নারীর মুক্তির স্বপ্ন ও সাহসের সৌন্দর্য

সমাজের ভ্রূকুটি এখনো বন্ধ হয়নি। ধর্ম, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, এমনকি সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে নারীর জন্য বন্ধ ঘরের অন্ধকারই অনিবার্য বিধান বলে প্রচারের প্রচেষ্টাও অব্যাহত। কিন্তু নিগ্রহ, অপমন, সংশয়, সন্দেহ ও সহিংসতাকে উপেক্ষা করে নারী আজ অমত্মঃপুরের অবগুণ্ঠন ছেড়ে বাইরের জগতে পা রেখেছে। সেটা ঘটেছে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে যেমন, তেমনি মন ও মননে শিক্ষা ও সংস্কৃতির অনুপম আলোর স্পর্শেও।
বলেছি, সমাজ পরিস্থিতি এখনো অনুকূল নয়, তবু নারী যে-অর্গল ভেঙেছে তার পেছনে আছে এ-সমাজেরই কিছু মানুষের দীর্ঘ সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও অপরাজেয় অঙ্গীকারের ইতিহাস। চারটি গ্রন্থে এরকম চারজন অপরাজিতার জীবন ও কর্ম, সাহস ও সাফল্যের গল্প তুলে এনেছেন লেখক ও গবেষক মালেকা বেগম। নিজে তিনি এদেশের নারী-আন্দোলনের অগ্রগণ্য একজন। তাঁর হাতে চার অবিস্মরণীয় বাঙালি নারীর জীবন তাই তথ্য, তত্ত্ব ও অনুসন্ধানের সূত্রে হয়ে উঠেছে ইতিহাসের এক উদ্দীপনাময় অধ্যায়, যা আজ ও আগামীকালের নারীর জন্য তো বটেই, প্রগতির যাত্রাপথে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজেরই প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে।
রোকেয়া খাতুন (১৮৮০-১৯৩২) যিনি বিবাহসূত্রে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামে পরিচিত হয়েছিলেন, তিনি আজ ‘বেগম রোকেয়া’ নামে দেশে-বিদেশে নারী-আন্দোলনের অগ্রপথিক হিসেবে সম্মানিত। মেয়েদের শিক্ষার জন্য তাঁর আজীবনের সংগ্রাম ও সাধনা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় বটে; কিন্তু নিজের জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ পাননি তিনি। এই অপূর্ণতার বেদনা তাঁকে কতটা পীড়িত
করেছিল রোকেয়ার লেখা চিঠি থেকে এই গ্রন্থে তা উদ্ধৃত করেছেন লেখক – ‘আমার মেট্রিক পরীক্ষা কেয়ামতের পরদিন দেওয়া হইবে। এখন পড়া তৈরি করিতেছি।’ প্রাতিষ্ঠানিক সনদলাভ তাঁর হয়নি বটে, কিন্তু কী বিপুল জ্ঞানতৃষ্ণা তাঁকে তাড়িত করেছিল তার পরিচয় আমরা পাই এ-গ্রন্থে – ‘প্রথমে বোন ও ভাইয়ের সহযোগিতায় বাংলা ও ইংরেজির চর্চা এবং বিয়ের পর উচ্চশিক্ষিত স্বামীর সর্বাত্মক সহযোগিতায় রোকেয়া একই সঙ্গে উর্দু, ফারসি, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় পড়া, লেখা ও ভাষণ দানের চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিলেন।’ জীবনীকার মালেকা বেগম বলছেন, ‘তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনের এই অধ্যায়টি ছিল সত্যিই খুব আগ্রহোদ্দীপক’; কারণ, ‘বাংলা ভাষায় লেখা তাঁর প্রথম নিবন্ধ ‘পিপাসা’ (১৯০২) এবং ইংরেজি ভাষায় লেখা ‘Sultana’s Dream’ রচনার সময় তাঁর বয়স ছিল যথাক্রমে ২২ ও ২৫ বছর।’
রোকেয়ার বিভিন্ন লেখায় যেসব বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে তাতেই বোঝা যায় ধর্ম, ইতিহাস, বিজ্ঞান, আইন, মহাপুরুষের জীবনী যেমন তাঁর অধীত, তেমনি কাব্য ও গদ্যসাহিত্যের নানা সৃজনশীল রচনারও অনুরক্ত পাঠক তিনি। জ্ঞানের চর্চা খুলে দিয়েছিল তাঁর দৃষ্টির অর্গল। মালেকা বেগম লিখছেন, ‘এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে তাঁর সমকালে বিভিন্ন দেশে মুসলিম নারী জাগরণের দৃষ্টান্ত রোকেয়াকে অনুপ্রাণিত করেছিল। … প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন লেখক ও মনীষীর রচনা থেকে তিনি নারীমুক্তির আদর্শ গ্রহণ করেছেন – এ কথা যেমন সত্য, তেমনি এ কথাও মিথ্যা নয় যে, বিদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগেই তিনি আপন জীবনের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকেই অবরোধবাসিনীদের যন্ত্রণা উপলব্ধি করেছিলেন।’
রোকেয়ার নারীমুক্তি আন্দোলনের দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক বলছেন, একশ বছর পরও বাংলাদেশের
নারী-আন্দোলন তো বটেই, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিচারেও তাঁর চিন্তা ও বক্তব্য প্রাসঙ্গিক। মালেকা বেগমের একটি তীক্ষন পর্যবেক্ষণ – ‘ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু নাগরিকের এবং বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম নাগরিকের পারিবারিক আইনে ইতিমধ্যে পরিবর্তন ঘটলেও
দুই দেশেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে, অর্থাৎ যথাক্রমে মুসলিম ও হিন্দু পারিবারিক আইনে কোনো সরকারই হসত্মক্ষেপ করেনি। দুই দেশেই নারী নেতৃত্ব নিজ নিজ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পারিবারিক আইন পরিবর্তনের দাবি তুললেও ভারতে মুসলিম ও বাংলাদেশে হিন্দু সমাজের
নারী-পুরুষদের তরফ থেকে এ বিষয়ে কোনো জোরালো দাবি বা আন্দোলন না থাকায় উভয় দেশের রাজনৈতিক সরকার ধর্মীয়
অনুভূতির দিক থেকে স্পর্শকাতর এ-বিষয়টি সম্পর্কে কোনো পদক্ষেপ নিতে চায় না।’
বেগম রোকেয়ার শিক্ষাচিন্তা, স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার কথা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কূপম-ূকতা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের কথা যেমন তুলে ধরেছেন লেখক, তেমনি সে-যুগে এই অবস্থান নিতে গিয়ে কত রকম কটূক্তি ও সমালোচনার কাঁটা বিছানো পথে দু-পা রক্তাক্ত করে তাঁকে এগোতে হয়েছে তা-ও বলেছেন। এমনকি এ-যুগেও সমালোচকদের কতটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে তারও উল্লেখ করতে গিয়ে বিশিষ্ট কবি ও লেখক হুমায়ুন আজাদের একটি বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যেখানে আজাদ লিখছেন, ‘রোকেয়া ছিলেন পাথরচাপা ঘাস বা স্বামীর ধাঁচে বিকশিত এক পরিতৃপ্ত বেগম, এখন সবাই তাঁকে নারীমুক্তির অগ্রদূত বলছে, অর্থাৎ তিনি ভুল প্রসিদ্ধি পেয়েছেন।’ সমকালের একজন লেখক-সমালোচকের এই মূল্যায়ন সম্পর্কে মালেকা বেগমের নির্মোহ বক্তব্য – ‘এসব মত ও মন্তব্য অবশ্য পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।’
বেগম রোকেয়ার ওপর বেশকিছু প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও গ্রন্থ রচিত হয়েছে আগে। লেখাগুলো থেকে রসদ সংগ্রহ করেছেন এই জীবনীকার; কিন্তু তথ্য-ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েনি এ-গ্রন্থ। প্রাঞ্জল উপস্থাপনার গুণে এ-গ্রন্থপাঠ একটি স্বাদু অভিজ্ঞতা।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সৈনিক সূর্য সেনের স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা (১৯০৩-২৮)। বলতে গেলে এটুকুই তাঁর পরিচয়, আর কিছু নয়। কিন্তু একজন মহান বিপস্নবীর সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়ে যে-জীবন তিনি অতিবাহিত করেছেন, সেটি অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা ও আত্মত্যাগের ইতিহাস। ‘She pays the debt of life not by what she does, but by what she suffers’ – জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ারের ‘অন ওম্যান’ নিবন্ধের বহুলউদ্ধৃত এই একটি পঙ্ক্তিই যেন পুষ্পকুন্তলার সারাজীবনের হাহাকারের প্রতিধ্বনি।
মালেকা বেগম জীবনীগ্রন্থটি লিখেছেন পুষ্পকুন্তলার বয়ানে, অনেকটা আত্মজীবনীর ধাঁচে। তাতে ফিকশনের স্বাদ আছে, কিন্তু তথ্যের সমর্থন অক্ষুণ্ণ। গ্রন্থের ষোলোটি অধ্যায় আত্মজীবনীর ঢংয়ে উত্তমপুরুষে লেখা হলেও শেষ অধ্যায়টি লিখেছেন তৃতীয় পুরুষের বর্ণনারীতিতে। কারণ ষোলোতম অধ্যায়েই সমাপ্তি ঘটেছে পুষ্পকুন্তলার দুর্বহ জীবনের। ষোড়শী সুন্দরী পুষ্পকুন্তলা বিয়ের অব্যবহিত পরেই জেনেছিলেন তাঁর স্বামী বিয়ে করতে রাজি ছিলেন না, পারিবারিক চাপে এই আনুষ্ঠানিকতায় সম্মতি দিয়েছিলেন তিনি। সূর্য সেন বিপস্নবী, দেশমাতৃকার আহবানে সাড়া দিতে গিয়ে সংসারজীবনকে তুচ্ছ করার মনের জোর ছিল তাঁর। কিন্তু পুষ্পকুন্তলা তো আর দশজনের মতোই স্বামীর সাহচর্য ও সংসার-সন্তান কামনায় উদ্বেল নারী। যখন স্বয়ং স্বামীর মুখেই শুনতে পান স্ত্রীসঙ্গ তাঁর জন্য পরিত্যাজ্য এবং ব্রহ্মচর্য সাধনায় দীক্ষা নিয়েছেন তিনি, তখন এই মেয়েটির মানসিক অবস্থা সহজেই অনুমেয়। সূর্য সেন যদিও অনুতপ্ত, কিন্তু একটি নারীকে তাঁর কাঙিক্ষত জীবন কে ফিরিয়ে দেবে? এই বঞ্চনা সত্ত্বেও পুষ্পকুন্তলা তাঁর স্বামীর মহৎ জীবনের অংশীদার হতে চেয়েছিলেন, বিপস্নবের সহযোদ্ধা হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন পর্যন্ত বিপস্নবী কর্মকা– নারীর অংশগ্রহণ স্বীকৃত নয় বলে সেই সুযোগ তিনি পাননি। এটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। এই অসম নিয়মের বিরুদ্ধে পুষ্পকুন্তলার ক্ষক্ষাভ উচ্চারিত হয়েছে, সেই ক্ষক্ষাভের যুক্তি একসময় উপলব্ধি করেছিলেন সূর্য সেনও। কিন্তু ততদিনে অকালমৃত্যুতে মুছে গেছে পুষ্পের বিকশিত হওয়ার স্বপ্ন।
এ-গ্রন্থে পুষ্পকুন্তলার জীবনের হৃদয়গ্রাহী একেকটি অধ্যায় শুরু হয়েছে খ্যাতিমান কবি-শিল্পীদের একেকটি গীতিকবিতার সত্মবক দিয়ে। এই গীতিকবিতার সত্মবক প্রতিটি অধ্যায়ের সারাংশের মতো মর্ম স্পর্শ করে পাঠকের। জীবনীকারের এই সৃজনশীলতা নিরেট জীবনকাহিনিকে অন্যমাত্রায় উত্তীর্ণ করেছে। তবে একটি বা দুটি কাব্যাংশ সুপ্রযুক্ত নয় বলে মনে হয়েছে আমাদের।
পুষ্পকুন্তলার যেখানে শেষ, হয়তো সেখান থেকেই শুরু প্রীতিলতার (১৯১১-৩২)। পুষ্পকুন্তলা স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, খুব বেশিদূর এগোনোর সুযোগ পাননি। কিন্তু প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার চট্টগ্রামের ডা. খাসত্মগীর স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ঢাকার ইডেন ও কলকাতার বেথুন কলেজে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পেয়েছিলেন।
প্রীতিলতার জীবনীটি মালেকা বেগম লিখেছেন বিভিন্ন পর্বের উপ-শিরোনাম দিয়ে। ফলে পর্যায়ক্রমে তাঁর শৈশব-কৈশোর, শিক্ষাজীবন, সমসাময়িক রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতি, বিপস্নবী জীবনের পাঠ, সাংগঠনিক তৎপরতা, নারী-আন্দোলনের নেতৃত্ব দান ইত্যাদি ঘটনাপ্রবাহ ধারাবাহিকভাবে জানা যায়। ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপস্নবে অংশগ্রহণের আগে এসব বাসত্মবতার অভিঘাত কীভাবে তাঁর মধ্যে সংকল্প ও অদম্য মনোবল গড়ে তুলেছিল তার বিশ্বসত্ম বিবরণ আমরা পাই গ্রন্থে। ফাঁসির আসামি বিপস্নবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, ছদ্মনাম গ্রহণ করা বিপস্নবী ‘নির্মলদা’ প্রমুখের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ তাঁর মধ্যে যেমন সঞ্চারিত করেছিল উদ্দীপনার মন্ত্র, তেমনি প্রবাদপ্রতিম বিপস্নবী সূর্য সেনের সঙ্গে সাক্ষাতের দুর্লভ সুযোগও তৈরি করে দিয়েছিল। নিজের স্ত্রী পুষ্পকুন্তলাকে বিপস্নবের সাথি করে নেওয়ার ভরসা পাননি সূর্য সেন; কিন্তু প্রীতিলতার শিক্ষা, বুদ্ধিমত্তা, সাহস ও অঙ্গীকার সেই আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটি তৈরি করেছিল। অবশ্য ইতোমধ্যে নারীদের অংশগ্রহণ বিষয়ে পূর্বের অবস্থান থেকে সরে এসেছিল বিপস্নবী দল।
চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে সশস্ত্র অভিযানের আগে প্রীতিলতার প্রস্ত্ততি, নির্ধারিত দিনে ক্লাবে আনন্দ-উৎসবে মত্ত ইংরেজদের ওপর প্রীতিলতার নেতৃত্বে আক্রমণ, তাঁর গুলিবিদ্ধ হওয়া এবং সায়ানাইড খেয়ে আত্মহননের ঘটনাক্রম বর্ণনায় লেখক নাটকীয়তার আশ্রয় নেননি, কিন্তু বাহুল্যবর্জিত ভাষায় লেখা এই বর্ণনাও আবেগসিক্ত করে তোলে পাঠকহৃদয়। এই গদ্যভঙ্গির জন্য অকুণ্ঠ প্রশংসা প্রাপ্য জীবনীকারের। প্রীতিলতার সহপাঠী ও বিপস্নবী সহযোদ্ধাদের কিছু স্মৃতিচারণ মুদ্রিত হয়েছে এ-গ্রন্থে। নিঃসন্দেহে কৌতূহলোদ্দীপক এ-অধ্যায়। তবে এখানে কিছু কিছু বিষয়ে পুনরাবৃত্তি এড়ানো সম্ভব হয়নি।
নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের (১৯২৫-২০০২) জীবন নানা বাঁকবদলের মধ্য দিয়ে পরিণতির পর্বে পৌঁছানো এক বর্ণাঢ্য নারীজীবনের ইতিহাস। লেখক জীবনীগ্রন্থের ভূমিকাংশে লিখেছেন, ‘ইলা মিত্রের ইতি নেই। অন্তহীন তাঁর ইতিহাস, ইতিবৃত্ত ও ইতিকথা।’ ‘অন্তহীন’, কারণ মৃত্যু এ-জীবনের শেষ লিখে দিতে পারে না। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের এক শিক্ষিত নারী, সমাজের শোষিত নিরক্ষর নিম্নবর্গের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শামিল হয়ে কীভাবে তাদেরই একজন হয়ে উঠেছেন, আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করে তাদের নেত্রী ‘রানীমার’ মর্যাদায় অভিষিক্ত হতে পারলেন, সেই কণ্টকাকীর্ণ পথপরিক্রমার যে-ইতিহাস এ-গ্রন্থে উঠে এসেছে তা পরবর্তী প্রজন্মের মুক্তিসংগ্রামীদের কাছে অক্ষয় প্রেরণা।
বেগম রোকেয়া, পুষ্পকুন্তলা ও প্রীতিলতার জীবনকাল অতিবাহিত হয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে। কিন্তু ইলা মিত্র ব্রিটিশ শাসন, ভারত-বিভক্তি ও দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তানের নানামুখী জটিল বাসত্মবতার অগ্নিদগ্ধ সাক্ষী। তিনি লিখেছিলেন, ‘পাকিস্তানি রাষ্ট্রনীতির অন্ধ বিবেচনায় আমরা অমুসলমানরা পাকিস্তানের বিশ্বসত্ম নাগরিক হবার যোগ্য নই। দৃষ্টির এই বিভ্রমই অসামাজিক অনেক পাপকে উসকিয়ে তুলেছিল।’ তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহ রূপ দেখেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রনীতি ও সুবিধাভোগী শ্রেণির এই ভেদনীতি তাঁকে গরিবের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। কারণ, ‘শাসকদের অত্যাচারের পাশে পাশে সেবা ভালোবাসার যে হৃদয়গুলো আমাকে ঘিরে রয়েছে, তাঁদের কথাও যে তেমন সত্য। দিনের পর দিন আমার শিরায় বাইরের রক্ত জোগাতে হয়েছে। এ কথাটা কীভাবে ভুলি সেই লালজীবন মুসলমান ভাইদের দেহ থেকে সঞ্জীবিত হয়েছিল। রক্তের জাত আছে কিনা জানি না, যদি থাকে আমি অবশ্যই জাতহীন।’ এই উপলব্ধি তাঁকে সাম্প্রদায়িকতার ভেদবুদ্ধি থেকে মুক্ত করেছিল, স্বদেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ করেছিল।
বস্ত্তত কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা রমেন মিত্রের সঙ্গে বিয়ের পরই নাচোলের কৃষকদের বঞ্চনা ও অপ্রাপ্তির বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন ইলা মিত্র। ফসলের অন্যায্য হিস্যা আদায় করার
জন্য কৃষকের ওপর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জমিদার শ্রেণির চরম অত্যাচার-নির্যাতনের রূপ স্বচক্ষক্ষ দেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। রমেন মিত্র জমিদার পরিবারের মানুষ হয়েও কৃষকদের স্বার্থের জন্য লড়াই করেছিলেন। সেই লড়াইয়ে যুক্ত হয়ে ইলা মিত্র সাঁওতাল নারী-পুরুষকে সংগঠিত করেছিলেন জমিদারদের বিরুদ্ধে, পক্ষান্তরে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধেও। কাজটি সহজ কিছু ছিল না। গ্রন্থকারের মতে, ‘… কৃষকেরা জমিদার বাড়ির বউ বলে ইলা মিত্রকে প্রথমে বিশ্বাস করেননি। এক বছর সময় ধরে তাদের সঙ্গে একই বাড়িতে থেকে, একই বিছানায় শুয়ে, তাঁদের সঙ্গে খেয়ে, তাঁদের ভাষা শিখে তিনি যে তাঁদেরই একজন – এ বিশ্বাস জন্মাতে হয়েছে।’
জমিদার ও তাঁদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে তীর-ধনুক দিয়ে কৃষকদের লড়াই ছিল অসম। কৃষকদের আন্দোলনে প্রাথমিক সাফল্য, শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হত্যা-নির্যাতনে পর্যুদসত্ম গ্রামবাসীর ভিটেমাটি ছাড়া হওয়া, ইলা মিত্রসহ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার, তাঁর ওপর চরম নির্যাতন, এমনকি সম্ভ্রমহানির তথ্যও এ-গ্রন্থে উঠে এসেছে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায়।
শ্রেণিচরিত্র অগ্রাহ্য করে কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্বদান ও অমানুষিক নির্যাতনের মুখে অনমনীয় ইলা মিত্র হয়ে উঠেছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি। সমসাময়িক কবি-লেখক ও শিল্পীদের লেখায়-রেখায় ফুটে উঠেছিল এই অসামান্য নারীর প্রতিকৃতি। এ-গ্রন্থে এসব লেখার
উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে তো বটেই, এছাড়া একটি অধ্যায়ে দুর্লভ কিছু লেখা সংকলিত হয়েছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, গোলাম কুদ্দুস, নুরুন্নবী চৌধুরী ও শহীদ সাবেরের কবিতা, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আলাউদ্দীন আল আজাদের গল্প, সরদার ফজলুল করিম ও ফয়েজ আহমদের রচনা ইত্যাদির সংগ্রহ ও সংকলন এ-গ্রন্থকে সমৃদ্ধ করেছে। এছাড়া ইলা মিত্রের জবানবন্দি, তাঁর লেখা চিঠিপত্র, সাক্ষাৎকার ও প্রবন্ধ থেকে তাঁর রাজনীতি ও দর্শন সম্পর্কে গভীরভাবে জানার ও বোঝার সুযোগও হয় পাঠকের।
ভূমিকায় লেখক বলেছেন, ‘তাঁর জীবনী লেখার প্রয়াসে নয়, তাঁর সংগ্রাম জানা-বোঝার জন্যই এই বই লেখায় অনুপ্রাণিত হয়েছি।’ এ-কথাটি শুধু ইলা মিত্রকে নিয়ে রচিত গ্রন্থটি নয়, আমাদের ধারণা আলোচ্য চারটি গ্রন্থের ক্ষেত্রেই সমান প্রযোজ্য। বলেছি, লেখক মালেকা বেগম নিজেও এদেশের নারী-আন্দোলনে সামনের সারির একজন। ফলে পূর্বসূরিদের সংগ্রামী জীবন তাঁর অনুসন্ধিৎসার বিষয়, প্রেরণার উৎস। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশিস্নষ্ট বইপত্র পাঠ ও গবেষণার পাশাপাশি তিনি সরাসরি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। যেমন পুষ্পকুন্তলার জীবনী রচনার জন্য তিনি কলকাতা গিয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সূর্য সেনের ভ্রাতৃবধূ ও পুষ্পকুন্তলার জা বিরাজমোহিনীর। একইভাবে ১৯৯৬ সালে ইলা মিত্রের ঢাকা সফরকালে তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে সমর্থ হয়েছিলেন তিনি। এ-ধরনের শ্রমসাধ্য প্রয়াসের ফলে এঁদের জীবন ও কর্মের বিশ্বসত্ম দলিল হয়ে উঠেছে তাঁর রচনা।
চারজন অসামান্য নারীর জীবন পর্যালোচনা করতে গিয়ে তাঁদের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, পুরুষের অবজ্ঞা-উপেক্ষা ও নিপীড়নমূলক চরিত্র যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি সহানুভূতিশীল পুরুষদের কথা উল্লেখ করতেও কুণ্ঠিত নন লেখক। পুষ্পকুন্তলার প্রতি স্বামী সূর্য সেনের উপেক্ষার কথা লেখা হয়েছে, পাশাপাশি রোকেয়ার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন, ভাই ইব্রাহিম সাবেরের পৃষ্ঠপোষকতা, প্রীতিলতার প্রতি বিপস্নবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, ‘নির্মলদা’র স্নেহসিক্ত প্রেরণা, সূর্য সেনসহ গোপন বিপস্নবী দলের সহযোদ্ধাদের আস্থা, ইলা মিত্রের সংগ্রামী জীবনে স্বামী রমেশ মিত্রের অকুণ্ঠ সহযোগিতা, পুরুষ সহকর্মীদের সমীহ ও সমর্থন এবং সর্বোপরি সমকালীন লেখক-শিল্পীদের সশ্রদ্ধ নিবেদনের কথা উলিস্নখিত হয়েছে এ-গ্রন্থে। ফলে নারীবাদী ‘একদেশদর্শিতা’র অভিযোগ থেকে মুক্ত এই লেখক।
এদেশে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় নারীর সংগ্রামের ঐতিহ্য দীর্ঘ; স্বদেশ-স্বাধিকার ও স্বাধীনতার যুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ও অবদান ইতিহাসস্বীকৃত। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রে তার সমতার মর্যাদা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যতদিন এই অপ্রাপ্তি থাকবে, ততদিন পাঠকের কাছে এ-চারটি ক্ষীণকায় গ্রন্থের প্রয়োজন ও প্রাসঙ্গিকতা ফুরাবে না।