নিউইয়র্কে লোরকা

হাসান ফেরদৌস

ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকার নির্বাচিত কবিতা

রক্ত ও অশ্রুর গাথা

অনুবাদ : সাজ্জাদ শরিফ

প্রথমা

ঢাকা, ২০১২

২৩০ টাকা

লোরকা নিউইয়র্কে এসে পৌঁছান ১৯২৯ সালের ২৬ জুন, তখন তাঁর বয়স ৩০। মুখ্যত নিজের কাছ থেকে পালাতেই বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। যে- যুবকটিকে লোরকা ভালোবাসতেন, সে তাঁকে ত্যাগ করে এক নারীর প্রেমে পড়েছে। সালভাদর দালি, তাঁর অন্য প্রেমিক, সেও তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে। নতুন যে-কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, সমালোচকদের হাতে, তা নিদারুণভাবে সমালোচিত হয়েছে। চারদিকের জমাটবাঁধা অাঁধারে বিদ্ধ লোরকা আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন সে-সময়ে, এছাড়া পালাবার অন্য কোনো পথই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ঠিক তখন হঠাৎ খবর পাওয়া গেল, তাঁদের পারিবারিক এক বন্ধু কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার উদ্দেশ্যে নিউইয়র্ক যাওয়ার আয়োজন করছেন। লোরকার ধনাঢ্য জোতদার পিতা তার প্রতিভাবান পুত্রের মানসিক অস্থিরতার কথা জানতেন, তিনিই লোরকাকে সে-বন্ধুর সঙ্গে আমেরিকায় যেতে প্ররোচিত করেন। সমুদ্র পেরিয়ে নতুন বিশ্বে লোরকার সেই প্রথম আগমন। নতুন দেশ, নতুন ভাষা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি উদ্বিগ্ন ও কিঞ্চিৎ অসহায় বোধ করছিলেন। কিন্তু এই শহরে যে অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছিল, তার জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্ত্তত ছিলেন না লোরকা। তাঁর আগমনের তিন মাসের মাথায়, ২৯ অক্টোবর, ‘কৃষ্ণ মঙ্গলবার’, শেয়ারবাজারের নাটকীয় পতনের ভেতর দিয়ে শুরু হয় আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা। হাজার হাজার মানুষ অকস্মাৎ তাদের সর্বস্ব হারিয়ে একদম নিঃস্ব হয়ে পড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়, রাতারাতি বেকারে পরিণত হয় অগণিত মানুষ।

এমন নিষ্ঠুর সময় আমেরিকা এর আগে কখনো দেখেনি।

আন্দালুসিয়ার মফস্বলীয় যুবক গার্সিয়া লোরকার কাছে এ ছিল এক অভাবিত অভিজ্ঞতা। মাস দুয়েক ছিলেন এ-শহরে, মুখ্যত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে। লক্ষ্য ছিল ইংরেজি শিক্ষা। কিছুটা শিখেছিলেন নিশ্চয়, যদিও লোরকার এক সাম্প্রতিক জীবনীকার লেসলি স্টেইনটন (লোরকা, অ্যা ড্রিম অব অ্যা লাইফ, ১৯৯৯) জানিয়েছেন, চূড়ান্ত পরীক্ষা দেননি লোরকা, সম্ভবত পাশ করবেন না, এই ভীতি থেকে। তাঁর সেই দশ মাসের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই লিখিত হয় নিউইয়র্কে এক কবি। পরে, এক ভাষণে লোরকা জানান, তাঁর পরিকল্পিত কাব্যগ্রন্থের বিকল্প নামকরণ ছিল, এক কবির ভেতর নিউইয়র্ক। সম্ভবত একটি নয় – দুটি কাব্যগ্রন্থের কথা ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু কবিতাসমূহের খসড়া চূড়ান্ত না হওয়ায় তাঁর জীবদ্দশায় এ-কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়নি। ১৯৪০ সালে, তাঁর মৃত্যুর পর, কিছুটা চটজলদি অবস্থায় তা প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়। তার ৪০ বছর পর, ১৯৮১ সালে, সেই একই বই, নতুনভাবে সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয়।

সাজ্জাদ শরিফের অনুবাদ কাব্যগ্রন্থ রক্ত ও অশ্রুর গাথায় (প্রথমা, ২০১২) লোরকার নিউইয়র্ক পর্বের মোট সাতটি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বক্ষ্যমাণ আলোচনা তার অনূদিত পুরো গ্রন্থটি নিয়ে নয়, শুধুমাত্র লোকার এই কবিতাগুলি নিয়ে। যে-কবিতাগুলি তিনি অন্তর্ভুক্ত করেননি, তার কথাও প্রাসঙ্গিকতার খাতিরে উল্লিখিত হবে। মূল স্প্যানিশের বদলে ইংরেজি থেকে কবিতাগুলি অনূদিত হয়েছে, সে-কথা মাথায় রেখে লোরকার অনুবাদকর্মের দুরূহতা বিষয়েও কতিপয় পর্যবেক্ষণ চিহ্নিত হবে।

লোরকার কবিতা তাঁর নিজ ভাষায় পাঠকদের কাছে দুরূহ বলে বিবেচিত। এই কবিতার অনুবাদ অসম্ভব, এমন ঘোষণাও করেছেন একাধিক লোরকা-বিশেষজ্ঞ। বিখ্যাত ইংরেজ কবি স্টিফেন স্পেন্ডার একজন স্প্যানিশ অনুবাদকের সাহায্য নিয়ে লোরকার বেশ কিছু কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। সে-অনুবাদকে ‘খোঁড়া ও ভোতা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। জন গুলড ফ্লেচার, নিজে খ্যাতনামা অনুবাদক, যুক্তি দেখিয়েছেন স্প্যানিশ ভাষা, যা তার সংগীতময় ধ্বনিমাধুর্যের জন্য সুপরিচিত, অন্য যে-কোনো ভাষায় তার রূপান্তর একটি দুঃসাধ্য কাজ। যে ছন্দ ও ছন্দস্পন্দ সে অনুসরণ করে, ইংরেজি ভাষায় তা অনুপস্থিত। গুলড স্মরণ করেছেন, লোরকার কবিতা এতটা সংগীতময় ছিল যে, স্পেনের সেরা সংগীতশিল্পী মানুয়েল দে ফাইয়া লোরকাকে ‘আমার পুত্র’ এই নামে সম্বোধন করতেন। আরেক সাহিত্য-সমালোচক ও ভাষা-বিশেষজ্ঞ রবার্ট ম্যাককরমিক স্পষ্ট করেই বলেছেন, লোরকার কবিতাকে শুধু তাঁর আক্ষরিক অর্থ উদ্ধারের মাধ্যমে অনুবাদের চেষ্টা করলে তা কবির প্রতি মোটেই সুবিচার হবে না। মার্কিন কবি রবার্ট ব্লাইয়ের লোরকা ও হিমেনেসের কবিতার অনুবাদগ্রন্থ (লোরকা অ্যান্ড হিমেনেস, সিলেকটেড পোয়েমস, বিকন প্রেস, ১৯৯৭) প্রসঙ্গে তাঁর এই মন্তব্য। সাংগীতিক জটিলতা এড়াতে ব্লাই মুক্তছন্দে আক্ষরিক  অর্থান্তর করেছেন। ম্যাককরমিক জানিয়েছেন, সে-চেষ্টাতে ব্লাইয়ের সাফল্য সীমিত। তিনি বাগধারা ভুল করেছেন, কালের হিসাবে ভুল করেছেন, এবং যখন তিনি নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে তাঁকে কাব্যসুধামন্ডিত করার চেষ্টা করেছেন, তখন পুরো ব্যাপারটাই গুবলেট করে ফেলেছেন।

লোরকার কবিতা অনুবাদে সমস্যা শুধু তাঁর ভাষা নয়, তাঁর দুর্বোধ্যতাও। তাঁর দুই বন্ধু, সালভাদর দালি ও লুই বুনুয়েলের প্রভাবে, লোরকার কবিতায় পরাবাস্তববাদী প্রবণতা সুস্পষ্ট, যদিও লোরকা নিজে যুক্তিহীন ও নিয়ন্ত্রণহীন স্বপ্ন-ভাবনার হাতে কবিতাকে ছেড়ে দিতে অনাগ্রহী ছিলেন। তাঁর কবিতার অন্য প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রতীকময়তা। যে-আন্দালুসিয়ায় তাঁর জন্ম ও লালন, তার স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাব – বিশেষত মুর, জিপসি গান ও কবিতা – লোরকার কবিতাকে নিজস্বতা দিয়েছে। আন্দালুসীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে অপরিচিত, এমন পাঠকের জন্য লোরকা প্রায় অবোধ্য। অনেক আন্দালুসীয় লোকগাথা তাঁর ব্যালাডে আশ্রয় পেয়েছে, কিন্তু নিজ ভাষার বাইরে সে-লোকগাথার সঙ্গে পরিচিত লোক বেশি নেই, ফলে তাঁর অনেক কবিতাই অগম্য। লোরকার কবিতা বোঝার আরেক সমস্যা তাঁর সমকামিতা, যেজন্য তিনি বিব্রত ছিলেন; কিন্তু তাঁকে প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি, যদিও সে-প্রকাশ ছিল প্রবল রূপকময়তায় আবৃত। সে-রূপকাবরণ উন্মোচন সর্বদা খুব সহজসাধ্য কাজ নয়।

ফলে, সাজ্জাদ শরিফ এহেন লোরকার অনুবাদ বাংলায় করার যে-উদ্যোগ নিয়েছেন তা আমাদের উৎসুক ও অনুসন্ধিৎসু করে। স্বস্তিবোধ করেছি এই জেনে, হঠাৎ হাতে বই পেলাম, ফলে কিছু কবিতা অনুবাদ করে ফেললাম, এমন উটকো তাড়না থেকে সাজ্জাদ এ-কাজে হাত দেননি। দীর্ঘদিন – কম-বেশি কুড়ি বছর – লোরকাকে তিনি অধ্যয়ন করেছেন। শুধু তাঁর কবিতা নয়, এই কবির জীবনাভিজ্ঞতার বিবরণও ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেছেন। ফলে, পর্যাপ্ত প্রস্ত্ততি নিয়েই কাজটিতে তিনি হাত দিয়েছেন। কাব্যগ্রন্থের ভূমিকা ও গ্রন্থভুক্ত একটি প্রবন্ধে সাজ্জাদের প্রস্ত্ততি ও লোরকা বিষয়ে তাঁর উপলব্ধির সারবত্তার প্রমাণ রয়েছে। একদিকে প্রেম, অন্যদিকে মৃত্যুবোধ – সাজ্জাদ লোরকার কবিতার এই দুই বৈশিষ্ট্যের প্রতি সবিশেষ দৃষ্টি দিয়েছেন। ‘লোরকার জীবন যেমন, তেমনই তাঁর কবিতারও একটি জরুরি দিক মৃত্যু ছাড়া অপঠিত থেকে যাবে,’ লিখেছেন সাজ্জাদ। এই গ্রন্থভুক্ত একাধিক অনূদিত কবিতায় সে-মৃত্যু প্রতীক্ষার রোদন ও একাকিত্ব ধরা পড়েছে। লোরকা দীর্ঘ জীবনের অধিকারী না হলেও তিনি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কাব্যগ্রন্থ ও নাটকের রচয়িতা। লোরকার কোনো নাটকের নির্বাচিত অনুবাদ এই গ্রন্থে নেই বটে, কিন্তু তার বাইরে দেড় দশকের বেশি পরিব্যাপ্ত লোরকার কাব্যজীবনের বিভিন্ন ঝোঁক ও প্রবণতার নজির তিনি সুচিন্তিতভাবে বাছাই করেছেন। অনূদিত কবিতাসমূহের শেষে কোনো টিকাভাষ্য নেই, তবে একটি দীর্ঘ ভূমিকায় লোরকার জীবনের পাশাপাশি তাঁর কবিতার বিভিন্ন প্রবণতার উল্লেখযোগ্য দিকগুলি চিহ্নিত হওয়ায় বাঙালি পাঠক সে-কবিতার সাংস্কৃতিক ও মনোজাগতিক মানচিত্রের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান।

লোরকা তাঁর জীবদ্দশায় জনপ্রিয়তায় ধন্য হয়েছিলেন। সেটি তাঁর মৃত্যুর অন্যতম কারণ, সে-কথা মাথায় রেখে সাজ্জাদ লোরকাকে ‘কবিতার শহীদ’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। নাৎসিবাদী ফ্রাঙ্কো সমর্থকদের হাতেই সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয়, যদিও সে-হত্যার সন্দেহ-শূন্য প্রমাণ আজো উদ্ঘাটিত হয়নি। লোরকা রাজনীতিমনস্ক ছিলেন। তাঁর কবিতাই সে-কথার প্রমাণ, কিন্তু সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন না। ফলে ফ্রাঙ্কোবিরোধিতার কারণে তাঁর মৃত্যু, সে-কথা সংশয়ের উদ্রেক করে। তাঁর মৃত্যুর অন্য যে সম্ভাব্য কারণের ব্যাপারে সংশয় কম, তা হলো সমকামিতা। সামাজিকভাবে সমকামিতা সে-সময়ের স্পেনে গ্রহণযোগ্য ছিল না। ফলে, এই বন্দিত কবির সমকামিতায় ক্রুদ্ধ কোনো নাৎসিবাদী যদি তাকে খুন করে থাকে, তাতে অবাকের কিছু থাকবে না। সাজ্জাদের গ্রন্থে সে-সমকামিতার প্রসঙ্গ এসেছে। বুনুয়েলের উদ্ধৃতিতে তিনি সে-কথা জানিয়েছেন। সালভাদর দালিও সে-সমকামিতা বিষয়ে ইঙ্গিত করেছিলেন। বুনুয়েল অবশ্য সে-অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, লোরকা খুন হয়েছিলেন অন্য কোনো কারণে নয়, তিনি কবি বলেই।

১৯৩৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পর লোরকার খ্যাতি অস্তমিত হওয়ার বদলে আরো বিস্তৃত হয়। স্পেনের গৃহযুদ্ধে রিপাবলিকানদের পক্ষে যে আন্তর্জাতিক ব্রিগেড অংশগ্রহণ করে, তাঁর অনেক সদস্য সে-যুদ্ধ শেষে লোরকার কবিতা সঙ্গে নিয়ে ফেরেন। ফলে যে-কবি ছিলেন স্পেনের নিজস্ব, তিনি হয়ে পড়েন আন্তর্জাতিক। অন্য আর যাঁরা তাঁকে হিস্পানিক ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনে সাহায্য করেন, তাঁদের অন্যতম হলেন পাবলো নেরুদা। সাজ্জাদের গ্রন্থে নেরুদার স্মৃতিকথা থেকে লোরকা বিষয়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক দীর্ঘ উদ্ধৃতি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

লোরকার জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে প্রকাশিত মোট কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৫। সাজ্জাদ প্রায় সব গ্রন্থ থেকেই কিছু কিছু কবিতা নিয়েছেন, সম্ভবত তাদের লোরকার প্রতিনিধিত্বশীল কবিতা এই বিবেচনা থেকে। অনুমান করি, মূল গ্রন্থসমূহ তাঁর হাতের কাছে ছিল না। একাধিক সাম্প্রতিক ইংরেজি সংকলন থেকে সেসব গ্রন্থের অনুবাদক-সম্পাদকের নির্বাচিত কবিতাসমূহ থেকে তাঁর প্রিয় অথবা সবচেয়ে অনুবাদযোগ্য, এমন কবিতাই তিনি বাচাই করেছেন। এতে অতিরিক্ত গবেষণা  অনুসন্ধানের ঝামেলা এড়ানো সম্ভব হয় বটে, কিন্তু সর্বদা কবির প্রতি সুবিচার হয়, এমন কথা বলা যাবে না। আমাদের বিবেচ্য নিউইয়র্কে এক কবি কাব্যগ্রন্থের ভিত্তিতে আলোচনায় সে-বিষয়ে আলোকপাতের চেষ্টা করব।

নিউইয়র্কে কবি কাব্যগ্রন্থে মোট কবিতাসংখ্যা ২৪, যা ১০টি বিষয়বিন্যাসে বিভক্ত। সাজ্জাদের গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত কবিতাসমূহ মুখ্যত চার পর্বের :

১। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্জনতার কাব্য (হাঁটাহাঁটির পরে, চক্কর দিয়ে গাওয়ার জন্য তিন বন্ধুর কিসসা)

২। কৃষ্ণকায়গণ (হার্লেমের রাজা, পরিত্যক্ত গির্জা)

৩। ইডেন মিলস হৃদবিষয়ক কবিতা (ইডেন হৃদের জোড়া কবিতা, জীবন্ত আকাশ)

৪। নিউবার্গের গ্রামাঞ্চলে এক কৃষকের কাঠঘরে (গরু)

অনুমান করি, এই কবিতাগুলি অনুবাদকের প্রিয়, সেই বিবেচনা থেকেই তাদের এই কাব্যগ্রন্থে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ‘তিন বন্ধুর কিসসা’ ও ‘হার্লেমের রাজা’ অবশ্যই নিউইয়র্কে কবি কাব্যগ্রন্থের দুই সেরা কবিতা, কিন্তু তার বাইরেও বেশকিছু কবিতা রয়েছে, যা লোরকার পরিণত ও জনপ্রিয় কবিতা হিসেবে সমধিক পরিচিত। বস্ত্তত, এই গ্রন্থের অধিক পরিচিত তিনটি পর্ব – মৃত্যুবিষয়ক, শহরে ফেরা ও দুটি গীতি কবিতা – তাতে রয়েছে লোরকার শ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক পরিচিত কবিতা ‘মৃত্যু, চাঁদ ও পোকামাকড়ের দৃশ্যকাব্য’, ওয়াল্ট হুইটম্যানের প্রতি নিবেদিত গীতিকবিতা ও নিউইয়র্ক। নিউইয়র্কে কবি কাব্যগ্রন্থকে যে অনেকে – স্পেন্ডার ও ব্লাই তাদের অন্তর্গত – লোরকার শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বিবেচনা করে থাকেন, তা এই কবিতাসমূহের জন্যই। পরবর্তী কোনো এক সংস্করণে সাজ্জাদ শরিফ যদি এ-কবিতাগুলি অন্তর্ভুক্তির কথা বিবেচনা করেন, তাতে পাঠক কৃতজ্ঞ হবেন।

নিউইয়র্কে লোরকার অভিজ্ঞতা খুব মধুর ছিল না। এই কাব্যগ্রন্থের প্রায় প্রতিটি কবিতায় তাঁর বিরক্তি ও বিবমিষার প্রতিভাস রয়েছে। নিউইয়র্কের বিখ্যাত সমুদ্রপার কনি আইল্যান্ড ভ্রমণের পর লোরকা যে-কবিতাটি লেখেন তার নাম ‘বমনরত জনতার ভূদৃশ্য। নিউইয়র্কের অন্যতম উপশহর স্টাটেন আইল্যান্ডে ভ্রমণ শেষে লেখা কবিতার নাম ‘প্রস্রাবরত জনতার ভূ-দৃশ্য’। বস্ত্তত, ১৯২৯-৩০-এর নিউইয়র্কে সত্যি প্রীত হবার মতো খুব বেশি অভিজ্ঞতা থাকার কথা নয়। চারদিকে অভাব, হতাশা ও ক্ষুধার রাজত্ব। অন্যদিকে প্রবল মন্দাবস্থা সত্ত্বেও ওয়াল স্ট্রিটে চলছে মচ্ছব। ইট, পাথর ও লোহার এই শহরে লোরকা ভালোবাসার চিহ্ন খুঁজে পাননি, স্নেহের স্পর্শ পাননি, বন্ধুত্ব পাননি। সমুদ্রপারে অপরিচিত বালক-বালিকার সাহচর্য তাকে আনন্দিত করেছিল, হার্লেমে কালো মানুষের সান্নিধ্য তাঁকে ক্ষণকালের জন্য হলেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচার সুযোগ দিয়েছিল। কবিতায় তিনি সে-অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, কিন্তু তা আনন্দ ভাগাভাগির জন্য নয়, তাঁর উষ্মা ও হতাশার তীব্রতা প্রকাশের প্রতিতুলক হিসেবে। এই মহানগরে লোরকা নিজেকে একাকী ও ব্রাত্য ভাববেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু  নেই। ব্যক্তিগত সংকট সেই বিচ্ছিন্নতা ও অসংহতিকে আরো জোরালো করে তোলে। কবিতা হয়ে পড়ে আরাধ্য নির্জন আশ্রয়।

নগরজীবনের প্রতি বরাবর বিরুদ্ধ মনোভাব পোষণ করেছেন তিনি, নগরের তুলনায় গ্রাম-নিষ্পাপ, নান্দনিক ও উষ্ণ – সে-কথা বিনা ভনিতায় দাবি করেছেন। নিউইয়র্ককে তাঁর সে-প্রত্যাখ্যান কঠোর-কোমল দ্বান্দ্বিকতার মোড়কে প্রকাশিত হয়েছে। সাজ্জাদ শরিফের অনুবাদে ‘হার্লেমের রাজা’ কবিতাটির কথা ধরা যাক।

‘আহা, হার্লেম! আহা, হার্লেম! আহা, হার্লেম!

তোমার লাঞ্ছিত লালের চেয়ে,

কিংবা অন্ধকার সূর্যগ্রহণের ভেতর ক্ষোভে কম্পিত তোমার

রক্তের চেয়ে,

কিংবা গ্রহণের বোবাকালা উপচ্ছায়ায় তোমার তামাটে

সহিংসতার চেয়ে

কিংবা প্রহরীর উর্দিতে বন্দি তোমাদের মহান রাজার চেয়ে বড়

আর কোনো বেদনা নেই।

 

সাজ্জাদের অনুবাদ-কলা বোঝার জন্য এই স্তবকের ইংরেজি অনুবাদটির পাঠ অর্থবহ হবে। মূল অর্থের বড় ধরনের গড়মিল না থাকলেও তাদের কাব্যিক ডিকশনের ভিন্নতা বোঝার জন্য আমি প্রথমে পাবলো মেদিনা ও মার্ক স্ট্যাটম্যান, পরে স্টিফেন স্পেন্ডারের করা অনুবাদ উদ্ধৃত করছি :

Oh Harlem! Oh Harlem!

There is no anguish compared to your oppressed reds,

to your blood shaken inside the dark eclipse,

to your garnet violence, deaf and mute in the  shaopws.

to your great priosoner king in his janitor’s uniform.

 

Ah Harlem! Ah Harlem! Ah Harlem

There is no anxiety comparable to your oppressed

scarlets,

to your blood shaken within your dark eclipse,

to your garuet violence deaf and dumb in penumbra

to your great king, a prisoner with a commissionaire’s

uniform

মূল রচনায় লোরকা নাটকীয়তা অর্জনের লক্ষ্যে তিনবার ‘অয় হার্লেম!’ লিখেছিলেন, স্পেন্ডারের মতো সাজ্জাদও সে নাটকীয়তা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। শুধু ইংরেজি নয়, মূল স্প্যানিশকেও যে তিনি অনুসরণ করেছেন, এ থেকে তা অনুমিত। মার্কিন ও ব্রিটিশ ইংরেজির তারতম্যের কারণে স্প্যানিশ conserje শব্দটি যথাক্রমে janitor ও commissionaire-এ রূপান্তরিত হয়েছে। সে-শব্দের বাংলা ‘প্রহরী’ শাস্ত্রসম্মত হলেও তার ব্যবহারিক গুরুত্ব রক্ষিত হয়নি। মার্কিন সংস্কৃতিতে জ্যানিটর বলতে বড় বড় ভবনের দৌবারিক ও ভবন পরিষ্কারক ভাবা হয়। লোরকার লক্ষ্য ছিল সামাজিক শ্রেণিবিভাজনে নিগ্রোদের অধস্তন অবস্থান বোঝানো। প্রহরী হিসেবে তাদের বর্ণনা করলে সে-বিভাজন অর্জিত হয় কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।

তবে শুধু যে আক্ষরিকতা নয়, কবিতার বেগ ও আবেগ অর্জনে সাজ্জাদ কতটা সচেষ্ট ছিলেন, তা বোঝার অন্য একই কবিতার আরো একটি স্তবকের দিকে নজর দেওয়া যাক। কবিতা হিসেবে সে-সাফল্য অর্জিত হলেও কবির অনুসৃত ভাব ও যুক্তি সর্বদা অর্জিত হয়েছে, সে-কথা বলা যাবে না। এই সমস্যা কেবল বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে নয়, ইংরেজি অনুবাদেও রয়েছে। সাজ্জাদের বাংলা অনুবাদ ছাড়াও একই স্তবকের দুই ভিন্ন অনুবাদের তারতম্য বোঝার জন্য প্রথম স্পেন্ডার ও পরে মেদিনা-স্ট্যাটম্যানের ইংরেজি অনুবাদের উদ্ধৃতিও দেব।

তোমাদের শায়িত রাতে রক্তের কোনো দরজা নেই।

তোমাদের মুখে নেই লালিমা। রক্ত খেপে ওঠে চামড়ার তলে,

জ্যান্ত হয়ে থাকে ছুরির মেরুদন্ডে আর নিসর্গের বুকে,

সাঁড়াশি আর কর্কটের স্বর্গীয় চাঁদের স্কচের তেজের নিচে।

 

The blood has no doors in your night face

upwards,

There is no blushing. Furious blood under the skins,

alive in the thorn of the dagger and in the breast

of landscapes,

under the pincers and the broom of the celestial

Moon of Cancer.

(স্পেন্ডার)

 

Blood has no doors in your night, face up.

There is no shame. Furious blood under the skin

alive in the dagger’s spine and in the breast of

the landscapes,

under the clamp and small yellow flowers of the celestial Moon of Cancer.

 

(মেদিনা-স্ট্যাটম্যান)

মূল স্প্যানিশের পাশাপাশি এই তিন উদ্ধৃতি পড়লে সাজ্জাদের  অনুবাদকেই লোরকার সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী মনে হয়, বিশেষত যদি তার গতিময়তা ও শব্দের পরিমিত ব্যবহারের কথা বিবেচনা করি। সমস্যা বাধে স্তবকের শেষ বাক্যটি নিয়ে। স্পষ্টত সাজ্জাদের অনুবাদে ‘স্কচ’ শব্দটি মুদ্রণ-বিভ্রাটের কারণে স্থান পেয়েছে। অথবা  সে-শব্দের অর্থ উদ্ধারও সম্ভব হয় না। (লোরকার ব্যবহৃত ‘Celeste luna de cancer’-এর আক্ষরিক অনুবাদ অবশ্যই কর্কটের স্বর্গীয় চাঁদ, কিন্তু আসলে কী বলতে চাইছেন কবি?) সাজ্জাদ লোরকার ব্যবহৃত ‘লাস রতোমাস’ বা ঝাড়ু শব্দটি এড়িয়ে গেছেন। অন্যদিকে মেদিনা-স্ট্যাটম্যান সে-শব্দের স্থলে ‘small yellow flowers’ করেছেন, কিন্তু কেন, তা উদ্ধার সে-অনুবাদের সরল পাঠ থেকে অসম্ভব। লোরকার কবিতায় চাঁদের বিভিন্ন ব্যবহার  আমরা দেখেছি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা মৃত্যু অর্থে ব্যবহৃত। এই কবিতাতেই অন্যত্র কবি লিখেছেন, ‘চাঁদের অ্যাজবেস্টসের নিচে।’ চাঁদকে আমরা বরাবর সৌন্দর্যের সঙ্গে সংযুক্ত করতে অভ্যস্ত, তাকে নারীর রূপের সঙ্গেও তুলনা করে থাকি। কিন্তু লোরকার কাছে তার অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন, চাঁদকে তিনি সংযুক্ত করেছেন দুরারোগ্য ক্যান্সারের সঙ্গে অথবা অ্যাজবেস্টসের সঙ্গে, যার প্রতিক্রিয়ায় কর্কট রোগের সম্ভাবনা থাকে। ‘হার্লেমের রাজা’ কবিতাটি আগাগোড়া বিবেচনা করলে এ-কথা বোঝা দুষ্কর হয় না যে, লোরকা বস্ত্তত হার্লেমের নিগ্রোদের অসহনীয় জীবনযাত্রার কথাই বলেছেন, মূলত সে- জীবনকে প্রত্যাখ্যানের তাড়না থেকে। যে-ন্যায়বোধ থেকে লোরকার নিজের রাজনৈতিক চেতনার নির্মাণ, তার প্রভাবে হার্লেমের অসহনীয় জীবনযাত্রাকে প্রত্যাখ্যান করলেও এই শহর তার  বাসিন্দাদের লোরকা নিকটবর্তী বিবেচনা করতেন। তাদের সঙ্গে একাত্মবোধ করতেন। সেই সংহতিবোধ থেকেই লোরকা লিখেছেন :

 

Es preciso cruzar los puentes

y llegar al rubor negro

para que el perfume de pulmon

nos golpeelas sienes con su vestido

de caliente pina.

 

It is necessary to cross the bridges

and to reach the black murmur,

so that the perfume of lungs strikes our

temples

with its suit of stained frenzy.

 

(স্টিফেন স্পেন্ডারের অনুবাদ)

 

One must cross the bridges

and arrive at the black shame

so that the lung’s perfume

hists our temples with its clothing

of hot pineapple.

 

(পাবলো মেদিনা ও মার্ক স্ট্যাটম্যানের অনুবাদ)

 

সেতুটি পেরিয়ে

বিড়বিড়ানো কালোদের কাছে যাওয়া দরকার

যেন তাদের ফুসফুসের সুগন্ধ

গরম আনারসের পুরসহ

হতে পারে আমাদের মন্দিরের ভোজ।

 

(সাজ্জাদ শরিফের অনুবাদ)

 

এই তিনটি অনুবাদের মধ্যে অসামাঞ্জস্য লক্ষণীয়। দ্বিতীয় বাক্যটি লক্ষ করুন। তিন অনুবাদক বাক্যটিকে তিনভাবে ভাষান্তর করেছেন, তাতে বক্তব্যের ব্যত্যয় ঘটেছে, কবিতার গাঁথুনিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মূল কবিতায় লোরকা Y llegar al rubor negro ব্যবহার করেছেন, যা আক্ষরিকভাবে দাঁড়ায় ‘পৌঁছাতে হবে রাঙ্গা নিগ্রোদের কাছে’। কবিতাটির আনুপূর্বিক ভাবানুসরণ করে স্পেন্ডার তার ভাবান্তর করেছেন ‘কালো মানুষের অস্ফুটালাপে’, আর মেদিনা-স্ট্যাটম্যান লিখেছেন ‘কালোমানুষের কলঙ্কে’। বাংলায় সাজ্জাদ এই বাক্যাংশের যে-ভাষান্তর করেছেন, মূলের তুলনায় তা সবচেয়ে দূরত্বে অবস্থিত। স্তবকের শেষ বাক্য দুটির ভাষান্তরেও রয়েছে বিভ্রান্তি। স্পেন্ডার ও মেদিনা-স্ট্যাটম্যান উভয়েই ‘temples’ শব্দটি ব্যবহার  করেছেন, ‘ললাটের দুই পাশের অংশ’ এই অর্থে। এক শব্দে সে-কথার অনুবাদ অসম্ভব, কিন্তু সে-শব্দের ভাবান্তরে সাজ্জাদ তাকে কেন মন্দির বললেন, তা আমার বোধগম্য নয়। কবিতাটির মূলে ব্যবহৃত ‘রাঙা নিগ্রো’ কথাটির আক্ষরিক অর্থান্তর করেছেন। লোরকা নিজে তার নিউইয়র্ক-বাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে যে-ভাষণ দেন, তাতে সে-ব্যবহারের একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। লোরকা লিখেছেন, হার্লেমে বেড়াতে এসে সবার আগে তাঁর নজরে পড়ছে সেখানকার লালরঙা ইটের ঘরগুলোর দিকে। নিউইয়র্কে এখনো অধিকাংশ ইটের বাড়ি লালচে রঙের, তাতে আলাদা কোনো পলেস্তারার ব্যবহার নেই। সম্ভবত এই বহিরাবরণকে কালোদের রঙের সঙ্গে বৈসাদৃশ্য চিহ্নিত করার ইচ্ছা থেকেই ‘রাঙা নিগ্রো’ প্রতীকের ব্যবহার।

‘হার্লেমের রাজা’ কবিতার এটি সম্ভবত সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ স্তবক। কবিতাটিতে কালো মানুষের অধিকারহীনতা ও তার পাশে শ্বেত-সভ্যতার ঔদ্ধত্যের প্রতি নিন্দা খুব সহজেই চোখে পড়ে। কিন্তু শুধু সেই রাজনৈতিক সমালোচনাতেই কবিতাটির বক্তব্য সীমিত নয়। ‘আমাদের সেই সব সেতু পেরিয়ে যেতে হবে’, কেননা, কালো মানুষদের সঙ্গে সংহতি জানানোর সেটাই একমাত্র পথ – তাদের নিকটবর্তী হওয়া। কালোদের প্রতি তাঁর এই সংহতির অন্য একটি সম্ভাব্য অর্থের কথাও আমরা ভাবতে পারি। অবস্থাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও লোরকা ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন ভাবতেন, তার সমকামিতার কারণে সামাজিক একাকিত্বে পীড়িত হতেন। সম্ভবত সে-কারণে আমেরিকার ব্রাত্য রাঙাকায়দের নিকটবর্তী হয়ে তিনি বুকের ভার কিছুটা হলেও লাঘব করার শক্তি খুঁজেছিলেন।

হার্লেমের রাজা কবিতাটি, লোরকার নিজের ভাষায়, একটি প্রতিবাদ। ১৯৩২ সালে, মাদ্রিদের কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে লোরকা নিউইয়র্কে কবি এ-নামের প্রস্তাবিত বই থেকে কবিতা পড়ে শোনান, এবং  সে-কবিতার নিজস্ব ব্যাখ্যা উপস্থিত করেন। হার্লেম নিয়ে তাঁর বলা কথার সবটাই উদ্ধৃতিযোগ্য। এখানে তার কিয়দংশ উপস্থিত করছি।

আমার চোখের সামনে যা ছিল তা যেমন নান্দনিক বিশিষ্টতামন্ডিত ছিল না, তেমনি তা ছিল না কোনো নীলাভ স্বর্গ। হার্লেম ছিল, আমার চোখে, পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষ-কায়-অধ্যুষিত নগর, যে-নগরের সড়ক ধরে আমি হেঁটে বেরিয়েছি। এখানে কদর্যতাও একধরনের নিষ্পাপতায় রঞ্জিত, যা ক্রমশ রূপান্তরিত হয় দুর্ভাবনায় ও এক ধরনের ধর্মীয় অভিজ্ঞতায়।

এই বাড়ি  বাড়িগুলো লাল ইটের, ঘরে ঘরে রয়েছে পিয়ানো বাদন, রেডিও ও সিনেমা, কিন্তু তার সঙ্গে রয়েছে প্রথাগত অবিশ্বাস।… আমি আমেরিকার কালো মানুষদের নিয়ে কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম। কালো হওয়ার জন্য কি বেদনার শিকার তারা, সে-কথা তুলে ধরতে চেয়েছিলাম। তারা সারাক্ষণ এই চিন্তায় ভীত যে, এক সময় তারা বিস্মিত হবে কী করে গ্যাসের চুলা ধরাতে হয়, অথবা মোটরগাড়ির চাকা ঘুরাতে হয়, অথবা মার দেওয়া জামার কলার কী করে ভাঁজ করতে হয়। দুই চোখের মাঝখানে কেউ কাঁটা চামচ বসিয়ে দেবে, এই ভাবনায় তারা ভীত।

আমি তাদের এ-অবস্থার প্রতিবাদ করেছিলাম, ‘হার্লেমের রাজা’ সে-প্রতিবাদের প্রমাণ। এই কবিতায় আমি চেয়েছিলাম কালো মানুষদের চেতনা তুলে ধরতে, চেয়েছি তাদের বুকে বল দিতে, যারা   যারা ভয়ে কুঁকড়ে থাকে এবং সন্তর্পণে সাদা নারীর মাংস খোঁজে।’

 

স্পষ্টতই লোরকা এই কবিতায় শুধু নিউইয়র্কের নয়, যে-কোনো বড় নগরসভ্যতার বিরুদ্ধে তাঁর অসন্তোষ – তাঁর প্রত্যাখ্যান – উচ্চারণ করেছেন। সে-বিষোদ্গারণে নিউইয়র্ক তার একটি ব্যবহারযোগ্য লক্ষ্যবস্ত্ত মাত্র। নিউইয়র্কে আসার আগেই ওয়ালস্ট্রিটের বল্গাহীন লালসার কথা তিনি জানতেন, এই মহলে মন্দাবস্থার সময় তাঁর ব্যক্তিগত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সে-মনোভাবকে আরো শানিত করে। ‘হার্লেমের রাজা’ কবিতায় তার প্রমাণ রয়েছে। সাজ্জাদের অনুবাদে সে-কথা অনুসরণ করা যাক।

 

হত্যা করা দরকার মদের শ্বেতাঙ্গ ফেরিয়ালাদের

আর আপেল ও বালির প্রত্যেক বন্ধুকে

আর ঘুষি মারা দরকার

বুদবুদে ভরা, কম্পমান ছোট ইহুদি নারীটিকে

যেন হার্লেমের রাজা গাইতে পারে তার লোকেদের নিয়ে,

যেন চাঁদের অ্যাজবেস্টসের নিচে

দীর্ঘ সারিতে ঘুমাতে পারে কুমিরেরা,

যেন পালকের বুরুশ কেরানি, তামার কড়াই আর রান্নাঘরের সবার

অনন্ত সৌন্দর্যে কারও সন্দেহ না জাগে।

একই গ্রন্থের অন্য একটি কবিতা, ‘দপ্তর ও প্রত্যাখ্যান’, যা সাজ্জাদ শরিফের অনুবাদগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়নি – তাতে নিউইয়র্কের সামাজিক বিভাজন বিষয়ে লোরকার প্রত্যাখ্যান ও নির্মম সমালোচনা আরো প্রত্যক্ষ।

 

আমি ঘৃণা করি সেই পঞ্চাশ ভাগকে

যারা উপেক্ষা করে জনতার অবশিষ্ট পঞ্চাশ ভাগকে

শাপমুক্তি যাদের অসম্ভব

যারা বহন করে সিমেন্টের ভারী বোঝা

যেখানে হৃদকম্প শোনা যায়

ইতোমধ্যে বিস্মত পশু শাবকদের

এবং যেখানে আমরা সবাই পরিণত হবো

কীটের শেষ ভোজে।

 

মূল কবিতার লোরকা ‘Yo denuncio’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যার অক্ষরিক অর্থ অভিযুক্ত করা, যদিও অভিযোগ নয়, শ্বেত-সভ্যতার কাঠামোগত বৈষম্য ও ন্যায়হীনতাকে প্রত্যাখ্যান করাই লোরকার লক্ষ্য। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্প্যানিশ সাহিত্য ও ভাষার অধ্যাপক রিচার্ড প্রেডমোর তাঁর লোরকাস নিউইয়র্ক পোয়েট্রি (ডিউক প্রেস, ১৯৮০) গ্রন্থে কবিতার এই অংশ উদ্ধৃত করে মন্তব্য করেছেন, লোরকা নিউইয়র্কের প্রতীকময়তাকে ব্যবহার করেছেন সমকালীন বিশ্বের কদর্যতা প্রকাশের বাহন হিসেবে। কবি শুধু নিউইয়র্ক নয়, সকল নগরসভ্যতা, তার নির্দয় উদাসীনতার প্রতি নিজের ঘৃণা উদ্গিরণ করছেন। মাদ্রিদে তাঁর বক্তৃতাতেও সেই প্রত্যাখ্যান ও ঘৃণা একই রকম নির্মোহ কঠোরতায় পুনরুচ্চারিত হয়।

 

‘হার্লেমের রাজা’ কবিতায় শুধু ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যান নয়, কৃষ্ণকায়দের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংহতির বার্তা উচ্চারিত হয়েছে। এমনকি আসন্ন এক বিপ্লবের সংকেতও তাতে রয়েছে। আগেই বলেছি, লোরকা রাজনৈতিকমনস্ক হলেও রাজনীতিক নন। তাঁর কবিতায় রাজনীতির যে-প্রকাশ তা নিম্নকণ্ঠ, সাংকেতিকতায় মোড়া। এই কবিতায় বিপ্লবের সম্ভাবনার প্রতি যে-উচ্চারণ, তা সেই সাংকেতিকতার ঊর্ধ্বে নয়। সাজ্জাদের অনুবাদে এ-বাক্যাবলির প্রতি নজর দেওয়া যাক :

 

রক্ত বয়, রক্ত বয়ে যাবে

ছাদে ছাদে সর্বত্র।

আর পুড়িয়ে দেবে শ্বেতাঙ্গিনীদের ক্লোরোফিল,

আর বেসিনের নিদ্রাহীনতার কাছে শয্যার পায়ে কাতরাবে,

আর ফেটে পড়বে তামাকের ছটায় ও নম্র হলুদে।

 

আমি জানি লোরকা স্পেনের খ্রিষ্টীয় সাংস্কৃতিক এতিহ্যের অনুসারী ছিলেন। যে-ন্যায়বোধ দ্বারা তিনি তাড়িত ছিলেন, তার পেছনে ছিল খ্রিষ্টীয় ন্যায়বোধের চেতনা। এই কবিতাতেও তার প্রমাণ মেলে। একই গ্রন্থের অপর কবিতা, রোমের প্রতি আর্তনাদ, তাতে সে-ভাবচেতনা আরো স্পষ্ট। এক ধরনের  অদৃষ্টবাদী চেতনার অনুরণন রয়েছে সে-কবিতায়, ভবিষ্যতের পরিবর্তন- অথবা বিপ্লব – তা ঈশবরের নির্দেশেই অর্জিত হবে, এমন এক বিশ্বাসবোধ সেখানে প্রকাশিত হয়। কিন্তু যতদিন সে-পরিবর্তন অর্জিত না হচ্ছে, কালো মানুষদের নিগৃহীত হতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে তাদের সংগঠিত হতে হবে, বিপ্লবের জন্য যে-ত্যাগ, তার  জন্য প্রস্ত্তত হতে হবে।

 

ততদিন, ততদিন, ততদিন

কালো মানুষেরা, যারা সাফ করে পিকদানি

কালো বালকেরা, যারা ভয়ে কাঁপে শ্বেতকায় দপ্তর প্রধানের লম্ফ ঝম্পে

কালো নারীরা, যারা ডুবে থাকে খনিজ তেলে

হাতুড়ি, ভায়োলিন অথবা মেঘমালায়

তারা চিৎকার করতে থাকবে, যদিও

তাদের মগজ থেঁতলে আছে দেয়ালে, তারা

চিৎকার করবে গম্বুজওয়ালা ভবনের সামনে

চিৎকার করবে দাউদাউ আগুনের প্রতিবাদে

চিৎকার করবে তুষারপাতের বিরুদ্ধে

চিৎকার করবে মাথায় মলের বোঝা নিয়ে

চিৎকার করবে নিশিথে সমস্বরে

চিৎকার করবে এমন ভগ্ন কণ্ঠে, যা শুনে

বালিকার মতো ভীতসন্ত্রস্ত হবে নগর, এবং

তারা তৈল ও সংগীতের শৃংখল ভেঙে বেরুবে

কারণ

আমরা চাই প্রতিদিনের বরাদ্দ রুটি

প্রভাতী ফুল ও অনন্ত স্নেহ

চাই পূর্ণ হোক প্রকৃতির ইচ্ছা, যেন

তার ফুল ও ফল পৌঁছায় প্রতিটি মানুষের হাতে।

লোরকা-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রিচার্ড প্রেডমোর আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, নিউইয়র্কে কবি, কাব্যগ্রন্থে যে প্রবল ও আবেদনবাহী উচ্চারণে ন্যায়বিচার – অন্যকথায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন লোরকা, এর আগে তাঁর সে-কণ্ঠস্বর শোনা যায়নি। অসত্য নয় যে, সামাজিক ন্যায়বোধ তিনি বরাবর অনুভব করেছেন, কিন্তু তা অর্জনে কোনো বৈপ্লবিক সম্ভাবনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হননি। নিউইয়র্কে মন্দাবস্থার সময় প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতাই তাঁকে বাঁক ফেরানোর দিকে নিয়ে যায়। এর আগে জনতার দাবির প্রতিও এমন সহমর্মিতার অনুরণন তাঁর কবিতায় আমি শুনিনি। সেজন্য বলা যায়, নিউইয়র্ক এই কবিকে এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করে, তাঁর নাগরিক দায়িত্ববোধকে জাগিয়ে তোলে। তিনি এই বিশ্বাসে জাগরিত হন যে, তাঁর শিল্পের ভেতর দিয়ে জনতার সঙ্গে সংহতি নির্মাণ সম্ভব। অধ্যাপক প্রেডমোর মনে করেন, ১৯৩২-৩৬-এ লোরকার কবিতায় সে-কথার প্রতিধ্বনি রয়েছে। এক ভাষণে লোরকা পরে উল্লেখ করেন, ‘যেদিন ক্ষুধা বিতাড়িত হবে, সেদিন ঘটবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আত্মিক পরিবর্তন। সেই মহান বিপ্লবের ফলে যে আনন্দের ফোয়ারা বইবে, তেমন আনন্দ বিশ্ব আগে কখনো দেখেনি, জানেনি। আমি এখানে একজন প্রকৃত সমাজতন্ত্রীর মতো কথা বলছি, তাই না?’

 

সাজ্জাদ শরিফকে ধন্যবাদ, লোরকার নির্বাচিত কবিতার এই অনুবাদের ভেতর বিশ শতকের একজন প্রধান কবির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটল। আমরা পরিচয় পেলাম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কীভাবে নাগরিক অভিজ্ঞতায় পরিণত হয় ও শিল্পের হাতিয়ারে রূপান্তরিত হয়। পৃথিবী বদলাবে, সে-স্বপ্ন প্রথম দেখে কবি। লোরকা সে-স্বপ্ন দেখেছিলেন। যতদিন সে-স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত না হয়, লোরকা আমাদের চেতনায় বিশ্বাসের শুকতারা হয়ে রবেন।