শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী
সৈয়দ শামসুল হক-রচিত এবং কলকাতার নাট্যদল ‘একুশ শতক’-প্রযোজিত বুকঝিম এক ভালবাসা একটি দু-ঘণ্টার একক উপস্থাপনা। নির্দেশনা ও অভিনয়ে শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়। তবে, একক হলেও শ্রমণ ছাড়াও মঞ্চে উপস্থিত থাকেন আরো ছজন মানুষ। দোহক হিসেবে থাকেন সর্বজিৎ ঘোষ এবং সুহানিশি চক্রবর্তী – তাঁদের মূল কাজ সময়ে সময়ে শ্রমণের অভিনয়ের পথে কিছুটা ‘ধরতাই’ দেওয়া। তাছাড়া থাকেন বাদকদলের চারজন – শুভদীপ গুহ (এই নাটকের সংগীতকার), চক্রপাণি দেব, জয়ন্ত সাহা এবং সুশ্রম্নত গোস্বামী। এঁদের ভূমিকায় পরে ফিরে আসব আমরা। আপাতত হকসাহেবের এই গাথার সূত্র ধরে এগোনো যাক।
আপামর বাঙালি জাতি থিয়েটারে গেলে গল্প চায়। আমরা গল্পে বাঁচি সবার আগে। কারণ, গল্প দিশা দেয়। সেদিক থেকে, বুকঝিমের গল্প খুব সহজ-সরল এক আশ্রয়। প্রেম ও তার অনিবার্য অপূর্ণতা। প্রায় পাঁচশো বছর আগে পূর্ববঙ্গের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের কাহিনি বলেন কবি (এটি উপন্যাস হলেও হকসাহেবকে কেন ‘কবি’ বলে ডাকাই শ্রেয়, তা নাটকটি দেখলে বা উপন্যাসটি পড়লে বোঝা যাবে)। মাটির সুরে গান গেয়ে চলা কৃষক পরিবারের মনসুর বয়াতিকে ভালোবেসে ফেলে জমিদার মহববত জঙের বোন চাঁদ সুলতানা; এবং সমাজ বরাবরই ভালোবাসার পূর্ণতায় মানুষের চেয়ে বড় করে দেখে তার শ্রেণি। অতএব বিচ্ছেদ ও ইতি। কিন্তু সমাজ ইতি টেনে দিলেই সব শেষ হয় না। ভয়ের পাশেই থাকে অভয়। প্রতিবেশী জমিদার ফিরোজ দেওয়ানের সঙ্গে কলেমা পড়ে বিবাহ দেওয়া হয় চাঁদের। ফিরোজ প্রাণাধিক ভালোবাসেন চাঁদকে, আর চাঁদ, মনসুরকে। ফিরোজ চাঁদের সেই ভালোবাসার কী বিচার করেন, সে নিয়েই আমাদের গল্প।
বুকঝিম শুরু হয় এক অমোঘ নিঃসঙ্গতায়। দেখি, কথকের ভাষায় ফুটে উঠছে এক খাঁ-খাঁ প্রাসাদপুরী, যার আঙিনায় বসে আছে একাকী ফিরোজ দেওয়ান ও আবুল বয়াতি, মনসুর যার মুর্শিদ। ফিরোজ বারবার আবুলের কাছে শুনতে চান সেই গান, যে-গান শুনলে তাঁর মনে পড়ে চাঁদণ্ডমনসুরের ভালোবাসার কথা, যে-ভালোবাসা বনের পশুকেও হিংসামুক্ত করে। গান শুরু হয়, ‘এই পানি যায় ভেসে যায় দূরে যায় দরিয়ায়।’ নিঃসঙ্গতা তীব্র হয়, প্রখর হয় যখন নাটকের মাঝে বারবার ফিরে আসতে থাকে এই সুর, এই গান – যার মূলে মনসুর ও চাঁদ, যারা কেউই এখন আর নেই। তবু এই বিষাদিত না-থাকার সঙ্গে আমাদের একাত্ম হওয়ার ইতিহাস খুব নতুন নয়। বুকঝিমের নিঃসঙ্গতা নতুন এখানেই যে, কিছুদূর যাওয়ার পর বোঝা যায়, নাটকের মূল চরিত্র আদৌ এই মৃত দুই প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, বরং ফিরোজ ও আবুল, যারা বেঁচে আছে চাঁদ ও মনসুরের জোছনায়, এবং সেই ক্রমশ ম্লান হয়ে আসা জীবনের ভার তাঁরা বহন করছে, তাঁদের বেঁচে থাকাটাই এক ধরনের অতীতযাপন।
এখানেই প্রয়োজন অভিনেতা শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়ের কথা বলা। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, শ্রমণ এই নাটকের শুরু ও শেষ। তাঁর হাত ধরেই নাটক শুরু হয়, পরিণতি পায় ও শেষ হয়। শ্রমণ একাধারে বুকঝিমের কথক, আবুল, ফিরোজ, মনসুর, চাঁদ, অত্যাচারী মহববত জং, এবং আরো আরো চরিত্র। কখনো তিনি যৌবনোচ্ছল গায়ক, কখনো তাঁর কিশোর শাগরেদ, কখনো নারীর লাবণ্য, কখনো জীবনের ভারে ন্যুব্জ এক প্রেমিক। তাঁর হাত ধরেই বুকঝিমে অনুভূতির শতপলস্নবের অবতরণ ঘটে। এবং শ্রমণের পারদর্শিতা এখানেই যে, তিনি নাটকের সমস্ত চরিত্রের উপাখ্যান একাই হয়ে ওঠেন, বিশেষত যেখানে এক একটি চরিত্রের নিঃসঙ্গতা ও ভালোবাসার ধরন এক এক রকমের।
দোহক হিসেবে সর্বজিৎ ও সুহানিশিও যথাযথ এবং খুব স্বল্পসময়ের জন্য হলেও নাটকে তাঁরা শ্রমণের দম নেওয়ার একটি পরিসর হয়ে ওঠেন। উপযুক্ত স্থানে তাঁদের পরিমিত ও উল্লেখযোগ্য ব্যবহার শ্রমণের নির্দেশক-মনেরও পরিচয় দেয়। যেমন, প্রায় পুরো সময় ধরে শ্রমণ নিজেই চাঁদের ভূমিকায় অভিনয় করে গেলেও যেখানে চাঁদের সঙ্গে মনসুরের গানের লড়াই হয়, সেখানে তিনি ব্যবহার করেছেন সুহানিশিকে, চাঁদ হিসেবে। তাতে নাট্য স্পষ্ট হয়, নাটক দিশা পায়। প্রায় এই একই সময়, আরেকটি স্থানে শ্রমণ সর্বজিৎকে যেভাবে ব্যবহার করেন, তাকে সূক্ষ্ম বললে কম বলা হবে। মনসুর যখন গানের লড়াইয়ের শেষে চাঁদকে প্রশ্ন করে, ‘আমার জন্য তুমি কেন হইবা দিওয়ানা’, চাঁদ উত্তর দেয় – ‘তুমি কবি – এই জানি, গরিব জানি না। দিওয়ানা হইলাম কেন, তুমি বোঝ না?’ এরপরই সর্বজিৎ দোহকের ভূমিকায় বলে ওঠে, ‘মানুষের মনের খবর এত রাখো তুমি, এত জানো, নারীর হিয়া তুমি জানো না?’ উল্লেখ্য, নাটকে এই দৃশ্যে উপস্থিত কেবল মনসুর (শ্রমণ) ও চাঁদ (সুহানিশি)। কাজেই, গল্পের পরিপ্রেক্ষেতে তৃতীয় স্বর অনভিপ্রেত এই ব্যক্তিগত পরিসরে। তদুপরি, যদি হকসাহেবের উপন্যাসটি পড়া যায়, দেখা যাবে, সর্বজিতের বলা কথাটি আসলে চাঁদের মুখেই রেখেছিলেন কবি, অন্য কেউ সেইক্ষণে ছিলই না। তবু, মঞ্চে হঠাৎ এই তৃতীয় স্বরের ব্যবহার কেন, যেখানে চাঁদ নিজে উপস্থিত? একজন দর্শক হিসেবে অনুমান করতে পারি, তার গঠনগত উপকরণের ভা-ারে যেমন এই নাটক ঋণী কথকতার কাছে, তেমনই এই বিশেষ মুহূর্তটি ঋণী ‘বিবেকে’র ব্যবহারের কাছে বোধ হয়। প্রায় অজান্তেই, চাঁদের সঙ্গে কথোপকথন চলাকালে সর্বজিতের কণ্ঠে এ-কথাটি বলে মনসুরের বিবেক। সর্বজিতের এ-প্রশ্ন মানুষ-মনসুরের মনের প্রশ্ন, কবি-মনসুরের অহংবোধকে। বহুমাত্রিক নাট্যের এই সূক্ষ্মতা লক্ষণীয়।
উল্লেখযোগ্য বাদকদলের ভূমিকাও। প্রথাগতভাবে অভিনয়ের বা নাটকের এই ধারাকে আমরা একক বলি বটে, কিন্তু পূর্বোলিস্নখিত ওই চারজন বাদক সমবেতভাবে যেন দ্বিতীয় আরেক কথক। প্রথম কথক (শ্রমণ) কথা বলে কাব্যে, আর দ্বিতীয় কথক কথা বলে সুরে। কেতাবি ভাষায় বললে, এই নাটক ‘সুরধর্মী’। কিন্তু সে তার সুরধর্ম পালন করে কোথায়? কোনো বিশেষ বিশেষ স্থানে? ক্লাইম্যাকটিক মুহূর্তে? গানের দৃশ্যে? ‘ফিলার’ হিসেবে? কোনোটাই নয়। ব্রহ্মপুত্রের তীরে গড়ে ওঠা এই নদীমাতৃক কাহিনিতে সুর হলো নদীর প্রতিরূপ।
আবহমান, সম্পূর্ণ। এবং নিঃসঙ্গ। কারণ, এই সুর কারোর জন্য বাজে না। সে বাজে নিজের জন্য, কেবল কথা বলার তাগিদে। সংগীতকার শুভদীপ গুহকে কুর্নিশ, তিনি কবিসাহেবের ভাষার ওপর এই সুর আরোপ না করলে বুকঝিমের যে-নিঃসঙ্গতা, তা অনেকাংশে অসম্পূর্ণ রয়ে যেত। তালবাদ্যে ও কণ্ঠে চক্রপাণি, তারবাদ্যে জয়ন্ত এবং বাঁশিতে সুশ্রম্নত এই নাটকের অপরিহার্য অঙ্গ। যে-ভাব কথায় অপ্রকাশিত থাকে, তা সুরে ঠিক ধরা পড়ে যায়। চাঁদের মুখে মনসুরের নাম শুনে ফিরোজের মন আমরা সুরে যত শুনতে পাই, কথায় তত নয়। প্রথাভাঙা মঞ্চসজ্জা এবং আলো এই নাটকের বিশেষ দুটি দিক হলেও, সুর আর কথা তাদের ছাপিয়ে যায়।
এসবের পরও বাকি থেকে যায় একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে কথা বলা। তা হলো বুকঝিমের দর্শক। কারণ, থিয়েটারের দর্শক হওয়ার মতো সৌভাগ্য খুব কম আছে। কারণ, শেষ অবধি দর্শকরাই হলেন বুকঝিমের মানুষ। নাটক শুরু থেকে শেষ অবধি শ্রমণ আপামর দর্শককুলকে বেঁধে রাখেন ‘লোক সকল’ বলে ডেকে। সে-ডাকের জোর, তার আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা এত প্রবল যে, শেষ অবধি আমরা, দর্শকরাই হয়ে উঠি বুকঝিমের মানুষ। একটা সময়ের পর গিয়ে শিল্পী আর দর্শক, ইন-টিম আর গেস্টের মধ্যে কোনো ব্যবধান থাকে না। বুকঝিম কথা বলে আমাদের সঙ্গে, সে গল্প শোনায় আমাদের। প্রেক্ষাগৃহের অন্ধকারে বসে থাকা দর্শকদের সে অগ্রাহ্য করে না, বরং তাঁদের ওপরেই নির্ভর করে। বুকঝিম আমাদের বিপদে ফেলে দেয়; সে আমাদের নাগরিকত্বের জামা খুলে নগ্ন করে, আমাদের আড়াল খুঁজতে চাওয়া বহুত্বের মাঝে আমাদের নিঃসঙ্গ করে, এবং আমাদের আপত্তি জানানোর সময়টুকু দেয় না। শেষে যখন পরিধানের আর কিছুই পড়ে থাকে না, সম্পূর্ণ উলঙ্গ আমরা, তখন বুঝি যে নাগরিকত্বের অন্ধকার থেকে একটা সহজ জীবনে বেরিয়ে আসা এতটাই সহজ ছিল!
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। নাগরিকত্ব ছেড়ে বেরিয়ে আসা কিন্তু অভিঘাতের স্থান নয় বুকঝিমের। তার স্থান হলো, মানুষ। এবং এখানেই বোধ করি যৌথতার শুরু। বুকঝিম আদৌ মনসুর, চাঁদ বা ফিরোজের কথা বলে না। বলে তাদের দেখতে আসা সব মানুষের কথা। বলে, আমরা সবাই এক। আমাদের সবার অন্তরেই আছে বুকঝিম করা সেই ভালোবাসা, এবং নিঃসঙ্গতা। কিন্তু নিঃসঙ্গরাই পারেন একমাত্র যৌথ হয়ে উঠতে। কারণ সাহচর্যের সঠিক অর্থ তাঁরাই জানেন, যাঁরা তা থেকে বঞ্চিত। হয়তো গভীরে কোথাও মানুষ সেই এক চিরন্তন সাহচর্য চায়, প্রেম চায়। রোজ রোজ হয়তো আমাদের মধ্য থেকে কোনো মনসুর বিষাদিত হয় না, কোনো চাঁদ মনসুরের জন্য প্রাণ পণ রাখে না, কোনো ফিরোজ তার চাঁদকে হারায় না। কিন্তু মানুষ? সে সঙ্গ চায়, এবং সঙ্গের অপূর্ণতাই নিঃসঙ্গতা। আশ্চর্যভাবে এই নিঃসঙ্গতার গাথাতেই বন্দি করে বুকঝিম আমাদের যূথবদ্ধ হতে শেখায়। সে আমাদের শিকড় টেনে ধরে, বলে নিঃসঙ্গের যৌথতা আজো সবচেয়ে কাঙিক্ষত ও পবিত্র, কারণ আমরা আজো ভালোবাসায় বাঁচি, হিংসায় নয়।
পরিশেষে এটুকুই বলার, বুকঝিম এক ভালবাসা মঞ্চাভিনীত একটি নাটক, কিন্তু তা মঞ্চ ছেড়ে অন্তরঙ্গে হলে তার পূর্ণতর বিকাশ বোধ হয় দেখা যেতে পারত। এক বছরের সময়কালে সে একবার অন্তরঙ্গে অভিনীত হয়েছে, মধ্যমগ্রামের আখড়ায়। সে-অভিনয় যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন তার অভিঘাত। আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন ছিলাম। বহুবার মনে হয়েছে, বুকঝিম অন্তরঙ্গে হলে মানুষ তাকে আরো বেশি করে ছুঁয়ে দেখতে পারত। তবু, বুকঝিম মঞ্চে কেন? নির্দেশকের নিজস্ব চিন্তা এবং নিয়োগ এর পেছনে থাকতেই পারে, তবে আমার মনে হয়, অন্তরঙ্গে যাওয়ার পথে এখনো আমাদের হাত-পা অনেকাংশেই বাঁধা। এখনো, বিকল্প থিয়েটার নিয়ে এত চর্চার পরও, শহরে আজো মঞ্চ-থিয়েটার কৌলীন্যের প্রতীক। অনেক দর্শকের কাছে পৌঁছানোর জন্য আজো মঞ্চই বহু নাট্যদলের ভরসা। শহরের বাইরে হয়তো বিকল্পধারার থিয়েটারের চল বেশি এবং দর্শকও বেশি, কিন্তু শহরে আমরা আজো বিকল্প থিয়েটারকে ‘আহা, বিকল্প’সুলভ ললিপপ ধরিয়ে দূরেই সরিয়ে রেখেছি বহুলাংশে। তবু, আশার কথা এই যে, বিকল্প থিয়েটারের যারা মূলধন, সেই মানুষকে বুকঝিম মঞ্চাভিনীত হয়েও পাশে পেয়ে গেছে, এমনই তার জোর। বুকঝিমকে কেন্দ্র করে এক নতুন সূচনা আমরা অনেকে দেখতে পাচ্ছি। কোনো কাগজে বিজ্ঞাপন নয়, কোনো ‘বিগ মিডিয়া হাউসে’র ব্যাকিং নয়, শুধু লোকমুখে বুকঝিম এক ভালবাসা জেগে উঠছে প্রতিদিন। সোশ্যাল মিডিয়া খুললে এখন প্রায়ই দেখা যায় কয়েকজন মানুষ এই নাটকের কথা বলেছেন, লিখেছেন। আর কিছু মানুষ স্ক্রল ডাউন করার ফাঁকেও সেটা পড়েছেন। কেউ শেয়ার করেছেন। কোনো অফিস-ফেরতার মনে হয়েছে, আজই ওই নাটকটা না? এসে কাউন্টারে টিকিট চেয়েছেন। কেউ নিজে আসতে না পারলে, তার টিকিটে তার বন্ধুদের পাঠিয়েছেন – দেখে এসো এই নাটক। ছেড়ো না। এরা সবাই, সববাই বুকঝিমের মানুষ। এঁদের ডাকেই বুকঝিম জাগছে আরো। এবং আশা করা যাক, এই জাগরণ থামবে না। থিয়েটারের শ্রেষ্ঠ উপহার! মানুষ!
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.