নষ্ট সময়

Shakor (Nastasamoy)
Shakor (Nastasamoy)

পারভেজ হোসেন
ওরা আমাকে তন্নতন্ন করে খুঁজছে। সম্ভাব্য এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে ওদের ছায়া পড়েনি। মির্জাদের পোড়োবাড়ি, আমতলির জঙ্গল, পুলিশের দাবড়ানি খেয়ে পালিয়ে বেড়ানোর গোপন সব আস্তানা, সন্ধ্যায় বিলে জলের মধ্যে ভেসে থাকা ছোট ছোট গ্রামের কোনখানে নয়! কিন্তু পেলো না ওরা। কী করে পাবে? এক উদ্দেশ্য এক আদর্শ আর একই শিক্ষণে বেড়ে উঠেছি আমরা। আজ না-হয় পথ আলাদা হয়ে গেছে।
পাকা শিকারির মতো নিশানা বরাবর হাতিয়ার তাক করে যেমন ছুটছে ওরা, তেমনি সমান দক্ষতায় ওদের লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে হন্যে হয়ে ছুটছি আমিও।
এ যেন হর্তেল ঘুঘুর নিপুণ ফাঁদ তিলে ঘুঘুর পথে। সে-ফাঁদের মধ্যে পড়েও এখন আমি বাইরে। আমার হৃদপিণ্ড এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়ার মতো নিশানা ঠিক রেখে গুলি ছুড়েছে, পাগলের মতো স্টেনগানের ট্রিগার চেপে ধরেছে; কিন্তু ঝাঁকে-ঝাঁকে পুলিশের ধাওয়া থেকে বছরের পর বছর ধরে পালিয়ে যেতে পেড়েছে যে, এতো সহজে কী করে তাকে বাগে পাবে ওরা?
একটার পর একটা আস্তানা বদলে এখন এই বাড়িটার চিলেকোঠার খাটটিতে লেপচাপা হয়ে পড়ে আছি। ঘন কুয়াশা এমন ভারী হয়ে আছে, জানালার বাইরেটায় দু-একটা গাছের পাতাঝরা কটা নিঃসঙ্গ ডাল ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। শহরের একেবারে প্রান্তের পুরনো এলাকা এটি। গায়ে-গা-লাগা বাড়িগুলো গাছপালায় আচ্ছন্ন থাকায় যেমন স্যাঁতসেঁতে, একেবারে হাড়ে গিয়ে বেঁধার মতো শীতও তেমন। পুরনো বাড়িঘর ভেঙে নতুন নগর ফাঁদার ঢেউ এসে এদিকটায় লাগেনি এখনো। তাই শীতকাতুরে পাখিদের কলরব ছাড়া এই ঘোর সকালে আর সকলই নীরব। একটু পরই গাছপালা ছেড়ে প্রায় দেড় মাইল দূরের সন্ধ্যার বিল থেকে উঠে আসা হিম বাতাস ভেঙে চলে যাবে ওরা। সেই সুনসান নীরবতার অপেক্ষায় আছি লেপ ছেড়ে উঠব বলে।
না উঠে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার। বাইরে থেকে তালা খোলার শব্দে ঝট করে কান খাড়া হয়ে গেল। এরকম কুয়াশায় এই সকালে রোদ ওঠার উপায় নেই, তবু বাইরেটা এখন বেশ পরিষ্কার। দেখি, রং ক্ষয়ে যাওয়া পুরনো একটা লাল চাদর গায়ে জড়িয়ে আটার রুটি আর আলুভাজির রেকাবি হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন চাচিআম্মা। বয়োবৃদ্ধ তিনি কিন্তু ন্যুব্জ নন। ধীরপায়ে ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে এসে ঢুকলেন। ছোট্ট একটা ছেলে ওনার ফুটফরমাশ খাটে হয়তো, জগ আর গ্লাস হাতে পেছন পেছন এগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
জঘন্য সন্দেহপ্রবণ মন আমাদের। ছেলেটির আগাপাছতলায় একঝলক চোখ বুলিয়েই কেমন একটা অশুভ গন্ধের ঘাইয়ে মাথাটা বিগড়ে গেল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অভিজ্ঞতায় চুরচুর চাচিআম্মার বুঝতে দেরি হলো না। ঠান্ডা গলায় বললেন, ও আমার লগেই থাহে, এই পোলারে নিয়া সন্দেহের কিছু নাই। হাত-মুখ ধুইয়া খাইয়া লও। আমি তালা মাইরা দিতাছি।
চিলেকোঠা হলেও এর চলনটা মন্দ না। লাগোয়া পায়খানা আছে। গোসলখানা আছে। আমাদের কমরেড গুরুর বাপ-দাদার কবেকার বাড়ি সেরকম কায়দায়ই বানানো। তেমন পরিস্থিতি হলে এ-ঘরের পেছনের জানালা দিয়ে একটা গাছ বেয়ে পালিয়ে যাওয়া কোনো ব্যাপারই না। দু-তিনদিনের বেশি তো নয়, খুঁজে খুঁজে হয়রান তো হবেই, তখন পরিস্থিতি আপনা থেকে শান্ত হবে। বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য সব পথের কোথায় কে ঘাপটি মেরে আছে বলা তো যায় না। অধৈর্য হয়ে নিজেদের গুটিয়ে নেবে, যার যার মতো সরে পড়বে। তেমন সময় এলে রাতের অন্ধকার গায়ে জড়িয়ে যে করেই হোক পাকুন্দা স্টেশনে রাত ৮টার ট্রেনটা ধরতে পারলেই হয়। নাভারণ হয়ে ভোমরা, কলারোয়া না-হয় ঝাউডাঙার বর্ডার ডিঙিয়ে সোজা রানাঘাট অথবা বনগাঁ। তখন কে পায় আর? ব্যাপারটা কল্পনা করতেই উত্তেজনায় দেহের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। ডোরাদার ডানার পাখির মতো আনন্দে উড়ে বেড়াবার নিবিড় উপলব্ধি মনে এসে ভর করে।
কতদিন শরীর ছেড়ে ঘুমাই না! ঘাড়ের রগ মাঞ্জা দেওয়া ধনুকের গুণের মতো টান-টান হয়ে আছে সারাক্ষণ। বড়ো সাধ করে বিপ্লবের স্বপ্নে, পরিবর্তনের আশায় মৃত্যুসমান অথচ নির্ভার যে-জীবন বেছে নিয়েছিলাম তা-ই আজ কাঁধের ওপর পাহাড়তুল্য ভার হয়ে চেপে আছে। মৃত্যুকে ভয় করে এখন।
বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির ওপরের দিকের কমরেড ছিলেন তিনি। চেয়ার-টেবিল আর তাকভর্তি বইয়ে ঠাসা চিলেকোঠার এই ঘরটা ছিল তাঁর পড়ার ঘর। তাঁর একমাত্র স্বস্তির জায়গা। পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির সদস্য হইনি তখনো। ওনার উপস্থিতির খবর পেয়ে অন্যদের সঙ্গে আমারও যাতায়াত ছিল এখানে। সবার পেছনে চুপ করে বসে আলোচনা শুনতাম। পাজামা-পাঞ্জাবির ওপর খদ্দরের চাদর-জড়ানো ছিপছিপে একজন মানুষ, চোখে সরু ফ্রেমের ভারী চশমা। শত অত্যাচারে রক্তমাংসের জীর্ণতা-বিশীর্ণতার নিচে অক্ষত যৌবন অটুট আছে এখনো। কী চমৎকার গভীর আর মর্যাদাপূর্ণ তার চাহনি। যেমন ঋজু, তেমনি স্পষ্ট আর ঋদ্ধ কণ্ঠস্বর। আলোচনা করছেন মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও থেকে শুরু করে গ্রামসি কর্ডওয়েল হয়ে নিজেদের কাল পর্যন্ত। তাঁর চিন্তায় ঐশ্বর্য-কল্পনায় প্রগাঢ় প্রখরতা। অগাধ আস্থা ছিল নিজের ধারণার ওপর। কবিতা ভালোবাসতেন। আলোচনার ফাঁকে-ফাঁকে কবিতা পড়ে কবিদের উদাহরণ টেনে-টেনে গুরুগম্ভীর রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর একটা কাব্যিক আধিপত্য স্থাপন করতেন। তার ভরাট আবৃত্তিতে লোরকার একটা কবিতা আমার স্মরণে আছে আজো।
নেরুদার বন্ধু লোরকা, স্পেনের স্বৈরাচারী শাসক ফ্রাংকোর গুণ্ডারা যাকে গুলি করে হত্যা করেছিল। তাক থেকে সেই কবির একটা বাংলা অনুবাদ তুলে নিলেন কমরেড, পড়লেন –
আমি টের পেলাম আমাকে তারা খুন করেছে।
কাফে, গোরস্তান আর গির্জা তন্নতন্ন করে তারা খুঁজল আমাকে,
উঁকি দিলো পিপায় আর দেরাজে,
তিনটি কঙ্কাল লণ্ডভণ্ড করে উপড়ে আনল সোনার দাঁত,
কিন্তু তারা আমাকে আর খুঁজে পেল না,
আমাকে তারা খুঁজে পায়নি?
না। আমাকে তারা আর খুঁজে পায়নি।
সবরকম আগাম সতর্কবার্তাসহ লোরকার সেই মৃত্যুর কণ্ঠস্বরই যেন বেজে উঠল কমরেডের গলায়। সুদীর্ঘ অস্তাচলের অন্ধকারেও যাঁরা মানুষের মধ্যে স্বপ্ন জাগিয়ে রাখেন সেই লোরকা আর আমাদের কমরেড। পালাতে গেলে পুলিশের গুলিতে মাথার খুলি ফুঁড়ে মগজ বেরিয়ে পড়েছিল তাঁর। বিপ্লবের নিঃসঙ্গ নিথর একটা অধ্যায় সারারাতের অন্ধকারে শিশিরে কুয়াশায় লুটিয়েছিল পথের ধারে, ঘাসে, ধুলায়!
অনেক খুঁজেও তাকে লোরকার বইটা আর পেলাম না। সারাদিন ধূলিমলিন এ-বই সে-বইয়ের পাতা ওলটতে-ওলটাতে কমরেডের এই ছোট্ট ঘরে কতভাবেই না নিজেকে স্থির করতে চাইলাম; কিন্তু এই প্রহর, শীতের এই হিম আরো তীক্ষè করে তুলল সমস্ত নির্জনতাকে। কতোগুলো দুর্বোধ্য ভাবনা, কুয়াশাবৃত স্বপ্ন, মাকড়সার জালের মতো কতোগুলো অস্পষ্ট অনুভূতি জীবনস্রোতের ওপর বিষাদ ঢেলে দিয়েছে যেন। প্রাণের মধ্যে সাড়া পেলাম মৃত্যুর, যার অধিকার থেকে জীবনকে উদ্ধার করতে শিখিয়েছিলেন কমরেড।

চিলেকোঠায় আটকে রয়েছি আজ তিন দিন। কুয়াশায় এ-অঞ্চলটা এমন আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে, সারাদিন এক ফোঁটা আলোর দেখা মিলল না। বাঁশঝাড়, আমবাগান ছাড়িয়ে সর্ষের  ক্ষেত, ধানশূন্য বিস্তৃত শুকনো মাঠ আর সন্ধ্যার বিলে বিকেল থেকে বাতাসে সূক্ষ্ম জলবিন্দুর পুঞ্জ ধোঁয়ার মতো আরো ভারি হয়ে উঠল।
রাতে ছোট্ট ছেলেটা তালা খুলে কপাটের আড়াল থেকে ভেতরে উঁকি দিতেই দেখি পেছনে চাচিআম্মা ছায়ার মতো ভেসে উঠলেন। অল্প পাওয়ারের বাল্বটার মৃদু আলোয় ঘরখানা নরম হয়ে আছে। খাবার দিতে এসে চাচিআম্মা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দু-একটা জরুরি কথা সেরে ফেলেন, কিন্তু আজ চেয়ার টেনে বসলেন তিনি। এ-বয়সেও মাথাভর্তি ঘন চুল পাটের রঙের মতো সাদা। কড়কড়ে শরীরে চামড়া কুঁচকে গেছে; কিন্তু জ্বলজ্বল করা চোখ দুটো নিয়ে শ্যামলা মুখখানা কী প্রসন্ন। বারো-চোদ্দো বছর আগেও যখন এ-বাড়িতে ঘনঘন যাতায়াত ছিল এই মুখের মায়ায় পড়েছিলাম আমি। কমরেডের মৃত্যুর পর একা পথে-পথে জীবনের সব নিষ্ঠুরতা সামলে চাচিআম্মার এই নির্মলতায় নিজেকে জিইয়ে রাখা স্বপ্নের মতো মনে হয় আমার। মানব জীবনের একাকিত্বের সৌন্দর্য নীরবে উপভোগ করার মানুষ চাচিআম্মা নন, তবু কী করে যেন এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন তিনি।
ছেলেটা জড়োসড়ো হয়ে খাটের এক কোনায় গিয়ে বসেছে। কাছের রাস্তায় দু-একটা রিকশা বা সাইকেলের টুংটাং আওয়াজ। কোলের ওপর লেপ রেখে খাটের একেবারে মাঝখানটায় আসন গেঁড়ে আছি আমি। ইশারায় ছেলেটাকে নিচে পাঠিয়ে দিলেন চাচিআম্মা। একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, এতদিনের রাস্তা ছাইড়া নতুন পথে হাঁটার হিম্মত সকলের থাহে না। তোমার মধ্যে সেই হিম্মত দেখলাম। আমার ভাইরে খবর দিছি। সে আইসা কাইল রাইতে পরিস্থিতি আন্দাজে কোনো একটা গাড়িতে তুইলা দেবে তোমারে।
আপনে অনেক করলেন আম্মা। ওই অবস্থায় এই আশ্রয়টুক না পাইলে … আমি বিনীত হতে চাইলাম কিন্তু আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পাওয়ার আগেই তিনি থামিয়ে দিলেন, তোমার সিদ্ধান্ত মহৎ কি-না কইতে পারি না, তয় এইটা বুঝি, অনুসরণের যহোন কিছু আর না থাহে, লক্ষ্য যহোন মুইছা যায়, সেই পথের মতো ভুলপথ আর নাই। সে-পথ পরিত্যাজ্য।
কথায় কথায় আরো অনেক কথা হলে দরজায় তালা দিয়ে চলে গেলেন তিনি। জানালাগুলো সব বন্ধ করেও জেঁকেবসা ঠান্ডাটা আর সামলানো যাচ্ছে না। হাত ধুয়ে খাবার নিয়ে বসেছি। ভাতগুলো কড়কড়ে ঠান্ডা হলেও তরকারিটা গরম। মুখে গ্রাস তোলার আগেই মুহূর্তের জন্য রাস্তার একটা কোলাহল কানে এলো। কারা যেন দৌড়ে গেল কোন দিকে। আশপাশের কোনো বাড়ির কারো শিশু কেঁদে উঠল। ঘরের বাতিটা বন্ধ করে ভাতমাখা হাতে জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মিটমিটে আলো জ্বেলে দূরে কুয়াশার ঘন অন্ধকারে একটা ল্যাম্পপোস্ট ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। গত দুদিনে এরকম কিছু ঘটেনি। মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হলো, ওরা কি টের পেয়েছে তবে? না-কি আন্দাজ করেছে কিছু? না, সেরকম কিছু তো না, ভাবলাম এ আমার মনের উদ্বেগ, তবু দেহযন্ত্র খাড়া রেখে দাঁড়িয়ে থাকলাম আরো অনেকক্ষণ।
রাত বাড়ছে, কোনো এক মুহূর্তে ঝাঁ-করে আমবনের ভেতর দিয়ে দু-একটা পেঁচা উড়ে গেল শুধু। তারপর ঠান্ডার ভেতর কুয়াশায় ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যাওয়ার মতো একেবারে নিস্তব্ধ সব।

ছাদের ওপর অনেকগুলো মানুষের দাপাদাপি। ফিসফিস কথাবার্তার চাপা আওয়াজ। কিছু আন্দাজ করে ওঠার আগেই তারা বাইরে থেকে তালা দেওয়া কপাটের আংটায় রড ঢুকিয়ে মুচড়ে খুলে ফেলেছে সেটা। লেপের ওম তছনছ করে ততক্ষণে লাফিয়ে উঠেছি আমি, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। দেখি, দরজায় সকালের আলো আড়াল করে মাথায় মুখে মাফলার-জড়ানো চাদর-মোড়া শকুনের মতো জনাকয়েক ডানা গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কুতকুতে চোখ ওদের আমার ওপর স্থির। চাদরের তলায় দু-দুটো হাতিয়ার তাক করা। এ-অবস্থায় লাফ দিয়ে সরে পড়ার চেষ্টা কোনো কাজের কথা নয়, নির্ঘাত মৃত্যু।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পেছনে দুমড়ে যাওয়া কণ্ঠের চাপা কর্কশ কথাগুলো ভেঙে-ভেঙে কানে এলো।
কুত্তার বাচ্চায় কী ভোগানটাই না ভোগাইছে। হারামির বাচ্চারে কী করি দ্যাখ।
বুইরা মাগিরে কী করবি?
কিচ্ছু করণের হুকুম নাই।
মনের মধ্যে কোনো আলোড়ন নেই। সমস্ত অনুভূতি অসাড় আর হিম হয়ে আসছে যেন। ওদেরকে অনুসরণ করা ছাড়া এখন কী-ই বা করার আছে আর? বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে প্রবল কুয়াশায় কিছুই চোখে পড়ে না। সামনের দুজন হাঁটতে হাঁটতে ছায়ার মতো শিশিরভেজা ধোঁয়ার দেয়ালের মধ্যে ঢুকে পড়ল। পেছনে ওরা এতোটাই শরীরলগ্ন, ঘাড়ের ওপর ওদের নিশ্বাসের শব্দ পাচ্ছি। মাফলারে মুখ বাঁধা থাকায় কণ্ঠস্বরে বুঝতে পারছি না, কে কানের কাছে মুখ এনে বলছে – ডরাইস না, কোনো কষ্ট দিমু না তোরে।

এ-পথের প্রায় মাইল দেড়েক দূরে লোকালয় ছেড়ে নলখাগড়ার বন আর প্রকাণ্ড বুড়ো হিজলগুলোর ছায়ায় সন্ধ্যার বিলের শান্ত নির্জন কিনার। সেখানে শেয়ালের আনাগোনা আর এই শীতে ডাহুকেরা বড় বড় শুকনো বাদামি পাতা উলটিয়ে পোকা খুঁটে খুঁটে খায়। ঢালের নিচে দিগন্ত বিস্তার করা স্বচ্ছ জল। সে-জলের শরীর ছুঁয়ে ভেসে থাকা লতায় অজস্র রক্তিম ফুল, তাতে ফড়িং এসে বসে থাকে নিশ্চুপ। ওই জলের তলায় গভীর কাদার হিম অন্ধকারে পুঁতে দেওয়া মানুষগুলোর খোঁজ কেউ কোনোদিন পায় না আর।