নিকারাগুয়ায় প্রজেক্ট ফুলপিড

মঈনুস সুলতান  

 ইসতেলি শহরের এসপানিওল বা স্প্যানিশ ভাষা শেখার স্কুল – ইসকুয়েলা হোরাইজনতির কিচেনের লাগোয়া টিনে ঢাকা আঙিনায় পাতা আছে লাঞ্চ-খাওয়া কিংবা হোমওয়ার্ক করার জন্য চেয়ার-টেবিল। আমি ভাষাশিক্ষার্থী হিসেবে ওখানে বসে লোকাল নিউজপেপারের পুরনো সংখ্যাগুলো ঘাঁটছিলাম। আজকের মতো ক্লাস করা হয়েছে, জমাও দিয়েছি রাইটিং অ্যাসাইনমেন্ট। পত্রিকা পড়া শেষ হলেই ফিরে যাব ব্লানডিনো পরিবারের পুলপেরিয়া বা মুদি-মনিহারি দোকানে। এ কৃষক পরিবারের খামারবাড়িতে আমি পেয়িংগেস্ট হয়ে বসবাস করছি। বিদেশি ভাষা শেখার প্রক্রিয়া হিসেবে তাদের পুলপেরিয়া বা মুদি-মনিহারি দোকানে আমি প্রতিদিন বিকেলে সামান্য কাজকর্ম করি। পত্রিকাগুলো গুছিয়ে উঠব-উঠব করছি, ঠিক তখন শিক্ষিকা সিনোরিতা এনতোনিয়েতা তাঁকে নিয়ে এসে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। বয়স্ক এক আমেরিকান পর্যটক, তাঁর মেরুদন্ড সোজা এবং শরীরে সুস্বাস্থ্যের কোনো খামতি না থাকলেও চুল-দাড়ি-ভুরু সব পেকে সাদা, কপাল বিস্তৃত হয়েছে আধখানা টাকে। তিনি যেন তার শ্যালককে সম্বোধন করছেন এরকম ভগ্নিপতিসুলভ ভঙ্গিতে বলেন – কাম অন ম্যান, চলো বাইরে যাই। চমৎকার বিকেল, আসো, ঘুরে বেড়াই ইসতেলিতে একসঙ্গে। সিনোরিতা এনতোনিয়েতা টিপ্পনী কাটে – হি ইজ অ্যা রাইটার, পুরনো পত্রিকা পড়তে ভালোবাসে, আর একা-একা কী যেন ছাই ভাবে, বলেই সে ফিক করে হেসে ফিরে যায় ক্লাসে; কিন্তু এ বয়স্ক মানুষটি কে? স্পষ্ট বোঝা যায়, তিনি সদালাপী, আচরণে সজ্জনও বটে। আমি তাঁর দিকে মনোযোগ ফেরাই।

তাঁর নাম চার্লস ডেভান। বয়স সত্তর, তবে ব্যায়াম করা পেটানো দেহের জন্য তাঁকে দেখায় মেরেকেটে বাষট্টির মতো। একসময় কাজ করতেন আমেরিকান এয়ার ফোর্সে, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত, ভ্রমণ করেন, নিজেকে হিস্টোরিয়ান হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। কিসের ইতিহাস – কেন তিনি তা লিখছেন ইত্যাদি জানার আগেই ইসকুয়েলার প্রিন্সিপাল সিনিওরা এডগেলিনা এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে সাদা দাড়িতে চুমো খান। কথাবার্তায় মনে হয় বছরদেড়েক আগে তিনি এখানে এসপানিওলে কোর্স করেছেন, শিক্ষিকাদের ভুলে যাননি, আবার এসেছেন তিনি একগাদা হারশির চকোলেটবার নিয়ে তাদের খোঁজখবর নিতে।

মি. চার্লসকে আমি গতকালও দেখেছি ইসতেলির স্ট্রিটে। ব্লানডিনো পরিবারের পুলপেরিয়ায় আমি শিমের বিচি, জুতার ফিতা, গেঞ্জি, হাঁসের আন্ডা ইত্যাদি গোছগাছ করছিলাম। জানালা দিয়ে রংচঙে একটি পাল সড়কে উড়ে যেতে দেখে বেরিয়ে আসি বারান্দায়। আমার চোখে ব্যাপারটি আচানকই বটে। এ বুড়ো বান্দা – মি. চার্লস শরীর ধনুকের মতো বাঁকিয়ে রোলারস্কেটের চাকাওয়ালা জুতায় ঘড়ঘড়িয়ে ছুটছেন। তার দুহাতে কায়দা করে ধরা নীল, হলুদ ও ম্যাজেন্টায় মেশানো একটি পাল। বাতাসে তা হাঙরের পেটের মতো ফুলে ওঠায় মহাশয়ের চলিষ্ণুতা বেড়েছে বেহদ। তার পেছন পেছন এরকম পাল উড়িয়ে দুটি ছেলে – বয়সে তারা লেট টিনএজার; তাদের পালগুলোকে দেখাচ্ছে বুলফাইটারদের কেইপের মতো। বিষয়টির এখানেই ইতি নয়, মেয়েটি দলছুট হয়ে পড়েছিল একটু পেছনে, সে-পালে রংধনুর বর্ণাঢ্যতা ছড়িয়ে বিকিনি-পরা গতরে মোচড় দিলে তার দেহবল্লরির দোদুল্যমানতায় ঘরবাড়ির বারান্দা ও জানালা থেকে যুগপৎ হাততালি ও শিস পড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় সম্ভবত আমার মুখ হা হয়ে বেরিয়ে পড়েছিল আলজিহবা। মেয়েটি পুলপেরিয়া অতিক্রম করে যেতে যেতে সান্ত্বনার ভঙ্গিতে আমার দিকে ছুড়ে দেয় উড়ন্ত চুমো, আমাকে এক্সাইটেড করার জন্য যার কোনো প্রয়োজন ছিল না।

মি. চার্লস খোদ ইসকুয়েলায় এসে হাজির হয়েছেন। এহেন বান্দার মূল ধান্ধা কী জানতে হয়। তাই তার প্ররোচনায় ইসকুয়েলা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামি। হাঁটতে-হাঁটতে মি. চার্লস জানতে চান – ইসতেলিতে এ-অবধি কোন কোন জায়গায় গিয়েছি, এবং কাদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি এ-সপ্তাহ কয়েকে যা যা করেছি তার একটা ফিরিস্তি দিলে মি. চার্লস সড়কে দাঁড়িয়ে পড়ে              দাড়ি-চুলকে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, এতদিন হয় তুমি এখানে আছো, বিপ্লবীযুদ্ধে নিহতদের গ্যালারিতে এখনো যাওনি, এটা কী রকমের কথা? আমি ঠিক সময় করে উঠতে পারিনি, এরকমের কমজোর অজুহাত দিতে গেলে তিনি – স্টপ ইট, বলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, তরুণদের নিয়ে আমি ওখানে একটি মজার প্রজেক্ট করছি। শহরের দু-একজন পর্যটক তাতে হাত লাগিয়েছেন। এই ওল্ডফুলের সঙ্গে যাবে ওখানে? আমি জবাব দিই – স্যার, আপনি ওল্ডফুল হলে আমি মিডল এজ্ড স্টুপিড। দুইয়ে মিলে দাঁড়ায় ফুলপিড, চলেন ফুলস্পিডে গ্যালারিতে এখনই যাওয়া যাক।

গ্যালারি তেমন একটা দূর নয়। যেতে যেতে দেখি, কৃষক পরিবারে আমি বাস করছি তার কর্তা – সিনিয়র ব্লানডিনো এক্কাগাড়িতে সারের বস্তা চাপিয়ে অন্যমনস্কভাবে বেতো ঘোড়া হাঁকাচ্ছেন। আমাদের তিনি খেয়াল করেন না। একটি পানশালার সামনে দাঁড়িয়ে তিনজন ভিখারি। তারা প্লাস্টিকের তিনটি ছোট্ট বাটিতে ভাগ করে ঢালছে ঢাউস একটি জংধরা জগ থেকে ফেনা-উপচানো বিয়ার। এ পানীয় সম্ভবত তারা খয়রাত হিসেবে পেয়েছে। গ্যালারির কাছাকাছি আসতেই জিপ স্লো করে ছোট্ট শহরের বেজায় বেঁটেখাটো মেয়র মি. চার্লসকে ড্রাইভ করতে করতে হ্যাট খুলে নড করেন।

গ্যালারির দালানের দেয়ালে অাঁকা বাণী-সংবলিত দুটি ম্যুরাল। তাদের একটু দূরে ফুটপাতের অন্য একটি দেয়ালে এ-মুহূর্তে অাঁকা হচ্ছে আরেকটি পেল্লায়মাপের ম্যুরাল। এটির বিষয়বস্ত্ত ঠিক বিপ্লব নয়, এতে বরং বিধৃত হচ্ছে সমকালের বিষয়-আশয়, ইসতেলি শহরের জীবনযাপন, সুখ-দুঃখ ও কল্পনা। রঙের ক্যান বালতিতে ধোয়ামোছার জন্য জল, ব্রাশ থেকে ছুটে আসা রঙের ছিটা থেকে ফুটপাত বাঁচানোর জন্য মেলে দেওয়া বড় কাপড় ইত্যাদি নিয়ে কয়েকজন তরুণ ও এক যুবতী ছবি অাঁকার কাজ করছে। মি. চার্লস এসেই এদের উদ্যোগে শামিল হন। কথাবার্তা বলে বুঝতে পারি, শহুরে তরুণ-তরুণীদের জন্য বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বাড়ছে ড্রাগস, গ্যাং ও ভায়োলেন্স। এর বিকল্প হিসেবে অল্পবয়সী প্রজন্মকে কিছুতে এনগেজ করার জন্য গ্যালারি আরেকটি                ম্যুরাল অাঁকার উদ্যোগ নিয়েছে। এ-কাজে সাহায্যের জন্য তারা কাসা-দে-কুলতুরা বা শহরের সংস্কৃতি ভবন থেকে ডেকে এনেছেন একজন আর্টিস্টকে। বিষয়টি জানতে পেরে মি. চার্লস, তিনি যে-হোটেলে আছেন, সেখানে মাসওয়ারি হিসেবে বাসরত এক পর্যটকের সঙ্গে গ্যালারির যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন। পর্যটক রং, ব্রাশ ইত্যাদি কেনা বাবদ কিছু টাকা-পয়সা জোগানোর সঙ্গে নিজে এসে আজ হাত লাগিয়েছেন আঁকাজোখায়।

সড়কের ওপারে ফুটপাতের ওপর সারি দিয়ে রাখা কয়েক জোড়া রোলারস্কেটের চাকাওয়ালা জুতা, রেলিংয়ে মেলে দেওয়া রংচঙে কটি পাল; ওখানে দাঁড়িয়ে গুলতানি করছে কয়েকটি ছেলেমেয়ে। মি. চার্লস আমাকে ডেকে তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। গেল দিনকয়েক হয় রোলারস্কেটে পালের ব্যবহার করে কীভাবে স্পিড বাড়ানো যায়, তা তিনি পালা করে বেশ কয়েকটি ছেলেমেয়েকে শেখাচ্ছেন। আজ তিনি ব্যাকপ্যাক থেকে বের করে তাদের হাতে তুলে দেন ছোট্ট দুটি ভিডিও ক্যামেরা। গতকাল তিনি তাদের ছবি রেকর্ড করার ওপর ঘণ্টা দেড়েকের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আজ তারা ম্যুরাল তৈরির কাজ ভিডিও করবে। মি. চার্লস এডিটিংয়ের যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছেন। ছেলেমেয়েরা আগ্রহী হলে শহরের অন্যান্য দৃশ্যেরও ছবি তুলবেন। টুকরা-টুকরা দৃশ্যপটকে জুড়ে দিয়ে কীভাবে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানানো যায়, তা তিনি তাদের শেখাতে চান। আশা করছেন মাসদুয়েক কাজ করলে এ-শহর নিয়ে তরুণরা চমৎকার একটি ফিল্ম তৈরি করতে পারবে। অনেক বছর পর মানুষ যখন এ-ফিল্ম দেখবে – তখন তারা পেয়ে যাবে একটি নির্দ্দিষ্ট সময়ের ধারণকৃত ইতিহাস।

আই অ্যাম অ্যা হিস্টোরিয়ান নাও, কাম অন ম্যান, আসো, হাত লাগাও ইতিহাস তৈরিতে, অনচু নট ইন্টারেস্টেড? বলে, মি. চার্লস আমার দিকে তাকালে ভাবি, এ-শহরে এসে প্রথমে ব্লানডিনোদের কৃষক পরিবারের সঙ্গে হাত দিয়েছিলাম চাষবাসে; এবার পালা এসেছে ইতিহাসের। দেখা যাক কী হয়? আমি নোটবুক থেকে একটি পাতা ছিঁড়ে তাতে পাঁচটি প্রশ্নের তালিকা করে মি. চার্লসকে বলি, এদের এ-সওয়ালগুলো ব্যবহার করতে বলুন। ভিডিও করার সঙ্গে সঙ্গে যারা ছবি অাঁকছে তাদের জীবনযাপন কেমন, স্বপ্নের ধরনইবা কী, তা ইন্টারভিউ করে এরা রেকর্ড করতে পারে। দিস ইজ অ্যান এক্সেলেন্ট আইডিয়া। আসো আমার সঙ্গে একটু। গ্যালারি আজকাল চালাচ্ছেন যে বিপ্লবী যোদ্ধার জননী দনিয়া নিনা আরমানদো, তাঁর সঙ্গে এখনই তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে হয়।

মি. চার্লসের সঙ্গে আমি চলে আসি গ্যালারির ভেতরবাগে। ঢুকতেই চোখে পড়ে কৌণিক ভঙ্গিতে সাজানো নীল-সবুজে মেশা বেশকিছু চিত্র। ছবিগুলো যেন মেহনতি মানুষের অবচেতনের হরেক কিসিমের স্বপ্নকে রূপ দিয়েছে সাইকোডেলিক বর্ণসম্ভারে। মি. চার্লস এ-গ্যালারির ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে বেশ খানিকটা খোঁজখবর নিয়েছেন। মানুষের স্বপ্ন ও উদ্দীপনা ছাড়াও বেশকিছু ছবিতে অত্যন্ত রিয়ালিস্টিক ভঙ্গিতে তুলে ধরা হয়েছে মূলত ৬৪ বছর ধরে স্থানীয় ফ্যাসিবাদী ডিক্টেটর সমোজা, তাদের পরিবার এবং পুঁজিবাদের  আন্তর্জাতিক অভিভাবক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের খতিয়ান। আমরা হাঁটতে হাঁটতে কিছু সাদা-কালো ছবি দেখি, যাতে নিকারাগুয়ায় ঘাঁটি গেড়ে-বসা মার্কিন দেশের মেরিন সেনানীর বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের পরিষ্কার হদিস পাওয়া যায়।

পুঁজিবাদী সমোজা চক্রের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক সান্দিনিস্তাদের বিজয় হলে এ-শহরের যারা প্রতিবাদ ও গেরিলাযুদ্ধে শামিল হয়ে প্রাণ উৎসর্গ করেছে, মূলত তাদের স্মারক হিসেবে চালু হয়              এ-গ্যালারির। যতদিন বামমার্গীরা ক্ষমতায় ছিল, এ-প্রতিষ্ঠান সরকার থেকে অনুদান পেত। তারপর নির্বাচনে ডানপন্থিরা গদিনশিন হলে বেশ কয়েক বছরের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় গ্যালারি। বামরা আবার ফিরে এসেছে পাওয়ারে। তবে হালফিল তারা বাজার অর্থনীতির সঙ্গে দহরম-মহরমে ব্যতিব্যস্ত। বিপ্লব বা মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য রক্ষায় তাদের আগ্রহ আর আগের মতো মজবুত নয়। তবে একজন জননী দনিয়া নিনা আরমানদো উদ্যোগ নিয়ে খুঁজে বের করেছেন, যেসব মা লড়াইয়ে সন্তান হারিয়েছেন তাঁদের। এ-এলাকায় এখনো বেঁচে আছেন তিনশোজন মা। দনিয়া নিনা তাঁদের নিয়ে অ্যাসোসিয়াশিওন দে মাদরেস বা, জননী সমিতি নামে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। আজকাল তাঁরাই চালাচ্ছেন এ গ্যালারি।

গ্যালারির এদিকে দেয়ালজুড়ে আটকানো নিহত বিপ্লবী যোদ্ধাদের সাদা-কালো ছবি। কিছু কিছু ছবির পাশে মৃত্যুর আগে তাদের ওপর কীভাবে টর্চার করা হয়েছিল এবং কোন পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের উৎসর্গ করেন – তার বয়ান টাইপ করে দেয়ালে সাঁটা। এ ছবিগুলোর সামনে পাওয়া যায় দনিয়া নিনা আরমানদোকে। সাদামাটা একটি টি-শার্ট গায়ে চশমা চোখের এ প্রৌঢ় মহিলা পর্যটকদের গ্যালারি দেখাচ্ছেন। অ্যাসোসিয়াশিওন ডে মাদরেস বা, জননী সমিতির কিছু মহিলাও গ্যালারিতে এসেছেন। পর্যটকদের স্মারকের নানা দিক বোঝাতে বোঝাতে দনিয়া নিনা মায়েদেরও দেখভাল করছেন। খানিক দূর থেকে তাকাতেই মনে হয় তাঁর জগৎসংসারে কী যেন একটা তীব্র প্রত্যাশা ছিল, তা ফলপ্রসূ হয়নি, তবে তিনি যুঝে যাচ্ছেন। আমি তাঁর অভিব্যক্তিকে স্টাডি করছি এটা বোধকরি তিনি বুঝতে পারেন। পর্যটকদের পাশ কাটিয়ে আমাদের কাছে চলে এসে তিনি প্রথমে মি. চার্লসকে আলিঙ্গন করেন, তারপর আমার সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে খুব স্নেহের সুরে জানতে চান – কিয়েন এস উস্তেদ বা, কে তুমি সিনিয়র, কোন দেশ থেকে এসেছ, কী করছ এখানে? আমি নিজেকে রাইটার বলতেই আমার কাঁধে হাত রেখে বলেন, গ্যালারি চালাতে যে গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছি। আউডে মে উনপকিতো বা, আমাকে একটু সাহায্য করো, করবে না? কী জবাব দেবো ঠিক বুঝতে না পারলে তিনি আবার জানতে চান – ইংরেজিতে লিখতে পারো তো সিনিয়র? আমি হ্যাঁ-সূচকভাবে মাথা দোলালে তিনি ছবিগুলোর দিকে নির্দেশ করে বলেন, এই যে ছেলেগুলো যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিল, তাদের কথা আমরা এসপানিওলে লিখে দেয়ালে ঝুলিয়েছি; কিন্তু এসপানিওলে দখল না থাকায় অনেক পর্যটক তা পড়তে পারে, না। তুমি কি একটি-দুটি কাহিনি তর্জমা করে দিতে পারবে ইংরেজিতে?

তর্জমা করা কতটা দুরূহ হবে। তার একটা হদিস পাওয়ার জন্য একটি কাহিনি পড়ার উদ্যোগ নেই। মি. চার্লস দেখিয়ে দেন কোথায় দনিয়া নিনার ছেলে দুটির ছবি টানানো। প্রথমে আমি তার ছোট ছেলে চোদ্দো বছরের হাবিয়ার আরমানদোর কথা পড়ি। তখন সান্দিনিস্তারা সমোজা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের সূচনা করেছে। দেয়ালে সান্দিনিস্তাদের গোপন ইশতাহার সাঁটার সময় ধরা পড়ে হাবিয়ার সন্ধ্যাবেলা। সমোজা সরকারের ন্যাশনাল গার্ডের সৈনিকরা পরদিন তার স্কুলের সতীর্থদের ডেকে আনে ক্যাম্পে। তাদের সামনে হাবিয়ারকে গ্যাং রেপ করা হয়। তিন দিন পর তাঁর লাশ পাওয়া যায় চার্চের পড়ো দালানের পাশে, জননেন্দ্রিয় ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় সম্পূর্ণ নগ্ন। অনুবাদ করব কি-না তা ভাবতে ভাবতে মনে মনে একটি বিষয়ের হিসাব-কিতাব করি। সমোজা সরকারকে অস্ত্রশস্ত্র প্রশিক্ষণ ও অর্থ দিয়ে মদদ করেছিল মার্কিনিরা। ইংরেজি পড়নেওয়ালা পর্যটকদের সিংহভাগ আসছে আমেরিকা থেকে। তাদের খাজনার কড়ির সঙ্গে ধর্ষিত হাবিয়ারের মৃত্যুর সরাসরি যোগসূত্র আছে। তাদের জানার প্রয়োজন আছে, কীভাবে তাদের সম্পদ ও অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে ইসতেলিতে?

আমি তর্জমা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে দনিয়া নিনার দ্বিতীয় ছেলের কাহিনি পড়ি। হাবিয়ারের  মৃত্যুর তিন মাস পাঁচ দিন পর তার বড়ভাই আঠারো বছরের আলানজো আরমানদো ন্যাশনাল                     গার্ডের ক্যাম্পে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে বাড়ি ফেরার পথে  কাসা-দে-কুলতুরা বা সংস্কৃতি ভবনের কাছাকাছি সাদা পোশাকধারী গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ে। পরদিন সেন্ট্রাল পার্কের লোকসমাবেশে নিয়ে আসা হয় আলানজোর কাটা মুন্ডু। এক অশ্বারোহী সৈনিক তার ঘোড়া দিয়ে ফুটবল খেলার মতো মুন্ডুতে লাথি কষায়। প্রথম কিকের পর মুন্ডুর খোলা চোখের দিকে তাকিয়ে ঘোড়াটি তা যে মানুষের দেহের অংশবিশেষ এ-ব্যাপারে সচেতন হয়ে লাথি মারার আদেশ অস্বীকার করে। রিফ্যুজেলে বিরক্ত হয়ে সৈনিক তাকে চাবুকপেটা করলে ঘোড়াটি তীব্র হ্রেষাধ্বনিতে সামনের দুপা তুলে প্রতিবাদ জানায়। তাতে পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে সৈনিকটি আঘাত পায়। ক্ষিপ্ত হয়ে সে ঘোড়াকে বেধড়ক পেটালে এক পর্যায়ে ঘোড়া সৈনিককে লাথি কষায়। পরদিন কমান্ড না নেওয়ার অভিযোগে সামরিক অশ্বকে ন্যাশনাল গার্ডের এক ক্যাপ্টেন শুট করে হত্যা করে। পরিবার আলানজোর লাশ সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়। সুতরাং, তার কোনো কবর নেই। এ-তথ্যের লিপিকার আরো জানাচ্ছেন যে, ঘোড়ার পদাঘাতে অশ্ব^ারোহী সৈনিকের কোমরের হাড় ভেঙে যায়। নির্ভরযোগ্য তথ্য নয়, তবে জনশ্রুতি যে, সে এখনো বেঁচে আছে, তার কোনো বিচার হয়নি; রাজধানী মানাগুয়ার শপিংমলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আজকাল সে ভিক্ষা করে। কমরেড আলানজো ধৃত হওয়ার তিন দিন আগে সান্দিনিস্তা পার্টির সদস্যপদ লাভ করেছিল।

তথ্যের নোট নিতে নিতে একটু দূরে দাঁড়ানো দনিয়া নিনার মুখের দিকে তাকাই। এবার তার অভিব্যক্তি বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না। না, সংসারে কোনো কিছুর প্রত্যাশা তিনি কখনো করেননি, কোনো অপ্রাপ্তির ছাপও নেই তার চোখেমুখে; তবে এবার আমি যা দেখছি তা হচ্ছে নিখাদ কষ্ট। রান্নাঘরের চুলার ওপর ধোঁয়ায় জমে ওঠা কালিঝুলির মতো খুব স্বাভাবিকভাবে তার মুখে লেগে আছে বিষণ্ণতার গাঢ় ছাপ। অত্যন্ত সংবেদনশীল মহিলা তিনি। আমার নীরব দৃষ্টিতে সাড়া দিয়ে কাছে এসে বলেন, চলো সিনিয়র, তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিই আরো কয়েকজন মায়ের সঙ্গে।

কোলের শিশুকে দুধ দিচ্ছেন, পাশে বন্দুক, এরকম এক বিপ্লবীর মায়ের চিত্রের নিচে মাদুর পেতে বসেছেন ছয়-সাতজন মা। তাদের কারো সন্তানের কোনো ফটোগ্রাফ না থাকায় দেয়ালে টানানো নেই কোনো ছবি। এদিকে শেলফজুড়ে রাখা নিহত মুক্তিকামী গেরিলাদের বুটজুতা, হ্যাঙারে ঝুলানো তাদের শার্ট, প্যান্ট ও জ্যাকেট। জননীরা বয়সে বৃদ্ধা হচ্ছেন, কোনো কাজ নেই, জড়িত নন কোনো কিছুতে, তাই সময় পেলেই চলে আসেন গ্যালারিতে। কথাবার্তা বলেন, ঝাড়পোছ করেন, যোদ্ধাদের জামাকাপড় ময়লা হয়ে গেলে তা কেচে ইস্ত্রি করে নিপাট করে শেলফে রাখেন, ব্রাশ করে চকচকে করে তোলেন গেরিলাদের বুটজুতা। এক জননী লাজুক হেসে বলেন, যুদ্ধে তিনিও শরিক ছিলেন, তখন তার কোলে শিশু। অনেক বছর পর তিনি কাসা-দে-কুলতুরায় ছবি আঁকাও শেখেন কিছুদিন। দেয়ালে ঝুলানো ছবিটি তাঁর অাঁকা। আমি চিত্রটির সামনে তাকে দাঁড় করিয়ে ফটো ওঠাতে চাই। রাজি হন না তিনি, লাজুক হেসে বলেন, তাঁর শিশুপুত্রটি এখন যুবক, কথাবার্তা শোনে না সে, ড্রাগস গ্যাং এসব নিয়ে আছে। স্বামীর মৃত্যুও হয়েছে যুদ্ধে। তার কোনো ফটোগ্রাফ নেই যে, এখানে এনে দেয়ালে টানাবেন। বুকে হাত দিয়ে তিনি বলেন, সিনিয়র, ছবি দিয়ে কী হবে, যারা চলে গেছে তারা তো এখানে সব সময়ই আছে।

কেউ কেউ অনুযোগ করেন, এ-বয়সে চাকরি পাওয়া ভার। সময় তাঁদের কাটে না। আমি জানতে চাই, পত্রিকা পড়তে তাঁদের ভালো লাগে কি-না? তেমন উৎসাহ দেখান না তাঁরা, আর চোখের যা হালত পড়াশোনাও তো মুশকিল। আমি ব্যাকপ্যাক থেকে নিকারাগুয়ার একটি শিশুতোষ রূপকথার বই বের করে জানতে চাই একটি গল্প পড়লে তাঁরা শুনবেন কি? বেশ আগ্রহ দেখা যায়। কেউ কেউ চশমা মুছে তা চোখে দিয়ে বলেন, পড়ো তো দেখি। আমি পরপর দুটি সংক্ষিপ্ত রূপকথা পড়ি। তারা মাঝে মাঝে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, বইয়ে সম্পূর্ণ ঠিক লিখেনি। এ-গল্পটা তো এরকম হওয়ার কথা। আমি কিন্তু একটু অন্যভাবে শুনেছি আমার আবুয়েলা বা গ্র্যান্ড মাদারের কাছে। সকলে জানতে চান কালকে কি আরেকবার আসতে পারবে সিনিয়র, অন্য একটি বই নিয়ে?

গ্যালারির বাইরে পাওয়া যায় মি. চার্লসকে। আজ তিনি রোলারস্কেট করবেন না। তাঁর তরুণ সাঙ্গপাঙ্গরা চাকাওয়ালা জুতা ও পাল নিয়ে তাঁকে ছাড়াই বেরিয়ে পড়ছে। তিনি তাদের রোলারস্কেট করার গ্রাউন্ড রুলস বা কিছু নিয়মনীতি বাতলে দিচ্ছেন। আমি তাঁকে বলি স্যার, এক কাজ করলে হয় না? দনিয়া নিনাকে দিয়ে শহরের লাইব্রেরি থেকে কয়েকটা বই আনানো যাক। আপনার সাগরেদদের কাছ থেকে দু-একটি ছেলেমেয়ে জোগাড় করে দেন। তারা কর্মহীন জননীদের গল্প পড়ে শুনাবে। জননীরাও তাদের বলবে যুদ্ধের কাহিনি, যে-যুদ্ধে এ-শহরের মেহনতি মানুষ লড়েছিল তাদের জাগতিক মুক্তি কামনা করে। দাড়ি চুলকিয়ে মি. চার্লস বলেন, দিস আইডিয়া ইজ এক্সেলেন্ট, টোটালি কুল, ছেলেমেয়েরা গল্প পড়ে শোনালে যোগাযোগ বাড়বে দুই প্রজন্মের।

তর্জমার বিষয়টি জানতে চাইলে আমি মি. চার্লসকে বলি, একটি বা দুটি এপিসোড আমি না-হয় অনুবাদ করে দিলাম। এ-কাজে আমেরিকান পর্যটকদের যুক্ত করলে ভালো হয় না? মি. চার্লস স্বীকার করেন যে, নিকারাগুয়ায় সমোজা সরকার যে-জুলুম করেছে এ-বিষয়টি শুধু পলিসি মেকার নয়, পর্যটক গোছের আদনা তিনকড়ির আমেরিকানদেরও জানা দরকার। হালফিল পর্যটনের কনসেপ্টও বদলাচ্ছে; এখন আর ভ্রমণ বলতে দিন কয়েকের জন্য ঘুরতে এসে খানকতক ছবি তুলে বা সস্তায় নারীসঙ্গীর সঙ্গে সঙ্গম করে স্বদেশে ফিরে গিয়ে বড়ফট্টাই করা বোঝায় না। আমেরিকান পর্যটকদেরও কেউ কেউ ইদানীং সংবেদনশীল হয়ে উঠছে। তারা ভিন্ন সংস্কৃতিকে বোঝার জন্য কোনো কোনো অখ্যাত এলাকায় মাসের পর মাস কাটাচ্ছে, স্থানীয়দের মেহমানদারির বিনিময়ে তারাও স্বেচ্ছাসেবামূলক কিছু কাজের মাধ্যমে সংযুক্ত হচ্ছে লোকাল কমিউনিটির সঙ্গে। কিন্তু গ্যালারির তথ্য অনুবাদে ট্যাকনিক্যাল সমস্যা হচ্ছে, এরা তো এসপানিওল তেমন জানে না। আমরা সিদ্ধান্ত নিই আমি ও মি. চার্লস, ওল্ডফুল অ্যান্ড মিডল এজ্ড স্টুপিড মিলে দু-একটা এপিসোডের মূল বিষয়টা অনুবাদ করব। তারপর মি. চার্লস খুঁজে দেখবেন আমেরিকান পর্যটকদের কাকে কাকে অনুবাদের সম্পাদনায় লাগানো যায়। গোটা বারো এপিসোড অনূদিত হলে তৈরি করা যেতে পারে একটি বুকলেট গ্যালারিতে যা বিক্রি হবে। আমরা হাই ফাইভের ভঙ্গিতে পরস্পরের করতলে তালি বাজিয়ে এ-কর্মকান্ডের নামকরণ করি প্রজেক্ট ফুলপিড।

 

দুই

ইসকুয়েলাতে মর্নিং ক্লাস সেরে দুপুরের দিকে চলে আসি গ্যালারিতে। কী কারণে জানি দনিয়া নিনা আরমানদো আজ আসেননি। মি. চার্লস মনে হলো গ্যালারিতে খুব গুছিয়ে তাঁর স্বেচ্ছাসেবা প্রদান করছেন। তিনিই ছবি টানানো কার্ডবোর্ডের দেয়ালের পেছনে একটি ডেস্ক টেনে এনে আমাকে বসিয়ে দেন। আমি ডিকশনারি ঘেঁটে একটি এপিসোডের অনুবাদ শুরু করি। অ্যাসোসিয়াশিওন দে মাদরেসের জনাকয়েক জননীও এসে গেছেন। তারা খোঁজ নেন নতুন বই কিছু নিয়ে এসেছি কি-না? আমার ব্যাকপ্যাকে বই আছে বেশ কয়েকটি। খুব উৎসাহের সঙ্গে নিকারাগুয়ায় মার্কিন মেরিন সেনানীদের উৎখাতের গেরিলা বিষয়-আশয় নিয়ে লেখা একটি বই তাদের মনে ধরে। মি. চার্লস কথা রাখেন, তিনি রোলারস্কেট করনেওলা দুটি ছেলেকে দায়িত্ব দেন মাদের গল্প পড়ে শোনানোর।

গ্যালারিতে আজ পর্যটক তেমন আসেনি। খানিক দূরে নিহত যোদ্ধাদের জুতা-জামা-কামিজ-কোটের শেলফের আড়ালে মি. চার্লস তার ফেসপেইন্টের পশরা মেলে ধরেছেন। দিনকয়েক পর শহরে দুদলের সকার বা ফুটবল ম্যাচ হবে। মাঠে যাতে শান্তি বজায় থাকে এজন্য যেসব ছেলেমেয়ে স্বেচ্ছায় কাজ করবে, তাদের মুখে তিনি লাগিয়ে দিচ্ছেন ফেসপেইন্ট। একটি মেয়ে সারামুখে গাঢ় নীল রং মেখে খিলখিল করে বেরিয়ে এলে আমার অনুবাদে বিঘ্ন ঘটে। ডিপ ব্লুর সঙ্গে সে ঠোঁটে মেখেছে ডগমগে লাল রঞ্জনি। তাকে আমি দেখেই চিনতে পারি। দিনদুয়েক আগে আমি ব্লানডিনো পরিবারের পুলপেরিয়া বা মুদিদোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকে দেখেছি বিকিনি-পরা গতরে মোচড় দিয়ে মি. চার্লসের পেছন পেছন পাল তুলে রোলারস্কেট করছে।

তার চোখের বর্ণ হাল্কা সবুজ। পাপড়ির নিচে নাকজুড়ে আড়াআড়ি করে টানা সাদা দাগ, তাতে তার সকার ক্লাবের লগো অাঁকা। চোখাচোখি হতেই আমি হাত তুলে তাকে ওয়েভ করি, সে স্ফুরিত ঠোঁটে চুমোর ভঙ্গি করে। মনে হয় তার মধ্যে চুম্বন প্রদানের একটি প্রবণতা বিরাজ করছে। তবে তা গ্রহণের মতো লোকজনের অনটন পড়েছে কি-না ঠিক বুঝতে পারি না। সবুজ চোখের মেয়েটি বইয়ের গল্প শুনতে থাকা জননীদের কাছে এসে শরীরের অ্যাপিলময় মনোজ্ঞ ভঙ্গি করলে ছুড়ির কান্ড দেখে বুড়িরা হেসে ওঠে। মেয়েটি খেলার মাঠে তার সকার টিমের সাপোর্টার হিসেবে তাদের যেতে বলে। সঙ্গে সঙ্গে বই পড়া ছেড়ে সকলে মেতে উঠে সকার-বিষয়ক সম্ভাব্য গন্ডগোলের আলোচনায়। আরো দু-তিনটি ছেলেমেয়ে নীল রঙের মুখ নিয়ে এসে কথাবার্তায় ফোঁড়ন দেয়।

গ্যালারি থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখি জননীদের একজন কীভাবে মার্কিন মেরিন সেনাদের উৎখাত করা হয়েছিল তার গল্প বলছেন। মি. চার্লস মন্তব্য করেন এ-মুখে বলা কাহিনিগুলো টেপে রেকর্ড করতে পারলে লোকাল হিস্ট্রি হতে পারত। দুই প্রজন্মের মধ্যে গল্পগুজব হচ্ছে, এটা খারাপ না, তবে এ-তৎপরতা জারি থাকবে কতদিন? জানতে চাইলে মি. চার্লস রেসপন্সে বলেন, মাত্র কিছু একটা শুরু করলাম, এ তো সকাল, এখনই হাল ছেড়ে দেবো? তিনি রোলারস্কেটে পালউড়ানো লোক, তাই আমি কোনো মন্তব্য করি না। হাঁটতে-হাঁটতে তিনি বলেন, চলো, দনিয়া নিনা আরমানদোর বাড়িতে যাই। তার নিশ্চয় কিছু হয়েছে, আজ আসেননি কেন?

আমার বিকেলে করার তেমন কিছু নেই, খোঁজ করা যেতে পারে দনিয়া নিনার; কিন্তু তাঁর বাড়িতে যাওয়ার আগে মি. চার্লসের আরেকটি কাজ বাকি আছে, সেটা তিনি সারতে চান। সকারের পাল্টি টিমের সাপোর্টার ছেলেমেয়েদের জন্য তিনি হলুদ ফেসপেইন্ট নিয়ে ঘুরছেন। প্রথমে তিনি তাদের মুখে পেইন্ট মাখিয়ে দিয়ে তবে দনিয়া নিনার ওখানে যেতে চান। তা বেশ, আমি তো আজ তার সঙ্গেই আছি।

এ বান্দা ইসতেলির এমন অনেক জায়গা চেনেন, যেখানে আমি কখনো আসিনি। আমাকে নিয়ে তিনি চলে আসেন চমৎকার চুনকাম করা সাদা এক দালানের সামনে। ওখানে রেলিং দিয়ে ঘেরা জায়গায় রাখা বিপ্লবীযুদ্ধে ব্যবহৃত ভাঙাচোরা জংধরা একটি ট্যাংক। তার চেনঅলা চাকার ওপর দাঁড়িয়ে বেজায় রংচঙে একটি মোরগা ম্রিয়মাণ দেখতে এক মুরগির সঙ্গে যা করছে তাকে এসপানিওল কী বলে আমি ঠিক জানি না, তবে বাংলায় বিষয়টি শৃঙ্গার। আমি তাকাচ্ছি দেখে মুরগা লাফ দিয়ে ট্যাংকের ওপর চড়ে বসে সূর্যের দিকে গ্রীবা বাড়িয়ে অ্যায়সা জোশে কুক-কুরুকু আওয়াজ তুলে যে, মি. চার্লস শিউরে ওঠেন। শারীরিক অন্তরঙ্গতার জন্য কুক্কুট যুগল যে-লোকেশন বেছে নিয়েছে, তা অভাবিতপূর্ব বলে আমি জার্নালে উল্লেখ করি। সকারের পাল্টি টিমের ছেলেমেয়েদের এখানে থাকার কথা, কিন্তু তাদের নাগাল পাওয়া যায় না। ফেরার সময় দেখি ট্যাংকের পেছনে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বসে একটি তরুণ। সে এক টুকরা সিগার জ্বালাতে চাচ্ছে তার রোদচশমায় সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে। তাতে কাজ না হলে সে রেলিংয়ে থাবড়া মেরে বলে নো, নো ট্রাবাখা, মালদিতা সে বা, না, কাজ হচ্ছে না, ড্যাম ইট। মি. চার্লস মাটিতে উবু হয়ে বসে তার সিগার জ্বালিয়ে দিয়ে বলেন, হোয়াট হ্যাপেন টু ইউ সান? ধোঁয়া ছেড়ে চোখ বন্ধ করে সে তমে কোকেইনা তিও বা, আমি কোকেন নিয়েছি আংকেল বললে আমি বুঝতে পারি, এ-ছেলে ও তার সাঙ্গপাঙ্গকে মি. চার্লস হলুদ রঙের ফেসপেইন্ট মাখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি তাকে কৌটা খুলে হলুদ ফেসপেইন্ট দেখান। সে তা আঙুলে নিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে মাখিয়ে দেয় ফুটপাতে। এ সকার টিমের যারা সাপোর্টার, গ্রুপের অন্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তার হাতে রং দিলে সে না আবার তা দিয়ে ছংবং করে। তার আঙুল আলগা হয়ে পোড়া সিগার মাটিতে পড়ে গেলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে পড়েন মি. চার্লস। স্পষ্টত ফুলপিড প্রজেক্ট নিয়ে তার মনে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে। আমি সান্ত্বনা দিতে চাই, জননীরা তো দিব্যি গালগল্প করছে। এই তো আমাদের প্রকল্প, এ নিয়ে অত ভাবনাচিন্তার কী আছে? দেখা যাক কী হয়?