নদী কারো নয়

সৈয়দ শামসুল হক

\ ২৮ \

 

নদী কেঁদে চলেছে, একটানা তার সিঁ সিঁ কান্নার শব্দ মকবুল হোসেনকে বধির করে দিতে থাকে। সে নির্ণয় করতে চেষ্টা করে, কেন নদী কাঁদছে। তার মনে হয় তার বাবা মইনুল হোসেন মোক্তারের জন্যে কাঁদছে। আধকোশার পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় তাঁর। কেন তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আধকোশার উন্মত্ত খলখল পানিতে? এই আধকোশা! রাতের অন্ধকারে স্থিরদৃষ্টিতে মকবুল তাকিয়ে থাকে আধকোশার দিকে। রাত অন্ধকার। অন্ধকারেরও একটি দীপ্তি আছে। নদীর বুকে ছোট ছোট তরঙ্গ, তরঙ্গের মাথায় কুয়াশার মতো আলো।

এই আধকোশা! একদিন অবিভক্ত ভারতে বঙ্গপ্রদেশের একটি নদী, ভারতভাগের সঙ্গে সঙ্গে নদী চলে যায় ভারতের ভাগে, তারপর মাত্রই তিনদিন পরে আবার ঘোষণা হয় আধকোশার স্থান পাকিস্তানে! এই যে নদী আবার ফিরে আসে, একই নদী কি ফিরে আসে? প্রিয়লি তার মেয়েটি যে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, সে যখন ফিরে আসবে আবার তার বাবার বাড়িতে – সেই এক মেয়েটিই কি ফিরবে?

নদী কাঁদে। মইনুল হোসেনের জন্যে কাঁদে। বাংলা ভাগ হয়ে যাওয়ার জন্যে কাঁদে। ভারত থেকে জলধারা নিয়ে নদী একদিন পাকিস্তান দিয়ে বয়ে যেতো, আজ বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সে বহে যায় – যাচ্ছে, এই অবাক করা ব্যাপারটি মকবুলকে বিভ্রান্ত করে রাখে। নদী যদি বিনা পাসপোর্ট ভিসায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে তার জলধারা নিয়ে স্বচ্ছন্দে চলে আসতে পারে, মানুষ কেন পারে না? নদী কাঁদে। নদী কেঁদেই চলে। রাতের গভীর মথিত হতে থাকে আধকোশার কান্নায়। মকবুলের মনে পড়ে বাংলা তো অখন্ড থাকবার কথা ছিলো। সাতচলি�শ সালে ভারত ভাগের ঠিক আগের মাসগুলোতে সেই অখন্ড বাংলার স্বপ্ন দেখে উঠেছিলেন কয়েকজন – সুভাষচন্দ্র বসুর বড়ভাই শরৎচন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আর আবুল হাশিম – বাংলা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অসামান্য ইতিহাস গ্রন্থের মেধাবী লেখক, মকবুল তাঁকে চেনে ও দু-একবার আলাপও হয়েছে, সেই বদরুদ্দিন ওমরের বাবা আবুল হাশিম। বাবা! মকবুল হোসেন কী করে ভুলবে তার বাবা মইনুল হোসেন মোক্তারের কথা! তিনিও তো এক বাংলার কথাই ভেবেছিলেন। না, সচেতনভাবে তিনি ভাবেন নাই, তাঁর দুঃস্বপ্নেও আসে নাই যে বাংলা কোনোদিন ভাগ হতে পারে। তিনি ভাবেন নাই যে-নদীর উন্মত্ত জল শাসনের জন্যে বাঁধ দেবার  প্রস্তাব নিয়ে ইংরেজ ছোটলাট পর্যন্ত দরবার করেছেন, নিজের মোক্তারি ছেড়ে সর্বস্ব তিনি বাজি রেখেছেন নদীটির জন্যে আর নদীর পাড়ে এই জলেশ্বরী শহরটিকে ভাঙন থেকে রক্ষার জন্যে, তাঁর সেই উদ্যম একদিন র‌্যাডক্লিফ সাহেবের লাল পেন্সিলের দাগে রক্তাক্ত হয়ে পড়বে।

নদী কাঁদে। নদী কেঁদেই চলে। মকবুলের মনে পড়ে আবুল হাশিমের লেখা আত্মস্মৃতি বইটি। দেশভাগের প্রস্ত্ততি চলছে জ্বরের ঘোরলাগা তাপ নিয়ে, সাতচলি�শের দশই এপ্রিল দিলি�তে জিন্নাহর ডাকা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের সভায় আবুল হাশিম বলছেন, ‘গান্ধী ঘোষণা করেছেন পন্ডিত জওহরলাল নেহরু হবেন তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী। গান্ধী একজন ঋষি। আমরা ভেবে পাই না, একজন ঋষির উত্তরাধিকারী কী করে কাশ্মিরের এক উদ্ধত পন্ডিত হতে পারে! নেহরু তো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকারী হতে চান।’ মকবুল হোসেন তার ইতিহাস পড়া থেকে এই সিদ্ধান্তই করে ওঠে যে, নেহরুর জন্যেই – নেহরুর ক্ষমতায় যাবার ওই নষ্ট উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্যেই হিন্দুস্তান পাকিস্তান হয়, অখন্ড বাংলা যে তৃতীয় একটি রাষ্ট্র হতে পারে তা বানচাল হয়ে যায়।

অখন্ড বাংলার স্বপ্ন নিয়ে দিলি�র ওই সভায় জিন্নাহকে আবুল হাশিম মনে করিয়ে দেন, মুসলিম লীগ যে পাকিস্তানের দাবি তুলেছিলো উনিশশো চলি�শ সালে – ‘সেই প্রস্তাব আদতে এক পাকিস্তানের কথা চিন্তা করে নাই। চিন্তা করেছিলো ভারতীয় মুসলমানদের জন্যে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের কথা।’ আমাদের মনে পড়বে ওই লাহোর প্রস্তাবে রাষ্ট্র বা ইংরেজিতে স্টেট শব্দটি বহুবচনে স্টেটস রূপে উলে�খ করা হয়েছিলো, পাশও করা হয়েছিলো। জিন্নাহ তখন সেই সভায় আবুল হাশিমকে বলেন, ‘একটা এস-এর ওপর জোর দিচ্ছেন কেন? ওটা স্পষ্টতই ছিলো ছাপার ভুল। স্টেটস নয় – হবে স্টেট, এক রাষ্ট্র! এক পাকিস্তান!’

আবুল হাশিম লিখছেন, ‘আমি তখন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানকে দলিল হাজির করতে বললাম। লিয়াকত সাহেব লাহোর প্রস্তাবের দলিলটি হাজির করলেন। তখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজচোখেই দেখতে পেলেন তাঁরই সই করা দলিলে স্পষ্টই লেখা রয়েছে – স্টেটস! অর্থাৎ একাধিক রাষ্ট্র! নওয়াবজাদা লিয়াকত বললেন, কায়েদে আজম! আমাদের পরাজয় হয়েছে!’ আমরা কল্পনা করতে পারি জিন্নাহর মুখখানা। নিশ্চয়ই জীবনে এই প্রথম তিনি অপ্রস্ত্তত হয়ে গিয়েছিলেন। আমরা এতদূর পর্যন্ত অনায়াসেই ভেবে নিতে পারি যে, কী অসীম ধূর্ততায় তিনি নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন, মনের আসল কথাটি গোপন রেখে কীভাবে তরী সামাল দিয়েছিলেন মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে। আমরা কান পেতে শুনি দিলি�র সেই সভায় জিন্নাহ তখন যে-কথাটি আবুল হাশিমকে বলেন – ‘আমি এক পাকিস্তান চাই না। আমি চাই ভারতীয় মুসলমানদের জন্যে একটি বিধানসভা।’ জিন্নাহ আবুল হাশিমকে অনুরোধ করেন, ‘আপনি প্রস্তাবটিকে এমনভাবে সংশোধন করতে পারেন কি যাতে লাহোর প্রস্তাবের অবমাননা না হয়, আবার আমার উদ্দেশ্যটি সাধিত হয়!’ আবুল হাশিম তখন বলেন, তাহলে এমনভাবে প্রস্তাবের সংশোধন করা হোক যাতে এমনটা হয় যে, ‘উত্তরপশ্চিম ভারতে একটি পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং বাংলা ও আসামকে নিয়ে উত্তরপূর্ব ভারতে একটি পাকিস্তান রাষ্ট্র।’ আবুল হাশিম স্পষ্ট করেই তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন যে, ‘জিন্নাহ এতে রাজী হন!’

অর্থাৎ বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। ইংরেজ যদি ভারত ভাগ করেই চলে যেতে চায়, তবে ভারতবর্ষে তিনটি রাষ্ট্র জন্ম নেবে – পাকিস্তান, হিন্দুস্তান ও বাংলা-আসাম – না, এই  বাংলা-আসামকে তখন আর দ্বিতীয় পাকিস্তান বলা যাবে না কারণ এই রাষ্ট্রে তখন মুসলিম ও হিন্দুর জনসংখ্যা হবে প্রায় সমান-সমান। উনিশশো ছেচলি�শ সালের অক্টোবরেই শরৎচন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে আবুল হাশিমের আলোচনা হয় বাংলা-আসাম রাষ্ট্র নিয়ে, তখনকার কমিউনিস্ট মুখপত্র এই আলোচনার বিষয়ে খবর লেখে – যে-বৃহত্তর বাংলা সৃষ্টির কথা চিন্তা করা হচ্ছে সেখানে মুসলমানেরা হবে সংখ্যালঘু! এটি ছিলো সত্যের বিকৃতি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখি, দিলি� থেকে ফিরে এসে আটাশে এপ্রিল আবুল হাশিমের দেয়া এই অসামান্য বিবৃতিটি।

‘সত্য কথা বলার সময় এসেছে। সুবিধাবাদী নেতৃত্ব ও ঠুনকো জনপ্রিয়তার জন্যে হীন চিন্তাধারার কাছে আত্মসমর্পণ বেশ্যাবৃত্তি মাত্র। ১৯০৫ সালেও বাংলা ভারতের চিন্তানায়ক ছিলো এবং সাফল্যের সঙ্গে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের শক্তির মোকাবিলা করেছিলো। এটা খুবই পরিতাপের বিষয় যে বাংলা আজ বৃদ্ধিবৃত্তিতে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে এবং বিদেশী নেতাদের কাছে চিন্তা ও নির্দেশের জন্যে অনুনয় ভিক্ষা করছে।’ মকবুল হোসেন স্পষ্টই অনুভব করে ওঠে যে, বিদেশি নেতা বলতে আবুল হাশিম কেবল ইংরেজকেই বোঝাচ্ছেন না, তিনি নেহরু ও জিন্নাহর প্রতিও ইঙ্গিত করছেন। এটি স্পষ্ট, আরো স্পষ্ট হয় বিবৃতিটির পরের বাক্যেই – ‘আমি ভেবে আশ্চর্য হই, বাংলার হিন্দুদের কী হলো যাঁরা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আশুতোষ মুখার্জি, চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ ব্যক্তির জন্ম দিয়েছিলো!… হীনমন্যতাকে ঝেড়ে ফেলে বাংলার উচিত তার অতীতের ঐতিহ্যে ফিরে গিয়ে প্রতিভার শীর্ষে পুনরায় আরোহণ করা ও নিয়তি গঠন করা।’

আবুল হাশিম স্মরণ করিয়ে দেন – বাংলার হিন্দু এবং মুসলমান উভয়কেই – ‘বাংলা ও বাঙালি বর্তমানে এমন এক চৌমাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে যার একদিকের পথে রয়েছে যশ ও মুক্তি, আরেকদিকে রয়েছে চিরকালের দাসত্ব এবং অশেষ অবমাননা। এই মুহূর্তে বাংলাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মানবজীবনে বিশেষ এক সময় আসে যখন তার প্রকৃত সদ্ব্যবহারে সৌভাগ্য সূচিত হয়। সুযোগ একবার বিনষ্ট করলে পুনরায় তা ফিরে নাও আসতে পারে।’ আবুল হাশিম আকুল আহবান জানান, ‘বাংলার যুবক হিন্দু ও মুসলমানদের উচিত একতা বজায় রেখে নিজেদের দেশকে বৈদেশিক প্রভাবের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে বাংলার বিলুপ্ত মর্যাদা পুনরুদ্ধার করা এবং ভারতের ও পৃথিবীর ভবিষ্যৎ জাতিসমূহের কাছে সম্মানের আসনলাভের চেষ্টা করা।… ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলার হিন্দু ও মুসলমানেরা তাদের নিজ নিজ অস্তিত্ব বজায় রেখে… অপূর্ব এক সাধারণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিলো।’

মকবুল হোসেনকে আমরা মনে করতেই পারি তিনি তরল সরল জনপ্রিয় উপন্যাসের লেখক মাত্র, কিন্তু এই বইগুলো যে তার বিপুল অর্থ উপার্জনেরই একটি সূত্র, এর অধিক কিছু নয়, এটি যেন আমরা ভুলে না যাই। মকবুল ভাবে, দেশ নিয়ে ভাবে, দেশের ইতিহাস নিয়ে ভাবে, এবং একদিন এ-সকল সে একটি বিপুল উপন্যাসে রচনা করবে, এমন আশাও করে থাকে। আমাদের প্রার্থনা কেবল এই হতে পারে যে, ততদিন পর্যন্ত সে যেন বেঁচে থাকে এবং তার কলমটি তরল লিখন থেকে ফিরে এসে গুরুতর রচনায় নিবিষ্ট হতে পারে। মকবুল আবুল হাশিমের ওই আত্মস্মৃতি বইটি থেকে, ওপরে উদ্ধৃত ওই অংশটি পড়ে উঠে দেখতে পায় বাঙালির ওই সাধারণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কারণেই একদিন এই দেশ মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এবং খন্ডিত বাঙালির হলেও শেষ পর্যন্ত এক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দেয়।

কিন্তু সাতচলি�শের আটাশে এপ্রিলে আবুল হাশিমেরা তো স্বপ্ন দেখছিলেন অখন্ড বাংলার। ইংরেজ চলে যাবার পর বিভক্ত ভারতে হিন্দুস্তান পাকিস্তান অতিরেকে বাংলা নামে বাঙালির তৃতীয় একটি রাষ্ট্রের কল্পনায় উচ্চকিত হয়ে আবুল হাশিম বলেছিলেন, ‘স্বাধীন এ বাংলায় মুসলমানেরা তাদের শরিয়ত এবং হিন্দুরা তাদের শাস্ত্র অনুযায়ী আপন সমাজ পরিচালনা করা ছাড়া হিন্দু ও মুসলমানের জন্যে বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা সংরক্ষিত থাকবে না। এটা মুসলমানদের আত্মিক প্রয়োজন মেটাবে এবং হিন্দুদের দেবে স্বাধীন বিকাশ সাধনের… প্রকৃত এক আবাসভূমি।’ মকবুল লক্ষ না করে পারে না যে, বর্তমানের রাষ্ট্র-কাঠামোয় ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি আজ ক্রমেই কতটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, এবং এ-বিষয়েও আবুল হাশিম তাঁর স্মৃতিকথায় আর কয়েক বাক্য পরেই ঋষিতুল্য সাবধানবাণী উচ্চারণ করবেন।

সাতচলি�শে দেশবিভাগের মাত্রই সাড়ে তিন মাস আগে আবুল হাশিম তাঁদের স্বপ্নের অখন্ড বাংলা, উপমহাদেশের তৃতীয় রাষ্ট্র বাংলার রূপরেখা দিচ্ছেন – এবং ভীতিগুলোকে চিহ্নিত করে আশ্বস্ত করছেন এই বলে, ‘স্বাধীন বাংলায় হিন্দু অধিবাসীরা হবে সংখ্যায় প্রায় অর্ধেক, অতএব তারা শাসন পরিচালনায় ও অন্যান্য পার্থিব সম্পদ ভোগের ক্ষেত্রে বৈধ অংশ থেকে বঞ্চিত হবে, এটা অচিন্তনীয়। বাংলার হিন্দু মুসলিম জনসংখ্যার একটা ভারসাম্য রয়েছে, ফলে কোনো সম্প্রদায়ই একে অপরের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ নয় ও হবে না। বাংলাকে যদি তার দেশের সন্তানদের জন্যে সকল সম্পদের ওপর অধিকার দেয়া হয় তবে হিন্দু মুসলমান উভয়েই অনাগত বহু শতাব্দী ধরে সুখী ও সমৃদ্ধ হবে।’ আর তাঁর সেই সাবধানবাণী – ভবিষ্যতের খন্ডিত ভারতভুক্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিষয়ে – ‘কিন্তু বিভক্ত বাংলায় পশ্চিম ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা পশ্চিমবঙ্গ একটি অবহেলিত প্রদেশ, সম্ভবত একটি কলোনিতে পরিণত হবে… বাংলার হিন্দুরা দিনমজুরের পর্যায়ে পরিণত হবে!’ সবশেষে আবুল হাশিম কাতরকণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘চিত্তরঞ্জন দাশ আজ জীবিত নেই। বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গঠনের জন্যে তাঁর বিদেহী আত্মা আমাদের পথ দেখাক। বৃটিশ শাসনের অবসানকালে বাংলার হিন্দু মুসলমান রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা আধাআধি মেনে নেয়ার ব্যাপারে একমত হয়ে উঠুক। আমি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাংলার যুবকেরা প্রতিক্রিয়াশীল বিখন্ডনের চিন্তা মুছে ফেলে বাংলাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসুক।’

মকবুল এ-ইতিহাস বারবার পাঠ করেছে তার কল্পিত সেই বিপুল উপন্যাস রচনার মালমশলা সংগ্রহ করবার জন্যে। যতই সে পড়ে ততই সে লক্ষ করে, আবুল হাশিম ক্রমেই তার সেই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হয়ে উঠতে চাইছেন। এমনকি আবুল হাশিম যে শেষ বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অন্ধ হয়ে যান, এটিও মকবুলের কাছে বিশাল একটি প্রতীক হয়ে জেগে ওঠে। অন্ধ! অন্ধত্বই তবে! গ্রিক পুরাণের রাজা ইদিপাসের মতো নিয়তির বিকট ও নির্মম খেলা দেখে নিজের হাতে নিজের দুচোখ উপড়ে ফেলেন নাই আবুল হাশিম – সত্য – কিন্তু ইতিহাসই তাঁর দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেয়, এ-কথা যখনই মকবুলের মনে পড়ে, সে আত্মার ভেতরে কান্নার ধ্বনি শুনে ওঠে।

নদী কাঁদে। এখন মধ্যরাত। আধকোশা নদীর দিকে মকবুল হোসেন স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। না, সে অন্ধ হয়ে যায় নাই বটে, কিন্তু যখনই তার মনে পড়ে যে তার বাবা মইনুল হোসেন মোক্তার দেশভাগের পর মস্তিষ্কের সুস্থতা হারিয়ে ফেলেন এবং তাঁর জন্মশহরের নদীটির একদিন ভাগ হয়ে যাওয়া ও র‌্যাডক্লিফের পেন্সিলের ভুল শুধরে আবার এ-দেশে ফিরে আসার পর আধকোশাকে তিনি মৃত্যুর উপায় বলে মনে করেন ও তারই পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যান, অপঘাত কি আত্মহত্যাই – আজো তার নির্ণয় নাই, মকবুল কাঁদে। মকবুল কাঁদে ও আধকোশা নদীটি কাঁদে। আজ রাতে নদীর কান্নার শব্দ তাকে বধির করে দিয়ে যেতে থাকে।

সাতচলি�শের দশই মে আবুল হাশিম বাংলার জন্যে কেঁদে ওঠেন, গান্ধী এসেছিলেন কলকাতায়, শরৎচন্দ্র বসুকে নিয়ে তিনি গান্ধীর কাছে যান, বাংলাকে অখন্ডিত রাখা যায় কিনা তার শেষ চেষ্টা তিনি করেন। তিনি যখন বলেন পাকিস্তান হলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে বারোশো মাইলের দূরত্ব দেখা দেবে, তার ফলে কি সমস্যা দেখা দেবে না? গান্ধীর প্রতি আমাদের সর্বশ্রদ্ধা সত্ত্বেও আমরা স্তম্ভিত হয়ে যাবো আবুল হাশিমকে এ-কথার পিঠে তাঁর জবাব শুনে। না, উত্তর তিনি দেননি, পালটা প্রশ্ন করেছিলেন – ইংরেজ যে সাত হাজার মাইল দূরে থেকে ভারত শাসন করেছিলো তাতে কি শাসনের কোনো অসুবিধে হয়েছে? আমাদের শ্রদ্ধা ভেঙে পড়ে। আমরা এক মহাত্মার বদলে ধূর্ত এক গুজরাতি বানিয়াকেই প্রত্যক্ষ করে উঠি গান্ধীর এ পালটা প্রশ্নের ভেতরে। শুধু কি এই? গান্ধীর লিপিকর বাবু পেয়ারেলালের স্মৃতিকথায় আমরা পড়ে উঠি, এর পর আবুল হাশিমকে গান্ধী আরো বলেন – বাংলার সংস্কৃতির কথা যে হাশিম বলছেন তা ‘মূর্ত হয়ে উঠেছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে এবং এর মূল প্রোথিত উপনিষদের মধ্যে, এটি শুধু বাংলার নয় সমগ্র ভারতের বেলায় সত্য।’ এই বলে গান্ধী প্রশ্ন করেন, তাহলে অখন্ড বাংলা আর আলাদা কেন, ইংরেজ চলে গেলে হিন্দুস্তানেই যোগ দিক না কেন! আমরা আরো একবার স্তম্ভিত হবো গান্ধীর এই ভাবনা পরিচয় পেয়ে! তিনি উপনিষদের কথা তুলে মুসলিম ঐতিহ্য ইতিহাস ও পুরাণকে এক ধাক্কায় ভূলুণ্ঠিত করলেন এবং এক বিকট ভুল সিদ্ধান্ত জ্ঞাপন করলেন যে, রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের দর্শন অবলম্বন করেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন!

এখানেও থামেন নাই মহাত্মা গান্ধী। রক্ষণশীল হিন্দু বাঙালি নেতা তখন যাঁরা ছিলেন তাঁরা বলতে লাগলেন যে, বাংলাকে অখন্ড রাখবার জন্যে বাংলার প্রাদেশিক বিধানসভায় যেন অনুকূল ভোট দেয়, তাই হিন্দু বিধায়কদের টাকা দিয়ে কিনতে শুরু করেছে আবুল হাশিমেরা। গান্ধী এই ডাঁহা মিথ্যাটি সত্য বলে গ্রহণ করলেন! আবুল হাশিম, শরৎ বসু ও সোহরাওয়ার্দী যে বাংলার ঐতিহ্য ও বাঙালির হাজার বছরের আদর্শ নিয়ে কথা বলছিলেন, অখন্ড বাংলার পক্ষে ইতিহাস ও ভবিষ্যতের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন, গান্ধী তা জেনেও না-জানার পথ অবলম্বন করলেন। বিচলিত হয়ে শরৎ বসু গান্ধীকে টেলিগ্রাম করলেন – ‘যুক্তবাংলার দাবীতে ভোট ক্রয় করার জন্যে অকাতরে আমরা অর্থ ব্যয় করছি, এই কথা যে আপনাকে বলেছে তার নাম জানবার জন্যে এবং সত্য কোথায় তার খোঁজ নেবার জন্যে অনুরোধ করছি। যদি এ সংবাদ মিথ্যে হয় তাহলে যে আপনাকে ভুয়া খবরটা দিয়েছে তাকে শাস্তি দিন। আর যদি মনে করেন খবরটা ছিলো সঠিক, তাহলে ঘুষ যারা দিয়েছে ও যারা নিয়েছে উভয়কে আপনি দন্ডিত করুন।’

এর উত্তরে গান্ধী যা লিখলেন, যে টেলিগ্রামটি তিনি শরৎ বসুকে পাঠালেন, তা আমাদের ঔপন্যাসিক মকবুল হোসেনকে স্তম্ভিতই শুধু করে না, গান্ধীর গুজরাতি ধূর্ততাও মকবুল দেখে ওঠে। মহাত্মার উচ্চাসন অবলম্বন করে গান্ধী লেখেন শরৎ বসুকে – ‘ক্রুদ্ধ তারবার্তা পেলাম। ক্রোধ অনুচিত। রোববারে তোমাক চিঠি দিয়েছি। নাম প্রকাশ করা উচিত হবে না। জনমত বাদ দিয়ে ব্যক্তিবিশেষ কীভাবে আন্দোলন ছাড়া ঘুষদাতা ও গ্রহীতাকে শাস্তি দিতে পারে। শান্ত হও এবং ধীরস্থির থাকো। বাপু।’

মকবুল স্তম্ভিত হয় ভেবে যে, শরৎ বসুর টেলিগ্রামে গান্ধী কোথায় দেখলেন ক্রোধ? বরং কত বিনয়ের সঙ্গেই না তারবার্তার কথাগুলো বলা হয়। আর মর্মাহত সে হয় গান্ধীর এই ভাবমূর্তি গ্রহণ করা দেখে যে – বাংলার অখন্ডতা রক্ষায় এমন মৌলিক একটি প্রশ্নেও বাঙালিকে তপোবনের ধীরতা ও স্থিরতা ধরতে হবে! আর গান্ধীর সেই রোববারের চিঠি – কী লিখেছিলেন তিনি সে-চিঠিতে? লিখেছিলেন, ‘…আমি পন্ডিত নেহরু এবং সরদার প্যাটেলের সঙ্গে আলোচনা করেছি… তাঁরা মনে করেন… এটা হিন্দু এবং তপসিলি নেতাদের দ্বিধাবিভক্তি করবার ফন্দী। তাঁদের এটা সন্দেহ নয়, প্রায় দৃঢ় বিশ্বাস। তাঁরা আরো মনে করেন ভোট সংগ্রহের জন্যে অকাতরে টাকা ঢালা হচ্ছে। তাই যদি হয় তাহলে তোমার উচিত আপাতত আন্দোলন ও সংগ্রাম থেকে বিরত থাকা। কারণ, বঙ্গভঙ্গের চেয়ে দুর্নীতিকে আশ্রয় করে অখন্ডতা ক্রয় করাটা হবে অনেক বেশি খারাপ।… আমি আরো মনে করি, ভারতের দুই অংশের বাইরে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো সম্ভাবনা নাই।’

মকবুল হোসেন লক্ষ না করে পারে না যে, গান্ধী অখন্ড শব্দটি ব্যবহার করলেও তাঁর কলম অখন্ড বাংলা কথাটি লিখতে নারাজ এবং ভারতবর্ষকে হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানে বিভক্ত করা ছাড়া যে আর কোনো বিকল্প নাই, এটাও তিনি অদূর ভবিষ্যতের ওই দুটি রাষ্ট্রের নাম পর্যন্ত উলে�খ না-করে লেখেন। এবং এই গান্ধীর কারণেই অখন্ড বাংলার স্বপ্ন নিহত হয়, এতে অন্তত আমাদের ঔপন্যাসিক মকবুল হোসেনের কোনো সন্দেহ থাকে না। বারবার মনে পড়ে মকবুল হোসেনের সেই চিঠি, সাতচলি�শের চোদ্দই জুন তারিখে শরৎ বসু লিখছেন গান্ধীকে, ‘ঘুষ দেয়া হচ্ছে – এটা সর্বৈব মিথ্যা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে এবং আমি আমার ক্ষুদ্র শক্তি দিয়ে বাংলার অখন্ডতার জন্যে কাজ করে যেতে চাই। বাংলাকে বিভক্ত করবার যে প্রচন্ড উত্তেজনামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চাই যে, আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই যে বাঙালি সাধারণ মানুষের কাছে যদি গণভোট চাওয়া হতো তাহলে দেখা যেতো বাংলার হিন্দুরা বাংলাকে বিভক্ত করার বিরুদ্ধে অধিক ভোট দিতো।’ আর এই চিঠির শেষ বাক্যে শরৎ বসু গান্ধীকে যা লেখেন তা সোনার অক্ষরে লিখে রাখবার মতো। শেষ বাক্যটি এই – ‘বাংলার কণ্ঠকে কিছুকালের জন্যে রুদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে ভবিষ্যতে সে নিজেকে জোরের সঙ্গে প্রকাশ করবে।’

জোরের সঙ্গে? সর্বশক্তি দিয়ে? সশস্ত্র হয়ে? বুকের রক্ত দিয়ে? শহীদের রক্তে বাংলার মাটি ভিজিয়ে?

হ্যাঁ তাই। এবং শরৎ বসুর শব্দ ওই ভবিষ্যতের সঙ্গে বিশেষণ যুক্ত করে – অদূর ও নিকট! অদূর ভবিষ্যতেই, সাতচলি�শের পর মাত্রই তেইশ বছর পরে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রণোদনায় পূর্ব বাংলার বাঙালি জেগে উঠবে, সশস্ত্র যুদ্ধ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দেবে – হোক খন্ডিত বাংলা, তবু বাংলাদেশ। মকবুল হোসেন স্মরণ করে ওঠে, আমরাও স্মরণ করে উঠি ফরিদপুরের গন্ডগ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া যুবক মুজিব তখন কলকাতায় এবং সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে রাজনীতিতে অবতীর্ণ তখনই এবং তিনি নিশ্চয়ই সেই তখনই তাঁর কল্পনায় পেয়ে গেছেন স্বাধীন বাংলা, স্বাধীন দেশ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন।

কিন্তু নদী কাঁদে। কেন কাঁদে? কেন এই মধ্যরাতে জলেশ্বরীর প্রান্ত ছোঁয়া আধকোশা নদীটি কাঁদে? চরাচর ব্যাপ্ত সিঁ সিঁ একটা ধ্বনি। বাংলাদেশটাই কি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার কান্নার ভেতরে কি মকবুল শুনতে পাচ্ছে ক্ষীণ একটি রব – আয়, ওরে আয়, কাছে আয়, পাশে আয়, আয়\ r (চলবে)