোখুনিটা এ অঞ্চলের ইতিহাসে নাই। ভাওয়াইয়া গানের প্রভাবেই কিনা কে জানে, মানুষের মন বড় নরম হেথায়! অতএব কাজ হাসিলের জন্যে লীগের পান্ডারা যে হিন্দুদের মনে সম্পত্তি নাশ আর নারীনষ্টের ভয় ছড়াচ্ছে, হাকিম নেয়ামতউলস্নাহ এতটা তলিয়ে এখনো দেখেন নাই। তাঁর নিজেরই এক গোপন দুশ্চিমত্মা থাকায় বোধ ও বিচারশক্তি এখন কিছুটা ঝাপসা। তাঁর দুশ্চিমত্মাটির কথা আমরা আগেই বলে নিয়েছিলাম  – নেয়ামতউলস্নাহ কাদিয়ানি মুসলমান, এরা আসলেই মুসলমান কিনা এ নিয়ে বিতর্ক আছে, মারদাঙ্গাও হয়ে গেছে। নেয়ামতউলস্নাহ ভাবছিলেন, তিনি হিন্দুস্থানেই চাকরির অপশন দিয়ে পাকিসত্মান ছেড়ে যাবেন কিনা। হিন্দুস্থানে তাঁর বড় আকর্ষণ মওলানা আবুল কালাম আজাদ। কলকাতায় গড়ের মাঠে তাঁর পেছনে তিন তিনবার ঈদের নামাজ পড়েছেন নেয়ামতউলস্নাহ। আর মওলানা আজাদের কী নূরানী চেহারা আর দাড়ির ছাঁট কী অপূর্ব সুন্দর। আমরা ছবি অাঁকতে পারি না, চোখেই আমরা দেখেছি হাকিম নেয়ামতউলস্নাহর দাড়িটি অবিকল মওলানা আজাদের মতো।

আমরা নেয়ামতউলস্নাকে শেষ পর্যমত্ম পাকিসত্মানেই থেকে যেতে দেখবো। জলেশ^রী থেকে তিনি বদলি হয়ে যাবেন প্রমোশন পেয়ে, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট পদে তিনি কিছুকাল বরিশাল শাসন করবেন। এই বরিশালেই এক সময় এক ইংরেজ, বৃটিশ রাজত্বকালের অমিত্মমকালের আই সি এস তরম্নণ এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা, মিস্টার ডেভিড পাওয়ার আসবেন ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে। এই পাওয়ার সাহেব অচিরেই মুসলমান হবেন এবং নাম নেবেন ডেভিড খালেদ পাওয়ার, বাঙালি এক মুসলিম রমণীকেও তিনি বিবাহ করবেন, এবং এই পাওয়ার দম্পতির সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে নেয়ামতউলস্নাহর। মওলানা মওদুদীর উসকানিতে পশ্চিম পাকিসত্মানে কাদিয়ানি নিধন যজ্ঞ শুরম্ন হলে, ভীত হয়ে পড়েন নেয়ামতউলস্নাহ এবং ডেভিড খালেদ পাওয়ারের পরামর্শে ও সহায়তায় তিনি ইংল্যান্ডে চলে যান স্থায়ীভাবে। কাদিয়ানি হয়ে হিন্দুর মতোই পাকিসত্মানে তিনি যে নির্বিঘ্ন নিরাপদ বোধ করেন নাই, এটাই জেনে রাখার বিষয়। ধূর্ত ধড়িবাজ বলেই যে তাদের সব কথাই মতলবি তা নয়। কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমানেরও এ কথাটি ফেলবার মতো নয় যে, বুঝলু রে কুসমি, তোমার তখন জন্ময় হয় নাই, সাতচলিস্নশে সে বড় পাগলা সময় গেইছে! বলিলেও না প্রত্যয় হয়! হবার কথাও নয়। r (চলবে)