নিজেকে ফিরে দেখা

হামিদ কায়সার

 

আমার দিনগুলি

সুস্মিতা ইসলাম

 

বেঙ্গল পাবলিকেশন্স লিমিটেড

ঢাকা, ২০১৪

 

৪৫০ টাকা

 

 

 

একজন মানুষকে যে একজীবনে কত কষ্ট সইতে হয়, কত আনন্দের ভার বইতে হয়, জীবন যে কত আলোর রেখায় রঙিন  হতে পারে, পাশাপাশি ঘাত-প্রতিঘাতের চড়াই-উতরাইয়ে হতে পারে কত খন্ডে চূর্ণ-বিচূর্ণ; জীবনের শেষবেলায় এসে আমরা কজন মানুষ পারি নির্মোহভাবে সেসব সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে, কজন মানুষ পারি নির্লিপ্তভাবে সেই জীবনটিকে গভীর উপলব্ধি আর বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি দার্শনিক সত্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে যে, ‘আমি ভালোই আছি’? সেই দুর্লভ মানুষদেরই একজন সুস্মিতা ইসলাম, যাঁর আত্মজীবনীগ্রন্থ আমার দিনগুলি শুধু তাঁর নিজের জীবনের মহাকাব্যিক আখ্যানই নয়, ব্রিটিশ-ভারত, ভারত-পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ এই তিনটি দেশ এবং তিনটি যুগের যেন চলমান কালছবিও।

জন্ম ১৯২৬ সালের বিভাগপূর্ব কলকাতার এক বনেদি পরিবারে। বাবা ত্রিদিবনাথ রায় ছিলেন খ্যাতিমান আইনজীবী, সংস্কৃত সাহিত্যে পন্ডিত, মধ্যযুগবিষয়ক গবেষক। পিতামহ নিখিলনাথ রায় ছিলেন যশস্বী ঐতিহাসিক। মা কল্যাণী রায় কবি হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। স্বভাবতই তাঁর এই আত্মজীবনীগ্রন্থে তৎকালীন কলকাতার একটি বিকাশমান বনেদি সমাজের ছবি উঠে এসেছে। সেইসঙ্গে আলোক কিরণের মতো প্রস্ফুটিত হয়েছে হিন্দু-মুসলিম নানা দ্বিধাভাজন চড়াই-উতরাই সম্পর্কের মধ্য দিয়েও শেষ পর্যস্ত মানবিক ধর্ম কীভাবে জয়লাভ করেছে, তেমন এক গাঁথাও, যার ধ্রুপদী স্রষ্টা হলেন লেখিকার মা, কিছুটা বুঝিবা বাবাও। তাদের উদার মানসিক এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতার কারণেই বাড়িতে গান গাইতে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন অনন্যসাধারণ এক মুসলিম যুবা, যিনি ব্রিটিশ-ভারতের একজন নামকরা পাইলট হিসেবে তখনই সুপ্রতিষ্ঠিত; শুধু তাই নয়, গান গান সায়গলের মতো, দেখতেও সুপুরুষ। একদিনের আসরে গান গাইতে এসে এ-মানুষটি ঘন ঘন এই বাড়িতে আসতে শুরু করলেন, তা যে রেখা নামের মেয়েটির টানেই, সেটা রেখা সামান্য বুঝতে পেরেছিল, কারণ, যুবক গান গাইতে গাইতে শুধু গভীর চোখে ওর দিকে তাকাতেন। রেখা ছাড়া এ-ব্যাপারটা এ-বাড়ির আর কোনো মানুষই বুঝতে পারেনি। কীভাবে বুঝবে? ধর্মীয় এবং সামাজিক পরিচয়ে যে দুজন বাস করেন দুই মেরুতে। সুস্মিতা ইসলামদের পারিবারিক পরিচয় তো আগেই জানানো হয়েছে, এবার ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ারের পরিচয়ও জানানো যাক। তিনি বিশ্বনবী বইয়ের লেখক কবি গোলাম মুস্তাফার বড় ছেলে। আগেই বলেছি, এটি কোনো সাধারণ আত্মজীবনীগ্রন্থ নয়, এতে রয়েছে মহাকাব্যের আকর, রয়েছে বীরোচিত নায়কের অস্তিত্ব। তাই কোনো কপটতা নয়, নয় চিত্তের দৌর্বল্য প্রদর্শন, ক্যাপ্টেন আনোয়ার রেখার উপস্থিতিতেই একদিন ওর মায়ের কাছে সোজা এবং দৃঢ় কণ্ঠে জানালেন, তিনি রেখাকে বিয়ে করতে চান। প্রাথমিক সংকোচ এবং বিহবলতা কাটিয়ে বাবা-মায়ের সম্মতিক্রমেই বিয়েটা হয়ে গেল। অবশ্য এর জন্য এই পরিবারটিকে সমাজ এবং আত্মীয়দের কাছে কম মূল্য দিতে হয়নি। দু’পক্ষের পরিবার থেকেই। সুস্মিতা ইসলাম সেসব কথা অতি সূক্ষ্ম এবং নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন।

বিয়ের পর ঐতিহাসিক ৫ নং পার্ল রোডের বাড়িতে আলাদাভাবে সুখের নীড় রচিত হলো তাদের। এ যেন সুস্মিতা ইসলাম যে একদিন লেখালেখির মানুষ হবেন, কয়েকজন লেখালেখির মানুষের সঙ্গে গভীর এক অচ্ছেদ্য সম্পর্কে জড়িয়ে যাবেন, তারই এক অপূর্ব যোগসূত্র! এই বাড়িতে যদি তিনি না আসতেন, সখ্য হতো কি তার সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে? পরে তাঁরই সূত্র ধরে আবু সয়ীদ আইয়ুব, রশীদ করীম; রশীদ করীমের সূত্র ধরে কবি শামসুর রাহমান; এরপর অনেক সাহিত্য ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এবং শেষাবধি তো নিজেই লেখালেখিতে যুক্ত হয়ে পড়লেন এবং এটাই তাঁর আজ শেষ জীবনের এক ধরনের অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তিনি লিখছেন একের পর এক অনুপম জীবনালেখ্য। প্রথমে ফিরে ফিরে চাই আমার দিনগুলিতে। যাহোক, ক্যাপ্টেন আনোয়ারের কর্মসূত্রে কলকাতা ছাড়াও সুস্মিতা চক্রবর্তীকে (ইসলাম) কিছুদিন দিল্লি, মুম্বাই এবং লাহোরেও কাটাতে হয়েছে। লেখিকা যেভাবে মুম্বাইয়ের দিন বিশেষ করে সমুদ্রপাড়ের স্যাকে এবং জনৈক কর্মকর্তার বাড়িতে থাকার দিনাভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন, তা যেন একটি রোমাঞ্চকর উপন্যাসকেও হার মানায়। বাবার সঙ্গে স্বামীর কর্মস্থল লাহোরের উদ্দেশে ট্রেনযাত্রার বর্ণনাও শুধু জীবন্ত নয়, একটি যুগ আর সময়ের ছবিও। দুঃসাহসী এক ক্যাপ্টেনের সঙ্গে জীবন জড়িয়ে তার জীবন যে কতটা সংগীতময়, বর্ণিল ও অ্যাডভেঞ্চারে রোমাঞ্চকর হয়ে উঠেছিল, তা বইয়ের একটি অংশ থেকে পাঠ করলেই বোঝা যাবে। বাবা তাঁকে লাহোরে নিয়ে গিয়েছেন, আর এটা সেই লাহোরেরই ঘটনা। ক্যাপ্টেন আনোয়ার তাঁকে একটা ট্রেনিং বিমানে চড়ালেন, তারপর পড়ুন, ‘এরপর আনোয়ার যা করল তার জন্য আমার কোনোরকম মানসিক প্রস্ত্ততি ছিল না। আনোয়ার বলল, ‘এইবার আমরা একবার একটা dive করব, তারপরে একটি loop করব।’ ‘ঘাবড়ানোর কিছু নেই। তুমি শুধু সিট বেল্টটা খুব শক্ত করে বেঁধে রেখো।’ বলা শেষ না হতেই দেখি চিল যেমন উঁচু আকাশের সীমানা থেকে পথিকের বাজারের থলিতে ছোঁ মারে, ঠিক               সে-ভঙ্গিমায় আমাদের প্লেনটি খুব দ্রুতবেগে মাটির প্রায় কাছাকাছি এসেই সুদূর ওপরে উড়ে গেল। তারপর প্লে­নকে সমান্তরালে ভাসমান করে আনোয়ার জিগ্যেস করল, ‘কী, ভয় পেলে?’ আমি বললাম, ‘না, না।’ আনোয়ার মহাখুশি। ও বলল, ‘এই তো চাই।’ এবার আমরা slow loop করব; সিট বেল্টটা শক্ত করে ধরে রেখো, দেখো খুব মজা হবে।’

আমার কি তখন কোনো পছন্দ ছিল? না। যে-অ্যাডভেঞ্চারের পথে এসেছি তার শেষ পর্যন্ত তো যেতেই হবে। তাই খুব মনের জোর নিয়ে বড় করে একটি গভীর নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই দেখি আমাদের প্লে­নটি এমনভাবে ঘুরল, যাতে আমাদের দুজনার মাথা মাটির দিকে থাকল। আগেই বলেছি, টাইগার মথে কোনো ছাদ নেই। সুতরাং সেই শূন্যে মাধ্যাকর্ষণের আকর্ষণকে উপেক্ষা করে পুরো বৃত্তাকারে (loop) ঘুরে প্লে­নটি আবার সোজা হলো। আনোয়ার বলল, ‘খুব মজা, না?’ তখন আর কি পিছিয়ে আসা যায়, যতদূর সম্ভব গলায় উচ্ছলতা নিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, খুব মজা।’ তখন বলল, ‘চলো আরো একবার একটি ‘লুপ’ করে আমরা নিচে নামি’ এবং আবারও একটি ‘লুপ’ করল আনোয়ার।

প্রতিবারই মাথা যখন মাটির দিকে যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল বুকের সব যন্ত্রপাতি বোধহয় নিচে নেমে যাচ্ছে। এরই নাম যদি মজা হয়, তাহলে অবশ্যই আমি সেদিন ভীষণ মজা পেয়েছিলাম। অন্তত ভয় পেয়ে যে পিছিয়ে যাইনি সেটাই আমার সবচাইতে বড় প্রাপ্তি হয়েছিল। কারণ আমাকে নিয়ে প্লে­নের এই কসরত করতে পেরে আনোয়ার অসম্ভব খুশি হয়েছিল।

কিন্তু আমাদের জন্য চমক অপেক্ষা করছিল মাটিতে। প্লেন থেকে নামার পর যখন সবাই হাততালি দিচ্ছে এবং অবশ্যই মুভি তোলা হচ্ছে, বাবা সবকিছু উপেক্ষা করে সবার সামনে তার জামাতাকে যে বকুনিটা দিলেন, তাতে আমার আর লজ্জার সীমা-পরিসীমা রইল না। বাবা বলে উঠলেন, ‘তুমি যা খুশি করো, তাই বলে আমার মেয়েটাকে নিয়ে এভাবে অ্যাডভেঞ্চার করা তোমার খুবই অন্যায় হয়েছে।’ আমি লজ্জায় মরমে মরে থাকলেও আনোয়ার কিন্তু একটুও না রেগে উলটো বাবার পিঠে হাত দিয়ে বাবাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল। এই হলো আমার বিমান ভ্রমণের প্রথম অভিজ্ঞতা। আনোয়ারের উৎসাহে সেই বছরের পূজাসংখ্যা যুগাস্তরে এই অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে ‘ভারতীয় মহিলার বিমান অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধও লিখেছিলাম।’

কিন্তু দিনযাপনের এই সরল আনন্দ আর রইল না। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ-পূর্ববর্তী দাঙ্গাসহ রাজনৈতিক-সামাজিক সব ঘটনাগুলোই তাদের ব্যক্তিজীবনকেও প্রভাবিত করেছিল, সুস্মিতা ইসলাম সেই ধারাবাহিকতায় ভারত ভাগ হওয়ায় তাদের জীবনে যে ক্ষতটুকু লেগেছিল, তারও যে বর্ণনা দিয়েছেন, ইতিহাসে সেরকম বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এদিক থেকে দেশভাগের যন্ত্রণার ক্ষরণ এখানে অস্তঃসারসহ উন্মোচিত হয়েছে। যে-ক্যাপ্টেন আনোয়ার মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও ভারতকেই তার হৃদয়ভূমি হিসেবে জানত, শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার কারণে, তার সব যোগ্যতা সত্ত্বেও তাকে ডিঙিয়ে একদিন প্রমোশন দেওয়া হয়েছে একজন জুনিয়র অযোগ্য প্রার্থীকে। ভারতে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল নয়, এমন একটা বাস্তবতা উপলব্ধি করে তারা পাকিস্তানে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সেটা যে মরণকুন্ড তা কি একবারও ভেবেছিলেন দুজনের একজন। হ্যাঁ, ভেবেছিলেন বা টের পেয়েছিলেন সুস্মিতা আনোয়ার। এক  নাগা-সন্ন্যাসী আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন যে, ওখানে মৃত্যু অপেক্ষা করছে। পিআইএতে চাকরি নিয়ে করাচিতে চলে গেলেন ক্যাপ্টেন আনোয়ার। আর সুস্মিতা আনোয়াররা বসবাস করতে লাগলেন ঢাকার শান্তিনগরে। কিন্তু প্রিয় স্বদেশভূমি ছেড়ে স্বীয় আত্মীয়স্বজন ফেলে ক্যাপ্টেন আনোয়ার পারলেন না স্বস্তিতে থাকতে, পারলেন না পাকিস্তানকে মন থেকে মেনে নিতে। তারপর ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এর পরের ১৪ আগস্ট করাচিতে প্লেনক্র্যাশে নিহত হলেন ক্যাপ্টেন আনোয়ার আর পুরো জীবনেরই বাঁক বদলে গেল সুস্মিতা ইসলামের।

জীবনের এই নতুন পর্ব থেকেই তাঁর চরিত্রের নিঃসঙ্গতা পরিবৃত যেমন শোকাবহ জীবনের ছবি পাই, তেমনি দৃঢ়তা অনমনীয়তা এবং আত্মসম্মান নিয়ে জীবনকে উতরে যাওয়ার সংগ্রামী প্রতিচ্ছবিও পাই। যা অনুকরণীয় তো বটেই, দৃষ্টান্তযোগ্যও। তিনি আবার কীভাবে লেখাপড়া করলেন, ডিগ্রি অর্জন করলেন, রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে যোগদান করলেন এবং সেখান থেকে পরে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরিতে। উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকা গেলেন – সবই একেকটি গভীর গল্প। আপন কর্তব্যকর্মের পাশাপাশি কীভাবে সযত্নে বুকের গভীরে আগলে আপন দুই সস্তানকে মানুষ করেছেন – সেসব শুধু দিন যাপনের কাহিনি নয়, পাঠকের জন্য প্রেরণারও। কিন্তু ব্যক্তি মানুষ হিসেবে যে তাঁর একটি নিজেরও আলাদা সত্তা আছে, সেখানে কি তিনি এমনই স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন? থাকতে পেরেছেন? সম্ভব সেটা? না সম্ভব নয়, ঘরের অন্ধকারে নিজের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে, সামলাতে হয়েছে নিজের চোখের জল, কিছুই গোপন করেননি, লুকোননি, কীভাবে সুস্মিতা আনোয়ার থেকে সুস্মিতা ইসলাম হয়ে উঠলেন, অকপটে বলেছেন সেই এলিজিও। তাই এটি শুধু আত্মজীবনী নয়, নয় উপন্যাসের উপাদান, আবারো পুনরাবৃত্তি করতে হয় কথাটা, মহাকাব্যিক আস্বাদন।

আমার দিনগুলির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, সুখ ও দুঃখের ভেলায় চেপে তিনি যে-সময়টাকে অতিক্রম করেছেন, তাকেও বিশ্বস্তভাবে রূপায়ণ করতে পেরেছেন। দাঙ্গাবিধ্বস্ত কলকাতায় তাদের হিন্দুপাড়ায় যেমন ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ারের থাকাটা ঠিক নয়, তেমনি ক্যাপ্টেন আনোয়ারের বাড়িতেও একই পরিস্থিতিতে বাইরের বারান্দায় সুস্মিতা ইসলাম এলেই রাগ করতেন ক্যাপ্টেন আনোয়ার, বাইরের মুসলমান মিছিলের লোকরা বুঝি সুস্মিতা ইসলামকে দেখে ফেলে! এভাবেই সময় আসে, ইতিহাস আসে ধারাবাহিকভাবেই, আসে একাত্তরের ভয়াল দিনগুলো, সেই বিভীষিকাময় সময়ে একা মেয়েকে নিয়ে তিনি ঢাকায় জীবনযাপন করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবন থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন জগন্নাথ হলের হত্যাযজ্ঞ, ট্রাকবোঝাই করে বধ্যভূমিতে হাজার হাজার লোককে ধরে নিয়ে যেতে দেখেছেন, নিজেও সম্মুখীন হয়েছেন পাক টিকটিকিদের, জীবন বিপন্নতায় কেটেছে প্রতি মুহূর্তে, সেই অগ্নিগর্ভ সময়েই মেয়েকে নিয়ে করাচি বিমানবন্দর হয়ে আমেরিকা যাওয়ার বর্ণনাটা সত্যিই রুদ্ধশ্বাসময়। আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর স্বাধীন বাংলাদেশে এসেও আহত হয়েছে তার সত্তা – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চোখের সামনে ভাইস চ্যান্সেলরকে অপমানিত হতে দেখে! আন্দোলনের নামে ছাত্র নামধারীদের নৈরাজ্য অথবা স্বাধীনতার মূল্যবোধ দ্রুত হারানোর ফলে সৃষ্ট দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন তিনিও,            পাকিস্তানিদের কাছে নয় এদেশের মানুষের কাছেই হারিয়েছেন সাভারের প্রিয় এক টুকরো জমি! তবু হাহাকার নয়, যন্ত্রণা নয় – শেষাবধি জীবন আর জীবনের আনন্দই তার কাছে ধরা পড়েছে অতি আদরে!

জীবনযন্ত্রণার দাবদাহের ভেতরেও – শেষ পর্যন্ত তিনি পরম জীবনপ্রেমিক! ক্ষণমুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়েছেন ঠিকই; কিন্তু মহাকালের আমন্ত্রণে ঠিকই আপন হাতে চাষ করেছেন গোলাপ, ফুরসত পেলেই ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রকৃতির অনিন্দ্যলোকে – ইউরোপ থেকে আমেরিকা, সারা পৃথিবী, নিজের হাতে প্রতি প্রভাতে আজো জলসিঞ্চন করে চলেন গাছের। তাই                এ-বইটি শুধু তার দিনগুলির বর্ণনা নয়, জীবনের জন্য একটুকু আগুনের পরশমণি, যার ছোঁয়া অনিবার্যভাবেই পাঠকের বোধকে ঈষৎ হলেও নাড়িয়ে দেবে। বোধেও হয়তো জাগিয়ে দেবে অনুরণন – আমি ভালোই আছি!