নন্দিত নরকের কথাকার

শচীন দাশ
চলে গেলেন বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা জনপ্রিয় কথাকার হুমায়ূন আহমেদ। কিছুদিন ধরেই কোলনের ক্যান্সারে ভুগছিলেন। চিকিৎসার জন্য উড়েও গিয়েছিলেন আমেরিকা। কিন্তু শেষরক্ষা আর হলো না। চিকিৎসকদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে প্রায় বছরখানেক নিজের সঙ্গে লড়াই চালাতে চালাতে অবশেষে গত জুলাইয়ে তিনি প্রয়াত হন। তাঁর বয়স হয়েছিল চৌষট্টি।
হুমায়ূন আহমেদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর। নেত্রকোনা জেলায়। তাঁর নানাবাড়ি মোহনগঞ্জে। বাবা ও মা দুজনেই লেখালেখি করতেন। বিশেষত মা আয়েশা ফয়েজ। সম্প্রতি প্রকাশিত আয়েশার একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ইতোমধ্যে অনেকের নজরে পড়েছে। কিন্তু মা লিখলেও বাবা আর এগোতে পারেননি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনীর হাতে তাঁর বাবা নৃশংসভাবে খুন হলে গোটা পরিবারেই শোকের ছায়া নেমে আসে। হুমায়ূন ততোদিনে অনেকটাই বড়ো। ষোলো পেরিয়ে সতেরোর দিকে। বাবার মৃত্যুকে তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। মনে মনে গুমরে উঠেছিলেন। আর ওই তখনই কখন নিজের অজান্তে হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম। পারিবারিক সূত্রে লেখার ইন্ধনটি ছিলই, এবার রসায়নটি পেয়ে গিয়ে নিঃশব্দে সাদা পাতায় ফুটিয়ে তুললেন অক্ষর। ১৯৭২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পড়তেই লিখে ফেললেন একটি উপন্যাস। নাম দিলেন নন্দিত নরকে। তাঁর জীবনের প্রথম উপন্যাস। এবং অচিরেই এ-উপন্যাসই তাঁকে যে-পরিচিতি এনে দেয়, তাতে আর লেখা থেকে দূরে সরে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারলেন না। সেই যে তুলে নিয়েছিলেন কলম, আমৃত্যু এরপর লিখেই গিয়েছিলেন।
ব্যক্তিজীবনে রসায়নের অধ্যাপক হুমায়ূন সাহিত্যে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর নিজস্ব এক কথনরীতি, যে-রীতিতে সহজ-সরল ভাষায় ব্যক্ত করতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশেরই মধ্যবিত্ত জীবন থেকে গ্রামজীবনের এক নিপুণ চিত্র। খোলামেলা জীবনেরই চালচিত্র। একদিকে মধ্যবিত্ত জীবনের রোমান্টিকতাকে যেমন তুলে এনেছেন তাঁর সংলাপ-নির্ভর কথামালায়, তেমনি নিস্পন্দ ওই গ্রামীণ জীবনের মধ্য থেকেও তুলে আনতে চেয়েছেন জীবনের রসদ। আর এসবই তিনি করেছেন তাঁর নিজের মতো করে। এবং কোনোরকম আখ্যান নির্মাণে না গিয়েও গল্প বলে ও কাহিনির মোচড়ে গত বিশ-তিরিশ বছরে ধাপে ধাপে যে-ধারাটি তিনি তৈরি করে ফেললেন তা-ই হয়ে উঠল অবশেষে বাংলাদেশের সাহিত্যে জনপ্রিয়তার নতুন এক ধারা। এর উৎস অবশ্যই ছিল পশ্চিমবঙ্গে। হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে কেবল নতুন করে ধরলেন। এবং তাঁর নিজের দেশের মতো করে। ফলে নতুন প্রজন্ম তাঁকে গ্রহণ করল বিপুল আগ্রহে। শুনেছি, তাঁদের প্রিয় কথাকার আসবেন জেনে ঢাকার একুশের বইমেলায় একবার হাজার হাজার ভক্ত দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন লাইন দিয়ে তাঁর একটি সই সংগ্রহের জন্য। কিন্তু কেন এমন তাঁর জনপ্রিয়তা? এক পাঠকেরই কথায়, বাংলাদেশেরই জনজীবনের রোজকার নীতিনৈতিকতা ও ছোটখাটো সমস্যাকে লক্ষ্যবস্তু করে তিনি যেভাবে তাকে গুরুত্ব দেন, যা বাঙালি মধ্যবিত্ত প্রতিটি পাঠকেরই তা দিনভর সমস্যা। ফলে তা না পড়লে মনে হয়, কী যেন অপূর্ণ রয়ে গেল। কাজেই প্রতিটি পাঠকেরই মনে হয়, দেখি তো হুমায়ূনভাই কী বলেছেন এ-উপন্যাসে? অবশ্য হুমায়ূন আহমেদ তাঁর এ-জনপ্রিয়তার পেছনে টিভি সিরিয়ালের কথাও বলেছেন। তাঁর জনপ্রিয়তার পেছনে যে টিভি নাটকের অবদান আছে সে-কথা নিজেই তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন।
প্রায় দুশোরও ওপর উপন্যাস লিখেছেন হুমায়ূন। এগুলোর বেশিরভাগই যেমন বেস্ট সেলার, তেমনি অনুবাদও হয়েছে ইংরেজি, জাপানি ও রাশিয়ান ভাষা ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ভাষায়। এর মধ্যে হুমায়ূনের পৈতৃক ভিটে বাংলাদেশের নগণ্য একটি গ্রাম নিয়ে লেখা তাঁর গৌরীপুর জংশনের কথা অবশ্যই বলা যায়।
এ-উপন্যাসটি ছাড়াও জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল, বাঘবন্দি মিসির আলি, জোছনা ও জননীর গল্প উপন্যাসগুলোর কথা নিঃসন্দেহে উল্লেখ করা যায়। উল্লেখ করা যায় এমনি আরো অনেক উপন্যাসের কথাও।
জোছনা ও জননীর গল্প মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা একটি সুবৃহৎ উপন্যাস। জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল তাঁর প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে লেখা। প্রধান শিক্ষক ফজলুল করিম ডাবল এমএ। বিটিতে প্রথম শ্রেণি। গাঁয়ের সবাই তাঁকে ভালোবাসে। সমীহ করে। বয়স পঞ্চান্ন। পাতলা রোগা। একটু কুঁজো হয়েই হাঁটেন। সবসময়ই ভাবছেন তিনি তাঁর স্কুল নিয়ে। ভাঙাচোরা স্কুলটাকে তিনি কীভাবে দাঁড় করাবেন।
এহেন শিক্ষক একদিন সরকার থেকে সাত লাখ টাকার একটা স্যাংশন পেয়ে যান। ওই স্যাংশন পেয়েই তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন স্কুলকে তিনি কীভাবে আবার নতুন করে গড়ে তুলবেন। তাঁর ওই স্বপ্ন ও স্বপ্নের বাস্তবতা নিয়েই রচিত হয়েছে উপন্যাস।
হুমায়ূনের উপন্যাসমালায় বিশেষত দুটি সিরিজ পাওয়া যায়, যে দুটি সিরিজ নিয়ে অত্যন্ত আশাবাদী ছিলেন হুমায়ূন। একটি ‘হিমু’ ও অন্যটি ‘মিসির আলি’ নামে দুটি চরিত্র। এদের দুজনকে নিয়ে অনেক উপন্যাসও লিখেছেন তিনি।
মিসির আলি হুমায়ূনের একটি বিখ্যাত চরিত্র। এবং এমনই এক চরিত্র যে, কোনো রহস্যের সন্ধান পেলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এটা তার নেশা। এবং এ-নেশায় পড়ে যে কতবার সে বিপদে পড়েছে তবু সে ফিরে আসেনি এমন আকর্ষণ থেকে। আবার  হিমুও তেমনি। মিসির যেমন রহস্য উদ্ধারের নেশায় সঙ্গে নেয় তার সঙ্গী তেরো বছরের একটি ভিখারি ছেলেকে, তেমনি হিমু আবার খোঁজে জীবনের দর্শন। সঙ্গে থাকে তার নানান ভাবনা। এ দুটি চরিত্রই বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে হুমায়ূনের কলমের জাদুতে।
বছর দুই আগে হুমায়ূন একটা উপন্যাস লিখেছিলেন। ম্যাজিক মুনশি। তিনি অবশ্য একে উপন্যাস বলতে রাজি ছিলেন না। উপন্যাসের ভূমিকায় তিনি উল্লেখ করেছিলেন : ‘উপন্যাস বললে প্রকাশকের সুবিধা হয়। পাঠকরা উপন্যাস পড়তে পছন্দ করেন। সমস্যা হচ্ছে ম্যাজিক মুনশিকে কোনো পর্যায়েই ফেলা যাচ্ছে না। ম্যাজিক মুনশি হলো রহস্যময়তার বর্ণনা এবং কিছুটা বিশ্লেষণ। উপন্যাসের কাঠামো অবিশ্যি ব্যবহার করা হয়েছে।’
কিন্তু জ্ঞানে হোক বা অজ্ঞানে, এ-উপন্যাসে তিনি কিন্তু একটি আখ্যান নির্মাণ করে ফেলেছেন। ধরাবাঁধা জায়গা ছেড়ে ভিন্ন এক ঘরানায় এ-উপন্যাসকে তিনি  বেঁধে ফেলেছেন। কোনো কাহিনি নেই, আছে কেবল এক অজানা রহস্য ও বিশ্লেষণ। সম্ভবত এসব কারণেই পাঠকের প্রতি তাঁর অনুরোধ ছিল তাঁরা যেন এ-উপন্যাসকে দুবার করে পড়েন।
কিন্তু কেমন গদ্যে আচ্ছন্ন করে রাখেন হুমায়ূন তাঁর উপন্যাস পাঠককে। বা কেমন জাদু-মাখানো সেই কাহিনি যা পাঠক সমাজকে গত দু-তিন দশক ধরে এভাবে আগুনে ঝাঁপ দেওয়া পতঙ্গের মতো আকর্ষণ করেছে! উদাহরণ হিসেবে একটি জায়গা না হয় তুলে ধরি একবার :
‘স্যার আসব?’
আমি চমকে তাকালাম। দরজার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে তিনিই যে ম্যাজিক মুনশি তাতে কোনো সন্দেহ রইল না। মুখভর্তি দাড়িগোঁফ। মুনশি মাওলানারা দাড়ি রাখেন। গোঁফ রাখেন না। পানি পান করার সময় গোঁফ পানি স্পর্শ করলে পানি নষ্ট (বা হারাম) হয়ে যায়, এই কথা প্রচলিত। যদিও হজরত আলীর (রা.)-ও গালপাট্টা ছিল। গোঁফ ছিল, দাড়িও ছিল।
দরজার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর মাথার চুল গ্রামের বয়াতিদের মতো লম্বা। মধ্যবয়স্ক মানুষ। অত্যন্ত সুপুরুষ। চোখের তারা ঘন কালো। চোখ যক্ষ্মা রোগীর মতো ঝকমক করছে। তবে মানুষটির যক্ষ্মা নেই। থাকলে খুকখুক কাশি শুনতাম।
মুনশি সাহেব সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পরেছেন। নবিজী (দ.) সবুজ রং পছন্দ করতেন। তার মাথার পাগড়ি ছিল সবুজ। ম্যাজিক মুনশির সবুজ পাঞ্জাবির পেছনে নবিজীর (দ.) পছন্দের রং কাজ করতে পারে।
তিনি পাঞ্জাবির সঙ্গে লুঙি পরেছেন। লুঙির রং ধবধবে সাদা। পায়ে খড়ম। বিশেষ ধরনের খড়ম। ময়মনসিংহ অঞ্চলে এই খড়মকে বলে বউলাওয়ালা খড়ম।
আপনিই কি ম্যাজিক মুনশি?
জি জনাব। আসসালামু আলায়কুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আপনার খবর অনেক আগেই পেয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে আসা উচিত ছিল। মাগরেবের নামাজ শেষ করে এসেছি বলে বিলম্ব হয়েছে। আপনার কাছে ক্ষমা চাই।
আমি বললাম, ক্ষমা করার মতো কোনো অপরাধ করেন নি। ভাই, ভেতরে আসুন।’
মাত্র চারটে উপন্যাস লিখেই ১৯৮১ সালে তিনি অর্জন করেন বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার। পান একুশে পদকও। এছাড়াও অন্যান্য সম্মাননা।
বড়োদের জন্য গল্প-উপন্যাস লেখা ছাড়াও ছোটোদের জন্য লিখেছেন হুমায়ূন। রহস্য-অ্যাডভেঞ্চার, ভৌতিক গল্প, সায়েন্স ফিকশন – এমন কোনো বিষয় নেই যে তা নিয়ে লেখেনি তিনি।
তাঁর লেখালেখি জীবনের এক বিরাট অংশ জুড়েই ছিল টিভি ধারাবাহিক। এই ধারাবাহিকগুলোতে নাট্যকার হিসেবে তাঁর সাফল্যও কম কথার নয়। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে এইসব দিনরাত্রি ধারাবাহিকের মাধ্যমে টিভি নাট্যকার হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত তাঁর লেখা ধারাবাহিকের ভেতরে রয়েছে বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই ইত্যাদি।
গত দু-দশক ধরেই তিনি যুক্ত হয়েছিলেন চলচ্চিত্রের সঙ্গে। ১৯৯৪ সালে তাঁর মুক্তি পাওয়া ছবি আগুনের পরশমণি একাই জিতে নেয় আট-আটটি পুরস্কার। এরপর শ্রাবণ মেঘের দিন। ঢাকার অদূরে গাজীপুরে ‘নুহাশ পল্লী’ নামে সিনেমার শুটিংয়ের একটি স্টুডিও বানিয়েছিলেন তিনি। সেখানে শুরু হয়েছিল নুহাশের ব্যানারে তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণ। নুহাশ চলচ্চিত্র ও ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রযোজনায় আগামী দিনে কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনাও ছিল তাঁর। কিন্তু অকালমৃত্যুতে সেসব অসমাপ্তই রয়ে গেল।
সম্প্রতি তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ আমার ছেলেবেলা প্রকাশিত হয়েছে। নিজের মেয়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে ও বাচ্চা মেয়েকে ভোলাতে ভোলাতে নানান গল্পের ফাঁদে তাঁকে ফেলতে গিয়েই তাঁর মনে হয়েছিল এবার নিজের ছেলেবেলাটা লিখে ফেললে কেমন হয়। সেই ভাবনা থেকেই অবশেষে তাঁর ছেলেবেলা। এবং এখানেও তাঁর সেই সহজ কথনরীতি… যা পড়তে গিয়ে আশ্চর্য শুধু নয়, গোটা শৈশবই যেন উঠে আসে পরমাশ্চর্য একটি শ্বেতপদ্ম নিয়ে।