না, শোকগাথা নয় (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে উৎসর্গিত)

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
কখনোই তুমি চাওনি
তোমার মৃত্যুসংবাদ চৌদিকে চাউর হয়ে যাক,
সেজন্যেই বুঝি তোমার চলে-যাওয়ার সময়টায়
পর-পর চারদিন জুড়ে কলকাতায় কোনো কাগজ বেরোয়নি,
বেরোলেও বিলি হয়নি,
আর হকারের সেই অপ্রত্যাশিত ছুটির উল্লাসে
সুন্দরবনের আশেপাশে
সপরিবারে বেরিয়ে পড়েছিল সবুজে সুনীলে
পিকনিকের মহানন্দে Ñ তুমি যেরকম চেয়েছিলে।

আমি তখন এলাহাবাদে প্রবাসী বাঙালিদের পূজার মণ্ডপে
তোমার কবিতা নিয়ে যেই
হাজির হলাম, দেখি ঢাকিরা কেমন করে যেন প্রয়োজনাতিরিক্ত আনন্দেই
বাজাচ্ছিল ঢাকঢোল, কেউ যেন ঘুণাক্ষরে জানতেও পারেনি
তুমি আর নেই।

আসলে মৃত্যু তো নয় অটলবিহারী বাজপেয়ী
অথবা ইন্দিরা গান্ধী। এক-একবার আমি যেই স্মৃতিধূপ জ্বালি
বুঝতে পারি এ জীবন মৃত্যুর চেয়েও শক্তিশালী,
এবং তক্ষুনি মনে পড়ে যায় আমাকে কীভাবে
রাজরোষ Ñ নাকি রাজ্ঞীরোষ Ñ থেকে বাঁচাবার অমূর্ত বিভাবে
আগলে রেখেছিলে তুমি।
রাজভবনে সত্তর দশকে
ইন্দিরা আমন্ত্রিত চায়ের আসরে এক গোধূলি সন্ধ্যায়
আমি তাঁর আরোপিত ইমার্জেন্সির প্রতিবাদে
সোচ্চার হয়েছিলাম, আর তখুনি মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়
আমাকে বললেন, ‘সাবধান,
যে-কোনো মুহূর্তে কিন্তু আপনাকে গ্রেফতার করা যায়।’

সুনীল, আমাকে তুমি ছমছমে সেই রাতে কালো গোয়েন্দাদের কর্ডন
দীর্ণ করে রাজভবনের প্রান্তে দাঁড় করিয়ে রাখা তোমার গাড়িতে
তুলে নিয়ে সারথিকে বললে : ‘চালাও’। সারারাতজুড়ে সেই আমাদের
ফুটপাত বদল না করে কলকাতা সন্দর্শন। রাত তিনটে নাগাদ তুমি
নিজেই অনভিজ্ঞ হাতে তোমার সেই হীনযানের সারথ্য স্বীকার
করে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যখন বদ্ধমুঠির মুদ্রা উৎকীর্ণ
করে দিতে চেয়েছিলে, স্টিয়ারিং বেঁকে বসল, আর তোমার নতুন
গাড়িটা অতর্কিতে ডেবে গেল একটা গর্তে। ঢাকুরিয়ার ব্রিজে কোনোক্রমে
উঠে গিয়ে আমরা দুজন জীবনানন্দের ‘জয় অস্তসূর্য জয়, অলখ
অরুণোদয়, জয়’ লাইনটাকে স্ক্যান করতে-করতে এক সময় ভোর
হয়ে এল।

মনে পড়ে তোমার গাড়ির সেই পুণ্য ভরাডুবি,
তোমার প্রস্থানে তাই বাজাব না প্রয়াণদুন্দুভি,
লিখব না চোখের জলে পরিপ্লুত একটিও এলিজি,
শুধু ভালোবাসা নিয়ে এইমাত্র যা-কিছু লিখেছি…