নমনীয়, মৃদু ও পেলব

জাহিদ মুস্তাফা20

শিরোনামটি বিচিত্র। কেমন একটা গল্পের ইঙ্গিত তাতে। ‘এখানেই সেখানে-সেখানেই এখানে’ – শিরোনামটি প্রখ্যাত জাপানি শিল্পী হোশিনা টয়োমির একটি একক চিত্র-প্রদর্শনীর। আয়োজিত হয়েছিল ঢাকার বেঙ্গল শিল্পালয়ে। প্রদর্শনীতে শিল্পীর আঁকা নানা মাধ্যমের আটত্রিশটি চিত্রকর্ম স্থান পায়। এগুলোর বেশিরভাগ কাগজে ইন্ডিয়ান ইংক ও রুপালি রঙের। এছাড়া কাগজে গোয়াশ মাধ্যমেও কাজ করেছেন, কাগজ কেটে আঠা দিয়ে কোলাজ ধরনের কাজও করেছেন তিনি।

হোশিনা টয়োমি জাপানের সমকালীন প্রধান শিল্পীদের একজন। জাপানে তাঁর খ্যাতির উৎস স্থাপনাশিল্প, নানা আর্ট প্রজেক্ট, ভাস্কর্য ও পাবলিক আর্ট। ১৯৫৩ সালে জাপানের হোন সু দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী এই শিল্পী বর্তমানে টোকিও ইউনিভার্সিটি অব আর্টসের অধ্যাপক।

প্রাচ্যশিল্পের ভেতর বাড়িতে চিন্তা-চৈতন্য আর দর্শনের প্রচলন আছে। জাপানের শিল্পেও এই দর্শন-চেতনা বিরাজমান বহুকাল থেকেই। হোশিনা টয়োমির কাজে সে-ঐতিহ্যের অনুরণন। জাপানি ঐতিহ্যের ‘ইয়োয়ি নোগু’ ও সুমিয়ে ধারার অঙ্কনরীতির সঙ্গে এই শিল্পী সম্পৃক্ত রয়েছেন। সুমিয়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে – চিত্রপটে বর্ণপ্রয়োগের আগে শিল্পীর ধ্যানস্থ হওয়া। ধ্যানকালে শিল্পীর কল্পনা যেন মানসপটে এসে ধরা দেয়। সেই দেখা ও অনুভবের একটি সরলরূপ ক্যানভাসে বা চিত্রপটে দৃশ্যমান হয়। বাহুল্য বর্জন করে শিল্পী সরল ভাষায় তাকে তুলে আনেন পটে।

চীনে এ-পদ্ধতিটির উদ্ভব তাং সাম্রাজ্যকালে। এই সাম্রাজ্যকাল সপ্তম থেকে নবম শতক পর্যন্ত। এটির আরো উৎকর্ষ ঘটে মোং সাম্রাজ্যকালে – নবম শতকের মাঝ বরাবর থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধ অব্দি। পরে এটি জাপান ও কোরিয়ার শিল্পে যুক্ত হয় এবং অন্যতম অঙ্কনরীতি হয়ে ওঠে। এর প্রধান দর্শনে বস্ত্তর অবস্থান গৌণ – বস্ত্তর অন্তর্নিহিত সত্তার অনুসন্ধান। গল্পের জন্ম এখান থেকেই – সে-গল্প বিচিত্র ধরনের, বিচিত্র গতিপ্রকৃতির।

হোশিনা টয়োমির চিত্রকর্মে গল্পের নানান আভাস। বর্ণনা কখনো বিশদও হয়েছে; কখনো মাত্র একটি অবজেক্টকে কেন্দ্র করে ঘটনা তুলে ধরেছেন তিনি। যেমন লম্বাটে বড় এক চিত্রপটে কানের ছবি এঁকে, নিচেই বর্ণনা করেছেন – ‘আমি কিছুই শুনতে পাই না বলেই চিকিৎসক বলছেন, এক ধরনের ছত্রাকের জন্য আলট্রাসাউন্ড কাজ করছে না।’ কানের সঙ্গে শ্রবণযন্ত্রের দুটি ডিভাইস ও তার ঝুলছে।

এখানে আমরা একটি গল্পের সন্ধান পাই। শিল্পী কিংবা শিল্পীর কোনো ঘনিষ্ঠজনের কানের সমস্যা এবং শ্রবণেন্দ্রিয় অকেজো হয়ে ওঠা, চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে কানের অকার্যকারিতার দুঃসংবাদ শোনা অবধি কত ঘটনার টুকরো টুকরো ছবি এ-গল্পের ভেতর।

প্রদর্শনীর সবচেয়ে দীর্ঘকায় চিত্রের শিরোনাম – ‘একটি স্থাপনার জন্য তিনটি কাহিনিসূত্র’।

শিল্পীর ভাষায় – ‘নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্যে অবাক চোখ নিজেকে যেন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে, সূর্যোদয়ে সূর্যের আলোয় ছিল কালো-কাক – অতঃপর সব স্মৃতি ধ্বংস হলো আগুনে।’ কথাগুলো কবিতার চরণের মতো হলেও এখানে লুকানো বড় এক গল্পের যোগসূত্র। আরেকটি চিত্র একটি স্থাপনার জন্য দুটি কাহিনিসূত্রে শিল্পী লিখেছেন – ‘আকাশ থেকে নৃত্যের ভঙ্গিমায় উড়ে এলো একটি অন্তর্বাস। বর্ষায় ডোবার জলে আমার প্রতিবিম্ব।’ ‘বৃক্ষ-বাগানের স্মৃতি’ শীর্ষক চিত্রে দেখা যায় – ফুল ফোটা ও ঝরে পড়ার ঘটনাপ্রবাহ। ‘বৃষ্টি’ নামের কাজে হোশিনা লিখেছেন – ‘আমরা – বৃষ্টি ও বৃষ্টিধারার নানা বিন্দু নিয়ে তৈরি করি গল্প।’

‘ব্লোয়িং কালারস’ চিত্রের মানুষ যেন বুদ্ধের মতো ধ্যানমগ্ন। এরকম আরো কিছু অবয়ব এঁকেছেন শিল্পী। এর একটি হচ্ছে ‘স্মৃতির মুখাবয়ব-৩’।

এক বালক যেন অতীতের ভূমি থেকে আগামীকে দেখতে চাইছে – তার চোখে এমনই দূরদৃষ্টি। এ যেন শিল্পীর নিজের বালককে অনুভব করা। বালক বয়সের স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস। একই শিরোনামে হোশিনা এঁকেছেন – দুজন বালক-বালিকার প্রতিকৃতি। সাদা কালোর সঙ্গে সামান্য লালচে আভাস ওদের চোখেমুখে। রং প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই মিনিমাইজেশন শিল্পীর কাজগুলোকে সহজেই অতীতচারী করে।

অবশ্য প্রায় সব কাজেই শিল্পী হোশিনা টয়োমির বর্ণপ্রয়োগ উচ্চকিত নয়, বরং নমনীয় মৃদু ও পেলব। জলরঙের স্বচ্ছতার মতো। আবার অস্বচ্ছতাকে এড়িয়ে যাননি শিল্পী তাঁর কতক কাজে। বর্ণকে ব্যবহার করেছেন নিজের প্রয়োজনমতো। আবার কোথাও কোথাও কাগজের টুকরা-টাকরাও জুড়ে দিয়েছেন তাঁর ভাবপ্রকাশের প্রয়োজনে।

শিল্পী হোশিনা টয়োমির চিত্রকর্মের উপকরণের মধ্যে আছে বিশেষ ধরনের কাগজ, সূক্ষ্ম ও মোটা বুনটের ক্যানভাস। রঙের উপকরণের মধ্যে আছে ইন্ডিয়ান ইঙ্ক, সিলভার, আটা, সামান্য জলরং, টিউব এবং হয়তো অ্যাক্রিলিকের সামান্য রং। এসব উপকরণ কাগজে-ক্যানভাসে জলরঙের মতো স্বচ্ছতায় ছেড়ে দিয়েছেন। তার ওপর আরো রঙের প্রলেপ পড়ে কোথাও স্বচ্ছতা এসেছে, কোথাও বা ভারী হয়েছে বর্ণ। প্রয়োজনে শিল্পী রুপালি রং ঢেলেছেন, বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির মতো তুলির আঁচড় দিয়েছেন। সব মিলিয়েই তৈরি হয়েছে হোশিনার শিল্পকৃতি।

শিল্পীর মানস-গঠন হয় তাঁর শৈশব-কৈশোর স্মৃতি ও জন্মস্থানের প্রকৃতি এবং মানুষের জীবনধারার সমন্বয়ে। হোশিনা টয়োমির জন্মস্থান পার্বত্য অঞ্চলের নদী-তীরবর্তী অববাহিকায়। নদীজলের প্রবহমানতার শব্দের সঙ্গে তাঁর বেড়ে ওঠা। শৈশবের সে-জলধারার মধুর শব্দ যেন এখনো তাঁর কানে সুর তোলে। শিল্পীর জন্মস্থানের দুদিকেই পাহাড় থাকায় সকাল নয়টার আগে সেখানে রোদের দেখা মিলত না। দূরের পাহাড়ের মাথায় সূর্যের আলোর ঝিকিমিকি শিল্পীর মনে দারুণ এক সৌন্দর্যচেতনার জন্ম দিয়েছে। রাতের দৃশ্য সম্পূর্ণ আলাদা। আকাশের বুকে চাঁদ ও তারার আলোয় ওই অঞ্চলের প্রকৃতি শান্ত-সৌম্য রূপ ধারণ করত। এমন ঐশ্বর্যময় নিসর্গের মধ্যে বেড়ে ওঠায় শিল্পীর শিল্প-সৃজনের বিষয় ও আঙ্গিকে বারবার ধরা দেয় তাঁর জন্মস্থানের নানা বৈশিষ্ট্য।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় – ‘পেইন্টিং ফর অ্যান ইন্সটলেশন-২’ শীর্ষক চিত্রটির বিষয়বস্ত্ত ও গঠনে শিল্পীর জন্মভূমির অবাক করা সৌন্দর্যের রূপের বর্ণনার কথা। প্রায় সাদা-কালোর আলো-অাঁধারিতে দুটি শিশু দূর-পাহাড়ের বুকে সূর্যালোকের বাহারি বর্ণের ঝিলিক দেখে আমোদিত। তারা যেন বলছে – ওই আলো ছিল দারুণ সুন্দর। ১৩০ গুণিতক ১০০ সেন্টিমিটার আকারের এই চিত্রকর্মটি শিল্পী এঁকেছেন গত বছর অর্থাৎ ২০১২ সালে। প্রদর্শিত চিত্রকর্মগুলো ২০০৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে আঁকা।

হোশিনা টয়োমির আঁকার ধরনে শিশু আঁকিয়ের সারল্য আছে। অঙ্কনধরন রিয়ালিস্টিকের কাছাকাছি, তবে, রিয়ালিজমের মাস্টারি না করে তাকে সরলভাবে উপস্থাপন করেছেন। এই সরলতার সৌন্দর্যের আলাদা ঐশ্বর্য দেখিয়েছেন শিল্পী। স্বচ্ছ ওয়াশে অবয়বের একপাশ এঁকে অন্য পাশ প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। এতে এক ধরনের রহস্যময়তা তৈরি হয়েছে অবয়বে ও তাঁর পেছনকার নিসর্গে। ছায়ার মায়ায় হঠাৎ অপার্থিব আলোর মতো এক ঝলক খেলে যাওয়ার আনন্দ পাওয়া গেল তাঁর চিত্রকর্মে।

জাপানের চারুশিল্পাঙ্গনে শিল্পী হোশিনা টয়োমির আলোচিত আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৮০ সালে তাঁর স্থাপনাকর্মের মাধ্যমে। স্পেস ও বডির সম্পর্ক নিয়ে তিনি কাগজ ও কাঠের টুকরোর সমন্বয়ে স্থাপনা করে জাপানের শিল্পী ও বোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শিল্পী হোশিনা তাঁর নিজের কাজ ও চেতনা সম্পর্কে যে-উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন, তা হলো – আমি প্রভাবিত হয়েছি চা উৎসব ও  হাইকু (জাপানি কবিতা) দ্বারা, যেগুলো আমাদের নিত্যদিনের ঐশী পথ। আমি অনুপ্রাণিত তাওবাদ, বুদ্ধবাদ, কনফুসিয়াসবাদ দিয়ে প্রাচ্যের সংস্কৃতিতে।

বেঙ্গল শিল্পালয়ে আয়োজিত এ-প্রদর্শনী চলেছে গত ১৭ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত। ঢাকার দর্শকদের সঙ্গে পরিচয় হলো একজন প্রাচ্য-ঐতিহ্যসচেতন আধুনিক জাপানি শিল্পীর সঙ্গে।