নিজের মতামতে অনড় একজন নিভৃতচারী

স্ট্যানলি টাইগারম্যান

১৯৬০-এর সেপ্টেম্বর, আমি ক্লান্ত। বিগত শিক্ষাবছর (ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার স্নাতক থিসিসের বছর) আমাকে কাঁদিয়েছে। আসলে মাস্টার্স প্রোগ্রাম আবারো একইভাবে চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। ক্লাসে নতুনদের আগমন নিশ্চিত করল যে, বছরটি ভালো যাবে না। অধিকাংশই, যাঁদের আমি বলতে পারি ‘শ্রেষ্ঠ ফসল’, তাঁরা কেউই সেরকম নন। তখন ব্রিটিশ টুইডের স্যুটপরিহিত এক ভদ্রজনের সাক্ষাৎ পেলাম, এবং তখনই মনে হলো, আমি একজন বন্ধু পেয়েছি – সম্ভবত আত্মার এক আত্মীয়। তিনি হলেন মাজহারুল ইসলাম। এই নিভৃতচারী, আত্মসংযমী বাঙালি ভদ্রলোকটি ক্লাসের মধ্যে স্বভাবতই সবচেয়ে পরিণত এবং সবার চেয়ে বয়স্ক ছিলেন। দৃশ্যত, আমরা কেউ কোনো সংকটে পড়লে তিনি দ্রুতই আমাদের ক্ষুদ্র দলের ‘প্রাজ্ঞজন’ হয়ে উঠতেন।
তাঁর জীবনের ওই সময়টায় তিনি (মাজহার) ‘লা কর্বুসিয়েরে’র অনুগ্রহলাভে তৎপর ছিলেন। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো তিনি ছিলেন সতীর্থদের মধ্যে জনপ্রিয় একজন মানুষ। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের পর থেকেই আমি সবসময় তাঁর মনস্তত্ত্বের এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি নিয়ে ভাবতাম যে, বাঙালিরা যে-অবস্থায় বসবাস করে তার প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু করাই হচ্ছে তাঁর কাছে স্থাপত্য। স্থাপত্য কখনই ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ হিসেবে মাজহারুল ইসলামের কাছে বিবেচিত হয়নি। বরং তাঁর নিজের মানুষদের আরো ভালো জীবন দিতে একটি সর্বাত্মক নির্মাণকৌশল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
আমাদের গ্র্যাজুয়েশনের পরও তিনি ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়েই এগিয়ে চললেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফেরার আগে কিছু সময়ের জন্য তিনি শিকাগোয় ছিলেন। পূর্ববঙ্গের স্থাপত্যের জনক হিসেবে তিনি যখন বিবেচিত হচ্ছেন (ওই সময় তিনি সরকারের প্রধান স্থপতি), তখন তিনি (ষাটের দশকের প্রথমদিকে) ‘গ্রেট ডায়ালগে’র (লাহোরে আইয়ুব খানের সঙ্গে শেখ মুজিব ও অন্য রাজনীতিকদের গোলটেবিল বৈঠক, যেখানে প্রথম ছয় দফা উত্থাপিত হয়) সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, যা দুই পাকিস্তানের পৃথকীকরণের সূচনা হিসেবে বিবেচিত হয়। তাঁর বড় কীর্তি (কিছু বাস্তব বিবেচনায় তাঁর ‘বোঝা’ও বটে) হচ্ছে, তিনি বাস্তব জীবন থেকে স্থাপত্যকে আলাদা করে দেখতেন না।
১৯৬০-এর দশকের মধ্যভাগে বিশ্বব্যাংকের (আইবিআরডি) একটি প্রকল্পে কাজ করার মধ্য দিয়ে আমাদের দুজনের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের সরকার ও আইবিআরডি প্রযুক্তিগত শিক্ষা বিস্তারের একটি কর্মসূচি হাতে নেয়। ফলে বরিশাল, বগুড়া, পাবনা, রংপুর ও সিলেটে পাঁচটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা হয়। পাট, প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল ও অন্যান্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব সরবরাহ করত এসব ইনস্টিটিউট। মাজহারুল ইসলামের সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যাংকটি আমাদের দুজনকে নিয়োগ দেয় এবং ১৯৬৪ সালে আমরা যৌথভাবে কাজ শুরু করি।
যুক্তরাষ্ট্রের সুপরিচিত স্থপতি পল রুডলফ (মাজহারুল ইসলাম ও আমার শিক্ষক, ইয়েলের আর্কিটেকচার স্কুলের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সদ্য পদত্যাগকারী) ও আমি ঢাকায় আমাদের পৃথক প্রকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা করতে এলাম (মাজহারুল ইসলাম ময়মনসিংহে এক কৃষি স্কুলের নকশায় অতিরিক্ত পরিকল্পনা যোগ করার সুপারিশ করলেন  রুডলফের কাছে)। লুই আই কান সে-সময় পাকিস্তানের ‘দ্বিতীয় রাজধানী’ নিয়ে কাজ করছিলেন (কানের এ-কাজটিরও সুপারিশ করেছিলেন মাজহারুল ইসলাম)। আমি যে-বার্তাটি দিতে চাচ্ছি তা হচ্ছে, মাজহারুল ইসলাম তাঁর জনগণকে ‘ভালো’ স্থাপত্য দেওয়ার জন্য কীভাবে চেষ্টা করতেন, যাকে বলা যায় তাঁর জানা প্রতিটি উপায়ই তিনি অবলম্বন করেছেন। মাজহারুল ইসলামের উদ্দেশ্য ছিল পূর্বাপর সঙ্গতিপূর্ণ। এখানে যে-বিষয়টি মজার, তা হলো, আমি পুরোপুরি নিশ্চিত যে, তাঁর সেসব প্রচেষ্টার কখনই প্রশংসা করা হয়নি।
অবশ্যই মাজহারুল ইসলামের আরো একটি দিক ছিল। তিনি কখনো মূঢ়দের সঙ্গ খুব ভালোভাবে মেনে নেননি।  আবার তাঁর ব্যক্তিত্বকে দমন করেও রাখেননি। তাঁর এ-বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি যাঁদের সমালোচনা করতেন, তাঁদের কাছে তিনি কখনো প্রিয় হতে পারেননি। তবু তাঁর উদ্দেশ্য সবসময় (তাঁর দৃষ্টিতে) নিজের জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থসিদ্ধির মধ্যেই নিহিত ছিল।
তিনি ও আমি পলিটেকনিক প্রকল্প নিয়ে ১০ বছর কাজ করেছি Ñ প্রথমত সমন্বিত বৃহৎ পরিকল্পনা (মাস্টারপ্ল্যান), তারপর এবং কেবল তারপর একে একে প্ল্যানভুক্ত ভবনগুলো নিয়ে। প্রয়োজনীয় কারণেই আমি বারবার (পূর্ব পাকিস্তানে) ফিরে ফিরে আসি, যা আমাকে (তখনকার) রাজনীতির সংস্পর্শে নিয়ে আসে – সেসব দিনের রাজনীতির আদর্শগত ইস্যু এবং কোনো কোনো ঘটনা আমাদের দুজনকেই (এবং স্বভাবতই, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোকেও) শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার জন্য বাঙালির যে-সংগ্রাম সে-সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলে।
ওই সময়টায় রাতে মাজহারুল ইসলামের কার্যালয়ের বারান্দা সরগরম থাকত। ভিন্নমতাবলম্বী যুবকরা আসতেন তাঁর কাছে পরামর্শ নিতে (এবং মাঝে মাঝে সম্মতি চাইতে)। এমনকি তাঁর মতামত প্রতিহত করারও চেষ্টা হতো (তিনি এমন একজন ছিলেন, যিনি কখনো রাজনৈতিক পুঁজি অহেতুক ব্যয় করতেন না)। ইতোমধ্যে ঢাকায় স্থাপত্যবিদ্যার স্কুল স্থাপনের কাজ চলছিল, এবং এ-বিষয়ে তাঁর মতামত লক্ষণীয়ভাবেই চাওয়া হতো না। তাঁর আদর্শিক অবস্থান যেহেতু পরিষ্কার, সে-কারণেও সে-সময়কার পেশাজীবী ও শিক্ষিত সমাজ স্থাপত্য নিয়ে তাঁর মতামত বাতিল করে দিত।
আমি স্বীকার করি, এশীয় উপমহাদেশ সবসময়ই রাজনীতির উত্তপ্ত ক্ষেত্র। এখনো মাজহারুল ইসলামের জীবন ও পেশার (ক্যারিয়ার) অনেক কিছু তাঁর নিজ জগতে দুঃখজনকভাবে অজ্ঞাত রয়েছে; কিন্তু তিনি যে কতটা রহস্যময় রয়ে গেছেন, তা ভেবে আমি অবাক হই। সম্ভবত জয়নাব ফারুকী আলী ও ফুয়াদ হাসান মল্লিকের বইটি তাঁর সম্পর্কে মানুষের মধ্যে নতুন করে আগ্রহ জাগিয়ে তুলবে এবং জানাবে যে, তাঁর পেশাগত জীবন ও দেশের উন্নয়নকে সমান্তরালভাবে দেখেছেন।
স্থপতি মাজহারুল ইসলামের আট দশকের জীবনে (!) তাঁর স্থাপত্যশিল্পকে উৎসর্গ করা দীর্ঘ প্রত্যাশিত এ-প্রকাশনায় ক্ষুদ্র অবদান রাখতে পেরে আমি খুবই খুশি। আমি আশা করি, বইটি তাঁর প্রতি মানুষের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে তুলবে। কেননা, বইটিতে তাঁর ভাবাদর্শগত চেতনা উঠে আসবে, একজন ‘পূর্ণ ব্যক্তি’ হিসেবে এটি তাঁর গুণাবলির পুনর্জন্ম, যা সন্দেহাতীতভাবে তাঁকে সঠিকভাবে পাঠকের কাছে তুলে ধরবে।