নারী ও পুরুষতন্ত্র

নারী ও পুরুষতন্ত্র

মোজাফ্ফর হোসেন

 

আমার এ দেহখানি

পূরবী বসু

 

বেঙ্গল পাবলিকেশন্স

ঢাকা, ২০১৩

 

৬৫০ টাকা

 

 

পূরবী বসু নারীবাদী কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। তাঁর এই পরিচয়ের পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎ মেলে আমার এ দেহখানি বইয়ে। বইটির সাবটাইটেল হলো ‘নারীর কথা : গল্পে ও রচনায়’। অর্থাৎ পূরবী বসু তাঁর রচিত নারীজীবননির্ভর ছোটগল্প এবং নারীজীবনের জাগতিক, শারীরিক, সামাজিক ও মনোজাগতিক সমস্যা নিয়ে রচিত চিন্তাশীল প্রবন্ধের সম্মিলন ঘটিয়েছেন এ-বইয়ে।

বইটি প্রকাশিত হয় বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে, ২০১৩ সালে। চমৎকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। ৪৪৮ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ৬৫০ টাকা।

বইয়ের নিবেদন অংশের শুরুতেই লেখক পূরবী বসু লিখেছেন, ‘পুরুষ ও পুরুষতন্ত্র যে দুটি প্রধান অস্ত্রের মাধ্যমে নারীকে শোষণ ও অবদমন করে থাকে, তার একটি ধর্মীয় বা শাস্ত্রীয় গ্রন্থে বিধৃত নারী-নির্মাণ ও নারীর বিরুদ্ধে আরোপিত যাবতীয় অনুশাসন-বিধিনিষেধ; আরেকটি সাহিত্যকলায়, বিশেষত প্রচলিত লোকসংস্কৃতিতে বর্ণিত নারীর রূপ, প্রকৃতি ও ভূমিকা।’ কথাগুলো আমাদের কাছে একেবারে নতুন না হলেও এটা গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিটা এ থেকে পরিষ্কার হয়। বোঝা যায়, তিনি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। নারীর দেহকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে চান তিনি।

বইয়ের ভেতরের আলোচনায় পূরবী কয়েকটি প্রসঙ্গ ধরে এগিয়েছেন। প্রতিটি প্রসঙ্গ একটি-দুটি গল্প ও প্রবন্ধের সংযোগে তিনি দাঁড় করিয়েছেন। স্বল্পপরিসরে দীর্ঘ এ-বইয়ের সব প্রসঙ্গ ধরে আলোচনা করা সম্ভব নয়। আমি বইটির চরিত্র সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য কেবল একটি প্রসঙ্গ ধরে আলোচনা করব।

বইটির একটি মজার প্রসঙ্গ হলো ‘মাতৃত্ব’। এই অংশে তিনটি প্রবন্ধ ও দুটি গল্প আছে। প্রথম প্রবন্ধ ‘মা হওয়া কি মুখের কথা’? এই অংশে লেখক বলতে চেয়েছেন মা হওয়া একজন নারীর জীবনের অন্যতম কষ্টকর এক অধ্যায়। প্রসববেদনা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ-বেদনা শেষ হয়ে যায় না, কেবল অন্য একটি মাত্রা পায় মাত্র। এখানে তিনি ছোট্ট করে হলেও অতি দরকারি একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন, ‘জগৎজুড়ে প্রতি মিনিটে ৩৮০ জন নারী সন্তানসম্ভবা হচ্ছে। এর ভেতর প্রায় অর্ধেকই, অর্থাৎ ১৮০টি গর্ভধারণ অনাকাঙ্ক্ষিত অথবা অপরিকল্পিত। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (১১০টি) গর্ভধারণ কোনো না কোনো জটিলতার মুখোমুখি হয়। আর কমপক্ষে ৪০টির সমাপ্তি ঘটে গর্ভপাতে। মৃত্যু হয় অন্তত একজনের।’ এ কেবলই এক মিনিটের হিসাব; যে-মিনিটে হয়তো একজন পুরুষ জুতার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে কিংবা সিগারেটে আগুন দিতে দিতে কাটিয়ে দেয়। এরপর প্রবন্ধজুড়ে বিষয়টির আরো বিশদ বয়ান আমরা পাই।

দ্বিতীয় গদ্য ‘সৃষ্টির রহস্য : নারী ও পুরুষ’। এই প্রবন্ধে পূরবী বলছেন, জীবজগতে যৌন ও অযৌন এই দুরকম বংশবৃদ্ধির প্রচলন আছে। তবে সুস্থ ও সবল প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য যৌনপ্রজনন অযৌন প্রজননের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর ও শ্রেষ্ঠতর।  এর কারণ তিনি এখানে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গ ধরে তিনি সত্যের পথে এগিয়েছেন। সত্যটা হলো, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভালো-মন্দের ভাবনায় পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি নারী জড়িত। পুরুষ এক্ষেত্রে স্বার্থপর কিন্তু নারী কল্যাণমুখী, নিঃস্বার্থপ্রাণ।

পরের অংশে পূরবী অন্যান্য প্রাণিকুলের জৈবকৃতির উদাহরণ টেনে দেখিয়েছেন, সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তোলায় স্ত্রীজাতির অবদান সবচেয়ে বেশি। পুরুষজাতির মধ্যে যে-প্রবণতা কাজ করে তা হলো বৈচিত্র্যপূর্ণ স্ত্রীসঙ্গ ও নিজের বংশের বিস্তার ঘটানো।

তৃতীয় গদ্য ‘ধরিত্রী’। গল্পের ঢঙে বলে চলা। কতগুলো চরিত্র আছে। প্রথম চরিত্র খাদিজা। সে একজন সংগ্রামী নারী। শ্বশুরবাড়ি যত রকমের সম্ভাব্য অত্যাচার-নিগৃহ আছে, তার সবটাই সে ভোগ করেছে; তারপর প্রতিবাদী হয়ে সংসার ছেড়েছে। নিজের সন্তানদের বড় করে তুলতে সংগ্রাম চালিয়ে গেছে, একা। অন্য দুটি চরিত্র স্বামী-স্ত্রী। তারা আসে গবেষণার কাজে আসা বিদেশি গবেষক ড. স্মিথের কাছে। তাদের সন্তান হচ্ছে না। স্বামী-স্ত্রী ভীষণভাবে সন্তান চায়। তবে স্ত্রী গোপনে জানায় যে, সে অন্য কোনো পুরুষের শুক্রাণুতে মা হতে চায়। কারণ তার স্বামী নানা রোগে জর্জরিত। সে সুস্থ সন্তান চায়, আবার অসৎভাবেও নয়।

এই অংশটিতে বিষয়ভিত্তিক আরো দুটি গল্প আছে। একটি ‘জনক-জননী’, অন্যটি ‘সবাই তাকে পাগল বলে’। এভাবেই নারীজীবনের আরো ষোলোটি প্রসঙ্গের আলোচনা পূরবী বসু করেছেন গল্পে ও প্রবন্ধে। তাঁর শানিত যুক্তি, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, কখনো কখনো কল্পিত চরিত্রের মধ্য দিয়ে বাস্তবনির্ভর কাহিনির সরল উপস্থাপন পাঠককে নানাভাবে ঋদ্ধ করে। নারী ইস্যুতে যাঁরা কাজ করছেন, যাঁরা নারীকে জানতে চান এবং যাঁরা নারীকে ভুলভাবে জানেন সবার জন্যই বইটি সমান গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশে এ-ধরনের ইস্যু নিয়ে অনেকেই কাজ              করেছেন। কিন্তু পূরবী বসুর এই বইখানির মেজাজ একেবারে আলাদা। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিও যেমন কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র, তেমনি প্রকাশভঙ্গিও সহজাত। তিনি প্রবাসজীবনে বিজ্ঞানচর্চা করেন,             গল্প লেখেন, প্রবন্ধ লেখেন এবং চেতনায় নারীবাদী, তাই তাঁর কাজটি অন্যদের চেয়ে আলাদা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। বইটি লেখক-পাঠক-অপাঠক সবার জন্য অবশ্যপাঠ্য বলে আমি মনে করছি। r

 

 

মাহমুদ কামাল : নম্রনীল কণ্ঠের কবি

জুলফিকার হায়দার

 

নির্বাচিত কবিতা

মাহমুদ কামাল

 

বিশ্বসাহিত্য ভবন

ঢাকা, ২০১৫

 

৩০০ টাকা

 

 

কবিতার শিল্প, প্রকরণ ও বিষয়মগ্ন ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করে এই সময়ে যাঁরা কবিতা-চর্চা করেন মাহমুদ কামাল তাঁদের অন্যতম। বহুকৌণিক কাচের বর্ণবিচ্ছুরণের মতো জীবনকে তিনি নানাভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখেন, তাতে মননের আলো ফেলে, স্বল্প কথায় সুন্দর চিত্রকল্পে, অনিন্দ্য ছন্দ, সৌকর্যে নিটোল নান্দনিক কবিতা লেখেন। তাঁর কবিতার শব্দ-সংহতি, প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা এবং চিত্রলতা স্থাপত্যের দ্যুতি ছড়ায়। যত্নশাসিত কবিতার উচ্চারিত আবেগ ও শব্দঝঙ্কারে তীব্র হয় জীবনের স্পন্দন। দীর্ঘ অনুধ্যান ও গভীর অভিনিবেশের তাৎপর্যহীন রহস্যগন্ধ পাঠককে আচ্ছন্ন করে। কবির নম্রনীল কণ্ঠে বেজে ওঠে জীবনের কলধ্বনি। সুপ্ত অন্তর্হিত আনন্দ-বেদনার বারিবর্ষণে সিক্ত হন পাঠক।

মাহমুদ কামালের কবিতায় রয়েছে জীবনের উদ্ভাস, অভিজ্ঞতার নির্যাস। তাতে আছে           প্রেম প্রকৃতি, প্রাতিস্বিক অনুভূতি, স্বপ্ন-কল্পনা, চাওয়া-পাওয়া, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংশয়-সন্দেহ, মনোকষ্ট, দুর্লভ স্মৃতি, চারপাশের নানা ভাঙচুর, সমকালের অনুভবের উন্মোচন বহুভুজ জীবনের কল্লোল এবং কলস্বর তাঁর কবিতায় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত। মাহমুদ কামালের কবিতা আত্মব্যক্তিত্বে ঋদ্ধ। নারীসঙ্গ কামনার ক্ষরণ ও সন্দীপনে সর্বশেষ আলোচনাময়, আত্মতাড়নায় অগ্নি জ্বালানোই তাঁর কাজ। তিনি প্রকৃতি-চেতনার আচছন্ন অদ্ভুত অন্তর্মুখী এবং প্রবল রোমান্টিক প্রেমের কবি।

মাহমুদ কামাল সমসাময়িক কবিদের মতো কবিতার ব্যাকরণ ভাঙার উল্লম্ফন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত নন। বরং বাংলা কবিতার ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে স্বীকার করেই কবিতাচর্চায় আগ্রহী। ধ্রুপদী কাব্য সংহতি অর্জন তাঁর কবিজীবনের অন্বিষ্ট, উক্তি ও উপলব্ধির অদ্বৈতায়নের সাধনায় নিমগ্ন। মাহমুদ কামাল জীবনের রূঢ় বাস্তব ও মৃত্তিকা-সংলগ্ন অনুভূতিকে কবিতায় রূপ দেন। প্রতিমুহূর্তের ঘাত-প্রতিঘাত থেকে, প্রেম-অপ্রেম থেকে, মান-অভিমানের পালা-পার্বণ থেকে কবিতার রস আহরণ করেন। অভিজ্ঞতার আলোতে পথ চলতে চলতে নির্মাণ করেন কবিতার কোমল শরীর। তাঁর কবিতার অন্তর্বহির্দেশ মেজাজ, প্রক্ষেপণ, অভিঘাত সবকিছুই স্বতন্ত্র। কম কথায় ছোট ছোট ছবি অাঁকা, পরিপার্শ্বকে কবিতার অভ্যন্তরে নিয়ে আসা, সরল ভঙ্গিতে কথা বলা, কিছু বলে কিছু না বলা, ছন্দ ও মিলের অভিঘাতে পাঠককে আলোড়িত ও অভিভূত করা তাঁর কবিস্বভাবের বড় বৈশিষ্ট্য। জীবনের বহুবর্ণ আর বহুমাত্রিক সত্য ও নস্টালজিয়া-আক্রান্ত স্মৃতিকাতর এই কবি পরিপূর্ণতাকে স্পর্শ করার অভিপ্রায়ে অনেক কবিতা লিখেছেন। সেসব গ্রথিত-অগ্রথিত কবিতার একটি নির্বাচিত সংকলন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাচিত কবিতা সংকলনে মাহমুদ কামালের কবিতার সামগ্রিক চরিত্র ফুটে উঠেছে।

মাহমুদ কামাল কবিতার নিবিষ্ট, নিমগ্ন। নির্বাচিত কবিতা সংকলনে তার ছাপ স্পষ্ট, কবিসত্তাও প্রোজ্জ্বল ও দীপ্তিময়। অভিনিবেশী পাঠক প্রত্যক্ষ করবেন, এখানে কবিতা বলে কামাল চষে ফেলেন অনন্ত আকাশ। প্রতিটি শব্দ থেকে তিনি সুন্দর বাক্য তৈরি করে তা পৌঁছে দিতে চান পাঠকের কাছে, মুগ্ধ পাঠক সারাজীবন যার মানে খুঁজবেন। শব্দ নিয়ে তাঁর ভাবনার শেষ নেই। সুনিপুণ  শব্দ-বিন্যাসে তিনি তৈরি করেন কবিতার দেহশয্যা। তাঁর ভাষায় :

 

শব্দের আনন্দ উপমায়

অাঁকা হবে সাংকেতিক মুখ

নাকি ধ্বনিসাম্যের আবহতত্ত্বে

প্রকাশিত হবে ঋতুমতি।            (‘ছাইভস্মস্থিতি’)

শব্দপ্রেমী কামালের কাছে শব্দই স্মৃতি, শব্দই গান, শব্দই অভিজ্ঞান। তাঁর ব্যবহৃত কবিতার ভাষায় প্রাণ পেয়ে জ্বলে ওঠে শব্দের বিভূতি। ধ্বনি হিল্লোলময় বাকস্পন্দ তাঁর কবিতার বড় সম্পর্ক শুধু কবিতার কথাই বলি কেন, জীবনেরও। তাই তার স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণ – ‘জীবনের যতটুকু ভালো/ শব্দময় বিভূতির আলো।’ অথবা,

যে কোন শব্দের কাছে হৃদয় কাঙাল হয়ে

অনুনাদে অনুবাদে যে ধ্বনি বিবৃত ঠোঁটে

সেই ধ্বনি স্মৃতিময় সেই ধ্বনি শব্দালঙ্কার            (‘আত্মসমর্পণ’)

 

কবিতার শব্দ আর ছন্দ পরস্পরের প্রভাবে বেঁচে ওঠে। শব্দের সঞ্জীবনী শক্তি নিহিত থাকে ছন্দের মধ্যে। তাই ছন্দের প্রতি রয়েছে তাঁর পূর্ণ পক্ষপাত, শব্দকে সাহায্য করার জন্য তিনি অক্লান্তভাবে ছন্দের সন্ধান করেন। স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ছন্দে অবিরাম অবিরল ধারায় রচনা করেন মানসম্পন্ন কবিতা। ছন্দ কোনো বিলাস কৌশল নয়, মন ভোলানোর আয়োজন নয়, সে শরীর হয়ে জাগিয়ে তোলে কবিতার আত্মা। ছন্দে সচেতন কবির উচ্চারণ :

ছন্দকে আমি শাসন করেছি প্রবলপ্রভাবে

যতই বন্দি ছন্দহীনতা যাদের স্বভাবে

মিথুন মুদ্রা মুগ্ধ নিচয়ে মুগ্ধচিত্তে

তোমার শেকড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে মাত্রাবৃত্তে (‘ছন্দবিষয়ক’)

বিশ্বের সর্বত্র কবি ছন্দের লীলা প্রত্যক্ষ করেন।

ছন্দ থাকে চলায় বলায়/ ছন্দ থাকে মিথুন কলায়। শুধু তাই নয় –

ছন্দ থাকে প্রসব ব্যথায়

শোণিত শীৎকারে

ছন্দপতন যায় ঘটে যায়

সমূহ চিৎকারে

(‘ছন্দ তবু আনুষঙ্গিক’)

ছন্দহীনতা জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে, বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি করে, অস্থিরতা দেখা দেয়। ছন্দহীন কবিতায়ও দেখা দেয় এসব উপসর্গ। এ সম্পর্কে কবির অভিমত হচ্ছে :

ছন্দকে সরিয়ে কিংবা বের করে দিলে

কবিতা শরীর হয় আড়াল সৌন্দর্য

ধ্বনিসাম্য ব্যতিরেকে অর্থহীন শব্দগুচ্ছ

প্রায়োগিক কৌশলে তাই যতই নিপুণ হোক

অরণ্যসংকুল পথে ঘটে বিড়ম্বনা

ছন্দহীন কবিতাগুচ্ছ আর নয় কবিতা শরীরে

(‘আড়াল সৌন্দর্য’)

এ জন্য মাহমুদ কামাল সচেতনভাবে কবিতায় সৃষ্টি করেন ধ্বনিসাম্য আর এর মধ্যে দিয়েই তিনি তা পৌঁছে দিতে চান পাঠকের চেতনায়। তিনি অত্যন্ত ছন্দসচেতন কবি।

প্রেম মাহমুদ কামালের কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ। প্রেম তাঁর কাছে সৃজনের প্রতীতি, উৎসবের প্রতীক। প্রেমের শক্তি ও প্রেরণায় তিনি আস্থাশীল। তাই তাঁর কবিতায় প্রেমের প্রক্ষোভ, যন্ত্রণা, সংক্রমণ, আত্মরতির স্বাদ, সংবেদন ইত্যাদি হয়ে উঠেছে স্বতঃস্ফূর্ত কবিতার ঢেউ। মাহমুদ কামালের প্রেম যৌনতায় আরক্ত তবে শিল্পের জাদুতে তা ঢাকা পড়ে যায়। তাঁর চিন্তা ও অনুভবজুড়ে বাস করে এক চন্দ্রকান্ত নারী, ছুরির চাইতেও সে অহঙ্কারী, তেজী ও দীপিত, এলাচ দানার মতো তার শরীরের সুগন্ধ। ফিরোজা রঙের শাড়ি পরা সেই যুবতীর প্রেমে তিনি উন্মত্ত, বিভোর। সেই শাশ্বত সুন্দরী রমণীকে তিনি এভাবে দেখেছেন : ‘কবিতা লিখেছে কবি যুগে যুগে নানা শব্দরাজি/ তুলির অাঁচড়ে দেবী প্রতিমার টেরাকোটা অাঁকা/ হাজার বছর ধরে এঁকে গেছে স্তনের মহিমা/ খয়েরি বর্তুল দুটো কেঁপে ওঠে  ঠোঁটের আঘাতে।’ সেই নারীর সঙ্গে কবি অর্ধেক জীবন কাটিয়েছেন, কাটিয়ে দিতে চান অবশিষ্ট জীবন। তার সঙ্গেই চলে কবির নিরন্তর অভিসার –

সারাদিন অভিনয় নিশিরাতে শুধু অভিসার

শরীরের রূপ রেখা মিশে যায় কামনার জলে

ভেসে যায় শোকতাপ অনুভবে ঠিক ঘুরে আসে

মনের গহীন কোণে ফিরে আসে পুরানো বিভূতি

আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, মাহমুদ কামাল রোমান্টিক প্রেমের কবি। প্রেমের নানা অনুভব উপলব্ধি ও সংবেদন নিয়ে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া প্রচুর প্রেমের কবিতা তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছেন নির্বাচিত কবিতা সংকলনে। যেমন – ঘুমতো আসে না প্রিয় সারারাত এপাশ/ ওপাশ এপাশে স্বামীর বাহু ওই পাশে কঠিন কপাট/ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে ক্লান্তিহীন কত অনুতাপ।’

মাহমুদ কামালের কাছে নারী কন্যা, জায়া, জননী ইত্যাদি নানা রূপে প্রতিভাত। তাঁর কাছে নারীর মূল্য অপরিসীম। তাঁর ভাষায়, প্রেমে অপ্রেমে ছন্দে দ্বন্দ্বে/ অবগুণ্ঠনে ফুল্ল/ লৌকিকতায় প্রিয় নারী জাতি কৌস্ত্তভ মহামূল্য।’ মহামূল্যবান নারীদের মধ্যে অপত্য স্নেহের আধার, অলোদাত্রী মায়ের গুরুত্ব তাঁর সবচেয়ে বেশি। তাঁর ভাষায় – ‘মাতৃ জঠরে ছিলাম বলেই তো বাহিরে এলাম/ যতনে ছিলাম বলেই তো সুন্দর পৃথিবীতে এলাম।’ যখন সংসারে সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, অথচ মমতাময়ী মা সেই সংসার শূন্য করে চলে যান, সময়ের দোলাচলে শব্দহীন নানা স্মৃতি, নানা পটভূমি মনের কোণে উঁকি দেয়, তখন মাতৃশোকে কাতর কবির কান্নাভেজা কণ্ঠে শুনি              আর্ত-আহাজারি –

বৃষ্টি, বৃষ্টি আর বৃষ্টি ভেজা চোখ

প্রতিটি গাছের পাতা বৃষ্টিস্নাত যেন পরিপ্লুত

তারা কি কাঁদছে?

ব্যবহার্য সকল তৈজস স্পর্শ সুখ থেকে বঞ্চিত

স্পর্শহীন ওম খোঁজে অনিকেত মায়ের অাঁচল

তারা কি কাঁদছে?

মাহমুদ কামালের কবিতায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্রকৃতি-চেতনার বর্ণময় বৈভব। বরষার মাঠ, হাঁসের জলকেলি, ঝাউপাতা দুলে ওঠার অপার বিস্ময়, দিগন্ত থেকে দিগন্তে মেঘের ওড়াউড়ি, উদাস দুপুরের বিশীর্ণ নদী, পাখিদের ঘরে ফেরা, বিশাখা নক্ষত্রযুক্ত পূর্ণিমা রাত ইত্যাদি দৃশ্য তাঁর কবিতায় পেয়েছে এক ভিন্নমাত্রা।                    প্রজ্ঞাময় সৌন্দর্যকে তিনি স্থাপন করেছেন অপার নান্দনিকতায়। তার বর্ণনায় –

অনড় দাঁড়িয়ে থাকে সকালের ছায়া, জামগাছ

নূপুর কাঁপিয়ে রোদে হেঁটে আসে টিকলির ছাদে

হেসে ওঠে ছায়ার ঝিলিক

কাঠামো লুকিয়ে থাকে দুপুরের ছায়া, জামগাছ

গলদেশে কানে, হাতে, কোমরেতে জড়িয়ে স্বর্ণাভ

ক্লান্ত রোদ ঋতুবতী নারীত্বের পটভূমি আনে।

(‘ছায়া সুন্দরী’)

নদীমাতৃক দেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দৃশ্য অঙ্কন করতে গিয়ে কবি লিখেছেন –

একটি শিশিরবিন্দু উপুড় হওয়া নদীটিতে প্রশ্ন করে

হে নদীমাতৃক দেশে জননী আমার

তুমি কি কাঁদছো?

এই প্রশ্নে নদীর কান্নার ধ্বনি

দ্রুত বেড়ে ওঠে

না, কোন স্রোতধ্বনি নয় প্রবহমানতা নয়

আনন্দ শীৎকার নয়

নদীটি কাঁদছে খুব পড়ন্ত বিকেলে

তার বুকে জল নেই কেন?

(‘উপুড় হৃদয় নদী’)

 

প্রেম ও প্রকৃতিতে মগ্ন কবি মাহমুদ কামালের কবিতায় ইতিহাস-চেতনা, সমকালীন সত্তার অনুভবের ক্ষণিক উন্মোচন পাঠককে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে। কাব্য-জিজ্ঞাসায় তিনি অসংখ্য সামাজিক চিত্র তুলে আনেন, অন্যায় অসংগতির চিত্র তুলে ধরেন। কবি লক্ষ করেন, তাঁর চোখের সামনে সবকিছু বদলে যাচ্ছে, স্বকীয়তা হারাচ্ছে, কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে রোদ্দুর। চোখে কালো চশমা নেই, তবু আমাদের সবকিছু কালো হয়ে যাচ্ছে, কালো মুখোশের আড়ালে সবকিছু ঢেকে রাখা হচ্ছে? রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের চূড়ান্ত চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে কবি লিখেছেন –

কলাগাছে কলার বদলে তেঁতুল ধরেছে

আশেপাশে একটিও তেঁতুলবৃক্ষ নেই

তবে, কলাগাছটির খুব কাছাকাছি

এক রাজনীতিবিদের বাড়ি আছে।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষকের দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরে তিনি লিখেছেন –

অবশেষে শূন্য কৃষক

চাষাবাদে হাজার হাজার শূন্য চাষ করে

গোলাভরা ধানের মত পূর্ণ করে

বিক্রয় মূল্য পেল না।

(‘শূন্যবিষয়ক’)

‘ব্যাগভর্তি বই আর মাথাভর্তি চুল/ ঘুণ পোকা কুরে খায় কুঁড়ি ও বকুল’ – কবিতার এ দুটি পঙ্ক্তির মধ্যে মাহমুদ কামাল ফুটিয়ে তুলেছেন আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের শিশুদের নিরুপায় অসহায়ত্ব, তাঁদের জীবন থেকে খেলার মাঠ আর অবকাশের আনন্দ হারানোর নিদারুণ চিত্র। এ-কবিতার মধ্যে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন কীভাবে জীবন-বিচ্ছিন্ন হয়ে আমাদের আগামী প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। শুধু তাই নয়, বিদেশি অর্থের কাছে বিকিয়ে যাচ্ছে আমাদের মেধা, মনন; ধীরে ধীরে জাতি অমানুষে পরিণত হচ্ছে – সেই চিত্র তুলে ধরে কবি লিখেছেন –

মুক্ত বাজারে

মুক্তচিন্তাগুলো কিনে নিচ্ছে দানব ডলার

প্রতিদিন বদলে যাচ্ছে বিশ্বাসের সকল ঝরোকা

তৈরি হচ্ছে দানবের বিপরীতে নতুন দানব।

(‘উদোম স্বাধীনতা’)

নির্বাচিত কবিতা, সংকলনের আরো বহু কবিতায় কবি মাহমুদ কামালের সমাজজিজ্ঞাসার নানা দিক উন্মোচিত হয়েছে। এ ক্ষুদ্র আলোচনায় তার সবটা তুলে ধরা সম্ভব নয়। এ-সংকলনের প্রতিটি কবিতাই পাঠককে আনন্দ দেবে, আলোড়িত করবে।

মাহমুদ কামাল আধুনিক বাংলা কবিতার একজন অন্যতম কবি। তাঁর কবিতা  নারী ও নিসর্গপ্রেমে আবিষ্ট, জীবন-জিজ্ঞাসায় আচ্ছন্ন। তাঁর কাব্য সৃষ্টি স্বতঃস্ফূর্ত, অন্তরঙ্গ ও জীবনঘনিষ্ঠ। বাকসংযম, শব্দচয়ন ও পদলালিত্যের সঙ্গে ভাবগাম্ভীর্যের মিলন তাঁর কবিতার বিশেষত্ব। তাঁর কবিতায় রয়েছে আত্মবীক্ষণ ও আত্মনিরীক্ষণ। বাংলা কবিতার উজ্জ্বল আবেগকে তিনি ধরে রেখেছেন। উচ্চস্বরকে তিনি কৌশলে পরিহার করেছেন। ইতোমধ্যে তিনি একটি নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। এ-কারণে তাঁর কবিসত্তাকে সহজেই পাঠক চিহ্নিত করতে পারবেন।