নিজস্ব স্বরের সন্ধান

মোস্তফা তারিকুল আহসান
কবি মাত্রই স্বীকার করবেন যে, কবিতায় নতুন স্বর খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টকর, বিশেষ করে নতুন কবিদের বেলায় বিষয়টি আরো জটিল হয়ে দাঁড়ায়। কিছু কবি আছেন যারা প্রচলিত বিষয়কে নিয়েই কবিতা লেখেন, কোনো নতুন পথের দিশা না পাওয়া সত্ত্বেও তিনি বেশ তরতর করে কবিতা লিখে চলেন, এভাবে কখনো দু-একটি ভালো কবিতাও লিখে ফেলতে পারেন। তিনি আপাতভাবে সফল তবে তাঁর কবিতার দীর্ঘস্থায়ী কোনো আবেদন থাকার কথা নয়। তাঁরা মূলত ছদ্মকবি, কিছুটা কাব্যশক্তি তাঁদের থাকলেও তাঁরা সত্যিকার অর্থে কবি নন। মূলত কিছু কৌশল করে তাঁরা কবিতা (পদ্য) লেখেন, কবিতা হয়ে-ওঠার কিছু কৌশল তাঁরা শিখে নেন কোনোভাবে এবং খ্যাতির লোভে বা মোহে কবিতাকে ব্যবহার করেন অস্ত্র হিসেবে। পৃথিবীর কোন দেশের কী অবস্থা ঠিক করে বলা মুশকিল, তবে বাংলাদেশে এই জাতীয় কবির সংখ্যা বেশি। তাঁদের দৌরাত্ম্যে প্রকৃত কবিদের নাভিশ্বাস উঠছে। তবু সাহিত্যে সবচেয়ে প্রাচীন ও সমৃদ্ধ শাখা কবিতার প্রতি সাধারণ পাঠকের আগ্রহের কমতি নেই। প্রকৃত কবি আজ অনেকটা নির্বাসনে, তিনি নিভৃতচারী হতে পারেন, তবে তাঁকে আলোকিত বা সম্মানিত করারও দায় রয়েছে বিদগ্ধজনের।
কবি ও কথাসাহিত্যিক জুলফিকার মতিনের সর্বশেষ কাব্যটি পড়তে গিয়ে যেসব অনুভূতি আমাকে আক্রান্ত করেছে তার খানিকটা প্রতিক্রিয়াস্বরূপ উপরোক্ত কথাগুলো বলা। মনে পড়ে ২০০১ সালে কবি জুলফিকার মতিনকে নিয়ে একটি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় তাঁর প্রথম কাব্য স্বৈরিণী স্বদেশ তুই (১৯৭২) নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে আমি বলেছিলাম প্রথম কাব্য হিসেবে জুলফিকার মতিনের কাব্যশক্তি ও নতুন কাব্যলোকের কথা। স্বদেশকে দেখার এক আলাদা ব্যঞ্জনা লক্ষ করা যায় এ-কাব্যে। স্বদেশের বিভিন্ন প্রসঙ্গকে একেকটি চরিত্র হিসেবে দাঁড় করিয়ে নাট্যকাব্যের আদলে নিজের অনুভূতির কথা তিনি ব্যক্ত করতে চেয়েছেন দীর্ঘ কবিতার আদলে। প্রথম কাব্যে বিশেষ করে স্বাধীনতার পরপরই সবার চেতনা যখন ধনাত্মকভাবে প্রকাশিত হওয়ার কথা, কবি জুলফিকার মতিন তখন স্বদেশকে স্বৈরিণী বলছেন। এটা কবির অভিমানজাত ধরে নেওয়া যায়, তবে আমরা গভীরভাবে লক্ষ করব যে, বাম আদর্শের এই কবির কাজে স্বাধীনতার অর্জন অন্য একজন সাধারণ নাগরিকের মতো ছিল না। সত্যিকার অর্থে তাঁর সমসাময়িক কবির মতো তিনি আবেগী বা রোমান্টিক ধারার কবি নন। বরং তিনি বাস্তববাদী এবং একই সঙ্গে মর্মপীড়িত স্বদেশ ও স্বজাতির জন্য; যেটুকু রোমান্টিকতার রং এখানে পাওয়া যাবে তা কবিসত্তার গভীরে মানুষকে ভালোবাসার অমোঘ চেতনা থেকে উৎসারিত। তিনি বুদ্ধির দীপ্তিকে আবেগের সঙ্গে মন্ডন করে নিয়েছেন বারবার। আর যেহেতু দেশ জীবন সময় ইতিহাসের তিনি গভীর পর্যবেক্ষক, সেহেতু তাঁর কবিতায় ইতিহাসের নানা উত্থান আসে কবিতার সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা হিসেবে। তিনি আধুনিক তবে তাঁর সমসাময়িক কবির চেয়ে অন্যধারার। তাঁর কাব্যসত্তা গভীরভাবে প্রোথিত মানুষের জীবনযাপনের যন্ত্রণার সঙ্গে, পরিবর্তনশীল সময়ের সঙ্গে, মানবিক সংকটের সঙ্গে। এসব মোটা দাগের বিষয়কে কাব্যের পেলব শরীরে বেঁধে ফেলার স্বতন্ত্র পথ তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন প্রথম থেকেই। ভঙ্গিটা ক্লাসিক সন্দেহ নেই, তবে শব্দ, ধ্বনি, অলঙ্কার আর অনুভববেদ্য নানা সংবেদ বুকে করে সে-কবিতা ছন্দময় পথে চলে কিশোরীর চঞ্চলতা মেখে। ‘স্বৈরিণী স্বদেশ তুই’, ‘কোন লক্ষ্যে হে নিষাদ’, ‘ঘামের ওজন কত’, ‘নীলিমাকে চাঁদ দেব বলে’, ‘বৈশাখে ঝড়জল রোদের কবিতা’ ও ‘কার চরণচিহ্ন ধরে’ কাব্যে কবি জুলফিকার মতিন তাঁর স্বতন্ত্র কাব্যভূমি খুঁজে পেয়েছেন। স্পষ্ট চেনা যায় তাঁর স্বর, উপলব্ধি করা যায় তাঁর গভীর মর্মদহন, চেনা যায় নতুন নতুন উপনিবেশ, নতুন নতুন অনুষঙ্গকে কীভাবে তিনি নিজস্ব সত্তার সঙ্গে একাকার করে ফেলেন তা ধরা পড়ে পাঠকের কাছে। একটা চিন্ময় ও প্রগাঢ় অনুভূতি তিনি পাঠকের হৃদয়ে ছড়িয়ে দেন, যার ব্যঞ্জনা নানাভাবে প্রসারিত হতে থাকে। আমাদের পঞ্চাশ, ষাট বা সত্তরের কবিদের কাছে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় চাওয়া, যা অধিকাংশ কবি দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। বেশিরভাগ কবি পৌনঃপুনিকতার নির্বেদে ডুবে থেকেছেন, শব্দচাতুর্য করে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন, প্রকৃত পাঠক তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। আগেই উল্লেখ করেছি, সময় হয়তো তাঁর কাব্যের মূল অনুষঙ্গ হয়ে আছে, তবে তিনি প্রত্যহ নতুন জীবনযাপনের, নতুন উপলব্ধির কাছে যেতে চেয়েছেন। প্রবহমান জীবনধারার নানামুখী পরিবর্তন তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন, তার কিছু নির্যাস তুলে এনেছেন কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে গাঢ় অথচ পেলব মুখরতায়, চিন্ময় এক প্রাখর্যে। এই হয়তো কবির কাছে পাঠকের চাওয়া। পাঁচ দশক ধরে অজস্র কবিতার মধ্য দিয়ে নিজস্ব ভুবনখানি আলোকিত করার চেষ্টা করেছেন তিনি। শৈশবে-যৌবনে লিখিত অনেক কবিতা যা কোনো কাব্যে আজো অন্তর্ভুক্ত হয়নি তা পাঠ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল; পাঠক হিসেবে কিংবা কবি হিসেবে আপ্লুত হয়ে গেছি, বিস্ময় মেনেছি এই কবিতা কেন সব পাঠকের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি ভেবে। আমি আশ্চর্য হয়েছি নবীন বয়সে তাঁর কাব্যশক্তি, প্রেরণা ও রচনাশক্তি দেখে। তিনি মানিক কুড়িয়ে ফিরেছেন শ্রেষ্ঠ মানিক পাঠকের কাছে তুলে দেওয়ার জন্য।
আমরা একে একে তাঁর কিছু কবিতার পঙ্ক্তি পাঠকের উদ্দেশে তুলে ধরব। লক্ষ্যণীয় হলো, কবি জুলফিকার মতিনের গভীর কাব্যলোকের কিছু টুকরো, কিছু আলোকচ্ছটা যেন পাঠক উপলব্ধি করতে পারেন এবং একই সঙ্গে কবিসত্তার নতুন নতুন আলো পাঠকের কাছে প্রতিভাত করা।
১৯৮৩ সালে লেখা ‘নিজের সামনে আমি’ কবিতায় কবি বলছেন, ‘দুঃখের খাপ খুলে এই তরবারি আমি ধরেছি ললাটে/ কোন স্বপ্ন বুকে ধরে আজও তারা বসে থাকে নির্দয় শীতের উঠানে।/ কার কার সন্তাপে অক্ষিগোলক থেকে ভেসে ওঠে শুভ্র গোলক রাজহাঁস/ নির্বাসন দন্ড নিয়ে সুন্দরবনের চিরগভীর হরিৎ/ আত্মদহনের চিতা নির্বিকার জ্বেলে বসে থাকে।/ নিজের সামনে আমি/ পরস্পরের কাছে পরস্পর মুখোমুখি কেউটে ছোবলে/ ঋত্বিকের পাপ থেকে দেয়ালে দেয়ালে শুধু ইতিহাস লেখে’। স্পষ্টত কবি সাম্প্রতিক সময়ের ভয়াবহতার সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের অসহায়তাকে শ্লেষের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। নিজের অসমর্থতা হয়তো নিজের নয়, পারিপার্শ্বিকতার দ্বারা রচিত, দুঃখ হয়তো নিজের অর্জিত নয়, তবু কবিকে এসব বহন করতে হয়। নিজেকে নিজের চিনে নেওয়ার আয়োজন করে চলতে হয়। অসমর্থতা যা দুরূহ বাস্তবতার দ্বারা তৈরি তাকে কবি নিজের করে নিতে না চাইলেও নিতে হয়। সেজন্যে বলেন, ‘অলস ছায়ায় বসে অর্থহীন কথার দুপুর/ বীর্যহীন যৌবনে টসটসে লালাই ঝরায়।’ এটা হয়তো ঠিক যে, এইসব পঙ্ক্তি একধরনের বিকারবোধের সৃষ্টি করতে পারে কিংবা তা জীবনের কোনো ধনাত্মক দিকে আমাদের প্রাণিত করে না, তবু এটা জীবনের অংশ এবং তিনি তাঁর ব্যক্তিগত উপলব্ধি দিয়ে আমাদের তাঁর সঙ্গে অংশীদার করে নিচ্ছেন। আরো আগে ১৯৭৭-এ কবি লিখেছেন আরো গভীর প্রত্যয়দীপ্ত কবিতা, যেখানে কবি নিজের আকাঙ্ক্ষার বা ক্ষমতার কথা বলেছেন। কিছুটা অনুতাপ সেখানে মিশে আছে কিংবা কিছুটা নেতি, তবে এক শাশ্বত বোধ এবং বোধজাত অধীরতা কবিকে উন্মুখ করে তোলে, ‘আমাকে মূল্য দিলেই আমি অমূল্য হতে পারি/ প্রেম দিলে পোষমানা সাহেবী বিড়াল,/ ভোরের কুয়াশা দিলে চাদর বিছানো মাঠে/ শিশুদের জন্ম দিতে পারি/ না নিষাদ না জনক এরকম কিছুতেই নয়/ মাঝামাঝি শুয়ে থাকা পৃথিবীর শুরু থেকে/ শেষতক বয়ে যাওয়া লবণ পানিতে,/ বিদীর্ণ হৃদয় আমি ধুয়ে দিলে/ কি আমাকে দিতে পার বল?’ কবির সৃষ্টিশীল সত্তা যা সৃষ্টি করতে পারতো তাকে না বোঝার জন্য, কবির অনুভূতির সজ্জাকে উপলব্ধি না করার জন্য কবি কষ্ট পান, কবি অভিমান করেন। তাঁর দুঃখ বা কষ্ট হয়তো থাকে তবে তার চেয়ে বেশি হয়ে ওঠে কবির চঞ্চল হৃদয়ের আনন্দানুভূতির মৃত্যুর জন্য কষ্ট। এ-কষ্ট অবশ্যই একজন শিল্পীর কষ্ট কিংবা তীব্র অভিমান – ‘আমারই বোঝার ভুল আমারই পাবার ভুল/ না, না, এরকম ভুল কিছু নয়,/ যা হবার পৃথিবীতে একবারই হয়।’
প্রবহমান মানবজীবনের সারসত্তা কী তা নিয়ে কবি নিজস্ব জিজ্ঞাসা লিখে ফেলেন কবিতার চরণে চরণে, কখনো জীবনের নানা অনুষঙ্গকে ব্যাখ্যা দেন নিজস্ব বয়ানে। হতে পারে সে-ব্যাখ্যা আমাদের প্রচলিত জ্ঞানকে তোয়াক্কা করে না, তবু সে-ব্যাখ্যা কবির অন্তর্জাত, গভীর মর্মদহনে নিষিক্ত। তাকে অস্বীকার করার উপায় থাকে না। কারণ কবি আগেই পৌঁছে যান এক চিন্ময় জগতে, যেখানে সত্য বা জীবনের নতুন নতুন ব্যাখ্যা তৈরি হয় কবির নিজস্ব অভিজ্ঞান দিয়ে। কবির এই অনুভববেদ্য জগতের সঙ্গে আমাদের খুব কমই পরিচয় থাকে। কারণ কবি যেভাবে নিজেকে অনভূতির রজ্জুপথে নিয়ে যান, সাধারণের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। তবে যে-রং কবি তৈরি করেন, তাতে পাঠক আলো দেখতে পান, এক আনন্দধারা তাঁকে আপ্লুত করতে পারে বিষয়টির ভেতরে সঠিকভাবে প্রবেশ না করেই। কবি কীভাবে বস্ত্তর ওপরে আলো ফেলছেন, কীভাবে বিষয়কে নতুন ঘনত্বে উপস্থাপন করছেন তা হয়তো পাঠক জানতে পারেন না সবসময়, তবে এটা আলো এবং এর রং যে জীবনকে চঞ্চল করে তোলে তা বোঝেন। ‘মানুষের কথা’ কবিতায় কবি জুলফিকার মতিন জীবনের নতুন গান শোনান, যার স্বরলিপিও তাঁর তৈরি করা – ‘জন্ম সত্য নয়/ মৃত্যু সত্য নয়/ যৌবন বার্ধক্য জরা কোন কিছু চিরস্থায়ী নয়,/ কেবল রয়েছে দেখি অনিত্য প্রলয়,/ বৈনাশিক কালচক্র সর্বভুক বিধাতার মতো। … অনেকেই এ কাহিনী বলেছিল আমার আগেও/ আমি জানি সে বাসনা কোনদিনও মানুষের পুরবার নয়/ তৃষ্ণা মেটানোর/ এমন তো প্রবাহিত নেই আত্মার ভেতর/ যা রয়েছে তা তো ধ্বংসের বীজ,/ পোড়ায় শস্যক্ষেত লোকালয় নিভৃত বিতান,/ ভস্মীভূত বসুন্ধরা ভাবে বসে বিমর্ষ চোখে,/ তারই সাথে শোক বয়/ তার ভাষা দেবতারা শেখেনি কখনও।’
কবি কখনো ভাবেন যে, তাঁর চোখের মধ্যে গাঁথা রয়েছে পৃথিবীর অমানবিকতার ইতিহাস; টুকরো টুকরো ছবি, কিংবা ইতিহাসের পথ ধরে প্রাগৈতিহাসিক কাল আজ অবধি তিনি পরিক্রমণ করে চলেছেন একা। তবে নষ্ট জোছনার ইতিহাসই হয়তো সত্য, বেদনার কালো রং হয়তো মর্মস্পর্শী এবং সে-কারণেই কবিকে তা স্পর্শ করে। অমাময় ইতিহাসের নদীতে ভাসবার সময় কবি কাউকে খুঁজে পান না সাথি হিসেবে। তবে সময় আর ইতিহাস তাঁকে নতুন নতুন বোধের কাছে নিয়ে যায়, যা মানবজীবনের আকুতি আর দীর্ঘশ্বাসকে প্রতিভাত করে। প্রাচীন পৃথিবীর মানুষ কিংবা তাদের ধারাবাহিক জীবনপরিক্রমা যার অংশত হয়তো কবি জানেন তবে তার গাঢ় আস্তরণ কবিকে আক্রান্ত করে এবং তিনি জানেন, এই অমানবিকতার ইতিহাসের শেষ নেই, দ্রোপদীর শাড়ির মতো তার দৈর্ঘ্য নেই শুধু বিস্তারিত হয়। কবি এসব নিয়ে পঙ্ক্তি রচনা করেন, ‘অনেকাংশে রোদ ছিল : বিষণ্ণ বাদুড় ছিল চোখের ভেতরে,/ আর ছিল হিরোশিমা,/ মাত্র কদিন আগে কথা দিয়েছিলে,/ প্রবল প্লাবণে সব ভেসে যাওয়া স্রোতের ভেতরে/ তৃণ গুল্ম লতাপাতা প্রবল শৈবালদাম,/ অনেকেই সঙ্গী ছিল সেই বিসর্জনে।/ ঘুরে বেড়ানোর এক প্রবল তৃষ্ণা নিয়ে চেয়ে আছে মার্কো পোলো,/ হাসছে দেয়ালে।’ (‘বিসর্পিল’)
১৯৭৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সময়কালে লেখা কবিতা নিয়ে কার চরণচিহ্ন ধরে কাব্যের মূলসুর যে কবির ইতিহাস-পরিক্রমণ তা বোঝা যায় এর উল্লেখযোগ্য কবিতা পড়লে। তবে মাঝে মাঝে তিনি অন্য পথে গেছেন, অন্যরকম কিছু অনুভবের কাছে নিজেকে মেলে ধরেছেন। সেগুলোকে বিচ্ছিন্ন কবিতা ধরা যায়, তবে সেখানেও কবি জুলফিকার মতিনের সত্তাকে শনাক্ত করা সম্ভব। তিনি সময় বা কালের গভীর পর্যবেক্ষক, মানবজন্ম পরিবর্তনসূত্রকে তিনি গ্রথিত করার চেষ্টা করেছেন তাঁর মতো করে, জীবনের সঙ্গে গাঢ়ভাবে লীন অনুষঙ্গকে তিনি ইতিহাসের কার্যকারণসূত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছেন। হতে পারে তাঁর সব বক্তব্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, তবে তাতে কবির কিছু আসে-যায় না বা কবিতার কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। কারণ কবির প্রতীতি বা অনূভবের রং এমন প্রগাঢ় যে তা অনিবার্য এক বোধের জগতে নিয়ে যায়, যাকে শুধু ন্যায়-অন্যায় সত্যাসত্যের প্রচল দিকটা দিয়ে বিচার করা যায় না। এটা ঠিক যে, কবি জুলফিকার মতিন সচেতন কবি, রোমান্সের চেয়ে বুদ্ধির দীপ্তি তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ, শুধু কথার পিঠে কথা বসানো কিংবা বাক্যবলয়ের মধ্যে সামান্য মোচড় দিয়ে তিনি কবিতা লিখতে চাননি বরং জীবনের গভীর সত্যকে অনুসন্ধান করে তার সঙ্গে নিজের উপলব্ধিকে যুক্ত করেছেন। নিঃসন্দেহে তিনি ক্ল্যাসিক ধারার কবি, হয়তো সুধীন দত্ত তাঁর প্রিয় কবি। তবু সে ক্ল্যাসিক ভঙ্গির মধ্যে কবির অনুভবের তীক্ষ্ণতা যেমন চোখে পড়ে আবার মানবের সাধারণ আনুভূতিক সৌন্দর্যও তিনি নিপুণভাবে অাঁকেন। যে-পথ দিয়ে এতদিন চলেছেন, তা মিলিয়ে নিয়েছেন ইতিহাস-পরম্পরায়, জীবনের বাঁকে বাঁকে যে লক্ষণ ধরা পড়ে, নদীর সেই চোরাবালিতে ইতিহাস তার নখ বসিয়ে যায়। এশিয়ার অন্যতম ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধকে তিনি সামনে এনেছেন, সেই বালক নালক যে জীবনপ্রবাহ দেখেছে তার রূপ কেমন, এতদূর কীভাবে এসেছে সে, ধীরপায়ে সে এগিয়ে চলেছিল পৃথিবীর পথে, তার চরণচিহ্ন রয়ে গেছে। কোনো কোনো নালকের বেলায় যেমন এই গল্প সত্য, তেমনি সব মানবের যাপিত জীবন ও রেখে গেছে পৃথিবীতে স্মরণচিহ্ন, সে-গল্পও সত্য। কবি জুলফিকার মতিন আমাদের সেই শাশ্বত বোধের কাছে নিয়ে যান, সেই জিজ্ঞাসার কাছে দাঁড় করিয়ে দেন, যা জীবনের জন্য অমোঘ; চঞ্চলা বা বিপুলা পৃথিবীর কাছে কিংবা মানবজীবনের কাছে আমরা কী পাঠ নিই, কী পাঠ রাখি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জন্য? শুধু কি হাহাশ্বাস? নাকি দীর্ঘ নিশ্বাস? কবি অবশ্য আমাদের হতাশার দিকে ধাবিত করেন খানিকটা, তবে এভাবে আরো নিয়ে যান জীবনের কাছাকাছি – কিছু স্মৃতি-বিস্মৃতি, জীবনব্যাপ্ত কিছু আধার, কিছু জিজ্ঞাসা, কিছু বিহবলতা, কিছু আকাঙ্ক্ষার রোদ, জমানো ক্রোধ বা অভিমানের কাছাকাছি।
পৃথিবীতে কবির আকাঙ্ক্ষার বস্ত্ত বা প্রসঙ্গ কিংবা অনুভূতির সূক্ষ্ম জগৎ তাঁকে হয়তো ব্যাপৃত রাখে অথবা তিনি সেই অমরাবতীর জগতের স্বপ্ন দেখেন। বাস্তব বা অবাস্তবের জগতের মধ্যে কবি একটা ব্যবধান তৈরি করে চলেন সচেতনভাবে। পারিপার্শ্বিকতাকেও কবি ব্যবহার করেন। এই কবি এতটা কল্পনার জগতের নন তবে তিনি তাঁর বক্তব্যকে পরিস্ফুট করতে কল্পনার শক্তিকে কাজে লাগান উপমা-উৎপ্রেক্ষা খুঁজতে। স্বভাবকবির মতো তিনি প্রচলধারার কবিতাও লেখেন, যদিও তাঁর মূলসূত্র হলো জীবনের গভীরে ফিরে যাওয়া বা পাঠককে গভীর অনুভবের সাগরে অবগাহন করানো। পারিপার্শ্বিকতা বা দৈনন্দিন জীবনের নানা খুঁটিনাটি বিষয় ও চরিত্র কবি ব্যবহার করেন কখনো কখনো, তা আপাতভাবে সরাসরি মনে হলেও বাস্তবে তা নয়। কারণ এসব প্রসঙ্গ বা চরিত্রকে তিনি ব্যবহার করেন তাঁর বক্তব্যকে রূপকল্প হিসেবে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার জন্য। একটি বিষয় জুলফিকার মতিনের কবিতার বেলায় স্পষ্ট বোঝা যায় যে, কবিতাকে কবিতা করে তোলার জন্য তিনি কখনো কষ্ট-কল্পনার আশ্রয় নেননি। বরং তিনি খুব অনায়াস ভঙ্গিতে পেয়ে যান কবিতার চিত্রকল্প, অনুষঙ্গ কিংবা গভীর অনুভববেদ্য পঙ্ক্তি। যে-পর্যায়ে পৌঁছে গেলে একজন কবির নতুন বিষয়ের জন্য হাপিত্যেশ করতে হয় না, নতুন অভিব্যক্তির জন্য চিন্তিত হতে হয় না, কবি জুলফিকার মতিন সেই উচ্চতায় পৌঁছে গেছেন। বালক বা কিশোর বয়স থেকে তাঁর অভিজ্ঞতা পুষ্ট হয়েছে জগৎ-জীবন ও পঠন-পাঠন থেকে, অজস্রধারার চিন্তাবিভূতি কবিকে সতত চঞ্চল করেছে বারবার। তবে তিনি এর মধ্যে প্রকৃত কবিতার শরীর ও প্রাণ খুঁজে নিতে পারেন, সেই বোধ তাঁর তৈরি হয়েছে দীর্ঘদিনের কাব্যচর্চার মাধ্যমে।
তাঁর পাশের জগৎ থেকে তিনি বিপুলভাবে গ্রহণ করেছেন উপাদান এবং তাকে কবিতার সূক্ষ্ম নরিতসু দেহে গেঁথে নিয়েছেন সচেতন শিল্পীর মতো। ‘ফেরিওয়ালা’ নামক কবিতায় ফেরিওয়ালা চরিত্রকে তিনি গ্রহণ করেছেন ভিন্ন এক মাত্রায়, নতুন অর্থদ্যোতকতায় এই দৈনন্দিন জীবনযাপন কবিতার অসাধারণ পঙ্ক্তি হয়ে উঠেছে।
দুপুরে দুপুরে তুমি ফেরিওয়ালা লুকোচুরি খেল,
জানালা থেকে শোনা যায় তোমার রৌদ্রাভ গলার আওয়াজ,
মাথার ওপরে গাছ ন্যাড়া মাথা, একটুকু ছায়াও পড়ে না,
… … …
বারবার ডেকে যাও, বারবার লুকোচুরি খেল,
সে কোন উঠোন মাড়িয়ে কখনোই অরণ্যের কাছাকাছি যেতে পারবে না
মানুষের জন্য এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই নিষিদ্ধ,
যেমন জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়া
যেমন নদীর মোহনায় গিয়ে দাঁড়ান
আতপ্ত দূরে চম্পকের সৌরভ নেয়া…
‘কার চরণচিহ্ন ধরে’ কাব্যের বেশ কিছু কবিতা আছে যেখানে কবি খানিকটা হালকা চালে এগিয়েছেন। এগুলো এ-কাব্যের মূলসুর থেকে কিছুটা স্বতন্ত্রপথে ধাবিত হয়, তবে জীবনের নানামাত্রিক ব্যঞ্জনার বাইরে অবশ্যই নয়। মাত্রাবৃত্তের হালকা দোলায় তিনি এ জাতীয় কবিতায় গভীর কোনো বিষয়ের অবতারণা করেননি হয়তো, কিংবা জীবনের রঙিন স্বপ্নকে নিয়ে তিনি হয়তো কথকতা তৈরি করছেন বলে আপাতভাবে মনে হবে, তবে কবিতাগুলো পড়তে পড়তে পাঠক এক অনির্বচনীয় আনন্দ পাবেন যা তাঁকে নতুনভাবে চিনিয়ে দেবে।

ক. আমায় তুমি ফিরিয়ে দাও শয্যাপাতা বিরল দুপুর,
ঘুরছি আমি নাচছে দুপা পেরিয়ে কোথায় যাচ্ছি সুদূর,
বুকের বসন – তাও খুলে যায় – দিচ্ছি খুলে ইচ্ছে করেই,
খুলতে আমার ভালোই লাগে। ভালোবাসা? রাখব ধরে?
(‘উৎসব’)

খ. তোমার বাড়ি হাওয়ার গাড়ি
তোমার বাড়ি মল্লিকা রাত
খোঁপার মধ্যে খুলে ফেলা একটি তরল বিরল দুপুর
ভ্রমণ শেষে রিক্ত হাতে সেতুর সাথে কথা বলা।
… … …
তোমার বাড়ি হাওয়ার গাড়ি। গণভবন। শার্সিমহল
ঘাম চেটে নেয়। কুমারিত্ব। দুপুর বেলায় ঘুম কি যাও?
উঠে শেষে দেখবে তোমার স্বপ্ন থেকে বৃহৎ বোয়াল
টেলিফোনে করছে আলাপ তোমার সাথে। জামার সাথে।
জুলফিকার মতিন তাঁর চেনাজানা পৃথিবীর একজন নির্মম সাক্ষী ও পর্যবেক্ষক। জীবনের প্রকৃত সত্য, আকাঙ্ক্ষা বা চেতনা বারবার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, কিছু সুবিধাভোগী মানুষ মর্তের এই জীবনকে কিংবা আরো ছোট্ট পরিসরে বাংলাদেশের বর্তমান জীবনকে বধ্যভূমিতে পরিণত করেছে। সত্যিকার অর্থে একজন কবির জন্য এই অসহ্য অধুনা মেনে নেওয়া কষ্টকর। এই অনুভূতি কবি ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন কবিতায় নানা ভঙ্গিতে। হতে পারে এই বোধের মধ্যে সামান্য নেতিবাচক প্রবণতা আছে, তবে সে-নেতি জীবনবাস্তবতাকে উপস্থাপনা করে গভীরভাবে, সূক্ষ্মভাবে, কবিতার প্রসাদগুণকে ক্ষতি না করে। ‘বধ্যভূমি’ কবিতায় কবি লিখেছেন, ‘অথচ এ জীবনের দায়বদ্ধ কিছু কিছু সত্যের কাছে/ নতজানু বিচারক আপন পকেটে খোঁজে অলৌকিক বিশ্বাসের জাদু,/ পতন তো এই একদিন বেশ হয়েছিল,/ উত্থানে পূর্বশর্তে লেখা ছিল কর্ষিত মানব জমিন,/ অসক্ষম মানুষের বাসযোগ্য পৃথিবীতে হরিৎ মালতী বীথি দিয়ে,/ প্রণয় সিক্ততার নীলিমার শ্রাবণ পূর্ণিমার শোকগাথা ভুলে যেতে দেবে না কখনও।/ এখন অগণ্য তারা নক্ষত্র সজ্জিত রাত দীপাবলি জ্বালিয়েছে বেশ,/ কোন দিন কবে যেন তারা সব কাছে এসেছিল,/ সঞ্চয়ের সরোবরে পুণ্যে ফোটা পদ্মের মূল্য বিনিময়ে,/ তারা সব বেঁচে আছে আকাশের বাগিচায় মিটিমিটি/ আলোর প্রপাত।’ (‘বধ্যভূমি’) এই কাব্যের অন্য একটি কবিতায় কবি উপলব্ধি করেছেন যে, সবকিছু আগের নিয়মে গতানুগতিকতার নির্বেদে চলছে, জীবন প্রকৃতি, বন্ধুত্ব-শত্রুতা সবকিছু আগের নিয়মে চলছে, বস্ত্তত পৃথিবীতে নতুন কোনো নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না, সবকিছু চলছে পুরনো নিয়মে। প্রেম, শারীরিক সম্পর্ক, যৌনতা কিংবা নারী সৌন্দর্যের চিহ্ন – সবকিছু আগের মতো আছে, সবকিছু চলছে পুরনো নিয়মে : ‘আকুলতা জড়ান বৈভব/ ধুয়ে মুছে ঝরে যায় স্তনের বোঁটায়,/ অবনত পুষ্পের সাথে মিশে যায় স্বেদ রক্ত/ মানুষের মূঢ় বিভ্রমতা।/ সকালের রোদ আসে পুরনো নিয়মে,/ যে পাথরে শুয়ে থাকে নিষ্ফল নিগূঢ় ললাট/ তার মুখোমুখি হলে/ অন্ধকারে আততায়ী আসে/ তাও বুঝি পুরনো নিয়মে।/ কাঠ জমি চুল্লিতে কয়লার কুচি,/ রমণীর স্বত্ব নিয়ে বাদ-বিসম্বাদ, ভদ্রাসন বেঁচে দিয়ে কাই্ বাবুরা/ দীর্ঘ রুখু প্রান্তরে পাথরের চোখ মেলে রাখে।’
তবু এসব নেতিবোধ বা মানবিক নানা বাধা অতিক্রম করতে গিয়ে কবি কখনো বিমর্ষ হয়ে পড়েন বটে তবে কবিতার সততার বাইরে তিনি কখনো থাকেন না, অনবরত তাঁর মাথায় কবিতার পঙ্ক্তি খেলা করে, চঞ্চল এক মনন নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত তিনি পাড়ি দেন সূর্যের সঙ্গে, তাঁকে আপাতভাবে মনে হবে বিরক্ত এই জীবন নিয়ে, তবে প্রকৃতপক্ষে তিনি অধীর-উন্মুখ হয়ে থাকেন মানুষের জন্য, মানবিক সব বোধের জন্য, পৃথিবীর যে-কোনো ঘটনার জন্য, যে-কোনো পরিবর্তনের জন্য। একজন কবি কী কী গ্রহণ করেন কাব্য-উপাদান হিসেবে তা বোঝা বস্ত্ততপক্ষে কারো পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ তিনি যেভাবে জীবনকে রাঙিয়ে নেন উপলব্ধির আলোয়, অনুভূতির স্পর্শে-গন্ধে বস্ত্ততপক্ষে সেই অভিজ্ঞতা অন্য কারো হওয়ার কথা নয়। তাই যাঁরা সহজে কবিতা লেখার চেষ্টা করেন বা স্থূল বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে চান, তাঁরা যে কবির মতো অভিজ্ঞতাযুক্ত নন সেটা স্পষ্ট এবং সে-কারণে তাঁদের কবিতা সত্যিকার অর্থে সেই স্তরে পৌঁছায় না, যা আমাদের নতুন অনুভূতিরাজ্যে নিয়ে যায়, আমাদের প্রাণিত করতে পারে সত্যিকার অর্থে। আগেই বলেছি, কবি জুলফিকার মতিন সবসময় সেই উত্তীর্ণ পঙ্ক্তির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন যাপিত জীবনের শত বাধা সত্ত্বেও, তাই তিনি লেখেন :
একটি মাত্র কবিতার পঙ্ক্তির জন্য শুধু সারা রাত বসে বসে থাকা
বাতাসের বিরুদ্ধতা সহ্য করে এই রুক্ষ মানব জমিনে তারা বিমূঢ় মানব
অন্তহীন প্রচাপের ঊর্ণনাভে খাটাচ্ছে তাঁবু,
এখনই গোটাতে হবে,
সমস্ত আকাশ ভেঙে মাথার ওপরে নামে নির্দয় হন্তারক জল, পুষ্পের থেতান বুকে হননের দুঃখ বেদনার
দূর ভ্রমণের কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই,
মায়াবী হরিণ কেটে আজ রাতে খাওয়া হবে বেশ।
(‘একটি মাত্র কবিতার’)
প্রচলিত রাজনীতি আর তার অসহ্য প্রতিক্রিয়া কবিকে প্রায়শ বিচলিত করে; তিনি বিরক্ত সেটা বোঝা যায় যখন তা ধরে রাখে নিপুণ সব শ্লেষের করাত। রাজনীতির নামে যে-অশিষ্ট আর বেলেল্লাপনা সবসময় কবির মস্তিষ্ক উত্তেজিত করে, তাকেই কবি কবিতার পঙ্ক্তি করেন খুব সাবধানে, এজন্যে যে, এ জাতীয় প্রতিক্রিয়া বিবৃতি হয়ে যেতে পারে, যা প্রকৃত কবিতা থেকে অনেক দূরে। এই সব বর্ণনায় কবির অভিজ্ঞতার একটা সারসংক্ষেপ (যদিও তা রূপকল্পে উদ্ভাসিত) আমার পাই যা কবিতার স্বাদ ধরে রাখে সযতনে : ‘ভুল পথে যাও তুমি/ জাদুতে রয়েছে বাঁধা সোনার বলদ।/ আষ্টেপৃষ্ঠে শৃঙ্খল,/ রগরগে মাস্তান আপাদমস্তক মুড়ে/ রিগানের পুরনো পোশাকে/ তিনটি আঙুল কেটে ব্রহ্মদত্যি বসে আছে,/ উলঙ্গবাহার নাচ জাতীয় ভাঁড়ের।/ মগজের কোষে কোষে প্রতিদিন চাইনিজ কুড়ালের ক্ষত/ দুঃখ পেতে খোলা মুখ দিয়ে রাখে,/ গোলাপি আভার গালে ড্রাকুলার দাঁত/ বলে, এই বাস্তবতা নত হও শয়তানের কাছে।’
প্রথম কাব্য থেকে কবি জুলফিকার মতিন নতুনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন অথবা বলতে হয়, নতুন নতুন ভঙ্গি খুঁজে পেয়েছেন, নতুন কাব্যভূমের সন্ধান পেয়েছেন, যা তাঁর মৌলিক কাব্যশক্তিকে শনাক্ত করে। স্বাধীনতা, প্রগতি, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের দীপ্র চেতনা নিয়ে কবি জুলফিকার মতিন তৈরি করেছেন তাঁর মনন এবং এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মানবজীবনের নানা সূক্ষ্ম অনুষঙ্গ; বিপন্ন মানবতা কিংবা মানবিকতার পক্ষে তাঁর কবিতা বরাবরই সোচ্চার, আবার তিনি সমান সচেতন কবিতার সত্যিকার রূপ গঠনে। কবিতাকে বিষয়ের সঙ্গে, প্রসঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করতে যে-চিত্রকল্প তিনি তৈরি করেন, সেখানে তাঁকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়। স্বৈরিণী স্বদেশ তুই থেকে দুঃখ ভোলার দীর্ঘশ্বাস – এসব কাব্যে তিনি নিজস্ব কাব্যবৈশিষ্ট্য ও জগৎ তৈরি করেছেন, স্বতন্ত্র স্বর তৈরি করেছেন। তাঁর সমসাময়িক কবিরা যখন একই ঘেরাটোপে বন্দি, নতুন কোনো কাব্যরীতি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন, কিছু শব্দের চমক দিয়ে কবিতায় একধরনের মাদকতা তৈরি করেছেন, যার কোনো দীর্ঘস্থায়ী কাব্যমূল্য নেই, সেখানে জুলফিকার মতিন সফল। ষাটের দশক থেকে তিনি লিখে চলেছেন, সময়টা স্বদেশ নিয়ে বেশি ভাববার, সেজন্যে তিনিও স্বদেশের বিষয়কে প্রথমত গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং সেটি তাঁর সত্তায় স্থায়ী আসন করে নিয়েছিল। তবে তিনি জীবনের বিবিধ প্রপঞ্চ নিয়ে তাঁর নিজস্ব অনুভূতিকে সূক্ষ্মভাবে চারিয়ে দিয়েছেন কবিতার শরীরে। তাঁর ভঙ্গি ক্লাসিক তবে বুদ্ধির দীপ্তি ও আবেগের যৌথ সম্মিলনে তিনি নতুন আলোর জগতের সন্ধান পেয়েছেন। তাঁকে কষ্ট-কল্পনা করতে হয়নি, তাঁর আধার পূর্ণ আছে বিবিধ উপাদানে, অপূর্ব রঙে তাঁর মানস রঙিন হয়ে ওঠে। আর কবিতার সত্যিকার অবস্থান সম্পর্কে তিনি অভিজ্ঞ এবং আপসহীন বলে তাঁর কবিতার গঠন ও সৌকর্য নিয়ে কেউ ঋণাত্মক কথা বলতে পারে না।
‘কার চরণচিহ্ন ধরে’ কাব্যেও তিনি তাঁর ধ্রুপদীভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন, গভীর এক অনুভবভেদ্য জগতে নিয়ে গেছেন পাঠককে। পৃথিবীর ক্রমঅপস্রিয়মাণ জীবনচেতনাকে, তার সূক্ষ্ম সব চিহ্নকে তিনি শব্দ দিয়ে বেঁধে ফেলেছেন চমৎকারভাবে। জন্ম-জন্মান্তর থেকে তাঁর অভিজ্ঞান পুষ্ট হয়েছে যাপিত জীবনের পাঠ থেকে। সময়কে তিনি ধরে রেখেছেন নানা রেখাচিত্রে। সভ্যতার সহজ অথচ সত্য এক রূপ যা আমরা আপাতভাবে উপলব্ধি করি না, কবি আমাদের সেই জগতে নিয়ে যান। আমরা যেন বুদ্ধের সেই বালকজীবনের পথপরিক্রমাকে মনে করি, মনে করি মানবজন্ম নিয়ে নালক যে-স্বপ্ন দেখত তা আজ কোথায়, যে-জীবন আমরা বহন করে চলেছি তার যোগসূত্র কতদূর, আমরা কি আমাদের পূর্বজন্ম থেকে সব স্মারকচিহ্নকে মনে রেখেছি কিংবা সেইসব স্মারককে কতটুকু মনে রেখেছি নিজের জীবনজিজ্ঞসায়? কবি লিখেছেন : ‘কার পদচিহ্ন ধরে ধরে?/ এতদূর এসেছ, নালক?/ ও পাড়ের বাতাসে বাতাসে/ কার হৃদয়ের হাহাকার নিয়ে এসেছ?/ তুমি কি বুঝতে পারো না তোমার মানবজন্মের ঋণ/ কোনো দিনও মুছে যায় না/ এই ধূলির রেণুর মাঝ থেকে?’
সত্যিকার অর্থে শিল্পের কাছে সমর্পিত একজন কবি জুলফিকার মতিন পাঁচ দশকের ওপর কাব্য-সাধনায় এক মৌলিক স্তরে পৌঁছে গেছেন। শব্দবোধের নিপুণ প্রয়োগে, বিষয়ের গভীরতায়, নিজস্ব সত্তার প্রকাশে এবং মানবজীবনের গভীর পর্যবেক্ষণজাত অভিনিবেশে কবিতার যে-ভূমি তিনি নির্মাণ করেছেন বাংলাদেশের কবিতার সামগ্রিক বিবেচনায় তা অবশ্যই নতুন ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত। বলতে দ্বিধা নেই, তিনি যে-মানের কবি তার সিকিভাগ মূল্যায়িত হননি, সে-দায় কার জানি না, তবে এ-বিষয়ে সবাই যে-দারুণভাবে উদাসীন এ-কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তবু এই শক্তিশালী কবি এগিয়ে চলেছেন কবিতার শক্তি ও সম্ভাবনা নিয়ে, কার চরণচিহ্ন ধরে তার একটি নমুনামাত্র। 