নাদানের দান

মালেকা পারভীন

ছেলেপক্ষ দেখে যাওয়ার সময় কাজরির হাতে পাঁচশো টাকার দুইটা নোট গুঁজে দিয়ে গেলো। ছেলের বড়বোন টাকাটা দেওয়ার সময় নির্লিপ্তভাবে বললো, ছোট বোনদের নিয়ে খরচ করো। এটাই নাকি নিয়ম। মেয়ে দেখলে টাকা দিতে হয়। যদিও টাকাটা নিতে কাজরির মোটেও ভালো লাগেনি। যেমন ভালো লাগেনি এভাবে সেজেগুজে অপরিচিত কিছু লোকের সামনে বোকার মতো ঘণ্টাখানেক বসে থাকতে। কোনো কিছু করার ছিল না তার। শুধু মেয়ে হওয়ার অপরাধে কিনা কে জানে, তাকে এই অপমানটুকু নীরবে চুপচাপ হজম করে যেতে হলো।

সত্যিই কাজরির কিছু করার ছিল না। প্রথমে একটু গাঁইগুঁই করলেও পরে বাবার কথা ভেবে চুপসে গেছে। কারণ, বদমেজাজি বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে তার আদেশ অমান্য করার মতো দুঃসাহস তার এখন পর্যন্ত হয়নি। যেটা বলা প্রয়োজন, কেবল সে অনার্সে ভর্তি হলো। ভর্তি পরীক্ষায় তেমন ভালো করতে পারেনি বলে তার সুযোগ মিলেছে ইতিহাসের মতো একটা পুরনো বিষয়ে। এ-ব্যাপারটাও তার কিছু বলার ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে অনেকাংশে। আর কবেই বা সে তার বাবার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পেরেছে। বড় মেয়ে হিসেবে জন্ম। তার বিয়েটা ঠিকমতো দিতে পারলেই না পরের তিনটা বোনের ভালো ব্যবস্থা করা যাবে। এসবও তো মাথায় রাখতে হয়, নাকি?

বিয়ে তো একটা হালকা পোশাকি শব্দ। মেয়েদের জন্য দরকার পড়ে আসলে ভারি একটা ব্যবস্থার। থাকার ব্যবস্থা, খাওয়ার ব্যবস্থা, আপাতদৃষ্টিতে একটা নিরাপত্তার ব্যবস্থা। ভাবতে ভাবতে কাজরি খেয়াল করে, টাকার

নোট দুটা সে হাতের মধ্যে মুচড়ে ফেলেছে অনেকটা টিস্যু পেপারের মতো। এরকম খিচখিচে মন নিয়েও ওর সামান্য হাসি পায়। বোনরা শুনলে রইরই করে উঠবে। বড়আপু আসলেই একটা বোকার হদ্দ। পছন্দ হোক বা না-হোক, হাজারখানেক টাকা তো পাওয়া গেছে। ওদের চার বোনের চায়নিজের দু-তিনটা মেন্যু তো অনায়াসে হয়ে যাবে। নিদেনপক্ষে বাসার সবার জন্য তেহারির প্যাকেট।

রাতে বিছানায় শুতে এলে তার পরের বোনটা জানতে চায়, ‘আপু, তোকে কী জিজ্ঞাসা করলো রে?’ বিকালবেলাটার ওই সময় সে গিয়েছিল কোচিং করতে। বাবা-মাও চাননি, তাদের বড় মেয়েটার তুলনায় চোখে পড়ার মতো সুন্দর এই মেয়েটাকে পাত্রপক্ষের নজরের চৌহদ্দির মধ্যে ফেলতে।

‘কই, তেমন কিছু না। নাম-ধাম, কী পড়ি, কী পছন্দ করি এসব।’

‘এগুলা তো ওরা জানেই। তোমার বায়োডাটা পড়েছে না? অন্য কিছু কী বললো?’

‘অন্য কিছু মানে? ও, হ্যাঁ, মনে পড়েছে, আর জানতে চেয়েছিল তোর কথা?’

‘আমার কথা? আপু, প্লিজ, ঢং করো না তো। সত্যি-সত্যি বলো না আর কী বললো?’

‘সত্যি-সত্যি বললাম তো, আর কিছু বলেনি। তবে…’ বলে টাকার কথাটা মনে আসে ওর। ‘আমাকে এক হাজার টাকা দিয়েছে। পাঁচশো টাকার দুটা নতুন ঝকঝকে নোট। টাকা দিয়ে কী করবো সেটাই বুঝতে পারছি না।’

‘তোমার কিছু বোঝার দরকার নেই, আপু। আমরা তোমার বোঝার কাজটা করে ফেলবো। তুমি শুধু আমাদেরকে টাকাটা দিয়ে দাও।’

‘আচ্ছা, দিবো। এখন ঘুমা’ বলে পাশ ফিরে ঘুমাতে চায় কাজরি।

 

দুই

পরের সারাটা দিন ব্যস্ততার মাঝে কেটে যায় কাজরির। টাকাটার কথা সে বেমালুম ভুলে থাকে। তবে ভার্সিটি থেকে ফিরে মায়ের মুখোমুখি হয়ে সে কিছুটা হকচকিয়ে যায়। মা মনে হয় কিছুক্ষণ আগে কেঁদেছেন। চোখের নিচে ভেজা। কান্নার কারণ অনুমান করার চেষ্টা করে সে। পারে না। বাবার অফিস থেকে ফেরার সময় হয়নি। কাজেই কথাকাটাকাটির মতো নৈমিত্তিক ঘটনাটা এখনো ঘটতে পারেনি। তাহলে কি ওরা জানিয়েছে যে, মেয়েকে ওদের পছন্দ হয়নি? ওদের হাবভাবে তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু পছন্দ না হলেও কি মায়ের এভাবে কাঁদা উচিত? সে কি শেষ পর্যন্ত একটা বোঝা হয়ে গেলো?

‘মা, তোমাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন?’

‘কীরকম দেখাচ্ছে’ বলে মা ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে ওকে একটু বিভ্রান্ত করতে চান। কিন্তু অন্যান্য সময়ের মতো এখনো তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হলেন। অনেক কষ্টে চেপে রাখা আবেগের তড়পানি বড় মেয়েটার কাছে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে কোনো লাভ হলো না।

‘মা, আমার কাছে লুকানোর চেষ্টা করো না। আমি জানি তোমার চোখে পানি কেন। ওরা কি ওদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে?’

‘তুই কীভাবে বুঝলি?’

‘এটা বোঝার জন্য অনেক কিছু জানতে হয় না, মা। তোমরা আমাকে যতটা বোকা মনে করো, আমি তো আসলে ততটা বোকা নই। নিশ্চয় ওরা এও জানিয়েছে, তোমাদের মেজমেয়েটা হলে তাদের কোনো আপত্তি নেই। এজন্য বরং আরো দু-এক বছর অপেক্ষা করতেও তারা রাজি আছে।’

কাজরির একদমে বলা কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই মা আঁচলে মুখ চেপে রান্নাঘরের দিকে দ্রুত পা চালিয়ে দেন। ওই রান্নাঘরটাই মায়ের শান্তিনিকেতন। ওখানেই তিনি দুনিয়ার যত আরাম খুঁজে পান। তার দুর্লভ হাসিমুখটা কেবল ওখানেই দেখার সুযোগ আছে। যা হোক, আপাতত কাজরির আর কিছু বলার বা করার নেই। সে শুধু আফসোস করে, তার মনের কথাগুলো এভাবে খোলামেলা সে তার বাবাকে বলতে পারে না বলে। মাকে বললে তাকে অযথা বাড়তি কষ্ট দেওয়া হয়। কেননা, তার একমাত্র কাজ হলো সংসারটা চারদিক থেকে যে-কোনো প্রকারে সামলে রাখা, অথবা বলা যায় ধরে রাখা। সিদ্ধান্ত নেওয়ার এবং দেওয়ার একমাত্র অধিকারী তার ‘অল পাওয়ারফুল’ পিতা। একটা ছেলেসন্তানের অভাবে তিনি এখনো হা-হুতাশ করে বেড়ান আর স্ত্রীর ওপর মেজাজ ঝাড়েন সবরকম উপায়ে।

বোনগুলো কাজরিকে ঘিরে হল্লা করতে থাকে টাকাটার একটা সদ্গতি করার জন্য। ইস্, এক হাজার টাকা! এক হাজার টাকায় কতগুলো দশ টাকা পাওয়া যায় এই বিটকেলে অঙ্ক করতে বসিয়ে দেয় মেজজন তাদের সবচেয়ে ছোট বোনটাকে। বেচারি                যোগ-বিয়োগের পর মাত্র গুণ শিখতে শুরু করেছে। ঠিকমতো অঙ্ক কষে বলতে পারলে তাকে দশ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে শুনে সে খুবই সিরিয়াস ভঙ্গিতে পেনসিলটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছে। ফলাফল কয়েকবার পেনসিলের মাথা কাটানো। কাজরি নির্মল আনন্দ উপভোগ করে তার ছোট বোনগুলোর নির্দোষ আমোদ-আয়োজনে। তাকে পছন্দ করেনি, তাতে কিই-বা আসে যায়। এই যে তার বোনগুলো সামান্য একটা উপলক্ষ ঘিরে এত খুশি হয়ে চেঁচামেচি করছে এটাই বা কম কী। সত্যি কথা বলতে কী, এই নির্ভেজাল আনন্দের সঙ্গে অন্য কিছুরই তুলনা হয় না।

 

তিন

যা হোক, দু-একদিনের মধ্যে কাজরি মোটামুটি মন ঠিক করে ফেলে। ওই টাকাটার কী ব্যবস্থা করবে সে-ব্যাপারে। আহা, বোনগুলো শুনলে কষ্টে একবারে দমে যাবে। কী কী খাবে এবং কীভাবে জিনডিয়ান চায়নিজ রেস্টুরেন্টে যাবে – সবকিছু ইতোমধ্যে ওরা প্ল্যান করে ফেলেছে। বড়বোনের মনের অভিলাষ জানলে ওদের উচ্ছ্বাসের বেলুন এক নিমেষে চুপসে যাবে। ওদের সেই করুণ মুখ কল্পনা করে ভীষণ খারাপ লাগার এক অনুভূতিতে কাজরির মনটা আচ্ছন্ন হয়ে যায়। কিন্তু সে তার পরিকল্পনা থেকে সরে আসে না। হ্যাঁ, একদিন সে ওদের ঠিকই চায়নিজ খাওয়াবে। তবে তার নিজের পয়সা খরচ করে। কোনোভাবেই এই কনে দেখার টাকায় নয়। বরং টাকাটা দিয়ে সে এমন কিছু করতে চায়, যাতে তার অপমানের জ্বালা সামান্য হলেও প্রশমিত হয়। অনেক এলোমেলো ভাবনা তার মাথায় ঘুরপাক খায়। পুরো টাকাটাই কাউকে সে দিয়ে দিতে চায়, যার এটা সত্যিই প্রয়োজন। বেশ কয়েকজনের কথা তার মনে আসে। প্রথমেই তাদের বাড়ির ছুটা বুয়াটার কথা সে ভাবে। কিন্তু আশপাশের সবাই জেনে যাবে বলে সে-চিন্তাটা বাদ দিতে হয়। এরপর তার এক বান্ধবীর কথা মনে হয়। তার ছোটভাইটার ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফিসের টাকা জোগাড় হচ্ছে না বলে ইদানীং সে প্রায়ই মনমরা হয়ে থাকে। এরপর আরো দু-একজনের কথা সামান্য ভেবেই বাদ দিয়ে দেয়। বান্ধবীর ভাইটার কথাই বেশ কিছু সময় ধরে মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। তারপর একসময় সে-চিন্তাও সরিয়ে রাখে।

কাজরি আসলে এমন কিছু করতে চাচ্ছিল, যাতে বিষয়টা তার মনে ধরে এবং মনে থাকে অনেকদিন। এভাবে হাত পেতে কারো কাছ থেকে সে কোনোদিন টাকা নেয়নি। ফলে ছেলেপক্ষ দেখে যাওয়ার পর থেকে তার মনের মধ্যে সঙ্কোচের একটা কাঁটা খচখচ করছে। তারপর আবার সেটার একটা অপমানসূচক পরিসমাপ্তি ঘটেছে। ওপরে-ওপরে সে যতই স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করুক, মনে-মনে সে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে। তার এই কষ্টের স্বরূপ তার পক্ষেও বুঝতে পারা সম্ভব হচ্ছে না। এমন তো নয় যে, সে সত্যি সত্যি চেয়েছিল, বিয়েটা এখানে হোক, এখনই হোক। আদতে সে এখন বিয়ের কথাই মাথায় আনতে চায় না। অথচ তার একরোখা রাগী বাবার কারণে তাকে আজ এই অসম্মানের মুখোমুখি হতে হলো। বাবা কি কখনো তার বড়মেয়ের মনের ভেতরের ক্ষোভটা বুঝতে পারবে? মনে হয় না। আর বুঝলেই বা কী। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। একদল অপরিচিত লোক বাসায় এসে তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করে রায় দিয়ে গেছে, একবারে পছন্দ করবার মতো তেমন কোনো মেয়ে নয় সে। হয়তো মা তার কষ্ট কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছেন; কিন্তু তার পক্ষে সবার সামনে সেটা প্রকাশ করাও সম্ভব নয় কেবল বাবার কারণে।

কিছু সময়ের জন্য রান্নাঘরে মাকে সাহায্য করতে যায় কাজরি। কাজের মধ্যে ভুলে থাকে টাকাটার কথা। হাত-মুখ ধুয়ে যেই পড়ার টেবিলে এসে বসে, অমনি কোথা থেকে উড়ে আসে সেই বিদঘুটে চিন্তাযুক্ত বিষয়টা। টাকাটা দিয়ে সে নিজের জন্য কিছু করবে না এটাই কেবল সে এই মুহূর্ত পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে জানে। তাছাড়া, এই দিনে এক হাজার টাকা দিয়ে কিই বা আর হবে? ছোট বোনগুলোকে শুধু একটু খুশি করতে পারতো। কিন্তু তা তো সে করবে না। এই অপমানের টাকা দিয়ে কোনো আনন্দ-ফুর্তি করতে পারবে না সে। আহ্, নিজের প্রয়োজন ছাড়া টাকাটা অন্য কীভাবে কাজে লাগানো যায় সেটাই এখন তার জন্য বিরাট মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ, ওর বান্ধবীদের দেখেছে, কত অনায়াসে এটা-ওটা কিনছে, দরকারে কিনছে, অদরকারেও কিনছে। টাকা উপার্জনের চিন্তা নেই, টাকা খরচের তো নেই-ই। আর সে সামান্য হাজার টাকা দিয়ে কিছু করার কোনো জুতসই উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। কী তাজ্জব কথা!

চার

একসময় ওই এক হাজার টাকার যথোপযুক্ত ব্যবস্থার বিষয়টা কাজরির ভেতরে একটা অবসেশনের মতো তৈরি করলো। ফলে  এ-মুহূর্তে তার মনের মধ্যে অজ্ঞাত কারণে এক অদ্ভুত চিন্তা একবার ঘুরপাক খাচ্ছে; আরেকবার চুপ করে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটার কোনো মাথামুন্ডু সে ধরতে পারছে না। এটা অবশ্যই স্বাভাবিক কোনো চিন্তা না। কাজরি যা ভেবেছে তা যদি কারো কাছে খুলে বলে, সে-ব্যক্তি যতটা সম্ভব ততটাই ভ্রূ কুঁচকে অথবা চোখ কপালে তুলে তার দিকে তাকাবেই তাকাবে। এত ভালো একটা ঘর এসে ফিরে গেলো বলে মেয়েটার মাথা খারাপ হয়ে গেল কিনা সেই সন্দেহ আসতে পারে। হুঁ, হতেই পারে। ছেলে সুপুরুষ, যোগ্যতার মানদন্ডে একেবারে ওপরের সারিতে। এরকম ছেলের পরিবার যে তাকে দেখতে এসেছিল – এতেই তার ধন্য হয়ে যাওয়ার কথা। যেমনটা হয়েছেন তার বাবা। আর তাই সবকিছু ভালোয় ভালোয় না হওয়াতে এখন মেয়ের মাথায় এ-ধরনের উদ্ভট বিপ্লবী চিন্তা চলে এসেছে। সোজা কথা, সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। সে-কারণে তার চিত্তবৈকল্য দেখা দিয়েছে। আবার কাজরিকে যারা কাছে থেকে চেনে বা জানে, তাদের মনে হতে পারে – এত মানুষ থাকতে তার মতো মেয়ে কেন এসব ভাবনায় জড়িয়ে যাবে। অনেক ভেবে-টেবে শেষ পর্যন্ত তারা কিছু বের করতে পারবে না বলে হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে থাকবে এপাশ-ওপাশ। ‘কাজরির কালো মেঘ পথ খুঁজে পেলো’ – না বলে তারা আকাশের দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থাকবে। তারপর কিছু না পেয়ে অথবা কিছু বুঝতে না পারার অসমর্থতায় অবধারিতভাবে তারাও ওর মানসিক অসুস্থতা নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করবে। দুনিয়া ভীষণ রহস্যে মোড়া!

ইত্যাদি নানা সমাচার ভাবনা-দুর্ভাবনা কাজরিকে সামান্য কাবু করে ফেলে। কিন্তু সে তার সিদ্ধান্তে অনড়। যা ভেবেছে তা সে করেই ছাড়বে। এ হচ্ছে নিজের সাথে একধরনের বাজি ধরা। অর্থহীন জেদ অথবা একগুঁয়েমিপনার বিশেষ নমুনা বলা যেতে পারে, কাজরি তা ভালো করেই জানে। কিন্তু এরকম জেদ আগে কখনো অনুভব করেছে বলে তার মনে পড়ে না। এটাও তাকে  সবিশেষ আনন্দ দেয়। আহা, তার এই ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ জীবনে সামান্য আনন্দের কারণ ঘটাই যেন একটা বিরাট ব্যাপার! আনন্দ কখনো- কখনো তাদের পরিবারে মাসে একবার বা দুবার গরুর মাংস খাওয়ার মতো সাময়িক একটা আয়োজন হয়ে আসে। তাই তার অদ্ভুত ভাবনার অপরিহার্য ফল চিন্তা করে সে যখন নিজের সাথে হাসতে থাকে, তাকে খুব একটা স্বাভাবিক লাগে না। কাজরি খাতার কাগজ ছিঁড়ে খামের মতো কিছু একটা বানানোর চেষ্টা করে। তারপর পাঁচশো টাকার নোট দুটা তাতে ভরে খামটা তার বালিশের ঢাকনার মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলে। দারুণ নিরাপদ ব্যবস্থা। কারণ, ঘরের বিছানা গোছানোর প্রাত্যহিক দায়িত্ব একমাত্র সে পালন করে। কাজেই সেখানে কারো হাত পড়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

 

পাঁচ

রিকশাওয়ালাকে বিদায় দিয়ে কাজরি পার্কের গেট বরাবর হাঁটতে থাকে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ভেতরে ঢুকে একটা সুবিধাজনক জায়গা খুঁজে নিয়ে দাঁড়ায়। যেখানে দাঁড়ালো, সেটা একটা বকুলগাছের তলা। একেবারে গাছের নিচে তার বয়সী একটা মেয়ে একদম একা। বিষয়টা কেমন যেন! সে যেকোনোভাবে হোক জেনে নিয়েছে, ওদের মতো কাউকে এখানে দিনের যেকোনো সময় পাওয়া যেতে পারে। সন্ধ্যার পরে বা রাত হলে ভালো হতো। কিন্তু ওর পক্ষে বিকাল ছাড়া এদিকে আসা সম্ভব না। সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরতে হবে। ব্যাপারটা কায়দা করে জানতে গিয়ে তাকে বেশ কয়েকবার বেকায়দায় পড়তে হয়েছে। অবশ্য তার নিষ্পাপ, নিরপরাধ জিজ্ঞাসার আড়ালে অন্য কোনো উদ্দেশ্য কেউ টের পায়নি। তাদের কাউকে কোন বিশেষ সহজ উপায়ে শনাক্ত করা যেতে পারে – সেটাও তাকে হিসাব করে বের করতে হয়েছে। এজন্য তাকে বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে – বুদ্ধিমতী গাধির শ্রম। সে যে কেন এসব করেছে তা খোদা মালুম!

মোটামুটি সবকিছু জেনে নেওয়ার পর, অথবা – সতর্ক প্রশ্নোত্তরে যতটুকু জানা সম্ভব,কাজরি সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে সময় নেয়নি। বিষয়টা, পোশাকি ভাষায়, সংবেদনশীল। এ-বিষয়ে তার সামান্য আগ্রহ, অথবা অন্য যে-কারো আগ্রহ, লোকের কুঞ্চিত বা প্রসারিত ভ্রূযুগল-যুক্ত প্রতিক্রিয়ার বাইরে নয়। তারপরও নিজের ভেতরে জেগে ওঠা এই অব্যাখ্যাত অস্বাভাবিক ইচ্ছার কোনো আপাতগ্রহণযোগ্য যুক্তি কাজরির নিজের কাছেও নেই।

কাজরি অপেক্ষা করছে আর ঘনঘন হাতঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে। কারণ, তার আর কিছু করার নেই। সে এখন বকুলগাছটা থেকে সামান্য তফাতে পাতা সিমেন্টের বেঞ্চটাতে এসে বসেছে। কুড়ি-একুশ বছরের একটা মেয়ে হৈমন্তী বিকালের এই অসম্ভব মায়াঘেরা সময়টায় একা একা বসে আছে পার্কের বেঞ্চে। রূপকল্পটা কেবল নাটক-সিনেমায় মানায়। তবে ঘটনা সত্য। কারণ, তা ঘটছে একেবারে আমাদের চোখের সামনে। আশপাশে অনেক মানুষের সরব উপস্থিতি কাজরিকে সাময়িক নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করে রেখেছে। কিন্তু এভাবে সে কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? অল্পখানিক পরেই ঝুপ করে অগ্রহায়ণের অন্ধকার নেমে পড়বে। তখন?

প্রথাগত বর্ণনা মেপে কেউই এখন পর্যন্ত তার সামনে দিয়ে চলে যায়নি। কাছে-দূরেও অস্পষ্টভাবে এমন কাউকে চোখে পড়েনি। বরং তার দৃষ্টির সীমানায় একটা স্বর্গীয় দৃশ্যের আবির্ভাব হয়েছে। এক তরুণ দম্পতি নতুন হাঁটতে শেখা তাদের পুত্রসন্তানটিকে মাঠের মাঝখানে ছেড়ে দিয়েছে। সামান্য দূরত্বে বসে তারা অমনোযোগী আলাপে ব্যস্ত। কাছেই আরেকটা বেঞ্চে একজন বৃদ্ধ লোক তার হাতের লাঠিটা সজোরে অাঁকড়ে ধরে শূন্যে দৃষ্টি মেলে বসে   আছেন। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। আহারে, বয়সের ভারে   কিছুটা নুয়ে পড়েছেন। শ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। তবু            এসেছেন, খোলা হাওয়ায় যতটা সম্ভব শ্বাসথলির ভেতর বিশুদ্ধ অম্লজান ভরে নিতে। যেভাবে লিক হয়ে যাওয়া গাড়ির চাকায় হাওয়া ভরানো হয়।

কাজরির অপেক্ষা এখন অধৈর্য অস্থিরতায় পর্যবসিত। সন্ধ্যা ঘনায়মান। আজ বুঝি কেউ আর এ-রাস্তা মাড়াবে না। সেটাও স্বাভাবিক। শহরের কেন্দ্রীয় পার্কের যত্রতত্র যখন-তখন তাদের অনিবার্য উপস্থিতি সম্পর্কে যা শুনেছে তা এখন ভুয়া মনে হচ্ছে। তাহলে আজ তাকে চলেই যেতে হবে। হয়তো সে আরেক দিন আসবে। মনে-মনে ভীষণভাবে চাইবে, তাদের কারো একজনের সাথে তার দেখা হোক। তাকে ডেকে দুটি কথা বলে ত্বরিতগতিতে তার হাতে পাঁচশো টাকার নোট দুটি গুঁজে দিয়ে সে উধাও হয়ে যাবে। তাকে কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। কিন্তু কাজরি সত্যিই জানে না, খুব একটা জানার চেষ্টাও করেনি, তার এই আশ্চর্য দান-সংক্রান্ত ইচ্ছাপূরণের জন্য এক কঠিন অভিযানে নামার কারণ।

 

ছয়

কাজরি পৌঁছানোর আগেই পার্কের ইতস্তত তার ঘুরে বেড়ানোর খবর বাসায় চলে আসে। তাদের পরিবারের জনৈক হিতাকাঙ্ক্ষীর বদৌলতে। পরিণতি অনুমান করা কঠিন নয়। বাবার নিদারুণ কর্কশ সব প্রশ্নের মুখোমুখি পড়ে বোবা হয়ে যায় কাজরি। তিনি প্রস্ত্তত হয়েই ছিলেন। এবং অনেকদিন পর মনের সুখ মিটিয়ে এতবড় মেয়েকে পেটালেন। তার সাথে তার মায়ের ভাগটাও বাদ গেলো না। মারের সাথে চললো অশ্রাব্য ভাষায় অবিরত গালিবর্ষণ।  মা-মেয়ে দুজনকে পেটাতে পেটাতে একসময় তিনি নিজেই কাহিল হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। কিন্তু তখনো তার মুখ থেকে তীরের মতো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল অসভ্য বাক্যগুলি। যদি কানে তুলা দেওয়া যেতো! এই বাবাকে তখন আর মেলানো যায় না অফিসগামী নিতান্ত ছাপোষা ভদ্রলোকটির সাথে।

কাজরি বলারই সুযোগ পায়নি কেন সে পার্কে গিয়েছিল। তাই মারের সময় যখন তার হাত থেকে পার্সটি ছুটে গেলো এবং সেটার ভেতর সম্ভাব্য কোনো ক্লু পাওয়া কিনা ভেবে বাবা সাথে সাথে তা খুলে ফেললেন, বেরিয়ে এলো অভিশপ্ত সেই পাঁচশো টাকার দুটি নোট। তার ক্রোধের আগুনে ঘি পড়লো। পিতা হিসেবে যথাযথ দায়িত্ব পালনের পক্ষে তিনি আরো মোক্ষম যুক্তি হাতে পেলেন। বাবা নিজের মতো করে বুঝে নিলেন, কেন ওই পাত্রপক্ষ মেয়েকে পছন্দ করেনি। নিশ্চয়ই তারা খোঁজখবর করে জানতে পেরেছিল, মেয়ের এজাতীয় পার্কে যার-তার সাথে ঘুরে বেড়ানোর মতো বদভ্যাসের ব্যাপারগুলি। আর সে-কারণেই তারা এতদূর এগিয়েও পিছপা হলো। এখন আবার দেখা যাচ্ছে, বাবার পকেট থেকে টাকা চুরির অভ্যাসও মেয়ে রপ্ত করে বসে আছে। আর সবকিছুতে সায় দিয়ে দিয়ে মেয়েকে মাথায় তুলেছে অকর্মার ঢেঁকি অতিশয় বদমায়েশ এই মহিলা। মুখে ফেনা ছোটাতে ছোটাতে আর দুই হাতের নিখুঁত শৈল্পিক প্রয়োগে বাবা হাঁপিয়ে উঠলেন। তার বয়স যে দুবছর আগে পঞ্চাশ পেরিয়েছে – এটা এখন এই রণাঙ্গনে তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। সাধারণত এরকম মুহূর্তে তিনি এক অসুরিক শক্তি লাভ করেন দৈবক্রমে!

একসময় ঝড়ের তান্ডব থেমে গেলো। শরীরে অসহ্য ব্যথা আর মুখের ভেতর নোনা স্বাদ নিয়ে কাজরি চোখ মেললো। তারপর বোঝার চেষ্টা করলো ওই সময় সে কোথায়। পাশ ফিরতে গিয়ে টের পেলো, তার পায়ের দিকে মা পড়ে আছে বেহুঁশ। আশপাশে বোন তিনটার কোনো দেখা নেই। ভয়ে-আতঙ্কে তারা হয়তো তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল বিছানার ওপর ঠাঁই নিয়েছে। যা হোক, সে কোনোরকম উঠে বসলো এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেখলো, তার অভাগিনী মা স্বামীর হাতে সযত্নে মার-টার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। এত কষ্টের মধ্যেও কাজরির ভীষণ হাসি পেলো। শুধু মায়ের পক্ষেই সম্ভব এভাবে ঘুমিয়ে পড়া! একেবারে গভীর ঘুম। ফোঁস-ফোঁস করে নাক দিয়ে বাতাস বের হচ্ছে। হয়তো এধরনের ব্যাপার তার জন্য নতুন না বলেই তিনি অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেছেন। কে জানে, হয়তো ওই ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের অস্বাভাবিকতায় বাবা তাকে পার্কে বেড়াতে নিয়ে গেছেন! যেটা কোনোদিন বাবা করেছেন বলে তার জানা নেই। তাদের জন্মের পরে তো নয়ই। পার্কের বেঞ্চে বসে বাবা-মা বাদাম খাচ্ছেন। মাঝেমাঝে বাবা মাকে বাদাম ছিলেও দিচ্ছেন। ঘুমন্ত ক্লান্ত মায়ের ঠোঁটের কোণে এক চিমটি মিষ্টি হাসি। কিন্তু, উফ্, আবার সেই পার্ক! আবার সেই বেঞ্চ!

ওইভাবে বসে বসেই কাজরির মনে আরো অদ্ভুত কিছু কথা এসে ভিড় করতে লাগলো। আচ্ছা, ওই যে মেয়েরা, তাদের কেউ কেউ কি এরকম অত্যাচারী বাবার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঘর ছেড়ে পালিয়েছিল? তারপর হয়তো পাকে-চক্রে আরো দুষ্টুলোকের হাতে পড়ে তাদের শেষ ঠিকানা হয়েছে ওই পল্লী। তারপর তারা এরকম পার্কে পার্কে ঘুরে বেড়ায়! কারণ, এই মুহূর্তে কাজরির বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এরপর সে কোথায় যাবে তা ভেবে বের করতে পারছে না। ওই পার্কে গিয়ে যদি বসে থাকে, তাহলে কী হতে পারে চিন্তা করে সামান্য কেঁপে ওঠে সে। এখন আবার নিজের ওপর রাগ জমতে শুরু করেছে ভয়ানকভাবে। যা ভেবে রেখেছিল, তা তো কোনোভাবে হলোই না। তারপর বাবার হাতে ধরা পড়ে এই অহেতুক মারের যন্ত্রণা। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, পাঁচশো টাকার নোট দুটি বেহাত হয়ে যাওয়াতে তার পুরো পরিকল্পনা এক্কেবারে নস্যাৎ হয়ে গেলো। হায়রে, হাত পেতে নেওয়া টাকার করুণ পরিণতি! কী ভাবলো আর কী হলো!

এখন কাজরি নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, ‘যাক, অগত্যা বাবাকেই টাকাটা দান করে দিলাম। নিজের জন্য খরচ না করে দানই তো করতে চেয়েছিলাম।’ ছেলেপক্ষ যেদিন এসেছিল, বাবা আতিথেয়তায় এতটুকু খুঁত রাখেননি। ওইসময় বাবাকে দেখে কেউ বলতে পারতো না, এই মানুষ মাসের তিরিশটা দিন গুনে-গুনে টাকা খরচ করেন। অথচ সেই বাবা, মেয়েকে দেখতে আসা উপলক্ষে বাড়িতে কত খানাদানার আয়োজনই না করলেন! সেদিন যেন ধুম পড়েছিল। রান্না করতে করতে মায়ের তো জান-যায় অবস্থা। তবুও মেয়ের সুখী জীবনের কথা ভেবে হাসিমুখেই সব করলেন। আর এখন? কাজরি ভাবছে, শেষ পর্যন্ত টাকাটার ভালো একটা ব্যবস্থাই হলো। তার জন্য শুধু-শুধু বাবার কতগুলো টাকা পানিতে ভেসে গেলো। ওই হাজারখানেক টাকা দিয়ে সামান্য হলেও তো সে বাবাকে কিছুটা সাহায্য করতে পারলো। এটাই বা কম কি! যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে। কাজরি ওড়না দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে হাসার চেষ্টা করে, ‘বাবা, টাকাটা আসলে তোমার জন্যই ছিল। বিয়েটা হয়ে গেলে ঝামেলা চুকে যেতো। যেহেতু এক ধাক্কায় হলো না, তাই তোমার মনের যন্ত্রণা সামান্য লাঘবের জন্য ওই  টাকাটা আমি তোমাকেই দিলাম। এতেই তোমার এই পোড়ারমুখী খুশি।’ কাজরি জোর করে হাসতে গিয়ে হু-হু করে কাঁদতে শুরু করলো।